শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৩৩+৩৪
Nabila Ishq
দীপ্তর উচ্চকণ্ঠ ভেসে বেড়াচ্ছে দেয়ালে-দেয়ালে। বাচ্চা-বাচ্চা কণ্ঠটি কর্ণগোচর হতে মুষড়ে ওঠে অরু। একঝটকায় সরে আসে তন্ময়ের উচ্চতাপ জনিত দেহখানা ছেড়ে। শীতলতার চাদরে লেপ্টানো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এযাত্রায় ভয়ের বিচরণ ছেয়ে গেল। আতঙ্কে ছোটোখাটো মুখমণ্ডল এইটুকুন হয়ে এসেছে। তাড়াহুড়ো পদচারণ ফেলে চতুর্দিক ছুটছে। আত্মগোপনের অপ্রাণ প্রয়াস।তন্ময় ব্যাকুলতম প্রেয়সীর চঞ্চলতা নিত্যকার মত নিশ্চুপ মুখে, নির্নিমেষ চোখে দেখল। অগোচরে বিশেষ ভঙ্গিতে হাসল। এতটা ভয় পাবার মানে আছে কী?
শাহজাহান তন্ময় দাঁড়িয়ে অর্থাৎ সে নিজে উপস্থিত থাকতে মেয়েটা কীনা এক বাচ্চা ছেলেকে ভয় পাচ্ছে? এও তাকে দেখতে হলো এই চোখে? অরু ইতোমধ্যে ছাঁদের এক কোণে আঁধারেতে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে। শ্বাসপর্ব নেওয়া-দেওয়া বন্ধ প্রায়। দীপ্ত গুনগুন সুরে গান গাইতে-গাইতে ওঠে এসেছে এযাত্রায়। ঝাঁকড়া চুলের মাথাটা ঢোকাল ছাঁদের দরজা চিড়ে। তন্ময় মানব ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে নিজের লম্বাটে দেহ নিয়ে। দীপ্ত বিচক্ষণ নয়নে একপল তন্ময়ের পানে চেয়ে নিলো। পরমুহুর্তেই পরিপূর্ণ ভাবে সম্পূর্ণ ছাঁদে দৃষ্টি ঘোরাল। অরুকে দেখতে না পেয়ে প্রশ্ন করল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
‘অরুপি কোথায় ভাইয়া?’
‘বাগানে।’
দীপ্ত সন্দিহান বড্ড। পুনরায় একপল ছাঁদের আনাচেকানাচে নজর ঘুরেফিরে থামল তন্ময়ের ওপর। বোকাঝোকা চোখে চেয়ে বলল,
‘বাগানে? বৃষ্টির মধ্যে বাগানে? তবে আমি তো থার্টি মিনিটস পূর্বে ছাঁদে আসতে দেখলাম। নামলে নিশ্চয়ই খেয়াল করতাম। লিভিংরুমেই তো বসেছিলাম। আর্ট করছিলাম।’
‘আর্টে কনসেন্ট্রেশন ছিল। তাই দেখিস নিই।’
দীপ্ত বয়স্ক বৃদ্ধার মত হিসেব-নিকেশ করে ভাবল। বোঝার ন্যায় মাথাটা দোলাল। নাক দিয়ে ‘হম’ ধ্বনি তুলল,
‘হতে পারে। এক্ষুনি চাচ্চুকে গিয়ে জানাচ্ছি অরুপি বৃষ্টিতে ভিজছে। দিবে বকা। বেশ হবে তখন। জ্বর বাঁধলে বুঝবে ঠ্যালা।’
দীপ্ত যেন এই সুযোগটিকে হাতেনাতে ধরতে চাইছে। বিচার দিতে ততক্ষণাৎ ছুটে চলে গিয়েছে। তন্ময় ঘুরে তাকায় অরুর আত্মগোপনের জায়গাটিতে। অন্ধকারে দেখতে চায় মেয়েটার মুখের একেকটি পরিবর্তন। অরু বেরিয়ে এলো তক্ষুনি। আড়ে-আড়ে দুবার চাইল তন্ময়ের মুখ পানে। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ আঁখিদুটির ঘনঘন পাপড়ি ঝাপটে নিচ্ছে। ওষ্ঠতে ওষ্ঠ চেপে রেখেছে নিবিড়ভাবে। তন্ময় এগুল ওর দিকে। দু’পা এক’পা ফেলে অগ্রসর হচ্ছে। অরু চেঁচাল এমুহূর্তে। ধড়ফড়িয়ে ওঠা বুকখানা চেপে বলল,
