শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৪৭+৪৮
Nabila Ishq
গাড়ির দু’পাশের জানালার কাঁচ নেমে এলো। অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কোমল হাওয়া ছুঁয়ে গেল। সকালের স্নিগ্ধ রোদের রশ্মি মুখাবয়ব স্পর্শ করল। সুন্দর সকালের ব্যস্ত শহরটি দেখতে মন্দ লাগল না তন্ময়ের। সচরাচর সে রাস্তাঘাট নিখুঁত চোখে দেখে না; প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয় না। তবে মাস কয়েক ধরে নির্নিমেষ চোখে আশপাশটা দেখে। এই পৃথিবীর সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করা সে অরু থেকে শিখেছে। ও সবকিছুতে বড়ো আগ্রহী।
শহুরে নীরব রাস্তাঘাট চঞ্চল চোখে দেখতে ব্যাকুল রয়। প্রকৃতি উপভোগ করতে ভালোবাসে। আকাশ ভর্তি তারা, পূর্ণাঙ্গ চাঁদ–সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, নদীজল, ফুলগাছ; পাখিদের আনাগোনা সহ আরও অনেক কিছুতেই মুগ্ধ হয়ে বসে থাকে। ওর বিচলিত চোখের মুগ্ধতা তাকেও এসবের প্রতি আগ্রহ করে তুলেছে। আজকাল সেও পৃথিবীতে স্থাপিত অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করে বেড়ায়। অরুর মতন হয়তো মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে না। তবে দেখতে তার আজকাল ভালোই লাগে। আরও অসাধারণ লাগে অরু পাশে– খুব কাছাকাছি থাকলে। এইযে মহারানি পার্শ্ববর্তী সিটে উদাসীন ভঙ্গিতে বসে। মুখে রা নেই। নিশ্চল, নিশ্চুপ অরুকে সে রীতিমত ভয় পায়। সেইবার ওই চঞ্চল চোখজোড়া তার পানে না চেয়ে, কথাবার্তা না বলে, দূরত্ব বাড়িয়ে–তার হৃদয় ছুরি চালিয়ে র ক্তাক্ত করে রেখেছিল। আহা, কতটাই না নিদারুণ ব্যথিত প্রহর সে পেরিয়েছে। সেই দিনগুলোর কথা ভাবতেই মন শীতল হয়ে আসে। তীব্র ভাবে কেঁপে ওঠে ভেতরটা।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
শক্তপোক্ত হাতজোড়া স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যস্ত। অবিচল চোখজোড়া সড়কপথে চেয়ে আছে। একফাঁকে চোরাচাহনি ফেলে অরুকে দেখে নিলো। যুক্তির সুর তুলে–আগবাড়িয়ে নীরবতার সুতো ছিঁড়তে তন্ময় শুধাল,
‘ব্রেকফাস্ট করেছিলি?’
অরু কয়েকমুহূর্ত চুপ থাকল। হনহনিয়ে ফিরে তাকাল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে, একরোখা গলায় সময় নিয়ে জবাব দিলো,
‘খেতেই তো নেমেছিলাম। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সাতসকালে এক অবিশ্বাস্য অসাধারণ, ব্রিলিয়ান্ট– মাইন্ডব্লোয়িং, বিউটিফুল দৃশ্য দেখে খাওয়ার রুচি হুড়মুড়িয়ে চলে গেছে।’ এতটুকু বলে ক্ষণিকের জন্য থামল। যেন নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত দম গুছিয়ে নিচ্ছে। দম নিয়ে পরপরই তেড়ছা গলায় কলকল করে বলে গেল,
‘ডিরেক্টর-দের যে ভ্যালেন্টাইন উইশ করতে ফ্লাওয়ার্স পাঠাতে হয়, গেঁয়ো আমি জানতাম না। তাহলে তো আমিও পাঠাতাম আমার প্রিয় আনম্যারিড প্রফেসরকে। সমস্যা নেই এখন জেনে গেছি। আজই পাঠা…’
তন্ময়ের চোয়াল শক্ত হলো। কপালে নীল শিরা-উপশিরা ফুলে উঠল। চোখ রাঙিয়ে তাকাল। ধমকে সুরে বলল,
‘চুপ। একদম চুপ।’
এই চাপাস্বরের ধমকটা অরুর ঠিকঠাক হজম হলো না। বদহজম হলো বুঝি। সে ঠোঁটে ঠোঁট টিপে নাক ফুলালো। অভিমানী কণ্ঠে পরিষ্কার ভাবে আদেশ ছুঁড়ল,
‘গাড়ি থামান। আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। বাসায় ফিরব।’
তন্ময় যেন শুনেও শুনল না। বিয়ের পর মেয়েটার সাহস গুনেগুনে দশ ধাপে বেড়ে গেছে। ভয়ডর বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই আর। আগে যাও ধমক-টমক দিলে চুপসে যেতো। এখন উলটো তাকে চুপসে যেতে হয়, শাহজাহান তন্ময়কে! প্রেয়সীর রাগিত–টগবগে লালিত মুখমণ্ডল দেখে কণ্ঠ নরম করে বলল,
‘আই ডোন্ট নো হার। যেভাবে পাঠিয়েছে সেভাবেই বাইরে রাখতে বলেছি। আই ডিডন্ট ইভেন টাচ দ্যাট থিং।’
কথার পিঠে অরু মিনমিনে গলায় বলল,
‘সাহস দিয়েছেন বলেই পাঠানোর স্পর্ধা করেছে! আমাকেও ভার্সিটিতে যারা-যারা প্রপোজাল দেবে সবাইকে পরিষ্কার রিজেক্ট করব না। দোনামোনা করব। তাহলে পিছু লেগেই থাকবে। বাসায় বুকেও আসবে—’
মেইন রোডের পাশেতে গাড়িটা সজোরে ব্রেক কষল তন্ময়। অরুর তেঁতো-ঝাঁজাল কথাবার্তা থামাতে–পরমুহূর্তেই ওর ফোলাফোলা নরম গাল দুটো; ডানহাতের সাহায্যে চেপে ধরল। বুড়ো আঙুল ডান গালে, বাকি চার আঙুল বামগালে। রাগান্বিত, তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল,
