শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩
সুমাইয়া সুলতানা
সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস আগুনের। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। প্রতিদিন সকালে নামাজ পড়ে বাইরে জগিং করতে চলে যায়। ভেবেছিল আজকেও যাবে তবে শরীর শায় দিচ্ছে না। রাতে তেমন ভালো ঘুম হয় নি। এখন আবার ওঠে পড়েছে। কলেজেও যেতে হবে। বিয়ের জন্য কালকে যেতে পারে নি। ফ্রেস হয়ে এসে বিছানার দিকে নজর পড়ে। নিষ্পাপ মুখের অধিকারী একটা শুভ্র পরী তারাই বিছানায়। এলোমেলো ভাবে মোম ঘুমিয়ে আছে। পড়নের কাপড় হাঁটু পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। বুকের কাছের আঁচল টাও ঠিক নেই। হাত দুটো এক সাথে করে মাথার নিচে দিয়ে গুটিশুটি মে’রে শুয়ে আছে। মাথার ছোট ছোট চুল গুলো কপালে পড়ে আছে। ফ্যানের বাতাসে উড়ছে সেগুলো। শুষ্ক ঢোক গিলে আগুন। দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
” বাচ্চা একটা মেয়েকে ঝুলিয়ে দিয়েছে আমার ঘাড়ে। যে নিজেকেই সামলাতে পারে না। সে আমাকে সামলাবে কিভাবে?
নিজের রুমের বেলকনিতে চলে যায় আগুন। গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। নজর তার দূর আকাশে। আকাশে এখনো সূর্যের দেখা মিলেনি। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তার কিরণ ছড়াবে ধরণীর বুকে। আগুন যখন মন দিয়ে হালকা ঘোলাটে আকাশ দেখতে মত্ত তক্ষুনি তার ফোন বেজে উঠে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা ছিল ফোন। সেখান থেকে ফোনটা নিয়ে পুনরায় বেলকনিতে চলে আসে। ওর ফ্রেন্ড নাঈমা ফোন করেছে। সে একজন ডাক্তার। আগুনের কলেজের পাশাপাশিই একটা হসপিটাল রয়েছে। সেখানকার একজন সিনিয়র ডাক্তার সে। এতো সকালে ফোন করেছে! ভ্রু কুঁচকে ফেলে আগুন। রিসিভ করে ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে নাঈমা বলে উঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” হাই হ্যান্ডসাম বয়। কি খবর তোর? কেমন আছিস? নিজে থেকে ফোন করে তো একটু খোঁজও নিস না। ভুলে গিয়েছিস? ”
আগুন বিরক্ত হলো। এইসব কথা বলার জন্য এই মেয়ে এত সকালে ফোন করেছে? নাঈমাকে আগুনের তেমন পছন্দ না। কলেজ লাইফ থেকেই ওর পিছে পড়েছে সে। আগুন জানে নাঈমা তাকে পছন্দ করে। একবার প্রপোজও করেছিল। আগুন না করে দিয়েছে। সে তাকে ফ্রেন্ড ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না। আগুনের থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে নাঈমা পুনরায় বলল,
” হ্যালো আগুন! শুনতে পাচ্ছিস? ”
” হ্যাঁ বল। শুনছি। এই সময় ফোন করার কারনটা ঠিক বুঝলাম না। ”
” কোনো কারণ নেই। কথা বলতে মন চেয়েছে তাই ফোন করেছি। কেন? কোনো সমস্যা? এমন তো নয় যে, ঘরে তোর বউ আছে বেটাইমে ফোন করলে সে রাগ করবে। ”