‘আমাকে ডাকা হচ্ছে।’
বলে সে দৌড় লাগাল। দৌড়ের গতি এতটাই দারুণ যে, এই দৌড়ে নিশ্চিত স্কুলকলেজের দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হত। আগে-পেছনে কিংবা ডানে-বামে তাকানোর প্রয়োজনবোধটুকু অবদি করেনি। তন্ময় মুচকি হেসে মাথা নত করে। তাকায় ডান হাতটার পানে। এই হাতেই তো ওই প্রফুল্লবদন ছুঁয়ে ছিল এযাবৎ। আর এই ঠোঁট দ্বারা…তন্ময়ের আফসোস লাগল এযাত্রায়! সেত ওই রক্তিম ওষ্ঠদ্বয় দেখতে পারল না। পূর্বেই মেয়েটা পালিয়েছে। অভিমান, রাগ, ভুল বোঝাবুঝি কী ভেঙেছে ওর? অরুর অভিমান যে বড্ড ভয়ংকরতম! হঠাৎ করে ছাঁদের দরজার সামনে অরু এসে হাজির হলো। শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার গতি দ্রুত। কোনোমতে ঝটপটে কণ্ঠে বলল,
‘ঠান্ডা লাগবে। চলে আসুন।’
কথকটুকু বলে পুনরায় ছুটে চলে গেল। তন্ময়ের ‘শোন’ শব্দটি বাতাসে ভেসে বেড়াল। যার উদ্দেশ্যে ছোঁড়া হলো সে ব্যক্তি শোনার সময় পেল না। তন্ময় আরেকদফায় হাসল। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যাক, প্রেয়সীর অভিমান ভেঙেছে তাহলে!
রাতভর বর্ষণ চলল। হিমশীতল হাওয়ারা একচিত্তে বইতে থাকল। রিমঝিম মাতোয়ারায় মত্ত বৃষ্টির ধ্বনি শাহজাহান বাড়িটা জুড়ে। আকস্মিক আঁধারে আসমান চমকে সাদা হয়ে উঠছে। বজ্রপাত হচ্ছে ক্ষণেক্ষণে শব্দ তুলে। জানালাটা সম্পূর্ণরূপে খোলা। শুভ্র রঙের পর্দাগুলো উড়ছে নৃত্যের চিত্তে। বাতাসে বাতাসে লেপ্টে ঘরে প্রবেশ করছে বৃষ্টির জল। ফ্লোর অনেকাংশে ভিজে গিয়েছে। সেদিকে ধ্যান নেই তন্ময়ের। সে অবলীলায় বুকের দিকটায় বিছানায় লেপ্টে উবুড় হয়ে শুয়ে। কোমরে পড়ে আছে পাতলা কম্বলটা। উদোম দেহখানা দৃশ্যমান। দেয়াল ঘড়িতে ভোরের ছটা। বাইরেটা অন্ধকারে আচ্ছন্নভাব। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধততা সবটা জুড়ে। মাথার ওপরের ফ্যানটাও বন্ধ। রাতের শেষভাগে নয়নযুগলে তন্দ্রারা ধরা দিয়েছে তন্ময়ের। এই কারণ বসত আজ আর সকাল-সকাল ঘুম ভাঙবে না তার। হলোও তাই। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে এলো নটাতে। এযাত্রায়ও তন্ময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হবে না? টানা কিছুদিন তার ঘুম হয়নি। চিন্তিত, বিদ্রোহ হৃদয় নিয়ে উদাস, হতাশ হয়ে ঘুরেফিরেছে। কাজকর্ম উঠেছে লাটে।
