শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৭৯+৮০

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৭৯+৮০
Nabila Ishq

বৃষ্টি বাইরে তখনো ঝিরিঝিরি বয়ে চলেছে। মাঝেমধ্যে শব্দ করে পড়ছে বজ্রপাত।
আশরাফুল সাহেব খানিকটা ভিজেছিলেন। ভেজা তিনি এবেলায় থতমত খেয়েছেন। ভ্রু’দ্বয়ের মধ্যিখানে ভাঁজ পড়েছে গুটিকয়েক। ড্যাবড্যাব চোখে দেখেন শাহজাহান বাড়ির প্রত্যেকের আচার-আচরণ, মুখের হাবভাব। তন্ময়ের এই বিহ্বলিত অবস্থা তার কাছে বড়ো সন্দেহজনক লাগছে। ওমন ফ্যাকাসে মুখে চেয়ে ভদ্রলোক সন্দিহান গলায় বলেই বসেন,

‘রাজপুত্র আমার, তোমার মুখের অবস্থা তো ভয়ানক। এমন আশ্চর্য এক্সপ্রেসনস অন্য মিনিং মনে আনাচ্ছে আমার। বলব? বলিইইই…মনে হচ্ছে যেন, অনাগত বাচ্চার সুহৃদবান, সুদর্শন পিতা তুমি নও…খুবই সন্দেহজন…’
তন্ময়ের তাজ্জব বনে যাওয়া ছুটে যায়— এই ভদ্রলোকের এহেন অভদ্র জনিত কথাবার্তায়। সে বিদ্যুৎ গতিতে ভদ্রলোকের বাক্যের মাঝেই ফোড়ন কাটে অত্যন্ত বিরক্ত তবে বেশ রাগিত গলাতেই,
‘অবশ্যই আমার বাচ্চা। আমার বাচ্চা, আমার বউ। সবই আমার। শাহজাহান তন্ময়ের। আংকেল আপনি প্লিজ নিজের মুখের ওপর দয়া করে একটু লাগাম টানুন।’
আশরাফুল সাহেব মুহূর্তেই বুকে কম্পন তুলে শব্দ করে হেসে ওঠেন। হাসির শব্দে কেঁপে ওঠে শাহজাহান বাড়ির লিভিংরুম। হেসে হেসে তিনি তন্ময়ের দিকে আমোদে এগুচ্ছেন। কাছাকাছি এসেই তন্ময়ের চওড়া কাঁধ থাপড়ে উৎসাহিত গলায় বলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘এইতো..এই হচ্ছে তেজ! ওমন এক্সপ্রেশনস করে কী বোঝাতে চাচ্ছিলে? বোকা ছেলে। তুমি বাবা হতে যাচ্ছো ইয়ংম্যান। বাবা! বছর খানেকের মাথাতেই কোলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে হবে। দিনরাত শুনতে হবে কান্নাকাটি। আর তিন বছরের মাথাতেই শুনবে, পাপা ডাক। এই পৃথিবীর অন্যতম ভালোবাসার ডাক। আদরের ডাক। তোমার বাবা তো এখনো কাঁদেন তুমি নরম স্বরে বাবা ডাকলেই।’
মোস্তফা সাহেব আড়চোখে বন্ধুর দিকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তা দেখার সময় কই আশরাফুল সাহেবের? তিনি আরও বলতে থাকেন,

‘বাড়ি থেকে যখন কাজের জন্য বেরোও কাঁদে কে? বউ তো? তখন বউ-বাচ্চা দু’জনই কাঁদবে। হা হা হা…’
তন্ময় নির্বিকার চোখে আশরাফুল সাহেবের প্রাণোচ্ছল হাসিটুকু দেখে কিছুক্ষণ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ায় মোস্তফা সাহেবের দিকে। মোস্তফা সাহেব তখন কান খাঁড়া করে শুনছিলেন তবে অন্যদিকে ফিরে থেকে। এযাত্রায় আড়চোখে চাইতেই ছেলের চোখে চোখ পড়ে যায়। অপ্রস্তুত মোস্তফা সাহেব লক্ষ্য করেন ছেলেটা তার আর নির্বিকার নেই। ওর চোখমুখ গম্ভীর তবে চোখের ভাষা ভিন্ন কিছু বলছে। মোস্তফা সাহেব বোঝেন, দাঁড়িয়ে পড়েন। ছেলের সামনাসামনি হোন। ছেলেটার শারিরীক দুর্বলতা তখনো শোচনীয়। ভদ্রলোক একমাত্র ছেলের জন্য চিন্তিত। ছেলের গম্ভীর মুখের গভীর চোখজোড়া রক্তিম হয়ে উঠছে। লাল শিরা ভেসে উঠছে কালো মণির চারপাশে। মোস্তফা সাহেব মুহূর্তেই উতলা হোন,

’কী হলো?’
তন্ময় প্রত্যুত্তর করে না। শুধুই চেয়েই রয়। তার চোখের কোণ দৃশ্যমান রূপে ভিজে উঠছে। লম্বা নাকের পাটা দুটো কাঁপছে। মোস্তফা সাহেব ছেলের অন্যরকম এমন পরিবর্তনে আশ্চর্য হোন, ব্যথিত হোন, ব্যাকুল হোন। কাঁধে হাত রাখেন খুব সংকোচে। ডাকেন,
‘অ্যাই, তন্ময়।’
তন্ময় আচমকাই জড়িয়ে ধরে মোস্তফা সাহেবের বাহু। মোস্তফা সাহেব একমুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হলেও পরমুহূর্তেই আবেগে আপ্লূত হোন। কিছুটা অপ্রস্তুত তিনি ভালোলাগার জোয়ারে ভেসে যান। নিজেও দু’হাত রাখেন ছেলের পিঠে। তন্ময়ের বন্ধ ডান চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে যায় একফোঁটা অশ্রুজল। সে বিড়বিড় করে,
‘আমি খুব খুশি বাবা। ভীষণ খুশি! আমার বাচ্চা আসছে, আমি বাবা হবো…এই বাবা হবার আনন্দটুকু অনুভব করা আমার জন্য কী অন্যায়? আ-আমার অ– অরু নিজেই তো বাচ্চা!’

মোস্তফা সাহেব দেখেন বাড়ির সবাই কাঁদছে। আনোয়ার সাহেবের চোখ দুটো রক্তিম। আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছেন জবেদা বেগম। কেনো কাঁদছে সব গুলো? আশ্চর্য! অথচ পরপর খেয়াল করলেন তার গালে উষ্ণ অনুভূতি। তিনিও কাঁদছেন! এই ছেলের ওপর তার রাগারাগি করার কথা, অভিমান করার কথা… অথচ তিনি কাঁদছেন! মোস্তফা সাহেব এইমুহূর্তে শুধুই ছেলের বাবা। নিজ সন্তানের বাবা। ছেলের খুশিই যেন সবকিছু। মিহি স্বরে অবলীলায় বলে বসেন,
‘অন্যায় কেন হবে? আল্লাহ চেয়েছেন, তিনিই দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ্। আলহামদুলিল্লাহ্।’
তন্ময়ও ভাঙা কণ্ঠে প্রত্যুত্তরে বিড়বিড় করে, ‘আলহামদুলিল্লাহ্।’
মোস্তফা সাহেব মৃদু হেসে ফেলেন চোখে জল নিয়েই। বলেন,
‘কংগ্রাচুলেশনস টু ইউ মাই, সান।’

আনোয়ার সাহেবকে আড়চোখে দেখে তন্ময়কে বাবাকে ছেড়ে চাচার দিক এগুতে চায়। পূর্বেই আনোয়ার সাহেব কাছে এসে জড়িয়ে ধরে সতর্ক করেন,
‘কোনোরকমের মাফটাফ শুনতে চাই না। আমার তন্ময়, আমার অরুর জন্য সবসময় ভালো চেয়ে এসেছে। আমি জানি, বিশ্বাস করি। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য। মেয়েটা ছোটো, অনেক যত্নে রাখব আমরা, হুঁ? আর আপসেট হোস না, বাবা।’
তন্ময় শান্ত হয়। বুকের পাহাড় সমান পাথরের ভার উঠে যায়। আনন্দে বড়ো করে শ্বাস টেনে নেয় ভেতরে। বেশা ফ্রি লাগছে তার নিজেকে। বাধভাঙ্গা খুশিতে বুক ব্যথা করছে। অন্যদিকে একে-একে পালাক্রমে সবাই তন্ময়কে জড়িয়ে ধরতে উতলা। আনোয়ার সাহেবের পর ওহী সাহেবও ভাই পুতকে জড়িয়ে ধরেছে। আকাশ এসে জড়িয়ে ধরেই আবেগে ভেসে বলে,

‘থ্যাংকস, আমাকে চাচ্চু বানানোর জন্যে।’
রুবি ভাইয়েত সুরে সুর মেলায়, ‘থ্যাংকস, আমাকে ফুপি বানানোর জন্যে।’
আনোয়ার সাহেব, ওহী সাহেব হেসে ওঠেন। মোস্তফা সাহেবের ঠোঁটেও একটুকরো হাসি। জবেদা বেগম, সুমিতা আড়ে আড়ে দু’জন দু’জনকে দেখে চোখ মোছেন আঁচলে। থমথমে পরিবেশ কেটে গেছে। দীপ্ত নিজেকে ছাড়া পেয়ে যেন আকাশ ছুঁয়ে নিয়েছে। ছুটে এসে ধরে তন্ময়ের পা। চোখমুখ ভেজা। তন্ময়ের গায়ে লেপ্টে গিয়ে আদুরে গলায় বলে,

