শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২২

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২২
সুমাইয়া সুলতানা

বিকেলের মধ্যভাগ শেষে সময়টা প্রায় সন্ধ্যার কাছাকাছি। তবুও জেদি সূর্য তার দাপট দেখাতে ভুলছে না। ভ্যাঁপসা গরমে অতিষ্ঠ করে তুলেছে ধরণী। নেই কোনো হিমশীতল বাতাস। থেমে থেমে ধুলোবালি নিজ চিত্তে উড়ে বেড়াচ্ছে। সেই সাথে সিএনজি গাড়ি গুলোর বিষাক্ত কার্বনডাইঅক্সাইড পরিবেশকে করে তুলেছে আরও অসহনীয়। এইরকম পরিবেশে কতশত মানুষের ব্যস্ততা। গাড়িতে বসে বসে মোমের কোমর ব্যথা হয়ে গিয়েছে।

শপিং শেষ করে ফিরে আসার পথে রাস্তায় জ্যামে আটকা পড়েছে তারা। সাথে আছে আয়মান, ময়ূরী আর তাদের পরিচিত এক ড্রাইভার। এই ড্রাইভার পারমানেন্ট না। ভাড়া করা। কারণ, গাড়িটা আগুনের। আগুনের গাড়ির জন্য আলাদা কোনো ড্রাইভার নেই। সে নিজের গাড়ি নিজেই চালায়। আয়মানও গাড়ি চালাতে পারে। কিন্তু ও অসুস্থ বলে আগুন ড্রাইভিং করতে নিষেধ করেছে। ভাড়া করে একজন পরিচিত ড্রাইভার ঠিক করে দিয়েছে ওদের জন্য। আয়মান সামনের সিটে বসেছে। পেছনে মোম’কে সাথে নিয়ে ময়ূরী বসেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ময়ূরী সিটে মাথা হেলিয়ে ঝিমাচ্ছে। এসি-যুক্ত বিলাসবহুল গাড়ি বলে বাইরের আবহাওয়া উপলব্ধি করতে পারছে না। নয়তো বুঝতে পারতো খেটে খাওয়া মানুষদের কত কষ্ট! বুঝতে পারতো তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন গুলোর পিছনে কত পরিশ্রম লুকিয়ে আছে।
অবশেষে জ্যাম কাটিয়ে আগুনের ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল তারা। আয়মান ড্রাইভারের সাহায্যে শপিং করে আনা জিনিসপত্র গুলো বাসায় নিয়ে আসলো। দরজায় কলিং বেল চাপ দিতেই কেউ একজন দরজা খুলে দিল। মোম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি’কে দেখে চমকে উঠল। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিয়ৎকাল। পরমুহূর্তেই ঝড়ের গতিতে হামলে পড়ল তার বুকে। মৃদু আওয়াজে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ক্ষীণ স্বরে ডেকে ওঠে,

” মা! ”
মোমের মা আতিফা বানু মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেন। মোম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মেয়েকে বুক থেকে তুলে পরম আদরে কপালে চুমু এঁকে দিলেন। চোখের পানি মুছে দিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
” কেমন আছিস মা? ”
মোম আবারও মায়ের বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কাঁদো কাঁদো গলায় জবাব দিল,
” ভালো। তুমি কেমন আছো? তোমার কথা অনেক মনে পড়তো মা। ”
” ভালো আছি রে। আর কাঁদিস না। ভেতরে আয়। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি? সব কথা দরজার সামনে দাঁড়িয়েই বলে ফেলবি? তোর শ্বশুর বাড়ির মানুষ দুজন তো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে খেয়াল আছে?
মোমের হুঁশ ফিরল। কিঞ্চিৎ হেসে নিজের মাথায় আলতো চাপড় মেরে জানায়,

” একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ”
আয়মান, ময়ূরীর দিকে তাকিয়ে আতিফা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
” উনি আয়মান ভাইয়া। সম্পর্কে আমার দেবর হয়। আর ময়ূরী আপুকে তো চিনই। ”
আয়মান, ময়ূরী, আতিফা বানুকে সালাম দিয়ে ওনার সাথে কুশল বিনিময় করল। শপিংয়ের জিনিসপত্র গুলো ভেতরে এনে দরজা বন্ধ করে দিল। শপিং গুলো ড্রয়িংরুমে নিয়ে রাখল। ড্রয়িংরুমে এসে মোম দেখতে পেলো ওর বাবা এবং বোন সোফায় বসে আছে। বসে বসে ওর শ্বশুর রাশেদ শিকদারের সাথে কথা বলছেন। মোম এক দৌড়ে বাবার কাছে চলে গেল। বাবার কাছে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। খলিল সাহেব বসা হতে উঠে মেয়েকে বুকে আগলে নিলেন। স্মিথ হেসে বললেন,