কোনোকিছুতেই মন বসেনি, বসাতে পারেনি। তার ব্যক্তিত্ব, তার ধৈর্য সবকিছু অরুর সামনে বৃথা হয়ে দাঁড়ায়। এই একটা পুচকে মেয়ের সামনে সে স্তব্দ, স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা দেখে না। দেখবে কীভাবে? তাকে এমন ভাবে নিজের ছোটো হাতের ছোট্ট পাঁচটা আঙুলে পেঁচিয়ে নিয়েছে যে, এজীবনে তার মুক্তি নেই। অবশ্য তন্ময় মুক্তি চায় না। সে এভাবে চিরজীবন আটকে থাকতে চায়। আশ্চর্যজনক বিষয়টা হলো, আজ তাকে কেউ ডাকেনি। ঘুম ভাঙানোর প্রয়াস করেনি। কেন? তন্ময়ের তন্দ্রের ঘোর সামান্য কেটে গেছে আপাতত। সে আধশোয়া হয়ে বসেছে। তাকাল দেয়াল ঘড়ির দিকে। মস্তিষ্ক এখনো স্লো পেসডে চলছে যেন। দরজাটায় ছোট্টখাট্টো একটা করাঘাত পড়ল। তন্ময় ঘুমে বসে যাওয়া গম্ভীর কণ্ঠে সাঁড়া দিবে পূর্বে একটি বড়ো কালো চুলের মাথা ঢোকে আচমকা। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিত হয়। মিলতেই মাথাটা মুহূর্তে বেরিয়ে যায় একশো ডিগ্রি গতিতে। তন্ময় হেসে ওঠে। গলা উঁচিয়ে ডাকে,
‘আয়।’
অরু ঢুকল না। ধীর কণ্ঠে বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকে জানায়,
‘বড়ো মা, কফি পাঠিয়েছে।’
‘রেখে যা।’
অরু তখনো বাহিরে দাঁড়িয়ে। ভেতরে আসছে না। তন্ময় আগ্রহী চোখে চেয়ে। সে ভেবে রেখেছিল অরু আজ সারাদিন হয়ত তার ত্রিসীমাতে আসবে না। লজ্জায় লাল-নীল-বেগুনি হয়ে পালিয়ে বেড়াবে। তবে তাকে ভুল প্রমাণ করে সাতসকালে সুশ্রী মুখখানা নিয়ে হাজির। এত মেঘ না চাইতেই জলের হদিস পাওয়া। তন্ময় আর ডাকল না। অরুকে সময় দিলো। ঠিক মিনিট খানেক সময় নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল অরু। মিনমিনে পদচারণ ফেলে আসছে। এদিক-ওদিক অর্থাৎ ডানে-বামে, ওপরে-নিচে তাকানো হচ্ছে শুধু তন্ময়ের পানে দৃষ্টি ফেলছে না। তন্ময় হাত বাড়াল। বলল,
‘কফি দিবি না?’
অরু ততক্ষণাৎ এগিয়ে ধরল। তন্ময় কফির মগটা নেয়ার সময় অনুদ্দেশ্যমূলক স্পর্শ করল অরুর কম্পিত হাত জোড়া। কাঁপতে থাকা নরম হাত দুটো এযাত্রায় ঠকঠক করে কেঁপে উঠল যেন। ঠাণ্ডা কফির মুগ ছুঁয়ে তন্ময় নির্বাক। এক চুমুক খেয়ে বাকশক্তিহীন। এ কফি নাকি শরবত? অরু লুকিয়ে, অগোচরে বারংবার চাইছে। তন্ময়ের বুঝতে আর বাকি রইল না কফিটা কে করেছে! সে সেই কফি নামক শরবতটুকু পান করতে থাকল। অরুর মুখশ্রী সূর্যমুখী ফুলের ন্যায় ফুটে ওঠেছে। ঝিলিক মারছে কালো মণি যুগল। তন্ময় বহুকষ্ঠে গিলল আরেক চুমুক। অরুর দিক তাকাল। শুধাল,
‘কফি নিয়ে লুডু খেলতে বসেছিলি?’
অরু ফ্যালফ্যাল করে চাইল, ‘লুডু কীভাবে খেলে কফি নিয়ে?’
‘তাহলে এত ঠাণ্ডা কেন?’
অরু জিহ্বা কামড়াল। হাত বাড়াল দ্রুত, ‘আমি গরম করে এনে দিচ্ছি। দিন।’
তন্ময় ফেরত দিলো না। পান করতে থাকল। একফাঁকে বলল,
‘এখন থেকেই ঠাণ্ডা কফি খাওয়া শিখি। ভবিষ্যতে তো ঠাণ্ডা কফিই খেতে হবে মনে হচ্ছে!’
