শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১৩
সুমাইয়া সুলতানা
আগুন ঠিক করেছিল আজকে কলেজে যাবে না। মোমের হাত পুড়ে গিয়েছে। তাকে একা বাসায় রেখে কলেজে যাওয়াটা উচিত হবে না। মেয়েটার কোনো কিছুর প্রয়োজন হতে পারে। আগুন কলেজে চলে গেলে, কোনো সাহায্যের দরকার হলে তখন কাকে বলবে? কিন্তু আজকে স্টুডেন্ট’দের সাপ্তাহিক পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। না গেলে কথার খেলাফত হবে। আবার মোম’কে একা রেখেও যেতে পারছে না। কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না। তখন কলেজের একজন দপ্তরি’কে ফোন করে বলল, রুটিনে আজকে প্রথম ক্লাস কার সেটা দেখে যেন আগুন কে জানায়।
আগুনের ক্লাস দুপর বারো-টার দিকে। দপ্তরি জানালেন প্রথম ক্লাস রাফি স্যারের। আগুন রাফি’কে কল করে বলেছিল, আজকে তার প্রথম ক্লাসে আগুন ক্লাস করাবে। আর রাফি যেন, আগুনের ক্লাস টাইমে তার ক্লাসটা নিয়ে নেয়। আগুন জানিয়েছে, ওর কিছু জরুরী কাজ আছে। সেজন্য ক্লাস টাইম বদলাতে হচ্ছে। রাফি কোনো দ্বিমত করেনি। রাজি হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর, আগুন কলেজে গিয়ে প্রথম ক্লাসের ঘন্টায় সাপ্তাহিক পরীক্ষাটা নিয়ে দ্রুত বাসায় চলে আসে। আগুনের ভয় হচ্ছিল। দেরি হলে মোম যদি একা হাতে দুপুরের জন্য রান্না করতে লেগে যায়! তখন কাঁচা ঘা’য়ে পুনরায় ব্যথা পেয়ে আবার না কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। মোম বারবার বলে দিয়েছে সে বাইরের খাবার খাবে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাসায়’ই রান্না করবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব বাসায় চলে এসেছে। মোম রান্না করছে আর তার পাশে আগুন দাঁড়িয়ে আছে। মোম’কে রান্না করতে অনেকটাই হেল্প করেছে সে। মোমে ঘেমে গিয়েছে। একে তো গরম, তারউপর রান্নাঘরে আগুনের তাপ। রান্নাঘরের ছোট্ট জানালাটা দিয়ে সরু রেখার মতো সূর্যের কিরণ ভেতরে আসছে। আর সেই কিরণ মোমের উপর এসে পড়ছে। মোমের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা সূর্যের আলোর জন্য চিকচিক করছে।
আগুন, মোমের সাথে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে মোমের নাকে থাকা ঘাম টুকু বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছে দেয়। মোম হকচকিয়ে যায়। অবাক হয়ে তাকায় আগুনের দিকে। কিছু না বলে পুনরায় রান্না করায় মন দেয়। আগুনের সে দিকে কোনো খেয়াল নেই। তার নজর মোমের ঘেমে যাওয়া গলার ভাঁজে। পরপর’ই বেহায়া চোখ দু’টোর নজর পড়ে মোমের মসৃন কোমরে। সেথায় মোমের ওড়না প্যাঁচানো। ঘেমে যাওয়ায় গায়ের জামা ভিজে বেশ কিছুু জায়গায় লেপ্টে আছে। দেখতে ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে। আগুন নেশাক্ত চোখে তাকিয়ে আছে পিচ্চি বউয়ের দিকে। হাত বাড়িয়ে কোমর স্পর্শ করতে উদ্ধত হতেই মোম বলল,
” রান্না তো প্রায় হয়ে এসেছে। বাকিটা আমি সামলে নিতে পারবো। আপনি বরং রুমে গিয়ে গোসলটা করে নিন। সেই রান্নার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘেমে কি হয়েছেন, দেখেছেন? ”
মোমের কথায় আগুনের হুশ ফিরলো। বাড়িয়ে রাখা হাত গুটিয়ে নিলো সহসা। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” প্রয়োজন শেষ, তো এখন দূরে সরিয়ে দিচ্ছো? ”
মোম, আগুনের কঠিন ভাষা বুঝতে অক্ষম। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
” কি বলছেন এসব আপনি? ”
