লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩৫
Fatima Fariyal
রাতের গভীর অন্ধকার ভেদ করে মীর হাউসের গেট পেরিয়ে একে একে প্রবেশ করল চারটি সাদা-কালো গাড়ি। গার্ড ছুটে এসে সামনের গাড়ির দরজা খুলতেই নামলেন আসফাক মীর। তার পেছনের গাড়িগুলো থেকে নেমে এল শাহীন, নাদিম আর শাওন। চারজন একসাথে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর আলোচনায় মেতে রইল। আজকের প্রাপ্ত সংবাদটা যে কোনো সাধারণ খবর নয় তা তাদের মুখভঙ্গিতেই স্পষ্ট। আসফাক মীর দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
“এখন পরিস্থিতি যেমনই হোক শাহীন! ওরা যখন একবার টার্গেট করেছে, তার মানে নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে। আহাদ না থাকায় আপাতত চুপ আছে। কিন্তু ভুলে যাস না, এই শত্রুতা শুরুই হয়েছিল আহাদকে কেন্দ্র করে।”
শাওন পকেট থেকে ফোন বের করে কিছু একটা দেখে আবার গম্ভীর মুখে সেটি পকেটে রাখল। কণ্ঠটা এবার আগের চেয়ে আরও কঠিন শোনাল,
“তবুও চাচা, ওদের ভরসা করা যায় না। ভাই আসার আগেও কিছু একটা করে বসতে পারে। একজন খবর পাঠিয়েছে ওরা নাকি মীর পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে নজরে রেখেছে।”
শাহীন সায় দিয়ে বলল,
“শাওন ঠিক বলছে চাচা। আপনি বরং ভাই না আসা পর্যন্ত সবাইকে সতর্ক রাখেন। কেউ যেন বাড়ির বাইরে না যায়।”
আসফাক মীর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললে,
“সে আমি সামলে নেব। তোরাও সাবধানে থাকিস। আর তালুকদারের চ্যালাটাকে ভাল মত ডেমো দে। এখনও অনেক কিছু লুকিয়ে যাচ্ছে চালাকির সাথে।”
শাহীনের মুখ শক্ত হয়ে গেলো,
“জ্বি চাচা। তার ধারনা আমরা তাকে বিশ্বাস করে নিয়েছি।”
আসফাক মীরের ঠোঁটে একরাশ বাঁকা হাসি খেলে গেল,
“রাজনীতি তো বিশ্বাসেরই খেলা, শাহীন। এবার সেই বিশ্বাসেরই সুযোগ নিয়ে বাকি খেলাটা খেলতে হবে। তবে সাবধান, যেন বুঝতে না পারে আমরা তার চালাকি ধরে ফেলেছি।”
“ঠিক আছে চাচা, আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
এই বলে তিনজন রওনা দিল ডেমো ঘর-এর দিকে। যেখানে আহাদের নির্দেশে গত তিন দিন ধরে বন্দি আছে তালুকদারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর। আহাদের অনুপস্থিতি তার ভাষ্যমতে, তার মুরগি পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব এই ত্রয়ীর উপরই বর্তেছে। তারা সেই দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। সেই চ্যালাটা শাহীনদের বিশ্বাস যোগাতে কিছু তথ্য দিয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো সালমান তালুকদার এখন খলিল মাতব্বরের সাথে হাত মিলিয়েছে। যে খলিল মাতব্বরকে একা সামলানোই এতদিনে অসম্ভব ছিল, সেখানে তার সঙ্গে যদি তালুকদারের জোট বাঁধে তাহলে সামনে যে ঝড় আসছে তা মীর পরিবারের জন্য ভয়ানক হয়ে উঠবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই!
মীর হাউসের করিডোরে আবার নিস্তব্ধতা নেমে এলো। মূল দরজা পেরিয়ে হনহন করে ভিতরে ঢুকলেন আসফাক মীর। গায়ে কালো পাঞ্জাবি, মুখে স্পষ্ট ক্লান্তি আর চোখে অচেনা রাগের রেখা। তাকে দেখা মাত্রই রিতু দৌড়ে এসে তার হাত থেকে কালো লেদারের ব্যাগটা নিয়ে নিল। আসফাক মীর হলঘরের মাঝাবরার দাঁড়িয়ে চারদিকে একবার চোখ বুলাল। কাউকেই দেখতে পেল না। তাই রিতুকে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“তোর খালাম্মা কোথায়?”
