শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩২(২)

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩২(২)
সুমাইয়া সুলতানা

” আগুন তুই আামকে ডেকেছিস? আমি তো ভাবতেই পারছি না। ”
নাঈমা উৎফুল্লতা সমেত বলে উঠল। আগুন অবিশ্বাস সহিত গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” আমিও ভাবতে পারিনি তুই এমন কিছু করবি! ”
” কি করার কথা বলছিস? ”
আগুন, নাঈনার বাহু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে হাঁটতে লাগল। নাঈমা হাত মোচড়ামুচড়ি করছে। আগুন হাতের চাপ আরো বাড়িয়ে দিল। নাঈমা মৃদু আর্তনাদ করে বলে ওঠে,

” আগুন আস্তে ধর, ব্যথা পাচ্ছি। ”
আগুন ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
” কেন? আমার স্পর্শ ভালো লাগছে না? তুই চাস না আমার স্পর্শ? ”
” চাই। তোর একটুখানি ছোঁয়া পাওয়ার জন্য আমি সবসময়ই ব্যাকুল হয়ে থাকি। ”
” তাহলে সহ্য করেনে। আমার স্পর্শ অনেক বিষাক্ত। যে সহ্য করে টিকে থাকতে পারে, তার জন্য গোলাপ ফুলের পাপড়ির মতো কোমল। আর যে সহ্য করতে পারে না, তার জন্য গোলাপ ফুলের কাঁটার চেয়েও খারাপ। ”
” কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে? ”
” আমার সঙ্গ চাস অথচ আমার সঙ্গে যেতে এত দ্বিধা? ”
” দ্বিধা থাকবে কেন? জানতে চাচ্ছি। ”
” জানার দরকার নেই, গেলেই দেখতে পাবি। ”

আগুন রুম থেকে বেরিয়ে নাঈমা’কে কল করে বলেছে, সে নাঈমার সাথে দেখা করতে চায়। নিজেদের মধ্যে সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে চায়। প্রেমে পাগল নাঈমা আগুনের কথা মেনে নিয়ে ছুটে আসে তার কাছে। মোম’কে আঘাত করে ওদের চোখের আড়াল হওয়ার পর নাঈমা ঢাকায় ব্যাক করবে এরকম মনস্থির করেছিল। বাসে উঠতে যাবে তক্ষুনি আগুনের কল পেয়ে ফিরে আসে আগুনের বলা ঠিকানায়।
আগুন ভরাট কন্ঠে শুধাল,
” তুই জানলি কিভাবে আমি সোনারগাঁও আছি? ফলো করিস আমাকে? ”
” ফলো তো করি। তবে তোরা সোনারগাঁও ঘুরতে আসবি সেটা তোকে ফলো করে জানতে পারিনি। ”
আগুন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চওড়া গলায় প্রশ্ন করলো,
” তাহলে কিভাবে জানতে পেরেছিস? ”

” মনে আছে? কয়েকদিন আগে লাস্ট তোর সাথে দেখা হয়েছিল তোর কলেজে? যদিও অরিজিনালী তোর সাথে দেখা করার জন্যই গিয়েছিলাম। কিন্তু তোর কলেজের সামনে পুরনো একজন ফ্রেন্ড সাক্ষাৎ করতে বলেছিল। তাই গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পথে তোর কলেজের পরিচিত এক প্রফেসরের সাথে দেখা হয়েছিল। তার সাথে কথা বলার সময় একপর্যায়ে তিনি জানালেন, আর তিনদিন পর তোরা নাকি সোনারগাঁও ঘুরতে আসবি। তখনই আমি ডিসাইড করেছিলাম, আমিও সোনারগাঁও আসবো। তোরা যেদিন এসেছিস, আমিও ওই দিন সোনারগাঁও এসেছি। ”
আগুন খুব মনোযোগ দিয়ে নাঈমার কথা শ্রবণ করল। হাঁটতে হাঁটতে সেই জায়গায় এসে থামল, যেই জায়গায় মোম’কে নাঈমা নিয়ে এসেছিল। জায়গাটা এখনো আবছা অন্ধকারাচ্ছন্ন। পার্থক্য শুধু তখন সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাইনি। তবে এখন দেখা যাচ্ছে। কারণ, এখন চারপাশে আগের তুলনায় অন্ধকারে ছেয়ে আছে বলে অল্পস্বল্প দূর হতে আসা আলোতে জায়গাটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
নাঈমা চোখ ঘুরিয়ে জায়গাটা অবলোকন করে জিজ্ঞেস করলো,

” আমাকে এখানে কেন এনেছিস? ”
নাঈমার হাত ছেড়ে দিল আগুন। বুকে হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়ায়।
” যাত্রা তো এখান থেকে তুই শুরু করেছিস। ভাবলাম, আমি না হয় শেষটা এখানেই করি। ”
” মানে? কি বলতে চাস তুই? ফোনে না বললি তুই আমাকে মেনে নিবি! ”
” মেনে নিবো কখন বললাম? বলেছি হিসাব বরাবর করতে চাই। ”
” কিসের হিসাব? ”
” বাদ দে! তোর সোনারগাঁওয়ে আসার কারণটা কি জানতে পারি? ”
নাঈমা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
” অফ কোর্স, তোর কাছাকাছি থাকার জন্য। ”