‘বড়ো ভাইয়া, আমি ভয় পেয়েছি। বুক ধড়ফড় করছে। প্লিজ ভালো হয়ে যাও তাড়াতাড়ি।’
তন্ময় ঝুঁকে বাচ্চা, বাচ্চা মুখটা দু’হাতে মুছিয়ে দেয়। গম্ভীর তবে মিহি স্বরে বলে,
‘আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হয়নি।’
দীপ্ত নাক টেনে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে, ‘অনেক র ক্ত তোমার গায়ে।’
মোস্তফা সাহেব মুহূর্তেই বিচলিত হোন। আপদমস্তক ছেলেকে দেখে ফের পেরেশানিতে পড়েন। সোফায় গিয়ে বসে শাহজাহান বাড়ির ইমোশনাল ম্যালোড্রামা দেখতে থাকা বন্ধুকে ধমকে ওঠে,
‘তোকে ডেকে এনেছি আমার ছেলেকে দেখতে। ওকে একটু দেখ।’
আশরাফুল সাহেব মিইয়ে গিয়ে দ্রুত কাছে ডাকেন তন্ময়কে। তন্ময় পাশে গিয়ে বসে। বাবার দিকে চেয়ে অসহায় গলায় বলে,

‘আমি ঠিক আছি। মাথায় আর হাতে চট পেয়েছি। ব্যান্ডেজ করিয়েছি ঔষধ লাগিয়ে।’
মোস্তফা সাহেবের বাবামন মানে না সে কথা। তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন,
‘তোমার চাচা একটু দেখে দিক। প্রব্লেম তো হচ্ছে।’
তন্ময় অসহায় হয়ে বসে রইল। আশরাফুল সাহেব চেক-আপ করে যাচ্ছেন। তিনি ব্রিফকেস এনেছিলেন সাথে করে। তন্ময় আড়চোখে চাইল ওপরে। খুব করে দেখল ফাঁকা করিডোর। তারপর আশরাফুল সাহেবের মুখে চেয়ে পরিষ্কার তবে আগ্রহী গলায় জানতে চাইল,
‘অরুকে কেমন দেখলেন, চাচা?’
আশরাফুল সাহেব আশ্বস্ত করেন নরম কণ্ঠে,

‘আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো। সম্ভবত দু’মাসের প্রেগন্যান্ট। আগামীকাল হসপিটাল নিয়ে এসো। কিছু চেক-আপ করতে হবে। ওর প্রতি দ্বিগুণ যত্নশীল হতে হবে… এইতো আর আমার বলতে হবে না। তুমি এভাবেই ওকে খুব যত্নে রাখো সাথে বাড়ির বাকিরাও। তাই আর ওসব বলছি না।’
তন্ময় মাথা দোলায়। আরও কিছু প্রশ্ন করতে চায় ওসময় পিনপতন নীরবতা ভেঙে দোতলার দরজা কেউ খোলে। নুপুরের ধ্বনি এসে ছুঁয়ে যায় কানের পাশটা। তন্ময় বিচলিত হয়। তাকায় নিজের দিকে। সে শার্ট খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলবে এতটুকু সময় তাকে দেওয়া হয় না। অরু উচ্ছ্বসিত কদমে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। সাদা কামিজ পরনে। নূপুর ধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। ওকে এভাবে নামতে দেখে সবাই শ্বাস বন্ধ করে চ্যাঁচিয়ে ওঠে,
‘সাবধানে!’

অরু চমকে ওঠে। বেচারির মুখ হঠাৎ এতগুলো চিৎকারে থতমত খেয়ে ওঠে। তন্ময় দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিচলিত অরু এবেলায় দেখে লম্বাটে তন্ময়কে। মাথায় ব্যান্ডেজ। গায়ের শার্টে র ক্ত। প্যান্ট ধুলোবালিতে মেখে আছে। বিধ্বস্ত মুখ। অরুর বিস্ফোরিত চোখের পাতার পলক পড়ে না। অস্পষ্ট স্বরে সে ডাকে,
‘তন্ময় ভাই!
তন্ময় ঘাবড়ে যায় সেই ডাকে। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ ছুটে যায়। ঢোক গিলে সে। অরু মুহূর্তেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। একমুহূর্তেই, চোখের পলকে কাঁদতে কাঁদতে দিশেহারা অবস্থা ওর। দ্রুত কদমে ছুটে আসতে চাইলে তন্ময়ই এগিয়ে যায় তার চেয়েও দ্রুত। অরুর হাত কাঁপছে। কাঁপছে অস্পষ্ট আর্তনাদ করা ঠোঁটজোড়া। তন্ময় এইমুহূর্তে লিভিংরুমে —সবার সামনে না থাকলে, এতক্ষণে কান্নারত এই গোলাপি ঠোঁটজোড়া এক শক্ত চুমুতে বন্ধ করে দিতো। এতক্ষণ ধরে কাঁদতে কখনো পারতো না। অরুর কম্পিত হাত এসে ছুঁয়ে দেয় তন্ময়ের র ক্তা ক্ত শার্ট। তন্ময় নরম তুলতুলে হাতটা ধরে শক্ত করে। অন্য হাতে মুখ ধরে.. নদীর জলের মতো শান্ত, মিহি গলায় বলে,
‘আমি ঠিকাছি। কান্না বন্ধ কর। শ্বাস নিতে পারছিস না।’

অরু কান্নার ধকলে শ্বাস নিতে পারে না ঠিকমতো। হেঁচকি তুলে সে বলে গেল কান্নারত ভেজা গলায়,
‘কী- কীভাবে হলো! আমি যেতে দিতে চাইনি। একদম চাইনি।’
মোস্তফা সাহেব অনুশোচনায় নড়েচড়ে ওঠেন। তিনিই তো পাঠিয়েছিলেন ছেলেকে। না পাঠালে তো আজ আর এমন হতো না। অন্যদিকে তন্ময় অসহায়! সে আগে থেকেই কল্পনা করেছে, মেয়েটা এমন করবে, এভাবেই কাঁদবে— তারপরও সে অসহায়। অসহায় এই অঝোরে কান্নারত মেয়েটার কাছেই। তন্ময় আশপাশ ভুলে আলগোছে জড়িয়ে ধরে অরুকে নিজের পুরুষালি বুকের মধ্যে। মাথা ছুঁয়ে শান্ত করতে চায়,
‘হয়েছে তো, থাম। চুউউপ। শান্ত হো।’

জবেদা বেগম সহ সুমিতা বেগম, মুফতি বেগম রান্নাঘরের দিকে হাঁটা ধরেন আঁচলে মুখ গুঁজে। তারা মিটিমিটি হাসছে। মোস্তফা সাহেব ভাইদের নিয়ে এই রাত-বিরেতে বাগান দেখতে বেরিয়ে গেলেন। সাথে আশরাফুল সাহেবও বাধ্য হলেন যেতে। আকাশ মাথা চুলকাতে চুলকাতে সরে গিয়েছে। আশেপাশে রুবি, দীপ্তও নেই। তন্ময় সকলের এহেন কাণ্ডে হাসে অগোচরে। বুকে থাকা ছোটোখাটো শরীরটা আরও গভীর, দৃঢ়ভাবে জাপ্টে ধরে নিজের মধ্যে। দু’হাতে গুছিয়ে নেয় অগোছালো চুলগুলো। অরুর কান্নার গতি কমে এসেছে। হেঁচকি তুলছে ঘনঘন। চোখমুখ টকটকে লালা। তন্ময় ওই মুখে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছুই জানে না? তন্ময় চাপা গলায় আওড়ায়,
‘পুরো বাড়ি মাথায় তুলে দিয়ে তুই কিছুই জানিস না?’
অরু নাক টেনে ভাঙা কণ্ঠে থেমে থেমে শুধায়,

‘কী? কী জানব?’
বড্ড আদুরে শোনায়। তন্ময় চারিদিকে একটিবার চেয়ে নেয়। সব ফাঁকা। কেউ নেই বলে সে মাথা নুইয়ে ফেলে ততক্ষণে। অরুর চোখে চোখ রাখে, মেলায় দৃষ্টিতে দৃষ্টি। চাপা গলায় বলে,
‘এই যে— তুই আমার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছিস।’
কেঁদেকেটে ফুলে ছোট্ট হয়ে আসা চোখ দুটো দানবের মতো বড়ো করে ফেলে অরু। অবিশ্বাস্য চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয় শুধু। তন্ময় মৃদু শক্ত করে টেনে ধরে অরুর নাজুক গাল। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইলেও সে শেষমেশ পারে না। এমন সময়তে কখনোই পারবে না। অসম্ভব! নরম হয়ে আসে স্বর,
‘ঔষধ গুলো খাসনি, তাই না? হুম?’
অরুর হতবিহ্বল অবস্থা তখনো দণ্ডায়মান। বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে আছে শুধু। পরপর দু’হাতে চেপে ধরে মুখ। অস্পষ্ট আর্তনাদ করে বসে। তন্ময় নিগূঢ় চোখে চেয়ে রয়। অরুর উজ্জ্বল চোখে নিজের ভবিষ্যৎ দেখে। এক সুন্দর স্বপ্ননীল ভবিষ্যৎ!

