লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩৩

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩৩
Fatima Fariyal

একটি নতুন সকালের সূচনা। সূর্যের নরম আলোয় ভরে আছে কটেজের প্রতিটি কোণ। রিদিতা সবে শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে আসে। পা দিয়ে নেতিয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়ি সরিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। কোমর ছোঁয়া চুলের ডগা থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ছে। কাল রাতের মত আহাদ রেগে যেতে পারে ভেবে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালের সাহায্যে চুল মুছতে লাগলো। কালো আর সোনালি মিশ্রণের গাউনটা তার ফর্শা ত্বকে চকচক করে ফুটে উঠেছে। চুলে হাত চালিয়ে আয়নার ভেতর ঘুমন্ত আহাদের মুখের দিকে তাকালো, তার ঘুমটা ভারী নয়। মৃদু বাতাসে তার চুল কপালের ওপর এসে পড়েছে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে বুক উঠছে নামছে শান্ত ছন্দে। সব মিলিয়ে তাকে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে।

সেই দৃশ্য দেখেই রিদিতার মন কেমন দুর্বল হয়ে যায়। এইতো কিছুূদিন আগেও আহাদ রাজাকে পাওয়া তার কাছে ছিলো স্বপ্নের মতো! অথচ আজ? হঠাৎ আহাদ নড়েচড়ে উঠতেই সে চমকে যায়। হাতে থাকা তোয়ালেটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। গত রাতের কথা মনে পড়তেই তার বুকের ভেতরটা অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠলো।
কটেজের ভিতর টিমটিম করে জ্বলছিলো হলদে ক্যান্ডেল। তখনই এক ঝটকা বাতাস এসে সাদা পর্দ উড়িয়ে দিলো। সেই বাতাসের সাথে গোলাপ আর ক্যান্ডেলের অমায়িক গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ঘরে। রিদি তখনও আহাদের বুকে মাথা গুঁজে রেখেছে। আহাদের অবাধ্য হাত বিচরন করতে লাগলো তার প্রেয়সীর পিঠ জুড়ে। সেই স্পর্শে থেকে থেকে সহসা কেঁপে উঠছে তার প্রেয়সী। আহাদকে সেই কাঁপুনি বেশ আনন্দিত করলো। সে এবার নিছু হয়ে রিদি নাকে নাক ঘঁষলো। আহাদের তপ্ত নিশ্বাষ অনুভব করতেই রিদি তার ঘাড়ের শার্টের অংশ খাঁমচে ধরলো। রিদির রেশমের মতে চুলগুলো আলতো হাতে সড়িয়ে তার গলার কাছে মুখ এনে মাতাল স্বরে বিড়বিড় করলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কেন মুগ্ধ করো আমাকে? কেন চুম্বুকের মত আকৃষ্ট করো আমায়? কেন পাগল করে দাও বারংবার, নিজেক সামলানো দুষ্কর হয়ে যায় প্রতিবার!”
রিদিতা কিছুই বলতে পারলো না। শুধুু তার ঘন নিশ্বাষের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আহাদের মুখ ধীরেধীরে এসে থামলো তার কানের পাশে, মৃদু শব্দে কানের লতিতে একটা নরম চুমু খেলো। আর তাতেই রিদিতা বিদুৎ এর মত ঝটকা খেয়ে দূরে সরে গেলো। আহাদ সেই ঝটকা সামলাতে না পেরে ধপ করে বিছানা থেকে পরে গেলো মেঝেতে। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। না! ব্যাথা পেয়েছে সে জন্য নয়, বরং রিদির আচরনে তার শরীরে ক্রোধ ঝলকে উঠলো। দাঁতে দাঁত পিষে চেঁচিয়ে উঠলো,

“এই আল্লাহর বান্দি এই! সমস্যা কী তোমার?”
রিদি বিছানার ওপাশে দাঁড়িয়ে আঙুলে ওড়নার কোন পেঁচাতে লাগলো। আহাদ উঠে নিজের গায়ে লেগে থাকা গোলাপের পাঁপড়ি ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে গেলো তার দিকে। তাতেই সে দু’কদম পিছিয়ে গেলো। আহাদ কটকমট করে উঠলো,
“স্টপ রিদি! আর এক পা ও নড়বে না। ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো চুপচাপ।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। আহাদ আবার এগিয়ে যেতেই রিদি দৌঁড়ে বিছানার অন্য প্রান্তে চলে গেলো। আহাদের এবার রাগ যেনো মাথায় উঠে গেলো। কপালের নীলচে শিড়া বিদ্ধমান। চোয়াল শক্ত করে দু আঙুল নাড়িয়ে ডাকলো,