আগুন থমথমে খেয়ে যায়। কন্ঠে যথাসাধ্য গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলল,
” না মানে, তোমাকে এতটা হেল্প করেছি, আর তুমি আমাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলে না। এটা কি ঠিক? ”
” হেল্প করেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ দিতে হবে? ”
” কেন, তুমি জানো না? কাউকে হেল্প করলে তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। ”
” জ্বি, জানি। তবে আপনার হেল্প করাটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো। ধন্যবাদ তো অপরিচিত কেউ হেল্প করলে তাকে দিতে হয়। কাছের মানুষদের ধন্যবাদ দিতে হয়, সেটা জানতাম না। ”
আগুন নিরেট স্বরে বলল,
” আমি তোমার কাছের মানুষ? ”
মোম কোনো ভনিতা ছাড়াই সরল মনে বলল,
” জ্বি। ”
” তাহলে এখনো কেন দিলে না? ”
” কি দেইনি আপনাকে? ”
” আমি যেটা পাওয়ার যোগ্য। ”
” কিসের কথা বলছেন আপনি? ”
আগুন বিরক্ত হলো। এখন বিরক্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবুও সে বিরক্ত। আগুন চোখ বুঝে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে মোমের ঠোঁটের দিকে চেয়ে মহোনীয় কন্ঠে বলল,
” ধন্যবাদ না দিলে অন্য কিছু দাও। ”
” কি দিবো? ”
আগুন তিরিক্ষী মেজাজ নিয়ে বলল,
” দিতে হবে না। সময় হলে আমি নিজেই নিয়ে নিবো। আমার জিনিস নিয়ে আমি বড্ড সিরিয়াস। এতটুকুও কোনো ছাড় দেই না। মাইন্ড ইট। ”
কথাটা বলেই ত্রস্ত পায়ে রান্নাঘর ত্যাগ করলো। মোম বোকার মতো দাঁড়িয়ে, আগুন হুটহাট মেজাজ কেন দেখালো? সেটা নিয়ে ভাবছে।
দুপুরের খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আগুন, মোম। তক্ষুনি দরজায় কলিং বেল বেজে উঠে। আগুন গিয়ে দরজা খুলে দেয়। নাঈমা দাঁড়িয়ে আছে। অধর কোণে তার মিটিমিটি হাসি। নাঈমা’কে দেখে আগুন চমকে যায়। এই সময় নাঈমার আগমন সে মোটেই আশা করেনি। ঠাস করে নাঈমার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেয়। সহসা নাঈমার মুখের হাসিটা মুছে যায়। মুখে নেমে আসে অমাবস্যা রাতের মতো অন্ধকার। এটা কি হলো? আগুন এভাবে দরজা কেন বন্ধ করে দিলো? নাঈমা সাইড ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে আগুনের ফোন নাম্বারে কল করলো। রিং হচ্ছে অথচ কল রিসিভ হচ্ছে না। নাঈমা থেমে নেই। একের পর এক কল করেই যাচ্ছে। আগুন হন্তদন্ত হয়ে ডাইনিং রুমে এসে মোমের হাত ধরে টেনে বেডরুমে নিয়ে আসে। আগুনের এমন আচরণ মোমের মাথায় ঢুকলো না। মোম’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আগুন বলল,
” কিছুক্ষণ এই রুমেই চুপ করে বসে থাকবে। রুম থেকে বের হবে না। আমি বললে তবেই রুম থেকে বাইরে আসবে। ”
মোম মেনে নিলো আগুনের কথা। মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলো। আগুন, মোম’কে রুমে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। চটজলদি এগিয়ে গিয়ে মেইন দরজা খুলে নাঈমাকে ভেতরে আসতে বলে। আগুন ভেবে পায় না, একটা মানুষ ঠিক কতটা নির্লজ্জ হলে এতক্ষণ দরজা বন্ধ থাকা সত্বেও চলে না গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে! নাঈমা ভেতরে এসে মৃদু রেগে বলল,
” তখন ওই ভাবে দরজা কেন বন্ধ করে দিয়েছিলি? আর এখন কেন দরজা খুলেছিস? কি লুকাচ্ছিস আমার থেকে, বল? ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
” তার আগে বল, তুই এই সময় আমার বাসায় কি করছিস? ”
” আজব! তোর বাসায় আসতে আমাকে আবার সময় দেখতে হবে নাকি? ”
