শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৮
সুমাইয়া সুলতানা
রাতের ঘুটঘুটে আঁধার সরে গিয়ে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আবছা অন্ধকারাচ্ছন্ন চারপাশ দেখতে খুব মনোমুগ্ধকর লাগছে। প্রকৃতির বাতাবায়নে উচ্ছ্বাস সমেত পক্ষীকূল নিজ গলায় শব্দ তুলে গগনে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের মতো চঞ্চল এক কিশোরী নুপুরের রিনঝিন শব্দ তুলে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে আগুন, মোম রেডি হতে শুরু করল। আগুনের অবশ্য বেশি সময় লাগলো না কিন্তু মোমের রেডি হওয়া তো দূরে থাক, এখনো ড্রেস কোনটা পরবে সেটাই সিলেক্ট করতে পারছে না। এই ভোরবেলা ময়ূরী’কে ভিডিও কল করে কয়েকটা ড্রেস দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছে কোনটা পড়বে? ময়ূরী উত্তরে বলেছে, ভাবি তুমি এমনিতেই সুন্দর। তুমি যেটা পড়বে তাতেই তোমাকে সুন্দর লাগবে। মোম, ময়ূরীর কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলো না। গোমড়া মুখ করে সোফায় বসে আছে। আগুন সম্পূর্ণ তৈরী হয়ে ব্লেজার টা আলমারিতে তুলে রাখল। এই গরমের মধ্যে শার্টের সাথে বাড়তি কাপড় পড়লে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। মোমের কাছে এসে শিনা টানটান করে দাঁড়ায়। বুকে হাত গুঁজে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এই মেয়ে এখনো আগের মতোই বসা। আগুন বিরক্ত হলো। ধমকে বলে ওঠে,
” তোমার কি যাওয়ার ইচ্ছা আছে? ইচ্ছে না থাকলে বলো, আমি একাই চলে যাবো। ”
আকস্মিক ধমকে মোমের সত্তা কেঁপে ওঠে। ভোঁতা মুখে আগুনের দিকে দৃষ্টি তাক করে। গাল ফুলিয়ে জবাব দেয়,
” আমি তো যেতে চাই কিন্তু কোন জামাটা পড়বো বুঝতে পারছি না। ”
আগুন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। বিছানায় জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আগুন একটা শাড়ি হাতে তুলে নিয়ে মোম’কে কাছে ডাকল,
” এদিকে আসো। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মোম থমথমে মুখে এগিয়ে যায়। আগুনের দিকে তাকাল না। ঠোঁট ফুলিয়ে রেখেছে সে। আগুন ঝুঁকে মোমের ফুলিয়ে রাখা নিচের ঠোঁটে আলতো করে কামড় দিল। স্মিথ হেসে বলল,
” ঠোঁট ফুলিও না। খেয়ে ফেলবো। ”
মোম ধীর স্বরে বলে,
” বাজে লোক। ”
” এই শাড়িটা পড়ো। সোনারগাঁও পৌঁছে হোটেলে যাওয়ার পর ড্রেস চেঞ্জ করা লাগবে, তখন অন্য ড্রেস পড়ে নিও। ”
মোম বাধ্য মেয়ের মতো শাড়ি পড়তে লাগলো। আগুন সোফার হাতলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে ফোন টিপছে। মোম শাড়ি পড়ার এক ফাঁকে আয়নায় আগুনের দিকে নজর গেল। অমনি তার বক্ষস্থল ছ্বলাত করে উঠল। তুরন্ত পেছন ফিরে আড়চোখে মুড নিয়ে থাকা আগুনের দিকে তাকাল। পলক ঝাপটিয়ে ডাগর ডাগর আঁখি তুলে নিভৃতে অনিমেষ চেয়ে রইল তার স্বামীর আদলে। আগুনের পড়নে ব্লাক ডেনিম প্যান্ট, গায়ে এ্যাশ রঙের শার্ট, যেটা ইন করা। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। ফর্সা শরীরে দারুন মানিয়েছে। বুকের কাছে দুটো বোতাম খোলা। ভেতরে সেন্টু গেঞ্জি রয়েছে। তবে সেটার গলা বড়ো হওয়ায় তেমন নজরে আসছে না।
