রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫২

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫২
রিক্তা ইসলাম মায়া

রাত ৩ঃ১৫। শেষ রাতের প্রহর ঘনিয়ে ভোর হতে চলল। সবেমাত্র বাসায় ঢুকলো রিদ। চারপাশে নিস্তব্ধ আর নিশ্চুপ পরিবেশ। এতো রাতে নিশ্চয়ই কেউ জেগে থাকবে না। রিদের পিছন পিছন আসিফও এসেছিল তবে সে নিচতলায় চলে গেল নিজের বরাদ্দকৃত রুমে ঘুমাতে। জসিমের ম্যাটার শেষ করতে করতে তাদের এতোটা সময় লেগেছে। আশা করা যায় আজকের পর জসিম বা তার লোকজন অন্তত রিদের বাবার পিছনে লাগবে না। ফ্ল্যাটের দরজা খোলে ভিতর থেকে লক করতে করতে আশেপাশে নিরব দৃষ্টিতে তাকাল রিদ। ড্রিম লাইটে আলোয় জনমানবহীন বসারঘরটা দেখে এগোল নিজের কক্ষের দিকে। চাপানো দরজা ঠেলে রুমে ঢুকতে চোখের পরলো খালিঘরটাকে। বুঝতে পারলো মায়া রিদের ঘরে ঘুমাইনি। রিদ কক্ষের আলো জ্বালিয়ে এগোল সামনে, হাতের চাবিটা ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখেই মায়ার সন্ধান করলো পুনরায় কক্ষ হতে বেরুতে বেরুতে।

পরপর দুই কক্ষে চেক করে তৃতীয় কক্ষ প্রবেশ করতেই মায়া দেখা মিলল সেখানে। এলোমেলো পা ফেলে বিছানায় শুয়ে মায়া। খোলা চুল বিছানা পেরিয়ে ফ্লোরে পরে। রিদ এগিয়ে এসেই ঘুমন্ত মায়াকে কোলে তুলে নিলো। অন্ধকারে সেভাবে এসেছিল ঠিক একই গতিতে পরপর পা ফেলে চলল নিজের কক্ষে। মায়াকে বিছানায় শুয়ে বেড সাইডের আলো জ্বালিয়ে মায়ার গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট জড়াল রিদ। ঠান্ডায় উষ্ণ আরাম পেতেই মায়া কাত হয়ে শুলো গায়ের ব্ল্যাঙ্কেটটা টেনে। রিদ কোমর ঝুঁকে মায়ার এলোমেলো খোলা চুল গোছাতে লাগল। মেয়েলি কাজের ধারণা তার নেই। তাই মায়ার সকল চুল এলোমেলো অবস্থায় দলাবটা করল পেঁচিয়ে, বালিশের উপর রেখে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বেখেয়ালি চোখ পরলো ঘুমন্ত মায়ার নিষ্পাপ মুখে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অল্প আলোয় কেমন জ্বলমল করছে মায়ার রুপ। রিদ কপাল কুঁচকে হাঁটু গেঁড়ে বসল মায়ার সম্মুখে। পরপর কপালে ভাজ ফেলে দৃষ্টি ঘুরাল মায়ার মুখে। এই মুখটা তাঁকে ভিষণ ডিস্টার্ব করে। অথচ এই মুখটার দিকে তাকালে সবাই বলবে এই নারী কতো নিষ্পাপ। সে কাউকে জ্বালাতেই পারে না। অথচ রিদ জানে এই নারী কতোটা ভয়ংকর। রিদের মতোন শক্ত পার্সোনালিটির মানুষকেও এই নারী বাধ্য করতে পারে। এইতো আজ যেমন বাধ্য হয়ে বউয়ের সামনে ঝুঁকে আছে এর থেকে বড় প্রমাণ কি হতে পারে? রিদের কুঁচকানো কপালের ভাজ সোজা করলো। মায়া গালে আসা চুল গুলো সরিয়ে দিতে চাইলে ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া পরলো মায়ার গালে। বরফের নেয় ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া পেতেই ঘুমন্ত মায়া নড়ে উঠল অল্প। রিদ নিজের ঠান্ডা হাতটা তবুও সরাল না মায়ার গাল থেকে বরং আক্রোশের নিজের কাজ করলো। মায়ার গালে আসা চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে দিতে নিজে ঠান্ডা হাতটা মায়ার গালে চেপে ধরলো। মায়া আবারও নড়ে উঠতে রিদের দৃষ্টিতে নমনীয়তা দেখা গেল। দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে রিদ বলল…

