লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২২

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২২
Fatima Fariyal

আহাদ রাজার কালো গাড়ি এসে থামলো মিরপুর এগারোতে, রিদির বাসার সামনে। বাইরের আকাশটা যেনো ক্লান্ত, বিকেলের শেষ আলোটা ঢলে পড়েছে শহরের ধূসর গায়ে। গাড়ির ভিতর তখন এক ধরনের নীরবতা, শুধু শ্বাস নেওয়ার শব্দগুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। রিদি পাশে বসে জানালার বাইরে তাকানোর ভান করলেও, আড়চোখে দেখছিল আহাদকে। আর আহাদ সরাসরি তার দিকেই তাকিয়ে আছে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে। যেন হাজার কথা জমে আছে সেই চোখে অথচ মুখ খুলে কিছু বলার ক্ষমতা নেই। রিদির কপালে একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ, কনুইতেও সাদা ব্যান্ডেজ মোড়ানো। অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে যাওায়াতে কপাল কনুই সহ আরো কয়েক জায়গায় আঘাত পেয়েছে। আর আহাদ সেই ক্ষতগুলোর দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে, যেনো প্রতিটা কাটা দাগ তার বুকে খোঁচা মারছে। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিদির দিকে, তার চোখে কেবল অনুশোচনা, অপরাধবোধ, আর ভ’য়। আজ যদি ওটা রাবার বুলেট না হয়ে ধাতব বুলেট হতো? তাহলে হয়তো সে তার প্রেয়সীকে… না না, আর ভাবতে পারছে না। সে মাথা নাড়ে দু’আঙুল দিয়ে কপালে চেপে ধরলো। রিদি সেটা লক্ষ্য করে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো,

“কি হয়েছে আপনার? মুখটা এরকম লাগছে কেনো? কি ভাবছেন?”
আহাদ চোখ তুলে তাকায় সরাসরি রিদির চোখে। রিদির কালো চোখের গভীরে এক টুকরো আলো ঝিকমিক করছিলো। আর আহাদের চোখে ছিলো তীব্র যন্ত্রণা, অজানা এক কষ্টের ছাঁয়া। দুজনার দৃষ্টি মিললো এক অদ্ভুত ভারে, এক অজানা ভ’য়ে’র মধ্যে। মুহূর্তটা স্থির হয়ে গেলো। গাড়ির এসির ঠান্ডা বাতাসও যেন থেমে গেলো তাদের নিঃশব্দতার সামনে। কিছুক্ষণ পরে আহাদ বহু কষ্টে ভঙ্গুর কন্ঠে বললো,
“আজকে যদি তোমার সাথে আমার এটাই শেষ দেখা হয়?”
এক মুহূর্তে রিদির মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। তার বুকটা যেন ধপ করে নেমে গেলো নিচে। সরু ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“মা…মানে শেষ দেখা মানে? আ.. আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?”
আহাদ ঠোঁট চেপে সামান্য মাথা নেড়ে বললো, “উহুম।”
“তাহলে?”
“যদি আমি এই রাজনীতি ধামাচাপায় প্রান হারাই, তাহলে কি তুমি..”
কথা সম্পুর্ন করতে পারলো না আহাদ, গলা আটকে আসলো তার। রিদি ঠোঁট ফুলিয়ে নিলো, চোখ জোড়া ছলছল করছে। যে কোন মূহুর্তে অশ্রু গড়িয়ে পরবে এমন একটা অবস্থা। তবু কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“কি ব ল ছেন আপনি এসব। হঠাৎ করে এমন কথা কেনো বলছেন?”
আহাদ গলা পরিষ্কার করতে চাইল, কিন্তু গলাটা কেমন যেনো ভাষ্পে ঢেকে গেলো। শেষ পর্যন্ত চোখ নামিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে বললো,
“আ.. কিছুনা, তুমি আসতে পারো। আমার সময় নেই, এমনেইতেই আজকে তোমার পিছনে আমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে।”
আহাদের কথাগুলো যেন ছুরির মতো গেঁথে গেলো রিদির বুকে। দৃষ্টি স্থির রেখে ঠোঁট চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,
“আমার জন্য আপনার সময় নষ্ট হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”

নির্দিধায় উত্তর দিলো আহাদ। রিদি ঠোঁট কামড়ে নিজের আবেগ সামলে বললো,
“ঠিক আছে, আমি আসছি। আর আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত।”
এই বলে সে দরজা খুলে নামতে যাচ্ছিলো। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার আগেই আহাদ তার কব্জি ধরে ফেললো। রিদির বুক ধুকপুক করে উঠলো, চোখে একটুখানি আশার আলো। সে ভেবেছিলো হয়তো এখন আহাদ কিছু বলবে, কিছু ব্যাখ্যা দেবে, হয়তো থামাবে তাকে। কিন্তু না, তাকে নিরাশ করে দিয়ে আহাদ শুধু তার ব্যাগটা হাতে ধরিয়ে দিলো। একবার মুখ তুলে তাকালোও না তার দিকে। রিদির বুক কাঁপছিলো। তার মনে হচ্ছিলো, এই মুহূর্তে যদি কেউ তার ভেতরটা খুলে দেখে, তবে দেখবে সেখানে ভাঙা কাঁচের মতো ছড়িয়ে আছে হ্রদয়। রিদি ঠোঁট চেপে, বুকের ভিতর কাঁপন নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। দৌড়ে ঢুকে গেলো বাসার ভিতর।