” অবশ্যই হবে। মানুষের পার্সোনাল প্রাইভেসি বলেও একটা কথা আছে। কোনো কিছু না জানিয়ে এভাবে একা একজন মেয়ে হয়ে কারো বাসায় আসা উচিত না। বিষয়টা তো তখন আরো সিরিয়াস, যখন সেখানে শুধু ছেলে থাকে। ”
নাঈমা ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
” আমি এতকিছু ভাবি না। আর না কোনো কিছু ভাবতে চাচ্ছি। এখন বল, দরজা কেন বন্ধ করেছিলি? ”
আগুন রাশভারী কন্ঠে জবাব দিলো,
” সেটা বলার তোকে কোনো প্রয়োজন মনে করছি না। তুই কিভাবে জানলি? আমি এখন বাসায় আছি। তোর কিছু বলার থাকলে বল। তারপর চলে যা। ”
” আমি তোর কলেজে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই জানতে পারি তুই আরো অনেক আগে বাসায় চলে এসেছিস। ভাবলাম তোর শরীর খারাপ হলো কি না। সেজন্য দেখতে এসেছিলাম। আর তুই আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস? ”
” হ্যাঁ, দিচ্ছি। তোকে না বলেছি হুটহাট আমার কলেজে চলে যাবি না। তবুও কেন গিয়েছিস? ”
” আমার তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। সেজন্য গিয়েছিলাম। ”
” দেখা শেষ? তাহলে এখন চলে যা। ”
” এভাবে বলছিস কেন? লাঞ্চ না করাস, এটলিস্ট এক কাপ কফি তো খাওয়াতে পারিস। ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে নাঈমার দিকে তাকিয়ে আছে। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,
” এই ভর-দুপুরে কেউ কফি খায়? আচ্ছা, বোস। আমি বানিয়ে আনছি। ”
” আমিও আসি তোর সাথে? ”
” নো নিড। ”
” ওকে। ”
নাঈমা ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পরে। পেছন থেকে আগুনকে ডেকে বলল,
” তোর জন্যেও এক কাপ আনিস। একা খেতে ভালো লাগবে না। ”
আগুন কফি বানাচ্ছে। রাগ যেন তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। চেয়েও কিছু বলতে পারছে না। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। নাঈমার মনে সন্দেহের বীজ বপন শুরু হয়ে গিয়েছে। আজকে আগুনের আচরণ ওর কাছে স্বাভাবিক লাগছে না। এর আগে অনেক বার আগুনের ফ্ল্যাটে এসেছিল দেখা করার জন্য। তখন তো এই ভাবে রিয়্যাক্ট করেনি। তাহলে, আজকে এমন ব্যবহারের কারণ কি? বাসায় কি এমন কিছু আছে, যেটা আগুন তাকে দেখাতে চাচ্ছে না?
থাকলে সেটা কি হতে পারে? নাঈমা চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অবলোকন করছে। আগুনের রুমের দিকে দৃষ্টি পড়তেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। আগুন বাসায় একা থাকে। বাইরে থেকে বেডরুমের দরজা আটকানো কেন? রুমে কি আছে? কিছুই বোধগম্য হলো না। আগুন কফি নিয়ে এসে নাঈমাকে দিলো। নাঈমা কফিটা নেওয়ার সময় ইচ্ছে করে আগুনের হাতের আঙুল স্পর্শ করে কফির মগটা হাতে তুলে নেয়। আগুনের কাছে এটা স্বাভাবিক। কফি নেওয়ার সময় হাতে টাচ লাগতেই পারে। তবে সে তো আর জানে না, নাঈমা এটা ইচ্ছে করে করেছে। নাঈমা কফির মগে এক চুমুক দিয়ে বলল,
” আমার জন্য কফি আনলি। তোর জন্য আনিসনি কেন? ”
” তোর খেতে ইচ্ছে করছে তুই খাঁ। আমি এ সময় কফি খাই না। ”
” দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বোস। ”
আগুন, নাঈমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসলো। বিষয়টা নাঈমার মোটেও ভালো লাগলো না। কিছুটা ঝাঁঝ নিয়ে বলল,
” এভাবে দূরে বসার কি আছে? আমার সাথে ঘেঁষে বসলে কি তোর গায়ে ফোসকা পড়ে যাবে? ”
