লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩১
Fatima Fariyal
সময় তখন রাত আনুমানিক আটটা ছুঁইছুঁই। হলঘরের ঝাড়বাতির আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে। সেখানে বসে আছেন রিদির পুরো পরিবার, বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে তারা এসেছে। কিন্তু এখনো আহাদ কিংবা রিদিকে চোখে পড়েনি। বড়রা সবাই গল্পে মশগুল, মাহি আর আদিবা দুজনেই এক কোনে বসে ড্রইংবুক দেখছে। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব হয়েছে, এটা দেকে একটু হাসলো সবাই। এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা গেলো আহাদ আর রিদিকে। রিদি সেই লাল শাড়িতেই আছে, তবে আহাদ কালো স্যুট পড়েছে। একে অপরের হাত ধরে ধীরেধীরে নেমে এলো হলঘরে। তারেক রায়ানের দৃষ্টি আটকে গেলো তার মেয়ের মুখে। লাল শাড়ির আভায় রিদি যেন রক্তিম দ্যুতি হয়ে ফুটে উঠেছে। মুহূর্তেই তার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। লুকিয়ে চোখের কোন মুছে, ঠোঁটের কোনে স্নিগ্ধ হাসির রেখা টেনে আনলেন। মাহি রিদিকে দেখেই চিৎকার করে উঠলো,
“খালামনি!”
এসেই জড়িয়ে ধরলো রিদিকে, রিদি হাত তুললো আলতো করে, কিন্তু ঠিকঠাক জড়িয়ে ধরতে পারলো না। কারণ তার এক হাত এখনো আহাদের হাতে বন্দি। কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। উপস্তিত সবার দিকে একঝলক তাকিয়ে সে নিচু গলায় ফিসফিস করে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“কী করছেন, ছাড়ুন না!”
আহাদও সামন্য কাত হয়ে ঠোঁটে আধা-বদমায়েশি হাসি টেনে বললো,
“ধরেছি কী ছাড়ার জন্য?”
“এখানে সবাই আছে তো!”
আহাদ চোখ টিপে বললো, “সো হোয়াট?”
রিদি ভ্রু কুঁচকে বললো, “আপনার কী লজ্জা করেছে না?”
আহাদ চোখ পিটপিটিয়ে প্রতিউত্তর করলো,
“হুম, করছে তো। দেখতে পাচ্ছো না?”
“না, পাচ্ছি না!”
“এখন কি তোমার শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা দিতে হবে?”
রিদি অসহায়ের মতো ঠোঁট উল্টে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠিক তখনই তারেক রায়ান এগিয়ে এলেন, হালকা হেসে কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
“আম্মাজান!”
রিদিও বাবাকে দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে গেলো। কন্ঠ কাঁপিয়ে বললো,
“আব্বু!”
আহাদ কিন্চিৎ বিরক্ত হলো, বাধ্য হয়ে রিদির হাত ছেড়ে দিলো। রিদি মূহুর্তেই বাবাকে জড়িয়ে ধরলো, তারেক রায়ান তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন। আর এই দৃশ্য আহাদের সহ্য হলোনা, তার হৃদয়ে যেন কেউ ছুরি চালালো। কী ভয়ানক ঈর্ষা, কী অদ্ভুত অধিকার, মুহূর্তেই তার চোখের দৃষ্টি বদলে গেলো। ঘাড় মোচড় দিয়ে, শব্দ তুলে অন্যত্র গিয়ে বসলো। বসে থাকলেও দৃষ্টি আটকে রইলো ওই বাবা-মেয়েতে। তার গলার ভেতরে ঈর্ষা যেন কাঁটার মত খোঁচা মারতে লাগলো। রিদি মাথা তুলে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মামা আর আম্মু আসেন নাই?”