‘যে প্রপোজ করবে ওর পা ভেঙে ফেলব। বাসায় ফুল পাঠাবে যে-হাতে ওই হাত ভেঙে ফেলব। বোঝা গেল?’ রাগিত কণ্ঠ খানা অসহায় হয়ে এলো এযাত্রায়,
‘আর কখনো বাসায় এসব আসবে না। কক্ষনো না। হুঁ? চুপ এবার।’
অরুর চোখমুখ ছোটো-ছোটো হয়ে এলো। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে গেল। তন্ময় ওর গাল ছাড়ল। মুখটা দৃষ্টির কাছাকাছি থাকায় স্পষ্ট দেখল ফর্সা গাল দুটো রক্তিম হয়ে গিয়েছে। আঙুলের ছাপ বসেছে। চোখের পলকে মাথাটা এগিয়ে ঝটপট দুগালে গাঢ় চুমু বসিয়ে দিলো। অরু আশ্চর্য হলো। এতটাই যে, চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে এলো। তন্ময় নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করল। যেন কিছুই হয়নি কিছুক্ষণ পূর্বে। সড়কপথে
দৃষ্টি রেখে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘কেএফসি যাচ্ছি তবে। পার্সেল আনব? নাকি ওখানে বসে খাবি?’
অরু তখনো স্তব্দ। তবে দৃষ্টি ছন্নছাড়া-এলোমেলো। ভুলবশতও তার দিকে চাইছে না। জড়সড়ভাব বসবার। তন্ময় আড়চোখে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাজুক ভঙ্গিতে মিটিমিটি হাসতে শুরু করেছে। ওর পূর্বের অভিমান পোঁটলাপুটলি বেঁধে পালিয়েছে। চঞ্চলতা ফিরেছে দৃশ্যমান রূপে। রয়েসয়ে মিহি গলায় জানায়,
‘ভিড় হবে আজ। পার্সেল আনুন–গাড়িতেই খাব।’
কেএফসির সম্মুখে গাড়ি থামাল তন্ময়। বেরিয়ে অরুকে ভেতরে রেখেই গাড়ি লক করল চাবি দিয়ে। এগোল কেএফসির ভেতর। অরুর কথামতন আজ দারুণরকমের ভিড় কেএফসি জুড়ে। কপোত-কপোতি দিয়ে প্রত্যেকটি টেবিল বুকড। দাঁড়ানোর জায়গাটুকু অবশিষ্ট নেই। পার্সেল নিয়ে বেরোতে তন্ময়ের পনেরো মিনিট লাগল। খাবার অরুর হাতে ধরিয়ে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করল। উদ্দেশ্যে উদ্দেশ্যহীন।
অরুকে ঘুরিয়েফিরিয়ে বাড়ি ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা। দুয়ার পেরোতেই আশ্চর্যজনক ভাবে অয়নকে দেখা গেল। সে লিভিংরুমে বসে। হাতে চায়ের কাপ। তার সম্মুখে মোস্তফা সাহেব। শক্তপোক্ত মুখ করে বসে। দোতালার পিলারের পেছনে শাবিহা নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে। অরু আড়চোখে মোস্তফা সাহেবের গম্ভীরমুখ দেখে দোতলায় চলে গেল। দাঁড়ানোর সাহস পেলো না। তন্ময়কে দেখতেই দাঁড়াতে চাইল অয়ন। তন্ময় হাতের ইশারায় বসবার তাগাদা দিলো। নিজেও ওর পাশে এসে বসল। জিজ্ঞেস করল,
‘কী খবর? চোখমুখ এমন কেন?’
অয়ন আড়চোখে ভবিষ্যৎ শ্বশুরের মুখপানে চেয়ে বলল, ‘শাবিহাকে ঘন্টাখানেকের জন্য নিতে চাচ্ছিলাম।’
তন্ময় হেসে সাবলীল গলায় বলল,
‘তো যাও নিয়ে। কে আটকেছে? শাবিহা কোথায়?’ পরপর উচ্চকণ্ঠে ডাকল,
‘এই শাবিহা! অয়ন অপেক্ষা করছে। তৈরি হয়ে নাম।’
মোস্তফা সাহেব আর কিছু বললেন না। তবে তার মুখাবয়ব পরিষ্কার জানাচ্ছে তিনি অসন্তুষ্ট। শাবিহা তৈরি হয়েই ছিল। ভাইয়ার পারমিশন পেতেই নেমে এলো সঙ্গে সঙ্গে। এতে খানিক নির্বাক হলেন মোস্তফা সাহেব। পুনরায় চোখের সামনে পরিষ্কার হলো, মিয়াঁ বিবি রাজি–তো কেয়া কারেগা, কাজি? কিছুই না। চুপচাপ দেখবেন শুধু। অয়ন সালাম জানিয়ে শাবিহাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তন্ময় উঠে দাঁড়াল। সিঁড়ির দিক যেতে-যেতে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
‘শুক্রবার অয়নের বাবা-মা আসবেন। শাবিহাকে আংটি সেদিন পরিয়ে যাবেন।’
মোস্তফা সাহেব বোঝবার ন্যায় মাথা দোলালেন। আংটি পরিয়ে গেলে বিয়ের দেরি নেই। আগামী মাসেই বিয়ের তারিখ পড়বে হয়তো। শাহজাহান বাড়ির বড়ো মেয়ের বিয়ে বলে কথা! এক্সাপশনাল ভাবে আয়োজন না করলে হবে নাকি? তবে মোস্তফা সাহেব আরেকটি বিষয় ভাবছেন। ওই বিষয়ে পার্সোনালি কথা বলতে হবে ছেলের সঙ্গে।
তন্ময় উঠে এলো দোতলায়। অরুর রুমের দরজা খোলা। যাবার সময় না চেয়েও তাকিয়ে বসল। অরু দাঁড়িয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে। ব্যস্ত হাতে অর্নামেন্টস খুলছে। তন্ময় ঠাঁই দাঁড়িয়ে কিছু মুহূর্ত দেখল। অরু একপর্যায়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। আশ্চর্য অরু শুধাল,
‘কী হয়েছে?’