” আমি এসেছি বলে কি তুই খুশি হোসনি? ”
মোম বুক থেকে মুখ তুলে তুরন্ত ব্যগ্র গলায় বলে,
” এসব তুমি কি বলছো, বাবা? তুমি এসেছ আর আমি খুশি হবো না? ”
খলিল মেয়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে স্মিথ হেসে বললেন,
” তাহলে কাঁদছিস কেন? ”
মোম ঠোঁট ফুলিয়ে জবাব দেয়,
” এ কান্না খুশির বাবা। কতদিন পর তোমাদের দেখছি। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। তোমরা তো আমাকে ভুলেই গিয়েছো। ”

” ভুলিনি রে, মা। জামাইয়ের থেকে সবসময়ই তোর খবর নিতাম। ”
মুনিয়া চঞ্চল পায়ে ছুটে এসে আপু বলে মোম’কে জড়িয়ে ধরল। মোমও বোনকে আদর করে দিল। আতিফা ড্রয়িংরুমে এসে রাশেদের সাথে টুকটাক কথা বলছেন। আয়মান, ময়ূরী খলিলের সাথেও ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে ফ্রেশ হতে চলে গেল। মোম বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ল,
” তোমরা এখানে কখন এসেছ? তোমরা আসবে আমাকে বলোনি কেন? ”
খলিল জবাব দিলেন,

” তোরা আসার কিছুক্ষণ আগেই এসেছি। তুই নাকি কিছুদিন ধরে বায়না করছিলি বাড়ি যাওয়ার জন্য? সেজন্য আগুন বাবাজী আমাদের ফোন করে বলে এখানে এসে তোর সাথে দেখা করে যেতে। আগুন নাকি কলেজ থেকে ছুটি পাচ্ছে না। তাই আমরাই চলে আসলাম তোকে দেখতে। আমরাও তো তোকে অনেক দিন ধরে দেখি না। আর আমাদের আসতে কোনো সমস্যা হয়নি। জামাই গাড়ি পাঠিয়েছিল আমাদের নিয়ে আসার জন্য। তোকে সারপ্রাইজ দিবো বলে জানানো হয়নি। জামাই তোকে জানাতে নিষেধ করেছিল। ”
মোম গাল ফুলিয়ে বলল,

” তবুও একবার জানালে কি হতো? ”
রাশেদ, মোমের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললেন,
” বলে দিলে কি আর সারপ্রাইজ থাকে? সারপ্রাইজ তো না বলেই দেয়, তাই না? ”
মোম শ্বশুরের কথায় সম্মতি প্রকাশ করল। কিন্তু মনে মনে আগুনের প্রতি চাপা অভিমান হলো। মোম আমতা আমতা করে আতিফা’কে জিজ্ঞেস করলো,
” মা, উনি কোথায়? জানো কি? ”
” কে? আগুনের কথা বলছিস? ”
মোম ছোট করে উত্তর দিল,

” হ্যাঁ। ”
” গাড়ি ঢাকায় পৌঁছানোর পর, আগুন নিজে গিয়েছিল আমাদের এগিয়ে নিয়ে আসতে। আমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আবার বেরিয়ে গিয়েছে। তার নাকি একটা কাজ আছে। ”
” ওহ্। তোমরা কথা বলো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ”

মোম ফ্রেশ হতে চলে গেল। মুনিয়াও চলল বোনের সাথে। মোম ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। মুনিয়া বাচ্চাসুলভ ডাগর ডাগর আঁখি তুলে আগুনের রুমটা অবলোকন করছে। রুমটা মুনিয়ার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এগিয়ে গিয়ে ধপ করে তুলতুলে নরম বিছানায় বসে পড়ল। বসতেই বিছানা কিঞ্চিৎ নিচের দিকে গর্ত হয়ে গিয়েছে। মুনিয়া ভয় পেয়ে তুরন্ত উঠে দাঁড়ায়। মোম ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে, মুনিয়া ড্যাবড্যাব করে বিছানার দিকে তাকিয়ে আছে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো,