মোমের নারী সত্তার দুর্বলতা বুকের লোম গুলো কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। যেন মোম’কে ডাকছে, ওই লোমশ বুকে মিশে যেতে। মাথার চুল গুলো সুন্দর কাট করে পেছনে নিয়ে রাখা। ফর্সা হাতে সোনালী রঙের হাতঘড়ি টা কি চমৎকার লাগছে! ঠোঁট কামড়ে ধরায় গোলাপি রাঙা অধর জোড়া টকটকে লাল রঙ ধারণ করেছে। কিছুদিন আগে আগুন ক্লীন সেভ করেছিল। এতে মোম চিৎকার করে পুরো বাসা মাথায় তুলে ছিল। আগুনের দাঁড়ি, চুল বড়ো হওয়ায় সেলুনে গিয়েছিল। মোম বারবার বলে দিয়েছিল সম্পূর্ণ ক্লীন সেভ যেন না করে। আগের মতো হালকা ভাবে ছাঁটাই করে আসবে। আগুনের চাপ দাঁড়ি মোমের ভীষণ পছন্দ।
অথচ আগুন, মোমের নিষেধ অমান্য করে এইবার ক্লীন সেভ করে এসেছে। সেদিন মোম, আগুনের সাথে কথা বলেনি। আগুন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বউ’কে মানিয়ে ছিল। এখন সেই ফর্সা গালে কালো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলো উঁকি দিচ্ছে। এতেও মোমের মাস্টার মশাই’কে দেখতে কি সুন্দর লাগছে! আগুন চোখ তুলে চায়। মোম চেয়ে ছিল, তাই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। মোম অস্বস্তিতে পড়ে যায়। দ্রুত নজর ফিরিয়ে তৈরী হতে লাগলো। আগুন মিটিমিটি হেসে মোমের পেছনে দাঁড়িয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
” চোরা চোখে তাকানোর কি আছে? তোমারই তো বর। সরাসরি তাকালে আমি মাইন্ড করবো না। ”
মোম হাতে রেশমি চুড়ি পড়ে, কাজল ঠিক আছে কি না চেক করে নিলো। আয়নায় আগুন’কে দেখে ভেঙচি কেটে বলে,
” আমি কেন আপনাকে দেখতে যাবো? আমি তো আপনার পেছনের দেয়ালে চোখ বুলাচ্ছিলাম। ”
” তাই নাকি? ”
” জ্বি। ”
আগুন আয়নার দিকে দৃষ্টি তাক করে মোমের লিপস্টিক পড়া পীবর ঠোঁটে নজর রেখে বলল,
” ভাবছি বুকের কাছের বোতাম দুটো খোলাই থাক। যা গরম পড়েছে, বাইরে গেলে হাওয়া বাতাস গায়ে লাগলে আরাম পাবো। ”
মোম তুরন্ত পেছন ফিরে চায়। একরাশ দ্বিধা নিয়ে জানায়,
” তাড়াতাড়ি বোতাম লাগান। বোতাম খুলে বাইরে যেতে পারবেন না। ”
” কি সমস্যা? ”
মোম কোনো ভনিতা ছাড়াই সরল গলায় জবাব দিল,
” আপনার গলা থেকে বুক পর্যন্ত আলাদা একটা মোহ আছে। যেই মোহ আমাকে আকর্ষণ করে। সেই দিকে অন্য মেয়েরা তাকাবে সেটা আমি সহ্য করতে পারবো না। ”
বলা শেষ করে মোম নিজেই ব্যস্ত হস্তে আগুনের শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিল। শুধু গলার সাথে লাগানো একদম নিকটের বোতামটা লাগালো না। আগুন চক্ষু হাসল। বলিষ্ঠ হাত বাড়িয়ে মোমের কোমর প্যাঁচিয়ে ধরল। সময় নিয়ে কপালে গাঢ় করে চুমু খেল। অধর প্রসারিত করে হেসে বলল,
” সবসময় এরকমই থেকো মোম। তোমার সরল-সাবলীল স্বীকারোক্তি আমার মনে প্রশান্তিকর হাওয়া বইয়ে দেয়। ”