“রিদি! কাম হিয়ার।”
“না।”
“আমি কিন্তু ভীষন রেখে যাচ্ছি রিদি। আসো বলছি!”
“উহুম।”
“আমার মাথা কিন্তু হেবি গরম হয়ে আছে জানু! একবার যদি তোকে ধরতে পারি, তাহলে কিন্ত থাপ্পড়ায়া তোর চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো।”
একটু থেমে ফের ডাকলো, “এদিকে আসো।”
মাথা নাড়লো রিদিতা, “না.. আপনি মারবেন।”
আহাদ এক পা এগোতেই রিদি ছুট লাগায় বারান্দার দিকে। তবে তার আগেই আহাদ বিছানার উপর দিয়ে এক লাফে গিয়ে পিছন থেকে ধরে ফেললো। রিদিতা মোচর দিয়ে সেই বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে চাইল। কিন্ত আহাদের সেই দৃঢ় বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে ব্যার্থ হলো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে আহাদ ঝাঁঝিয়ে উঠলো,
“তুমি বোধহয় ভুলে গেছো। আহাদ রাজা দুবার অপশন দেয়, তৃতীয়বারে অ্যাকশন নেয়। ইদানীং কিছু বলছি না বলে লাই পেয়ে পেয়ে একদম মাথায় উঠে গেছো না? তোমার কী মনে হয়, ছেড়ে দেবো তোমাকে? উহুম! একদম বুকের সাথে পিষে মেরে ফেলবো।”

“ছাড়ুন না!”
“যদি ছাড়ারই হতো তাহলে টাকা পয়সা খরচ করে এত দূর নিয়ে এলাম কেনো? হেহ? এখন ছেড়ে দিলে আমার কত টাকা লোকসান হবে আইডিয়া আছে তোমার?”
রিদি একরকম চমকে নিজেকে ঘুড়িয়ে তাকায় আহাদের দিকে। বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি এ.. জন্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন?”
নির্লিপ্ত ভাবে উওর দিলো আহাদ, “অফকোর্স!”
অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে নিলো রিদি, “আমি আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম!”
“আমি বলেছি আমাকে বিশ্বাস করতে? তুমি নিজ ইচ্ছায় আমার উপর ভরশা করে পালিয়ে এসেছো।”
রিদি আহাদের বুকে কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দিয়ে বললো,

“আপনি খুব খারাপ।”
“বেশি খারাপ?”
আহাদের শার্টের বুকের খোলা অংশে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে মৃদু মাথা দুলিয়ে ছোট করে বললো,
“হুম।”
মূহুর্তেই মুখের রঙ বদলে যায় তার। একহাতে রিদির হাত দুটো নিজের বুকে চেপে ধরে অন্য হাতে তার কোমর টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল ভীষন আশ্লেষে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,

“যখন খারাপের অপবাদ দিয়েই দিয়েছো, তাহলে চলো খারাপ কাজটা করেই ফেলি।”
“ম.. মানেহ.!”
“ডট ডট ডট!”
“সে… টা আবার কী?”
কন্ঠ কেঁপে উঠলো রিদিতার। আহাদের দিকে তাকাতেই সে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে এক চোখ টিপে দিলো। সেই ইঙ্গিতের মানে রিদির বুঝতে আর বাকি রইল না। আজ আর কোন অজুহাতেই যে কাজ হবে না। এটাও বেশ ভালো করেই বুঝলো। বরং হঠাৎই রিদি এক বিস্ময়কর কান্ড করে বসলো। আহাদের গলার কন্ঠ মনিটা ঢোক গেলার সাথে সাথে অদ্ভুত ভাবে নড়তে দেখে লোভ সামলাতে পারলো না। এর আগেও যতবার তার এই কন্ঠ মনির দিকে নজড় পরেছে ততবার এই অবাধ্য অনূভতি জেগেছে। সে এবার দু পায়ের আঙুলে ভর করে উঁচু হয়ে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে বসলো সেখানে।

আহাদ এক সেকেন্ড আহাম্মকের মত দাঁড়িয়ে রইলো। অতঃপর ব্যাপারটা যখন বুঝতে পারলো। তার ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি খেলে গেলো। নিজের প্রেয়সীকে আরো আশ্লেষে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। রিদির নাকের ঢগায় তার চওড়া ঠোঁট ছুঁয়ে গেলো। সেখান থেকে আয়ত্তে নিয়ে নিলো প্রেয়সীর তীরতীর করে কাঁপতে থাকা চিকন সরু ওষ্ঠজোড়া। দুজনেরই শুধু ঘন নিশ্বাষের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অতঃপর ধীরেধীরে পিছিয়ে এসে ধপ করে বিছানায় পরলো দুজন। সাদা চাদরে মুড়িয়ে নিলো নিজেদের। বাতাসে পর্দা সরতেই মেঘে ঢাকা ধূসর চাঁদের আলো এসে পরলো তাদের নরম আলিঙ্গনে।