তন্ময় শব্দ করে গলা পরিষ্কার করার ছুঁতোয়; নিজ রুমের দিক যেতে নিয়ে বলল, ‘একমগ কফি দিয়ে যা।’
ওয়েদার ডিপার্টমেন্টের লোকজন কী নিজেদের কাজকর্ম ঠিকঠাক করে না, নাকি? ছাতারমাথা গবেষণা করে! ইয়ার্কির একটা লিমটেশন থাকা প্রয়োজন। আধঘণ্টা পূর্বেও ওয়েদার দেখাল আকাশ পরিষ্কার থাকবে। ঝকঝকে চকচকে পরিষ্কার যাকে বলে। অথচ এই অসময়ে একঝাঁক অসহ্যরকমের বৃষ্টি উদয় হয়েছে। ঝরঝরে তুখোড় ঝুম বৃষ্টি নেমে একাকার। এইতো দুপুরবেলায় সুমিতা বেগম ছাঁদ থেকে কাপড়চোপড় নামিয়ে আনার দায়িত্বটুকু অরুকে গছিয়ে দিয়েছিলেন। অরুও বড়ো ধুরন্ধর চালাকচতুর মেয়েমানুষ। সে ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল ভঙ্গিতে ওয়েদারের মতিগতি দেখে নিয়েছে। ফুরফুরে মেজাজে সে আর কাপড়চোপড় নিয়ে মাথা ঘামাবার ফুরসত পায়নি। ঘুরতে বেরিয়েছে তন্ময়ের সাথে। ফিরেও কোনো হাবভাব ছিলো না কাপড়চোপড় নামিয়ে আনার।
তন্ময় বাইরের বৃষ্টি দেখেই তড়িৎ ল্যাপটপ সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘর ছেড়ে বেরুতেই অরুকে দেখল। ও উত্তেজিত, ছন্নছাড়া ভঙ্গিমায় দৌড়ে সিঁড়ি ধরেছে ছাঁদের। চাপাস্বরে আর্তনাদ করতে করতে ছুটছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে – সাহায্যের হাত বাড়াতে তন্ময়ও দ্রুত পায়ে পিছু নিলো। তড়িৎতার কাজকর্মে এই মেয়ে সাধারণের চেয়েও খুব স্লো হয়ে যায়। দেখা যাবে নিজেও ভিজছে আর কাপড়চোপড়ও। কাজের কাজ কিছুই করতে পারবে না। মনে-মনে আওড়ানো দৃশ্যটুকুই তন্ময় ছাঁদে উঠে দেখল। অরু ভিজে-ভিজে তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে কাপড়চোপড় অন্ধের মতন টানছে তো টানছেই। ইতোমধ্যে ও জবজবে ভিজে। ছাঁদের সাদা বাল্বের অস্পষ্ট আলোতে দৃশ্যমান হচ্ছে, ওর চুল বেয়ে পড়া একেকটি বৃষ্টির ফোঁটা। তন্ময় দ্রুতপায়ে এগুলো। পেশিবহুল হাত দুটো অবলীলায় কাপড়চোপড় ছুটিয়ে নিচ্ছে। ইতোমধ্যে সেও পরিপূর্ণ রূপে কাকভেজা। কিছুক্ষণ পূর্বে পরিবর্তন করা টিশার্ট তার পেটানো শরীরে লেপ্টে রয়েছে। অরু আড়চোখে সেই দৃশ্য দেখল। পিটপিট নয়নে দেখেই গেল। তন্ময় ওর অসভ্য দৃষ্টি খেয়াল করল না। সে কষিয়ে উচ্চকণ্ঠে ধমকাল,
‘এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কাপড়চোপড় নিয়ে ছাঁদ থেকে নাম।’
অরুর যেন চেতনা ফিরল। এলোমেলো দৃষ্টি দুলিয়ে কাপড়চোপড় বুকে নিয়ে ছুটে নামল। দোতালার সিঁড়িপথে সুমিতা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। তার দু’হাত কোমরে, তীক্ষ্ণ রাগান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন অপলক। যেন এখনই চিবিয়ে চিবিয়ে অরুকে খাবে। মায়ের গরম পানির মতন ফুটন্ত হাবভাব দেখেই সে ঢোক গিলল। তন্ময়ও সেমুহূর্তে নেমে এসেছে। ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়াতে-নাড়াতে বলল,
‘কিছু বলো না, চাচি। আমার সাথে বেরিয়েছিল দেখে হয়তো মনে ছিলো না।’
সুমিতা বেগম পূর্বের তুলনায় নমনীয় হয়ে এসেছেন তন্ময়ের প্রতি। তন্ময়ের কথামতন আর বকাঝকা করলেন না। তবে চাপাস্বরে দুটো ধমক ঠিকই দিলেন। একপ্রকার কেঁড়ে নিলেন আধভেজানো কাপড়চোপড় গুলো। অস্পষ্ট স্বরে বকতে-বকতে নিচতলায় নামছেন। সুমিতা বেগমকে নিজ চোখে যেতে দেখে তারপরই নিজের রুমে ঢুকল তন্ময়। ভেজা কাপড়চোপড় বদলে বেরোল। অরুর রুমের দরজা আধভেজানো। এক-কাপ কফি সে চেয়েছিল
