রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা শেষ পর্ব (১)
রিক্তা ইসলাম মায়া
খান বাড়ির জুড়ে এখন উৎসবের আবহ। নিহাল খানের বিশাল জয়! ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই গোটা এলাকায় যেন আনন্দের ঢেউ লেগেছে। পাড়ায় পাড়ায় বাজছে বিজয়ের গান, চলছে মিষ্টিমুখ, আর সবার মুখে একটাই নাম—নিহাল খান। এই উৎসবের মাঝেই রিদের উপস্থিতি। গত দুদিন ধরে বাবার নির্বাচনের ব্যস্ততায় সে বাড়ি ফিরতে পারেনি, আর না মায়ার সঙ্গে কথা হয়েছে। এই জনাকীর্ণ কোলাহলে রিদের একটাই লক্ষ্য ছিল—সবকিছু যেন সুষ্ঠু হয়। হলোও তাই। রিদের দৃঢ়তার ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং বিশাল জয়ের মাধ্যমে নিহাল খান রাজনৈতিক ময়দানে নিজের অবস্থান আরও দৃঢ় করলেন।
জয়ের উল্লাসের দিন শেষে ধরনীতে রাত নামতেই খান বাড়ির পুরুষদের একে একে ক্লান্তিতে বাড়ি ফিরতে দেখা গেল। রাত তখন প্রায় মধ্যাহ্নে। রিদকে তখনও বাড়ি ফিরতে দেখা গেল না। খান বাড়ির উৎসবের কোলাহল তখনও পুরোপুরি থামেনি। নিহাল খানের বিপুল বিজয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই পরদিন তাঁর শপথ গ্রহণের বার্তা শোনা গেল। খুব স্বাভাবিকভাবেই শপথ পাঠের জন্য ওনাকে ঢাকা যেতে হবে। কিন্তু এই আনন্দের মাঝেও সুফিয়া খান ভাবাবেগহীন। ওনার রাজনৈতিক মহল পছন্দ নয়। সেই পনেরো বছর আগে নিহাল খান সুফিয়া খানকে ছেড়ে রাজনৈতিক জগৎকে বেছে নিয়েছিলেন বলেই তিনি আত্মসম্মান নিয়ে এক কাপড়ে স্বামীর ঘর ছেড়েছিলেন। আজও নিহাল খান সেই পথেই হাঁটছেন। নিহাল খানের জয়ের উল্লাস সাক্ষী দেয় যে সুফিয়া খান আরও একবার নিহাল খানের রাজনীতির কাছে হেরে গেছেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যদিও নিহাল খান আজকাল প্রকাশ করছেন যে তিনি সুফিয়া খানকে সঙ্গী হিসেবে চাইছেন, তবুও সুফিয়া খানের গুরুত্ব নিহাল খানের জীবনে তাঁর রাজনীতির পরেই আসে। যেখানে সুফিয়া খান স্ত্রী হিসেবে স্বামীর প্রায়োরিটি লিস্টে প্রথম নন, সেখানে সুফিয়া খানের খান বাড়িতে নিহাল খানের জীবনে থাকাটা মূল্যহীন। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুফিয়া খান আজও নিহাল খানের জয়ের নীরব দর্শক হলেন। জয় শেষে তিনি এবার নিজের নীড়ে ফিরতে চাইলেন। পনেরো বছর আগে তিনি যেমন এক কাপড়ে এই খান বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন, আজও তিনি সেই একই নীরব বিদ্রোহ নিয়ে এই বাড়ি ছাড়তে প্রস্তুত হলেন।