এই মূহুর্তে গতরাতের বেশামাল, ছন্নছাড়া আহাদের কথা মনে পরতেই রিদিতার বুকের ভিতর আলোড়ন সৃষ্টি হলো। গাল দুটো টকটকে লাল চেরির মত হয়ে আছে। তখনই অনূভব করলো ঘাড়ের কাছে তপ্ত নিশ্বাষ। আয়নায় স্পষ্ট আহাদ ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে। অর্ধ ঘুমন্ত চোখ, মুখে একরাশ দুষ্টু হাসি। তার নরম গালে নিজের খসখসে দাড়ি ঘর্ষণ করে ঘুমন্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“কী ভাবছো?”
“কিছু না।”
“কিছু না? তাহলে এভাবে ব্লাস করছো যে?”
আয়নায় নিজের প্রতিভীম্বের দিকে তাকিয়ে দ্রুত গালে হাত রেখে ঢেকে নিলো রিদি,
“ক… কই!”
আহাদ এবার তার কাঁধে হাত রেখে ঘুরিয়ে নেয় নিজের দিকে। রিদি চোখ নামিয়ে নেয়, নিজের অজান্তেই আহাদের বুকে গিয়ে পড়ে। আহাদও হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে নেয়। কিছু সময় কাটলো সেই মৃদু আলিঙ্গনে। কিছুক্ষণ পর রিদি ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায় আহাদের মুখে। তার সেই গাঢ় বাদামি চোখ জোড়া ঘন পাপড়িতে ঢাকা, আর সেই চোখের গভীরে মিশে আছে একরাশ অদ্ভুত উষ্ণতা। রিদির কণ্ঠ কেঁপে ওঠে,
“আপনি জানেন? আমার জীবনের প্রথম পুরুষ আপনি। আমার প্রথম অনুভূতিগুলোও আপনাকেই ঘিরে জন্ম নিয়েছে।”

আহাদের মুখের ভাব এক মুহূর্তে বদলে যায়। দু ভ্রুর মাঝখানে গভীর ভাঁজ পরলো। কন্ঠ গম্ভীর হয়ে উঠল,
“এভাবে বলছো যেনো আমার জীবনে আরো রমনীর আগমন ঘটেছে। আরো দু-চারটা বিয়ে করেছি আমি।”
“সেটা কখন বললাম?”
“এই যে, এখনই তো বললে।”
“আমি কী তা বলেছি?”
“বলেছো! যেটা বলেছো সেটার মানে এটাই দাঁড়ায়।”
রিদি একটু সরে কপাল গুছিয়ে বললো,
“আপনি সব কিছু এমন পেঁচান কেনো? নরমাল ভাবে নিতে পারেন না?”
“না।”
“কেন?”
“কারন আমি নরমাল না।”
“তাহলে কী? অ্যাবনরমাল?”

আহাদ চোয়াল শক্ত করে কটমট করে তাকালো তার দিকে। এতে রিদি মিয়িয়ে গেলো। নিজের জামার বুকের কাছের চুৃমকি খুঁটতে খুঁটতে মিনমিন করে বললো,
“আপনিই তো বললেন আপনি নর.. মা..ল. না।”
আহাদ দাঁত কপাটি দিয়ে বললো,
“আমি বলেছি নরমাল না, মানে এক্সট্রা-অর্ডিনারি। আমি কী বলেছি আমি অ্যাবনরমাল?”
“স.. সরি, ভুল করে বলে ফেলেছি।”
“কান ধরো।”
“এ্যাহহ!”
রিদি চমকে তাকায় আহাদের দিকে। আহাদ সহজ ভঙ্গিতে আবার বললো,
“এ্যাহ না হ্যাঁ। ভুল যখন করেছো তখন কান ধরো। কান ধরে বিশবার উঠবস করো।”
রিদি ঠোঁট ফুলিয়ে পিটপিট করে তাকালো আহাদের দিকে। আহাদ এগিয়ে এসে নিচু গলায় বললো,
“এই একদম এভাবে তাকাবে না আমার দিকে। আমার হাওয়াই মিঠাই এর মতো মন। যদি গলে যায়, এর দায়ী কে দেবে? তোমার বাপ? তাছাড়া আমার মন গলে গেলে বিপদ কিন্তু তোমারই। সামলাতে পারবে না সেই ধকল। আমার মন নরম বলে আগে ভাগে ওয়ার্ন করছি।”