অরু বুঝল না যেমন। সরু চোখে চেয়ে। পরপর মুখের রঙ বদলাল। বলদটা কী ভাবল কে জানে! মুখে ওড়নার একাংশ চেপে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। তন্ময় দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কফিটা দেখল। চোখমুখ খিঁচে একটানে গিলে ফেলল।
শীতল হয়ে যাওয়া কফিটা খেয়ে তন্ময়ের সর্বাঙ্গ গুলিয়ে ওঠে।
দেহের সমস্ত অংশ জুড়ে কুৎসিত শিহরন বয়ে যায়। লম্বা একটি সময় ধরে থমকে; চোখমুখ বুজে পড়ে রয়। চিনি হয়তোবা বয়ামে যতটুকু ছিলো সবটুকুই কফিতে ঢেলেছে। নাহলে এতটা মিষ্টি কীভাবে হয়? এহেন মিষ্টি ধাঁচের কফি খাওয়ার অভিজ্ঞতা তন্ময়ের এই প্রথম। সামনে আরও কতরকমের অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে হয়, তা এক সৃষ্টিকর্তাই জানেন। বমি ভাবটা কেটে যেতে বিছানা ছাড়ল। ফকফকে সাদা ফ্লোরে পদচারণ ফেলে ওঠে দাঁড়াল। জানালার সম্মুখে এসে বাইরে তাকাল। সূর্যের ঈষৎ দেখা মিলল এবেলায়। সূর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে বাগানটি লোভনীয় দৃশ্যে পরিনত হয়েছে। সাতসকালে মন-মস্তিষ্ক নিপুণ ভাবে চমৎকার করতে এই দৃশ্যটুকু নিঃসন্দেহে কার্যকর। কার্যকরী এই বাগানের চেয়ে বাগানের মালিনীর সুশ্রী মুখমন্ডল অবশ্য আরো দৃঢ়ভাবে কার্যকরী। এযাত্রায় তার উষ্ণ অনুভূতির ছন্দপতন ঘটাতে সেলফোন ভাইব্রেট হতে লাগল। বড়ো বড়ো ইংরেজি অক্ষরে বন্ধু মাহিনের নাম ভেসে উঠল।
সাতসকালে ঠিক কী কারণে তাকে কল দিচ্ছে ভাবার সময় নিলো না। কল রিসিভ করে, ফোন কানে গুঁজল। ওপাশে মাহিন নিত্যকার হাবভাবপূর্ণ উচ্চকণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘কই তুই?’
তন্ময় নির্বিকার গলায় জানাল,
‘বাসায়।’
আশ্চর্যের সপ্তমে পৌঁছাল যেন মাহিনের স্বর,
‘বাসায়! তাও আজকে? কারণ কী? তোর প্রেয়সীর মনমালিন্যতা গলে গেছে?’
এহেন প্রশ্নের সম্মুখে তন্ময় নির্লিপ্ত,
‘তুই কোথায়?’
‘তোকে খুঁজতে এসছিলাম তোর অফিসে। এখন ফিরে যাচ্ছি। সন্ধ্যায় বেরোবি। তখন বলব।’
ওপাশ হতে লাইন কেটে দেবার ধ্বনি কর্নগোচর হলো। সেলফোন বিছানায় ছুঁড়ে তন্ময় ওয়াশরুম ঢুকল। দাঁত ব্রাশ করে, হাতমুখ ধুয়ে তোয়ালে হাতে বেরুতেই দেখল অরুকে। বিছানা গোছাচ্ছে। বিছানা গোছানো ওর বাহানামাত্র। নজর ঘুরেফিরে তার পানেই নিবদ্ধ করছে। তন্ময় অবলীলায় ঈষৎ অদেখা হাসে। তোয়ালেতে মুখ মুছতে নিয়ে আয়নার সম্মুখে দাঁড়ায়। অরু ইতস্ততভাবে আড়ে-আড়ে দুবার চেয়ে প্রশ্ন করে বসে,
‘আপনি আজ বাড়িতেই থাকছেন বুঝি?’
তন্ময় আয়নাতে নজর ফেলে দেখে নিজের অবাধ্যগত বলদটাকে।
ভ্রু তুলে শুধায়,
‘তুই চাচ্ছিস না আমি থাকি?’
অরুর সরু চোখজোড়া বড়ো হয়ে এলো,
‘কেন চাইব না?’
তন্ময় উদাস হবার ভাণ ধরল,
‘চাইবি বুঝি? কেন?’
কথার মারপ্যাঁচ খেয়ে অরু থামকাল। বিমুঢ় হলো। এলোমেলো নয়নে এদিক-ওদিক চাইল। তোতলানো গলায় বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘কত রঙ। একেকসময় একেক ভাবভঙ্গি। থাকছেন নাকি বললেই হয়!’