কিন্তু বিপত্তি ঘটল মায়াকে নিয়ে। সকাল থেকে রাতভর মায়াকে সুফিয়া খানের পিছন পিছন ঘুরঘুর করতে দেখা যায় সার্বক্ষণিক। সে ইতিমধ্যে খান বাড়ির সদস্যদের মাঝে শাশুড়ির-নেওটা পুত্রবধূ হিসেবে বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। তবে শ্বশুরের জয়ের উল্লাসে বিমোহিত মায়া তখনও সুফিয়া খানের বাড়ি ত্যাগ করার মনোভাব ঠাহর করতে পারেনি। সুফিয়া খান যখন রাতের মধ্যভাগে খান বাড়ি ছাড়তে প্রস্তুত হলেন, তখনই মায়ার টনক নড়ল। মূহুর্তে হৈচৈ করে কেঁদেকেটে সুফিয়া খানকে জাপটে ধরতে একে একে সকলের মধ্যে সুফিয়া খানের বাড়ি ছাড়ার বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেল। উল্লাসে মেতে থাকা পরিবেশ মুহূর্তে বিষাদে পরিণত হলো। খান বাড়িভর্তি মানুষ সুফিয়া খানকে ঘিরে উঠে দাঁড়াল। সকলের একই বক্তব্য—সুফিয়া খানকে থেকে যাওয়ার জন্য আহাজারি করে। হেনা খান, আরাফ খান, মায়াসহ—সকলে পথ আটকে দাঁড়াতে শক্ত সুফিয়া খান বিরক্তির কপাল কুঁচকাল। মায়া তখনও ওনাকে জাপটে ধরে কাঁদছে, যেতে দেবে না বলে। এই ব্যাপারটায় তিনি বেশ অতিষ্ঠ। ওনার পিছু পিছু মায়া সার্বক্ষণিক ঘুরঘুর না করলে হয়তো এতক্ষণে তিনি নিশ্চুপ চলে যেতে পারতেন। মায়ার জন্য সকলের দৃষ্টিতে ভিড়ল। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, ওনার বয়োজ্যেষ্ঠ শ্বশুর-শাশুড়িও সুফিয়া খানের পথ আটকে দাঁড়িয়ে। বিরক্তির সুফিয়া খান নিজের আশেপাশে সকলের ভিড় দেখে মায়াকে খানিকটা ধমকের সুরে বললেন,
‘ মায়া, ছাড়ো। লেট হচ্ছে আমার।
সুফিয়া খানের শক্ত গলায় মায়া ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,
‘ প্লিজ আম্মু আমাদের ছেড়ে যাবেন না। আমরা সবাই আপনাকে ভিষণ ভালোবাসি। প্লিজ আমাদের সঙ্গে থেকে যান আম্মু।
মায়ার কথায় সুফিয়া খান উপস্থিত সকলের দিকে এক পলক দৃষ্টি বোলাল। সকলে কেমন অসহায় দৃষ্টিতে সুফিয়া খানের দিকে তাকিয়ে। ব্যাপারটায় তিনি বেশ অস্বস্তি বোধ করতে মায়াকে তিনি আগের নেয় শক্ত গলায় বলল…
” আমি বিরক্ত হচ্ছি মায়া। ছাড়ো।
সুফিয়া খানের কথায় মায়া হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি ছাড়ব না আম্মু। আপনি বিরক্ত হলেও ছাড়ব না। আপনি হীনা গোটা খান বাড়ি শূন্য। প্লিজ আম্মু, আমাদের ছেড়ে যাবেন না।
মায়ার কথায় খান বাড়ির সকলে সম্মতি জানাল। অস্থির উত্তেজিত ভঙ্গিতে সুফিয়া খানকে বোঝাতে চাইল একেকজন। সকলের হৈচৈয়ে সুফিয়া খান যেমন বিরক্ত, তেমনই অস্বস্তি বোধ করলেন। এর মাঝে আরাফ খান পরিস্থিতি বুঝে হাতের লাঠিতে ভর করে এগিয়ে এসে সুফিয়া খানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বেশ গম্ভীর মুখে বললেন,
” তুমি কি সত্যি চলে যেতে চাও সুফিয়া?