এক জনম হয়ে এসেছে। তা আর নসিবে মিললে তো। অগ্যত সে নিজেই নামল নিচে কফি বানানোর উদ্দেশ্যে। মোস্তফা সাহেব লিভিংরুমে বসে। তার হাতে সংবাদপত্র। ভদ্রলোক বারংবার দেয়াল ঘড়িতে নজর বোলাচ্ছেন। ঠিক কী কারণে ঘড়িতে দৃষ্টি পায়চারি করছেন তা তন্ময় বুঝল না। অবুঝের মতো কফির জন্য রান্নাঘরে পানি বসাল। রান্নাঘরে কেউই নেই। জবেদা বেগম পাশের বাড়ি গিয়েছেন মুফতি বেগমকে নিয়ে। চুলোয় বসাতেই তন্ময়ের টনক নড়ল। সন্ধ্যায় অয়ন এসে শাবিহাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিল। বিষয়টা ভুলেই বসেছিল সে। ঘড়িতে নজর বুলিয়ে দেখল–এখন নটা ত্রিশ। রাত হয়েছে ভালোই। পকেট থেকে মোবাইলফোন বের করে তন্ময় অয়নকে কল করল। তিনবার রিং হতেই রিসিভ হলো। স্থির গলায় তন্ময় শুধাল,
‘কখন ফিরবে?’
ওপাশ হতে অয়ন আর একটি ঘন্টা চেয়ে নিলো। তন্ময় সম্মতি জানিয়ে কল কাটল। পানি ফুটে এসেছে। দুটো মগ নামিয়ে নিলো ওপরের কাবার্ড থেকে। একটি মগে দুধ-চিনি-কফি মিলিয়ে বানাল। একচামচ মুখে তুলে টেস্ট করে নাক কুঁচকাল। তার নাক কুঁচকে এসেছে মানে পার্ফেক্ট। ওটা পাশে রেখে নিজের জন্য তেঁতো কফিটা করে; দুটো কফির মগ দু’হাতে তুলে রান্নাঘর ছাড়ল। মোস্তফা ছেলে দেখেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘শাবিহা কতদূর?’
তন্ময় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই জানাল,
‘আর একঘণ্টার মধ্যেই চলে আসবে। চিন্তা করো না।’
মোস্তফা সাহেবের মুখাবয়ব অসন্তুষ্ট তবে কণ্ঠে আকাশসমান আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন,
‘আমার জন্য করলে না যে! জিজ্ঞেসও তো করলে না, আমি খাব কী-না!’
তন্ময়ের হেলদোল হলো না। বরঞ্চ সে ঠাট্টার সুরে বিচিত্র গলায় জবাবে বলল,
‘তোমার স্ত্রীকে বলো চা করে দিতে। কফি ইজ’ন্ট ফর ইউ।’
কফি-টা অত্যন্ত অপছন্দ করেন মোস্তফা সাহেব। ওপরদিক চা-য়ের প্রতি তন্ময়ের এক আসমান সমান অনিহা। বাবা-ছেলের মধ্যে এই কফি-চা-য়ের বিদ্রোহ যেন শেষ হওয়ার নয়। মোস্তফা সাহেব চোখমুখ কালো করে সংবাদপত্রে দৃষ্টি ফেললেন। তন্ময় দোতলায় উঠে এসেই স্তব্দ হলো। অরু তার দিকে পিঠ করে তারই রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এই দৃশ্য নতুন নয়। পুরনো বড়ো। ও সবসময় এমন কাজকর্ম করে থাকে। তবুও প্রত্যেকবার এহেন দৃশ্য স্বচক্ষে দেখে তার গম্ভীরমুখ জুড়ে হাসির বিচরণ খেলে। ওর দু’পা তুলে মাথা বাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দেয়ার দৃশ্যটি তাকে না হাসিয়ে ছাড়ল না এবারও। নিঃশব্দে সে চোখ বুজে হাসল কিছুক্ষণ। প্রাণখোলা হাসি শেষ করে গলা পরিষ্কার করল শব্দ তুলে। অরু চমকাল, ভড়কাল– তৎপর লাফাল। তড়িৎ পেছনে ফিরে তন্ময়কে দেখে বোকার মতন হাসল। দু’তিন দফায় হাসার প্রচেষ্টায় সাফাই গাওয়ার সুরে আগ বাড়িয়ে জানাল,
‘কফির জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাচ্ছিলাম।’
তন্ময় জবাব দিলো না। তবে এগিয়ে এসে চিনি-দুধের সংমিশ্রিত কফিটা অরুর হাতে ধরিয়ে দিলো। নিজের কফির মগ নিয়ে নিজ রুমে চলে এলো। অগোচরে নিপুণ দৃষ্টিতে একটিবার খেয়াল করে নিলো অরু আসছে কী-না! তার বিশ্বাস ও পিছু-পিছু তড়তড়িয়ে আসবে। হলোও তাই। অরু দ্রুত পায়ে তন্ময়ের রুমে চলে এলো। বিছানায় পা দুলিয়ে বসল। দু’পা নাড়াতে নাড়াতে দু’হাতে কফির মগ ধরে চুমুক বসাল। এক চুমুক খেয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে শুধাল,
‘এতো মজার কফি কী আপনি বানিয়েছেন, তন্ময় ভাই?’