“খালাম্মা তো রান্নাঘরে..”
রিতুর কথা শেষ না হতেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন হালিমা বেগম। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে স্বামির মুখের দিকে তাকালেন। তিনি আঁচ করতে পারলেন কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। কপালের ভাঁজে চিন্তার রেখা, চোখে অস্থিরতার ছাঁয়া। উদ্বেগমাখা কণ্ঠে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে তোমার? এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন?”
আসফাক মীর এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন স্ত্রীর দিকে। মনে মনে ভাবলেন, সত্যিটা বললে হয়তো ঘরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। তাই সাবধানতার সাথে কথাটা ঘুরিয়ে দিলেন। গলা পরিষ্কার করে বললেন,
“কাউকে দেখতে পাচ্ছি না যে? কোথায় গেছে সব।”
“কোথায় আর যাবে! বাড়িতেই আছে। আহিয়া নিজের ঘরে আছে, আর আদিবা পড়াছে। আদনান এখনও ফেরেনি। আপা একটু আগেই এসেছে, এখন ক্লান্ত তাই বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছে।”
“আর তোমার ছেলে?”
“কোথায় আর থাকবে, বাইরে গেছে। হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে আছে।”
এই উত্তরটা শুনেই আসফাক মীরের মুখের গাম্ভীর্য ভেঙে গেল। কপালে ভাঁজ, কণ্ঠে রাগ মিশে উঠল,
“রাত নয়টা বাজে, আর তোমার ছেলে এখনো বাইরে? কতবার বলেছি, ছেলের দিকে একটু খেয়াল রাখো! সারাদিন শুধু বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, রেস, গেম এইসব নিয়েই পড়ে থাকে। পড়াশোনার কোনো দায়িত্ববোধ নেই তার। দিন দিন বাঁদর হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা!”
হালিমা বেগেমও তেঁতে উঠলেন স্বামির কথায়,
“এখন এসব বলছো কেনো? আমি যখন বলেছিলাম ওকে জার্মানি পাঠাতে, তখন তো তুমি রাজি হওনি! এখন আমার ওপর দোষ চাপাচ্ছো? গরিবের কথা বাসি হলে মিষ্টি হয়, এখন বোঝো?”
আসফাক মীর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন। কিন্তু হালিমা থামলেন না,
“আমি কতবার বলেছি, আদনানের মতো ওকেও ডাক্তারি পড়াও। না, বাবা! ছেলে, ভাতিজা কেউ রাজি না। সবাই একসাথে আমার বিপক্ষে। এখন দোষ আমারই!”
এই বলে গজরাতে গজরাতে ঘরের দিকে চলে গেলেন। আসফাক মীর টের পেলেন, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলাতে ধীরে পায়ে সহধর্মিণীর পিছু পিছু গেলো। মৃদু কণ্ঠে বললেন,
“তোমাকে কোথায় দোষারোপ করলাম। আমি তো শুধু বলেছি ছেলের দিকে নজড় রাখ।”
“তোমার ছেলে ছোট নাকি? নজড় রাখব আমি।”
পাল্টা ঝাঁঝালো জবাব এল সঙ্গে সঙ্গেই। আসফাক মীর ঘরে ঢুকেই তার দু’বাহুতে আলতো করে হাত রাখলেন। কণ্ঠটা এবার একেবারে নরম, প্রায় করুণ,
“ছেলের দিকে না রাখো, ছেলের বাবার দিকে একটু নজর দাও। তোমার অবহেলায় শুকিয়ে যাচ্ছি আমি।”
হালিমা বেগম স্বামির দিকে কটমট করে তাকালেন। ঠোঁট চেপে শক্ত স্বরে বললেন,
“এইবার লাইনে এসেছেন মশাই। ছেলের অজুহাতে যে ইনিয়ে বিনিয়ে নিজের কথা বোঝাতে চাইছেন সেটা কি আমি বুঝি না?”