মোম লাজুক হেসে মাথা নিচু করে নিলো। আগুন দূরে সরে দাঁড়ায়। মোম বাকি কাজ কমপ্লিট করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটা ব্যাগে ভরে নেয়। কয়েকদিন সোনারগাঁও থাকবে। তাই বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ভালো করে সবকিছু আরেকবার দেখে নিলো।
কলেজের গেইটে গাড়ি থামতেই আগুন, মোম’কে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে মোমের হাত ধরে ভেতরে দিকে হাঁটা শুরু করল। আগুন নিজের গাড়ি করে আসেনি। টেক্সি ভাড়া করে এসেছে। যেহেতু কলেজ থেকে গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে, সবাই এক সঙ্গে যাবে বলে। সেখানে এখন নিজের গাড়ি করে কলেজে আসলে গাড়ি কার কাছে, কেথায় রেখে যাবে? তাই আর নিজের গাড়ি আনেনি। আগুন, মোম’কে নিয়ে লাইব্রেরীর সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেক টিচার্স আছে সেখানে। অপরিচিত এত লোকজন দেখে মোম কিছুটা ঘাবড়ে গেল। এখানে সবাই উচ্চ শিক্ষিত, তাদের সাথে মোম মানিয়ে নিবে কিভাবে? ওর জন্য আগুন’কে আবার লজ্জায় পড়তে হবে না তো? ভয়ে মোমের হাতের তালু ঘামতে শুরু করেছে। আগুনের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। সে উৎফুল্ল সমেত হাঁটছে। লাইব্রেরীর ভেতরে প্রবেশ করতেই সকলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ওদের উপর। আগুন’কে দেখে সবাই খুশি হলো। প্রিন্সিপাল স্যার এসে আগুনের কাঁধে হাত রেখে শুধালেন,
” এত দেরি হলো কেন? ”
আগুন কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে বলে,
” ওই রেডি হতে একটু দেরি হয়ে গেল। সবাই এসে পড়েছে? ”
” হ্যাঁ। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিল সবাই। ”
” সরি, স্যার। ”
প্রিন্সিপাল মুচকি হেসে বললেন,
” ইটস ওকে, ম্যান। ”
আগুন বাকিদের দিকে তাকায়। সবাই কেমন হা করে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখেমুখে একরাশ বিস্ময়। তাদের একাগ্রতা গভীর চাউনী আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী রমণীর দিকে। অল্প বয়সি এই হুরপরী আগুনের সাথে কি করছে? সকলের মনে এই একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। তাদের মনোভাব বুঝতে পেরে আগুন স্মিথ হেসে জানাল,
” মীট মাই ওয়াইফ, মিসেস আগুন শিকদার। ”
সকলে যেন হোঁচট খেলো। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে দুই কপোত-কপোতীর দিকে। প্রিন্সিপাল স্যার এতক্ষণ মোম’কে লক্ষ করেননি। তিনি নিজেও আগুনের বলা মিসেস শিকদার কথায় বেশ অবাক হয়েছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” তুমি বিয়ে করেছো কবে? কোথায় আমাদের তো জানালে না? ”
” আসলে স্যার তেমন কাউকে বলতে পারিনি। সাডেনলী বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বিয়ের প্রায় দেড় মাস হয়ে গিয়েছে। ”
আগুন একে একে সবার সাথে মোম’কে পরিচয় করি দিল। সবাই আন্তরিকতার সাথে অনেক কথাই মোম’কে জিজ্ঞেস করেছে, বিশেষ করে অন্য প্রফেসরেদের ওয়াইফ’রা। মোম শুধু বিনিময়ে হেসে মাথা নেড়ে জবাব দিয়েছে। রাফি, আগুনের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