তারেক রায়ান মৃদু হাসলেন,
“তোমার মামা ভোলা চলে গেছে। আর তুমি তো যাবেই আমাদের সাথে, তাই তোমার আম্মু আসে নাই।”
রিদি ঠোঁট উল্টে বললো, “ওহহ…”
কণ্ঠে অভিমান, চোখে প্রত্যাশাহীনতা। একটু নিরবতার পর রিদি এগিয়ে গেলো সুমন আর ঈশানীর দিকে। ঈশানীর সাথে রাগ অভিমান কালই মিটে গেছে। বিদায় নিয়ে আসার সময় কী কান্নাটাই করেছে ঈশানী! সুমন আর ঈশানীর মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় এসে বসলো রিদি। তার মুখমোখি আহাদ বসে আছে, তার পাশ ঘেঁষেই বসে আছে তার বাবা। তবে একে অপরের দিকে ঘুড়েও দেখছে না। যেন দৃষ্টি মিললেই ঝড় বয়ে যাবে। দুজনই কেমন শক্ত হয়ে বসে আছে। অবশেষে সব দ্বীধা সড়িয়ে তারেক রায়ান মুখ খুললেন,
“দেখুন! আমি আপনার মতো রগচটা মানুষকে আমার মেয়ের জামাই হিসেবে চাইনি। সেটা ভালো করেই জানেন। আমি শুধু আমার মেয়ের কথা ভেবে রাজি হয়েছি।”
বাঁকা হাসলো আহাদ, দৃষ্টি রিদির দিকে রেখে বললো,
“আপনি মোটেও আপনার মেয়ের কথা ভাবেননি। আপনি আপনার সম্মানের কথা ভেবেছেন।”
তারেক রায়ানের চোখে দৃঢ়তা নেমে এলো,
“আমি যদি বলি, আমার সম্মানই আমার মেয়েরা?”
আহাদ এবার আড় চোখে তাকালো তারেক রায়নের দিকে। তারেক রায়ানের দৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ, বীরত্ব আর ভালোবাসা মেশানো। তিনি কন্ঠ খানিকটা ভারী করে বললেন,
“আমার তিন মেয়ে আমার জন্য তিনটা জান্নাত। তাদের গায়ে হাত তো দূরের কথা, একটা টোকাও দেয়নি কখনো! আমি যদি কোনদিন জানতে পারি, আপনার জন্য আমার মেয়ের শরীরে আঁচ পরেছে! সেদিনই আমি নিজে এসে আমার মেয়েকে নিয়ে যাবো।”
আহাদ কিন্চিৎ হাসলো, রিদির দিকে তাকালো অদ্ভুত মায়াভরা দৃষ্টিতে। কন্ঠ ভাড়ী করে বললো,
“আপনার মেয়ে যদি হয় আপনার জন্য জান্নাত, তবে সে আমার জন্য জান্নাতের সুবাস। সেই সুবাস আমার প্রয়োজন, যে কোন মূল্যে।”
তারেক রায়ান কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন আহাদের দিকে। তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলেন, আর এতোটুকু তো তিনি বুঝেছেন, আহাদ রাজা উপর থেকে দেখতে যেমন রগচটা মনে হয়, ভেতরে সে তার মেয়ের জন্য ছাঁয়া, প্রাচীর, সমুদ্রের গভীরতা। তার মেয়ে হয়তো সেটাই দেখেছে! তবে মুখে আর কিছুই বললেন না, শুধু নিরব রইলেন। আহাদের কথায় তার ভিতরে এক রকম প্রশান্তি নেমে এলো, অজান্তেই ঠোঁটের কোন এক চিলতে হাসি ধরা দিলো।
রাতের খাওয়া দাওয়া সবে শেষে করলো সবাই। নিচতলায় এখন রিদিকে নিয়ে যাওয়ার তোরজোড় চলছে। কিন্তু উপরে আহাদের রুমে বাতাসটা ভারী, উত্তপ্ত, দাবি আর আবেগের সংঘর্ষে কম্পমান। আহাদ তার কিং সাইজের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। শরীরভঙ্গিতে একগুঁয়েমি, চোখে দখলের আগুন। সে সরাসরি নাকোচ করে দিয়েছে রিদি কিছুতেই যেতে পারবে না। আর রিদি তার পাশে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় অনুনয়ের স্বরে বললো,
“কেন এমন করছেন? যেতে দিন না!”