‘ আজকেও তুমি বেঁচে গেল বউ। তবে দিন আমারও আসবে। এই একই বিছানা তোমার রাত জাগার সাক্ষী হবে।
কথাটা বলেই রিদ নিজের উষ্ণ ঠোঁট ছুঁয়াল মায়ার গালে। শব্দ করে চুমু খেল পরপর একই জায়গায়। মায়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে মায়ার নাকে নাক, কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিশ্চুপ রইল রিদ। ধীরে বলল….
‘ আমার তুমি কখন আপন হয়ে গেলে বউ। তোমায় ছাড়া কিছু চলে না আমার। শূন্য আমি।

মায়া নাকে নাক ঘষে রিদ উঠে দাঁড়াল। কবাট থেকে টি-শার্ট আর তাউজার নিয়ে ঢুকলো ওয়াশরুমে। ঘুমন্ত মায়া ঘুমিয়ে থাকল। টের পেল না রিদের উপস্থিতির খবরটা। আর না শুনতে পারলো রিদের না বলা ভালোবাসাময় কথা গুলো। রিদের অব্যক্ত ভালোবাসার কথা গুলো আবারও মায়ার কাছে অপ্রকাশিত থাকল। মায়ার শুনা হলো না স্বামীর বলা ভালোবাসার কথা গুলো। রিদ সময় নিয়ে গোসল করে একেবারে বেরুলো। রাতে খাবার সে বাহির থেকে খেয়ে এসেছিল বলে দ্বিতীয়বার খাওয়ার প্রয়োজন পরলো না। রিদ হাতের টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে কফি মেকারে নিজের জন্য কফি বানালো। হাতের কফিতে চুমুক দিতে দিতে পিছন ঘুরে তাকাল ঘুমন্ত বউয়ের দিকে। ভেজা চুল আর ধোঁয়া উড়ানো কফির মগ যেন নিস্তব্ধ পরিবেশ মোহিত করছে। রিদ পিছনের শিলটে কোমর ঠেকিয়ে বামহাত গুঁজাল পকেটে।

ডানহাতের কফির মগে চুমুক বসাতে বসাতে ভাবল,বিয়ের পর এই প্রথম দুজন একত্রে বন্ধ দরজার ভিতরে রাত কাটাচ্ছে। অথচ তাঁর বউ ঘুমিয়ে। এই রাতটা সুন্দর হতে পারতো যদি তার বউ সঙ্গ দিতো। ঘুমন্ত বউকে জাগ্রত করতে আপাতত তার মন নারাজ। সেও খানিকটা ক্লান্ত। সারাদিন পর রাতটাও পার হলো ব্যস্ততায়। দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে আবারও বেরুতে হবে বাবার সঙ্গে। এমন আরও দুইটা দিন যাবে এখানে ব্যস্ততার মধ্যে। ঢাকা ফিরে যা করার করতে হবে ওদের বিয়ের ব্যাপারে। তবে যত যায় কিছু হোকনা কেন কোনো ভাবে সে বউকে আর হাত ছাড়া করবে না। রিদ যেখানে থাকবে তার বউ সেখানেই থাকবে। এতে দুই পরিবারের কারও কথা সে শুনবে না আর। বউ তার ডিসিশনও তারই হবে। তার শশুর বাড়ির মানুষ মানুক বা না মানুক। বিয়ে করার সময় যখন সম্মতি নেওয়া হয়নি বিয়ের পর বউকে তার সাথে রাখার জন্য অন্য কারও সম্মতি অন্তত রিদ খানের প্রয়োজন নেই।