নাঈমার কথায় আগুন কিছুটা থমথমে খায়। ওকে এখন কিছু বলা যাবে না। জানতে পারলে সিনক্রিয়েট করতে পারে। মোটকথা কাউকেই কিছু বলা যাবে না। কলেজে বিষয়টা জানাজানি হলে আগুনকে অনেক হ্যানস্তা হতে হবে। কলিগ, সিনিয়র টিচার্স’রা মজা নিবে। মান-সম্মানের দফারফা হয়ে যাবে। আর স্টুডেন্টরা জানলে তো কোনো কথাই নেই। সঠিক সময় আসুক তখন না হয় সবাইকে জানানো যাবে। তপ্ত শ্বাস নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” তেমন কিছু না। বউ না থাকলেই যে যখন তখন ফোন করা যাবে এমনটা ভাবা ভুল। এখন আর ছোট নেই তুই। একটু ম্যানার্স শিখিস। কোন কাজে দরকার ছাড়া অ’টাইমে ফোন করাটা আমি ভালো চোখে দেখি না। আসা করি এরপর থেকে বিষয়টা খেয়াল রাখবি। ”
কথা শেষ করেই কল কে’টে দিয়েছে আগুন। নাঈমার এরকম হুটহাট ফোন করায় চরম বিরক্ত হয় আগুন। আগে রাতে দুটো-তিনটের দিকেও ফোন করতো। ইদানীং টাইম মানে না। যখন তখন ফোন করে বসে। কিছুদিন আগেও ফোন করেছিল এমন সময় যখন সে স্টুডেন্টস’দের ক্লাস করাচ্ছিল। আগুনের ইচ্ছে করছিল নাঈমার কানের নিচে ঠাটিয়ে এক থা*প্পর দিতে। বিরক্ত হয়ে নাম্বার ব্লক লিস্টে রেখেছিল। পরে নাঈমা ক্ষমা চেয়েছিল। কান্নাকা’টি করে ব্লক থেকে নাম্বার উঠাতে বলেছিল। আগুন তার কথা শুনেছিল। আর সাবধানও করেছিল নেক্স টাইম যেন খেয়াল থাকে।
আকাশের ঘন কালো মেঘের মতো আবছা অন্ধকার সরে গিয়ে সূর্য উঁকি দিয়েছে। ধরণীর বুকে তার দীপ্তি ছড়াচ্ছে। লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বেলকনি থেকে রুমে আসে আগুন। এসে দেখে বিছানা শূন্য। মোম নেই। হয়তো ওঠে পড়েছে। বাছানাটা পরিপার্টি করে গোছানো। নিশ্চই মোম করেছে। খট করে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ পেতেই পেছন ফিরে তাকায়। মোম দাঁড়িয়ে আছে। আজকেও সুতির শাড়ি পড়েছে। তবে তার শাড়ি পড়া ঠিকঠাক ভাবে হয় নি। এটাকে শাড়ি পড়া বলে না। কোনো রকম গায়ের সাথে সাপের মতো প্যাঁচিয়ে রেখেছে যেন। আগুন মোমের সামনে এসে দাঁড়ায়। এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” এভাবে শাড়ি পড়েছ কেন? যখন তখন আঁচলে পা বেজে পড়ে যেতে পারো। বিয়ের সময় কি শাড়ি ছাড়া অন্য কোনো ড্রেস দেয় নি আমাদের বাড়ি থেকে? কালকে তো দেখলাম ঠিকঠাক ভাবেই শাড়ি পড়েছিলে। এখন এভাবে পড়েছো কেন? ”
আগুনের কথায় মোম কিছুটা লজ্জা পায়। আমতা আমতা করে ধীর কন্ঠে বলল,
” জ্বি দিয়েছে। আসলে কালকে আপনার বোন শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছিল। আমি শাড়ি পড়তে পারি না। কখনো পড়িনি। আর শাড়ি না পড়ে অন্য কোনো ড্রেস পড়লে কেউ যদি কিছু বলে সেজন্য শাড়িই পড়েছি। গ্রামে থাকতে আমার কাকী বলেছিলেন বিয়ের পর মেয়েদের শাড়ি পড়তে হয়। ”
” কে তোমাকে কি বলবে? সবার পরিবারের মতো আমাদের পরিবার না। তুমি যেই ড্রেসে কামফর্ট্যাবল ফিল কর সেটাই পড়তে পারো। কেউ কিছু বলবে না। ”
মোম মাথা নেড়ে লাগেজ থেকে মিষ্টি রঙের একটা থ্রি-পিছ নিয়ে পুনরায় ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। আগুন নিচে চলে আসে ব্রেকফাস্ট করার জন্য। নয়তো কলেজে যেতে লেট হয়ে যাবে। রাশেদ ড্রয়িং রুমে বসে পত্রিকা পড়ছেন আর খাতায় কিছু একটা লিখছেন। ময়ূূরী মায়ের হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে। আয়মান এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। ডাইনিং টেবিলে না বসে আগুন বাবার পাশে গিয়ে বসলো। ললাটে ভাজ ফেলে রাশেদকে বলল,
” এত মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছো? ”
রাশেদ চোখের চশমাটা ঠিক করে পত্রিকাতে নজর রেখেই বললেন,
” দেশের অবস্থা দিন কে দিন খারাপ হচ্ছে বুঝলে? এখন মানুষ স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে। সামান্য জমির জন্যও আপন ভাইকেও খু*ন করতে দু’বার ভাবে না। এই তো গত কালকেই এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। সেটাই মন দিয়ে পড়ছিলাম। এভাবে চলতে থাকলে দেশের যে কি হবে সেটারই হিসাব করছিলাম। ”
একথার প্রেক্ষিতে আগুন কিছু বললো না। কিছু বললেই বাবার লম্বা ভাসন শুরু করে দিবেন। এখন ভাষন শোনার বিন্দু মাত্র ইন্ট্রেস্ট তার নেই। মিনা খেতে আসার জন্য ডাক দিলেন। আগুন, ময়ূরী’কে ডেকে বলল,
” নাস্তাটা এখানেই নিয়ে আয়। আজকে কলেজে যেতে হবে। ”
পাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে রাশেদ বললেন,
” নতুন বিয়ে করেছো। কটা দিন বাড়িতেই থাকো। কলেজে যাওয়ার দরকার নেই। ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে তাকায় বাবার দিকে। রাশভারী কন্ঠে বলল,
” বিয়ে করেছি বলে কি কলেজে যেতে পারবো না? ছুটি ছাড়া এমনিতেই একদিন প্রেজেন্ট ছিলাম না। আবার আজকেও যাবো না বিষয়টা খারাপ দেখায়। তাছাড়া এভাবে হুট করে বিয়ে করে ফেলেছি সেটা তো কেউ জানে না। আমি চাইও না এখন কেউ জানুক। বাঁধা দিও না আমার কাজে। তোমার কথা মতো তো বিয়েটা করেছি। ”
রাশেদ ক্ষেপা স্বরে বললেন,
” বিয়েটা করে আমাকে উদ্ধার করে দিয়েছো। তোমাকে এখন সালাম করা দরকার। কি বলো? ”
আগুন বিরক্ত হয়। ইচ্ছে করছে খাবার ছেড়ে উঠে যেতে। মা কষ্ট পাবে। তাই যেতে পারছে না। মিনা ছেলের পাশে বসেন। বাটিতে আরেকটু আলু ভাজি তুলে দেন। ছেলের দিকে চেয়ে নরম কন্ঠে বললেন,
” কলেজে যাবি যা। তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস কেমন? বুঝতেই তো পারছিস মেয়েটা ছোট। অনেকটা অবুঝ। হাজার আমরা পাশে থাকি। স্বামীর সঙ্গটাই বড় সঙ্গ। ”
আগুন কিছু বললো না। চুপ করে খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। মিনা পুনরায় বললেন,
” হে’রে মোম কি উঠেছে? মেয়েটার কোনো কিছুর দরকার পড়তে পারে। নতুন তো লজ্জায় হয়তো বলতে পারবে না। তুই গিয়ে দেখ একটু। ”
মায়ের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” ওঠেছে। তোমরা গিয়ে দেখো। বললাম না আমাকে কলেজে যেতে হবে। ”
ছেলের কথায় মিনার মুখটা থমথমে হয়ে গিয়েছে। আমতা আমতা করে বললেন,
” বলছিলাম কি, তুই হয়তো কয়েক দিনের মধ্যেই তোর ফ্ল্যাটে চলে যাবি। মোম…”
মিনার কথা কেড়ে নিয়ে আগুন শান্ত কন্ঠে বলল,
” কয়দিন পর নয় মা। আমি কালকেই সেখানে চলে যাবো। আয়মানেরও তো ভার্সিটি খোলা। ওকে জানিয়ে দিও। আমরা কালকে ফ্ল্যাটে ফিরে যাবো। ”
