লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২০
Fatima Fariyal
রাত তখন অনেক গভীর। শহরের বুক জুড়ে নেমে এসেছে নীরবতা। চারদিকে যেনো অচেনা এক শূন্যতা। দূরে কোথাও কুকুরের ঘেউঘেউ ডাক শোনা গেলেও সে শব্দ মিলিয়ে যায় বাতাসের মৃদু স্রোতে। মীর হাউজ যেনো গভির ঘুমে মগ্ন হয়ে আছে। শুধু এক অস্থির পদচারণার শব্দ ভেসে আসে মীর হাউজের প্রধান দরজা দিয়ে। দুলতে দুলতে ভেতরে ঢুকলো আহাদ রাজা। চোখে মুখে ক্লান্তি, শরীরে অদৃশ্য ভার। আজ রাতেও নেশায় কিছুটা মাতাল সে, তবে পুরোপুরি বেহুঁশ নয়। নিজেকে সামলাবার অদ্ভুত এক চেষ্টা তার মধ্যে এখনো বিদ্যমান।
ভেতরে ঢুকেই ধপাস করে বসে পড়লো হলঘরের সোফায়। শার্টের উপরের বোতামগুলো খানিক খোলা, চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দুটো লালচে। তাকে দেখে যে কেউ বুঝেতে তার ভেতরে অশান্তির ঝড় বইছে। এই সময় তাকে দেখে পরিচারিকা বানি এগিয়ে এলো। আহাদকে আজ একটু বেশিই এলোমেলো লাগছে তার কাছে। সে কাছে গিয়ে নরম স্নেহভরা কন্ঠে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“বাবা, তোমাকে কি আমি একটু লেবু পানি এনে দেবো?”
আহাদ ধীরে চোখ তুলে তাকালো বানির দিকে। চোখে কেমন অদ্ভুত হাহাকার। একটু মাতাল ভাঙা স্বরে বললো,
“লেবু পানি খেলে কি ওকে ভুলে যাবো খালা?”
কথাটা শুনে বানি চমকে গেলো। আহাদ ও বলতে কাকে বোঝাচ্ছে, সেটা বুঝতে পারলো না। কাছে গিয়ে আবার জানতে চাইলো,
“তুমি কার কথা বলছো বাবা?”
আহাদের দৃষ্টি কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইলো বানির দিকে। সেই দৃষ্টিতে যেনো অশ্রু জমতে চাইছে, কিন্তু সে পুরুষ মানুষ, আর পুরুষ মানুষ যে আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। এক মুহূর্ত পর মশা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বিরক্তি মেশানো স্বরে বললো,
“কই না, কেউ না! কিছু না। আ.. আমি উপরে যাচ্ছি।”
বলেই উঠতে চেষ্টা করলো, কিন্তু মাতাল শরীর ভারসাম্য হারিয়ে আবারো ধপাস করে সোফায় পড়ে গেলো। তারপর হঠাৎই পাগলের মতো এক দমকা হাসি ছড়িয়ে পড়লো তার ঠোঁটে। সেই হাসিতে যেনো যন্ত্রণার গন্ধ আর বেদনার মিশেল। বানি দাঁড়িয়ে সবকিছু চুপচাপ দেখলো, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না। অবশেষে আহাদ আবার দাঁড়ালো, পা টেনে টেনে দুলতে দুলতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলো। নিজের রুমে ঢুকেই মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিস্তব্ধতায় মোড়া চারদেয়ালে একবার দৃষ্টি বুলালো। আলো অন্ধকারের খেলায় রুমটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। বুকের ভেতরও যেনো একই শূন্যতা। শার্টের কলার টেনে একটু স্বস্তি নেয়ার চেষ্টা করলো। মাথাটা জাগিয়ে উপরে তুলে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো।
