রাজবধূ পর্ব ৬৩
রেহানা পুতুল
শিখা নিজের সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। দাঁতে দাঁত পিষে উচ্চারণ করে,
” ওই খোদার নামে কসম খেয়ে বলছি এই পরিবারের যেই হোক না কেন,তার শাস্তি অবধারিত। নিরপরাধ জীবন্ত মানুষকে পুঁতে ফেলার গুরুতর অপরাধের জন্য, নির্মম শাস্তি আমি তাদের নিজ দায়িত্বে দিবো। নিজ দায়িত্বে!”
শিখা উঠে চলে যায়। সে ঠিক করলো এই ভিতরে বাদশা থেকে আজগর আলীর গুম ও হ*ত্যাকারীদের নাম জানতে চাইবে না। নাম জেনে গেলে নিজেকে কন্ট্রোল করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাদের শাস্তি দিতে হলে প্রস্তুতির প্রয়োজন। সেসব নিয়ে বহুসময় ধরে চিন্তা করতে হবে। ফন্দী আঁটতে হবে সুকৌশলে চতুরতার সঙ্গে। অনেক সময় সাপেক্ষ। এতসব কিছু করার মতো ফুরসত শিখার হাতে একদম নেই। তার একমাত্র লক্ষ্য এখন মনোযোগের সহিত পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া। কাঙ্ক্ষিত ভালো ফলাফল করা।
বাদশা আর ফুল আসাতে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। তালুকদারও এখন নিশ্চিন্তে থাকতে পারে বেশি। বাদশা আগের মতো সবকিছু তদারকি শুরু করেছে। ফুলও মতির মায়ের সঙ্গে আগের মতই মিলেমিশে গৃহস্থালি কাজকর্ম সামলে নিচ্ছে। ঘরের সবাই শিখার সঙ্গে তুলনামূলক সদ্ব্যবহার করছে।
শীতকে সঙ্গী করেই ইংরেজি নতুন বর্ষ শুরু হলো। সাল উনিশশো তিরানব্বই। শিখার প্রাইভেট পড়ার চাপও অধিক হলো। এই বিষয় ওই বিষয় নিয়ে পড়তে হচ্ছে। নোট করতে হচ্ছে। স্যারদের সাহায্য লাগছে নোট করা নিয়ে। ভালো ছাত্রী বলে শিক্ষকগণও শিখাকে ফিরিয়ে দেয় না। যখন যা প্রয়োজন বুঝিতে দিচ্ছে। দেখিয়ে দিচ্ছে।
একদিন সকালে কলেজে যাওয়ার সময় মনসুরদের বাড়ি গেলো শিখা। তাদের সালাম দিয়ে বলল,
“আপনাদের থেকে কেনা জমিটা আমার শ্বশুরের নামে। উনি ফিরিয়ে দিবে উপযুক্ত প্রমাণ পেলে। আপনারা শান্ত থাকুন। সামনের বছরে নতুন ধানের ফসল আপনারা ঘরে তুলতে পারবেন।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
তারা আলহামদুলিল্লাহ বলে শিখার দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালো। শিখা বলল,
“তবে যত টাকা আপনাদের দেওয়া হয়েছে সেই টাকা ফেরত দিতে হবে আপনাদের। কত টাকা যেন দলিলে উল্লেখ আছে?”