আরাফ খানের কথায় সুফিয়া খান ঘাড় ঘুরিয়ে আরাফ খানের দিকে তাকালেন। সোজাসাপটা উত্তরে বললেন,
“জ্বি বাবা।
সুফিয়া খানের উত্তরে ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরাফ খান সম্মতি দিতে দিতে বললেন,
“বেশ, তোমার কথাই রইল সুফিয়া। তোমাকে আর কেউ বাঁধা দেবে না এই নিয়ে। অনেক তো হলো, এসব আর কতদিন চলবে? তুমি বা নিহাল, তোমরা কেউ ছোট নও। তোমাদের ছেলেরা বড়ো হয়েছে, তাদের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনেছ, তারপরও তোমাদের মনোমালিন্য শেষ হলো না। আমরা বুড়ো মানুষ, আজ বাদে কাল মারা যাব। আমাদের চিন্তা তোমাদের করতে হবে না। মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে তাদের দাম এমনই থাকে না। তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর কাছেও আমাদের গুরুত্ব কখনোই ছিল না। তোমরা শুরু থেকে তাই করেছ যেটা তোমাদের মন চেয়েছে। দীর্ঘ পনেরো বছর তোমাদের দুজনের পিছনে ছুটতে ছুটতে আজ আমরা ক্লান্ত। শেষ বয়সে এসে এবার আমরাও শান্তিতে মরতে চাই। তুমি যেহেতু খান বাড়িতে থাকতে চাইছ না, তাহলে আমাদেরও তোমার সাথে নিয়ে যাও। গোটা পনেরো বছর তোমাকে ছাড়া নিহালের সঙ্গে কাটালাম, বাকি যে ক’দিন বাঁচব সেটা তোমার সঙ্গে কাটাব ভাগাভাগি করে। আমি আর তোমার শাশুড়ি, দুজনই আজ তোমার সাথে খান বাড়ি ছাড়ব এক কাপড়ে, চলো।
আরাফ খানের কথায় তৎক্ষণাৎ হেনা খান সম্মতি দিলেন সুফিয়া খানের সঙ্গে যাবেন বলে। এর মাঝে মায়াও সাহস পেয়ে হৈচৈ করে ভেজা চোখে বলল সেও যাবে,
মায়ার কথার মাঝে গোটা খান বাড়ির সদস্যরা হৈচৈ করে উঠল সুফিয়া খানের সঙ্গে যাবেন বলে। আরাফ খানের দুই কন্যা, তাদের ছেলে-মেয়ে সবাই একত্রে সম্মতি দিতে সুফিয়া খান সকলের দিকে তাকালেন। আজ ওনাকে আটকাতে পুরো খান বাড়ি দাঁড়িয়ে। সকলে খান বাড়ি ছাড়তে প্রস্তুত, অথচ সুফিয়া খানকে নয়। ঠিক যেভাবে নিহাল খান সুফিয়া খানকে পনেরো বছর আগে ছাড়তে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু রাজনীতি নয়। শক্ত সুফিয়া খান নিজের কথায় অটল থেকে আরাফ খানের উদ্দেশ্যে বলল…
“আপনারা আমার সাথে যেতে চাইলে যেতে পারেন। এতে আমার কোনো সমস্যা নেই বাবা, কিন্তু তারপরও আমার পক্ষে খান বাড়িতে থাকা সম্ভব নয়।
সুফিয়া খানের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। রিদের অনুরোধে তিনি নির্বাচন পর্যন্ত খান বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু এখন নির্বাচন শেষ, ওনার এখানে থাকার আর কোনো কারণ নেই। যে প্রেক্ষিতে তিনি চট্টগ্রামে ছুটে এসেছিলেন, সেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল। মায়া আর রাদিফের সাজানো মিথ্যা নাটক তিনি আরও অনেক আগেই ধরে ফেলেছিলেন, তখনই তিনি চলে যেতেন কিন্তু রিদের অনুরোধে, নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত রয়ে গেছেন। সুফিয়া খান যখন আরও কিছু বলবেন, তার আগেই শোনা গেল নিহাল খানের ক্লান্তিময় কণ্ঠ।
” ঠিক আছে সুফিয়া। তুমি থাকতে না চাইলে কোনো সমস্যা নেই। পুরো খান পরিবারের জায়গা যখন তোমার ঘরে হবে তখন আমার একা মানুষের জায়গাও তোমার বাড়িতে হবে। তুমি থাকতে না চাইলে আমরা সবাই তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকব, তারপরও তোমার সঙ্গেই থাকব।