ফাঁকা লিভিংরুম। দেয়াল ঘড়িটা নীরবতা চিড়ে শব্দ করছে। তন্ময়ের গভীর দৃষ্টির সামনে অরু ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। কাঁপছে ঠোঁট জোড়া। কিছুক্ষণের জন্য আশ্চর্য হলেও, পরপরই নিজেকে বেশ চমৎকার ভাবে মানিয়ে নিয়েছে —যেন এমন সংবাদ তার প্রত্যাশার মধ্যেই। নিভু-নিভু চোখে চেয়ে— চোরের মতন অস্বাভাবিক ভাবে তোতলাতে শুরু করে,
‘ত..তন্ময় ভা..ভভাই…আমি–’

তন্ময় এই বোকা, সহজ-সরল– উজ্জ্বল চোখ দুটোর ভাষা পড়তে পারে। বুঝতে পারে এই শীর্ণ মেয়েলি দেহের একেকটি ভাবভঙ্গি। সে ঠিকই ধরেছে, এই মেয়ে ইচ্ছে করে পিল গুলো খায়নি। তন্ময়েরও দোষ আছে। দাঁড়িয়ে থেকে চোখের সামনে বসিয়ে খাওয়াতে হতো। ওর ভীষণ কাছে যাবার আগেই তন্ময় খুব করে ভেবেছে এইসব বিষয়ে। তার অরুটা ছোটো। পড়াশোনা চলছে। কেবলই অনার্স! তন্ময়ের ইচ্ছে আছে ও অনেকদূর পড়াশোনা করবে। অগত্যা এমন বয়সে ভুলবশতও গর্ভধারিণী হওয়া যাবে না। এরজন্য সে বারংবার নিজেকে বুঝিয়েছে। অরুর কাছে যেতে দ্বিধা করেছে। ধৈর্য ধরেছে, নিজেকে শক্ত করেছে। অবশেষে যখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ওর কাছে গিয়েছে তখনো বেশ সতর্ক থেকেছে। শরীরে উত্তাল ঝড় বয়ে গেলেও নিজেকে অনড় রেখেছে। কার জন্য? কার জন্য তার এতো চিন্তাভাবনা? কার জন্য সে এতো ভেবেছে? এতোটা ত্যাগ স্বীকার করেছে? অথচ যাকে সে চারিদিক হতে হেফাজতে রাখতে ব্যস্ত, সে নিজেই লাফিয়ে গিয়ে খাদে পড়ে বসে আছে।

এখন তন্ময় রাগ হবে না? তার হওয়া দরকার। কিন্তু সে পারছে না। আসছে না। বাবা হওয়ার এই অসহ্যকর সুখময় অনুভূতি তাকে রাগতে দিচ্ছে না। আর এই সুখ যার মাধ্যমে পেয়েছে তার ওপর রাগ কী আদতেও সম্ভব? তন্ময়ের পক্ষে অন্তত নয়।
অরু গভীর দৃষ্টির সামনে নত হয়ে ফের কুণ্ঠিত স্বরে ডাকে,
‘ততন্ময়ভভভাই….’
এমন ঘটনা ঘটিয়ে, এমন সময়ে, এমন সম্বোধন শুনে তন্ময় আশ্চর্য না হয়ে পারে না। ভ্রু’দ্বয়ের মধ্যিখানে চার-পাঁচেক ভাঁজ পড়ে। এমনিতে ওর এই ডাক তন্ময় পুরোপুরি অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে। এখন এই কাণ্ড ঘটার পরও, এইমুহূর্তেই আবার কেনো এমন সম্বোধনেই ডাকা লাগবে? তন্ময় কদম বাড়িয়ে অরুর ঘনিষ্ঠ হয়। মাথাটা ঝুকোয় অরুর সমান। কানের খুব কাছে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বেশ চাপা তবে গম্ভীর স্বরে শুধায়,
‘পেটে আমার বাচ্চা নিয়ে তুই আমায় ভাই ডাকছিস?’

অরু সতর্ক হয়। দিশেহারা হয় ওর দৃষ্টি। ঠোঁটে ভিজিয়ে বোকা ভাবে একবার তাকিয়ে নেয় তন্ময়ের গম্ভীর মুখে। অনিশ্চিত, ভীতু, ধীর স্বরে পালটা শুধায়,
‘তাইলে কী ডাকব? ফাফায়াজ- ফাইজার বাবা?’
তন্ময় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়। নড়েচড়ে ওঠে তার অভিনীত চোয়াল। মুখটা হা হয়ে আসে সামান্য। পরমুহূর্তেই মুখ বন্ধ করে নিজেকে চট করে সামলে নিয়ে হতবিহ্বল কণ্ঠে জিজ্ঞাসাবাদ করে,
‘ফায়াজ-ফাইজা? কে?’
অরু আরও ঘাবড়ে ওঠে। সতর্ক ভঙ্গিতে মিনমিনে গলায় বলে,

‘আমাদের মেয়ে হলে ফাইজা আর ছেলে হলে ফায়াজ। আম– আমি ভেবে রেরেখেছিলাম আর কি—।’
শেষের দিকের কথাগুলো অরুর জড়িয়ে আসে। ভয়ে বেচারি চুপসে যাচ্ছে। চোরাচাহনিতে ঘনঘন চাইছে তন্ময়ের মুখের দিকে। তন্ময়ের সুগভীর দৃষ্টির সামনে নুইয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। তন্ময়ের প্রত্যুত্তর না পেয়ে ফের শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নেয়। সামনেই হাপিত্যেশ করা এই বোকা মেয়েটাকে তন্ময়ের এখন আর বোকা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ছেলে-মেয়ের নামও ভেবে রেখেছিস?’
অরু মিইয়ে যায়। আহত চোখে চায়। হয়তো-বা মাত্র বুঝতে পেরেছে সে নিজের জালে নিজেই ফেঁসেছে। লজ্জায় আর মাথা তুলে তাকানোর সাহস করে না। নিজেকে বাঁচাতে নিচে চেয়েই বলে ওঠে তড়িঘড়ি করে,
‘আমি না তো।’

তন্ময় বুক ভরে শ্বাস টেনে নিলো। বুকে বাঁধল হাত দুটো। ভ্রু তুলে বেশ আগ্রহ হয়ে জানতে চাইল,
‘ওহ, তাহলে? কে রেখেছে?’
অরু চোরের মতন একপলক দেখে নিলো তন্ময়ের মুখ– পরিস্থিতি বুঝে নিতে। তন্ময়ের হাবভাব স্বাভাবিক দেখে সাহস পেলো সামান্য।
চোখ খুলে মুহূর্তেই মিথ্যে বলতে থাকল,
‘অজ্ঞান হলাম না? তখন স্বপ্নে দেখলাম দুটো বাচ্চা এসে অনুনয় করে বলছে, তাদের নাম যেন ফায়াজ, ফাইজা রাখি। সত্যিই! আ-আমি এসব নিয়ে আগে ভাবিনি।’
কথাটুকু বলে অরু ফের তাকায় তন্ময়ের মুখে। তন্ময় তখন হাসি চেপে মুখ গুরুগম্ভীর করে রেখেছে। একচিত্তে শুধুই চেয়ে আছে অরুর সুশ্রী মুখে। অরু হাঁসফাঁস করছে প্রত্যুত্তর না পেয়ে। তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঠোঁটে ছুটে এসে লেপ্টে যায় আটকে রাখা হাসিটুকু। নরম চোখে চেয়ে গভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘আমার বাচ্চার মা হওয়ার এতো সখ তোর?’
অরু লজ্জায় নেতিয়ে যায় ফুলের মতন। এলোমেলো চুল কানে গুঁজে মিনমিন করে বলে,
‘আপনার বুঝি সখ নেই আমার বাচ্চার বাবা হবার!’
তন্ময় নিঃশব্দে হেসে ফেলে। আড়চোখে দেখে দুয়ারে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারা কিছু মাথা। হেসে অরুর গাল টেনে ধরে সুর টেনে বলে,
‘খুউউব সখ।’

অরুর মুখখানি ঝলমলে রোদের মতো উজ্জ্বল হয়। রাতের আকাশের তারা ভাসে চোখে। এলোমেলো ভঙ্গিতে জাপ্টে ধরতে চায় তন্ময়ের পুরুষালি কোমর। পূর্বেই তন্ময় আলগোছে ডান হাতের আঙুল অরুর কপালে ঠেসে ওকে কাছে আসতে দেয় না। অরু আশ্চর্য হয় এতে। ফ্যালফ্যাল চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। ওসময়ে কিছু হাঁচি-কাশির শব্দ এসে কানে লাগে। অরু হকচকিয়ে ওঠে। সরে আসে তন্ময়ের কাছ থেকে। তিন শাহজাহান এসে ঢুকেছে ভেতরে। আনোয়ার সাহেব হাতের ইশারায় মেয়েকে কাছে ডাকেন। অরু ওমনি ছুটে যায় বাবার দিকে। আনোয়ার সাহেব একটুখানি মেয়েটাকে বুকে আগলে নেন। তার চোখজোড়া তখনো রক্তিম। চোখের কোণ ভেজা। এসময়ে জবেদা বেগম এসেছেন কয়েক গ্লাস জুস ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে। তন্ময় অ্যাপল জুসটা পছন্দ করে। তিনি এসে ছেলের হাতে অ্যাপল জুসটাই তুলে দিয়ে বলেন,

‘ভাত দিচ্ছি, খাবি আয়। জুসটা খেয়ে গোসল নিয়ে চটজলদি নাম।’
তন্ময় মাথা দোলায়। জুসের গ্লাসটা নিয়ে বসে সোফায়। মোস্তফা সাহেব কোমলার জুস নিয়ে ছেলের পাশেই এসে বসেছেন। আনোয়ার সাহেব তখনো মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতেও জুসের গ্লাস। অরু দু’হাতে নিজেরটা ধরে রেখেছে। আনোয়ার সাহেব বাম হাতে মেয়ের মাথার চুল গুছিয়ে দিতে নিয়ে বলেন,
‘আম্মু, এবার কি একটু চঞ্চলতা কমানো যায়?’
অরু বুঝদার হবার মতন মাথা দোলায়। মুখেও বলে,
‘আর করব না।’
সুমিতা বেগম আঁচলে হাত মুছতে নিয়ে এসে দাঁড়ান স্বামীর পাশে,
‘এসব শুকনো কথার ভত নেই। এখন থেকে আর ওপরে থাকা হবে না আপনার। নিচে থাকবেন। রুম খালি করাচ্ছি। ঠিক বলেছি তো ভাইজান?’