মনসুর বলল,
“আরেহ মা,এইখানেও জালিয়াতি করছে হারামি ছোট তালুকদার। দলিলে উল্লেখ আছে এক লক্ষ টাকা। কিন্তু আসলে আব্বারে দিছে পঞ্চাশ হাজার টাকা। আমার বাপে যে কই হারাইলো। থাকলে আইজ বড় কাজে লাগতো।”
শুনে ঘরের অন্যরাও মনসুরের কথায় সম্মতি জ্ঞাপন করলো। শিখার মনটা আক্ষেপে ভরে গেলো। তার খুব ইচ্ছে করছে আজগরের নিখোঁজ রহস্য তার পরিবারকে জানিয়ে দিতে। এতে তাদের প্রত্যেকের দীর্ঘ বছরের অপেক্ষার অবসান হবে। কিন্তু বলল না। হীতে বিপরীত হবে। তারা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। দলবলসহ লাঠিসোটা নিয়ে তালুকদার বাড়ি হামলা করবে। তাদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার পর শিখা সব বুঝিয়ে বলবে তাদের। এই ভিতরে তার আই.এ ফাইনালটাও হয়ে যাবে।
শিখা বলল,
“তাহলে পঞ্চাশ হাজার টাকা যোগাড় করতে থাকেন। বাকিটা আমি দেখবো।”
তারপর শিখা কলেজে চলে যায়। কলেজের একজন গার্ড শিখার হাতে একটা খামবন্দী চিঠি দিলো। রাজ বাড়ির ঠিকানায় চিঠি না লিখে কলেজের ঠিকানায় চিঠি লিখলো শিখার কাছে। বাড়ির ঠিকানায় দিলে যদি শিখার হাতে না পৌঁছায়। সেই আশংকা থেকে বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করেছে সে। শিখার তর সইছে না। কলেজের ওয়াশরুমে গিয়ে হলুদ খামটি ছিঁড়ে নিলো। এক পাতার চিঠি। লেটার প্যাডটিও শৈল্পিক! সবুজ,হলুদ রঙের মিশেলে চিঠির পুরো পাতাজুড়ে লাভ আর লাভ চিহ্ন অংকিত। ঝাপসামতো রয়েছে হাত হাতে রাখা দুজন যুবক যুবতীর ছবি। শিখার অধরকোণ প্রশস্ত হলো। ভোরের সূর্যের ন্যায় উদ্ভাসিত হলো একটুকরো ঝলমলে দুষ্টমিষ্ট হাসি।
“রঙিন প্রজাপতি কেমন আছো? আমি ভালো নেই। রাত বাড়লেই তোমাকে বুকের ওমে পেতে ইচ্ছে করে। আরো কত কি যে করতে ইচ্ছে করে প্রেমিক হৃদয়ে। পানি ছাড়া মাছ যেমন, তুমি ছাড়া আমি তেমন। আমার যত শূন্যতা তোমার জন্য। আমার যত পূর্ণতা তোমায় ঘিরে। তুমি মানা করেছো বলে আসতে পারছি না। হৃদয়ের সুখ পাখিরা কেবল বিরহের গান শোনায় আমাকে। জানি তোমার উপর দিয়ে অনেক ঘাত প্রতিঘাত গিয়েছে। হয়তো আরো যাবে। আমি আমার স্থানে যথাসম্ভব যা করার করেছি এবং করবো তোমাকে ভালো রাখার জন্য।
আমার মৌনাকাশে তুমি এক উজ্জ্বল শুকতারা। জ্বলছো অহর্নিশ! ভৎসনা করে নাকি ভালোবাসায় এই পথিকের জীবনে জড়িয়ে আছো, এই প্রশ্ন মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি দেয় মনের আরশিতে। মেডিসিন নিয়ম করে খাচ্ছো তো? পড়াশোনার বিষয় নতুন করে কি আর বলবো? তুমি নিজেই মহা সিরিয়াস সেদিকে। এতে আমি আনন্দিত। কারণ তুমি ব্যতিক্রম! সাধারণত আমাদের বাংলাদেশের অনেক মেয়েরাই সচ্ছল পরিবারে বিয়ে হলে আর পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চায় না বা করেও না। সেইক্ষেত্রে তুমি আমার কাছে নমস্য!