নিহাল খানের হঠাৎ কথায় সকলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল দরজার দিকে। যেখানে নিহাল খানের সঙ্গে আয়ন, রাদিফ দুজনই দাঁড়িয়ে, থমথমে মুখে নিহাল খানের দিকে চেয়ে । এই অসময়ে নিহাল খান এমন কথা বলবে, কারও ধারণাতে ছিল না। সকলেই হতবাক। কিন্তু তীক্ষ্ণ সুফিয়া খান কপাল কুঁচকে তাকাল নিহাল খানের দিকে। এর মাঝে নিহাল খান এগিয়ে এসে সকলের সঙ্গে দাঁড়ালেন, তিনিও সুফিয়া খানের সঙ্গে খান বাড়ি ছাড়বেন বলে।
পরিস্থিতি যখন বেশ থমথমে, তক্ষুনি খান বাড়িতে প্রবেশ করল রিদ। গম্ভীর রিদের বিগত দু’দিনের ছোটাছুটি আর মাথা ব্যথায় চোখ দুটো রক্তিম হয়ে আছে। এর মাঝে মা-বাবার সঙ্গে পারিবারিক কলহের বিষয়টি তাঁর কানে এসেছে। মূলত এজন্যই তাঁর এখন বাড়ি ফেরা। রিদ একপলক মায়ার দিকে তাকাল। সুফিয়া খানকে জড়িয়ে মায়া রিদের দিকে তাকিয়ে। রিদের তাকানোতে খুব স্বাভাবিকভাবেই চোখাচোখি হলো দুজনের। ক্লান্তিময় মুখ আর রক্তিম চোখে রিদকে বেশ অন্যরকম দেখাল। রিদের অসুস্থতা তাঁর চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে। রিদ মায়ার মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সুফিয়া খানের দিকে তাকাতেই আবারও চোখাচোখি হলো মায়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সঙ্গে। রিদের অসুস্থতার বিষয়টি চট করে সুফিয়া খান বুঝে গেলেন। রিদ শান্ত গলায় সুফিয়া খানের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল,
“শেষ একটা সুযোগ সবাই ডিজার্ভ করে আম্মু। সবসময় সব জায়গায় আত্মসম্মান বজায় রাখতে নেই। আপনজনদের কাছে আত্মসম্মান নয়, ভালোবাসা রাখতে হয়—এটা তোমার দেওয়া একটা শিক্ষা। আজ বাবার পাশে কেউ নেই, সবাই বাবাকে একা করে তোমার সম্মানে পুরো খান পরিবার দাঁড়িয়ে। আমার মনে হয় এবার তোমার তাদের শেষ একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।
পুরো খান পরিবার নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রিদের কথায় নীরব সম্মতি জানাল। সুফিয়া খান নিজেও নিশ্চুপ। রিদ কিছু বললে যে সুফিয়া খান শুনবেন, সেটা সবাই জানে। সেজন্য সকলে চুপ থেকে রিদকে বলার সুযোগ দিল। রিদ পুনরায় একই ভাবে বলল,
” আমার জীবনে দেখা উত্তম নারী তুমি। তোমার হাত ধরে অনেক কিছু শিখেছি। একটা পরিবার, সংসার কিভাবে সামলাতে হয়, সেটা তোমার থেকে ভালো এখানে কেউ জানবে না। এসব পারিবারিক কলহ আর ভালো লাগছে না আম্মু। তোমাদের বিচ্ছেদের ভাঙন আমরা দুই ভাই গোটা পনেরো বছর পাড় করেছি। এবার না-হয় শেষটা সুন্দর হোক। নিজের জন্য না-হয় আমাদের জন্য থেকে যাও। দ্বিতীয়বার তোমার অযত্ন কেউ করবে না। ভরসা রাখো।
রিদের কথায় সুফিয়া খানের মাঝে নমনীয়তা দেখা গেল। রিদ কখনো এমন নরম সুরে ওনার কাছে কোনো কিছু নিয়ে আবদার করেনি। বাবা-মার বিচ্ছেদ নিয়েও কখনো কথা বলেনি। এই প্রথম রিদ কিছু বলল বাবা-মার বিচ্ছেদ নিয়ে। সুফিয়া খান কি নিজের জেদ বজায় রাখতে গিয়ে ওনার সন্তানদের কষ্ট দিয়েছিলেন এতকাল? এজন্যই রাদিফ বারবার আবদার করত বাবা-মার কাছে একত্রে হয়ে যাওয়ার? সুফিয়া খান নিজের ব্যক্তিগত জীবন আলোচনা করতে না চেয়ে সরাসরি রিদের অসুস্থতা সম্পর্কে জানতে চেয়ে বলল,
“তুমি কি অসুস্থ রিদ?