মোস্তফা সাহেব সহমত প্রকাশ করেন, ‘ঠিক বলেছো। নিচের রুম আগামীকালই খালি করাতে হবে। তোমার ভাবিকে নিয়ে কী করবে না করবে গুছিয়ে নাও!’
ভদ্রলোক থেমে ফের ছোটো ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হ্যাঁ রে আনোয়ার, হাসপাতাল যেতে হবে না সকাল সকাল?’
আনোয়ার সাহেব মেয়েকে সাথে নিয়েই ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলেন। প্রত্যুত্তরে বলেন,
‘জি, ভাই। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব।’
অরু বাপ-চাচার মধ্যিখানে বসে জুস খাচ্ছে। তার সচেতন আড়চোখের দৃষ্টি তন্ময়কে দেখার চেষ্টায় মগ্ন। তন্ময় সামনে তাকিয়েও সেই দৃষ্টি অনুভব করতে পারছে। পরমুহূর্তেই একটি দ্বন্দ্ব লেগে যায় হাসপাতাল কে কে যাবে সেই বিষয় নিয়ে! মুখের ভাবভঙ্গি বলে দিচ্ছে সবাই যেতে যায়। এখন গোটা শাহজাহান পরিবার নিয়ে তো আর হাসপাতাল যাওয়া যাচ্ছে না৷ কেমন দেখাবে? তন্ময় ভেবেই মুচকি হাসে। এইমুহূর্তে, এইক্ষণে তার মনে হচ্ছে জীবন সুন্দর। ভীষণ সুন্দর। এরচেয়ে সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না।

শাহজাহান বাড়িতে অন্যরকম এক পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তনটুকু তন্ময় উপলব্ধি করতে পারছে পরিবারের সবার মধ্যে। পূর্বে তাদের বিয়েটা নিয়ে সকলের মধ্যে চাপা এক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল— যা খুব সন্তর্পণে তারা গোপন করে রেখেছিল। আজকাল আর তা গোপনে নেই। সকলে উৎসাহের সহিত নিজেদের ভাবনা গুলো অকপটে ব্যক্ত করছে। আজকের ব্যাপারটাই বলা যাক, তন্ময় অফিস ব্যাগ সহ নেমেছে ব্রেকফাস্ট করতে। খেয়েদেয়ে বেরুবে অফিসের উদ্দেশ্যে। ডাইনিংয়ে এসে চেয়ার টেনে বসেছিল ঠিক অরুর পাশেই। অরুর পাশের চেয়ারটা আজকাল সবসময় ফাঁকা থাকে। এই বাড়ির অনেক বড়ো এক রুলস হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ফাঁকা চেয়ারটা। এটাতে তন্ময়ই বসবে এবং অরুর পাশেই বসবে! অন্যদিকে অরু ঘনঘন তাকেই আড়চোখে দেখে যাচ্ছে। তন্ময় সেই দৃষ্টি সবসময়ের মতো উপেক্ষা করে। মুফতি বেগম ডাইনিং ভরতি সবার সামনেই গদগদ গলায় হঠাৎ করে বলে বসলেন,
‘তন্ময় আর অরুকে পাশাপাশি কী ভালো দেখতে লাগে! আমারই তো নজর লেগে যাবে।’

রুবি বেশ উৎসাহিত গলায় মায়ের সুরে সুর মেলায়, ‘বছরের মাথায় দু’জনের মধ্যে ফুটফুটে বাচ্চাও থাকবে। কিইইই কিউট!’
দীপ্ত চিন্তিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে, ‘আমাদের বাবুর সোনার আমি কী হব? মামা নাকি চাচ্চু?’
মোস্তফা সাহেব শব্দ করে হেসে ওঠেন। পালাক্রমে হাসেন বাকিরাও। অরু লজ্জায় কাত হয়ে গেলেও– তন্ময় বেশ নির্বিকার। সে নিজের মতো হাত বাড়িয়ে দুধের গ্লাসটা অরুর দিকে এগিয়ে দিয়েছে। পানির কাচের জগটা থেকে গ্লাসে পানি ভরে ওর হাতের কাছেই রেখেছে। দুটো টিস্যু খুব নিপুণভাবে অরুর হাতে গুঁজে দিয়েছে। এসব বাড়ির লোকজন নিত্যদিন দেখেও অভ্যস্ত হননি। প্রতিদিনের মতন মুগ্ধ হোন। সুমিতা বেগম পরম মমতায় ধরা চোখে চান তন্ময়ের দিকে। স্বেচ্ছায় তাকে রুটি, ভাজি বেড়ে দিতে নিয়ে বলেন,

‘তুই খা বাবা! এই ধিঙি মেয়েটাকে এতো মাথায় তুলিস না।’
তন্ময় প্রত্যুত্তরে নিঃশব্দে হাসে। অরু মায়ের দিকে অভিমানী দৃষ্টি ফেলে। সুমিতা বেগম অগ্রাহ্য করে সেই তন্ময়ের খাবারের পেছনেই লেগে থাকলেন। মোস্তফা সাহেব খেয়ে উঠেছেন। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে নিয়ে হেসে অরুকে শুধান,
‘কী খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, মামণি? কী নিয়ে আসব?’
অরু গদগদ গলায় বলে, ‘চাচ্চু আমি স্ট্রবেরি ফ্লেভারের আইসক্রিম খাব।’
তন্ময় কাটকাট গলায় বাঁধ সাধে, ‘ঠান্ডা খাওয়া যাবে না।’
মোস্তফা সাহেবের সঙ্গে তন্ময়ের মতামত সচরাচর মেলে না। দুজন কথা কাটাকাটি করতেই ব্যস্ত থাকে। তবে এই ব্যাপারে মিলে গেল। মোস্তফা সাহেব ছেলের সঙ্গে একমত হয়ে বলেন,
‘মামণি, ঠান্ডা খাওয়া যাবে না। অন্যকিছু বলো?’

অরু হাপুস নয়নে চেয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলে, ‘চাচ্চু, ট্রিপল ডিম দিয়ে মগলাই খাব৷ ঝাল ঝাল।’
বলতে বলতে অরু জ্বলজ্বল চোখে চেয়ে রয়। জবেদা বেগম রান্নাঘর ছেড়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে বলেন,
‘এসব আবার হোটেল থেকে আনতে হবে কেন? আমি এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি। বাড়িতে সবই আছে। কতক্ষণ লাগবে আর? উল্টো আমার হাতেরটা ওই হোটেলের থেকেও মজার হবে দেখিস।’
আকাশ রুটি চিবুতে চিবুতে বুকের পাটা টানটান করে বলে, ‘আমাকে গতকাল রাতে বলেছে মমো খেতে চায় আমি রাতে ফেরার পথে তাই নিয়ে আসব।’

তন্ময় উদাস ভঙ্গিতে বাড়ির সবার কীর্তিকলাপ দেখে গেল। স্বামী হিসেবে স্ত্রী কী খেতে চায় এনে দেবার দায়িত্ব ছিল তার! কিন্তু এই বাড়িতে সেই অধিকার থেকে সে বঞ্চিত। সবাই লাইন ধরে আছে কে কী আনবে! আনোয়ার সাহেব তো একফাঁকে মেয়েকে চাপাস্বরে বলে গেছেন,
‘আম্মু আমাকে ফোন করে জানিও কী খাবে, হুঁ? বাবা ফেরার পথে নিয়ে ফিরব।’
অরু বাধ্য মেয়ের মতো হেসে মাথা দুলিয়ে বলেছে, ‘বিকেলেই বলে দেব।’
আনোয়ার সাহেব হাসিমুখে ভাইদের সাথে বেরিয়ে গেলেন। তন্ময় ডাইনিং ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ব্যাগ হাতে। অরু উৎসুক চোখে চেয়ে আছে। তন্ময় জানে কেন এই উৎসুক হাবভাব! সবাই জিজ্ঞেস করুক এতে মন ভরবে না। তন্ময়কেও জিজ্ঞেস করতে হবে, মহারানি কী খবেন! অবশেষে কাছে এসে অরুর মাথায় হাত ছুঁয়ে নরম কণ্ঠে শুধোয়,

‘কী খেতে ইচ্ছে হয়? কী আনব?’
অরু হাপুস নয়নে চেয়ে বলে, ‘খেতে না, ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে।’
তন্ময় হাত ঘড়িতে নজর বোলায়। আজ তার চারটা মিটিং আছে। দ্রুত ফিরতে হলে দুটো ক্যান্সেল করতে হবে।
‘বিকেলে তৈরি থাকিস।’
অরু খুশিতে আত্মহারা। দু’হাতে সংকোচ নিয়ে জড়িয়ে ধরে তন্ময়ের বাম হাত। তন্ময় আড়চোখে শুধু চায়, কিছু বলে না বলেই সাহস করে অরু সেভাবেই দুয়ারের দিক এগুতে শুরু করে। পেছন থেকে দু’জনকে দেখে আঁচলে মুখ গুঁজে হাসেন বাড়ির তিন গিন্নি। তিনজনই রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে আছেন।

ফেব্রুয়ারি মাস। শুক্রবার, আজ চৌদ্দ তারিখ। ভালোবাসা দিবস। তন্ময় বসে আছে বাগানে। সকালের মিঠা ঝলমলে রোদ্দুর এসে ছুঁয়েছে বাগানের ফুলগুলো। প্রজাপতি উড়ছে, মিহি বাতাস বইছে। পাখিরা ডাকছে। সহনীয় রোদ এসে পড়েছে তন্ময়ের মুখেও। কোলে ল্যাপটপ। হাতে চায়ের কাপ। মাত্রই জবেদা বেগম দিয়ে গিয়েছেন তার আর অয়নের জন্য। পাশেই অয়ন বসে চা খাচ্ছে আমোদে। আজ অয়ন-শাবিহা বেড়াতে এসেছে সকাল সকাল। মোস্তফা সাহেব ভাইদের নিয়ে বাজারে গিয়েছেন। মেয়ে জামাই এসেছে যেহেতু রান্নাবান্নার একটা তোরজোর আছে না?