তন্ময় পাশ ফিরে চায় তবে জবাব দেয় না। মুখে কুলূপ এঁটে চেয়ারে এসে বসে। সে কী আর বলতে পারবে,
‘যেটা আমি খেয়ে বিরক্ত হই সেটিই তোর মুখে মধু-তে রূপান্তরিত হয়। তাই তোর পছন্দের কিছু বানানো কঠিন কিছু নয়।’
অরু কফিতে চুমুক দিতে দিতে ওয়েদার ডিপার্টমেন্ট নিয়ে গবেষণা শুরু করল,
‘দেখলেন দেশের আবহাওয়া গবেষণার কী বিশ্রী পরিস্থিতি? সকাল থেকে এই পর্যন্ত দেখাল পরিষ্কার আকাশ থাকবে। কোনোরকমের বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। তাহলে এখন আকাশ থেকে কী নামছে? মধু? আর এদের ওপর ভরসা করা যাবে না। আমার মতন সাধারণ জনগণের কত ভোগান্তি!’
তন্ময় ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখে সাবলীল গলায় বলল,
‘ভোগান্তি হতো না যদি সময় মতন কাপড়চোপড় নামিয়ে আনতি।’
অরু সচরাচর দমে যাবার পাত্রী নয়। তবে এযাত্রায় খানিক দমল। তবুও নিভুনিভু চোখে চেয়ে বিড়বিড় করে ওঠে,
‘আমায় ভুল ইনিফরমেশন দিলে দোষ কী আমার? দোষ ওদের।’
বারান্দার দরজা খোলা। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে বৃষ্টির সুভাস, সুর। মোহিনীয় কণ্ঠে সুর তুলে যেন বৃষ্টি গান গাইছে। অরু বিছানা ছেড়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। জানালাটা খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে হাওয়ার সাথে বৃষ্টি মিশে তাকে ছুঁয়ে যায়। চোখমুখে বৃষ্টির ফোঁটা এসে ভীড় জমায়। আড়চোখে এই দৃশ্য তন্ময় দেখল। খানিক কাঁপল ল্যাপটপের কি-বোর্ডে থাকা তার হাত দুটো। দৃষ্টি নিবিড় হলো। লম্বা, ঘন কালো চুলগুলো এখন আধভেজা অরুর। বৃষ্টির স্পর্শে চোখ বুজে নিচ্ছে। মিষ্টি করে হাসছে আর একটু-একটু করে কফি খাচ্ছে। এই নিদারুণ দৃশ্য যেন একটুকরো সুখ। হৃদয়ে দারুণ প্রশান্তি দিয়ে গেল। আনমনে উঠে দাঁড়াল সেও। ঠিক অরুর পেছনে এসে দাঁড়াল। মনে পড়ল অন্য একদিনের কথা। যখন সে জবেদা বেগমকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে উঠেছিল। সেদিন লোডশেডিং হয়েছিল। বাইরে ছিল তীব্র বৃষ্টি! আর হাতে? হাতে কী যেন ছিলো? কফি না চা? তন্ময়ের ঠিক মনে নেই। তবে একই ঘটনা ঘটেছিল সেদিন প্রায়। এখন শুধু লোডশেডিং হওয়া বাকি? মৃদু হাসতেই আশ্চর্যজনক ভাবে লোডশেডিং হলো তীব্র ধ্বনি তুলে। কোথাও যেন বজ্রপাত ঘটেছে। এহেন কাণ্ডতে অরু একটুও ঘাবড়াল না। না সে নড়ল। কেমন দাঁড়িয়েই রইল ঠাঁই। দৃষ্টি তখনো ওর জানালার বাইরে। তন্ময় হাসল। সেবার সে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘ভয় করছে না?’
অরু কতটা অবলীলায় সরল গলায় বলে ফেলেছিল,
‘আপনি আছেন না!’
এবারো যদি সে একই প্রশ্ন করে অরুর জবাব কী হবে? ভিন্ন কিছু? নাকি আগেরটাই? তন্ময় উৎসুক হয়ে পড়ু। তবে নিজের উৎসুক হাবভাব স্বযত্নে আড়াল করতে সক্ষম হলো। কণ্ঠ সাধারণ করে প্রশ্ন করল,
‘ভয় করছে না?’