দুই পরিবারের যদি কারও রিদের বিয়ের নিয়ে কোনো সমস্যা থাকে সেটাও রিদ শুনতে যাবে না। তবে পরিবারের সবাই যদি তাদের বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠানিকতা চাই তাহলে এতে রিদের কোনো সমস্যা নেই। করুক আয়োজন কিন্তু শর্ত একটাই তার বউ তার সাথেই থাকবে। খান বাড়ির বাহিরের রিদের বউ কোথাও যাবে না। এমনকি মায়ার নিজের বাড়িতেও না। মোট কথা পরিস্থিতি যায়ই হোক ভালো-মন্দ সকল পরিস্থিতিতে তার বউ তার পাশে চাই। অন্তত কারও জন্য সে তার বউকে নিজের থেকে দূরে করবে না। মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় রিদ পরপর কফির মগে চুমুক বসাল। অর্ধ খাওয়া মগটা কফি মেকারের পাশে রেখে বিছানার দিকে এগোল। মায়ার পাশে বিছানায় টানটান করে শুতে শুতে একই ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে ঢুকল রিদ। মায়া তখনো রিদের দিকে পিঠ করে কাত হয়ে শুয়ে। রিদ বিছানায় শুয়েই মায়ার বাহু চেপে নিজের কাছে টানল। উষ্ণতা আরাম পেয়ে মায়াও মিশে গেল রিদ বুকে মাঝে। রিদ দুজনের গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট জড়াতে জড়াতে মায়ার মাথায় শব্দ করে চুমু খেল। হাত বাড়িয়ে বেড সাইডের লাইট অফ করে দিতেই মূহুর্তে অন্ধকার ছুঁয়ে গেল কক্ষ জুড়ে। মায়া ঘন নিশ্বাস আর রিদের আলিঙ্গনের উষ্ণতা বয়ান করছেন ভালোবাসা সুন্দর। যদি সঠিক মানুষের সাথে হয়।

সকাল ৮ঃ৪৫। রিদের গাড়ি হতে মায়া জুই দুজনেই নামল কলেজের সম্মুখে। রিদ সঙ্গে আসেনি সে দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে আবারও ছুটেছে নিবার্চনের কাজে। তাই মায়া আর জুইকে ড্রাইভারই নামিয়ে দিয়ে গেল রিদের অপর গাড়িতে। জুই খুব সকালেই মায়ার জন্য জামা-কাপড় আর বই নিয়ে উপস্থিত ছিল ফ্ল্যাটে। মায়াকে রিদের রুম থেকে বেরুতে দেখে খুব ইতস্ততায় জড়িয়ে ছিল জুই। তারপরও মায়াকে এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলো না সে। বরং স্বাভাবিক নেয় মায়াকে নিয়ে রেডি হয়ে বেড়িয়ে আসল কলেজের উদ্দেশ্য। রিদের সঙ্গে জুইয়ের দেখা মিলেনি। তার আগেই রিদ বেড়িয়ে যাওয়াতে মায়াকেও সকালে লজ্জার সম্মুখীন হতে হয়নি। ইতস্ততার জুই মায়ার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে জড়তায় আস্তে করে বলল…

‘ গোসল করিস নি কেন?
মায়া কলেজে ঢুকেই আশেপাশে তাকিয়ে রাফার খোঁজ করলো। রাফার সাথে মায়ার কষাকষির হিসাব বাকি। রাফার জন্য মায়া কম বিপদে পড়েনি। বলতে গেলে সে এখনো বিপদের মুখে ঝুলে আছে শুধু মাত্র এই রাফার জন্য। আজ রাফাকে হাতের কাছে না পেলেই নয়। অন্যমনস্কর মায়া জুইয়ের মনোভাব বুঝতে পারলো না। আর না বুঝলো জুইয়ের বলা কথাটার মানে। বরং জুইয়ের কথায় মায়া মুখ কুঁচকে বলল…
‘ এতো সকালে গোসল কে করে? আমাকে দেখেছিস কখনো এতো সকালে গোসল করতে? যে আজ করব। শুধু উল্টাপাল্টা কথা বলিস।
মায়ার কথা জুইয়ের ইতস্ততা আরও বাড়ল। মায়াকে সরাসরি কিছু বলতে না পেরে আবারও ইঙ্গিতে বুঝিয়ে মিনমিন করে বলল…