অরুকে নিয়ে শাবিহাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল এসময়ে। অরুর হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে। অরুর পাঁচ মাস চলছে। পেট দৃশ্যমান রূপে বড়ো। তাকে সিঁড়ি বাইতে দেয়া হয় না। একা কোথাও ছাড়া হয় না। সবার নজর বন্দী একপ্রকার। বিশেষ করে তন্ময়ের। তন্ময় আজকাল অফিসে বেশিক্ষণ থাকে না। চেষ্টা করে বাসায় সবটা কাজ করে ফেলার। এই বছর সে কোনো ব্যবসায়িক কাজে ঢাকার বাইরে যাবে না বলে জানিয়েছে। এতে অবশ্য মোস্তফা সাহেব খুশিই হয়েছেন। তন্ময় মাথা তুলে দেখে হন্তদন্ত কদমে আসতে চাওয়া ছোটোখাটো রমণীকে। অরুর চঞ্চলতা কমেছে বললে ভুল হয়, সে চঞ্চল হতে পারছে না। বাড়ির সকলের তার ওপর হাজার খানেক নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে৷ তন্ময়ের শীতল দৃষ্টি দেখে অরু হাঁটার গতি কমায়৷ কচ্ছপের মতো ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়ার প্রচেষ্টা করে। এতে তন্ময় সন্তুষ্ট হয়। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ফের অয়নের সাথে আলাপে মগ্ন হয়। তবে অন্যমনস্ক ভাবে একাংশ মনোযোগ অরুর ওপর রয়েই গেল। অরু কাছাকাছি এসেই মুগ্ধ গলায় অয়নের উদ্দেশ্যে বলল,

‘অয়ন ভাইয়া আপনি কত রোমান্টিক! কী সুন্দর আপুকে ফ্লাওয়ার বুকে এনে দিয়েছেন।’
অয়ন আড়চোখে তন্ময়ের দিকে চেয়ে ফাঁকা হাসল। প্রত্যুত্তরে তার বলার সাহস নেই যে, ‘অরু তুমি চাইলে আমি কিনে দিতে পারি তোমাকেও একটা।’ নির্ঘাত তন্ময় চোখ দিয়ে তাকে ভস্ম করে দেবে। অগত্যা অয়ন চুপ রইল। শাবিহা হাসছে। অরু আড়চোখে চায় তন্ময়ের প্রতিক্রিয়া দেখতে। কোনো ভাবান্তর না দেখে ঠোঁট ফোলায়। গিয়ে বসে তন্ময়ের পাশেই। তবে হাল ছাড়ে না। ফের বলে,

‘আমাকে দেখাবে ওই ফুলের তোড়াটা? কী ফুল? গোলাপ?’
শাবিহা হাসিটুকু গিলে নেয়। বলে, ‘অনেকগুলো ফুলের মিশেলে বানানো ছিল।’
অরু ফের হাপিত্যেশ করে ওঠে মুগ্ধ গলায়, ‘অয়ন ভাইয়া কতো রোমান্টিক!’
অয়ন ঢোক গিলে। মনে মনে অরুকে আচ্ছারকম বকে। তাকেই কেন ফাঁসাতে হবে? অয়ন তন্ময়ের কঠিন দৃষ্টির সামনে আলগোছে উঠে দাঁড়ায় চায়ের কাপ নিয়ে। অযুহাত ধরে বাড়ির ভেতর চলে যায়। শাবিহাও হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে। অরু মুখ ফুলিয়ে তাকায় তন্ময়ের দিকে। তন্ময় চেয়েইছিল বলে মেয়েটা হকচকিয়ে ওঠে সামান্য।
পিটপিট করে করে চোখ দুটো। মিনমিন করে বলে,

‘এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো? মিথ্যে তো বলিনি। সত্যই তো বললাম।’
তন্ময় স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘আমার চেয়ে না।’
অরু ভেঙচি কাটে। তন্ময় ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হাসিটুকু গিলে ফের বলে, ‘আমার চেয়ে রোমান্টিক না। প্রমাণ তো সামনেই।’

অরু আশ্চর্য হয়ে চতুর্দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলে, ‘কই? কীসের প্রমাণ? কিছুই তো দেখি না।’
তন্ময় তাকায় অরুর পেটের কাছটায়। অরুও দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজ পেটে তাকায়। ফুলো পেটে কীসের প্রমাণ? অরু অবুঝের মতো কিছুক্ষণ পলক ফেলে পরমুহূর্তেই আশ্চর্যে দাঁড়িয়ে যায়। তাকায় তন্ময়ের চোখে। তন্ময় তখন ভ্রু তুলে তাকিয়ে আছে।

মাহিন শব্দ করে হেসে ডেকে বলে,
‘অ্যাই-যে ফায়াজ-ফাইজার বাবা, ভালো আছেন? মন মেজাজ ভালো? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’
তন্ময় ঘুরিয়ে কেবলই সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরেছে। অন্যদিকে রিয়ান হকচকিয়ে ওঠে। প্রশ্ন করে,
‘ও ভাই, কী মিস করলাম? ফায়াজ-ফাইজা কে?’
মাহিন হাসতে হাসতে বলে, ‘কে আবার? তন্ময়!’
সৈয়দ আশ্চর্য হয়ে পড়ে। আপদমস্তক নির্বিকার তন্ময়কে দেখে বলে,

‘এতো ফাস্ট? এইতো বাসরটুকুও করতে চাইছিলি না। বিড়ালের মতন লেজ আকাশে তুলে মাছের থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলি। আমরাই তো জোরপূর্বক মাছ সামনে সার্ভ করে খেতে বাধ্য করলাম। আমরাই তো সবকিছুর বন্দবস্ত করে দিলাম। অথচ এখন দেখি তলে তলে আনবর্ণ বাচ্চাদের নামধামও ডিসাইড করে আছিস। তাও আবার দুটোর! আশ্চর্যজনক।’
ইব্রাহিমের হাতে জুসের গ্লাস। সে গ্লাসে মুখ দিতে ভয় পাচ্ছে। দেখা যাবে খেতে নিচ্ছে এসময় এমন কিছু বলে বসল যে তার মাথায় জুস উঠে গেছে। কাশতে কাশতে জীবন যাবে পরে। এমন অভিজ্ঞতা হাজার খানেক হয়েছে তার ইতোমধ্যে। তাই আর রিস্ক নেয়ার প্রশ্নই আসে না। এই অসভ্যদের মধ্যে শান্তভাবে খাওয়াও বিলাসিতা। বিড়বিড় করে এযাত্রায় বলে,

‘এখনো জানিস না দেখছি? শালার লাক না যেন খোদাই করা স্বর্ণ! অরুর আলট্রাসনোগ্রাফিতে জমজ বাচ্চা ধরা পড়েছে। এক ঝটকায় প্রেগন্যান্ট করিয়ে তো ফেলেছেই তাও আবার দুটো বাচ্চার!’
তন্ময় থমথমে চোখে ইব্রাহিমের দিকে চাইতেই ইব্রাহিম মুখ ঘুরিয়ে চুপসে যায়। রেস্টুরেন্টের ছাঁদে তখন বেশ শোরগোল, মানুষজন। বন্ধুরা তারা বসেছে পূর্বদিকে চার টেবিল জুড়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ভরা মজলিসের মধ্যেই হৈহৈ করে ওঠে সবগুলো। উচ্চ শব্দ শুনে আড়চোখে সবাই চাইছে এদিকটায়। তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শুধায়,
‘তোরা বাসায় যাবি না?’

ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে বারোটা চল্লিশে। চল্লিশ মিনিট ধরে এই বাঁদরগুলো তাকে আঁটকে রেখেছে। নেহাতি বন্ধুবান্ধবদের আকুতি-মিনতি রক্ষার্থে এসে হাজির হয়েছিল। রিয়ান তখনো কৌতুহলী হয়ে আছে জানতে,
‘তা নাহয় বুঝলাম, তবে এই নাম রেখেছে? ভবিষ্যৎ দেখেছিলি নাকি যে দুটো হবে?’
মাহিন ফের খিলখিল করে হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,
‘আমাদের অরু রানি রেখেছে। ছেলে হলে ফায়াজ, মেয়ে হলে ফাইজা। এখন ছেলে, মেয়ে দুটোই হচ্ছে। তাই নামও ওলরেডি ফিক্সড।’

শুহানি তন্ময়ের ফোনটা নিয়ে অরুর ছবি দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মেয়েটার মুখ ফুলে গেছে। শরীরও বেশ পরিবর্তন হয়েছে। এক অদ্ভুত সৌন্দর্য এসে ছুঁয়েছে সম্পূর্ণ ওকে জুড়েই।
সৈয়দ আবদার ধরে এবেলায়, ‘বাসায় একদিন দাওয়াত দে না, দোস্ত! অরুকে একটু দেখি। ছবিতে কী মিষ্টি লাগছে, একদম নাদুসনুদুস।’
তন্ময়ের প্রত্যুত্তরটুকু কাটকাট, কঠিন শোনায়,
‘না। কখনো না।’
রিয়ান ঠোঁট ফোলায়, ‘আমার ডার্লিংকে একটু দেখতে দিবি ন….’
তন্ময়ের কালো মুখ দেখে কথাটুকুর পূর্ণতা করার সাহস রিয়ান আর পায় না। আলগোছে মুখ বন্ধ করে ফেলে। একটু ডার্লিং ডাকলে কী এমন হয়েছে? তন্ময়টা না যাচ্ছেতাই!