আসফাক মীর সামান্য ঝুঁকে হেসে বললেন,
“বোঝোই যখন, তাহলে একটু…”
এর আগেই হালিমা চট করে সরে গেলেন। আলমারি থেকে একটা তোয়ালে তুলে ছুড়ে মারলেন স্বামির মুখে। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“ন্যাকামি বন্ধ করে, আগে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি খাবার রেডি করছি।”
কথাটা শেষ করেই তিনি ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আসফাক মীর মুখ থেকে তোয়ালেটা সরিয়ে হালকা হেসে ফেললেন। এত এত ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তার মাঝেও স্ত্রীর এই ভালোবাসামাখা ছলে এক টুকরো অনাবিল প্রশান্তি খুঁজে পেলেন। হালিমা বেগম রুম থেকে বেড়িয়ে আসতেই দেখল আদনান হলঘরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে হালকা ক্লান্তির ছাঁপ, মনে হচ্ছে আজ ডিউটিতে বেশ চাপ ছিল। তবু চাচিকে দেখে মুখে আদরের হাসি ফুটিয়ে তুলল সে। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
“আহি কোথায়, চাচি আম্মা?”
হালিমা বেগম শান্ত স্বরে বললেন, “উপরেই আছে।”
“ওর পায়ের ব্যাথা কমেছে? ঠিক আছে এখন?”
“হ্যাঁ, অনেকটাই কমে গেছে।”
হালিমা বেগমের কণ্ঠে স্বস্তির আভাস। আদনান মাথা নেড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। কিন্তু আহিয়ার রুমের সামনে গিয়ে থমকে গেল। ভিতরে যাবে কি যাবে না দ্বীধায় পরলো। আহিয়া এখন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ডিউটি শেষ করতে আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। তবু সারাদিন তার কথা ভেবে ভেবে মনে একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। নিজের চোখে দেখার জন্য মন ছটছফ করছিলো। একটু দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে সব দ্বিধা পাশে সড়িয়ে দরজায় দু’বার টোকা দিল। ভিতর থেকে আহিয়ার কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হ্যাঁ, আসো।”
আদনান দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। আহিয়া ভেবেছিল হয়তো চাচি আম্মা এসেছে কিন্তু আদনানকে দেখে একরকম শক্ত হয়ে বসে রইল। মুখে এক ধরনের অপ্রস্তুত ভাব ফুটে উঠল। আদনান সেদিকে একবার তাকিয়ে হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা টেবিলে রেখে বিছানার এক কোনে বসল। আহিয়া নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বলবেন, আদনান ভই?”
তার চোখে উদ্বেগ, মুখে কৌতূহল। আদনান সরাসরি বলল,
“তোর পায়ের কি অবস্থা? দেখি।”
আহিয়া আলতো করে চাদরটা টেনে পা বের করলো। গতকালের নীলচে দাগটা আজ অনেকটাই ফ্যাকাশে। তবু আদনান চোখ সরাতে পারল না। তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
“ব্যথা কমেছে? নাকি এখনো আছে?”
আহিয়া ছোট্ট করে উত্তর দিল, “হুম..”
“কী হুম? ঠিক করে বল।”
আহিয়া এবার মুখ তুলে বলল, “কমে গেছে অনেকটা।”
আদনান পলকহীনভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। অতঃপর সামান্য নড়েচড়ে শিপিং ব্যাগটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলো। আহিয়া ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইল,
“কি এটা?”
“খুলে দেখ।”
দ্বিধাগ্রস্ত হাত দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে ভিতরে তাকাতেই আহিয়ার চোখ মুহূর্তেই বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। নিউ ব্রান্ড আইফোন! সাথে অনেকগুলো চকলেট। তার চোখ যেন হঠাৎ আলোয় ঝলমল করে উঠল।
“নতুন ফোন?”
“হুম, তোর ফোনটা তো গতকাল পরে ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাই নিয়ে এলাম। আর চকলেট পছন্দ করিস তাই…”
আহিয়ার ঠোঁটে ধীরে ধীরে এক চওড়া হাসি ফুটে উঠল।প্যাকেট খুলতে খুলতে বলল,
“থ্যাঙ্ক ইউ, আদনান ভাই…”
আহিয়ার বলতে দেরি হলো কিন্তু তার হাত থেকে প্যাকেটটা ছোঁ মেরে নিতে আদনানের দেরি হলো না। আহিয়া হঠাৎ বুঝতে পারলো না কি হলো এটা! মুখের রঙ উবে গেলো, হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে আদনান ভাই?”
আদনানের চিবুক শক্ত হয়ে গেলো। কটমট করে বলল, “আমি কি রাস্তাঘাটের অচেনা কেউ? কথায় কথায় ধন্যবাদ দিতে হবে কেন তোর? যাহ! তোকে আর কখনো কিছু দিবই না!”
আহিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মিনমিন করে বলল, “শুধু ধন্যবাদই তো দিয়েছি… এতে রাগ করার কি আছে?”
আদনান আরও ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,
“দিবি কেন? আমি বলেছি দিতে? আই হেট দিস ওয়ার্ড!
তোর মুখ থেকে এই শব্দটা শুনলে আমার গা জ্বলে যায়! কতবার বলেছি, আমাকে ধন্যবাদ দিবি না!”
আহিয়া মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলল,
“সরি… আর বলব না। এবার তো দিন।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ রইল আদনান। তার মুখের রাগের রেখা ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসল। অবশেষে প্যাকেটটা আলতো করে আবার আহিয়ার হাতে ধরিয়ে দিল। অতঃপর কিছু না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হবার পর আহিয়া অবাক হয়ে কিছুক্ষণ প্যাকেটটির দিকে তাকিয়ে রইল। ধন্যবাদ দিলেও যে কেউ এত পরিমান রেগে যেতে পারে, সেটা আদনানকে না দেখলে বোঝাই যেত না। তার এমন কান্ড দেখে আহিয়া হালকা শব্দ করে হেসে ফেললো। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আদনান সেই হাসির শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলো। এবার তার নিজের ঠোঁটেও অজান্তে এক ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠল।
দীর্ঘ আট থেকে নয় ঘন্টার পথ পারি দিয়ে আহাদ রাজারা যখন নাখাফুম পৌঁছাল ততক্ষণে দিনের আলো প্রায় শেষ। পশ্চিমে, সবুজ পাহাড়ের সারিগুলোর আড়ালে সূর্য ডুবে গেছে। নাখাফুমের মতো জায়গায় সাধারণত রাত কাটানোর অনুমতি মেলে না। জায়গাটা বন্য, দুর্গম, আর এখানকার রাতের নিস্তব্ধতা ভীতিকর। কিন্তু আহাদ রাজা আগেই সব ঠিক করে রেখেছে। স্থানীয় এক পাহাড়ি গাইডের মাধ্যমে বিশেষ অনুমতি নিয়ে রেখেছে তারা। তুহিন আর রিয়াদ আহাদের নির্দেশে ঝর্ণার পাশের উঁচু একটা ঢিবিতে জায়গা ঠিক করে। জায়গাটা ছোট, কিন্তু নিরাপদ। ঢিবির নিচ দিয়ে ছোট একটা ঝিরি বয়ে গেছে সেখানে ঝর্ণার পানি এসে পড়ছে অবিরাম শব্দে। সবাই মিলে ব্যাগ থেকে ক্যাম্পিংয়ের সরঞ্জাম নামাতে লাগল। ছোট ছোট দুইটা তাবু খাটিয়ে নিল ঢিবির মাঝখানটায়। তবে দুই তাবুর মাঝখানে বেশ খানিকটা দূরুত্ব রেখেছে।
আহাদ রাজা ছোট একটা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে দিল তাবুর পাশে। রিয়াদ কিছু কাঠ একত্র করে আগুন জ্বালিয়ে দিল, আর তাতেই অন্ধকার ভেদ করে চারপাশে এক চিলতে উষ্ণতা ফিরে এল। সবগুছগাছ শেষে সবাই ক্লান্ত হয়ে বসে পরল। রিদি ট্রেকিংয়ে আনা ইনস্ট্যান্ট নুডুলস আর গরম কফির মগ এনে সবার হাতে হাতে ধরিয়ে দিল। আহাদ রিদির হাত টেনে নিজের পাশে বসালো। রিদি একটু ইস্তিত্ব করছিল তার পাশে বসতে তুহিন আর রিয়াদকে দেখে। তবুও আহাদের চোখের ইশারায় সে আপত্তি জানাতে পারল না। ধীরেধীরে বসে পড়ল তার পাশে। মুগ্ধ চোখে চারপাশটা দেখতে লাগল। আহাদ কফির কাফ থেকে চুমুক তুলে কিন্চিৎ কপাল গুছিয়ে তাকাল তার প্রেয়সীর দিকে। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে, কি দেখছো? কোন প্রবলেম?”