প্রশ্নটি করে সে আঁধারে মৃদু হাসল। অপেক্ষায় রইল চিরচেনা সেই জবাবটির। তবে মিনিটের মধ্যে এলো না। তন্ময় তবুও হেসে দাঁড়িয়ে থাকল। আরেকটু কাছে এগুল। যখন সে ভাবল মেয়েটা বোধহয় তার প্রশ্ন শোনেনি, তখনই অরু স্তব্দ আঁধারে ধীর বরঞ্চ পরিষ্কার গলায় জবাবে বলল,
‘পেছনেই আমার স্বামী আছে তো।’
এই একটি বাক্যে কী যে ছিল তন্ময়ের জানা নেই! তবে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জুড়ে শিহরণ বয়ে গেল। অপলক হলো দৃষ্টি। স্তব্দ হলো শরীর, হৃদয় সব। ঝিম মারা পো’জোড়া শক্ত হলো জমিনে। অন্ধকার বিচ্ছিন্ন করে অরুকে দেখতে চাচ্ছে তার ব্যাকুল দৃষ্টি। তবে পারছে কই? বাধ্য হয়েই দ্রুত গতিতে দু’পা এগিয়ে পরিপূর্ণ অরুকেই জাপ্টে ধরল পেছন থেকে। অরু কেঁপে উঠল দৃশ্যমান রূপে। হাতে থাকা কফির মগটাও নড়বড়ে হলো। তবে কফি পড়ল না। নিস্তব্ধ এই আঁধারে কক্ষজুড়ে শুধু বৃষ্টি আর নিশ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তন্ময়ের টেনে নেয়া ফেলা একেকটি গরম শ্বাসপ্রশ্বাস–অরুর গলার কাছটায় পড়া একেকটি অসহ্যকর সুখময় যন্ত্রণা যেন! তবে আজ আর এই অনুভূতি থেকে পালানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই তার। চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়েই রইল।
ওয়েদার ডিপার্টমেন্টের লোকজন কী নিজেদের কাজকর্ম ঠিকঠাক করে না, নাকি? ছাতারমাথা গবেষণা করে! ইয়ার্কির একটা লিমটেশন থাকা প্রয়োজন। আধঘণ্টা পূর্বেও ওয়েদার দেখাল আকাশ পরিষ্কার থাকবে। ঝকঝকে চকচকে পরিষ্কার যাকে বলে। অথচ এই অসময়ে একঝাঁক অসহ্যরকমের বৃষ্টি উদয় হয়েছে। ঝরঝরে তুখোড় ঝুম বৃষ্টি নেমে একাকার। এইতো দুপুরবেলায় সুমিতা বেগম ছাঁদ থেকে কাপড়চোপড় নামিয়ে আনার দায়িত্বটুকু অরুকে গছিয়ে দিয়েছিলেন। অরুও বড়ো ধুরন্ধর চালাকচতুর মেয়েমানুষ। সে ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল ভঙ্গিতে ওয়েদারের মতিগতি দেখে নিয়েছে। ফুরফুরে মেজাজে সে আর কাপড়চোপড় নিয়ে মাথা ঘামাবার ফুরসত পায়নি।
ঘুরতে বেরিয়েছে তন্ময়ের সাথে। ফিরেও কোনো হাবভাব ছিলো না কাপড়চোপড় নামিয়ে আনার। তন্ময় বাইরের বৃষ্টি দেখেই তড়িৎ ল্যাপটপ সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘর ছেড়ে বেরুতেই অরুকে দেখল। ও উত্তেজিত, ছন্নছাড়া ভঙ্গিমায় দৌড়ে সিঁড়ি ধরেছে ছাঁদের। চাপাস্বরে আর্তনাদ করতে করতে ছুটছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে – সাহায্যের হাত বাড়াতে তন্ময়ও দ্রুত পায়ে পিছু নিলো। তড়িৎতার কাজকর্মে এই মেয়ে সাধারণের চেয়েও খুব স্লো হয়ে যায়। দেখা যাবে নিজেও ভিজছে আর কাপড়চোপড়ও।
কাজের কাজ কিছুই করতে পারবে না। মনে-মনে আওড়ানো দৃশ্যটুকুই তন্ময় ছাঁদে উঠে দেখল। অরু ভিজে-ভিজে তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে কাপড়চোপড় অন্ধের মতন টানছে তো টানছেই। ইতোমধ্যে ও জবজবে ভিজে। ছাঁদের সাদা বাল্বের অস্পষ্ট আলোতে দৃশ্যমান হচ্ছে, ওর চুল বেয়ে পড়া একেকটি বৃষ্টির ফোঁটা। তন্ময় দ্রুতপায়ে এগুলো। পেশিবহুল হাত দুটো অবলীলায় কাপড়চোপড় ছুটিয়ে নিচ্ছে। ইতোমধ্যে সেও পরিপূর্ণ রূপে কাকভেজা। কিছুক্ষণ পূর্বে পরিবর্তন করা টিশার্ট তার পেটানো শরীরে লেপ্টে রয়েছে। অরু আড়চোখে সেই দৃশ্য দেখল। পিটপিট নয়নে দেখেই গেল। তন্ময় ওর অসভ্য দৃষ্টি খেয়াল করল না। সে কষিয়ে উচ্চকণ্ঠে ধমকাল,
‘এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কাপড়চোপড় নিয়ে ছাঁদ থেকে নাম।’
অরুর যেন চেতনা ফিরল। এলোমেলো দৃষ্টি দুলিয়ে কাপড়চোপড় বুকে নিয়ে ছুটে নামল। দোতালার সিঁড়িপথে সুমিতা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। তার দু’হাত কোমরে, তীক্ষ্ণ রাগান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন অপলক। যেন এখনই চিবিয়ে চিবিয়ে অরুকে খাবে। মায়ের গরম পানির মতন ফুটন্ত হাবভাব দেখেই সে ঢোক গিলল। তন্ময়ও সেমুহূর্তে নেমে এসেছে। ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়াতে-নাড়াতে বলল,
‘কিছু বলো না, চাচি। আমার সাথে বেরিয়েছিল দেখে হয়তো মনে ছিলো না।’
সুমিতা বেগম পূর্বের তুলনায় নমনীয় হয়ে এসেছেন তন্ময়ের প্রতি। তন্ময়ের কথামতন আর বকাঝকা করলেন না। তবে চাপাস্বরে দুটো ধমক ঠিকই দিলেন। একপ্রকার কেঁড়ে নিলেন আধভেজানো কাপড়চোপড় গুলো। অস্পষ্ট স্বরে বকতে-বকতে নিচতলায় নামছেন। সুমিতা বেগমকে নিজ চোখে যেতে দেখে তারপরই নিজের রুমে ঢুকল তন্ময়। ভেজা কাপড়চোপড় বদলে বেরোল। অরুর রুমের দরজা আধভেজানো। এক-কাপ কফি সে চেয়েছিল
এক জনম হয়ে এসেছে।
তা আর নসিবে মিললে তো। অগ্যত সে নিজেই নামল নিচে কফি বানানোর উদ্দেশ্যে। মোস্তফা সাহেব লিভিংরুমে বসে। তার হাতে সংবাদপত্র। ভদ্রলোক বারংবার দেয়াল ঘড়িতে নজর বোলাচ্ছেন। ঠিক কী কারণে ঘড়িতে দৃষ্টি পায়চারি করছেন তা তন্ময় বুঝল না। অবুঝের মতো কফির জন্য রান্নাঘরে পানি বসাল। রান্নাঘরে কেউই নেই। জবেদা বেগম পাশের বাড়ি গিয়েছেন মুফতি বেগমকে নিয়ে। চুলোয় বসাতেই তন্ময়ের টনক নড়ল। সন্ধ্যায় অয়ন এসে শাবিহাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিল। বিষয়টা ভুলেই বসেছিল সে। ঘড়িতে নজর বুলিয়ে দেখল–এখন নটা ত্রিশ। রাত হয়েছে ভালোই। পকেট থেকে মোবাইলফোন বের করে তন্ময় অয়নকে কল করল। তিনবার রিং হতেই রিসিভ হলো। স্থির গলায় তন্ময় শুধাল,
‘কখন ফিরবে?’