ভোরের মিঠে-মিঠে রোদ্দুর এসে ছুঁয়েছে বেলকনির ফ্লোর। দুটো পাখি এসে ঘুরছে এদিক-ওদিক জুড়ে। বেলকনির রেলিঙে ঝুলানো ফুল গাছগুলোতে কিছুক্ষণ আগেই জবেদা বেগম পানি দিয়ে গিয়েছেন। পানির সংস্পর্শে এসে ভেজাটে ফুলগুলো দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে। ফুলের পাপড়ি থেকে টুপটুপ করে এখনো পানি ঝরছে। তন্ময় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে সবেমাত্র। এসেই দাঁড়িয়েছে বেলকনিতে। গলায় রাখা তোয়ালে দিয়ে বেশ অবহেলিত ভঙ্গিতেই মাথার চুলগুলো মুছে নিচ্ছে। দৃষ্টি গিয়ে থামে বাগানের দক্ষিণ দিকটায়।

সেখানটায় এই সাতসকাল বেলায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শাহজাহান বাড়ির বেশ কিছু সদস্য। তাদের সবার দৃষ্টি — গর্ভধারিণী অরুর ওপর। অরুর ছয় মাস চলছে। মাসের তুলনায় পেট অস্বাভাবিক বড়ো। কিছুদিন আগেই তার আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে জমজ বাচ্চা ধরা পড়েছে। একটি ছেলে আর ওপরটি মেয়ে। এরপর থেকেই বাড়ির ভেতরে এক থমথমে পরিস্থিতি। আনন্দের মধ্যেও সবাই চিন্তায় অশান্ত হয়ে আছে। অরুর বয়স কম, অল্পবয়সী প্রেগ্ন্যাসির মধ্যেই আবার জমজ বাচ্চা! ও যে তাদের হাতের ননির পুতুল। এই পুতুল জমজ বাচ্চার মাতৃত্বের স্বাদ আদতেও নিতে পারবে তো?

তন্ময় নিজেও দুঃশ্চিন্তায় আজকাল ঘুমোতে পারছে না। আজ ক’টা দিন ধরেই সে বড্ড বিচলিত। এতো অশান্তি লাগছে ভেতরে। বাবার হওয়ার আনন্দটুকুও সে উপভোগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। জমজ বাচ্চার ডেলিভারি প্রসেস আতঙ্কজনক। ডিফিকাল্টিস বেশ হাই। তন্ময় ডাক্তার থেকে নিপুণভাবে শুনেছে, জেনেছে।
অসহায় লাগছে তার।
বাড়ির বুজুর্গদের অবস্থাও তন্ময়ের মতনই—কাছাকাছি। জবেদা বেগম আর সুমিতা বেগম অরুর পেছনেই লেগে থাকেন চব্বিশঘণ্টা। ওর প্রতিটা পদক্ষেপ যেন তাদের ইশারায় ফেলতে হবে। এতে অরু মহা বিরক্ত! চঞ্চল সে গৃহবন্দী হয়ে তো আছেই, সাথে একেকটা কদমও তাকে গুনে-গুনে ফেলতে হয়। গতকাল রাতেও সে তন্ময়ের কাছে আহ্লাদী স্বরে নালিশ জানিয়েছে। তন্ময় শুনেছে বেশ মনোযোগ সহকারে। তবে শোনা পর্যন্তই। নালিশ কানে তোলেনি। সেই ব্যপারটি ধরে অরু এখনো মুখ ফুলিয়ে আছে। কথাবার্তা বলছে না। অল্পতেই মুখ ভার করছে, কাঁদছে…অভিমান করছে। ডাক্তার বলেছেন এসময়টায় ওর অনুভূতির ঘুর্ণিঝড় বয়ে যাবে। আর তা তার ওপরেই। শাহজাহান তন্ময়ের ওপর!

মোস্তফা সাহেব গম্ভীরমুখে চেয়ে আছেন শূন্যে। যেন জগৎ সংসারের ওপর তিনি অতিষ্ঠ। খুব শীঘ্রই বেরিয়ে পড়বেন অজানার উদ্দ্যেশ্যে। হাতে তার চায়ের কাপ। গরম চা থেকে এখনো ধোঁয়া উড়ছে। সুমিতা বেগম মাত্রই দিয়ে গিয়েছেন। তন্ময় এসে বসেছে ভদ্রলোকের পাশেই। সে কফি নিয়ে এসেছে এক মগ। হাতের ল্যাপটপটা রেখেছে টেবিলের ওপর। পায়ের ওপর পা তুলে চায় অদূরেই। অরু ফুল গাছে পানি দিচ্ছে। পাশেই রুবি দাঁড়িয়ে আছে। দীপ্ত প্রজাপতি ধরতে ব্যাকুল। তন্ময় ওদিকে চেয়েই কফির মগে চুমুক বসায়। মৃদু বাতাস বইছে। পাখি ডাকছে। দারুণ এই সময়টা তন্ময় উপভোগ করতে পারে না। পূর্বেই বাবা নামক দুঃসম্পর্কিত শ্বশুর ক্যাটক্যাটে কণ্ঠে বলে ওঠেন,
‘খুব আমোদেই কফি খাচ্ছো দেখছি।’

তন্ময় জানে তার পিতা মহাশয় কী নিয়ে তার ওপর বিরক্ত! দুটো বাচ্চা তো তন্ময়ের কাণ্ডে আসেনি। আল্লাহ্ এর ইচ্ছেতেই এসেছে। তাই নয় কী? কিন্তু এই ভদ্রলোক সেই বিষয় নিয়ে তন্ময়ের ওপর চটে আছে। আশ্চর্য!
‘কেঁদে কেঁদে খাব?’
তন্ময়ের সরল প্রশ্নের বিপরীতে মোস্তফা সাহেব তীক্ষ্ণ ভাবে চোখ রাঙান। তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন,
‘না কেঁদে কেঁদে কেনো খাবা? হেসে হেসে খাও।’
তন্ময় ফের মগে চুমুক বসায়। নির্বিকার কণ্ঠে বলে,
‘হাসতে ইচ্ছে করছে না আপাতত। তোমার হাসি আসলে আমায় ধার দিও, বাবা। তোমার জন্য নাহয় একটু হেসে হেসেই কফি খাব।’

মোস্তফা সাহেবের থমথমে মুখখানা আরও থমথমে হয়ে এলো। নাক ফোলালেন। বিরক্তিতে মুখ ভোঁতা করে বাঁকাচোখে ছেলেকে দেখলেন। তন্ময় যেন বাবার ওই ধারালো দৃষ্টি দেখেও দেখল না। ভদ্রলোককে সুযোগ দিলেই তাকে পেয়ে বসবে। মোস্তফা সাহেব মিনমিনে গলায় আওড়ালেন,
‘দামড়া ছেলে তুমি কিচ্ছুটি কী বুঝো নাই? গাফলতির দ্যাখো কী পরিণাম দাঁড়িয়েছে।’
তন্ময় যেন শুনেও শোনে না। তবে প্রত্যুত্তর করবে না করবে না করেও, করে বসে শেষমেশ,
‘তুমি দাদা হচ্ছো।’

মোস্তফা সাহেবের কথাটুকু বুঝতে সময় লাগে। গুরুগম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ ছেলের উদাস মুখপানে চেয়ে রন। অবশেষে তিনি হনহনিয়ে উঠে চলে গেলেন। পিতা নামক দুঃসম্পর্কিত শ্বশুরকে বিরক্ত করে তন্ময়ের মন ভালো হয়ে আসে অনেকাংশে। সে বেশ আরাম করে কফিতে চুমুক বসাতে বসাতে অরুকে দেখে। মেয়েটা ম রে যাওয়া ফুল নিয়ে হাহুতাশ করছে। রুবি স্বান্তনার বুলি আওড়াচ্ছে। এযাত্রায় ফিরে চায়। তন্ময়ের চোখে চোখ পড়তেই মুখ ভেঙায়। মাথা ঘুরিয়ে ফের ফুল দেখতে ব্যস্ত হয়। ও কী জানে ওভাবে মুখ ভেঙালে তন্ময়ের ভেতর কিছু একটা হয়? তছনছ হয় ভেতরটা? জানে? জানে না। জানার কথাও না।

অরুর জন্য সিঁড়ি ঘরের রুম ফাঁকা করা হয়েছে। ক’মাস ধরে এই রুমেই সে থাকে। তন্ময়কেও ঘুরেফিরে এই রুমেই পাওয়া যায়। আজও ব্যতিক্রম নয়। অরু বিছানার অন্যপাশে গিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে৷ রাতের খাবার খায়নি এখন অবধি। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে ন’টায়। তন্ময় হাত ঘড়ি খুলে রাখতে নিয়েই ডাকে,
‘অরু? খেতে আয়।’
অরু আরও ঘুরে বসে। পিঠ দেখিয়ে আওড়ায়,
‘খাব না।’
তন্ময় ওর দিকে এগুতে নিয়ে শুধায়,
‘কেনো খাবি না?’
অরুর প্রত্যুত্তর বাঁকা, ‘আপনার জানা লাগবে না।’

তন্ময় এসে দাঁড়ায় অরুর সামনে। গাল দুটো রক্তিম হয়ে আছে। ফুলো ফুলো গাল দুটোকে আবার কেমন ফুলিয়ে রেখেছে টমেটোর মতন। চুলে তেল দিয়ে দুটো বিনুনি গেঁথে দিয়েছে জবেদা বেগম। দেখতে বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। আর এই বাচ্চার পেটেই তার নাকি দুটো বাচ্চা! ভাবতেই তন্ময়ের মেরুদণ্ড বেয়ে শিহরণ ছুটে যায়। সেই অনুভূতি বড্ড অদ্ভুত। তার পুরো পৃথিবীটাই যেন শুধু ওর সামনে এসে থমকে গেছে। সে পকেট হাতড়ে পায়েলের বক্সটা বের করে। কিনেছিল গতকাল রাতে, ফেরার পথে। মেয়েটা অভিমান করে কাছেও আসেনি, দেবার সুযোগও হয়নি। এবারে এসে তন্ময় বসে অরুর পাশেই। বক্স থেকে পায়েলটা বের করে আলতোভাবে অরুর পা’টা বিছানায় রাখে। পায়েলটা পরিয়ে দেয় খুব যত্নের সাথে। অরু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। চোখে কতশত প্রশ্নের বাণ। সেই প্রশ্নের বাণ এড়িয়ে তন্ময় ফের উঠে দাঁড়ায়। আর একটা কথাও বলে না। হঠাৎ করেই কোমর বেঁকিয়ে অরুকে পাজাকোলে তুলে নেয়। অরু হকচকিয়ে ওঠে। অস্পষ্ট আর্তনাদ করে। দ্রুত জাপ্টে ধরে তন্ময়ের গলা। সে কী ভারী! এই তাকে মানুষটা কীভাবে তুলতে পারে? তন্ময় ইতোমধ্যে এগুতে শুরু করেছে দরজার দিক। অরু প্রথমে আশ্চর্য হয়। রুম থেকে বেরুতে দেখে বিচলিত হয়ে ওঠে,