এমন সময় তার চোখ আটকে গেলো আলমারির দিকে। পা যেনো নিজে থেকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে। ধীরে ধীরে আলমারি খুলে ভেতর থেকে টেনে বের করলো তার প্রেয়সীর পরশে ভরা লাল শাড়িখানা। আহাদ শাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে। এক মূহুর্তের জন্য তার মনে হলো, ধীরে ধীরে সে এক অচেনা আবেশে জড়িয়ে যাচ্ছে। অতঃপর ধীরে মুখ ডুবিয়ে দিলো সেই কাপড়ে। শাড়ির আঁচলে লেপ্টে থাকা মেয়েলি সুবাস যেনো তার মস্তিষ্ক নাড়িয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে আরও গভীরভাবে টেনে নিলো সেই সুবাস। যেনো এই মূহুর্ত সেই গন্ধের উপর ভিওি করে তার জীবন বেঁচে আছে। কয়েক কদম পিছনে গিয়ে ধপাস করে বিছানায় এলিয়ে দিলো তার ভারী শরীর। শাড়িটাকে মুখে চেপে ধরেই আধো মাতাল কণ্ঠে বিড়বিড় করে উঠলো,
“লাল শাড়িতে তুমি দাও অগ্নি ঝলক,
তোমায় না পেলে বুকে বাড়ে শূন্য কলক।
তীব্র চাওয়ায় জ্বলে আমার হৃদয় প্রহর,
প্রেয়সী তুমি ছাড়া বিধ্বস্ত এই অন্তর।”
শব্দগুলো যেনো তার বুকের ব্যথার প্রতিধ্বনি। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত দেহ আর ভাঙা মন তাকে ঘুমের দিকে টেনে নিলো। শাড়ির আঁচল মুখে চাপা রেখেই গভীর অচেতন ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো আহাদ। তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ মিলিয়ে গেলো আঁধারের গভীরে।
এমন নীরবতার ভেতর দিয়েই কেটে গেলো টানা তিন দিন। এই কয়েক দিনে শহর যেমন নিজের ব্যস্ততায় হারিয়ে গেছে, তেমনি মানুষের ভেতরের গল্পগুলোও বদলে গেছে নিঃশব্দে। গ্রামের বিয়ের ধকল শেষ করে কালই আবার ঢাকায় ফিরেছে রিদিতারা। তবে এই ফিরে আসাটা তেমন আনন্দের হয়নি তার জন্য। বুকের ভেতর ভারি হয়ে আছে অদৃশ্য এক বোঝায়। একেতো রিদির ফোন চুরি হয়ে গেছে, যার কারনে বান্ধবিদের কারোর সাথেই আর যোগাযোগ করা হয়নি। তার উপর আহাদ রাজা তো আছেই। আজ অনেকদিন পর সে ঠিক করলো ভার্সিটিতে যাবে। তবে আগে সে আহিয়াদের বাসায় যাবে এবং সেখান থেকে আহিয়ার সাথে একত্র হয়ে ভার্সিটি যাবে। আর তাছাড়া মনে মনে ভাবলো, যদি এই সুযোগে আহাদ রাজার সাথেও দেখা হয়ে যায়। তাই স্বাভাবিক দিনের চাইতে একটু আগেভাগেই বেরিয়ে পড়লো সে।
মীর হাউজের বড় গেট দিয়ে যখন ভেতরে ঢুকছিলো, পা দুটো যেনো ভারী হয়ে গিয়েছে। বুক ধকধক করছে, অজানা এক আশঙ্কা ঘিরে ধরেছে তাকে। তবুও সাহস সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু দরজার চৌকাঠের সামনে দাঁড়িয়ে, বুকের ভেতরের দোটানায় দুলছিলো রিদি। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতর থেকে এগিয়ে এলেন হালিমা বেগম। চোখে মুখে প্রশান্তির দীপ্তি, নরম কন্ঠে বললেন,
“আরে রিদিতা! দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে আসো না।”
তার কথায় ভেতরের পরিবেশটা যেনো মুহূর্তেই সরগরম হয়ে উঠলো। ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা আসফাক মীর, আমজাদ মীর সহ আহিয়া একসাথে ঘুরে তাকালো। শুধু আদনান নিজের স্বভাবশুলভ ভঙ্গিতে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। তবে রিদিতার নাম শুনে অস্বস্তিতে হালকা নড়েচড়ে বসলো। চোখ তুলে তাকালো না ঠিকই, কিন্তু তার কপালের ভাঁজ স্পষ্ট। আহিয়া উঠে এক রকম বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় রিদিতার দিকে। দৌড়ে গিয়ে রিদিতার হাত চেপে ধরে বললো,
“কিরে তুই কবে আসলি? আর তোকে ফোন দিয়ে পাচ্ছি না কেনো?”