” এই কি আপনার সেই পছন্দের মানুষ, যার কথা সেদিন রেস্টুরেন্টে বলেছিলেন? ”
আগুন শান্ত কন্ঠে জবাব দিল,
” হ্যাঁ। ”
রাফি চওড়া হাসি উপহার দিয়ে বলল,
” জিতেছো ভাই। ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো,
” মানে? ”
” ভাবি কে দেখতে অনেকটা বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। বয়স কত শুনি? ”
” ষোলো। ”
সবাই আরেক দফা চমকে উঠল। বিস্ময়ে তাদের চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কথাটা আগুন একটু জোরেই বলেছে। সবাই অবাক হলেও তাদের তেমন কোনো ভাবান্তর হলো না, কিন্তু সিনিয়র এক প্রফেসর এসে অবাক সহিত জানতে চাইলেন,
” হোয়াট! আই ক্যান্ট বিলীভ দিস, আগুন! তুমি…. তুমি একজন ষোলো বছরের বাচ্চা মেয়েকে কিভাবে বিয়ে করতে পারলে? বিবেক বাঁধলো না? ”
আগুন অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কিভাবে বিষয়টা হ্যান্ডেল করবে? রাফি বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ায় জন্য বলল,
” আরে স্যার বাদ দেন সে কথা। আজকাল কার মেয়েরা অল্প বয়সেই এডাল্ট হয়ে যায়। আগুন স্যারের বউ’কে দেখতে কিন্তু অতোটাও ছোট মনে হচ্ছে না। ”
সিনিয়র প্রফেসর তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বললেন,
” মেয়েটা কতটুকু সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হলো প্রফেসর আগুনের বয়সের সাথে মেয়েটা যাচ্ছে না। কোথায় ঊনত্রিশ আর কোথায় ষোলো? শুধু বিয়ে করলেই হয় না! বয়সের সাথে ম্যাচিং এর ও তো একটা কথা আছে? শিক্ষিত মানুষ হয়ে বাল্যবিবাহ কিভাবে করেছে সে? ”
আগুন তাকায় প্রফেসরের দিকে। এই প্রফেসর কোনো এক কারণে আগুনকে সহ্য করতে পারে না। কারণ টা তিনি না জানালেও আগুন বুঝতে পারে। আগে এই সিনিয়র প্রফেসরের কাছে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তো। চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে শিক্ষার্থীরা আগুনের কাছে প্রাইভেট পড়তে চায়। কিন্তু আগুন এই পর্যন্ত কাউকেই প্রাইভেট পড়ায় নি। সকলকে নিষেধ করে দিয়েছে, তবুও কোনো শিক্ষার্থী আর এই সিনিয়র প্রফেসরের কাছে প্রাইভেট পড়েনি। সেজন্য তিনি আগুনের উপর রেগে আছেন। আগুন বুঝতে পারে না, এতে আগুনের কি দোষ? হয়তো, সেই রাগ এখন বাল্যবিবাহ নাম করে ঝাড়তে চাইছেন! আগুন ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস টেনে রাগ টুকু গিলে নিলো। কন্ঠ খাদে এনে ভারিক্কি গলায় বলল,
” কোথায় লেখা আছে শুধু অশিক্ষিতরা বাল্যবিবাহ করতে পারবে, আর শিক্ষিতরা পারবে না? আমাদের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। আমার ওয়াইফ যদি আমাকে খুশিমনে মেনে নিয়ে সংসার করতে পারে, সেখানে আপনার কি সমস্যা বুঝতে পারছি না! ”
