রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ২
ফারহানা চৌধুরী
অরু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলো ঘর ফাঁকা। কেউ নেই। সে দরজা আটকে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। শুভ্র ঘর বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছে তাকে। এটা তার ঘর। সে-ই থাকবে এখানে এখন থেকে। অরু বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেলো এ মাথা থেকে ও মাথা। ও মাথা থেকে এ মাথা। তারপর কিছু একটা মনে করে লাফিয়ে আবার উঠে বসলো৷ আচ্ছা, শুভ্র তো তাকে বিয়ের সময় সেভাবে দেখেনি, তবে আজ দেখে কি করে চিনল? অরু হাজার ভেবে-টেবেও কিছু খুঁজে পেল না। সে উঠে গিয়ে দরজা খুলে আধ মাথা বের করে উঁকি দিলো বাইরে। এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিরবে খোঁজ চালাল মেরিনার। তখনই দেখল শুভ্রকে। হাতে পানির বোতল নিয়ে এদিকেই আসছে। অরু চমকে গেল। সবার প্রথমে ধরাম করে দরজা লাগাল। তারপর গিয়ে বিছানায় বসল। ঐ লোকটাকে দেখলেও কেন যেন হাতের তালু শিরশির করে৷ কিছু একটা করে দিতে মন চায়। তার এখনো মনে পড়ে, মা একদিন হুট করে এসে তাকে বলেছিল, ‘আজ তোমার বিয়ে। তৈরি হও শিগগিরি।’
তখন অরু কি পরিমাণ অবাক হয়েছিল তা বলার বাইরে। তার বয়স তখন কমজোর ১৬-১৭। এই বয়সেই মা-বাবা তার বিয়ের কথা ভাববে তা ছিল কল্পনাতীত। এমন নয় তাদের আর্থিকভাবে খুব বাজে অবস্থায়। মোটেও না। অরুর বড়ো দুই ভাই বেশ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। রিটায়ার্ড হওয়ার পরেও একটা ভালো এমাউন্টের টাকাও তারা পায়। তখন তো আরো বাবা চাকরি করতেন। ভাইরাও চাকরি করতো। অরু সকলের ছোট হওয়ায় তাকে আদরে রেখেই বড়ো করা হয়েছে। সেখানে এমন হুট করে এসে বিয়ের কথা বলবে মা, তা অরু ভাবতেও পারেনি। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
-‘কার সাথে বিয়ে? কিসব বলছো?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মা হেসে শুভ্রর কথা বলেছিলেন। শুভ্র তার মায়ের বান্ধবীর ছেলে৷ অর্থাৎ মেরিনা আর অরুর মা সাবিনা ছিলেন বান্ধবী। অরু শুভ্রর কথা শুনে হতবাক হয়ে যায়। যেই লোকটাকে তার পছন্দ না তার বাজে ব্যবহারের জন্য, যে কি না বাইরের লোকের সাথে সামান্য সুন্দর করে দু-চারটে কথাটুকু বলতে পারে না; এমন ছেলেকে অরু বিয়ে করবে তা মা-বাবা কি করে ভাবলো? অরু তৎক্ষনাৎ ‘না’ বলে দিলে মা রেগে গেল। অরুকে ধমকালেও যখন দেখল মেয়ে তার কথায় অনঢ়, তিনি অরুর বাবা ফারুক খানকে সব জানাল। ফারুক খান মেয়েকে বোঝান, মেয়ে না মানলে কঠোর বাক্যে জানিয়ে দেন বিয়ের কথা। বিয়ে হবেই। শুভ্রর সাথেই হবে৷ অরু ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকলে তার বড়ো ভাই শাওন আর ছোট ভাই রায়হান মিলে বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। ছোট বোনের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তারা কোনো কাজ করতে নারাজ। তবে তারা তো তারা-ই। তাদের কথা গায়ে মাখলো না। তারা কথা দিয়েছে মেরিনা আর আশরাফুল তালুকদারকে। কতো শখ করে চেয়েছেন তারা তাদের মেয়েকে। অতঃপর পরদিন আসর বাদ শুভ্র আর অরুর বিয়েটা হয়েই যায়।
বিয়ে শেষ যখন শুভ্রর চলে যাওয়ার খবর শুনল সবাই তখন তাজ্জব বনে গিয়েছিল। এভাবে বিয়ের আসরে বৌ রেখে চলে যাওয়া চারটে খানি কথা নয়। তারউপর যখন অরুর কানে কথাগুলো গেল সে ভয়ানক রেগে গিয়েছিল। রাগের মাথায় ঘরে ভাঙচুর করতেও পিছপা হয়নি। এরপর মেরিনা আর আশরাফুল তালুকদার তাদের কাছে ক্ষমাও চান ছেলের এমন ব্যবহারে। তবে বিয়ে তো অস্বীকার করা যায় না, সেই হিসেবে অরুকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান তারা। শাওন আর রায়হান তৎক্ষনাৎ না করে দেয় তাদের প্রস্তাব। প্রথমত অরুর মতের বাইরে বিয়ে হলো, এরপর শুভ্র দেশ থেকে চলে গেল, এখন কি হিসেবে বোনকে ঐ বাড়িতে পাঠাবে তারা? মেরিনা আর আশরাফুল তালুকদার ফারুক খানের কাছে বড়ো অনুনয় করেই বলেছিলেন,
-‘শুভ্রর ব্যবহারে আমরা নিজেরাও কি বলব জানি না। ও এমন করবে, এসব আমরা ভাবতেও পারিনি পর্যন্ত। যা হয়েছে আমরা তাতে লজ্জিত। তবে বিয়ে তো অস্বীকার করা যায় না। আমরা অরুকে মেয়ে হিসবে নিয়ে যেতে চাই, বাড়ির বউ না। আমাদের কোনো মেয়ে নেই, অরুকে আমরা সেভাবেই দেখি। শুভ্রর জন্য আমরা নিজেদের মেয়ের সাথে সম্পর্ক কি করে নষ্ট করি বলেন?’
ফারুক খান আর সাবিনা ইতস্তত বোধ করলেও অরু এসে সবাইকে থামিয়ে দিল এক বাক্যে,
-‘আমি যাব আঙ্কেল-আন্টির সাথে।’
শাওন তাকায় তার দিকে। রায়হান তো বলেই বসে,
-‘এসব কেমন কথা? যাবি বললেই হলো?’
রোদ্দুর এবং তুমি পর্ব ১
অরুর তখন মা-বাবার প্রতি অভিমানে বিবেকবুদ্ধি খুইয়ে বসেছে। সে জেদ ধরে সে যাবেই। থাকবে না এখানে। ভাইদের হাজার কথায়ও তার জেদ অনঢ় রয়। শেষমেশ তারা হার মানে। বোনের কথায় রাজি হয়। সেদিন অরু ঘর তো ছাড়েই, সাথে বিচ্ছিন্ন করে বাবা-মায়ের সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ। তাদের জেদেই তো তার এই অবস্থা। এখন তারাও থাকুক তাদের জেদ জেদ নিয়ে। মেয়ের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, বাচাঁ-মরাকে তো কবেই কবর দিয়েছিল তারা। এখন মেয়ের থাকা না থাকাতে কিসের ফারাক?