” কি রে? কি দেখছিস? ”
” আপু, তোমাদের খাটে বসলে সেটা হালকা ভাবে নিচের দিকে চলে যায় কেন? ”
বোনের বোকা বোকা কাথায় মোম ফিক করে হেসে ফেলল। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে কতগুলো চকলেট বের করে মুনিয়ার হাতে দিল। চকলেট পেয়ে মুনিয়া খুব খুশি হলো। সহসা বোন’কে জড়িয়ে ধরল। মোম হেসে মুনিয়ার গাল টিপে দিল। বোনের হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে, নিজেও পাশে বসলো। অধর কোণে হাসি বজায় রেখে বলল,
” কারণ, খাটের মধ্যে বিছানো জাজিম’টা একটু বেশিই নরম। তোর দুলাভাই অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে। সেজন্য কোনো ভারী ব্যক্তি বা বস্তু খাটের উপর পড়লে সেটা কিঞ্চিৎ নিচের দিকে চলে যায়। ”
মুনিয়া চকলেট খেতে খেতে জবাব দেয়,

” কত সুন্দর। আর আমাদের বাড়ির বিছানা এত নরম না। শুলে কেমন শরীর ব্যথা করে। ”
মুনিয়া রাজ্যের সকল কথা জুড়ে দিল। কতদিন পর বোন’কে কাছে পেয়ে মোমও মনোযোগ সহকারে মুনিয়ার কথা গুলো শ্রবণ করছে। কিছুক্ষণ পর ওদের সাথে আয়মান, ময়ূরীও এসে যোগ দিল। মোম বেশি কিছু বলছে না। চুপ করে ওদের কথা শুনছে। রুমটাকে হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত করে রেখেছে আয়মান। ওর একেকটা মজার মজার কথায় মুনিয়া খিলখিল করে হাসছে। ইতোমধ্যে আয়মানের সাথে মুনিয়ার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে। রাত আট’টা পর্যন্ত ওরা আড্ডা দিয়েছে। আগুন এখনো বাসায় ফিরেনি। মোমের চিন্তা হতে লাগলো। চঞ্চল পায়ে রান্নাঘরে চলে গেল। সেখানে মিনা রান্না করছেন। তাকে হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছেন আতিফা। দুই বেয়ান মিলে কথা বলেছেন আর রান্না করছেন। মোম গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ায়। মোম’কে দেখে মিনা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন,

” কিছু বলবে? ”
মোম ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছে। আগুনের কথা জিজ্ঞাসা করবে কি করবে না সেটাই ভাবছে। মোমের আর জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হলো না। তক্ষুনি ওর সকল দ্বিধাদ্বন্দের অবসান ঘটিয়ে কেউ একজন ডোরবেল বাজালো। মিনা, মোম’কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” দেখো হয়তো আগুন এসেছে। যাও গিয়ে দরজা খুলে দেও। ”
মিনার বলতে দেরি হলেও আগুন এসেছে শুনে মোমের চঞ্চল পা যুগল ছুটতে দেরি করল না। মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আতিফা। মোমের স্বামীর জন্য অস্থির হওয়া তার নজর এড়ায় নি। মোম যে আগুনের কথা জানতেই রান্নাঘরে এসেছিল, সেটা ওর ছুটে চলা দেখেই তিনি বুঝতে পেরেছেন। তারমানে, মেয়ে তার শ্বশুর বাড়িতে সুখেই আছে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে আতিফা মৃদু হাসলেন।

মোম দরজা খুলে দিতেই আগুনের ক্লান্ত মুখশ্রীতে নজর আঁটকায়। হাতে রয়েছে বড়সড় একটা ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর কি আছে মোম জানে না। মোম ঠোঁট মেলে কিছু বলতে উদ্যত হতেই আগুন ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। মোমের মনটা খারাপ হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই ভাবলো, হয়তো ক্লান্ত ছিল। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। দরজা বন্ধ করে মোম রুমে চলে আসে। আগুন ব্যাগটা ড্রয়িংরুমে রেখে মা’কে বলে ফ্রেশ হতে চলে গেল। মোম, আগুনের টি-শার্ট, ট্রাউজার বের করে বিছানায় রাখে। চুপ করে বসে আগুনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। মুনিয়া এসে বলল, ওকে ওর শাশুড়ি ডাকছেন। অগত্যা মোম, মুনিয়ার সাথে পা বাড়ায়। আগুন ফ্রেশ হয়ে এসে তৈরী হয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। সেখানে রাশেদ, খলিল, আয়মান বসে বসে টিভি দেখছে। টিভিতে তখন নিউজ চলছে। যদিও আয়মানের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তো আনিকা’কে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। আগুন এসে আয়মানের পাশে বসলো। রাশেদ গলা পরিষ্কার করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