এপর্যায়ে প্রফেসর কিছুটা দমে গেলেন। পাল্টা আর কথা বাড়ালেন না। ওনাকে এই কলেজের কেউ দেখতে পারে না। না শিক্ষার্থী, আর না অন্য কোনো প্রফেসর! এমনকি প্রিন্সিপাল স্যারও ওনাকে দেখতে পারেন না। ওনার নামে অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ জানিয়েছে তাকে। প্রফেসর ক্লাসে পড়া সঠিকভাবে না বুঝিয়ে বারবার প্রাইভেট পড়ার তাগিদ দেন। বিষয়টা নিয়ে প্রিন্সিপাল, প্রফেসরকে রাগারাগিও করেছিলেন। প্রিন্সিপাল স্যার সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
” এই টপিক নিয়ে কেউ আর বাড়াবাড়ি করবেন না। এটা যার যার পার্সোনাল ম্যাটার। কলেজ মাঠে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সকলে নিজেদের সিটে গিয়ে বসে পড়ুন। ”
মোম’কে জানালার পাশের সিটে বসিয়ে সাথের সিটে আগুন বসলো। আগুন আগে থেকেই বলে রেখেছিল জানালা বরাবর ডাবল সিট লাগবে তার। নিজের জন্য না, তার কোমলমতির জন্য। বড়সড় একটা বাস গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। গাড়িটা দুইতলা বিশিষ্ট। যারা এসেছে তাদের মধ্যে কাপল হচ্ছে আটজন আর বাকি গুলো সিঙ্গেল। আগুন দ্বিতীয়তলায় মোম’কে নিয়ে বসেছে। মূলত কাপল যারা, তাদের সকলের সিট দ্বিতীয়তলায়। আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার। ইতোমধ্যে সূর্যের কিরণ পৃথিবীর বুকে হানা দিয়েছে। রাতের অন্ধকার সরিয়ে নিজের দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়েছে ধরণীর বুকে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে তার নিজ গতিতে।
মোম শাড়ির সাথে হিজাব বাঁধে নি। ক্লিপ দিয়ে ফুলের মতো করে খোঁপা বেঁধেছে। গাড়ি চলার সাথে সাথে মোমের কানের দুল সামনে পিছে দুলছে। আজ একটু ভালোই সাজগোছ করেছে। আগুন নিজে মোম’কে সাজিয়ে দিয়েছে, শুধু লিপস্টিক গাঢ় করে দিতে দেয়নি। সেজন্য হালকা করে দিয়েছে। মোম পাতলা ঠোঁটে মনোমুগ্ধকর হাসি ঝুলিয়ে বড়ো বড়ো আঁখি তুলে চারপাশে অবলোকন করছে। আগুন সেই রাঙা ঠোঁটের হাসির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার নববধূর কাজল কালো চোখের মায়ায় আটকে যায় সে ক্ষণে ক্ষণে। চোখ দুটো স্থির লোচনে মনোনিবেশ করল মোমের পীবর ঠোঁটে। বাকি কাপল রা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, হাসাহাসি করছে। তাদের সকল কথা আগুন’কে নিয়ে। সে আসার পর থেকে তাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। তার সকল মনোযোগ বউয়ের দিকে। এসব নিয়েই তারা কথা বলছে। আগুনের এক কলিগ হাঁক ছেড়ে ডাকল,
” প্রফেসর আগুন, আমাদের দিকে একটু নজর দিলেও তো পারেন। ”
মোম তাকায় সেদিকে। দেখতে পেলো, ওদের দিকে চেয়ে সবাই মিটিমিটি হাসছে। মোম লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। কারণ, আগুনের নজর এখনো মোমে’তে আবদ্ধ। মোম কটমট করে আগুনের হাতে চিমটি কাটলো। আগুন মৃদুস্বরে ব্যথাতুর শব্দ তুলল। কন্ঠ খাদে এনে রাশভারী গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” কি হয়েছে? ”
মোম ঠোঁট উল্টে জবাব দিল,
” আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? দেখছেন না সবাই দেখছে! কেউ একজন আপনাকে পেছন থেকে ডেকে ছিল। ”
” শুনতে পাইনি। ”
মোম চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” শুনবেন কি করে? মন কোথায় থাকে আপনার? ”
আগুন মাথা কিঞ্চিৎ ঝুঁকিয়ে মোমের কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
” আমার সকল ধ্যান তোমাতে নিবদ্ধ। ”
” দূরে সরুন, সবাই তাকিয়ে আছে। ”
আগুন সরলো। পেছন ফিরে মুচকি হেসে জানতে চাইল,
” জ্বি, কেউ ডেকে ছিলেন? ”
আগুনের কলিগ রসিকতা গলায় বলল,
” ডেকে তো ছিলাম, তবে আমার মনে হয় না আপনি আমাদের কথা শোনার মতো পরিস্থিতিতে আছেন। ”
” কেন শুনবো না? আপনারা বলুন। ”
” না থাক। ভাবির সাথে সময় কাটান। লং জার্নি তো, পড়ে টায়ার্ড হয়ে যাবেন। টায়ার্ড হওয়ার আগ পর্যন্ত এনজয় করুন। ”
পাশ থেকে লোকটার স্ত্রী ধমকে নাক ঝামটি মেরে বলে উঠলো,
” মিস্টার আগুন তো আর তোমার মতো রসকষহীন কাঠখোট্টা মানুষ না, যে বউ রেখে অন্যদের সাথে আজাইরা আলাপ করবে! ওদের দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। গাড়ি ঝাঁকুনি দিচ্ছে না, তবুও কি সুন্দর বউয়ের কাঁধ জড়িয়ে এক হাতে আগলে রেখেছে। আর তুমি? আমাকে আগলে রাখা তো দূরের কথা, আমি পাশে বসলেই তোমার চুলকানি উঠে যায়। বলি আগুন স্যারকে দেখে কিছু শিখো। ”
প্রফেসরের মুখটা নিমেষেই চুপসে গেল। মোম ফিক করে হেসে উঠল। আগুন ঠোঁট কামড়ে হাসে। বাকিরা শব্দ করে হেসে উঠে। আগুন হাসি মুখে ভরাট কন্ঠে বলল,
” ভাবি আজকে অন্তত রাগারাগি না করলেই ভালো হয়। আনন্দটা মাটি হয়ে যাবে। আর আমার মতো কাউকে হতে হবে কেন? সবাই তার নিজস্ব জায়গায় নিজস্ব ভাবে সুন্দর। তাছাড়া, আমার বউটা একদমই বাচ্চা, ওর সাথে তো আপনার কম্পেয়ার করলে চলবে না। ”
কলিগের বউয়ের মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। আগুনের কলিগ হো হো করে হেসে উঠে। একদম ঠিক হয়েছে। তাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলা! কলিগের স্ত্রী বিরক্ত হলো। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইল। বাকিরা বেশ মজা নিচ্ছে।
আগুন ঘাড় ঘুরিয়ে পুনরায় সামনে তাকাল। মোম ঠোঁট টিপে হাসছে। হাসির সাথে গাল দুটো কেমন ফুলে উঠছে। আগুনের ইচ্ছে করছে ওই ফর্সা রক্তাভা ফোলা গালে কুটুস করে কামড় বসাতে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না।
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ২৭
জায়গা এবং পরিস্থিতি দুটোই এখন প্রতিকূলে! এদিকে আগুনের বুকে ঝড় বইছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি বউকে বুকের ভেতর জাপ্টে ধরে অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করতে। মোমের ঝকঝকে হাসিটা চিরস্থায়ী হলো না। আগুনের হাস্কিস্বরে বলা কথায় ধপ করে নিভে গেল। আগুন বলল,
” এত হেসো না। আামাকে জ্বালিয়ে দিব্যি হাসা হচ্ছে? হোটেলে একবার ফিরতে দাও। এই হাসি আমি যন্ত্রণার কারণ বানিয়ে ছাড়বো। ”