“আপনি খুব খারাপ।”
এক হেঁচকা টান দিয়ে রিদিকে নিজের বুকস্থলে ফেলে মৃদু স্বরে বললো,
“বেশি খারাপ?”
রিদির মূহুর্তেই গত রাতের স্মৃতি মনে পড়তেই মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“না না, আপনি ভালো… আপনি অনেক ভালো।”
হালকা হাসল আহাদ, বললো, “বেশি ভালো?”
“হ্যাঁহ।”
উপর নিচ মাথা দুলিয়ে বলল রিদিতা। আহাদ একটু ঝুঁকে তার নাকের ঢগায় একটা টোকা দিয়ে হেস্কি স্বরে বলল,
“এতো ভালো আমার পোষায় না জানু! আমি গত রাতের মত আবার খারাপ হতে চাই।”
রিদি কোৎ করে একটা শুকনো ঢোগ গিললো। মনে মনে ভাবলো, এতো মহা বিপদ! খারাপ বললেও বিপদ। ভালো বললেও বিপদ। তার একেবারে তার সারে সর্বনাশ করে ছাড়লো এই আহাদ রাজা!

সূর্যের উজ্জল রশ্মি থাকা সত্তেও নীলার রুমটা ঘন অন্ধকারে ঢেকে আছে। পর্দার মোটা কাপড় বেধ করে সূর্যর তীব্র আলো ভিতরে ঢুকতে আজও ব্যার্থ হলো। এক কর্নারে মেঝেতে হাটু জড়িয়ে বসে আছে নীলা। চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ, চুল এলোমেলো, ঠোঁট শুকিয়ে নিস্তেজ। ঘরের টিমটিমে টেবিলল্যাম্পের হলদে আলোয় ছড়িয়ে আছে কিছু পুরোনো স্মৃতি। অজস্র ছবির অ্যালবাম, কিছু ছোট বেলার ড্রইংবুক এবং একটা ক্যামেরা। যেটা তার ১৪ তম জন্মদিন আহাদ উপহার হিসেবে দিয়েছিল। বরং সে সময় থেকেই নীলা আহাদের প্রতি অদ্ভুত অনূভতি বয়ে বেড়াচ্ছে। তবে আহাদের ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ আর তার ভীতু হৃদয়ের কারনে তা প্রকাশ করতে ব্যার্থ হয়েছে।
নীলার পুরো নাম তাসনিয়া বাসার নীলা। সবাই নীলাই ডাকে। নীলার বাবা খাইরুল বাসার। ঢাকার অন্যতম একজন সফল ব্যাবসায়ী। যার জন্য ব্যাস্ত থাকেন সবসয়ময়। নীলার মা নিলুফা শিকদার, উঁচু খানদানি বংশের মেয়ে। নীলার মায়েরও নিজস্ব একটা ফ্রেবরিক কম্পানি আছে। যার অফিস, কাজ, বিদেশ সফরেই কেটে যায় জীবন। তাদের একমাত্র সন্তান হয়েও নীলা ছিল একা। তার বাবা মা তাকে তেমন সময় দিতে পারতো না। তার দেখাশোনার জন্য আলাদা গভারনেস রাখা হতো।

খাইরুল বাসার আর আমজাদ মীর ছিলেন পুরনো বন্ধু।
আর তাই, ছোটবেলা থেকেই মীর পরিবারের সঙ্গে নীলার ছিলো যাওয়া-আসা। নীলা যখন প্রথম মীর হাউজে যায়, তখন তার বয়স ছিলো মাত্র চার বছর। সে ছোট থেকেই খুব চাপা স্বভাবের, তবুও আদিল, আহিয়ার সাথে তার বেশ ভাব হয়। তাদের সাথে বেশ জমত। মীর পরিবারের সবাই তাকে এতটাই আপন করে নিয়েছিল, যেন সে তাদেরই একজন। নীলা নিজের বাবা মাকে তো তেমন পেত না, কিন্তু মীর পরিবারের ভালোবাসা পেয়েছিলো নিখুঁতভাবে।
আহাদও তাকে নিজের ছোট বোন আহিয়ার মতোই দেখত। শাসন করত, যত্ন নিত, রাগ করত, আবার মানাতও। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, নীলার মনে ততই বদলে গেছে সেই ভালোবাসার রং। একটা সাধারণ যত্ন ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল তার জীবনের সবচেয়ে গভীর অনুভব। একটা নীরব ভালোবাসা। আহাদ শেষবার তাকে তার জন্মদিনে একটা ক্যামেরা উপহার দিয়েছিল। নীলা সেটা পেয়ে কতই না খুশি হয়েছিল। আনন্দে অস্থির হয়ে আহাদকে জড়িয়ে ধরেছিল নীলা। আর সেই আলিঙ্গনটাই সবকিছুর মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আহাদ তখনই টের পেয়েছিল তার চোখের গভীরে লুকানো ভালোবাসা, তার জন্য বহন করা নীলার অনূভতির ব্যাপারে। আর সেই দিন থেকেই সে নীলাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে।