” সামনে তো মোমের এসএসসি পরীক্ষা। তাকে কি পরীক্ষা দেওয়াবে না? সেসব নিয়ে কি এখনো কিছু ভাবোনি? ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে তাকায় বাবার দিকে। শান্ত গলায় বলল,
” মোমের একাডেমির বইপত্র এনে দিয়েছি। পরীক্ষা ওদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েই দিবে। ”
” ভালো। ”

এরপর আর রাশেদের সাথে আগুনের কোনো কথা হলো না। আগুন চুপ করে বসে আছে। যা কথা বলার রাশেদ, খলিল তারাই বলছেন। দশ-টা বাজে সবাই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে চলে গেল। ঘুম বলতে আগুনের কোমলমতি মোম’ই ঘুমাচ্ছে। আর বাকিরা জেগে আছে। তাদের তো ঘুমালে চলবে না। মোম ঘুমিয়ে পড়তেই আগুন ওঠে আসে। ড্রয়িংরুমে এসে দেখে ড্রয়িংরুমের দেয়ালে কিছু বেলুন ফুলিয়ে টাঙানো হয়েছে। আয়মান আরেকটা বেলুন ফুলানোর সময় ঠাস করে বেলুনটা ফুটে গেল। ময়ূরী মৃদু ধমকে বলল,
” আস্তে। শব্দ করিস না। ”

আয়মান মেকি হাসি উপহার দিল। ড্রয়িংরুমের মাঝখানে মাঝারি সাইজের একটা টেবিল বসানো। সেখানে বড়ো রকমের সুন্দর একটি বার্থডে কেক রাখা। কেকের উপর ছোট ছোট বার্থডে ল্যাম্প। সকল কাজ কমপ্লিট করে সবাই সোফায় বসে আছে। অপেক্ষা রাত বারো’টা। সময় যেন যাচ্ছেই না। রাত জাগা মানুষ গুলোর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটার কাছাকাছি পৌঁছাল। এখনো দশ মিনিট বাকি। আগুন গিয়ে চটজলদি মোম’কে ডেকে তুলল। মোম ঘুম ঘুম চোখে পিটপিট করে তাকায়। আগুন তাড়া দিয়ে বলল,
” মোম, দ্রুত ওঠো। সময় নেই। নয়তো খুব দেরি হয়ে যাবে। ”
আগুনের উত্তেজিত বলা কথায় মোম তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে ওঠে পড়ে। আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করে,

” কি হয়েছে, মাস্টার মশাই? ”
” গেলেই দেখতে পাবে। এখন আমার সাথে চলো। ”
আগুন, মোম’কে নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসে। কিন্তু মোম চোখে কিছু দেখতে পারছে না। চারপাশ অন্ধকার। এর কারণ, আগুনের বলিষ্ঠ একটি হাত মোমের চোখ ঢেকে আছে। আগুন টেবিলের সামনে মোম’কে দাঁড় করিয়ে আস্তে করে মোমের চোখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। তক্ষুনি পরিচিত কিছু মানুষের গলার আওয়াজ ভেসে আসে। তারা এক সাথে চিৎকার করে বলে উঠলো,
” হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। ”
বাকি সবাই মৃদু আওয়াজে মোম’কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালেও আয়মান, ময়ূরী, মুনিয়া চিৎকার করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মোম তাড়াক করে চোখ খুলে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে আপনজনদের মুখ। সাথে একটা টেবিলে বার্থডে কেক সহ, জ্বলন্ত বার্থডে ল্যাম্প। মোম তো ভুলেই গিয়েছিল আজকে তার জন্মদিন। এবার কানের কাছে মিহি কন্ঠে ভেসে আসলো আগুনের থেমে থেমে বাক্য,