‘কই নিচ্ছেন? নামান, নামান। বাইরে সব্বাই আছে তো।’
তন্ময় কী শুনলো? বোধহয় না। খুব ধীরস্থির কদমে এগুতে থাকল নিজের মতোই। অরু চোখমুখ আতঙ্কে, লজ্জায় বুজে নিয়েছে। শক্ত করে ধরেছে তন্ময়ের গলা। লিভিংরুমে উপস্থিত সকলের মুখ তখন হা হয়ে আছে। মোস্তফা সাহেবের হাত থেকে বাদাম পড়ে গিয়েছে। আনোয়ার সাহেব থতমত চেহারায় চেয়ে আছেন। তন্ময় কোথাও চায় না। সোজা ডাইনিং এসে চেয়ারে বসিয়ে দেয় অরুকে। জবেদা বেগম বেয়াকুবের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন এহেন দৃশ্যে। তন্ময় বলে,
‘ওকে খেতে দাও।’
যেন হুঁশ আসে জবেদা বেগমের। তিনি আমতাআমতা করেন,
‘ওহ, হ্যাঁ। দিচ্ছি, দিচ্ছি। তুইও বোস।’
অরু মাথা নত করে রেখেছে। রীতিমতো লজ্জায় মেয়েটা এইটুকুন হয়ে আছে। তন্ময় পাশের চেয়ার টেনে বেশ সাবলীল ভাবেই বসে খেতে। আগ বাড়িয়ে অরু প্লেট উল্টে দেয়। অথচ পেছনে অনেক গুলো চোখ বড়ো বড়ো চোখে তাদের দুজনকেই দেখছে।

অরুর প্রেগন্যান্সির আট মাস। শরীরের তুলনায় পেট খানা তার অসম্ভব বড়ো। বড়ো পেটের কারণে হাঁটাচলা তো দূরের বিষয়, মেয়েটা আরাম করে শুতে অবধি পারে না। কোনোরকম একপাশ হয়ে শুয়ে থাকতে হয় সারাটিরাত। অথচ ও বিছানার জুড়ে ঘুমের ঘোরে পায়চারি করা মেয়েমানুষ। তন্ময় হাপুসনয়নে প্রিয়তমারা অস্বস্তি, কষ্ট দেখে —পীড়া অনুভব করে। সে পীড়া অনুভব করে, তা অরু হয়তোবা বোঝে। তাইতো কোনোভাবেই খারাপ লাগা জাহির করতে চায় না। চঞ্চল থাকতে চায়, হাস্যোজ্জ্বল থাকতে চায়৷ বোঝাতে চায় সে মোটেও খারাপ নেই। দিব্যি আনন্দে আছে। এতেও তন্ময় খুব অসহায় অনুভব করে। তার অরুর এতো বুঝদার হওয়া ভালো লাগছে না। এতো বুঝতে কে বলেছে? এসময়েও কেনো তার কথা ওই পুচকে মেয়েটার ভাবতে হবে? ওর খারাপ লাগলে কাঁদুক, তন্ময়কে জ্বালাক, পোড়াক…জানাক এইতো সে চায়।

খুব করে চায়। এইযে ও কিছু মাস ধরে শান্তিতে ঘুমুতে পারছে না। ঘুমের ঘোরে একটু নড়তেচড়তে গেলে অসুবিধে হয়। ব্যস, ওমনি ঘুম ভেঙে যায়। আর বাকিটা রাত ঘুম আসে না ওর। নির্ঘুম কাটে। তন্ময়েরও ঘুম ভেঙে যায়, সে অবশ্য ওর চিন্তায় ঠিকঠাক ঘুমাতেও চায় না৷ ইচ্ছে হয় না।

অরুর পাশে— বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে তন্ময়। কাজের ফাঁকে-ফাঁকে আড়চোখে ঘুমন্ত অরুর ওপরও নজর রাখছে। ওর ওঠার সময় হয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে এই মাঝরাতে উঠে বসে থাকার বদভ্যাস করে রেখেছে। আজ রাতের খাবার সেরে একটু হেঁটেছিল। এরপর ঘরে এসেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। দেয়াল ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে রাতের একটা পঁয়তাল্লিশ। আজ আকাশে চাঁদ নেই, নেই নক্ষত্র। কালো মেঘে আকাশ অন্ধকার। জানালা দিয়ে কেমন ঠান্ডা বাতাস আসছে। এসময়ে ঝংকার তুলে বজ্রপাত পড়ল। তন্ময় চকিতে তাকাল অরুর দিকে। না, ওর ঘুম ভাঙেনি। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মাঝেমধ্যে অস্বস্তিতে গুঙিয়ে উঠছে। তলপেটে হাত রেখে আছে। অন্যহাত গালে। তন্ময় কিছুক্ষণ নীরবে, বড্ড নিভৃতে অরুর মুখখানি দেখে। আগের তুলনায় স্বাস্থ্য হয়েছে সামান্য। গাল দুটো ভরাট। কী ভীষণ মিষ্টি দেখায় আজকাল! অন্যরকম সৌন্দর্য বহন করছে ওর অস্তিত্ব জুড়ে।
তন্ময় হাত বাড়িয়ে অরুর অবাধ্য চুলগুলো মুখ থেকে সরিয়ে কানে গুঁজে দেয়। মুখ থেকে হাত নামিয়ে আলগোছে ওর তলপেটে হাত রাখে। বুলিয়ে দেয়। অরুর পেট বুলিয়ে দেয়া তার অন্যতম এক অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অভ্যাসটা অবশ্য অরুই করিয়েছে তাকে। হঠাৎ করে এসে বলতো,

‘তন্ময় ভাই, বাবুদের ছুঁয়ে দিন তো একটু। ওরা ওদের বাবার স্পর্শ চায়।’
তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এমন মুহূর্তে ওর মুখের ভাই ডাকটা পৃথিবীর অন্যতম হাস্যকর সম্বোধন।
তন্ময় অসহায় গলায় তখন বলে,
‘এক মুখে আমায় ভাই ডাকছিস, আবার তোর পেটের বাচ্চাকে আমায় বাবা ডাকাচ্ছিস। তোর কমনসেন্স কোথায়?’
অরু মিইয়ে যায়। দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে মিনমিনে গলায় বলে,
‘ফায়াজ-ফাইজার বাবা, বাবুদের ছুঁয়ে দেন না।’

তন্ময় ওকে কোলে বসিয়ে উঁচু পেটটা ছুঁয়ে দিতো, চুমু খেতো। ভীষণ আদর করতো। এখন তাকে আর বলতে হয় না। সে দিনে অগুনিত বার অরুর পেট বুলিয়ে দেয়। সেদিন ঘরের দুয়ারে এসে দেখে অরু নিজের পেট দু’হাতে ধরে নরম গলায় গল্প করছে। তন্ময়কে দেখতে পেতেই হাতের ইশারায় কাছে ডেকে উত্তেজিত বলে,
‘একটা বাবু মাত্রই কিক করল। কে কিক করতে পারে বলুন তো? ফায়াজ নাকি ফাইজা?’
তন্ময় কীভাবে জানবে কে লাথি দিয়েছে? তার তো জানার কথা না। ওদিকে অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকা প্রেয়সীকে হতাশ করতে ইচ্ছে হয়নি তার। অরুর চোখে চেয়ে দিনদুপুরে মিথ্যে বলেছিল,
‘ফায়াজ।’

অরু গদগদ গলায় বলে, ‘আসুন, ছুঁয়ে দেখুন কীভাবে কিক করছে! একদম আপনার মতো অ্যানার্জেটিক।’
তন্ময় আর অ্যানার্জেটিক? আদতেও এই কথা বিশ্বাস করার মতন? তন্ময় এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে অরুর পেটে হাত রাখে। তখুনি বাচ্চা ফের কিক করে। তন্ময় স্পষ্ট একটা নতুন জীবনের উপস্থিতি পায়। সেই অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। আজও সে অরুর পেট ছুঁয়ে বাচ্চাদের উপস্থিতি অনুভব করার প্রচেষ্টা চালায়। এসময়ে ফের বজ্রপাত ঘটে। আশেপাশেই ঘটেছে বোধহয়। জানালা খোলা থাকায় খুব জোরালো হয় বজ্রের ধ্বনি। অরু নড়েচড়ে ওঠে। তন্ময়ের হাতটা শক্ত করে দু’হাতের মধ্যে। আড়মোড়া চোখ মেলে চায়। তন্ময়কে দেখে ঠোঁট ফুলিয়ে বিড়বিড় করে,

‘খেতে ইচ্ছে করছে।’
তন্ময় ল্যাপটপ বন্ধ করে। অন্য হাতে অরুর চুল বুলিয়ে দিয়ে শুধায়,
‘কী খেতে ইচ্ছে হচ্ছে?’
অরু বলে না। বরংচ প্রশ্ন করে, ‘কয়টা বাজে?’
তন্ময় সময় বলতেই অরু কিছুক্ষণ নীরব থাকে। চিন্তিত গলায় বলে, ‘কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঘুমাচ্ছেন না কেনো? এতো রাত হয়েছে আর আপনি এখনো জেগে। আসুন, ঘুমান।’
বাইরে বুঝি বৃষ্টি শুরু হয়েছে? ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ঝুম হয়ে বৃষ্টি এই নামবে বলে। তন্ময় অরুর গাল ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী খেতে ইচ্ছে করছে?’