রিদি হকচকিত হয়ে তাকাল, হালকা হেসে বলল,
“উহুম। দেখছি, জায়গাটা সত্যিই সুন্দর।”
তুহিন হাসল, আগুনের কুণ্ডলীতে কাঠের টুকরো ছুড়ে দিয়ে বলল,
“দিনের বেলা দেখলে আরও প্রেমে পড়বেন ভাবি। সকাল হলেই বুঝবেন আসল নাখাফুম কাকে বলে।”
“আপনারা এর আগেও এসেছিলেন এখানে?”
কৌতহল নিয়ে প্রশ্ন করল রিদি। তুহিন এবার নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। যেন গল্প করার জন্য প্রস্তুত। গলা পরিষ্কার করে বলল,
“হ্যাঁ, কলেজে পড়ার সময় এসেছিলাম একবার। আহাদও ছিল সাথে। অনেক পুরনো ঘটনা কিন্তু এখানকার সৌন্দর্য একটুও বদলায়নি।”
একেটু থেমে সে আবার বলল,
“তখন একটা মজার ঘটনাও ঘটেছিল।”
“কি ঘটেছিল?”
রিদি আগ্রহ নিয়ে তাকাল। তুহিন একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে শুরু করল,
“তখন আমাদের টিমের লিডার ছিল আহাদ। কিন্তু সে বার টিমের লিডার বানিয়েছিল অন্য একজনকে, যার সাথে আহাদের কখনই বনিবনা হতো না। তাই আহাদ তাকে লিডার বলে মানতেও রাজি ছিল না। তবে বাধ্য হয়ে সেই টিমের সাথেই আসতে হয়েছিল। তো, এখানেই ঘটেছিল আসল মজাটা…”
“স্টপ ইট, তুহিন!”
গর্জে উঠল আহাদ রাজা, চোখ রাঙিয়ে তাকাল তুহিনের দিকে। তুহিন হেসে বলল,
“কী স্টপ ইট! তুই স্টপ ইট!”
দাঁত কিড়মিড় করে তুহিনের দিকে তাকিয়ে রইল আহাদ রাজা। তবে তুহিন সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে আবার বলতে শুরু করল,
“আপনার স্বামি কি করেছে জানেন?”
রিদি কৌতহলী নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি করেছে?”
“আপনার স্বামী লুকিয়ে সেই লিডারের প্যান্টে বিছুটি পাতা ঢুকিয়ে দিয়েছিল!”
“কি?”
রিদির চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল, রিয়াদ হো হো করে হেসে উঠল।
“হ্যাঁ! সবাই মিলে পাহাড়ি পথে হাঁটছিলাম, হঠাৎ সেই ছেলেটা চিৎকার দিয়ে ছটফটাতে শুরু করল। শেষমেশ সহ্য করতে না পেরে পাশের একটা পুকুরে ঝাঁপ দিল! ভাবতে পারেন?”
রিয়াদ হাসতে হাসতে বলল,
“ভাই, আপনি তো খুব ডেঞ্জার ছিলেন!”
“ওতেই শেষ না, রিয়াদ। পরেরদিন সে ছেলেটার কফিতে জামলা গোটা মিশিয়ে দিল, আর যখন বেচারা ওয়াশরুমে দৌঁড়া দৌঁড়ি শুরু করলো। রাজা সাহেব বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে নিচ দিয়ে পটকা ছুড়ে মারলো। এমন শিক্ষা পেয়েছিল যে লিডার হওয়ার স্বাদ মিটে গেছিল তার। এরপর থেকে আহাদ রাজার নাম শুনলেই তেল ঢেলে পালাত!
কিন্তু এর জন্য আহাদকে শাস্তি হিসেবে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, আমাদের ডিপার্টমেন্টের হেড! পাক্কা আধ ঘন্টা কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিল!”
তুহিন নিজেই হো হো করে হেসে উঠল। রিয়াদ অবাক হয়ে আহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাই আপনি তো খুব দুষ্ট ছিলেন।”
“শুধু দুষ্ট না, পিএইচডি করা বজ্জাত ছিল। ওকে কান ধরিয়েছিল বলে, সেই হেডের চেয়ারে সুপার-গ্লু রেখে দিয়েছিল। হেড চেয়ারের বসতেই সাথে সাথে চেয়ারের সাথে আটকে গেল। এরপর করুন অবস্থা হয়েছে, সেটা না হয় না-ই বললাম। অবশ্য এখনও ঐরকমই বজ্জাত আছে। কথায় আছে না, কুত্তরা লেজ বারো মাস চুঙ্গায় ঢুকায়া রাখলেও সোজা হয় না!”