রিদ বুঝতে পারল সুফিয়া খান রিদের কথা মেনে তিনি খান বাড়ি ছেড়ে যাবেন না। তাই রিদও মায়ের কথায় সম্মতি দিয়ে অল্প উত্তরে বলল,
” হুম একটু!
সুফিয়া খানের কঠিন মুখটা অবশেষে নরম হলো। এতক্ষণ যে সুফিয়া খান ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অনমনীয়, সেই নারী যেন নিমেষেই বদলে গেলেন। রিদের কপালের শিরাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, চোখের কোণে ক্লান্তি আর লালচে আভা। একজন মা সবসময় সন্তানের মন পড়তে পারে। তাই তিনি মায়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
“রিদকে নিয়ে রুমে যাও মায়া।
মায়া ততক্ষণে সুফিয়া খানকে ছেড়ে পাশে সরে দাঁড়িয়েছিল। রিদের অসুস্থতা মায়ার চোখেও পড়েছে। মায়া ব্যাপারটা নরমাল মনে করলেও রিদের অসুস্থতার বিষয়টি ছিল জটিল। রিদের মাথায় পরপর দুটো সার্জারি হয়েছিল অ্যাক্সিডেন্টের ফলে। তার নিয়মিত মেডিসিন চলে। চেকআপের জন্য লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রিদ সেই যে জেদ করে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরেছিল, তারপর আর লন্ডনের মাটিতে পা পড়েনি। বিগত কয়েক দিনের ব্যস্ততায় রিদের মেডিসিন নেওয়া হলো না। এতে করে রিদের ব্রেইনে চাপ অনুভব হতেই রিদ ক্রমাগত অসুস্থ অনুভব করছে। রিদ আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রুমের দিকে হাঁটতে মায়াও পিছন পিছন গেল।
ঘরে ফিরে রিদ সোজা ওয়াশরুমে ঢুকল। অল্প সময় নিয়ে গোসল করে বের হতে মায়াকে দেখল বিছানায় বসে রিদের দিকে তাকিয়ে। রিদ তখনও কোনো কথা বলল না। মাথার শিরা ধপধপ করছে ব্যথায়। মায়ার নামিয়ে রাখা কাপড়গুলো রিদ গায়ে না জড়িয়ে পুনরায় ফরমাল প্যান্ট-শার্ট নামাল কবাট হতে। রিদকে পরিপাটি হয়ে রেডি হতে দেখে মায়া ভাবল রিদ আবারও বের হয়ে যাবে এই রাতে। রিদ আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজের মেডিসিন বক্স খুলে কয়েকটি ঔষধ মুখে পুরে অল্প পানি পান করতে মায়া উঠে এসে রিদের পিছনে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে জানতে চেয়ে বলল,
“আপনি কি অসুস্থ? এ-তো গুলো কিসের ঔষধ খেলেন?
রিদ মায়ার কথায় উত্তর না দিয়ে পুনরায় কবাট খুলল। ড্রয়ার হতে রিদের পাসপোর্টের সঙ্গে মায়ার পাসপোর্টও বের করতে মায়া রিদের শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখে বলল, “এই পাসপোর্ট দিয়ে কি করবেন? আপনি কই যাবেন?
মায়ার জানা ছিল না রিদের কাছে ওর পাসপোর্ট রয়েছে। রিদকে কথা বলতে না দেখে মায়া পুনরায় বলল,
“আপনি কথা বলছেন না কেন? কই যাবেন, বলুন না। আপনি কি আমার সাথে রাগ করেছেন?