আহাদ চোয়াল শক্ত করে টগবগ চোখে তাকালো তার দিকে। মাথাটা প্রচণ্ড আকাঁড়ে গরম হয়ে আছে। সবে কালই সে তার প্রেয়সীকে পেয়েছে, এর মধ্যেই আবার যাওয়ার কথা উঠছে কেনো সে বোঝেনা। তার উপর আজকে সারাদিন তার কেটেছে বাহিরে বাহিরে। একটু সময় নিয়ে ভালো করে দেখতেও পারলো না। আহাদ কর্কশ কন্ঠে একই কথা আবার বললো,
“রিদি! আমি দ্বিতীয়বার বলেছি। আর যেন বলতে না হয়।”
রিদি গলার স্বর নরম করে তার মন গলানোর চেষ্টা করলো,
“দেখুন! আমারও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কিন্তু এটা তো একটা রেওয়াজ, আর আব্বুও নিতে এসেছে। এখন যদি না যাই তাহলে কেমন দেখাবে।”
“কেমন দেখাবে মানে? তোমার চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে?”
“আমার না হোক, পরিবেশের চেহারা তো নষ্ট হবে।”
আহাদ কপাল গুছিয়ে নিলো, এক মূহুর্ত তাকিয়ে রইলো রিদির দিকে। অতঃপর হঠাৎই এক ঝটকা মেরে তাকে টেনে বসালো নিজের উরুর ওপর! আহাদের এমন কান্ডে হকচকিয়ে যায় রিদি। লজ্জা আর উত্তেজনায় বুক দ্রুত উঠা নামা করছে। তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে আহাদ বিড়বিড় করলো,
“আহাদ রাজা দু’বার অপশন দেয়, তৃতীয়বার অ্যাকশন নেয়। ওয়ার্ন করেছিলাম জানু! আমাকে যেন আর বলতে না হয়।”
রিদি শুধু দ্রুত নিশ্বাষ ফেলতে লাগলো, কোন কিছু বলার ক্ষমতা বা শক্তি কোনটাই অবশিষ্ট নেই তার শরীরে।
শরীরের প্রতিটি স্নায়ু কেঁপে ওঠে, অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে দেহটা এলিয়ে পরলো আহাদের উপর। আহাদ তাকে দু’হাতে সামলে নেয়, তার লালচে বর্ন নরম গালে আহাদের চওরা ওষ্ঠের উষ্ণ ছোঁয়া পরতেই কুঁকড়ে যায় কোমল দেহখানা। আহাদ আরো বেশ কিছুটা ছন্নছাড়া হয়ে যায়। এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে হালিমা বেগমের ডাক ভেসে আসে,
“রিদিতা! আহাদ!”
“রিদি!”
কিন্তু আহাদ যেনো শুনছেই না সেই ডাক। রিদি ধড়ফড় করে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। আহাদ বিরক্ত হলো, নাকের ঢগা ফুলে উঠলো রাগে। রিদি কেমন হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের নিশ্বাষ গুছালো, চুলগুলো ঠিক করে দু’পাশে ফেলে দ্রুত দরজা খুলে দিলো। হালিমা বেগম কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন, তবুও উপায় ছিলো না। রিদি আড় চোখে আহাদের দিকে একবার তাকালো।
আবার মাথা নিচু করে বললো,
“চ-চাচি আম্মু…”
হালিমা বেগম রিদির শরীরের উষ্ণতা অনূভব করতে পারলেন। কোন রকম নজর সড়িয়ে গলা পরিষ্কার করে বললেন,
“তোমার জন্য নিচে সবাই অপেক্ষা করছে, চলো।”
আহাদ সাথে সাতে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে পরলো, কর্কশ কন্ঠে নিজের সিদ্ধান্ত জানালো,
“ও কোথাও যাবে না, চাচি আম্মা। নিচে গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দাও।”
হালিমা বেগম কঠোর চোখে তাকালেন,
“এটা কি ধরনের কথাবার্তা আহাদ? ওকে ওর বাবা নিতে এসেছে, সবাই নিচে অপেক্ষা করছে। আর এখন তুই বলছিস ও যাবে না?”