আগুনের ভীষণ মেজাজ খারাপ লাগছে। রাগ হচ্ছে নাঈমার উপর। ইচ্ছে করছে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিতে। নাঈমার খোঁচা মারা কথা ঠিক হজম হচ্ছে না। কিন্তু ও এখন রাগ দেখাতে চাচ্ছে না। মোম বাসায় আছে। সিনক্রিয়েট করাটা ঠিক হবে না। চাপা স্বরে ধমকে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” মুখ সামলে কথা বল। ঘেঁষা ঘেঁষি করা তোর স্বভাব, আমার না। সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস। কফি খাওয়া শেষ? এখন তুই আসতে পারিস। ”
” আর একটু থাকি। তুই কি লাঞ্চ করেছিস? না করলে চল, এক সাথে লাঞ্চ করে আসি। ”
আগুনের কন্ঠ ফুঁড়ে এবার রাগটা বেরিয়েই আসলো। মৃদু চিৎকার করে বলল,
” আমি জাস্ট বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি, নাঈমা। তোর আগমনে আমি সত্যিই বিরক্ত। আর জ্বালাস না। আমার মাথাটা খুব ধরেছে। রেস্ট নিবো। প্লিজ, নাও ইউ ক্যান লিভ। ”
নাঈমা খেয়াল করলো, আগুন রেগে যাচ্ছে। তাই আর বেশি ঘাটলো না। ভেবেছিল বেডরুম কেন বাইরে থেকে লক করে রেখেছে জিজ্ঞাসা করবে। সাথে এটাও জেনে নিবে ওই রুমে কি আছে? কিন্তু আগুনের রেগে যাওয়া দেখে কথা গুলো গিলে নিলো। শুষ্ক ঢোক গিলে মেকি হেসে বলল,
” ওকে, রিলাক্স। ডোন্ট বি এক্সাইটেড। আমি চলে যাচ্ছি। তুই শান্ত হ। ”
নাঈমা চলে গেলে আগুন রুমে গিয়ে মোম’কে ডেকে নিয়ে আসে। মেয়েটার নিশ্চই খিদে পেয়েছে? আগুন আসতেই মোম মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো,
” কে এসেছিল, বাসায়? আপনার পরিচিত কেউ? ”
” হ্যাঁ। এখন, খেতে চলো। ”
” মেয়েটা কে ছিলো? ”
আগুন চমকে উঠে। অবাক হয়ে মোমের দিকে তাকায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
” তুমি কিভাবে বুঝলে সে মেয়ে ছিল? ”
” মেয়েটা যখন কথা বলছিল, তখন তার কন্ঠস্বর শুনে বুঝতে পেরেছিলাম। ”
” বাহ! আমার বউ তাহলে শুধু ভীতু নয়, বুদ্ধীমতিও। যাক ভালোই হয়েছে, একটু আধটু বুদ্ধী না থাকলে আবার চলবে কি করে? ”
” বললেন না তো, মেয়েটি কে? আপনার কি হয়? ”
” নাঈমা আমার ফ্রেন্ড। স্কুল, কলেজে এক সাথে পড়াশুনা করেছি। ক্লাসমেইট ছিল। ইন্টার শেষে সে মেডিকেলে ভর্তি হয়। পেশায় সে একজন ডক্টর। ”
” ওহ! ”
” খাবে না? জলদি চলো। ক্ষুধা পেয়েছে তো। ”
” হুম, চলুন। ”
আগুন হাত ধরে মোম’কে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। চেয়ার টেনে মোম’কে বসিয়ে দেয়। নিজেও পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। প্লেটে ভাত, তরকারি আগুন বেরে দিলো। আগুন খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। মোম হাতে খেতে পারছে না। কিভাবে খাবে? সকালেই তো হাত পুড়লো। হাতে জ্বালা না করলেও ব্যথা আছে। হাতের তালুতে ফোসকা না পড়লেও কবজিতে দুইটা ছোট ছোট ফোসকা পড়ে গিয়েছে। মোম বাম হাতের সাহায্যে চামচ দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে। তবে ঠিক মতো খেতে পারছে না। এক পর্যায়ে হাত ফোসকে চামচ’টা ফ্লোরে পড়ে গেল। সাথে সাথে’ই টুংটাং শব্দের মৃদু আওয়াজ শোনা গেল। আগুন চকিতে তাকালো। সে ভুলেই গিয়েছিল মোমের হাত পুড়েছে। মোম নিচু হয় ফ্লোর থেকে চামচ উঠাতে। আগুন বাঁধা দেয়। মোম প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। আগুন চামচ’টা উঠিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখে। ধমকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” হাত দিয়ে খেতে পারছো না, বলোনি কেন? কাজের সময় কথা বলো না। অন্য সময় তোতাপাখির মতো বুলি আওড়াও। ”