রিদ হাতে দুটো পাসপোর্ট নিয়ে কবাট লাগাল। রিদের ফোনের সাথে মায়ার ফোনটি হাতে নিয়ে অপর হাতে মায়ার হাত শক্ত করে চেপে ধরতে ধরতে বলল,
“চলো।
কথাটা বলে রিদ মায়ার হাত টেনে বাইরের দিকে হাঁটতে মায়া আঁতকে উঠে বলল,
“চলো মানে? কই যাব আমরা?
নিশ্চুপ রিদ অল্প উত্তরে বলল,
“লন্ডনে।
রিদের কথায় মায়ার মাথা ঘুরে ওঠার মতো অবস্থা। মায়া মোটেও এই মুহূর্তে প্রস্তুত নয় দেশ ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার মতো। মূলত মায়া শ্বশুর-শাশুড়ি সবেমাত্র একত্রে হয়েছে। ওদের কাছাকাছি এক ঘরে আনার দায়িত্ব মায়ার। মায়া সেই দায়িত্ব পালন না করা পর্যন্ত ওহ কোথাও যাবে না। দ্বিতীয়ত, খান বাড়ি ভর্তি মেহমান। মায়ার মা, জুই সকলেই আছে খান বাড়িতে। এতসব মানুষের ভিড়ে মায়ার বেশ আনন্দে দিন কাটে। শ্বশুরের বিজয়ের উল্লাস এখনও শেষ হয়নি, তাই মায়া চায় না এতসব আনন্দের মুহূর্ত ছেড়ে রিদের সঙ্গে একা একা বিদেশ গিয়ে থাকতে। মায়া রিদের সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার হলে আরও কয়েকটা দিন পর যাবে প্রস্তুতি নিয়ে। বিনা প্রস্তুতিতে হুট করে এলোমেলো পোশাকে মায়া কখনোই বিদেশ যেতে চায় না। সেজন্য মায়া রিদের থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চেয়ে খানিকটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল,
“আমি কোনো লন্ডন-টন্ডনে যাব না নেতা সাহেব। আপনার যাওয়ার হলে আপনি যান। আমি সবার সাথে এখানেই থাকব।, কেমন?
মায়ার কথায় রাগে রিদের চোয়াল শক্ত হতে দেখা গেল, তারপরও রিদ মায়াকে কিছু বলল না। বরং শক্ত হাতে মায়ার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগল নিজের সাথে। মায়া যত বাঁধা দিচ্ছে, রিদ ততই টানছে মায়াকে। রিদের শক্তিতে না পেরে মায়া চিৎকার করতে লাগল রিদের সঙ্গে যাবে না বলে। মায়ার চিৎকারে পুনরায় বসার ঘরের সকলে ভিড় জমাল। রিদের কাছে জানতে চাইল কি হয়েছে। বিরক্তির রিদ মায়ার উপর রেগেমেগে মায়াকে কাঁধে তুলে নিতেই আরাফ খান রিদকে বাঁধা দিতে চাইল মায়াকে নিয়ে যেতে। তক্ষুনি রাদিফ পাশ থেকে আরাফ খানকে আটকে বলল,
“বাঁধা দিও না দাদাভাই। ভাই-ভাবির আজ ফ্লাইট আছে। ওরা লন্ডনে যাবে। ভাবি যেতে চাচ্ছে না বলে ভাই জোর করে নিয়ে যাচ্ছে।
রিদের ফ্লাইটের বিষয়টি কানে যেতেই বিস্ময়কর হলো আরাফ খান। বলল..
” রিদের ফ্লাইট মানে? কবে ঠিক করল ওরা লন্ডনে যাবে?
“অনেক আগেই টিকিট করা ছিল আজকের তারিখের।
“ওরা ফিরবে কবে?
“সঠিক বলতে পারছি না।
“আসিফ যাবে ওদের সাথে?