তন্ময় দুর্লভ হাসল এযাত্রায়। গম্ভীর কণ্ঠ খানা ফিনফিনে পাতলা শোনাল,
‘থাকছি। বাড়িতেই আছি আজ।’
অরুর পাতলা পেলব ওষ্ঠদ্বয় জুড়ে রিনঝিন হাসির বিচরণ। ওই হাস্যকর ওষ্ঠদ্বয়ে দৃষ্টি পড়তেই তন্ময়ের হৃদয় ধক করে উঠল। গতকাল রাত্রির ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত নয়নযুগলের সামনে ভেসে উঠল। ছোটোখাটো মেদহীন মসৃন দেহ ছোঁয়ার অনুভূতি এখনো সতেজ। ওষ্ঠতে ওষ্ঠ মিলনের অনুভূতি স্পষ্টভাবে চেতনাজুড়ে। সাদা দাঁতে ঠোঁট পিষে তন্ময় আড়চোখে চাইল। ওর ফোলাফোলা গাল জোড়া হাসির তালেতে লোভনীয় দৃশ্যে রুপান্তরিত হয়েছে। তন্ময়ের ইচ্ছে করল দুরত্ব ঘুচিয়ে গাল দুটো টেনে ধরতে। একচিত্তে কিছু চুমু বসাতে পারলে হৃদয় প্রশান্তি অনুভব করত। তবে ক্ষনিকের প্রশান্তি লোভনীয় হলেও সেই লোভের ডাকে সে সাড়া দেবে না। অরুটা ভীষণ ছোটো। এসব কুকর্মিত কাজকর্ম মেয়েটার অষ্টাদশী হৃদয়ে তুফান বইয়ে দেবে। তারপর পড়াশোনা যাবে গাঙ্গে ভেসে। দেখা যাবে তাকেও ভয়টয় পাবে না। কথাবার্তা শুনবে না। এই যুবতী মেয়েদের আন্ডারকন্ট্রলে রাখা প্রয়োজন। এই বয়সটা সকল ধ্বংসের শুরু। সে বিমর্ষ গলায় প্রশ্ন করল,
‘কলেজ যাস নাই কেন?’
অরু চুপসে গেল। ভেবেচিন্তে জবাবে বলল, ‘আপনিও তো অফিস যাননি!’
‘তাহলে তো যাওয়া উচিৎ ছিল।’
অরু চেঁচিয়ে উঠল, ‘না। একদমই উচিৎ ছিল না। আমি আজ ছুটি নিয়েছি। মাথা ব্যথার জন্য চাচ্চু নিয়ে দিয়েছে। বিশ্বাস নাহলে চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করেন।’
তন্ময় কঠোরভাবে তাকানোর প্রয়াস চালাল, ‘রেগুলার ক্লাস অ্যাটেন্ড করবি। কোনোপ্রকার ফাঁকিবাজি চলবে না।’
অরু মিটিমিটি হেসে মাথা দোলাল। জানাল, ‘আমি আজ গোরুর মাংস রান্না করব।’
তন্ময়ের ভালোলাগা, ভালোবাসা, স্নেহ-আদর-আকঙ্খা-আকুলতা হুড়মুড়িয়ে খোলা জানালা দ্বারা পালাল। আতঙ্কে ধড়ফড়িয়ে উঠল বুকের ভেতরটা। অবিশ্বাস্য গলায় নিশ্চিত হতে শুধাল,
‘তুই রান্না করবি?’
তন্ময়ের আতঙ্কিত কণ্ঠ অরুর কর্ণকুহরে প্রবেশ করল না। সে পুনরায় ব্যস্ত হলো বিছানা গোছাতে। গোছানোর একফাঁকে বলল,
‘আমি গোরুর মাংস রান্না শিখেছি। আজ দুপুরে রান্না করব।’
তন্ময়ের ভ্রুদ্বয়ের মাঝে সূক্ষ ভাঁজ পড়ল, ‘হাতপা পু ড়িয়ে ফেলার ধান্দা?’