সব ঠিক ছিল, কিন্তু তুহিনের শেষ কথাটা শুনে আহাদ রাজার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। রক্তচক্ষু করে তুহিনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। তুহিন সেটা খেয়াল করল না বরং সে নিজেই হেসে লুটিপাটি খাচ্ছে, সাথে রিয়াদও। রিদি আড় চোখে তাকাল পাশে বসে থাকা আহাদ রাজার দিকে। তার মুখের ভঙ্গি দেখে রিদিও মুখ টিপে হেসে ফেললো। এতে আহাদের রাগ আরো দিগুন বেড়ে গেলো।
“তুহিনের বাচ্চা!”
গর্জে উঠল আহাদ। আগুনের আলোয় তার মুখটা যেন আরও গাঢ় লাল হয়ে উঠল। এক মুহূর্তেই হাসি থেমে গেল সবার। বাতাস ভারী হয়ে উঠল। রিদি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আহাদের দিকে। তার গলায় গর্জন,
“আমাকে নিয়ে ফান করতেছিস?”
তুহিন কৃত্তিম হাসি টেনে উপর নিচ মাথা দোলাল, অর্থাৎ হ্যাঁ। আহাদ আবার দাঁতে দাঁত পিষে গর্জে উঠল,
“তুহিন!!”
তুহিন বুঝতে পারলো রাজা সাহেব বেজায় রেগে আছে। তাই সে দ্রুত উঠে পরলো। রিয়াদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“চল রিয়াদ, একটু ঠান্ডা হাওয়া খেয়ে আসি। মন্ত্রী সাহেব ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত আশেপাশে থাকা নিরাপদ না।”
রিয়াদ হেসে তার সঙ্গে বেরিয়ে গেল। তারা একটা টর্চ জ্বালিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল, আহাদ রাজার নির্দেশ অনুযায়ী তাদের বোর্ড চালকরাও তাদের বোর্ড নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তুহিন আর রিয়াদ সেদিকেই গেলো। আহাদ রাজা তখনও রাগে ফুঁসছে। রিদিতা তাকে শান্তনা দেয়ার জন্য একটু নড়ে তার পাশ ঘেঁষে বসল। দু’হাতে তার বাহু জড়িয়ে আলত করে মাথাটা রাখল তার কাঁধে। আহাদ আড় চোখে তাকাল সেদিকে, এক পলকেই তার রাগ ঠান্ডা বরফের ন্যায় হয়ে গেলো। সেও হাত বাড়িয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে নিল নিজের প্রেয়সীকে।
রাত বাড়লো। চারদিকে ঘন অন্ধকার। ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক, বুনো পাখির আর্তনাদ, আর ঝর্নার জলপ্রপাতের একটানা গর্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ঢিবির আশপাশের ঘন জঙ্গলে মাঝেমাঝে জোনাক পোকার দল জ্বলে উঠছিল। যেন কোনো গোপন ভাষার সংকেতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘন মেঘের আড়াল থেকে একটা পূর্ণ চাঁদ উঁকি দিল। চাঁদের আলো যখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল, তখন দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। আলো-আঁধারিতে ঝর্নার জলপ্রপাতের সাদা মুক্তার মত জলকণাগুলো বাতাসের আর্দ্রতায় চিকচিক করছে। মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাতেই রিদি স্তব্ধ হয়ে গেল, সেখানে অসংখ্য তারার মেলা! শহুরে আলোয় অভ্যস্ত চোখে এত তারার সমাহার আগে কখনও দেখেনি রিদি।
আহাদ রাজার কাঁধে মাথা রেখে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অসীম আকাশে। মনে হচ্ছিল যেন কেউ কালো মখমলের কাপড়ে হীরার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছে। নিজের প্রেয়সীর সেই মায়াবি দৃষ্টির দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইল আহাদ রাজা। তার মনে হলো, এই পৃথিবীতে এরচেয়ে সুন্দর কিছু আর হতে পারে না। তার ঠান্ডা হাত দুটো নিজের হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে নিলো। অতঃপর তার দৃষ্টি অনুকরন করে তাকালো আকাশের পানে, গুনগুন করে গেয়ে উঠল,
“রাতেরই এ আঁধারে
অজানা ছোঁয়া
মায়াবী চোখে কি মায়া
যেন গোধূলি আবীর মাখা
কি নেশা ছড়ালে…
কি মায়ায় জড়ালে..