মোম মাথা নিচু করে নিলো। কিছু বললো না। ইতোমধ্যে তার চোখে পানি চলে এসেছে। এভাবে ধমক দেওয়ার কি আছে? সুন্দর ভাবেও তো বলা যায়। আগুন কি জানতো না, মোমর হাতে ব্যথা? তাহলে কেন ধমকাচ্ছে? মোম গাল ফুলিয়ে বসে রইল। আগুন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মোমের সামনে থেকে ভাতের প্লেট সরিয়ে নেয়। আগুনের প্লেটে অর্ধেক খাওয়া এঁটো ভাতের সাথে মোমের প্লেটের ভাত, তরকারি ঢেলে নিলো। নিজ হাতে ভাত মেখে মোমের মুখের সামনে ধরলো। শান্ত কন্ঠে বলল,
” মাথা তুলো মোম। ”
মোম মাথা তুলে তাকাল আগুনের দিকে। অমনি টুপ করে এক ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল তার মসৃন গাল বেয়ে। আগুন বুঝতে পারলো মোমের চোখের জলের কারণ। বাম হাতের সাহায্যে মোমের চোখের পানি মুছে দিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
” প্লিজ, কেঁদো না। ভাত খাওয়ার সময় কান্না করতে নেই। আচ্ছা, আর ধমক দিবো না। আসলে, মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না। সরি, মুখ খুলো। তোমাকে কষ্ট করে নিজের হাতে খেতে হবে না। আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি। ”
আগুন পুনরায় বলতেই মোম এক লোকমা ভাত মুখে পুড়ে নিলো। আগুন যত্ন নিয়ে মোম’কে খাইয়ে দিচ্ছে। সাথে নিজেও খাচ্ছে। খাওয়া শেষে মোম’কে রুমে যেতে বলে, সবকিছু নিজে গুছিয়ে রাখলো। এঁটো প্লেট গুলোও নিজেই ধুয়ে নিলো। মোম নিষেধ করেছিল। তবে আগুন শোনেনি। ধমকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখে মোম রান্নাঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আগুন টাউজারের পকেটে হাত গুজে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নিজের ফর্মে ফিরে এসে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমাকে না রুমে যেতে বলেছি? একদিন না বলেছিলাম কথার অবাধ্যতা আমি পছন্দ করি না। ”
মোম ঠোঁট উল্টে মিনমিন করে বলল,
” রুমে একা ভালো লাগছিলো না। ”
” আমার সাথে থাকতে ভালো লাগে? ”
মোম সরল মনে উত্তর দিলো,
” হ্যাঁ। ”
” আমি রেগে কথা বলি, তাতেও ভালো লাগে? ”
” হ্যাঁ। ”
” আমি ধমক দিলে, সেটাও ভালো লাগে? ”
” হ্যাঁ। ”
” আমার আর কি কি ভালো লাগে? ”
” আপনার হালকা ছাটাই করা চাপ দাঁড়ি, আর বুক। ”
কথাটা বলেই সহসা জিভ কাটলো। চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। ছিঃ! বলতে বলতে বেশিই বলে ফেলেছে। এখন লজ্জা লাগছে। আগুন ঠিকি বলে, কাজের সময় কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে না অথচ অন্য সময় মুখে খই ফুটে যেন। মোমের অবস্থা দেখে আগুন ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসে। একটু ঝুকে মোমের চোখে ফুঁ দেয়। মোমের শরীর মৃদু কেঁপে উঠে। ফট করে চোখ খুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আগুনের চোখের দিকে। তবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। নজর নামিয়ে নেয়। আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। এক ছুটে বেডরুমে চলে যায়। মোমের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, আগুন। মোমের পায়ের নুপুরের রিনঝিন শব্দে বুকের ভেতর এক পসলা বৃষ্টির ন্যায় ছুঁয়ে গেল। বুকের বাম পাশে হাত রেখে আগুন বলে উঠলো,
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ১২
❝ ভালোবাসার সবটুকু রং ছড়িয়ে দিলাম একসাথে, তুমি রাঙিয়ে নিও তোমার মনে। অবুঝ এ মনের স্বপ্নগুলো উড়িয়ে দিলাম বাতাসে, তুমি সাজিয়ে নিও তোমার জীবনে। ❞