ওপাশ হতে অয়ন আর একটি ঘন্টা চেয়ে নিলো। তন্ময় সম্মতি জানিয়ে কল কাটল। পানি ফুটে এসেছে। দুটো মগ নামিয়ে নিলো ওপরের কাবার্ড থেকে। একটি মগে দুধ-চিনি-কফি মিলিয়ে বানাল। একচামচ মুখে তুলে টেস্ট করে নাক কুঁচকাল। তার নাক কুঁচকে এসেছে মানে পার্ফেক্ট। ওটা পাশে রেখে নিজের জন্য তেঁতো কফিটা করে; দুটো কফির মগ দু’হাতে তুলে রান্নাঘর ছাড়ল। মোস্তফা ছেলে দেখেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘শাবিহা কতদূর?’
তন্ময় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই জানাল,
‘আর একঘণ্টার মধ্যেই চলে আসবে। চিন্তা করো না।’
মোস্তফা সাহেবের মুখাবয়ব অসন্তুষ্ট তবে কণ্ঠে আকাশসমান আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন,
‘আমার জন্য করলে না যে! জিজ্ঞেসও তো করলে না, আমি খাব কী-না!’
তন্ময়ের হেলদোল হলো না। বরঞ্চ সে ঠাট্টার সুরে বিচিত্র গলায় জবাবে বলল,
‘তোমার স্ত্রীকে বলো চা করে দিতে। কফি ইজ’ন্ট ফর ইউ।’
কফি-টা অত্যন্ত অপছন্দ করেন মোস্তফা সাহেব। ওপরদিক চা-য়ের প্রতি তন্ময়ের এক আসমান সমান অনিহা। বাবা-ছেলের মধ্যে এই কফি-চা-য়ের বিদ্রোহ যেন শেষ হওয়ার নয়। মোস্তফা সাহেব চোখমুখ কালো করে সংবাদপত্রে দৃষ্টি ফেললেন। তন্ময় দোতলায় উঠে এসেই স্তব্দ হলো। অরু তার দিকে পিঠ করে তারই রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এই দৃশ্য নতুন নয়। পুরনো বড়ো। ও সবসময় এমন কাজকর্ম করে থাকে। তবুও প্রত্যেকবার এহেন দৃশ্য স্বচক্ষে দেখে তার গম্ভীরমুখ জুড়ে হাসির বিচরণ খেলে। ওর দু’পা তুলে মাথা বাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দেয়ার দৃশ্যটি তাকে না হাসিয়ে ছাড়ল না এবারও। নিঃশব্দে সে চোখ বুজে হাসল কিছুক্ষণ। প্রাণখোলা হাসি শেষ করে গলা পরিষ্কার করল শব্দ তুলে। অরু চমকাল, ভড়কাল– তৎপর লাফাল। তড়িৎ পেছনে ফিরে তন্ময়কে দেখে বোকার মতন হাসল। দু’তিন দফায় হাসার প্রচেষ্টায় সাফাই গাওয়ার সুরে আগ বাড়িয়ে জানাল,
‘কফির জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাচ্ছিলাম।’
তন্ময় জবাব দিলো না। তবে এগিয়ে এসে চিনি-দুধের সংমিশ্রিত কফিটা অরুর হাতে ধরিয়ে দিলো। নিজের কফির মগ নিয়ে নিজ রুমে চলে এলো। অগোচরে নিপুণ দৃষ্টিতে একটিবার খেয়াল করে নিলো অরু আসছে কী-না! তার বিশ্বাস ও পিছু-পিছু তড়তড়িয়ে আসবে। হলোও তাই। অরু দ্রুত পায়ে তন্ময়ের রুমে চলে এলো। বিছানায় পা দুলিয়ে বসল। দু’পা নাড়াতে নাড়াতে দু’হাতে কফির মগ ধরে চুমুক বসাল। এক চুমুক খেয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে শুধাল,
‘এতো মজার কফি কী আপনি বানিয়েছেন, তন্ময় ভাই?’