কি নেশা ছড়ালে…
কি মায়ায় জড়ালে..”
মৃদু হাওয়ায় আহাদ রাজার চুলগুলো উড়ছে। রিদিতা গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে সেই মানুষটার দিকে। প্রথমবার আহাদ রাজার এই অমায়িক কন্ঠে গান শোনার সৌভাগ্য হলো রিদির। নেজের প্রেয়সীকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা হেসে আহাদ রাজা জিজ্ঞেস করল,
“কি দেখছো এভাবে?”
“আপনাকে!”
“আমার লজ্জা করেনা বুঝি?”
হালকা হাসল রিদি, বলল,
“আপনি এত সুন্দর গান গাইতে পারেন জানা ছিল না।”
“এখনো অনেক কিছুই তোমার অজানা, জানু! আহাদ রাজাকে জানতে হলে আরও কাছাকাছি আসতে হবে।”
রিদি তার কণ্ঠের গভীর সুরে লুকানো ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল। হালকা লজ্জায় চোখ নামিয়ে অন্য দিকে তাকাল। ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল ঢিবির কিনারা ঘেঁষে থাকা একটা সরু পথের দিকে। যেখানে অসংখ্য জোনাকি আলো ঝলমল করছে। রিদি উৎসাহভরে বলল,
“চলুন না, ওই দিকটায় যাই!”
আহাদ রাজা ঘুড়ে তাকাল সেদিকে। কিছুটা বিচলিত হয়ে বলে উঠল,
“মাথা খারাপ! দেখেই তো মনে হচ্ছে কোন ভূতের গুহা।”
রিদি ভ্রুু কুচঁকে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি ভূতকে ভয় পান?”
সে নিজের দূর্বলতা লুকিয়ে, ঠোঁটে আত্মবিশ্বাসী হাসি টেনে বলল,
“আহাদ রাজা পাবে ভূতের ভয়?”
“তাহলে যেতে চাইছেন না কেন?”
“তোমার কথা ভেবে যেতে চাইছি না। সেখানে গেলে যদি ভূত আমার সুন্দরী বউটাকে নিয়ে যায়! তখন তো আমি এতিম হয়ে যাব।”
“বউ না থাকলে কেউ এতিম হয় না। আর আমার আব্বু বলছে ভূত টূত বলতে কিছু হয় না। হ্যাঁ জ্বীন আছে, তাদের মধ্যে ভালো জ্বীন খারাপ জ্বীন হয়। খারাপ জ্বীনেরা মানুষেদের ভয় দেখায়, ক্ষতি করার চেষ্টা করে। তাই মানুষ খারাপ জ্বীনটাকে ভূত বলে সম্বোধন করে।”
“ওই সম্বোধন যেহেতু করে তার মানে ওই টাই ভূত।”
“তার মানে আপনি যাবেন না?”
“না।”
এই সোজাসাপ্টা ‘না’ এর উত্তরে রিদির মুখ কালো হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ঠোঁট ফুলিয়ে, উঠে গটগট করে তাবুর ভেতর ঢুকে গেল। আহাদ স্পষ্ট বুঝতে তার প্রেয়সীর অভিমান। তবুও সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“তোমার অভিমানের থেকে আমার জান বাঁচানো ফরয জানু!আমি মরে গেলে তোমায় এত ভালো কে বাসবে!”
একটা ভারী নিশ্বাষ ছাড়লো। এমন সময় শুকনো পাতার মর্মর শব্দ ভেসে এলো। প্রথমে গ্রাহ্য করল না আহাদ, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শব্দটা স্পষ্ট হতে লাগল। নিয়মিত, ভারী, ধীরেধীরে কাছে আসছে। কপলে গভীর ভাঁজ পরলো তার, সামান্য ঘাড় বাঁকিয়ে ঘুড়ে তাকাতেই তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। একটা লম্বা ছাঁয়ামূর্তি, আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তার দুটো মাথা। সে তড়াক করে দাঁড়িয়ে পরলো। মুখের সব রঙ মুহূর্তেই লোপাট। কণ্ঠ শুকিয়ে একদম ফিসফিস হয়ে গেল,
“ভূ.. ভূত!”