“হ্যাঁ।”
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উওর দিলো আহাদ। হালিমা বেগম এবার বিরক্ত হলেন, বললেন,
“এমন কেনো করছিস? কালই তো আবার চলে আসবে!”
“কাল যখন আসবেই, তাহলে কষ্ট করে আর যাওয়ার দরকার নাই।”
“এটা একটা রেওয়াজ! বিয়ের পরের দিন বউকে শশুড় বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি পাঠানো হয়।”
আহাদ এক ধাপ এগিয়ে এসে উঁচ কন্ঠে বললো,
“কে বানিয়েছে এই রেওয়াজ? যে বানিয়েছে সে নিশ্চয়ই বউকে ভালোবাসতো না! শালা আস্ত একটা বজ্জাত। নিজে বউ রাখবে না বলে কী একখানা রেওয়াজ বানিয়ে দিলো। আমি মানি না কোন রেওয়াজ!”
আহাদের এই উদ্ভট কথা শুনে রিদি হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারলো না। এমন সময় নিচ থেকে আবারও ডাক পরলো। হালিমা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন,
“চলো চলো নিচে ডাকছে।”
রিদি দ্বিধায় পরে দাঁড়িয়ে আহাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহাদ তার দিকেই জলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হালিমা বেগম এবার টেনে বললেন,
“চলো তো! ওর দিকে কী দেখছো? ও পাগলের মত কথাবার্তা বললেই হবে নাকি!”
হালিমা বেগম এক প্রকার জোর করেই টেনে নিয়ে গেলো। নিচে আসতেই একে একে সবাই বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে শুরু করলো। রিদি মূল দরজার কাছে আসতেই পা থেমে যায়। শেষবারের মতো ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো উপরের দিকে। আহাদ তখন উপরে করিডোরের গ্রিল ধরে সেই একইভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রিদির মনে হলো সেই দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করে দিবে। দ্রুত নজড় সড়িয়ে সবার পিছু দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো। আহাদ তার চলে যাওয়া পিঠের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাষ ছাড়লো। পকেট থেকে ফোন বের করে কানে ধরে বলে উঠলো,
“শাহীন, আজকে রাতেই ব্যাবস্থা কর। অ্যাজ সন অ্যাজ পসিবল, কুইক!”
ওপাশ থেকে শাহীনের কন্ঠে এলো,
“ঠিক আছে ভাই!”
আহাদ ফোনের দিকে তাকিয় একটা রহস্যময় বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,
“রেডি থাকো, মাই ডিয়ার প্রেয়সী!”
বাইরে হালকা বাতাস চলছে, জানলার কাচে মাঝে মাঝে ঢেউ খেলে যাচ্ছে পর্দার ছাঁয়ায়। আফরোজা শেখ হাতের কাজ শেষ করে সবে রুমে এলেন। রুমটায় ম্লান আলো জ্বলছে। সেই আলোয় কর্নারের টেবিলে কাগজপত্র বিছিয়ে মনোযগ দিয়ে দেখছিলো আমজাদ মীর। সেদিকে এক ঝলক তাকালেন অতঃপর বিছানায় পিছনে কুশনটা পিঠে ঠেস দিয়ে বসলেন। চোখে দুশ্চিন্তার আলোছায়া স্পষ্ট।
হাত কপালে, যেন ভেতরের চাপ কমানোর চেষ্টা করছেন।আমজাদ মীর ব্যাস্ততার মাঝেও সেটা লক্ষ্য করলেন। তার স্ত্রী কপাল চেপে ধরে আছে, চোখ বন্ধ, ভাবলেন হয়তো সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত হয়ে পরেছে। তিনি চশমা খুলে টেবিলে রেখে এগিয়ে এসে ধীরে বসলেন পাশে। আফরোজা শেখ হালকা বিচলিত হয়ে চোখ খুলে তাকান সেদিকে। আমজাদ মীর এবার নরম, শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“আফরোজা, কী হলো? শরীর খারাপ?”