তন্ময় পাশ ফিরে চায় তবে জবাব দেয় না। মুখে কুলূপ এঁটে চেয়ারে এসে বসে। সে কী আর বলতে পারবে,
‘যেটা আমি খেয়ে বিরক্ত হই সেটিই তোর মুখে মধু-তে রূপান্তরিত হয়। তাই তোর পছন্দের কিছু বানানো কঠিন কিছু নয়।’
অরু কফিতে চুমুক দিতে দিতে ওয়েদার ডিপার্টমেন্ট নিয়ে গবেষণা শুরু করল,
‘দেখলেন দেশের আবহাওয়া গবেষণার কী বিশ্রী পরিস্থিতি? সকাল থেকে এই পর্যন্ত দেখাল পরিষ্কার আকাশ থাকবে। কোনোরকমের বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। তাহলে এখন আকাশ থেকে কী নামছে? মধু? আর এদের ওপর ভরসা করা যাবে না। আমার মতন সাধারণ জনগণের কত ভোগান্তি!’
তন্ময় ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখে সাবলীল গলায় বলল,
‘ভোগান্তি হতো না যদি সময় মতন কাপড়চোপড় নামিয়ে আনতি।’
অরু সচরাচর দমে যাবার পাত্রী নয়। তবে এযাত্রায় খানিক দমল। তবুও নিভুনিভু চোখে চেয়ে বিড়বিড় করে ওঠে,
‘আমায় ভুল ইনিফরমেশন দিলে দোষ কী আমার? দোষ ওদের।’
বারান্দার দরজা খোলা। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে বৃষ্টির সুভাস, সুর। মোহিনীয় কণ্ঠে সুর তুলে যেন বৃষ্টি গান গাইছে। অরু বিছানা ছেড়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। জানালাটা খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে হাওয়ার সাথে বৃষ্টি মিশে তাকে ছুঁয়ে যায়। চোখমুখে বৃষ্টির ফোঁটা এসে ভীড় জমায়। আড়চোখে এই দৃশ্য তন্ময় দেখল। খানিক কাঁপল ল্যাপটপের কি-বোর্ডে থাকা তার হাত দুটো। দৃষ্টি নিবিড় হলো। লম্বা, ঘন কালো চুলগুলো এখন আধভেজা অরুর। বৃষ্টির স্পর্শে চোখ বুজে নিচ্ছে। মিষ্টি করে হাসছে আর একটু-একটু করে কফি খাচ্ছে। এই নিদারুণ দৃশ্য যেন একটুকরো সুখ। হৃদয়ে দারুণ প্রশান্তি দিয়ে গেল।
আনমনে উঠে দাঁড়াল সেও। ঠিক অরুর পেছনে এসে দাঁড়াল। মনে পড়ল অন্য একদিনের কথা। যখন সে জবেদা বেগমকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে উঠেছিল। সেদিন লোডশেডিং হয়েছিল। বাইরে ছিল তীব্র বৃষ্টি! আর হাতে? হাতে কী যেন ছিলো? কফি না চা? তন্ময়ের ঠিক মনে নেই। তবে একই ঘটনা ঘটেছিল সেদিন প্রায়। এখন শুধু লোডশেডিং হওয়া বাকি? মৃদু হাসতেই আশ্চর্যজনক ভাবে লোডশেডিং হলো তীব্র ধ্বনি তুলে। কোথাও যেন বজ্রপাত ঘটেছে। এহেন কাণ্ডতে অরু একটুও ঘাবড়াল না। না সে নড়ল। কেমন দাঁড়িয়েই রইল ঠাঁই। দৃষ্টি তখনো ওর জানালার বাইরে। তন্ময় হাসল। সেবার সে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘ভয় করছে না?’
অরু কতটা অবলীলায় সরল গলায় বলে ফেলেছিল,
‘আপনি আছেন না!’
এবারো যদি সে একই প্রশ্ন করে অরুর জবাব কী হবে? ভিন্ন কিছু? নাকি আগেরটাই? তন্ময় উৎসুক হয়ে পড়ু। তবে নিজের উৎসুক হাবভাব স্বযত্নে আড়াল করতে সক্ষম হলো। কণ্ঠ সাধারণ করে প্রশ্ন করল,
‘ভয় করছে না?’
প্রশ্নটি করে সে আঁধারে মৃদু হাসল। অপেক্ষায় রইল চিরচেনা সেই জবাবটির। তবে মিনিটের মধ্যে এলো না। তন্ময় তবুও হেসে দাঁড়িয়ে থাকল। আরেকটু কাছে এগুল। যখন সে ভাবল মেয়েটা বোধহয় তার প্রশ্ন শোনেনি, তখনই অরু স্তব্দ আঁধারে ধীর বরঞ্চ পরিষ্কার গলায় জবাবে বলল,
শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৪৫+৪৬
‘পেছনেই আমার স্বামী আছে তো।’
এই একটি বাক্যে কী যে ছিল তন্ময়ের জানা নেই! তবে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জুড়ে শিহরণ বয়ে গেল। অপলক হলো দৃষ্টি। স্তব্দ হলো শরীর, হৃদয় সব। ঝিম মারা পো’জোড়া শক্ত হলো জমিনে। অন্ধকার বিচ্ছিন্ন করে অরুকে দেখতে চাচ্ছে তার ব্যাকুল দৃষ্টি। তবে পারছে কই? বাধ্য হয়েই দ্রুত গতিতে দু’পা এগিয়ে পরিপূর্ণ অরুকেই জাপ্টে ধরল পেছন থেকে। অরু কেঁপে উঠল দৃশ্যমান রূপে। হাতে থাকা কফির মগটাও নড়বড়ে হলো। তবে কফি পড়ল না। নিস্তব্ধ এই আঁধারে কক্ষজুড়ে শুধু বৃষ্টি আর নিশ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তন্ময়ের টেনে নেয়া ফেলা একেকটি গরম শ্বাসপ্রশ্বাস–অরুর গলার কাছটায় পড়া একেকটি অসহ্যকর সুখময় যন্ত্রণা যেন! তবে আজ আর এই অনুভূতি থেকে পালানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই তার। চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়েই রইল।