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি প্রিয়া, প্রতিবছর কড়া শীতে আমি গ্রামে যাই। মা,চাচী,ভাবিরা শীতের নানারকম পিঠাপুলি তৈরি করে। কিন্তু ঘটনাক্রমে বিয়ের পর গত দুই বছর তা হয়নি। সব কেমন ফিকে হয়ে গিয়েছে। তো জুবায়ের আমাকে গতকাল টেলিফোন করলো। একান্ত অনুরোধ করে বলল, এই শীতে যেন অবশ্যই বাড়ি যাই। বড় ভাইয়াদেরকেও নাকি সে অনুরোধ করে বলেছে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। ঘরের পরিবেশ এখন আর আগের মতো উগ্র নেই। নেই কারো মাঝে দাম্ভিকতা। বাবার শরীরটাও ভালো না। সবাই মিলে পিঠা,পায়েস খাওয়া হবে। আমি তাকে কথা দেইনি। তুমি না চাইলে আমি আসবো না। তোমার সম্মতির অপেক্ষায়,
তোমার রাজ।”
শিখা কন্ঠে মধু ঢেলে আপন মনে বললো,
ইসস! কি আদিখ্যেতার কথা। ভৎসনা নাকি প্রেম? শোন হে রাজ বাবু,ভুলভাল কিছু দেখলে এই অগ্নিশিখা, না ভৎসনা করবে না তোমায় ভালোবাসবে। আবার ঘৃণাও করবো না কিন্তু।
রাজের নামের উপরে শিখা আলতো করে অধর ছোঁয়ালো। চলে গেলো ক্লাসে।
বাড়িতে গিয়ে সন্ধ্যার পর শিখা জুবায়েরের রুমে গেলো। জুবায়ের কাগজ কলমে কি যেন লিখছে কাটাঁছিড়া করে। ক্যাসেট প্লেয়ারে লো ভলিউমে বেজে চলছে শিহরণ জাগানো একটি ভালোবাসার গান।
‘মাতাল করা হাওয়া এই স্বপ্নীল জোছনায়,মনে মনে কত ছবি দোলা দিয়ে যায়.. ‘
১৯৯১ সালের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘অরকিজ’ এর ‘পলাশ জয়ে’র কণ্ঠে গাওয়া গানটি অসম্ভব সুন্দর। শিখা অনুমতি ছাড়াই রুমে প্রবেশ করলো। খুক করে কাশি দিলো জুবায়েরের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। জুবায়ের ক্যাসেট বন্ধ করে দিলো।
“বন্ধ করলেন কেন? গান, সুর আমার অসম্ভব প্রিয়। আমি যদি মোটামুটিও গাইতেও পারতাম, তাহলে জীবনে আর কোন সাধ থাকতো না। সারাদিন গান গেয়ে বেড়াতাম।”
জুবায়ের একটুখানি স্থির চোখে তাকালো শিখার মুখপানে। বলল,
” বন্ধ না করলে তোমার কথা ভালো করে শুনবো না। বলো শিখা? কি করতে পারি তোমার জন্য?”
“বলছি। তার আগে বলেন আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকেন কেন?”
শিখার আদুরে কণ্ঠের বদলে রুষ্ট কণ্ঠ শুনে জুবায়ের বিষম খেলো।
” হঠাৎ একথা? কারো সামনেতো ডাকিনা শিখা। যখন কেবল তুমি একা থাকো তখন ডাকি।”
“তখন কেন ডাকেন?”
“রাজ আর আমি সমবয়সী। তাই ডাকি।”
হতভম্ব গলায় বলল জুবায়ের।
“আমি রাজের বউ। আপনার নয়। আর কখনো নাম ধরে ডাকবেন না আমাকে।”
জুবায়েরের চোখ দুটো আরক্ত হয়ে উঠলো শিখার কাটকাট কথা শুনে।
“মনে থাকবে। এবার বলে ফেলুন।”
“আহ হা! আপনি বলে ত বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিলেন। আপনি আমার বেশ সিনিয়র। শুরু থেকেই আপনার মুখে তুমি ডাক শুনেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তুমিই বলবেন। আম্মাকেও আমার চাচারা ভাবি তুমি, বলে কথা বলে। এতে না এতটুকু শ্রদ্ধা কমে। না ভালোবাসা কমে যায়। বুঝলেন?”