অরুর আত্মবিশ্বাসী গলায় জানাল, ‘আমি শিখেছি। রান্না করতে পারব।’ এতটুকু বলা পর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বাকিটুকু বলে ফেলল একনাগাড়ে, ‘আর এভাবেও ভবিষ্যতের জন্য তো আমায় শিখতে হবে।’
তন্ময়ের বুঝতে আর বাকি রইল না, এই গোরুর মাংসের তোরজোর কার জন্য হচ্ছে। নস্টালজিক অনুভূতি হলো তার। পরমুহূর্তেই চিন্তিত। অরুর রান্নাবান্নার করুণ অবস্থা। ঠিকঠাক রান্না করলেই হয়! নাহলে আজ তার প্রিয় খাবার অপ্রিয়-র তালিকায় যুক্ত হবে। প্রেয়সীর উত্তেজনায় ঘি ঢালতে তন্ময় কোনোরকমে বলল,
‘ওল দ্যি বেস্ট।’
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অরু গদগদ ভঙ্গিতে মাথা দোলাল। ছোটো করে, ‘খেতে আসুন’ বলে প্রফুল্লবদনে বেরিয়ে গেল। তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কফি খেয়ে পেট গুলিয়েছে। গোরুর মাংশ খেয়ে পেট ঝলসে না গেলেই, আলহামদুলিল্লাহ। সকালের নাস্তা করতে তন্ময় রুম ছেড়ে বেরোল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নিয়ে দেখল লিভিংরুম জুড়ে নিস্তব্ধতা, শূন্যতা। মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব অফিসে চলে গিয়েছেন। দীপ্ত স্কুলে, শাবিহা-রুবি এসময় ইউনিভার্সিটিতে। আকাশ ইদানিং ওহী সাহেবের সঙ্গে কাজে বেরোয়। তাই বাড়িঘর এসময়টাতে ফাঁকা থাকে। তন্ময় সোজা ডাইনিংয়ে চলে এলো। জবেদা বেগম ছেলেকে দেখতে পেয়ে গলা তুলে শুধালেন,
‘কী দিব খেতে? ঘি দিয়ে পরোটা আছে বানানো। সাথে দুরকম ভাজি।’
‘যা আছে তাই দাও।’
মিনিট খানেকের মধ্যেই অরু প্লেট হাতে হাজির। দুটো প্লেট দেখে ভ্রু তুলে তন্ময় প্রশ্ন করল, ‘ব্রেকফাস্ট করিস নিই?’
অদূর হতে জবাব দিলেন সুমিতা বেগম, ‘তোমার চাচ্চু কত করে নাস্তা করতে বললেন। করল না। এখন বেলা কয়টা? এখন বসবে খেতে!’
তন্ময় পাশের চেয়ারটা টেনে দিলো। অরু ঝটপট টেনে দেয়া চেয়ারে বসল। তন্ময়কে পরোটার প্লেট এগিয়ে দিলো। নিজে ত্বরান্বিত ভঙ্গিতে খেতে শুরু করল। ওর খাওয়ার ধরনে বোঝাই যাচ্ছে ক্ষুধার্ত ছিল। তন্ময় দু’আঙুলের সাহায্যে অরুর কপালে টোকা মারল,
‘এত ক্ষিদে পেলে সকালে খাস নাই কেন? না খেয়ে থাকার মানে কী? আর যদি এমন না দেখি। বোঝা গেল?’
অরু পরোটা মুখে পুড়ে মাথা দোলাল। যার অর্থ সে বুঝেছে। ব্যস্ততায় খেতে নিয়ে খাবার তালুতে উঠল। তন্ময় চটজলদি একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। পানিটুকু গিলে নিয়ে অরু খানিক খাওয়ার গতি কমাল। আড়চোখে চাইল পরিপাটি তন্ময়ের দিক।
জবেদা বেগম এলেন। তন্ময়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘বাবা, তুই বাসাতেই তো আছিস তাই না?’
তন্ময় খেতে নিয়েই জবাব দেয়, ‘হুঁ। কোনো দরকার ছিলো?’
‘হ্যাঁ রে। একটু বাজারে যেতি। কিছু তাজা সবজি লাগবে। যেই বাড়িতে থেকে এলাম, সে বাড়ির বাড়িওয়ালা রাহনুমা আফাকে দাওয়াত করেছিলাম। মেয়েটা নিয়ে আজ আসবে জানিয়েছে। ভালোমন্দ রান্নাবান্না তো করতে হয়।’
অরু খাওয়ার একফাঁকে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘ওনার মেয়ে আছে বুঝি? কে সে?’
‘রেবেকা! শাবিহার সাথেই তো পড়ত। চিনিস না?’
‘এখন চিনলাম।’
শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৩১+৩২
তন্ময় বলল, ‘লিস্ট করে দাও কী কী প্রয়োজন!’
জবেদা বেগম দ্রুতপায়ে ছুটে চলে গেলেন লিস্ট করতে। অরু এই ফাঁকে সুকৌশলে বলল, ‘আমিও যাব।’
‘তুই যেয়ে কী করবি? যাওয়া লাগবে না।’
পরোটার শেষটুকু মুখে ঢুকিয়ে অরু উঠে দাঁড়াল, ‘আমি রেডি হয়ে আসছি।’