“না।
আরাফ খান বুঝলেন রিদ এবার লম্বা ছুটিতে দেশ ছাড়ছে। তিনি লাঠিতে ভর করে খান বাড়ির বাইরে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল, বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা হেলিকপ্টারে রিদ একপ্রকার মায়াকে ছুঁড়ে ভিতরে ফেলতে ফেলতে সে উঠে বসল। রিদ হেলিকপ্টারে উঠে বসতেই একজন দেহরক্ষী দ্রুত এগিয়ে এসে দরজা লাগাল। আসিফ বাইরে দাঁড়িয়ে। সে রিদের সঙ্গে যাবে না। বরং সে কাল ঢাকায় ফিরে যাবে রিদের কোম্পানির কাজে। দেশের বাইরে থেকেও রিদ আসিফের সঙ্গে যোগাযোগ করবে এমনটাই নিধারিত।
রিদ মায়াকে নিয়ে হেলিকপ্টারে বসতেই হেলিকপ্টারের পাখা গোল গোল ঘুরিয়ে আকাশে উড়ে যেতেই মায়া আতঙ্কে রিদকে দু’হাতে জাপটে ধরল। রিদ মায়াকে না ছুঁয়ে শক্ত হয়ে বসল। তাদের শেষ রাতের দিকে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট আজ। এখন রাত বারোটা। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পৌঁছাতে হেলিকপ্টারে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। এর মাঝে রিদের মাথা ব্যথাটা খানিকটা কমে আসলে আরাম পেতো বলে মনে করলো রিদ। রিদ যথাসম্ভব কথা না বলে রিদের মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু মায়ার ফ্যাচফ্যাচ কান্নায় তার মাথা ব্যথা বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। রিদ মায়াকে শক্ত গলায় ধমক লাগাতে গিয়েও লাগাল না। বরং মায়ার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল,
“দুনিয়ার সব বোঝো, শুধু আমাকে ছাড়া। সবাই তোমার প্রায়োরিটি লিস্টে পরে, শুধু আমি ছাড়া। জীবিত মানুষের মূল্যায়ন তোমার কাছে নেই। আমি মরে গেলে মূল্যায়ন করবে তো রিত?
রিদের কথায় মায়ার তৎক্ষণাৎ কান্না থেমে যায়। ভেজা দুই চোখের মনি দুটো স্থির হয়ে যায় রিদের মুখের ওপর। মায়ার নীরবতা বুঝে রিদ চোখের ওপর হাত ঠেকিয়ে শুয়ে পড়ল সিটে। মায়া তখনও স্থির দৃষ্টিতে রিদের দিকে তাকিয়ে। পুরোটা সময় মায়া আর কোনো কথা বলল না। শুধু নিশ্চল দুই চোখ ঘুরে ঘুরে রিদের দিকে তাকাতে লাগল। রিদ বুঝেও না বোঝার মতো করে রইল।
ঢাকা পৌঁছাতে রিদের একজন অ্যাসিস্ট্যান্টকে দেখা গেল মধ্যরাতে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকতে রিদের অপেক্ষায়। রিদ মায়াকে নিয়ে প্রথমে নিজের বাড়িতে গেল। সেখান হতে অল্প সময়ের মধ্যে নিজেদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি টানল সোজা এয়ারপোর্টে। সময় থাকতে শেষ রাতের আগেই মায়াকে নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে রিদের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট এগিয়ে আসল। রিদ এক হাতে মায়ার হাত চেপে অপর হাতে দুটো পাসপোর্ট নিয়ে হাঁটল কাউন্টারের দিকে। প্রয়োজনীয় সকল তথ্য শেষে মায়াকে নিয়ে প্ল্যানে উঠে বসতেই প্ল্যানটি সময় নিয়ে আকাশে উড়াল দিল দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে।