‘ এখন-তো আলাদা বিষয় তাই না?
মায়া জুইয়ের কথার অর্থ না বুঝে আশেপাশে রাফার খোঁজে অনুসন্ধানে চোখ ঘুরিয়ে বলল…
‘ কিসের আলাদা বিষয়? দেখ জুই! বিষয় যায় হোক না কেন এই শীতের সকালে গোসল করার মতোন পাবলিক আমি না বুঝেছিস?
‘ গোসল না করে বেড়িয়েছিস যে ভাই কিছু বলবে না?
‘ সে আবার কি বলবে? আমি কি তার মতো নাকি? যে কথায় কথায় গোসল করবো? সে-তো রাত নেই, দিন নেই যখন তখন গোসল করে। রাতের তিনটা বাজেও উঠে গোসল করা পাবলিক। এসব মানুষের সাথে আমার তুলনা দিলি কেমনে?

মায়ার কথায় জুইয়ের ইতস্ততা বাড়ল। জুই মায়াকে আসলে কিভাবে গোসলের বিষয়টা বুঝাবে তা নিয়ে দ্বিধায় পড়লো। মূলত জুই সকালে মায়াকে রিদের রুম হতে বেরুতে দেখেছিল বলে এই মূহুর্তে সে সংকোচে আছে। মায়াকে গোসল করতে না দেখে সেটা দ্বিগুণ হলো। জুই মায়াকে পুনরায় বুঝাতে চেয়ে বলল…
‘ তারপরও রিতু! সবাই বলে মেয়েদের বিয়ে হলে নাকি গোসল করতে হয়।
মায়া বিরক্ত হয়ে বলল…
‘ আমার বিয়ের আড়াই বছর হয়েছে, এতোদিন দেখেছিস আমাকে গোসল করতে যে আজ করবো?
‘ তারপরও…
জুইয়ের কথায় ফোঁড়নকেটে মায়া বিরক্তি নিয়ে বলল…

‘ তারপরও কি জুই? তুই আজকে আমার গোসল নিয়ে পরেছিস কেন? তুই কি আমাকে চিনিস না? আজ নতুন দেখছিস আমাকে সকালে গোসল না করতে? এমন ভাব করছিস আজকে সকালে গোসল করাটা যেন আমার জন্য ফরজ ছিল। তুইও তো গোসল করিস নি তাহলে আমাকে বলছিস কেন?
‘ আমি আর তুই কি এক?
‘ অবশ্যই এক। এখন আয়। রাফাকে খোঁজ আগে। এই মাইয়ার আজ খবর আছে। ওর জন্য আমি এখনো বিপদের মুখে ঝুলে আছি। চল চল।
কথা গুলো বলতে বলতে মায়া তাড়াহুড়োর পা চালাল কলেজ পথে। আশেপাশে তাকিয়ে রাফার খোঁজ করেও সন্ধান মিলল না। শ্রেয়া,নাদিয়াও কলেজে নেই। মায়ার কলেজর গেইট পেরিয়ে মাঠে যাবে তখনই পিছন থেকে কেউ মায়ার কাঁধ জড়িয়ে ধরে উৎফুল্লতায় বলল…