সামন্য চোখ তুলে তাকালে স্বামির দিকে। কোন উওর দিলেন না, মৃদু মাথা দোলালেন। আমজাদ মীর ফের জিজ্ঞেস করলেন,
“তাহলে? কী ভাবছো?”
আফরোজা শেখ একটা ভাড়ী নিশ্বাষ ফেললেন। এক মূহুর্ত নীরবতার পর মুখ গম্ভীর করে বললেন,
“আদননাকে নিয়ে ভাবছি। ছেলেটা বড্ড চাপা স্বভাবের। সহজে মুখ ফুঁটিয়ে কিছু বলে না। চিন্তা হয় আমার ওকে নিয়ে। ভাবছিলাম বিয়ে করালে হয়তো একটা সঙ্গী পাবে,
মনের মানুষের কাছে সব বলতে পারবে। কিন্তু দেখুন… আমি নিজেই সব গোলমাল করে ফেললাম।”
আমজাদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। স্ত্রীকে সামলে নিতে হাতটা আরও শক্ত করে ধরলেন। শান্তনার স্বরে বললেন,
“শুধুু শুধু কেনো চিন্তা করছো বলোতো? তুমি তো শুনলে আদনান এমনিতেও এ বিয়ে করতো না। দু ভাই মিলে রেশারেশি করে এই পরিবেশ তৈরি করেছে। এখন যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে, আর এসব নিয়ে ভেবো না।”
আফরোজা শেখ এবার খানিকটা বিরক্ত হলেন স্বামির গা ছাড়া কথাবার্তায়। চোখে রাগ, স্বরে কষাঘাত,
“আপনি তো থাকেন আপনার রাজনীতি নিয়ে। সংসার, বউ, বাচ্চা এসবের দিকে খেয়াল থাকে আপনার? থাকলে অতন্ত আদনানের চেহারা দেখতেন। কাল থেকে ছেলেটা কেমন যেনো হয়ে আছে। ভাইজান, ভাবিজান এখনোও কিছু জানে না। তাদেরকে কী জবাব দিবো আমি?”
আমজাদ মীর হালকা হেসে মজার ছলে বললেন,
“তুমি রাজনীতি নিয়ে সব সময় এমন হিংসা করো কেনো? মাঝেমাঝে মনে হয় রাজনীতি তোমার সতীন?”
ব্যাস! কথা শেষ হতেই আফরোজার ধৈর্যের বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে গেলো,
“আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি, আর আপনি এখনোও মজা করছেন?”
আমজাদ মীর কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই পিঠ মুড়িয়ে শুয়ে পরলেন আআফরোজা শেখ। আমজাদ মীর পিছন থেকে কয়েকবার খুঁচিয়ে সাফাই দেয়ার চেষ্টা করলো। তবে কাজ হলো না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে আবার নিজের কাজে ফিরে গেলেন।
আহিয়া হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো আদনানের রুমের দরজার সামনে। হাতের ট্রে টা কেমন ঠকঠক করে কাঁপছে। তার বুকের ভেতরটা যেনো অদ্ভুত ভয় আর উৎকণ্ঠায় ঢেউ তুলছে। আদনান রাতে নিচেও আসেনি, আর খাবারও খায়নি। শুধু জানিয়েছে তার চা টা যেনো উপরে দিয়ে আসা হয়। বিশেষ করে সে রিদির পরিবারের সামনে পরতে চায়নি। রিতুকে চায়ের কাপ নিয়ে যেতে দেখে, তার হাত কাপটা নিয়ে সেই দায়িত্ব নেয় চা দিয়ে আসার। কিন্তু আদনানের ঘরের সামনে এসে এখন তার হাত কাঁপছে বেশ তীব্র ভাবে। গতকাল রাতের কথা মনে পরতেই ভিতরটা কেমন অস্তিরতায় ভরে গেছে। আদনানের সেই কথার মানে তো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। আর তখন জিজ্ঞেসও করা হয়নি। তাই মনে মনে ভেবেছে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে,
“আমার জন্য বাজি ধরেছে মানে!”