রিদির কন্ঠ কেমন আটকে এলো, গলা দিয়ে শব্দ বের হতে চাইলো না। তবুও কেমন ফ্যাসফ্যাস করে বললো,
“এইতো কালই আসছি। আমার ফোন চুরি গেছে, তাই কারো সাথে যোগাযোগ রাখতে পারি নাই।”
“উপরে চল, তোর সাথে কথা আছে।”
এই বলে আহিয়া রিদির হাত ধরে টেনে উপরে নিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় সিঁড়ির ধাপে পায়ের শব্দে হল ঘরের মাঝখানেই থেমে যায় তারা। শুভ্র পাঞ্জাবিতে মোড়ানো আহাদ রাজা গম্ভীর মুখে নিচে নামছিলো। আলো পড়তেই তার চোখেমুখের রূঢ়তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলো রিদি। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো, যেনো শ্বাস আটকে আসছে। দৃষ্টি মিশে গেলো আহাদের গভীর, অচঞ্চল চোখের সাথে। কিন্তু আহাদ দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, এমন ভান করলো যেনো তাকে চিনেই না। পাঞ্জাবির হাত গুটাতে গুটাতে ধীরে ধীরে নিচে এলো। চোখে মুখে কেমন কঠোর এক ভাব, হাত মুষ্ঠিবদ্ধ, যেনো নিজের ভেতরের ঝড়কে সংযত রাখার তীব্র যুদ্ধ চলছে নিজের সাথে। সে সোজা সামনের দিকে যেতেই হঠাৎ হালিমা বেগম ডাক দিলেন,
“আহাদ, নাস্তা করবি না?”
আহাদের পা থমকে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ডাইনিং টেবিলের দিকে। মুহূর্তের জন্য তার দৃষ্টি সবাইকে বিদ্ধ করে গেলো। আমজাদ মীর চুপচাপ আবার নিজের প্লেটে মন দিলেন। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করলো সে। অতঃপর কয়েক কদম হেটে, ডাইনিং টেবিলের পাশে গিয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো এক নিশ্বাষে। আদনানের দিকে তাকিয়ে আবার টকাস শব্দ করে কাঁচের টেবিলে রাখে গ্লাসটা। আদনান চোখ বন্ধ করে নিলো সেই শব্দে। আহাদ আড় চোখে তাকিয়ে আদনানের প্রতিক্রিয়া দেখছে।
এরপর আর কোন কথা বললো না, বা’হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নাকটা ঘষে নিয়ে সোজা বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো। রিদির কাঁধ ঘেঁষে চলে গেলো বাতাসের ন্যায়। এক মুহূর্তের জন্য তাদের কাঁধ একে অপরকে ছুঁয়ে গেলো। সেই ছোঁয়ায় যেনো রিদির বুকের ভেতর বজ্রপাত হলো। সে ভেবেছিলো, আহাদ এখনই বিস্ফোরিত হবে। কিন্তুু নাহ! তাকে একরাশ ভাবনায় পিছনে ফেলে রেখে চলে গেলো আহাদ। রিদি তখনো পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আহাদের চলে যাওয়া পিঠের দিকে তাকিয়ে রইলো। বুকের ভেতর অচেনা এক চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়লো। সে কাঁপা হাতে বুকে চেপে ধরলো, যেনো নিজের ব্যথাটাকে সামলাতে চাইছে। আর এসব কিছু কড়া নজড়ে বন্ধি করেছে আহিয়া। রিদির হাত শক্ত করে ধরে আবার টেনে উপরে নিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ করেই আদিল লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। রিদিকে দেখে একগাল হাসি ছড়িয়ে দিয়ে হাত নেড়ে বললো,
“হাই বিউটি!”
“হাই!”
রিদিও একচিলতে হাসি দিয়ে হাত নেড়ে জবাব দিলো। আদিল তখন ঘাড় কাত করে খেয়াল করলো, আহিয়া রিদির হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। তাই রিদির তাকিয়ে দুষ্টুমি ভঙিতে বললো,
“শাঁকচুন্নি তোমার উপর ভর করেছে নাকি? বাঁচাতে হবে?”
আহিয়া দাঁত কিড়মিড় করে উঠলো,
“আদিইইই!”
আদিল হেসে দুহাত উঁচু করে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করে দৌড়ে নিচে নেমে গেলো। আহিয়া বিরক্ত মুখে রিদিকে টেনে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। আদনান এক নজড় তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে যায়। সবার থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পরে।
আহিয়ার রুমের জানালার পর্দা অর্ধেক টানা, মৃদু বাতাসে হালকা নড়ছে। আহিয়া নিজের রুমে এসে রিদিকে বিছানার উপর বসিয়ে, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রিদি একটু অস্বস্তিতে নড়ে চড়ে বসে। ঠোঁট কামড়ে আমতা আমতা করে বললো,
“এ.. এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?”
“কেনো তাকিয়ে আছি বুঝতে পারছিস না।”
রিদি বুঝতে পারছে আহিয়া তাকিয়ে আছে কেনো? তাই কিছু বললো না। শুধু চোখ নামিয়ে আঙুলে ব্যাগের ফিতেটা কচলাচ্ছে অবচেতনভাবে। আহিয়ার ভেতরে যেনো আগুন জ্বলছিলো। এক ঝটকায় রিদির হাত থেকে ব্যাগটা টেনে নিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি, রিদি!”
“আমি কি বলবো।”
আহিয়ার চোখ যেনো আরও বিস্ফারিত হলো। ধীরে ধীরে রিদির দিকে ঝুঁকে নিচু কিন্তু ধারালো কন্ঠে বললো,
“কি বলবি মানে? আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। তুই ভাইয়াকে কি করে ভালোবাসতে পারিস?”
রিদি হঠাৎ চমকে তাকালো। কথাটা যেনো বজ্রপাতের মতো নেমে এলো তার উপর। ভালোবাসার কথা শুনে কান গরম হয়ে গেলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“কিহহ! ভালোবাসি? মোটেও না!”
আহিয়া এক চিলতে হেসে ফেললো, রিদির মুখটা কেমন লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। মুখে না বললেও তার চেহারায় সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আহিয়া চোখ সরু করে বললো,
“একদম লুকাবি না। সব জানি আমি। তুই আর ভাইয়া! আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
রিদির বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে গেলো। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে চুপচাপ জানালার দিয়ে তাকিয়ে রইলো দূরে কোথাও, কিন্তু ঘরের ভেতর অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। কিছুক্ষণ পর দৃঢ় স্বরে বললো,
“বিশ্বাস না হওয়ার কি আছে? আজব!”
আহিয়ার চোখে অবিশ্বাস আরও গাঢ় হলো। সে যেনো প্রতিটি শব্দ কেটে কেটে বললো,
“তার মানে… সব সত্যি?”
রিদি এবার কোনো অস্বীকার করলো না। শুধু চোখ নামিয়ে হালকা মাথা নাড়লো। চোখের ইশারায় বোঝালো হ্যাঁ, সব সত্যি। সে আহাদকে সত্যিই ভালোবাসে।
এক মুহূর্তে পরিবেশ আরও ভারী হয়ে গেলো। মনে হলো ঘরের বাতাস জমে গেছে। আহিয়া হতভম্ব হয়ে বসে পড়লো রিদির পাশে। কেমন যেনো অচেনা লাগছিলো রিদিকে। রিদি আড়চোখে তাকালো, আহিয়ার মুখভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলো। সে কি খুশি হবে? না কি রাগ করবে? নাকি তার জন্য কষ্ট পাবে? কিছুই বুঝতে পারলো না। বিছানার ওপর দুজন বসে আছে পাশাপাশি। কিন্তু তাদের মাঝে যেনো বোঝাপড়ার অদৃশ্য একটা দেয়াল উঠে গেছে। নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে কেটে গেলো সেই মুহূর্তটা। শুধু বাতাসে টের পাওয়া যাচ্ছিলো তাদের বুকের ভেতরের অস্থির ধুকপুকানি।
রাত তখন প্রায় তিনটা। শহরের ব্যস্ততা অনেক আগেই নিভে গেছে, কিন্তু রিদিতার ভেতরের অস্থিরতা যেন আরও বেড়ে উঠেছে। একটুও স্বস্তি পাচ্ছিলো না। বিছানায় শুয়ে সে এপাশ ওপাশ করছে, কিন্তু চোখের পাতা এক করতে পারছে না কিছুতেই। আজকে সারাদিন সে কতভাবে আহাদের সাথে দেখা করতে চেয়েছে, একটু কথা বলার অজুহাত খুঁজেছে। কিন্তুু সেই সকালে এক ঝলক দেখেছিলো তারপর আর দেখা পায়নি তার। আহাদের এই চুপচাপ থাকা, দূরে দূরে থাকা, তাকে ভেতর থেকে জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো। তার চেয়ে ভালো ছিল যদি রাগ করে কিছু বলতো, একটা থাপ্পড় দিতো, এমনকি শতবার কান ধরে উঠবস করাতো। সেটা হলেও সে নির্দিধায় মেনে নিতো। কিন্তু এই অদৃশ্য শাস্তি! এভাবে তাকে ভাবনার গহ্বরে ফেলে রাখা রিদিতার জন্য অসহনীয় হয়ে উঠছিলো।
বিরক্ত হয়ে সে উঠে বারান্দায় গিয়ে পায়চারি করতে লাগলো। এমন অদ্ভুত অনূভতি তার কখনো হয়নি। সে বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দিলো অচেতন মনে। হালকা হাওয়ায় চুল উড়ছিলো, কিন্তু তাতে তার অস্থিরতা একটুও কমলো না। হঠাৎ নিচের দিকে চোখ পড়তেই বুকটা ধক করে উঠলো। গাড়ির পাশে হেলে দাঁড়িয়ে, মুখ তুলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে একটা ছাঁয়া। রাতের আধো আলোয় পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না, তবে রিদির মন ঠিকই বুঝতে পারলো এটা আহাদ রাজা!
রিদিতার ঠোঁটের কোণে অজান্তেই এক চিলতে হাসি খেলে গেলো। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত বিছানা থেকে ওড়না তুলে নিয়ে জড়িয়ে নিলো গায়। পা টিপে টিপে বাসা থেকে বেড়িয়ে নিচে চলে আসে। প্রতেকটা ধাপে ধাপে তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। রিদিকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল আহাদ। কাছে আসতেই দৃষ্টি মিললো আহাদের সেই ঘন পাপড়িযুক্ত গাঢ়ো বাদামি চোখের সাথে। যেখানে এক অদ্ভুত ঝড় লুকিয়ে আছে। রিদি ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এলো, এতটাই কাছে যে দুজনেরই হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি তীব্র ভাবে অনিয়ন্ত্রিত হতে লাগলো। আহাদ এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কোন কিছু না বলেই ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু রিদিতা হঠাৎ পিছন থেকে আহাদের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরে। আহাদ থমকে গেলো। একেবারে স্থির। শরীর শক্ত হয়ে গেছে, যেন নড়াচড়া করার ক্ষমতাও নেই। রিদি তার হাতের মুঠোয় পাঞ্জাবি শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখে নিচু গলায় বললো,
“শুনুন না!”
আর রিদির এই বাক্যটা যেনো আহাদকে আরো কাবু করে ফেললো। এই অবস্থায় নিজেকে কি করে সংযত রাখতে হবে সে জানেনা। তবুও ধীরে ধীরে ঘুরে এক ঝলক তাকালো তার প্রেয়সীর দিকে। কিম্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না, মাথা ঝাঁকা দিয়ে অবাধ্য অনূভতিগুলোকে ফেলে দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“এই, একদম এভাবে ডাকবে না আমাকে! আমি কি তোমার বিয়ে করা জামাই? যে এভাবে বিবাহিত বউয়ের মতো ডাকছো?”
রিদি লজ্জায় গুটিয়ে গেলো নিজেকে। তার গাল গরম হয়ে উঠলো, শরীর থেকে যেন লজ্জার উষ্ণতা বের হচ্ছে। হাত কচলাতে কচলাতে নিচু গলায় বললো,
“আমি তো এমনি ডাকলাম..!”
আহাদ এবার চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“এমনি ডাকবে কেনো? বিবাহিত বউয়ের মতো ডাকছো, বিবাহিত জামাইয়ের মতো আচরণ করলে সামলাতে পারবে?”