‘ জানু এসেছিস! আই মিস ইউ।
রাফার কন্ঠ পেতেই মায়া ফুঁসে উঠল। কাঁধের উপর রাফার হাতটা খপ করে ধরে আক্রমণ করলো রাফার উপর। রাগে ফুঁসে উঠে সরাসরি মেসেজের কথাটা উল্লেখ্য করে মায়া চেতে
বলল…
‘ বেয়াদব মাইয়া মেসেজে কি পাঠিয়ে ছিলি উনাকে? আমার জামাই ছাড়া রাতে ঘুম আসে না, একা একা লাগে? সে বাসর বুঝে না? তার সিস্টেমে সমস্যা আছে এজন্য বউয়ের কাছে আসে না? কিসের লিংক পাঠিয়েছিলি তাঁকে? আবার বলেছিল লিংক দেখে দেখে শিখতে? ঐ কি শিখবে হ্যাঁ? কি শিখবে?
মায়া রাগান্বিত মুখটা দেখে রাফা দুষ্টু হাসল। মায়াকে আরও রাগিয়ে দিতে নিজের হাতটা টেনে পুনরায় মায়ার কাঁধ জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল…

‘ আরে জানু চিল! দুইদিন দেখা হয়নি বলে আমার উপর তোর এতো ভালোবাসা বেড়ে গেল? মাইরি সাংঘাতিক তো তুই!
রাগান্বিত মায়া আরও ক্ষেপে গেল। রাফার হাতটা ঝটকা দিয়ে ফেলে দিতে দিতে বলল…
‘ অসভ্য মাইয়া! কিসব লিংক পাঠিয়েছিলি তুই উনাকে আগে সেটা বল? খবরদা কথা ঘুরাবি না।
রাগে মায়ার নাকের ফাটা ফুলে উঠছে। রাফা তাতে মজা পেয়ে বলল…
‘ বাপরে তোরা এতো এডভান্স জানু? সব লিংক দেখাও শেষ? তা কি কি শিখলি তোরা? কয়টা কাজে লাগালি বলতো শুনি? আউচ!
বাহুতে হাত চেপে রাফা মৃদু চেঁচাল। রাফার কথায় মায়া তৎক্ষনাৎ হাতের বোতলটায় আঘাত করলো রাফার বাহুতে। রাফার চেঁচানোতে নাক মুখ শক্ত করে মায়া আবারও বলল…
‘ অসভ্য মাইয়া।

মায়াকে অতিরিক্ত রেগে যেতে দেখে রাফা এগিয়ে আসল। জোর করে টেনে মায়ার কাঁধ জড়িয়ে ধরতে চাইলে মায়া রাফার হাতটা ঝটকা ফেলে দিতেই রাফা আবারও মায়ার কাঁধ জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলল….
‘ দেখ জানু আমি যে-টা করেছি সেটা তোর ভালোর জন্যই করেছি। যদি সেদিন আমি এসব না করতাম তাহলে রিদ ভাইয়া হয়তো আজও আসতো না তোর কাছে। তুই বল, বিগত তিনমাস ধরে ভাইয়ার রাগ ভাঙ্গাবোর চেষ্টা করছিস পেরেছিস বল? হয়তো আমার তরিকা ভুল ছিল কিন্তু উদ্দেশ্য সঠিক ছিল। তুই ভাইয়ার জন্য কষ্ট পাচ্ছিলি যেটা আমার ভালো লাগছিল না। এজন্য আমার উদ্দেশ্য ছিল যে করেই হোক ভাইয়া অন্তত তোর কাছে ফিরে আসুক। তারপর তোদের দুজনের রাগ-অভিমান এমনই চলে যাবে।
রাফার কথায় মায়া রাগ কমলো। খানিকটা নমনীয় হয়ে মায়া বলল…

‘ তাই বলে এসব পাঠাবি? অন্য কিছু করতি।
‘ তুই তো কতো কিছু করেছিস ভাইয়াকে ফিরাতে কাজ হয়েছে বল? তাছাড়া তখন এর থেকে ব্যাটার অপশন আমার মাথায় আসেনি। ঐ মূহুর্তে মনে হয়েছিল আমি যা করছি সেটাতেই ঠিক কাজ হবে। হয়েছেও তাই! ভাইয়া ঠিকই চলে আসলো তোর টান খেয়ে।