প্রখর দ্বীধা দন্ধের পর দরজা ঠেলে ভিতরে উঁকি দেয়। আদনান টেবিলে বসে খুব মনোযগ সহ ল্যাপটপে কাজ করছিলো। আহিয়া যে তার ঘরে এসেছে, সে না তাকিয়েই সেটা বুঝতে পেরেছে। আহিয়ার অবেচেতন ভাবেই ঘাড়টা একটু কাত হয়ে যায়। সে এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আদনানকে কখনো দেখেনি। আদনান জার্মান থেকে এসেছে দু’বছর হলো। তার যখন এগারো বছর বয়স, তখন তার বড় আব্বু বড় আম্মুর সাথে মানে আদনানের বাবা মায়ের সাথে জার্মান চলে গেছিলো। তবে প্রতি এক দু’বছর পর সবাই এসে ঘুড়ে যেতো। আদনান পড়াশুনা শেষে করে গত দু’বছর আগে একেবারে জন্য দেশে চলে আসে। আহিয়ার আদনানকে দেখে এর আগে এমন অনূভতি হয়নি। তবে ইদানীং কেমন উল্টাপাল্টা ভাবনা আসে। এর কারনও হলো আদনান নিজে, সে কেমন করে তার দিকে তাকায়, মাঝে মাঝে হুটহাট করে এমন কথা বলে যে তার মনের কোনে অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আহিয়ার গভীর চিন্তার বিঘ্ন ঘটে আদনানের নির্লিপ্ত গলার স্বরে,
“চা কী শরবত হলে দিবি?”
শব্দের মাঝে কেমন ব্যঙ্গ, কেমন অভিমানের লুকোচুরি।
আহিয়া হকচকিয়ে গেলো। দ্রুত চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে গিয়ে সেখানেও বাঁধে বিপত্তি। হাত কেঁপে গরম চা গিয়ে পরলো আদনানের হাতে। ইশশ! কী বিশ্রী একটা কান্ড। আহিয়া দাঁত বের করে কৃত্তিম হাসি টেনে বলে,
“স-সররি…!”
আদনানের মুখ অনড়। আহিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আদনানের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলো, তার চেহারায় একফোঁটা বিরক্তি আছে কি না বোঝা গেলো না। একাট টিস্যু নিয়ে আদনানের সামনে টেবিল সাফ করতে হাত বাড়ালো। ততক্ষনাৎ আদনান খপ করে হাতটা চেপে ধরলো। গলার স্বর খানিকটা ভাড়ী করে বললো,
“এসব বন্ধ কর আহি! আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করা বন্ধ কর প্লিজ! আর কতভাবে আমাকে ধংশ করবি?”
আহিয়া স্থির হয়ে গেলো। চোখের পাতা কাঁপে উঠলো অসহায় কন্ঠে ফিসফি করলো,
“কী করেছি আমি?”
আদনানের বুক ওঠা-নামা করছে ক্ষোভে,
“বুঝতে পারছিস না কি করেছিস? নাকি বুঝতে চাইছিস না?”