” সেকি! কালকেই চলে যাবি? বউমাকে নিয়ে যাবি না? ”
” এতটা জার্নি করে বাসা থেকে রোজ রোজ কলেজে যেতে কষ্ট হয়। আয়মানেরও সমস্যা হয়। সেজন্যই তো কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি। আর মোম কে নিবো মানে? ও সেখানে গিয়ে কি করবে? আয়মান আছে সাথে। মোমকে নিয়ে যেতে পারবো না। ও এখানেই থাকবে। ”
” দরকার হলে আয়মান ওখান থেকে বাড়িতে চলে
আসবে। তবুও মোম কে নিয়ে যা। এমনিতেও আয়মান সপ্তাহে এক-দুইদিন যায় ভার্সিটিতে। আমি ওকে বলে দিবো। সেখান থেকে ওর যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে এখানে চলে আসতে। তাহলে তোদের কোনো সমস্যা হবে না। ”
” কোনো দরকার নেই। আমি যেটা বলছি সেটাই হবে। মোম এ বাড়িতেই থাকবে তোমাদের সাথে। ”
রাশেদ খুবই মনোযেগ সহকারে পত্রিকা পড়ছিলেন। ছেলে এবং স্ত্রীর বলা কথা গুলোও আমলে নিয়েছেন। আগুনের কথায় তার মুখোভঙ্গি বদলে যায়। ছেলেটা একটু বেশিই ত্যাড়া। তবে তিনিও কম না। পত্রিকা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছেলের দিকে তাকান। গলার আওয়াজ যথাসাধ্য গম্ভীর রেখে বললেন,
” মোম তোমার বিয়ে করা বউ। তুমি যেখানে থাকবে তোমার স্ত্রীও সেখানেই থাকবে। কালকে বিয়ে করেই আজকে বলছে আলাদা থাকবে। সেটা হবে না। ”
আগুন অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়। ভীষন রাগ হচ্ছে তার। নিজেকে সামলে শান্ত কন্ঠে বলল,
” আলাদা থাকবো সেটা কখন বললাম? বলেছি আমার কলেজ যাতায়াতের সুবিধায় ফ্ল্যাটে ব্যাক করবো। আমি কলেজে চলে গেলে মোম সারাদিন বাসায় একা থাকবে। তার থেকে বরং তোমাদের সাথে থাকাই ভালো। ”
রাশেদ তবুও মানতে নারাজ। নিজের কথায় ওঠেল থেকে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
” তোমার এত ভালো বুঝতে হবে না। কালকে আয়মান গিয়ে সেখান থেকে তার ব্যবহৃত সকল জিনিস নিয়ে আসবে। তুমি মোম কে নিয়ে যাবে। ও তোমার সাথেই থাকবে। এটাই ফাইনাল।”
ক্রোধ নিয়ে চিৎকার করে আগুন বলল,
” ঠিক আছে। মেনে নিলাম তোমার কথা। আমি যেখানেই থাকবো মোমও আমার সাথেই থাকবে। নিয়ে যাবো মোম’কে। সবকিছু তো জোড় করে চাপিয়ে দিচ্ছ আমার উপর। প্রথমে নিজের থেকে চৌদ্দ বছরের ছোট বাচ্চা একটা মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছো। এক প্রকার বাধ্য করেছো বিয়েটা করতে। এখনো নিজেদের যা খুশি সিদ্ধান্ত আমার চাপিয়ে দিচ্ছ। ”
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২
আগুন আর কথা বাড়ালো না। গটগট পায়ে রুমের দিকে অগ্রসর হলো। রেডি হয়ে এখন কলেজে চলে যাবে। ছেলের চিৎকারে রাশেদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সবসময় ছেলের জেদ’কে পাত্তা দিলে আজকে তার লক্ষীমন্ত বউটা তাদের বাড়িতে থাকতো না। হুট করেই বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। কাছাকাছি থেকে একে অপরের প্রতি অনুভুতি জন্মানোটা খুবই প্রয়োজন। দুজন এক সঙ্গে না থাকলে মনের মিল হবে কি করে?