রাফার কথায় মায়া গলে গেল। আসলেই মায়া বিগত তিনমাসে অনেক কিছু করেছে রিদের অভিমান ভাঙ্গাতে যেটাতে মায়া ব্যর্থ হয়েছিল। তবে রাফা যা করেছে তাতে তরিকা ভুল হলেও সঠিক কাজ হয়েছে। রিদকে চট্টগ্রাম ফেরাতে সক্ষম হয়েছে। তবে রিদের কাছে মায়ার ইজ্জত শেষ। রিদ ভাবছে মায়া এসব কিছুর লিংক পাঠিয়েছে তাঁকে। এজন্য-তো রিদ মায়ার সাথে অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যবহার করছে। আর এখন তো সোজা বলে দিয়েছে মায়া রিদকে ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে পারবে না। বলতে গেলে রাফার কাছে মায়ার ভালোও হয়েছে আবার বিপদেও পরেছে। ভালো হয়েছে কারণ মায়া সবসময় রিদকে চোখের সামনে পাবে। আর বিপদের কথা মায়া কাউকে বলতে পারছে না যে মায়ার স্বামীর ওর সাথে কেমন কেমন কাজ করে বেড়াচ্ছে উফ!

এই পুরো বিষয়টাতে জুই বোকার মতোন দাঁড়িয়ে। মূলত মায়া রাগের কারণটা জুই বুঝতে পেরেই চুপ থাকল। রাফা যে মায়ার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করেছে তার ধারণা জুইয়ের হয়েছিল আগেই কিন্তু কাউকে কিছু বলল না। চঞ্চল রাফা মূহুর্তে মায়াকে নিজের দলে করে নিলো। মায়া কাঁধ জড়িয়ে গলাগলির ভাবও হয়ে গেল। জুই সেইদিকে তাকিয়ে বিনোদন নেওয়ার মাঝেই কোথা থেকে আয়ন উপস্থিত হলো সেখানে। গলা কেশে সকলে মনোযোগ ভাঙ্গতেই চমকে উঠার মতোন জুই পিছনে তাকাতে আয়ন এগিয়ে আসল মায়ার দিকে। জুইকে ইগনোর করে মায়া, রাফার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে আয়ন মায়াকে বলল….
‘ শুনলাম তোমার নাকি কলেজ ট্রান্সফার করাবে রিদ?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে দিতে বলল…

‘ উনিতো তাই বলল।
আয়ন ভ্রুর উঁচিয়ে জানতে চাইল…
‘ তোমার তাতে অসম্মতি আছে?
মায়া মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি দিতেই আয়ন সুন্দর হেসে বলল…
‘ রিদ তোমাকে নিয়ে খুব সেনসিটিভ মায়া। তোমার ব্যাপারে কারও ইন্টারফেয়ারেন্স পছন্দ করে না। ওহ সেটা বলে সেটা শুনে যাও মায়া। তোমার উপর আসা সকল বিপদের মোকাবিলা রিদ একাই সামলে নিবে। তুমি শুধু ওর হয়ে থাকো বাকিটা ওহ সামলে নিবে।
আয়নের কথায় মায়া আবারও মাথা কাত করে সম্মতি দিতেই আয়ন অল্প হাসলো। ফের মায়ার উদ্দেশ্য বলল….
‘ তাহলে তোমরা ক্লাসে যাও মায়া। আমি জুইকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।
আয়নের কথায় জুই চুপ রইল। আয়ন বলেছিল জুইকে বিকালে দেখা করতে কিন্তু তার আগেই যে সকাল সকাল দেখা করতে আয়ন চলে আসবে তা বুঝেনি জুই। মায়া আয়নের কথায় পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চাইল…

‘ কেন ভাইয়া?
‘ একটু কাজ আছে। যেটা জুইকে ছাড়া সম্পূর্ণ হবে না।
‘ ওহ ক্লাস করবে না?
‘ আজ করবে না।
‘ আচ্ছা।
মায়া আবারও ঘাড় কাত করে সম্মতিতে দিতে দিতে রাফাকে নিয়ে চলে যেতেই জুই ইতস্তত বোধ করলো আয়নের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। আয়নের পিছনে ঘুরেই জুইয়ের ইতস্তত মুখটা দেখে কপাল কুঁচকে বলল…
‘ আপনার আবার কি হলো জুই? এমন করছেন কেন?
নত মস্তিষ্কের জুই মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি দিতে দিতে বলল…
‘ কিছু হয়নি।