এক মূহুর্ত নীরবতার পর আহিয়ার হাতটা ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“যদি বুঝতেই না পারিস, তাহলে এটাও বুঝতে হবে না। শুধু আমার থেকে দুরুত্ব বজায় রাখ। এসব চায়ের বাহানায় আমার ঘরে আসার প্রয়োজন নেই। আমার কারোর দয়া-দাক্ষিণ্যেরও প্রয়োজন নেই। যেতে পারিস, আমি ব্যস্ত আছি।”
আদনানের বলা কথাগুলো কাঁটার মতো বিঁধল তার মনে।
ততক্ষণে চোখ থেকে আপনা আপনি গরম অশ্রু গড়িয়ে পরলো। এই প্রথম আদনান তার সাথে এমন কঠিন হয়ে কথা বলেছে, যেটা তার জন্য সহ্য সীমার বাহিরে। ধীরে ঘুরে যেতে নিলেই আবারও আদনানের সেই কঠিন স্বর ভেসে এলো,
“চায়ের কাপটাও নিয়ে যা। এটারও প্রয়োজন নেই।”
আহিয়া ঢোক গিলতে পারছে না। মনে হলো কেউ কন্ঠ নালী চেপে ধরেছে। চায়ের ট্রে টা তুলে নিয়ে এক দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। আদনান সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো,
“আই’ম সরি আহি! কিন্তু এটা তোর প্রয়োজন ছিলো। আর কত আমি তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করবো? এবার তোরও বোঝা উচিৎ, ভালোবাসার যন্ত্রণা কেমন হয়!”
গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে চেয়ারের পেছনে মাথা এলিয়ে দিলো। চোখের পাপড়িতে জমে থাকা ক্ষত লুকাতে চাইলেও বুকের দাহটা লুকানো গেলো না।
রাত তখন প্রায় একটা। চারপাশ স্তব্ধ; বাসার সবাই গভীর ঘুমে। শুধু রিদির চোখে ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে কেমন অস্থির ভাবে এপাশ-ওপাশ করছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর একটা পাথর চেপে আছে, শ্বাস ঠিক মতো নিতে পারছে না। তার এই নড়াচড়ায় পাশে শুয়ে থাকা রাইসার ঘুম ভেঙে গেলো। আলো-আঁধারির মাঝে বিরক্ত হয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠলো,
“সমস্যা কী তোমার? এতো নড়াচড়া করতেছো কেনো?
তোমর জন্য ঘুমাতে পারি না ঠিকমতো!”
রিদি উঠে বসে পরলো। যদিও স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না, আধো আলোয় রাইসার অবয়বের দিকে তাকিয়ে হালকা ক্ষোভে বললো,
“ঘুম না এলে আমি কী করবো বল? আমি কী ইচ্ছে করে করতেছি?”
“তোমার ঘুম আসে না বলে, তুমি আমার ঘুম নষ্ট করবা?”
“দূরর! ঘুমা তুই!”
ক্লান্ত সুরে বলেই বিছানা থেকে উঠে পড়লো রিদি। বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিয়ে উঠে বারান্দায় এসে দোলনায় বসলো। মৃদু ঠাণ্ডা বাতাসে তার চুলগুলো মুখে এনে ফেললো। রিদি সেগুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে, আনমনে তাকালো রাতের অসীম আকাশের দিকে। সেখানে চাঁদের উজ্জলতা ছড়িয়ে আছে, তার আশেপাশে অজস্র তারার মেলা। সব কেমন মিটমিট করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চাঁদের পাশের তারাটা সবথেকে উজ্জল মনে হলো, তার মনে পড়ে গেলো আহাদের সেই আচরন, কেমন বেশামাল হয়ে গেছিলো। ভাবতেই অকারণে মুচকি হেসে ফেললো। কিন্তু পরক্ষণেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, আসার পর থেকে একবারও খোঁজ নেয়নি আহাদ। না কোনো কল, না কোনো বার্তা। রিদি বুঝতে পারলো আহাদ বেজায় রেগে আছে।
এমন সময় হাতের ফোনটা কেঁপে উঠলো, রিদি চমকে তাকায় জলন্ত স্ক্রিনের দিকে। আহাদের নাম্বার থেকে বার্তা এসেছে,
“দুই মিনিটের মধ্যে নিচে আসো।”