“বুঝিয়েছো। তাই বুঝলাম। বলো কেন এলে?”
“উনি চিঠি দিয়েছে। আমি ব্যস্ততার জন্য উত্তর দিতে পারছি না। আপনি আমার হয়ে উনাকে টেলিফোন করবেন। বলবেন, শীতে যেন বাড়ি আসে।”
“তুমিই বলে দিও আমার দোকান গিয়ে ফোন করে। আমি কাল তোমাকে কলেজ থেকে বাইকে করে তোমাকে নিয়ে আসি?”
“নাহ। তার দরকার নেই। আপনি বললেই হবে।”
শিখা বেরিয়ে যায় রুম হতে। জুবায়ের চোখ বন্ধ করে শিখার সান্নিধ্য উপভোগ করলও ক্লান্ত,অবিশ্রান্ত,তৃষিত পথিকের ন্যায়।
পরের সপ্তাহে রাজ এলো। সারারাত কাটালো কম্বলের নিচে শিখাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রেখে। মন ভরে ঘুমালো শিখার সংস্পর্শে থেকে। যেন বহুদিনের ঘুম কাতুরে সে।
তার বাকি দুই ভাইও এলো প্রতিবছরের মতো। শিখাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেলো। তাই সেইসবের জন্য ঘরের সবার মন বিষন্ন!তিক্ত! তবে উপরে উপরে সবাই শান্ত থাকছে। কিন্তু সুফিয়ার অন্তরখানি এখনো বিতৃষ্ণায় ভরে আছে শিখাকে নিয়ে।
কুয়াশাজড়ানো হিম ভোর। রুক্ষ প্রকৃতিও শীতে জুবুথুবু হয়ে আছে মানুষের মতো। দেখা মিলছে না সারাবাড়ি মাতিয়ে রাখা ভোরের পাখিগুলোকেও। মতির মা মাটির চুলায় বড় একটি হাঁড়ি বসিয়ে দিলো রস ঢেলে। ঊষাকালেই গাছ থেকে পাড়া দুই হাঁড়ি খেজুরের রস এনে দিলো তাদের চেনা গাছি কিসমত। গতকাল বাদশা তাকে বলে রেখেছে তালুকদারের কথা বলে। বেতের ঝাঁঝরিতে আধাসের ‘কাউন’ চাল ধুয়ে রাখা হলো পানি ঝরিয়ে যাওয়ার জন্য। রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে কমিয়ে আনা হচ্ছে। তাজা খেজুরের রসের সুঘ্রাণে রসুই ঘরের চারপাশ ম ম করছে। সেই ঘ্রাণে দুই একটা বিড়াল রোয়াকে উঠে ঘুরঘুর করছে।
এদিকে শীতবস্র পরিধান করে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে এলো। উঠানের একপাশে স্তুপ করে রাখা শুকনো পাতা ও খড়ের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দিলো বরকত। আগুন জ্বলে উঠলো দাউদাউ করে। সবাই কুণ্ডলী পাকিয়ে জ্বলতে থাকা আগুনকে ঘিরে দাঁড়ালো বৃত্তাকারের মতো। আগুন পোহানো হচ্ছে উৎসব করে। জুবায়েরও এলো চোখ ঢলতে ঢলতে। ফুল আগুনের দিকে দু-হাত মেলে ধরে তাতিয়ে নিচ্ছে। সেই তাতানো দু’হাত নিজের দু’গালে চেপে ধরে উষ্ণতা দিচ্ছে।
ছড়া কাটার মতো করে বলছে,
‘শীত মিত ভাই /আমার কাঁথা কাপড় নাই
শীতেরে কইয়ো গিয়ে আগুন আমার ভাই।’
তা শুনে আদুরী কিঞ্চিৎ হেসে বলল,
“বাদশা ভাই, আপনার ফুল বলে কি? ওরে কাঁথাকাপড় দেন না?”