আহাদ স্থির হয়ে বসে রইলো গাড়ির সিটে। রিদির অবয়ব মিলিয়ে যেতে দেখলো। এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত অতঃপর যেন পুরো পৃথিবীটাই নিঃশব্দ হয়ে গেলো। তার চোখে ঝাপসা আলো, বুকের ভিতর কেমন এক অদ্ভুত শূন্যতা। একটা ভারি নিঃশ্বাস জমে উঠলো। সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“আমাকে একটু সময় দাও, মাএ আর কয়েকটা দিন। জাস্ট নির্বাচনটা শেষ হওয়া অবধি। তারপর আমি সব ঠিক করে দেবো জানু, সব! শুধু একটু সময়ের প্রয়োজন আমার। আমি চাইনা আমার জন্য তোমার কোন ক্ষতি হোক। ”
বাক্যগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে আহাদের বুকটা যেন ভিতর থেকে চিৎকার করে উঠছিলো। প্রতিটি শব্দ কেটে কেটে আসছিলো ভেতর থেকে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। কালো গাড়িটা ধীরে ধীরে শহরের যানজটের ভিতর মিলিয়ে গেলো, যেন এক অপূর্ণ ভালোবাসা ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে ঢাকার আকাশে।

এদিকে রিদি উপরে আসতেই এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ঈশানী, দরজা আগেভাগে খুলে রেখেছে যেন জানতো রিদি এখনই ফিরবে। রিদির পদক্ষেপ ধীর হয়ে এলো। হালকা বাতাসে তার চুলের গোছা এলোমেলো হয়ে মুখে এসে পড়লো। ঈশানী কঠিন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে। অতঃপর ঠান্ডা অথচ তির্যক গলায় বললো,

“একটা দিনও কি তুই শান্তিতে থাকতে দিবি না? প্রতিদিনই একটা না একটা কাণ্ড ঘটাবি তুই?”
রিদির ভিতরটা মুহূর্তেই জ্বলে উঠলো। এমনিতেই মেজাজ খারাপ, তার উপর বোনের এই কটাক্ষ যেন কাঁটার মতো বিঁধলো। সে খানিকটা বিরক্ত স্বরে বললো,
“কি করেছি আমি? আমাকে নিয়ে যদি তোমাদের এতোই সমস্যা থাকে, তাহলে বলো আমি চলে যাচ্ছি!”
এই বলে ঈশানীর পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো। জুতা খুলে পা ফেলে ধপধপ করে রুমের দিকে যাচ্ছিলো, তখনই পিছন থেকে ঈশানীর কণ্ঠস্বর ছুরির মতো কেটে গেলো বাতাসের মধ্যে দিয়ে,
“কার কাছে যাবি, ওই আহাদ রাজার কাছে?”
রিদির পা থেমে গেলো। শরীররে এক মুহূর্তে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে গেলো। ধীরে ধীরে ঘুরে তাকালো বোনের দিকে। ঈশানী তখনও দাঁড়িয়ে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রিদির গলায় কাঁপুনি,

“ম.. মানে?”
ঈশানী এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
“বুঝতে পারছিস না? বুঝিয়ে বলতে হবে? অবশ্য তোকে তো বুঝিয়েও লাভ নেই। আমি আগেই বলেছিলাম, ওই আহাদ রাজার থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, এখন তো তোদের নিয়ে ব্রেকিং নিউজও চলছে।”
রিদির ভ্রু কুঁচকে গেলো। মাথার ভেতর ঘুরছে হাজার প্রশ্ন, ঈশানী কোন নিউজের কথা বলছে? তখনই ঈশানী রিমোট তুলে টিভি অন করলো। স্ক্রিনে তখন নিউজ চলছে, হেডলাইনে ছিলো,
“নিজের জীবন ঝুঁ’কি’তে ফেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলেকে বাঁচালো এক তরুণী।”
ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রিদি রাস্তায় পড়ে আছে, মাথাটা আহাদের উরুর উপর। রিদির চোখ বড় হয়ে গেলো। ভ’য়ে ভ’য়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে তাকালো বোনের দিকে। ঈশানী এবার ক্ষোভে ফেটে পড়লো,
“কী এসব? এখন চুপ করে আছিস কেনো? আমি তোকে আগেই সন্দেহ করেছিলাম রিদি। কিন্তু তুই যে আমার কাছ থেকে এতো বড় সত্যিটা লুকাবি, সেটা ভাবিনি।”