যদিও নীলা বুঝতে পারেনি, তার অনূভতির ব্যাপারে আহাদ অবগত। সে শুধুু টের পেয়েছে আহাদ আর তার সাথে আগের মতো কথা বলে না। আগের মতো মিশে না। তবুও তার হৃদয় আশা ছাড়েনি। সে ভাবত, একদিন আহাদ বুঝবে। জানতে পারবে তার অনূভতিগুলোকে। হয়তো সেদিন তাকে আপন করে নিবে। কিন্তু না! সে ভুল ছিল। সেদিনই তার বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল যেদিন জানতে পারে আহাদ আর রিদি একে অপরকে ভালোবাসে।
সেদিন থেকে নীলা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বন্ধি করেছে অন্ধকার ঘরে। আহাদ আর রিদির বিয়ের সংবাদ তাকে প্রায় নিঃশ্বেষ করে দিয়েছি। অথচ সে অসহায়!

কিই বা করবে? নিজের বান্ধবির ভালবাসা ছিনিয়ে নিবে? যেখানে আহাদও তাকে পাগলের মত ভালোবাসে। সেখানে তো অন্য কোন প্রশ্নই আসে না! নীলার ভীতরটা জ্বলছে, যন্ত্রণা হচ্ছে খুব! তীব্র যন্ত্রণা। এত এত যন্ত্রণা তার এতটুকু হৃদয় সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে। সামনে থাকা আহাদের দেয়া প্রতেকটা উপহার কাঁপা কাঁপা আঙুলে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো। কত যত্নেই না সে এসব আগলে রেখেছিল। অথচ এখন মনে হচ্ছে এসব কিছু তুচ্ছ! ভাবতেই তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। উরুতে চিবুক ঠেকিয়ে আবারও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল। নোনতা অশ্রু টপটপ করে পরতে লাগলো তার গাল বেয়ে। তার কান্নার শব্দটাও ছিল খুব ক্ষীন। যেন কেউ তার কান্না শুনলেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস টেনে ভারী কন্ঠ স্বরে বিড়বিড় করল,

“ভালোবাসা পেতেও কপাল লাগে… ভাগ্য লাগে। সেই ভাগ্য আমার কপালে কেনো রাখলে খোদা?”
ফোঁস করে নাক টেনে নিলো। অভিযোগের সুরে কাঁপা কাঁপা গলায় আবারও বিড়বিড় করল,
“এই হৃদয় তো তুমিই বানিয়েছো খোদা… তাহলে যাকে ভাগ্যে রাখলে না, তাকে এই হৃদয়ে কেনো রেখেছো? কেন তার জন্য অনূভূতি জাগিয়ে তুলেছো? কেনো খোদা…? কেনো…?”
ভাষ্পে ঢেকে গেলো তার গলা। কন্ঠে তীব্র ব্যথার কম্পন ছড়িয়ে পড়ে। আর পারছে না উপর ওয়ালার কাছে অভিযোগ করতে। অভিযোগ করতে করতেও ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। নিশ্বাষ টেনে তুলতে পারছে না আর, হু হু করে আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। তার কান্না এতটাই করুন ছিলো যে ইটপাথরের দেয়ালগুলোও কেমন কেঁপে উঠেছে। কান্নার মাঝেই হঠাৎ করে সে হেসে উঠলো। সেই হাসিটা ছিলো ভাঙা আয়নার মতো। এই মূহুর্তে কেউ যদি তার হাসিটা দেখতো তাহলে তার ভেতরটা চকচকে ধারালো ছুরির মতো কেটে যেতো। নীলা চোখ মুছে ধীরেধীরে অ্যালবাম থেকে আহাদের একটা ছবি বেরে করলো। তার কাঁপা আঙুলের ঢগা ছুঁয়ে গেলো সেখানে। সে ফের গলা কাঁপিয়ে ভেজা কন্ঠে বলে উঠল,