” শুভ জন্মদিন মোম। ”
খুশিতে মোম কান্না করে দিল। আতিফা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। স্মিথ হেসে বললেন,
” জন্মদিনে কেউ কান্না করে? বোকা মেয়ে। একদম কান্না করবি না। আজ ষোলো তম বয়সে পা রাখলি। দোয়া করি, এভাবেই সবসময় হাসিখুশি থাক। শুভ ষোলো তম জন্মদিন আমার, মা। ”
আতিফা মেয়েকে আদর করে দিলেন। একে একে সবাই মোম’কে শুভেচ্ছা জানিয়ে যে যা পেরেছে ছোট ছোট গিফট মোমের হাতে তুলে দিল। শুধু আগুন, মোম’কে কিছু দেয়নি। রাশেদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
” কি ব্যাপার আগুন? আজকে তোমার বউয়ের জন্মদিন। সবাই টুকটাক গিফট দিয়েছে আর তুমি কিছু দিলে না কেন? ”
আগুন ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,

” দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। তাই দেইনি। ”
রাশেদের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল। কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মোমের বাবা-মায়ের সামনে কিছু বলা সঠিক মনে করলেন না তিনি। সেজন্য আগুনের গা ছাড়া ভাবে বলা কথাটা হজম করে নিলেন। আয়মান কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
” ভাই আবার আলাদা করে কি গিফট দিবে? কিছু দেওয়া লাগবে না। ভাই নিজেই তো আস্ত একটা গিফট। ”
পরপর মোমের দিকে চেয়ে বলল,
” ভাবি দ্রুত কেক টা কাটো। ঘুম পাচ্ছে আমার। ”

মোম, ফু দিয়ে বাতি গুলো নিভিয়ে দিল। কেক কেটে কেকের ছোট এক টুকরো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোম বুঝতে পারছে না সর্বপ্রথম কাকে কেক খাওয়ানো উচিত? এখানে প্রত্যেকটা মানুষই ওর আপন। কাকে রেখে কাকে আগে খাওয়াবে? মোম মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আগুন কি বুঝতে পারল, তার কোমলমতির মনের কথা? হয়তো! তাই তো মোমকে উদ্দেশ্য করে শান্ত গলায় বলল,
” কেক হাতে দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও তোমার বাবা-মা’কে কেক খাওয়াও। ”

আগুনের সম্মতি পেয়ে মোম প্রথমে খলিল কে কেক খাওয়ালো। তারপর মা’কে। ঘুরে আগুনের দিকে কেকের টুকরো ধরল। আগুন কেক খেলো না। মোমের হাত থেকে কেক নিয়ে সেটা মোম’কে খাইয়ে দিল। আগুন কেক না খাওয়ায় মোমের মুখটা ছোট হয়ে গেল। দ্রুত নিজেকে সামলে সবাইকে কেক খাওয়ালো। নিজেও বাকিদের হাতে কেক খেলো। মুনিয়া তো বাটিতে করে পেট ভরে কেক খেলো। কত মজার কেক। গ্রামে থাকতে যদিও খেয়েছে। তবে এই কেকটা একটু বেশিই মজা। কেক কাটা শেষ হতেই আয়মান, ময়ূরী’কে কিছু একটা ইশারা করে কোথায় যেন চলে গেল। রাত অনেক বলে কেউ আর আগুনের আসল বাড়িতে ফিরে যায়নি। ঠিক করা হলো, আয়মানের রুমে রাশেদ, খলিল আর আয়মান থাকবে। এবং ড্রয়িংরুমে মিনা, আতিফা, ময়ূরী, মুনিয়া থাকবে। একটা রাত কষ্ট করে ঘুমালে কি আর হবে? ড্রয়িংরুমের মেঝেতে কাঁথা বিছিয়ে বিছানা তৈরী করছেন, মিনা। বালিশ কম বলে সোফায় থাকা ছোট বালিশ ব্যবহার করতে হচ্ছে। এই বালিশেই মাথা দিয়ে শুয়ে বাকি রাতটা পার করবেন। ময়ূরী, মোম’কে ডেকে বলে,

” ভাবি, আমার সাথে একটু এসো তো। ”
” জ্বি, আসছি। ”
ময়ূরী চলে গেল। আগুন ড্রয়িংরুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ফোনে কিছু একটা দেখছে। মোম ধীর পায়ে আগুনের কাছে গিয়ে চাপা স্বরে গোমড়া মুখে বলল,

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২১

” আপনি তখন কেক কেন খাননি? নাকি আমার হাতে খেতে চাচ্ছিলেন না? ”
আগুন ফোন বন্ধ করে ট্রাউজারের পকেটে রাখে। দু হাত পেছনে নিয়ে মোমের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে হিসহিসিয়ে বলে,
” ওই কেক তোমার জন্য এনেছি। তুমি তোমার কেক খাও। আমি আমার কেক খেয়ে নিবো।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৩