আয়ন কলেজ মাঠে দাঁড়িয়ে কথা বাড়াতে চাইনি কারণ আশেপাশে অনেকেই এদিকটা তাকিয়ে ওদের দেখছে। আয়ন কলেজে গেইটের বাহিরের পথে হাঁটা দিতে দিতে জুইয়ের উদ্দেশ্য বলল….
‘ আমার সাথে আসুন জুই।
আয়নের পিছন পিছন জুইও হাঁটল। আয়নের গাড়ির সামনে আসতেই দরজা খোলে দাঁড়াল। জুই আঁড়চোখে আয়নের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের। আয়ন পূর্ব থেকে গাড়ির দরজা খোলে জুইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল বলে দুজনের চোখাচোখি হলো। ইতস্তত জুই লজ্জায় দ্রুত গাড়িতে উঠে বসতেই আয়ন ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। গাড়ি স্টার্ট করতে করতে আয়ন বলল…
‘ আপনার বান্ধবী নাদিয়া কোথায় জুই? আজ আসেনি?
আয়নের ছোট কথাটা যথেষ্ট ছিল জুইয়ের মুড সুইংয়ের জন্য। মূহুর্তে জুইয়ের সকল জড়তা বিরক্তিতে রুপান্তরিত হলো আয়নের এক কথায়। আয়ন জুইয়ের রাগের কারণটা বুঝতে পেরে আবারও একই সুরে বলল…
‘ আপনি আমার ভালোবাসার প্রস্তাবটা আপনার বান্ধবী নাদিয়াকে জানিয়েছিলেন জুই?
জুই বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে জেদ্দি গলায় বলল…

‘ জানি না। আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন সেটা বলুন আগে?
আয়ন গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বলল…
‘ যেখানে নতুন সম্পর্ক গড়া হয় সেখানে।
আয়নের কথার মানে জুই বুঝতে না পেরে বলল…
‘ মানে?
‘ মানে আজকে আমার বিয়ে সেজন্য আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি সাক্ষী হতে।
জুই আয়নের কথায় সিরিয়াস নিলো না। অহেতুক মজা বলে উড়িয়ে দিতে দিতে বিরক্ত গলায় বলল…
‘ আপনার বিয়েতে আমার কি কাজ? আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন? আমি কোনো সাক্ষী টাক্ষী হতে পারবো না। আমাকে কলেজে দিয়ে আসুন। ক্লাস করবো।
জুইয়ের কথায় আয়ন আর হেয়ালি করলো না। বরং সিরিয়াস হয়ে বলল…

‘ কালকের কথা ভুলের যাচ্ছেন জুই? আপনি তো আমাকে কাল ওয়াদা করেছিলেন যে আমি যা চাইবো আপনি তাই আমাকে দিবেন তাহলে আজ কেন নিজের কথার ক্ষেলাপ হচ্ছে?
আয়নের কথায় জুই শান্ত হতে হতে বলল…
‘ আমি কথা ক্ষেলাপ করছি না। আমাদের রক্তেই নেই কথা দিয়ে না ক্ষেলাপ করাটা। আপনি বলুন আপনার কি চাই?
আয়ন সরাসরি আবদার করে বলল…
‘ আপনাকে চাই জুই।
জুই শকট হওয়ার মতোন করে বলল…
‘ মানে?
আয়ন জুইকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বলল…
‘ আমি আপনাকে আজ বিয়ে করতে চাই। করবেন আমাকে বিয়ে?
‘ অসম্ভব!
জুইয়ের অসম্মতি আয়ন শান্ত কন্ঠে বলল…