“আপনাকে পাওয়া অসম্ভব। আমি চাইলেও আপনাকে পাবো না। তবুও এই হৃদয়, এই বেহায়া হৃদয়.. কেনো মানতে চায় না এই সত্যিটা?”
নীলার মাথায় বোধোগম্য হলো। আহাদকে ভুলতে হলে তার সব সৃতিগুলো নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে। ভাবতেই নীলা এতোদিনের যত্নে তুলে রাখা প্রতেকটা বস্তু একটা কালো পলিথিনে মুড়িয়ে নিলো। যেন নিজের অতীতকে কবর দিতে প্রস্তুত। চোখ মুখ মুছে সেটা নিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গলা উঁচিয়ে ডাকল,
“খালা! রেশমা খালা! রেশমা খালাআআ!”
রেশমা তার ডাক শুনেই দৌড়ে আসে। উৎকণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কী হইছে নীলা মা, কিছু লাগবো?”
নীলা মুড়ানো কালো পলিথিনটা তার হাতে দিয়ে বললো,

“এটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসো। একদম বাহিরের ডাস্টবিনে। আমার চোখের ত্রিসীমানায় যেন না পড়ে।”
“আইচ্ছা।”
রেশমা সেটা নিয়ে মূলদরজার দিকে যায়। দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ডোকে আহিয়া আর আনিকা। রেশমাকে দেখেই আহিয়া জিজ্ঞেস করলো,
“নীলা কোথায়?”
“উপরে, নিজের ঘরে আছে।”
আহিয়া আর আনিকা উপরের দিকে পা বাড়াতেই পিছন থেকে রেশমার কন্ঠ ভেসে আসে,
“মা হুনো।”

দুজনেই থেমে যায়। ঘুরে তাকায় পিছনে। রেশমা এগিয়ে এসে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তোমরা তো নীলা মার বন্ধু। হেল লাইগ্গা কই, নীলা মা আজ কাইল কেমন জানি হইয়া গেছে। আগের মত নাই। নিজের রুম থেইক্কাই বেড়োয় না। খাওন খায় না ঠিক মত। ম্যাম সাহেব আইজ পনেরো দিন দেশের বাইরে। সাহেবও আহে না ঠিকমতো। আমি তো নতুন, তেমন কিছু জানিও না, কাউরে চিনিও না। কারে কমু খুইজা পাইনা। তোমাগোরে চিনি হেল লাইগ্গা তোমাগোরে কইলাম।”
আনিকা আর আহিয়া একে অপরের দিকে তাকাল। অতঃপর আহিয়া রেশমাকে আশ্বস্ত দিয়ে বলল,
“আমরা দেখছি। আপনি চিন্তা করবেন না।”
“আইচ্ছা।”

রেশমা সেখান থেকে যেতেই, আনিকা আর আহিয়া উপরে উঠে গেলো। নীলার রুমের দরজা খোলাই ছিলো তাই ধড়ফড় করে ঢুকে পরলো। নীলা ওদের দুজনেকে একসাথে দেখে একটু হকচকিয়ে যায়। বিস্ময়ের সুরে বলে উঠে,
“তোরা?”
আনিকা হালকা রাগি স্বরে বলল,
“হ আমরা। তোর কী হইছে? কল ও ধরিতেছিস না, মেসেজ এর রিপ্লাই ও দিচ্ছিস না। ভার্সিটিও যাচ্ছিস না। বুঝলাম রিদি তার জামাই নিয়া পালায়া হানিমুনে গেছে। তুমি কোন বা’তা’র নিয়া পইরা আছো হেহ?”
নীলার বুকটা কেমন চিনচিন করে উঠল। তবুও তাদের বুঝতে না দিয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে কথার মোড় ঘুড়িয়ে দিলো,
“রিদি হানিমুনে গেছে? বাহ! ভালই তো। আমি ভাবছি ও আবার কোন কান্ড করে না বসে।”
আহিয়া বলে উঠলো,
“সে তোর ভাবতে হবে না। তুই আগে বল তোর কী হয়েছে? রেশমা খালা বলল, তুই নাকি রুম থেকেই বের হচ্ছিস না। আর রুম এমন অন্ধকার কেনো? দেখি।”
শেষের কথাটা বলেই সে জানালার পর্দা টেনে দিলো। সূর্যের আলো পরতেই নীলা চোখমুখ খিঁচে নিলো। কন্ঠ গম্ভীর করে বলল,

“কিছুনা, আমার ভালো লাগছিল না।”
আনিকা টেবিলের বই খাতা গুছাতে গুছাতে মৃদু রাগ মেশানো স্বরে বলল,
“রিদিকে তো খুব বলতি, তোর এই ভাল্লাগে না শুনতে আমারও ভাল্লাগে না। প্যারাসিটামল খা। এখন তুই একটা প্যারাসিটমল খা, আর চল আমাদের সাথে।”
“আমার সত্যিই ভালো লাগছে না আনিকা। তোরা যা আমি কোথায়ও যাবো না।”
“ঘরে এমন ভ্যাটকায়া পইরা থাকলে কেমনে ভালো লাগবো।”
আহিয়া এক মূহুর্ত নীলার দিকে তাকিয়ে তার মনভাব বোঝার চেষ্টা করলো। অতঃপর দৃঢ় স্বরে বলল,
“তোর কী মনে হয়? আমরা এখানে তোরে পচে পচে মরতে রেখে যাবো? আনিকা ধরতো!”