“ক.. কি লুকিয়েছি আমি।”
দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো রিদিতা, ঈশানী এবার এগিয়ে এসে চোখ রাঙিয়ে বললো,
“এখনো অভিনয় করছিস? এখন যদি আব্বু বা মামা এই নিউজ দেখে তখন কি হবে বুঝতে পারছিস? তোর পড়াশুনা তো গোল্লায় যাবেই, সাথে আমাকেও কি কি শুনতে হবে তার ঠিক নেই।”
রিদি মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। তার নীরবতাই যেনো সব স্বীকারোক্তি। ঈশানী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গলার স্বর একটু নিচু করে জিজ্ঞেস করলো,
“রিদি, সত্যি সত্যি বল, তোর আর আহাদ রাজার মধ্যে ঠিক কি চলছে?”
রিদি ঠোঁট কামড়ে ধরলো, কোন ভনিতা না করে চোখ নামিয়ে বললো,
“আমি… ভার্সিটিতে প্রথম দিন উনিকে দেখে ক্রাশ খাই। তারপর থেকে উনিকে আমি প.. প পছন্দ করি।”
ঈশানী তাছিল্যের হাসি দিয়ে হাত নেড়ে বললো,
“হাহ..! তিনবেলা ভাত খাস না ঠিক করে, আর এখন গেছিস ক্রাশ খাইতে! তাও আবার বদমেজাজি, লাগামহীন ওই আহাদ রাজার উপর! ”

রিদি এবার সাথে সাথে প্রতিবাদ করলো, চোখে একরাশ জেদ নিয়ে বললো,
“তুমি উনিকে যেমনটা ভাবো, উনি আসলে তেমনটা না। মিডিয়াতে যা দেখায় তার অর্ধেকটাই মিথ্যা। উনি খারাপ না, তুমি সেটা বুঝবে না।”
ঈশানী হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে। তার চোখে অবিশ্বাস, হতাশা আর একটুখানি বিস্ময়। কপাল গুছিয়ে ধীরে ধীরে বললো,

“এতোদিন শুনেছি মানুষ প্রেমে অন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তুই তো অন্ধের সাথে সাথে বধির হয়ে গেছিস। সব জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছিস রিদি। এরপর যদি কিছু হয়, আমাকে বলতে আসিস না, আমি এর মধ্যে নাই।”
রিদি কোনো উত্তর দিলো না। শুধু একবার চোখ পিটপিট করে তাকালো বোনের দিকে। ঈশানীকে এখন একটু শান্ত মনে হলো। তাই সে নিজের রুমে চলে গেলো, ওপাস থেকে ধপ করে দরজাটা বন্ধ কর দিলো। ঈশানী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো সেই দরজার সামনে। দুই আঙুল কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলো। মনে হচ্ছে, সামনে এক অজানা ঝড় আসছে, যার শুরুটা সে দেখছে আজ কিন্তু শেষটা কোথায় তা সে নিজেও জানে না।

রাতের আকাশটায় অন্ধকার একটু তীব্র হয়ে এসেছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোতে মাঝে মাঝে ছাঁয়া পড়ছে দূরের বিল্ডিংগুলোর জানালায়। শহরের কোলাহল কিছুটা কমে এসেছে কিন্তু মীর হাউজে ঠিক তার উল্টো চিত্র, ড্রইংরুমে একরকম শোরগোল পরেছে। যে যার মতো গল্প করছে, হাসছে সব মিলিয়ে যেন এক উচ্ছ্বাসের উৎসব। শুধু আদনান তার চিরচেনা ভঙ্গিতে শিড়দাড়া সোজা করে বসে আছে। এই সময়েই মূল দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো আহাদ রাজা আর আসফাক মীর। দরজা খোলার সাথে সাথেই ঘরের কোলাহল যেন এক দমে বেড়ে গেল। আহাদ চারপাশে চোখ বুলিয়ে ধপ করে এসে বসলো আদনানের মুখোমুখি সোফায়। আসফাক মীরও খানিকটা অবাক হয়ে বসতে বসতে আদিলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,

“কিরে, কাহিনি কি? এতো তোলপাড় কেনো?”
আদিল চওড়া হাসি দিয়ে মিষ্টি তুলে নিয়ে বাবার মুখে পুরে দিয়ে বললো,
“আগে মিষ্টি মুখ করো, তারপর বলছি।”
“কেনো?”
“কারণ তুমি শশুড় হতে যাচ্ছো।”
এক মুহূর্তের জন্য চারদিক নিস্তব্ধ। আসফাক মীর মিষ্টিটা মুখে নিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলেন হালিমা বেগমের দিকে। আর ঠিক তখনই আহিয়াও এসে ভাইয়ের পাশে বসলো। হালিমা বেগম একটা মিষ্টি আহিয়ার মুখে, আরেকটা আহাদের মুখে পুরে দিয়ে উচ্ছ্বসিত স্বরে বললেন,
“আরে! আদনানের বিয়ে ঠিক হয়েছে, সবাই মিষ্টি মুখ করো। এতোদিন পর মীর হাউজে একটা খুশির খবর এলো।”
এই কথাটা শোনা মাএই আহাদ আর আহিয়া একসাথে চমকে তাকালো আদনানের দিকে। দুজনের মুখেই মিষ্টি আটকে গেলো, না গিলতে পারছে না ফেলতে পারছে।
তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আফরোজা শেখ কপাল কুঁচকে বললেন,

”কি সমস্যা তোমাদের দুজনের, এমন ভূতুম পেঁচার মতো হা হয়ে আছো কেনো?”
মায়ের কথায় দু ভাইবোন একে অপরের দিকে তাকালো। নিজেদের অবস্থা বুঝতে পেরে দ্রুত মুখ থেকে মিষ্টি ফেলে দিলো। আহাদ জ্বিব দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে। আদনানের দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি টেনে বললো,
“ওর মতো শুচিবায়ুর কপালে মেয়েও জুটলো! কোন আধপাগল রাজি হলো মেয়ে দিতে?”
আফরোজা শেখ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন,
“মুখে লাগাম টানো বেয়াদব ছেলে। ওর কপালে তো তাও জুটেছে, তোমার কপালে সেটাও জুটবে না।”
আহাদ তার মায়ের কথায় একটু জোড়ে এসে ফললো। অতঃপর একটু ঝুঁকে বসে আদনানের দিকে, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললো,

“আহাদ রাজার কপালে জুটতে হয় না। যেটা আহাদ রাজার সেটা আহাদ রাজা ছিনিয়ে নিতে জানে।”
আদনানও এবার একটু ঝুঁকে আহাদের মুখমোখি হয়ে বসলো। চোখে ঠান্ডা তাচ্ছিল্য, ঠোঁটে মাপা হেসি টেনে দৃঢ় গলায় বললো,
“চ্যালেঞ্জ করছিস তাহলো? তবে এবার বাজি জেতা তোর জন্য দুষ্কর হবে।”
“চ্যালেঞ্জ না, সত্যি বলছি। আহাদ রাজা এই উনএিশ বছরের জীবনে কোনো বাজিতে হারেনি। আর হারবেও না।”
কথাটা দৃঢ়তার সাথে বললো আহাদ, আদনান চোখ ছোট করে বাঁকা হাসি ছুড়ে দিয়ে বললো,
“কনফিডেন্স ভালো, তবে ওভার কনফিডেন্স ভালো না। তোর জন্য এখনই আফসোস হচ্ছে আমার। এইবার তুই গো হারা হারবি।”

এই বলে দু’বার ‘চ’ সূচক শব্দ করলো। আহাদের গাঢ়ো বাদামি চোখের মণি যেন লালচে হয়ে উঠলো। চোয়াল শক্ত, কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লো আদনানের দিকে। আদনানের শার্টের কলার ধরে একটা ঘু’ষি বসিয়ে দেয় মুখ বরাবর। তার ঠোঁট কে’টে কিন্চিৎ র’ক্ত বেরিয়ে আসলো। আবার হাত তোলে আহাদ তখনই আসফাক মীর আর আদিল ছুটে এসে আহাদকে টেনে পিছনে সরিয়ে নিয়ে আসে। মূহুর্তেই পুরো ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। সবাই যেন শ্বাস আটকে তাকিয়ে আছে দুই ভাইয়ের দিকে। রিতু আর বানি এক কোণে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, আহিয়া ভ’য়ে গুটিশুটি মেরে হালিমা বেগমের পিছনে এসে দাঁড়ায়। আফরোজা শেখ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রাগত্ব গলায় বললেন,

“নিজেদের সংযত করো! তোমরা এখন আর ছোট নও,
যে প্রতিটা কথা নিয়ে বাজি ধরবে আর লড়বে। তোমাদের দুই ভাইয়ের এই লড়াই দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত!”
আহাদ সাথে সাথে কর্কশ গলায় উওর দিলো,
“তাহলে চোখে পট্টি বেধে রাখো। দেখতে কে বলেছে তোমাকে?”
এই কথাটা শুনে আফরোজা শেখের মুখ লাল হয়ে গেলো। চোখে আগুন জ্বলে উঠলো, বুক ওঠানামা করছে রাগে। এই ছেলের কোন কথা মাটিতে পরবে না, সব কথার উওর দিতেই হবে। তিনি জানেন এই ছেলের সাথে তর্ক মানে দেয়ালে মাথা ঠোকার মতো। তাই কিছু না বলে কটমট চোখে এক ঝলক তাকালেন দুই ছেলের দিকে। এরপর গটগট করে নিজের রুমে চলে গেলেন। আহাদ আবার আদনানের দিকে তাকালো। আদনান তখনো সেই একই ভঙ্গিতে বসে আছে, ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসি টেনে বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে ঠোঁটের কোন মুছলো। এই দৃশ্য সহ্য হলো না আহাদের। সে আরও ক্ষীপ্ত হয়ে তার দিকে তেড়ে গেলো, কিন্তু আসফাক মীর এবার সামনে এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন,
“স্টপ, আহাদ। অনেক হয়েছে।”

আহাদ চাচার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে, বা হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা নাকটা ঘষে নিয়ে নিজের রাগ সংযত করার চেষ্টা করলো। অতঃপর ধপধপ শব্দ তুলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। তার চলে যাওয়াতে হলঘরের পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হলো। আসফাক মীর হতাশ হয়ে হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আদনান দু বাহু ঘুরিয়ে নিজের শার্ট ঠিক করলো, তারপর সামনে রাখা ঠাণ্ডা পানির গ্লাস তুলে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিলো। মুখে কোনো ভাব নেই, যেন কিছুই ঘটেনি। তখনই আহিয়া একটু কাছে এসে আদনানের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,

“কংগ্রাচুলেশন্স, আদনান ভাই।”
“কেনো? তোর ভাইয়ের হাতে মার খেয়েছি তার জন্য?”
“না, এই যে আপনার বিয়ে ঠিক হলো।“
আদনান হালকা ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তর দিলো,
“ওহহ, ধন্যবাদ।”
আহিয়া এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে থেকে সোজা নিজের রুমে চলে আসলো। তার চোখে হালকা কুয়াশা, বুকটা কেমন কেমন করছে। এমন অনূভতি তো তার আগে কখনো হয়নি। সে তো সব সময় চেয়েছে আদনান যেনো বিয়ে করে, তবে আজ সেই খবরে তার খুশি কেনো হলো না। কেনো এমন অস্হিরতা লাগছে তার। কেনো বুকটা ধকধক করছে, এমনটা তো হওয়ার কথা না। আয়নার নিজের প্রতিবিম্বর দিকে তাকিয়ে জোড় পূর্বক একটা হাসি আনলো ঠোঁটে কিন্তু ঠোঁট কাঁপছে। নিজের প্রতিচ্ছবিকে বললো,

“কি সব ভাবছিস আহিয়া? ছি!”
মাথা নেড়ে সব উল্টাপাল্টা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিলো। অতঃপর ঘুরে এসে বিছানায় বসলো, জানালা খোলা থাকায় বাইরে থেকে মৃদু বাতাস ঘরে ঢুকছে, সাথে পর্দা নড়ছে ধীরে ধীরে। আহিয়ার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে, কিছুতেই মনটা স্থির হচ্ছে না। বুকে যেন এক অজানা দোলাচল। কিন্তু আহিয়া এই অস্থিরতার কারন বুঝলো না।

সোফার ওপর পা তুলে, নিজের উরুতে চিবুক ঠেকিয়ে বসে আছে রিদিতা। চোখো মুখে হালকা ক্লান্তির ছাঁপ। কপালের সামনের ছোট ছোট চুলগুলো বারবার চোখের সামনে এসে পড়ছে, আর সে বিরক্ত মুখে ফুঁ দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। ঘরে এক ধরণের স্থিরতা ছড়িয়ে আছে। ঠিক তখনই রিদিতার সামনের সোফায় এসে বসলো সুমন। দুই হাত ছড়িয়ে পেছনে ভর দিলো। রিদি চোখ তুলে এক ঝলক তাকালো তার দিকে, অতঃপর আবার দৃষ্টি নামিয়ে আনলো নিজের হাতে থাকা কুশনের দিকে। সুমন একটু চুপ থেকে, ঠোঁটে চেনা হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“তুমি এতো সাহসী কবে হলে, ছোট্ট গিন্নি? স্পাইডারম্যান না না, স্পাইডারউওমেনের মতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলেকে বাঁচালে!”
তার কণ্ঠে একরকম মজার ছল, কিন্তু রিদি কিছু বললো না। শুধু আড় চোখে একবার তাকালো সুমনের দিকে। সুমন আবার প্রশ্ন করলো,

“একটা কথা বলতো, তুমি ওখানে কি করছিলে?”
রিদি নিচু গলায় উত্তর দিলো,
“আমরা বসুন্ধরা যাচ্ছিলাম। আর তখনই হঠাৎ করে এসব ঘটলো।”
কথাটা শান্তভাবে বললেও আজকের ঘটনাটা তার চোখে একটুখানি ঝলক দিয়ে উঠলো। সুমনও আর সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করলো না। পাশ থেকে একটা ছোট্ট শপিং ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে দিলো তার দিকে। রিদি একটু কপাল কুঁচকে তাকালো,