‘ আমার হয়ে যান জুই। সারাজীবন আগলিয়ে রাখব আপনাকে। যদি আজ আমাকে ফিরিয়ে দেন তাহলে লাইফে আপনি কখনো তৃতীয় চান্স পাবেন না আমার জীবনে ফিরে আসার। আমি অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা করে দুজনের জন্য এই ডিসিশন নিয়েছি জুই। আমাকে খালি হাতে ফেরাবেন না। বাকিদের সামলে নেওয়ার দায়িত্ব আমার। আপনি শুধু হ্যাঁ বলুন।
আয়নের কথায় যেন জুইয়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতোন চাপ পরছে। খালি মস্তিষ্ক ধপধপ করছে আয়নের কথা গুলো। জুই কিছু বুঝে, না বুঝে শুধু আয়নকে না করে যাচ্ছে একে পর এক…
‘ অসম্ভব!

জুইয়ের না করার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটি থামল একটা কাজি অফিসের সামনে। কলেজ থেকে মাত্র দশমিনিট দূরে কাজী অফিসটি। আর সেখানে অনেকেই দাঁড়িয়ে। রাদিফকে দেখা গেল হাতে দুটো বরমালা নিয়ে আয়ন-জুইয়ের অপেক্ষা করছে উৎফুল্লতায়। সঙ্গে চারটি মেয়ে আর সাত-আটজনের মতোন দামড়া দামড়া ছেলে দাঁড়িয়ে একত্রে। আয়নের গাড়িটি থামতে সকলে হৈচৈ করে এদিকটায় এগিয়ে আসতে চাইলে আয়ন গাড়িতে বসা অবস্থা হাতে ইশারায় সবাইকে থামতে বলল। সকলে থেমে যেতেই আয়ন দীর্ঘ শ্বাস
নিজের মধ্যে টেনে আস্তে ধীরে বলল…

‘ আপনার হাতে এক ঘন্টার মতোন সময় আছে জুই। একঘন্টা ভেবে চিন্তে তারপর উত্তরটা দিবেন আশা করছি। এখন থেকে হয় আপনার সাথে আমার নতুন যাত্রা শুরু হবে, নয়তো এখানে সবকিছুর ইতি ঘটবে। এখন বাকি সম্পূর্ণটা আপনার হাতে, এতে আমি জোর করবো না। তবে একটা কথা মাথা রাখবেন জুই। আজ আমি এখান থেকে খালি হাতে ফিরে গেলে সোজা বিয়ে করে নিব পারিবারিক পছন্দের মেয়েকে। আমার দেখা আপনি কখনোই পাবেন না। আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াবেন মেয়েরা এসে আপনাকে নিয়ে যাবে। অসম্মতি হলে সমস্যা নেই গাড়ি থেকে নামার প্রয়োজন নেই আমি বুঝে নিবো আপনি বিয়েতে রাজি নন।

কথাটা বলেই আয়ন গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল নিজের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে। জুই অশ্রু সিক্ত চোখ ঠোঁট কামড়িয়ে কাজী অফিসের দিকে তাকাল। এই মূহুর্তে জুইয়ের কি ডিসিশন নেওয়া উচিত বুঝতে না পেরে দু’হাতে মুখ ডেকে ফুপাতে লাগল কান্নায়। মায়া পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে বলে এটা নিয়ে কত কিছু হচ্ছে। ওদের পরিবারের মানুষজন জানলে কি হবে সেই ভয়েও আছে ওরা।

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫১

এমন একটা পরিস্থিতিতে আয়ন কিভাবে জুইকেও এনে দাঁড় করাল। জুইয়ের এখন কি করার উচিত? আয়নকে ফিরিয়ে দেওয়া নাকি গ্রহণ করা উচিত? আয়নকে আজ ফিরিয়ে দিলে চিরতরে জুই আয়নকে হারাবে। বারবার আয়ন আসবে না জুইয়ের কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে ছোট হতে। আবার আয়নকে গ্রহণ করে যদি এই মূহুর্তে বিয়ে করে নেয় তাহলে ওর পরিবারের সঙ্গে আবারও বড় ধরনের ধোঁকাদারি করা হবে। যেটা জুইয়ের দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়।

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫৩