রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ১৩
ফারহানা চৌধুরী
মিশমির এমন চুপচাপ হাঁটার পথেই তার সামনে একটা বাইক ধুলো উড়িয়ে এসে সজোরে ব্রেক কষে। মিশমি এ যাত্রায় চমকে উঠলো। হকচকিয়ে গিয়ে আশেপাশে তাকালো। পরপরই সামনে চোখ গেল। লোকটা বাইক থামিয়েছে৷ এভাবে রাস্তার ধুলো উড়িয়ে মুখের সামনে এসে ব্রেক কষা কেমন ভদ্রতা? মিশমি প্রচন্ড রেগে গেলো৷ ক্ষিপ্ত চোখে বাইকারের দিকে চেয়ে রইলো। লোকটা মাথা থেকে হেলমেট নামিয়ে বাইকের উপর রাখে। খুব সুন্দর করে লম্বা চুলগুলো ঠিক করে। বে-শি-ই ফিল্মি! লোকটা এবার সাথে থাকা এক্সট্রা হেলমেট বাড়িয়ে দিলো মিশমির দিকে। মিষ্টি হেসে প্রস্তাব রাখলো,
-“Let’s go on a bike ride mam?”
কি মিষ্টি সুর! রাইডারকে চিনেছে মিশমি বাইক দেখেই। মেজাজ চটে গেলো মূহুর্তেই। সাদা-কালো শার্ট-প্যান্টের উপর কোট পড়া লোকটার উদ্দেশ্যে আঙুল তুলল ক্ষিপ্ত মেজাজে হিংস্র চোখে চেয়ে। কর্কশ গলায় বলল,
-“সমস্যা কি আপনার? এভাবে রাস্তা ব্লক করার মানে কি হ্যাঁ?”
সাদাফ বাইকের উপর হেলমেট রাখল৷ স্ট্যান্ড নামিয়ে ভালো করে রেখে বাইক থেকে নামল। মিশমির সামনে এসে দাঁড়ালো নৈঃশব্দ্যে৷ মিশমি তখনও কেমন করে তাকিয়ে আছে। পারলে কচকচ করে চিবিয়েই পেটে ঢুকিয়ে ফেলতো। বেচারার মুখ খানা শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে গেল। সে কাছে এসে মিশমির হাত দু’টো ধরলে মিশমি ঝাড়া মারলো। সাদাফ অসহায় চোখে তাকালো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-“এখনো রেগে আছো?”
ফুঁসে উঠলো মিশমি। ক্ষেপাটে গলায় বলল,
-“না। রাগবো কেন? খুব প্রেম পাচ্ছো আমার। প্রেম করছি তো আমি। আপনি করবেন প্রেম? আসেন দু’জন প্রেম করি, স্যা-র?”
টেনে ডাকে মিশমি। সাদাফ লাজুক হেসে অত্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
-“তোমার জন্য তো জানও করবান জানেমান। প্রেম আর এমন কি? আসো করি।”
পরপর ঝু্ঁকে পড়ে মুখের সামনে। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
-“প্রেম কিন্তু অনেক জায়গায় করা পসিবল। উম্, পার্কেও আবার বেড রুমেও। ইউ নো না ম্যাম?”
মিশমি চোখ বড় বড় করে তাকালো। এরপর আচমকা রেগে হাতের ব্যাগ দিয়ে মারতে শুরু করলো সাদাফকে। সাদাফ হাত দিয়ে ঠেকালো কোনোমতে। চেপে ধরলো মেয়েটার ফিনফিনে সরু হাত জোড়া। মিশমি থেমে গেল। নাকের পাটা ফুলিয়ে তাকালো তার দিকে। চেঁচিয়ে বলল,
-“হাত ছাড়ো। ছাড়ো। অসভ্য লোক!”
সাদাফ ছাড়লো না। আরো শক্ত করে ধরল হাত দু’টো। শুকনো মুখে তাকিয়ে বলে,
-“আমার কি করার বলো? স্যার এতো প্রেশারে রেখেছে, আমার কিছু করারই নেই। তারমধ্যে কাজের এতো চাপ আসছে ক্লায়েন্টদের থেকে, সামনে আবার নতুন প্রজেক্টে হাত দেবে। এতো এতো কাজ। আমি একা সামলে উঠতে পারছি না। তারউপর কোনো ভুল হলে শুভ্র স্যার যা মানুষ, আস্ত রাখবে না আমাকে। একটু বোঝো।”
মিশমি হাত ছাড়িয়ে নিলো জোর করে। মৃদু স্বরে বলে,
-“এতে কাজ নিয়ে পরে থাকলে প্রেম করতে কে বলেছিলো? আমি বলেছিলাম? শুধু শুধু আমার সাথে যা-তা ব্যবহার করার মানে কি? সেসবের জবাব আগে দেওয়া হোক।”
-“কাজের প্রেশারে সব গুলিয়ে আসছে আমার। তাই বাজে বিহেভ করে ফেলেছি। আমি ইন্টেনশেনালি তো আর করিনি।”
মিশমি কথা বলে না। সাদাফ এগিয়ে এলো। দু’হাতে মিশমিকে জড়িয়ে ধরলো। কেমন একটা গলায় বলল,
-“আ’ম স্যরি সোনা। আর হবে না এমন। প্রমিস।”
মিশমি বাঁকা চোখে তাকালো। সাদাফ জোর গলায় বলল,
-“প্রমিস তো। সত্যিইইইই!”
মিশমি সরে এলো। হেঁটে গিয়ে বাইকের কাছে দাঁড়ালো চুপচাপ। সাদাফ না এলে সে কপাল কুঁচকে তাকায়। সাদাফ বুঝলো। হেসে ফেলল। বাইকে উঠে বসে হেলমেট পরিয়ে দিলো মেয়েটাকে। মিশমি তার কাঁধ চেপে বাইকে উঠতেই সাদাফ হাসে,
-“বাহ, বাহ! প্রস্তাব গৃহীত বলে কি আমি ধরে নেব জান?”
মিশমি মুখ বাঁকায়,
-“নাটক না করে বাইক স্টার্ট দেও।”
সাদাফ বাইক স্টার্ট করলো। স্পিড বাড়িয়ে বলল,
-“তুমি দিন দিন বড্ড আনরোম্যান্টিক হয়ে যাচ্ছো মিশু।”
-“ফাও কথা বলো কেন এতো? আনরোম্যান্টিকের কি দেখলে?”
সাদাফ কৃত্রিম দুঃখ প্রকাশ করে,
-“এই যে, আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসো না। মূল কথা ঠিক করে কথাই বলো না। আর এটাই তো আনরোম্যান্টিক হওয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য।”
মিশমি মুখ কুঁচকায়,
-“বলছে আপনারে!”
-“হ্যাঁ। সত্যিই!”
-“আপনার সত্যি নিয়ে আপনি থাকেন৷ এখন তাড়াতাড়ি চলেন৷ আর হ্যাঁ, মা-বাবার সাথে দেখা না করে গেলে দেখেন কি করি।”
সাদাফ বলল,
-“সে দেখা করবো। আমার ফিউচার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বলে কথা! তবে তুমি এমন ঢং লাগিয়েছো কেন?”
-“কিসের ঢং, হ্যাঁ?”
মিশমি সরু চোখে তাকালো। সাদাফ লুকিং মিররে কাঁদো কাঁদো মুখ বানিয়ে তাকিয়ে বলল,
-“আপনি আপনি করছো কেন সোনা? রাগ এখনো পড়লো না?”
মিশমি দাঁতে দাঁত পিষে তাকালো,
-“পড়েছে। গাছের থেকে, আকাশের থেকে পড়েছে। হয়েছে? এখন আর একটা কথাও বললে আমি তোমাকে ছুঁড়ে মারবো বাইক থেকে আই সয়্যার।”
সাদাফ ভোঁতা মুখে সামনে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল,
-“বড্ড রুড হয়ে যাচ্ছো দিনকে দিন।”
মিশমির বাড়ির সামনে বাইক থামালে মিশমি দ্রু নামল বাইক থেকে। হেলমেট খুলে হাতে ধরিয়ে সামনে হেঁটে গেলে সাদাফ গলা উঁচিয়ে ডাকল,
-“এ্যাই মিশু?”