“কি এটা?”
“খুলে দেখো।”
রিদি ব্যাগটা হাতে নিলো, ভিতরে হাত দিয়ে বের করে আনতেই দেখলো, ব্র্যান্ড নিউ ফোন। তার চোখে বিস্ময়, মুখে হাসি ফুটে উঠলো,
“এটা আমার ফোন? থ্যাঙ্ক ইউ ভাইয়া!”
সুমন এক গাল হেসে, গলায় মজা এনে বললো,
“শুধু ধন্যবাদ দিলে হবে না, এখন আমার জন্য এক কাপ চা করে নিয়ে আসো।”
মুহূর্তেই রিদির মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
“এতো রাতে কে চা খায়।”
“আমি খাই। যাও নিয়ে আসো।”

“আপনি আর আপনার বউ মিলে আমাকে বড্ড খাটান সুমন ভাই, এটা ঠিক না।”
এই বলে রিদি গাল ফুলিয়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে সুমন হালকা হেসে ফেললো। এরপর ফোনটা হাতে নিয়ে বসে পড়লো, সেটিংস ঠিক করতে হবে সাথে নতুন সিমও সেট করতে হবে। এমন সময় ঈশানী এসে বসলো তার পাশে। কাঁধে হালকা করে হাত রেখে ফিসফিস স্বর বললো,
“শুনছেন, কাল আব্বু আম্মু সহ সবাই আসছে। মামাও নাকি আসবে।”
সুমন ফোন থেকে চোখ না তুলে বললো,
“হঠাৎ সবাই? কারন কি?”
ঈশানীর চোখে ভয়, গলায় কাঁপুনি,
“আমার মনে হয় আব্বু নিউজটা দেখে ফেলেছে। তা না হলে এমন হুট করে আসবে কেনো? আমার খুব ভ’য় করছে।”

সুমন এবার ফোনটা টেবিলে রেখে ঈশানীর দিকে তাকালো। মুখে ঠাণ্ডা ভাব, কিন্তু চোখে একটুখানি চিন্তার ছাঁয়া,
“ভয়ের কি আছে! আজব কথা বলো না। বাবাকে আমি বুঝিয়ে বলবো। তুমি চিন্তা করো না।”
সুমন একটু সোজা হয়ে বসলো, ঘাড় কাত করে রান্নাঘরের দিকে তাকালো। দেখলো, রিদি মগে চা ঢালছে। সুমন চুপচাপ তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঈশানী তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, আসন্ন ঝড়ের আগমনী বার্তা ওরা কেউই পুরোপুরি বুঝতে পারছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুরটা আজ কেমন যেন অস্বাভাবিক। হাওয়ার ভেতরেও একরকম কাঁপন লেগে আছে। প্রতিটা করিডোরে ছাত্রছাত্রীরা জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিদিরা ঠিক তখনই ক্লাস শেষ করে বেরিয়েছে। প্রথমে বুঝতে পারেনি কি হচ্ছে, কিন্তু কাছে এগোতেই পরিষ্কার বুঝতে পারলো যে রাজনীতির কোনো বড় সংগঠনের সভা চলছে আজ। মাঠ প্রাঙ্গণের দিকে যেতেই দেখা গেলো, ভিড়ের মাঝখানে উঁচু মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে আহাদ রাজা। পাশে দাঁড়িয়ে আছে শাহীন, নাদিম, শাওন সাথে রাজনীতির প্রভাবশালী কিছু।চেনা মুখ।

আহাদের সাদা পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে গেছে, কাপড় শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। চোখে কালো সানগ্লাস, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝমেছে, মাঝে মাঝে বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে তা মুছে নিয়ে আগুন মেশানো কণ্ঠে বক্তৃতা দিচ্ছে। তার গলা যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে বাজছে চারদিকে। রিদি থেমে যায়। তার পা যেন মাটিতে গেঁথে গেলো। সেই বিশাল ভিড়ের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে রিদির চোখ আটকে রইলো আহাদ রাজার উপর। মুখের ওপর আলো ছায়ার খেলা, চোখের চশমায় রোদ ঝলমল করছে। সবকিছু মিলিয়ে তাকে আজ একেবারে অন্যরকম লাগছে। তার পাশে থাকা আহিয়া সেটা লক্ষ্য করে হালকা কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বললো,

“চল সামনে যাই, তাহলে ভাইয়াকে আরো ভালো করে দেখতে পাবি।”
রিদি চোখ সরিয়ে নিলো, ঠোঁট শক্ত করে বললো,
“মাথা খারাপ? রাজনীতির এই রংতামাশা দেখার কোনো শখ নেই আমার। তোদের ইচ্ছে হলে তোরা যা।”
আনিকা হেসে একটু কটাক্ষ করে বললো,
“হুমমম! রাজনীতি দেখার শখ নাই, অথচ রাজনীতির রাজা তোমার শখের পুরুষ! ”
রিদি গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,
“শখের পুরুষ না ছাই। উনি শুধু আহিয়ার ভাই। আর কিছু না।”
আহিয়া আর আনিকা দুজনেই তখন একসাথে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকালো তার দিকে। রিদি নজড় সরিয়ে নিলো। ব্যাগের ফিতা আঙুলে জড়াতে জড়াতে নিজেকেই মনে মনে বললো,
“আমি এমন নির্লজ্জ কবে থেকে হলাম? কালই তো রাগ করে চলে এলাম, আর আজ আবার তাকিয়েই আছি উনির দিকে!”

হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে,
“বেহায়া মন আমার।”
আনিকা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি বললি?”
রিদি দ্রুত মাথা নেরে বললো,
“কিছু না।”

ঠিক তখনই মঞ্চ থেকে আহাদ নেমে আসে, তার ডান পাশে শাহীন আর বাম পাশে শাওন আর নাদিম। সাদা পাঞ্জাবি হাতা গুটানো, চোখে কালো চশমা, যেন এক অদ্ভুত রহস্যের আবরণে ঢাকা চোখ। রিদি আবারও তাকালো নিশ্বাস রোদ করে। আহাদ সরাসরি তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। রিদির বুক ধুকপুক করতে লাগলো। মনে হলো আহাদ এখনই হয়তো কিছু বলবে। কিন্তু না! আহাদ পাশ কাটিয়ে সোজা চলে গেলো, যেন ওকে চিনেই না, বা তাকে খেয়ালই করেনি। রিদির চোখের দৃষ্টি মুহূর্তেই নিস্তেজ হয়ে গেলো। সে এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। ঠোঁট চেপে ধরলো জোরে। মনে হচ্ছিলো, বুকের ভেতর কেউ একটা ভারী পাথর বসিয়ে দিয়েছে।
এদিকে আনিকা একটু এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে শাহীনকে ডাকলো। শাহীন একটু ঘুরে তাকালো। তর্জনী আঙুল নিজের দিকে ইশারা করে বললো,

“আমাকে ডাকলেন?”
আনিকা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। শাহীন একটু দ্বিধায় নাদিম আর শাওনের দিকে তাকালো। তারা চোখের ইশারায় যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত দিলো। শাহীন হালকা হাসি দিয়ে কয়েক কদম এগিয়ে এলো আনিকার দিকে,
“বলুন, কি বলবেন? একটু ব্যস্ত আছি আজকাল।”
আনিকা হাত কচলাতে কচলাতে বললো,
“আসলে কালকে তাড়াহুড়োয় আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে পারিনি…”
“ধন্যবাদ? কেনো?”
“আপনি কালকে আমাকে বাঁচিয়েছেন তাই।”

শাহীন ঠোঁট কামড়ে হালকা হাসলো। তাকে হাসতে দেখে আনিকা বিরক্তিতে কপাল গুছিয়ে নিলো। শাহীন সেটা লক্ষ্য করে দ্রুত হাসি থামিয়ে দিয়ে বললো,
“ওহহ, সরি। আসলে আপনার জায়গায় যদি আহিয়া কিংবা নীলা বা মিস রিদিতা থাকতো। তাহলে তাদেরও আমি একই ভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। এটা ভাইয়ের হুকুম ছিলো, আর আমার কর্তব্যও। তাই এতো বেশি ইমোশনাল হওয়ার কিছু নেই।”

আনিকা মূহুর্তেই রেগে গেলো, দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“চামচা কোথাকার।”
“জ্বি, কি বললেন।“
“কিছু না।”
অতঃপর মুখে হাসি টেনে আনিকা বললো,
“যাই হোক, তবুও আপনি সাহায্য করেছেন আমাকে। তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।“
শাহীন চিবুকে দু আঙুল বুলিয়ে কিছু একটা ভেবে নিয়ে দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকালো,
“শুধু ধন্যবাদে পেট ভরে না, বুঝলেন?”
“মানে?”
“মানে শুধু ধন্যবাদ বললেই হবে না। কিছু রান্না-টান্না করে খাওয়ান।”

বলেই ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেললো। আনিকা কটমট করে তাকিয়ে মুখ শক্ত করে বললো,
“ঠিক আছে, আপনি যা খেতে চান, সেটা রান্না করে নিয়ে আসবো। কিন্তু তারপর আপনি আমাকে আর কোনো উপকার করতে আসবে না। কারণ আমি কারোর ঋণ রাখতে চাই না।”
শাহীন এক ঝলক তাকায় তার দিকে। চোখে এক রকম খেলা আনলো, চোখ টিপে দিয়ে বললো,
“আগে দেখি, আপনি কথা রাখেন কিনা। আপনার রান্না খেয়ে সন্তুষ্ট হলে বাকিটা পরে দেখা যাবে।”
বলেই হালকা হাসি ছুঁড়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আনিকা তার পেছনের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“দেখা যাবে শাহীন সাহেব, দেখা যাবে। আমার রান্না খেয়ে আপনি তিন মাস কোমায় থাকবেন। তখন বুঝবেন সন্তুষ্ট কাকে বলে।”

তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো, কিন্তু চোখে সেই অদ্ভুত জেদটা এখনও টিকে আছে। নাদিম আর শাওন গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। শাহীনকে কাছে আসতে দেখে দুজনে দ্রুত এগিয়ে যায় তার দিকে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করে দুজনে একসাথে হো হো করে হেসে উঠে। শাহীন তাদের হাসার কারন বুঝতে পারলো না। বিরক্ত হয়ে তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“হাসছিস কেনো তোরা? আমাকে জোকার মনে হয়?”
নাদিম কোন রকম হাসি থামিয়ে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
“ভাইয়ের ডায়লগ দিচ্ছিস কেনো?”

শাওন তৎক্ষণাৎ এক ধাপ এগিয়ে এল, দুই হাত নাড়িয়ে আহাদের কণ্ঠ নকল করে বলতে শুরু করলো,
“শাহীনের জায়গায় যদি এখন ভাই থাকতো। তাহলে বলতো, এই নাদিমের বাচ্চা! ফান করতেছিস আমার সাথে? আমি ফান করতেছি নাকি! থাপ্পড়ায়া তোর চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো। এখনই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা, কুইক!”
এই বলে তিনজন একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো। এমন সময় বাতাস কেটে পেছন থেকে ভেসে এলো সেই ভয়ঙ্কর কণ্ঠ,
“শাওনের বাচ্চা…!”

শব্দটা যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গর মতো এসে গায়ে পড়লো তিনজনের। শাওনের হাত মাঝ পথে ঝুলে রইলো, চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। ধীরে ধীরে তারা তিনজনই ঘুরে দাঁড়ালো। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আহাদ রাজা, চোয়াল শক্ত করে কিড়মিড়ি করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তার চেহারায় এমন এক তীব্রতা যেন এই মুহূর্তেই সব কিছু স্তব্ধ হয়ে গেলো। তিনজনই তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে মাথা নত করে দাঁড়ালো আহাদের সামনে। আহাদ এক কদম এগিয়ে এসে গর্জে উঠলো,

“আমাকে জোকার মনে হয় তোদের?”
তিনজন একসাথে মাথা নাড়লো, “না ভাই।”
আহাদের কণ্ঠে বজ্রধ্বনি,
“আমাকে নিয়ে ফান করতেছিস?”
তিনজন আবারও একসাথে না সূচক মাথা নাড়লো। আহাদ আবারও গর্জে উঠলো,
“আমি ফান করতেছি?”
তিনজন এবার একে অপরের দিকে তাকালো। হ্যাঁ, না কিছুই বললো না। আহাদের চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠলো। দাঁত চেপে কটমট করে বললো,
“থাপ্পড়ায়া তোদের চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো আমি! এখনই আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা। কুইক!”
তবু তারা এক পাও নড়লো না। শাওনের ঠোঁটে হালকা একরকম দুষ্টু হাসি খেলে গেলো, যা সে ঠোঁটের ভিতরে গিলে ফেলার চেষ্টা করলো।
“যেতে বলছি তো তোদের আমি!”

আহাদ আবার গর্জে উঠলো, কিন্তু তার সামনে দাঁড়ানো এই তিনজন যেন প্রস্তর মূর্তি। আসলে তারা আহাদকে খুব ভালো করেই চেনে। এখন যদি তারা সত্যি সত্যি চলে যায়, তখনই আহাদ আবার বলবে,
“আমি বলেছি বলেই তোরা চলে যাবি?”

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২১

তাই তারা স্থির দাঁড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে। আহাদের রাগ এবার চরম পর্যায় পৌঁছে গেলো। তাদের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে নিজেই গাড়িতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। গাড়ির কাচ উঠতে না উঠতেই তিনজনের মুখে একসাথে হাসির ফোয়ারা ছুটে গেলো। গাড়ির ভেতর বসে আহাদও সেটা শুনতে পেলো। জানালার বাইরে তাকিয়ে তার ঠোঁটের কোণেও হালকা একটা হাসি ফুটে উঠলো। বাইরে তার তিনজন বিশ্বস্ত সঙ্গী। এই ত্রয়ীই একমাত্র, যারা আহাদ রাজার রাগকে ভয় পায়, আবার ভালোও বাসে সবচেয়ে বেশি। এমন সময় আহাদের চোখ আটকে গেলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রিদির দিকে। একটা দীর্ঘনিশ্বাষ ফেলে সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
“এভাবে তাকাস না জানু, আমি পুড়ে যাই .!“

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here