আহাদের এই লাগামহীন আগোছালো কথা শুনে আরো গুটিয়ে গেলো। বুকের ভিতর হৃদপিণ্ড এমনভাবে লাফাচ্ছে যেনো আর একটু পরেই বেড়িয়ে আসবে। সে মাথা নিচু করে চোখ পিটপিট করে বললো,
“আমি তো শুধু… আপনি চলে যাচ্ছিলেন বলে ডাকলাম।”
“চলে যাবো না তো কি করবো? এখানে থাকার জন্য এসেছি?”
“তাহলে এলেন কেনো?”
আহাদ এক মুহূর্ত নীরব রইলো। চোখে এক ঝলক অদ্ভুত দৃষ্টি খেলে গেলো। ঠাণ্ডা স্বরে বললো,
“আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই।”
রিদির বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। মন খারাপ হয়ে গেলো তার। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। আহাদ প্রেয়সীর সেই গুটিয়ে যাওয়া অবয়বের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই কয়দিন যে রাগের কুণ্ডলী নিয়ে ঘুড়ে বেড়িয়েছে তা এক নিমিষেই গলে বরফে পরিণত হলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে কপাল গুঁজে রেখে নরম গলায় বললো,
“হাত দেখি।”
“হাত?”
সে বুঝতে পারলো না হঠাৎ এভাবে হাত চাইলো কেনো। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো আহাদের দিকে। আহাদ এবার খানিকটা বিরক্ত হলো। সব কিছু দু’বার কেনো বলা লাগে এই বান্দিকে বোঝেনা! একটু ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলো,
“হাত দিতে বলেছি তো!”
রিদি ধীরে ধীরে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো। হাতটা কাঁপছিলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে, যেন নিজের কথা নিজেই মানছে না। রাতের শীতল বাতাস তার শরীরে ছুঁয়ে যাচ্ছে, তবু তার হাতের তালু জ্বলছে উত্তাপে। আহাদ এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। তার চোখে দ্বিধা আর গভীর স্নেহের মিশেল। শেষমেশ নিজের উষ্ণ হাতের মুঠোয় রিদির হাতটা শক্ত ধরে। উষ্ণতা যেন তৎক্ষণাৎ ছড়িয়ে গেলো রিদির শরীরে। গভীর মোলায়েম স্বরে বললো,
“কাঁপছো কেনো? ভয় পাও আমাকে?”
রিদি দুই দিকে ধীরে মাথা নাড়লো। না, অর্থাৎ সে ভয় পায়না। কিন্তু চোখের কোন লজ্জায় চিকচিক করলো। আহাদ বুঝলো ভ’য় না পেলেও লজ্জার শিহরিত হয়েছে তার প্রেয়সী। সে আর কিছু না বলে নিজের পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকালো। ধীরে ধীরে বের করে আনলো একটা ছোট বক্স। বক্স খুলেতেই চোখে পরলো, রংধনুর মতো কয়েক রঙের ঝিনুক আর স্বচ্ছ কাঁচের মতো পাথরের তৈরি একটি ব্রেসলেট। হালকা আলোয় পাথরগুলোর ঝিলিক চারপাশের অন্ধকার ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছে।
রিদি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো। তার নিশ্বাস যেন আটকে গেছে। আহাদ কোন দ্বিধা না করে ব্রেসলেটটা রিদির কব্জিতে পরিয়ে দিলো। তার উষ্ণ আঙুলগুলো স্পর্শ করে গেলো রিদির হাত। হাতটা ঘুরিয়ে একবার দেখে নিলো, যেন শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মত মানিয়েছে কিনা। অতঃপর ধীরে হাতটা ছেড়ে দিয়ে নির্দ্বিধায় বললো,
“এখন ঠিক আছে। ব্রেসলেটটা তার নিজের জায়গা খুঁজে পেয়েছে। তোমার হাতের কারণে এটার সৌন্দর্য বেড়ে গেছে। তা না হলে ফিকে লাগছিলো।”
রিদি যেন হঠাৎ ভাষা হারিয়ে ফেললো। কি বলবে খুঁজে পেলো না। শুধু তাকিয়ে থাকলো নিজের কব্জির দিকে, যেখানে ব্রেসলেটটা ঝলমল করছে। ঠোঁটের কোনে এক অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি ফু্টিয়ে ধীরে বললো,
“আপনি কি এতো রাতে এটা দিতে এসেছিলেন?”