আহিয়া নীলার ব্যাগটা আনিকার হাতে ধরিয়ে দিলো। নীলা জিন্স আর কুর্তি পরে আছে তাই পোষাক বদলানো জরুরি মনে করল না। শুধু একটা আকাশি রঙের ওড়না নীলার গলায় জড়িয়ে দিল। আনিকা আর আহিয়া দু’পাশ থেকে ওর বাহু ধরে টেনে টেনে বাসা থেকে বের করে নিয়ে গেলো। রেশমা নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল তিনজনের চলে যাওয়া পিঠের দিকে।
সারাদিন ধরে আনিকা আর আহিয়া নীলাকে নিয়ে ভার্সিটির প্রাণকেন্দ্রে ঘুরেছে। নীলার পছন্দমত, ফুসকা, ঝালমুড়ি, আইসক্রিম সহ আরো অনেক কিছু খেয়েছে। এবং শপিং মল ঘুরে কিছু কেনাকাটাও করেছে। এতে নীলার মনটা আগের তুলনায় সত্যিই একটু হালকা হয়েছে। তবে সত্যি বলতে, আহিয়ার নিজের ভেতরেটাও ভার ছিল। নীলার কষ্টে সে নিজেও একরকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তবু নীলাকে হাসাতে পারার তৃপ্তিটা যেন অনেকটা শান্তি এনে দিয়েছিল ওর মনে।

সন্ধ্যার একটু আগে আগে সবাই যে যার বাড়ি ফিরে গেল।
আহিয়া ব্যাস্ত পায়ে গেট পেরিয়ে মূল দরজায় আসতেই তার পা দুটো থমকে যায়। হলঘরের মাঝখানে, বড় সোফায় বসে আছে আদনান। তার পাশেই আদিল। আদনানের উরুর উপর ল্যাপটপ, দুজনের চোখ তাতে নিবদ্ধ। মনে হয় কোনো গুরুতর আলোচনায় ব্যস্ত, হয়তো আদিলের পড়াশোনা বা কোনো প্রকল্প নিয়ে কথা বলছে। আহিয়া এক মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল। সারাদিনে একবারও আদনানের কথা মনে পড়েনি, এমনকি এক মুহূর্তের জন্যও না। কিন্তু এখন ওকে চোখের সামনে দেখতেই গতকালের তিক্ত স্মৃতিটা যেন পাথরের মতো বুকের ওপর নেমে এল। মনে পড়ল ওর চোখের ঠাণ্ডা দৃষ্টি, সংযত অথচ কাঁপিয়ে দেওয়া কণ্ঠস্বর। আজ যে আদনানের ছুটির দিন সেটা আহিয়া পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিল। তবে মনে মনে ভাবলো,

“ভালোই হয়েছে সারা দিন বাইরে ছিলাম, অন্তত সামনে তো পড়তে হয়নি। না হলে আবার কোনো না কোনো ভাবে উনির রাগের কারণ হয়ে যেতাম।”
তাই দ্বিতীয়বার আর কিছু না ভেবে আহিয়া তাড়াহুড়ো করে উপরে ওঠার জন্য সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। তবে অপ্রত্যাশিত বলেও কিছু থাকে। যা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারে না। সিঁড়ির তৃতীয় ধাপে উঠতেই হঠাৎ আহিয়ার পা পিছলে গেল। একটা তীব্র চিৎকার ফেটে পড়ল নীরব হলঘরে,
“আআআহহহহ!”
আদনান ও আদিল দুজনেই চমকে ঘুরে তাকাল। পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন হালিমা বেগম। আহিয়া সিঁড়ির ধাপে কাঁত হয়ে বসে আছে, পা ধরে মুখ বিকৃত করে রেখেছে। হয়তো ব্যথায়। হালিমা বেগমকে দেখেই কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল,

“আমার পা… আমার পা ভেঙে গেছে চাচি আম্মু!”
আদিল উঠে এসে ধরতে গেল ওকে, কিন্তু আহিয়া তীব্র কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,
“খবরদার! তুই আমাকে ধরবি না! সব তোর কারণে হয়েছে। চাচি আম্মু ওকে যেতে বলো এখান থেকে।”
“যাক বাবা! আমি আবার কী করলাম?”
আদিল হতভম্ব। হালিমা বেগম এসে শান্তনা দিয়ে বললেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে। ও ধরবে না তোকে। তুই পা সোজা কর।”
কিন্তু আহিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“না, ভেঙে গেছে, সোজা করতে পারব না!”
“দেখি কিছু হয়নি। সোজা কর।”
“না। পারব না।”
এতক্ষণ পর্যন্ত একদম নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিল আদনান।