সবাই হেসে উঠলো। সুমনা বলল,
“ছোট ভাইয়া ও শিখা কই? এখনো ঘুমায় নাকি?”
জুবায়ের দোতলার দিকে চাইলো গলা উঁচিয়ে। দেখলো শিখা নেমে আসছে। পরনে অন্য শাড়ি। ভেজাচুলগুলো সারা পিঠময় ছড়িয়ে আছে। শিখা নেমে এসে আগুন পোহাতে লাগলো। ডলি মুচকি হেসে টিপ্পনী কেটে বলল,
“সবাই সইরা যাও। যার এখন শীত বেশী, তারে আগুন পোহাইতে দাও।”
শিখা লজ্জা লজ্জা মুখে ডলির দিকে তাকালো। চাপা হেসে চোখের পাতা নামিয়ে নিলো। জুবায়ের আড়চোখে শিখাকে দেখছে। একটু পর রাজ নেমে এলো হাই দিতে দিতে। ট্রাউজারের দুই পকেটে হাত গুঁজে জুবায়েরের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো।
“উঠলি কেন? তোরা দু’জন আরো ঘুমা।”
বাঁকা স্বরে বলল জুবায়ের।
” জ্বলে খুব?জেলাস? বুঝি না? নাহ? শালা ফকির আর কত নজর দিবি?”
জুবায়েরের পেটে আলতো ঘুষি মেরে বলল রাজ।
“হ জেলাস! অন্নেক বেশী! নজরে নজরে তোদের ছারখার করে দিবো। কি করবি তুই?”
হেসে জবাব দিলো জুবায়ের।
কাউন চাল দিয়ে খেজুরের রসের ক্ষীর তৈরী হয়ে গিয়েছে। কাঁচের নাস্তার পিরিচে বেড়ে নেওয়া হলো একে একে। কেউ ডাইনিংয়ে বসে খেলনা। রসুই ঘরের সামনে দাওয়ায় ও উঠানে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো। কেউ চেয়ারে,কেউ মোড়ায়,কেউ জলচৌকিতে,কেউ লম্বা টুলটায়, কেউ পিঁড়িতে,কেউ পাটিতে।
রাজ তার বাবাকে বলল,
“বাবা, মজা হয়েছে না?”
“হ। ম্যালা স্বাদ। তোর চাচীর হাতের খেজুরের রসের ক্ষীর সবসময় খুব ভালো হয়।”
জুবায়ের বলল,
“আমার মায়ের হাতের খাবার মানেই অমৃত! তাইনা মা?”
আমেনা মিটমিটিয়ে হাসলো। বলল,
“হ কইছে তোরে। মুড়ি নিবি? আমগো ক্ষেতের চাইলের ভাজা মুড়ি। দেখ,তোর বড় মা,বড় ভাবি মুড়ি মিশায়া খাইতাছে। আমিও খাই একটু মুড়ি দিয়া।”
“নাহ। আপনি খান মুড়ি দিয়ে।”
“মুড়ি দিয়ে আমার কাছেও হেব্বি লাগে।”
বলল আদুরী।
“তাহলে তোর প্লেটে মুড়ির পুরো কৌটা ঢেলে দিই?”