প্ল্যান জার্নির পুরো রাস্তায় মায়া রিদের সঙ্গে টুঁ-শব্দটিও করল না। কেমন চুপচাপ বসে রইল বাড়ির কাপড়ে। মায়ার গায়ের এই শাড়িটা আজ মায়ার শাশুড়ি দিয়েছিল বাড়িতে নির্বাচনের উল্লাস ও লোকজনের আনাগোনা থাকবে বলে। সেই শাড়ি পরেই রিদের সঙ্গে এক দেশ হতে অন্য দেশে পাড়ি জমাল মায়া। রিদ মায়াকে শাড়িটা পরিবর্তন করার সময়টুকুও দিল না। অথচ রিদ নিজে গোসল করে নতুন কাপড় পরে বাবু হয়ে বসে আছে।
বাংলাদেশে গরম, অথচ লন্ডনের মাটিতে উষ্ণ ঠান্ডা। এখন সময় দশটা। বাংলাদেশ সময় হয়তো বিকাল তিনটার নাগাদ হবে। মায়া লন্ডনে এসেছে পর থেকে বাংলাদেশের কারও সাথে কথা হয়নি। হয়তো রিদের হয়েছে, তবে রিদ মায়াকে কিছু বলেনি এই বিষয়ে। মায়ারা আজ সকাল সাতটার নাগাদ লন্ডনে এসে পৌঁছায়। এয়ারপোর্ট থেকে রিদের লোক এসে মায়াদের রিসিভ করে, তারপর ওরা একটি হাসপাতালে যায়। মায়া হাসপাতালটির নাম জানে না। তবে সেখানে রিদকে চিকিৎসা নিতে দেখে মায়া বুঝতে পারে, এর আগে রিদের অ্যাক্সিডেন্টের সময় রিদকে হয়তো এই হাসপাতালেই রাখা হয়েছিল, তাই আজ মায়ারা লন্ডনে ফেরার পরপরই রিদ মায়াকে নিয়ে সোজা এই হাসপাতালে চলে এসেছে চেকআপের জন্য।
রাতের ব্যাপারটায় মায়া রিদের ওপর অভিমান করে বসে নেই, বরং মায়া রিদের কথায় কষ্ট পেয়েছিল বলে সে নিশ্চুপ। মায়ার জীবনে স্বামী হিসেবে রিদের গুরুত্ব অনেক। রিদের আগে মায়ার জীবনে কখনো কাউকেই প্রথম প্রায়োরিটিতে রাখেনি। মায়ার প্রথম প্রায়োরিটি মায়ার স্বামী। রিদের অসুস্থতার বিষয়টি মায়া জানত না, জানলে হয়তো মায়া কখনোই রিদকে বাঁধা দিত না। এখন মায়ার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে তখন রিদকে বাঁধা দিয়ে। মায়ার স্বামী নিশ্চয়ই মনে করছে মায়া ওর স্বামীর মন বোঝে না। সত্যি কি তাই? মায়ার তীব্র অপরাধ বোধে কান্না পেল। কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আসতে মায়া নিজের পাশে কারও উপস্থিতি টের পেল। মায়া ঘাড় বেঁকে তাকাতেই দেখল রিদ সবে গোসল করে কোমরে তোয়ালে বেঁধে খালি গায়ে দাঁড়িয়েছে। ভেজা চুল আর স্নিগ্ধ মুখে রিদকে দারুণ দেখাল। মায়া রিদের মুখে দিকে তাকিয়ে থাকতে রিদ কপাল কুঁচকে মায়াকে পরখ করলো। রিদ মায়াকে সেই ঘণ্টাখানেক আগে বলেছিল গোসল করে ফ্রেশ হতে, অথচ মায়া গোসল না করে রুমের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ পথে চেয়ে আছে। কি এত ভাবছে কে জানে? তবে রিদের ধারণা, সে মায়াকে জোর করে নিজের সঙ্গে নিয়ে আসায় হয়তো মায়া এখনও অভিমান করে বসে। আর এই ব্যাপারটায় রিদ চট করে বিরক্ত বোধ করল। মায়ার দিকে বিরক্তি চোখে তাকিয়ে বলল,
রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৭৩
‘ কি সমস্যা? এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ফ্রেশ হবে না?
রিদকে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে দেখে মায়া ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিল। রিদের ভেজা শরীরে দু’হাতে জাপটে জড়িয়ে রিদের বুকে কপাল ঠেকাতে ঠেকাতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
‘ আমার একটাই আপনি ছিলেন নেতা সাহেব। আপনাকে ভালোবাসার স্বাদ এই জন্মেও শেষ হবে না।
রিদ বুঝতে পারল মায়া রিদের রাতে বলা কথাগুলো মনে পুষে কষ্ট পাচ্ছে। রিদ মায়াকে দু’হাতে জড়িয়ে নিতে নিতে বলল, “তাই?
“হুম।”