রিদির নিশ্বাস রোধ করে এক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকে সেই বার্তাটার দিকে। অতঃপর গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে তাকায় নিচের দিকে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আধো আলোয় গাড়ির বোনেটের সাথে হেলে দাঁড়িয়ে আছে আহাদ। ধূসর ছায়ার মাঝেও তার দৃষ্টি যেনো স্পষ্ট, রিদির ওপর নিবদ্ধ। দ্রুত সরে এলো রিদি, বুক অনিয়ন্ত্রিতভাবে ধুকপুক করছে। সেই ধুকপুকানি নিয়ে ধীরে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসে। রিদি গাঢ়ো নীল রঙের একটা সেলোওয়ার কামিজে, ওড়নাটা ভালো করে মাথায় টেনে রেখেছে। আহাদ রিদিকে আসতে দেখে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা সোজা করলো। তার চোখে রাগ, কিন্তু সেই রাগেই ছিলো এক অদ্ভুত টান। রিদি একদম তার সামনে এসে মাথা নিচু করে ধরে দাঁড়ায়। আহাদ হাতের ঘড়ির উপর ঠকঠক করে গম্ভীর স্বরে বললো,
“সতেরো মিনিট লেট, আমি বলেছিলাম দুই মিনিটের মধ্যে আসতে।”
রিদি আবছা আলোয় চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। মিনমিন করে বললো,
“বললেই কী দুই মিনিটে আসা যায়?”
“হ্যাঁ, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।”
রিদি এক মূহুর্ত চুপ করে থেকে মাথা নত করে বললো,
“ভুল হয়ে গেছে, পরেরবার চেষ্টা করবো।”
আহাদ ভ্রু কুচঁকে বললো,
“ভুল হয়ে গেছে?”
রিদি চমকে তাকালো আহাদের দিকে, দ্রুত মাথা নেড়ে আতঙ্কিত গলায় বললো,
“না-না! মানে… আমি…”
আর কিছু বলার আগেই আহাদ হঠাৎই এক ঝটকায় রিদির কোমর টেনে তাকে নিজের বক্ষস্থলে এনে ফেললো। কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
“আমার কিন্তু এখন লাইসেন্স আছে জানু! তাই এখন থেকে যা বলবে, ভেবে চিন্তে বলবে।”
রিদির মুখ লালচে হয়ে উঠলো, তার মাথা নিঃশব্দে এসে ঠেকলো আহাদের বুকের উপর। আহাদের বুকে মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ হৃদপিন্ডের তীব্র ধুকপুকানি শুনতে লাগলো। কিন্তু সেটা কার? রিদির? নাকি আহাদের? দুইজনেই টের পাচ্ছিলো, হৃদয়ের গতি সমান ছন্দে দৌড়াচ্ছে। রিদির কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে আহাদ আলতোভাবে তার চিবুক ধরে মাথা উঁচু করলো। দু হাত দিয়ে মুখটা ধরে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো না?”
“উহুম।”
নির্দিধায় উওর দিলো রিদি। আহাদ রিদির দিকে তাকিয়ে তার ভিতরের অনূভতি বোঝার চেষ্টা করলো। অদ্ভুত মাতাল করা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“পালাতে চাইবে আমার সাথে? ভরশা আছে আমার উপর?”
বুকটা ধপাধপ করছে রিদির। প্রশ্নটার মানে সে পুরোটা বুঝলো না। তবুও নিজের সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে মাথা নিচু করে হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকালো। আহাদ এবার কড়া স্বরে বললো,
“মুখে বলো। হ্যাঁ অথবা না।”
লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩০
চোখ বন্ধ করে রিদি উচ্চারণ করলো, “হুমম।”
আহাদের ঠোঁটের কোনে বিজয়ী হাসির রেখা ফুটে উঠলো। হাত বাড়িয়ে রিদির কোমল হাতটা নিজের উষ্ণ হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। অতঃপর গাড়িতে উঠে বসতেই তাদের গাড়ি রাতের রাস্তায় ধীরেধীরে মিলিয়ে গেলো। চাঁদ-তারার নীরবে সঙ্গ নিয়ে এক অজানা, অপ্রকাশিত যাত্রার পথে ছুটে চললো।