থিতু গলায় বলল জুবায়ের।
“ধুর জুবা টুবা ভাই। সবসময় আপনি আমার সঙ্গে এমন করে কথা বলেন।”
রাজ মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
“আমার মা জননী দেখি নিজেই খাচ্ছে। অন্যদিকে মন নেই।”
“খাওনের কালে এতকথা কইতে নাই। খাওন হইলো ইবাদতের সমান। এক মনে এক দিলে খাইতে হয়। ছগর বগর না কইরা।”
বলল সুফিয়া বিবি।
রানী কোন কথা বলল না। প্রতিবেশীর মতো শান্তভাবে খেয়ে উঠে গেলো। সে এবং রাজ দেবর ভাবি কেউই কারো সঙ্গে কথা বলে না সেদিন হতেই।
এভাবে নানান খুনসুটি ও প্রীতিময় আমেজে রোজ কিছু না কিছু আয়োজন হয়ে থাকে তালুকদার পরিবারে। কোন সকালে ভাপা পিঠা,কোন সকালে দুধ চিতই,কোন সকালে ম্যারা পিঠা,কোন সকালে গরম গরম সবজি খিচুড়ি রান্না হলো।
এতসব দেখে তালুকদারের নয়নকোণ ভিজে উঠলো। বহুদিন পরে তার ঘরে আগের মতো আনন্দমুখর দিনগুলো ফিরে আসতে শুরু করলো। জুবায়েরও এটাই চেয়েছে। তাই রাজ,খালেদ,আসলামকে বাড়ি আনালো সে। তবে আসল কারণটা সে গোপনই রাখলো।
রাজ বাড়িতে থাকাবস্থায় আদুরীর বিয়ের জন্য প্রস্তাব এলো। সে জানিয়ে দিলো সবকিছু ঠিকঠাক হলে যেন তার অপেক্ষা না করে আদুরীর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।
এই কয়দিনে শিখা চুপিচুপি লক্ষ্য রেখেছে
রাজ,খালেদ,আসলাম,জুবায়ের কবর থাকা বাগানটার দিকে যায় কিনা। বা কোন শলা পরামর্শ তারা কেউ করে কিনা। দেখল, নাহ। কেউই গেল না সেদিকটায়।
রাজ চলে গেলো এক সপ্তাহ পরে। শিখার গালে,কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“চিঠি দিও। কেমন?”
রাজের বুকে আলুথালু হয়ে শিখা মুখ ঘষতে ঘষতে বলল,
“আপনার মতো লিখতে যে পারি না?”
“যেমন পারো, যা পারো। তবুও দিও। তোমার কাঁপা কাঁপা হাতের এলোমেলো অক্ষরগুলো আমার ভিতরে কতটা উম্মাদনা জাগায়,কতটা তোলপাড় করে, বুঝাতে পারব না। টেলিফোন করো। তোমার কিন্নরী কণ্ঠ শুনতে পেলে আমার হৃদয়ে ছন্দহিল্লোল শুরু হয়।”
“আচ্ছা দিবো। আল্লাহ হাফেজ!”
কোন এক নিদিষ্ট কারণে বাদশার বেজায় মন খারাপ হয়ে গেলো। সে কাউকে বলতে পারছে না বিষয়টা। গোপনে গুমরে মরছে প্রতিনিয়ত।
তারপর কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। সবার জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে। শীতও বিদায় নিলো। পাতা ঝরা নব বসন্তের আগমনী সুর বাজলো। এমন এক আগুন ঝরা ফাগুন বিকেলে শিখা ছাদে গেলো। কারো নিরব পদধ্বনি শুনতে পেলো সে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো জুবায়ের। খালি ছাদে জুবায়েরকে দেখে কিছুটা ভড়কে গেলো শিখা।
“কি জুবায়ের ভাই? আমি এলাম। আর আপনিও?”
“তুমি এলে বলেই ত আমি এলাম। তুমি না আমার ভালোবাসার গল্প শুনতে চেয়েছো?”
“হ্যাঁ চেয়েছি। বলেননি তো।”
“আজ বলবো। এখন বলবো। তুমি শুনবে?”
“ওরেহ! আপনার ছ্যাঁকা খাঁওয়া ব্যাঁকা হিস্টোরি শুনতে গেলে এখন আমার বারোটা নয় কেবল, তেরোটা বেজে যাবে। আমার ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হোক? তখন শুনি?”
খিলখিলিয়ে হেসে বলল শিখা।
রাজবধূ পর্ব ৬২
“নাহ। তুমি এখন শুনবে। তোমাকে শুনতে হবে। এরপর আর সময় নেই। আমার সময় শেষ প্রলয়শিখা।”
গলায় এক সমুদ্র বিষাদ ঢেলে গম্ভীর মুখে বলল জুবায়ের।