অরুর সদ্য ঘুম ভাঙা মুখ অসহায় দেখল। বড়ো হতাশ হয়ে জানাল,
‘রসমালাই। কিন্তু আমি খেতে চাচ্ছি না বিশ্বাস করুন। বাচ্চারা খেতে চাচ্ছে।’
তন্ময় হেসে ফেলে। সেই হাসি দেখে অরু হাপুসহুপুস করে। লজ্জা পায়। নিজের কথাটুকু প্রমাণ করতে বলে,
‘ওদের জিজ্ঞেস করুন, ওরাই বলবে আমি নির্দোষ।’
বলতে বলতে অরু উঠতে চায়। তন্ময় দু’হাতে উঠে বসতে সাহায্য করে। অরুর গায়ের ম্যাক্সি হাটুর ওপরে উঠে আসে৷ তন্ময় নরম হাতে ছায়া, ম্যাক্সি ঠিক করে দিয়ে বলে,
‘আমার বাচ্চারা খেতে চেয়েছে যেহেতু আমি তাদের বানিয়ে খাওয়াব। তাদের মাকে তো একবার বানিয়ে খাইয়েছিলাম। ভুলে গেছে?’

অরু মুহূর্তেই তন্ময় বুকে হামলে পড়ে। দু’হাতে জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে জানায়,
‘আমাকে কিনে এনে দিলে মোটেও ভালো হতো না। আমি খুব অভিমান করতাম। খুউউব।’
তন্ময় নিঃশব্দে হাসে। অরুর চুলগুলো গুছিয়ে নিতে নিয়ে বলে,
‘দিনের চব্বিশঘণ্টার বিশ ঘণ্টাই তো অভিমান করে থাকিস।’
অরু প্রত্যুত্তরে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে তন্ময়ের পুরুষালি কোমর। বড়ো করে ঘ্রাণ শুঁকে নেয় তন্ময়ের শরীরের। তন্ময়ের বুকে যেই শান্তি পায় সে তা পৃথিবীর কোথাও পায় না। এই যায়গাটাই তার সবকিছু। অরুর আস্ত পৃথিবী এই বুক।

বাতি বন্ধ লিভিংরুমের, রান্নাঘরের। সবাই ঘুমাতে চলে গিয়েছে। রাত তো কম হয়নি! তন্ময় বাতি জ্বালায়। এসে দাঁড়ায় রান্নাঘরে। সেবার ইউটিউব দেখে রান্না করেছিল। এবারো সে ইউটিউবে রসমালাই বানানোর ভিডিও ছেড়ে কিছুক্ষণ দেখল। উপকরণ গুলো আগে জড়ো করতে হবে। প্রথমে ফ্রিজ থেকে দুধ নামিয়ে ভিজিয়ে রাখল।
এরপর রান্নাঘরের কাবার্ড খুলে উপকরণ খুঁজতে থাকল। নীরবতা চিড়ে টুংটাং ধ্বনিতে মুখরিত চারিপাশ। এসময়ে কারো উপস্থিতি অনুভব করে তন্ময় পিছু চেয়ে আশ্চর্য না হয়ে পারে না৷ মোস্তফা সাহেব আগ্রহী বদনে দাঁড়িয়ে আছেন। হালকা কেশে প্রশ্ন করেন চাপাস্বরে,

‘কী করছো?’
তন্ময় ফের ব্যস্ত হয় নিজের কাজে। বলে,
‘অরু রসমালাই খেতে চাচ্ছে। তাই বানাব।’
মোস্তফা সাহেব আনন্দে আপ্লূত হলেন। চটপট বেসিনে ধুতে গেলেন হাত দুটো। হাত দুটো ফটাফট ধুয়ে এসে বলেন,
‘একা করতে পারবে না। দেরি হবে। আমিও সাহায্য করি।’
বলতে বলতে তিনি নিপুণ দৃষ্টিতে তন্ময়ের ফোন নিয়ে রসমালাই বানানোর রেসিপিটা দেখে নিলেন। বিজ্ঞের মতো বলেন,

‘দুধটা চুলোতে বসিয়ে দিই আগে। এটা অনেকক্ষণ জ্বাল দিতে হবে। তারপর নাহয় ঢো বানানোর কাজে লাগব।’
মোবাইলটা রেখে মোস্তফা সাহেব দুধের প্যাকেট কেটে ঢেলে নিলেন পাতিলে। তন্ময় তখনো এক এক করে উপকরণ খুঁজে খুঁজে এক যায়গায় জড়ো করছে। ব্যস্ত দুজন হঠাৎ কারো উপস্থিতি পেয়ে পিছু ফিরে দেখে আনোয়ার সাহেব দাঁড়িয়ে। চোখে চশমা, হাতে বই। ভদ্রলোক ঠান্ডা পানি খেতে এসেছেন। বড়ো ভাই, এবং ভাইপোকে রান্নাঘরে ব্যস্ত দেখে আশ্চর্য গলায় শুধান,
‘কী করছেন ভাইয়া?’
মোস্তফা সাহেব আনন্দিত গলায় ঘোষণা দেবার ভঙ্গিমায় জানান,
‘অরু রসমালাই খেতে চেয়েছে। রসমালাই বানাচ্ছি।’

মুহূর্তেই আনোয়ার সাহেব বিচলিত হলেন। বইটা পাশে রেখে হাত দুটো ধুতে গেলেন বেসিনে। ধুয়ে এসে তিনিও বড়ো ভাইয়ের পেছনে রসমালাই বানানোর কাজে ব্যস্ত হলেন৷ তন্ময় আশ্চর্য না হয়ে পারে না। নির্বাক তাকে মোস্তফা সাহেব কাজ ভাগ করে দিলেন। তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে হেসে ভাগে পড়া কাজটুকু করতে থাকে।
রান্নাঘরের টুংটাং শব্দ, মিহি স্বরে রসমালাই বানানোর আলোচনার মধ্যে অরু ধীরপায়ে এসে হাজির হয় লিভিংরুমে। সে এসেছে তন্ময়ের রসমালাই বানানো দেখতে। অথচ রান্নাঘরে তন্ময় ব্যতীত আরও দুজন ভীষণ ব্যস্ত। মোস্তফা সাহেবের নাকে আটা লেগে আছে৷ আনোয়ার সাহেবের সাদা শার্টেও সাদা কিছু একটা লেগে গিয়েছে। তন্ময়ের দু’হাতে মিশ্রণের বাসন। এই পর্যায়ে তন্ময় অরুকে দেখতে পায়৷ অদূরেই দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাদের দেখছে। আনোয়ার সাহেবও এবারে মেয়েকে দেখেন৷ দু’হাতে ময়দা তার। সেভাবেই দু’গাল ভরে হাসেন। মোস্তফা সাহেব প্রাণোচ্ছল গলায় বলেন,

‘মামণি আর আধঘন্টার মধ্যেই রসমালাই হয়ে যাবে। তুমি বসো।’
অরু লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। বাবা-চাচাদের এহেন কাণ্ডে আনন্দে হেসেও ফেলে। তন্ময় চাইতেই সে দু’হাত মুখে চেপে হেসে ওঠে। চাচার কথা মতো বসে লিভিংরুমের সোফায়। দেখা গেল কিছুক্ষণের মধ্যে জবেদা বেগম, সুমিতা বেগমও এসে হাজির হলেন। তবে তারা রান্নাঘরে ঢোকে না। লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে তাদের ব্যস্ত কাণ্ডকারখানা দেখে যায়।

অরুর ডেলিভারি ডেট ঘনিয়ে আসছে। তন্ময় আপনমনে খুব অস্থির হয়ে আছে। অরুও কিছুটা ভয়ে মাঝেমধ্যে গুটিয়ে যায়। এইতো অরুর প্রায় ন’মাস। এই মাসের শেষের দিকে অরুর ডেলিভারি ডেট পড়েছে। জবেদা বেগম, সুমিতা বেগম ব্যাগপত্র গোছাতে শুরু করেছেন। আজ তন্ময় বেবিশপ থেকে শপিং করে ফিরেছে। নবজাতক বাচ্চা যা যা প্রয়োজন সবই সে নিয়ে এসেছে। সেসব জবেদা বেগমের হাতে দিয়ে ঘরে এসে ঢোকে। অরু বিছানায় বসে আছে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে। তন্ময়কে দেখে অস্থির হয়, নড়েচড়ে ওঠে। তন্ময় হাত ঘড়ি খুলতে নিয়ে শুধায়,
‘কী হলো?’

অরু হাতের ইশারায় কাছে ডাকে। তন্ময় এগিয়ে যায়। পাশে বসে৷ অরু কিছুক্ষণ তন্ময়ের দিকে চেয়ে থেকে কান্না আটকে রাখা চাপা গলায় বলে,
‘তন্ময় ভাই, যদি আমার কিছু হয়ে যায় আপনি কিন্তু কখনো অন্যক কাউকে বিয়ে করতে পারবেন না।’
তন্ময় মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়। থমকায় তার মুখ। চোয়াল তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়। এক ভয়ংকর বিশ্রী অনুভূতির তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয় ভেতরের সবকিছু। অরু বোধহয় বুঝতে পারে সে ভালো কিছু বলেনি! কিন্তু তাকে কিছু বলতেই দেয় না তন্ময়। জাপ্টে ধরে নিজের বুকের মধ্যে। বিড়বিড় করে তন্ময়,

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৭৭+৭৮

‘দ্বিতীয়বার এইসব কথা তোর মুখে শুনলে আমি — আমি….’
তন্ময় শেষ করতে পারে না বাক্য। সে থামে যায়। অরু ঘাবড়ে যায়। গুটিয়ে যায় তন্ময়ের বুকে৷

শাহজাহান তন্ময় পর্ব ৮১+৮২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here