মিশমি দাঁড়িয়ে পড়লো। পিছে ঘুরে তাকালো কপাল কুঁচকে। সাদাফ বাইক পাশে ঠিক করে পার্ক করে হেলমেট রাখলো সেখানে। বলল,
-“একটু ভেতরেও যেতে বলবে না? কেমন গো তুমি?”
-“ইনভিটেশন কার্ড নিয়ে আসি স্যার? মালা, ফুল সব নিয়ে আসি। এক কাজ করি। ফুল ছিটিয়ে ছিটিয়ে আপনাকে ঘরে বরণ করে ঢুকাই। হ্যাঁ? ভালো হবে না?”
-“তোমার প্রেমিক হই আমি। আধুনিক ভাষ্যমতে বয়ফ্রেন্ড হই। একটু রেসপেক্ট দিলে কি জাত যাবে তোমার?”
-“নাহ! একদমই না। আসে কাছে আসেন। রেসপেক্ট দেই ধরে-বেঁধে?”
সাদাফ অত্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে তাকালো,
-“আসতাগফিরুল্লাহ! আসতাগফিরুল্লাহ! কিসব বলো তুমি? আল্লাহ! পাপ লাগবে।”
-“আপনি বললে কিছু না। আমি বললে খুব গায়ে মাখছেন যে? পল্টিবাজ ব্যাটালোক কোথাকার।”
সাদাফ হেসে ফেলল,
-“আচ্ছা, সামনে এসো।”
মিশমি ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো,
-“ কেন?”
-“আসো না!”
বড্ড মিষ্টি সুর। বড্ড নির্ভেজাল আবদার। মিশমির সুবিধার ঠেকলো না। নিশ্চয়ই ঘাপলা আছে। সে গুটি গুটি পা করে এগিয়ে এলো সামনে। দূরত্ব রেখে দাঁড়ালে আচমকা সাদাফ তার হাতে টান বসালো শক্তপোক্ত। ছোট্ট তনু শরীরে আছড়ে পড়তেই লতানো কোমড় পেঁচিয়ে ধরলো সাপের মতো৷ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফটাফট, টপাটপ দু’গালে দু’চারটে চুমু খেয়ে ছেড়ে দিলো। ভদ্র ছেলের মতো সরে এসে দাঁড়ালো হাসিমুখে। মিশমি হকচকিয়ে গিয়ে থ হয়ে গেলো। চোখ-মুখ লাল টুকটুকে। দেখে মনে হচ্ছে চরম রাগে এখুনিই ফেটে পড়বে। সে ক্ষেপে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলবে, তখুনিই ভেতর থেকে তার মায়ের ডাক এলো ভেতর থেকে,
-“মিশু? এসেছিস মা?”
উনি বেরিয়ে আসছেন বাইরে। তারা নিচ তলার ফ্লয়াটে থাকে। মায়ের আসতে ক’মিনিটও লাগবে না। চোখ বন্ধ করে খোলার আগেই হাজির হয়ে যাবে ফুড়ুৎ করে। মিশমি আঁতকে উঠলো। ঝট করে সরে গেলো সাদাফের কাছ থেকে। যেন বড়সড় কোনো অপরাধে ধরা পড়েছে। গালে লালচে রঙ লেপ্টে দিয়ে গিয়েছে। ঠোঁট কামড়ে চোখ রাঙালো সাদাফকে। নিচু গলায় গর্জে উঠলো,
-“আর একবার এমন করলে… আমি… আমি—””
সাদাফ ঠোঁট চেপে হাসি থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। বলল,
-“হু হু। বলো, বলো।”
মিশমি বলল না কিছু। আর দাঁড়ালও না। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে তড়িঘড়ি করে এপার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকে গেলো। সাদাফ বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। এলোমেলো ভাবে দুষ্টু হাসলো।
ভেতরে গিয়েই মিশমি শ্বাস ফেলে বসলো ড্রইংরুমে। মা তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কি রে সোনা, এত দেরি হলো কেন? কাজ কি বেশি ছিলো?”