“উহুম।”
রিদি আবার প্রশ্ন করলো, “তাহলে কেনো এসেছেন?”
“এমনই।”
“এমনই? তাহলে এটা দিলেন কেনো?”
“ঠিক আছে, খুলে ফেলে দিচ্ছি।”
এই বলে সে এগিয়ে এসে রিদির হাত থেকে ব্রেসলেটটা খুলতে উদ্যত হলো। রিদি হঠাৎ ঝটকা মেরে হাতটা পিছিয়ে নিলো, নিজের পিছনে লুকিয়ে রাখলো। একটু জোরে বলে উঠলো,
“নাহহ!”
তারপর আহাদের চোখে চোখ রেখে বললো,
“এটা থাকুক।”
আহাদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রিদির দিকে। তার চোখের ভেতরে এক অদ্ভুত নরম আগুন, যা রিদির মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। রিদি অস্বস্তিতে নজর নামিয়ে নিলো। নিজের ওড়নার কোন নিয়ে আঙুলে পেঁচাতে লাগলো। হঠাৎ আহাদ নেশালো গলায় ডাকলো,
“মিস জানু.!”
“হুমম..”
বলেই রিদি বুঝলো, সে কি ডাকের জবাব দিলো! লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে গেলো। আর সেই লালচে মুখ আর লজ্জার ঢেউ দেখে আহাদের ঠোঁটের কোণে এতোদিন পর এক ঝলক হাসি ফুটে উঠলো। রিদি মুহূর্তটা সামলাতে না পেরে ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হলো। কয়েক কদম যেতেই আহাদের গভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“না বলে চলে যাওয়ার অভ্যাসটা গেলো না।”
রিদির পা থেমে গেলো। সে ঘুরে আহাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ম… মানে?”
আহাদ কয়েক কদম এগিয়ে এসে রিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“না বলে আর কখনো চলে যাসনা জানু.! বড্ড এলোমেলো হয়ে যাই আমি। এই অগোছালো আহাদ রাজাকে সাজা দেয়ার কি আর অন্য কোনো বিকল্প পথ ছিলো না, হুঁ?”
রিদির নিশ্বাস যেন গলায় আটকে গেলো। বুকটা হাপরের মতো উঠানামা করছে। আহাদের নেশালো কণ্ঠের ভার সে নিতে পারছে না। কোন রকমে টেনে টুনে দুটো শব্দ বের করলো,
“আর যাবো না।”
আহাদ একটু সরে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ালো। চোখে কৌতূহল আর তৃষ্ণা। তার মুখ থেকে সেই কথাটা আরেকবার শুনতে চাইলো। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
“কি বললে?”
রিদিও কম কিসে। সে এখন আহাদের মনের খেলা বুঝে গেছে। চোখে একরাশ বুদ্ধিদীপ্ত হাসি নিয়ে কথাটা ঘুরিয়ে বললো,
“বলেছি আমি এখন আসছি। আল্লাহ হাফেজ।”
এই বলে রিদি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। অজানা অনুভূতি নিয়ে দৌড়ে বাসার ভেতরে চলে গেলো। আহাদ কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্ধকারে রিদির অবয়ব মিলিয়ে গেলো। সে দাঁড়িয়ে রইলো অচল হয়ে। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত শূন্যতা, ঠোঁটে অদ্ভুত তিক্ততা। সে ভেবেছিলো, হয়তো আজ তাদের দূরত্ব মিলিয়ে গেছে। কিন্তু নাহ! এই আল্লাহর বান্দি সেটা হতে দিলো না। ঠিকই তাকে ফেলে রেখে চলে গেলো। আহাদ দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বললো,
“ঠিক আছে, মিস জানু! সবকিছু সেই কাঙ্ক্ষিত দিনের জন্য তুলে রাখলাম। তবে আমার আপনার জন্য বড্ড চিন্তা হচ্ছে, আপনি কি এতোকিছুর ধকল সামলাতে পারবেন?”
লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ১৯
এ কথা বলে আহাদ একটা বাঁকা হাসি দিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে বসে। রাতের নীরবতার ভেতর তার নিঃশ্বাস আর রিদির উষ্ণতার স্মৃতি মিলেমিশে ধোঁয়ার মতো ভেসে রইলো।