সাদা চাদরের মত পোষাক পরা। দুটো মাথা ওয়ালা ভূতটা এগিয়ে আসছে। তার গলার সেই অস্বাভাবিক স্বর শুনে রিদি তাবুর পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এল। কিছু বলতে যাবে এমন সময় তার চোখেও ধরা পড়ল সেই অদ্ভুত ছাঁয়াটা। দুটো মাথা। দুটোই সমান লম্বা। সাদা চাদরে মোড়া যেন অদ্ভুত এক অবয়ব। রিদি গলা শুকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সামনের দৃশ্য দেখে তারও সারা শরীর কেঁপে উঠল। সে যতই বুলুক ভূত টূত কিছু নেই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সেও ভয় পায়। তাছাড়া এখন সেই দ্বি-মূখা সাদা ভূতটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সে তোতলাতে তোতলাতে চেঁচিয়ে উঠল,
“ভূ.. ভূ ভূত! ভূত!”
আহাদ এক ঝটকায় আগুনের জলন্ত পোড়া একটা কাঠ তুলে নিলো। রিদিকে নিজের দিকে টেনে এক হাতে জড়িয়ে নিলো। যেন নিজের প্রেয়সীকে রক্ষার চেষ্টা। জলন্ত পোড়া কাঠটা সামনে বাড়িয়ে বলে উঠল,
“খবরদার! আমার বউয়ের দিকে নজড় দিবি না! তাহলে কিন্তু থাপ্পড়ায়া চেহারার নকশা পাল্টে দিবো!”
কিন্তু সেই সাদা কাপড়ে মোড়ানো মাথা দুটো আরেকটু এগিয়ে এলো। সে ভড়কে রিদিকে নিয়ে একধাপ পিছিয়ে গেলো। রিদি তার বুকে লেগে আছে। আহাদ পোড়া কাঠ ছুঁড়ে মেরে মন্ত্রোচ্চারণের মত বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“ইচিং বচিং চিচিং চা
ভূত তুই সরে যা!
ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি,
নইলে তোরে দেবো খাঁমচি!
খেতে না চাইলে আহাদ রাজার মার..
লেজ গুটিয়ে যা পগারপার!”
রিদি চোখ গোল গোল করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আহাদ রাজার দিকে। এটা কি ছিলো, কবিতা? না ভূত তাড়ানোর মন্ত্র? রিদি হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো। অবিশ্বাসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যে আহাদ রাজার ভয়ে সবাই কাঁপে, সেই আহাদ রাজা কি না ভূতকে ভয় পায়! আহাদের এমন মন্ত্র শুনে সাদা চাদরের নিচে থাকা তুহিন আর রিয়াদ তব্ধা খেলো। একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুহুর্তেই হো হো করে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো। একেকজন হেসে লুটিপাটি খাচ্ছে। তাদের চাদর সরে যেতেই চাঁদের আর আগুনের ম্লান আলোয় তাদের মুখ ভেসে উঠল। রিদি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠল,
“তুহিন ভাইয়া! রিয়াদ ভাইয়া!”
অতঃপর নিজের বুকে নিজে থু থু দিয়ে বলল,
“ভয় পাইয়ে দিছিলেন তো!”
তুহিন আর রিয়াদ হাসতে হাসতে প্রায় নুইয়ে পড়লো। কিন্ত আহাদের দিকে চোখ পরতেই দুজনের হাসি উবে গেলো। আহাদের চোখ তখন লাল। মনে হচ্ছে চোখের ভিতর থেকে আগুন বের হচ্ছে। কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিষে গর্জে উঠল,
“তুহিনের বাচ্চা!”
লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩৪
তুহিন একটা কৃত্তিম হাসি টেনে আনলো মুখে। মজা করতে গিয়ে ভুলেই গেছিলো, সে কার সাথে মজা করছে। আহাদ তার দিকে তেড়ে আসতেই সে ছুটে দৌঁড় দিল, সাথে রিয়াদও। আহাদ পিছু নিলো দুজনের, কিন্তু কিছুটা গিয়ে পিছন ফিরে তাকাল। সেখানে রিদি একা দাঁড়িয়ে আছে।হালকা কাঁপছে। আহাদের শরীর গরম, রাগ এখনো মাথা থেকে নামেনি কিন্তু তার প্রেয়সীকে একা ফেলে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। তাই সে আবার ফিরে এলো। রিদিকে এক হাতে নিজের বক্ষস্থলে টেনে নিল। আলতো করে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখল। কিন্ত মনে মনে স্থির করল, এই দুইটার একটা শায়েস্তা করতেই হবে!