মিশমি মুখে কিছু বললো না। ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে ফেলে জল খেতে গেলো রান্নাঘরে। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন মেয়ের ভঙ্গি দেখে। অদ্ভুত মেয়ে!
শুভ্র নিজের বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো। স্টেয়ারিং-এ হাত রেখে তপ্ত শ্বাস ফেললো। আজ কি কি যে হলো! এতোটা কিছু আনএক্সপেক্টেড ছিল। তার অরুকে ওখানে নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি। না যাওয়াটাই সবচেয়ে উচিৎ ছিলো। অরুর দোষ সে দেখছে না এখানে আপাতত। সে নিজেই বলেছিলো তাকে যাওয়ার জন্য। শুভ্র নিজে সামলাবে সবটা। অরুকে প্রপার সেইফটি দেওয়া তার দায়িত্ব। কর্তব্য। এতোদিন সবকিছু সেটা ভেবেই করেছে। তবে আজ কেন যেন ভিন্ন কিছু হলো। নিজের আচরনের পরিবর্তন লক্ষ করলো আজ সে। তামিমকে দেখে অদ্ভুতভাবেই আজ কেন যেন সহ্য হয়নি। রাগ হচ্ছিকো খুব। খু-উ-ব! কেন? সে জানে না।
রাগের মাত্রা এতোটা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো যে তাকে আঘাত করতেও সে দু’বার ভাবেনি। তাও এক নয় একাধিক বার! শুভ্র নিজের কাজে হতবাক। তার মেজাজ এখনো যে খুব ভালো তা-ও নয়। অরুর তখন বাঁধা দেওয়ায় আরো তেঁতে আছে। আপাতত ভালো লাগছে না কিছুই।
অরু আড় চোখে তাকালো তার দিকে। ওমনি চেয়েই পর্যবেক্ষণ করলো নিরবে। শুভ্রর নামের সঙ্গে গায়ের রঙের মিল রয়েছে। গম রঙা গায়ে কালো রঙের শার্ট ইন করে পরা ফর্মাল প্যান্টের সঙ্গে। কালো শার্টের স্লিভ ফোল্ড করা। ফোলা পেশি হাতের ভেইনস্ গুলো খুব স্পষ্ট। অরুর চোখ কপালে উঠলো। শ্বাস কেমন আটকে এলো। সে চোখ সরায় তরিত্বে। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো।
শুভ্র চোখ তুলে তাকায়। বিরক্ত মুখে নামলো গাড়ি থেকে। বড় বড় পা ফেলে লিফটের সামনে গেল। বাটন প্রেস করে দাঁড়িয়ে রইলো। লিফট ওপেন হতেই অরুর দিকে তাকালে সে সুরসুর করে ভিতরে চলে গেল। শুভ্র ঢুকতেই বাটন প্রেস করলো। লিফট ওপেন হলো নির্দিষ্ট ফ্লোরে। শুভ্র বেরিয়ে এলে অরু তার পিছু পিছু এলো। এপার্টমেন্টের সামনে এসে দরজার লক খুলতেই অরু হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে নিলো।
রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ১২
ক’পা ঢুকেছিলোই তখনই বাহুতে টান পড়লো। সে পিছে তাকাতেই এক জোড়া উষ্ণ ঠোঁট হামলে পড়লো তার নরম তুলতুলে ঠোঁটে। অরু চমকে গেলো। থরথর করে কেঁপে উঠল। তখন শুভ্রর এক হাত তখন তার কোমড় ছুঁয়েছে। অপর হাত ঘাড়ের পেছনে চেপে ধরেছে। ওষ্ঠের সংঘর্ষ নিবিড় হলে অরু চোখ খিঁচে নিলো। খামচে ধরলো শুভ্রর পেটের কাছটার শার্টের অংশ। শুভ্র আলগোছে বা পায়ে ঠেলে দরজা আঁটকে দিলো।