চোখে কোনো ভাব নেই, মুখে একরকম স্থিরতা। কিন্তু ‘পা ভেঙে গেছে’ কথাটা শুনে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। হাঁটু মুড়ে বসল আহিয়ার সামনে। কোন কথা না বলে পা টেনে আনল নিজের উরুর উপর। আহিয়া অবাক হয়ে তাকাল, দোটানায় পড়ল। কিন্তু আদনান শুনল না। ধীরে ধীরে হাত রাখল তার গোড়ালিতে, আঙুল দিয়ে চেপে চেপে অনুভব করল। তার কণ্ঠ নিচু কিন্তু স্থির,
“উহুম, পা ভাঙেনি।”
আহিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “ভাঙছে।”

“আমি তো বললাম, ভাঙেনি।”
“আমি বলছি, ভাঙছে।”
আদনান এবার চোয়াল শক্ত করল, স্বর আরও গম্ভীর,
“ডাক্তার কে? তুই? না আমি?”
“আপনি।”
“তো আমি যখন বলছি, ভাঙেনি তার মানে ভাঙেনি।”
আহিয়া মুখ ফুলিয়ে গজগজ করে বলল,
“তাহলে মনে হয় মচকে গেছে।”
“না, মোচও লাগেনি।”
“লাগছে।”
“বললাম তো না।”
শেষে আদনান হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“জাস্ট একটু ব্যথা পেয়েছিস। বরফ দিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
হালিমা বেগম ব্যস্ত হয়ে উঠলেন,
“আমি বরফ নিয়ে আসছি, তুমি বস।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বরফ নিয়ে এলেন। আদনান বরফের টুকরো হাতে নিয়ে আহিয়ার পায়ের পাতায় আলতো করে চেপে ধরল। ঠাণ্ডা স্পর্শে আহিয়ার শরীরটা শিরশির করে কেঁপে উঠল, আর সেই সঙ্গে বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত স্রোত বইতে লাগল। নিজের অজান্তেই সে আদনানের বুকের শার্টের অংশটা খামচে ধরল। একটা ক্ষণস্থায়ী, অবচেতন প্রতিক্রিয়া। তাতেই আদনান থেমে গেল। আঙুল নিথর হয়ে রইল আহিয়ার পায়ে। বুকে যেন কিছু একটা ধক করে উঠল। একটা ভারী ঢোক গিলে চোখ তুলে তাকাল আহিয়ার দিকে। আহিয়া চোখ বন্ধ করে আছে। তার শ্বাসপ্রশ্বাসের ওঠানামা আর চোখের পাপড়ির কাঁপুনি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আদনানের মনে হলো,
“ও কি আমার মতোই কিছু অনুভব করছে? নাকি আমি শুধু কল্পনা করছি?”
তার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিলো
ওষ্ঠজোড়া। হঠাৎ করেই সে আহিয়ার পা টা ঝটকা দিয়ে সড়িয়ে উঠে দাঁড়ল। আহিয়া হকচকিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো আদনানের দিকে। কন্ঠ কেঁপে উঠল,

“কি… কী করছেন আপনি? ব্যাথা পেয়েছি তো আমি।”
আদনানের মুখে কোন ভঙ্গি নেই। নির্লিপ্ত স্বরে হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চাচি আম্মা, ওকে উপরে নিয়ে যাও। আমি কিছু মেডিসিন দিয়ে দিবো, সেরে যাবে ওর ব্যাথা।”
হালিমা বেগম তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখি ওঠ, ধর আমাকে।”

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩২

হালিমা বেগম এবার ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল আহিয়াকে নিয়ে। ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা ভর করলো। ওদের করিডোরে মিলিয়ে যেতে দেখে একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদনান। বিড়বিড় করে বলল,
“এতটুকু ব্যাথা সহ্য করতে পারছিস না। মেডিসিনের প্রয়োজন হচ্ছে তোর। তাহলে ভাব আমার এত গভীর ক্ষত নিরাময়ের কোন মেডিসিন না থাকা সত্তেও আমি কীভাবে সহ্য করছি। অবশ্য সেটা বোঝার ক্ষমতা তোর নেই আহি!”
আদনান গিয়ে আবার সোফায় বসে পড়লো। বানি এসে আহিয়ার ব্যাগ, ফোন, আর জুতাগুলো গুছিয়ে রাখতে লাগলেন।

লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here