মৃদু হাওয়ার প্রকোপে গাছের লতাপাতা নড়ছে, সেই সাথে নাঈমার উন্মুক্ত চুল। আগুন কয়েক কদম এগিয়ে নাঈমার মুখশ্রীতে পড়ে থাকা চুল কানের পিঠে গুঁজে দেয়। নাঈমার মন শিহরণে পুলকিত হলো। আবেশে নেত্রদ্বয় বন্ধ করে ফেলে। আগুন বাঁকা হাসল। আগুনের হাত কাঁধ বেয়ে হঠাৎ নাঈমার পেছনের চুল শক্ত করে মুঠো করে ধরল। চুলে টান লাগায় মাথায় ব্যথা অনুভব হতেই সুখে ভাসা নাঈমা ফট করে চোখ খুলে তাকায়। আগুন রক্তিম চোখে নাঈমার দিকে চেয়ে আছে। ক্ষুধার্ত সিংহের মতো গর্জন করে হুংকার ছেড়ে বলে,
” মোম’কে মারতে চাচ্ছিলি কোন সাহসে? তোর যদি কোনো অভিযোগ বা রাগ থেকে থাকে তাহলে সেটা আমার উপর দেখাতি। আমার স্ত্রী’কে আঘাত করার স্পর্ধা কোথা থেকে পেলি তুই? ”
নাঈমা তাচ্ছিল্য হেসে জবাব দিল,

” ওহহো! তারমানে তুই প্রতিশোধ নিতে আমাকে ডেকেছিস? ”
” প্রতিশোধ কেন নিবো? বললাম না, হিসাব বরাবর করবো! ”
বলেই পুরুষালী শক্তপোক্ত হাতে সজোরে থাপ্পড় মারলো নাঈমার নরম গালে। থাপ্পড়ের চোটে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেল৷ রাগান্বিত চোখে আগুনের দিকে দৃষ্টি তাক করতেই আবারও নরম গালে শক্ত হাতের থাপ্পড় পড়ল। থাপ্পড়ের জন্য নাঈমার ঠোঁটের কোণা ফেটে চিকন ধারায় রক্ত বের হতে শুরু করল। মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে লাগলো। চারপাশ ঝাপসা, ঘোলাটে লাগছে৷
আগুন চোয়াল শক্ত করে, তেড়ে এসে নাঈমার কনুই চেপে পেছন দিকে নিয়ে মুচড়িয়ে ধরে। ব্যথায় নাঈনার চোখ দুটো জলে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছে। নাকের পাটাতন ফুলিয়ে রক্তিম চোখে চেয়ে আগুন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,

” বল, মোম’কে কেন মারতে চাচ্ছিলি? সে তোর কি ক্ষতি করেছে? কেন পড়ে আছিস ওই নিষ্পাপ মেয়েটার জীবনের পিছনে? ”
যন্ত্রণায় নাকমুখ বিকৃত করে ফেলল নাঈমা। তেজি গলায় চিৎকার করে বলে ওঠে,
” কারণ, ওই মেয়েটা আমার একমাত্র পথেরকাঁটা ছিল। ওর জন্যই তো তুই আমাকে পাত্তা দিচ্ছিলি না। আমাকে বারংবার রিজেক্ট করেছিস! ওই অপয়া মেয়েটার জন্য আজ তোর আর আমার মধ্যে এতটা দূরত্ব! ”

” মোম’কে তুই দোষ দিচ্ছিস? লাইক সিরিয়াসলি? ব্রেইনলেস, ডার্টি গার্ল! আ রে, মোম আমার লাইফে আসার আগে থেকেই তো আমি তোকে ইগনোর করতাম। তোকে তো আরও একবার বলেছিলাম, মোমের সাথে আমার বিয়ে না হলেও আমি কক্ষনো তোকে বিয়ে করতাম না। তাহলে ওই মেয়েটা তোর পথেরকাঁটা কিভাবে হলো? ওকে দোষারোপ করিস কিসের ভিত্তিতে? আর তুই এতটাই নিচুতে নেমে গিয়েছিস যে, বাচ্চা মেয়েটাকে এভাবে আঘাত করতে তোর বুক কাঁপলো না? তুই নিজেও তো একজন মেয়ে। একবারও মনে হয়নি, ও তোর ছোট বোনের মতো? কিভাবে পারলি আমার পিচ্চিটা’কে এতটা কষ্ট দিতে? ”
আগুন আবারও নাঈমার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। নাঈমা লম্বা শ্বাস টানল। মানসিক রুগীদের মতো ক্রুর হেসে বলল,

” মেরেছি বেশ করেছি। তোদের দুজনের এমন আলগা পিরিত আমার জাস্ট সহ্য হচ্ছিল না। এখানে শুধু তোর কাছাকাছি থাকার জন্য আসিনি, তোর বউয়ের ক্ষতি করার জন্যই এসেছি। তোর বউয়ের ক্ষতি করার চিন্তা আরও আগেই মাথায় এসেছিল। সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এখানে এসে তক্কে তক্কে ছিলাম, কখন তোর বউকে একা পাবো। দূরত্ব বজায় রেখে এতদিন তোদের উপর নজর রাখছিলাম৷ ফাইনালি একটা সুযোগ হাতে পেয়েছিলাম, বাট ওই ইডিয়ট রাফি এসে সব প্ল্যান ভেস্তে দিল! ”
বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে পাগলের মতো হো হো করে হাসতে লাগলো।
” তারমানে সন্ধ্যায় একদল লোক আমার চারপাশে ঘিরে ধরেছিল, তারা তোর ভাড়া করা ছিল? যাতে ভীড়ের মাঝে তুই এক ফাঁকে মোম’কে নিয়ে যেতে পারিস? ”
নাঈমা চওড়া হাসি দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। ”

আগুন রাগে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে নাঈমার তল পেট বরাবর লাথি মেরে দিল। গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল নাঈমা। ব্যথার দরুন মুখ দিয়ে তরল লালা বেড়িয়ে গড়িয়ে পড়ল চিবুকে। আগুন ধাক্কা দিয়ে নাঈমাকে নিচে ফেলে দেয়। ছোট ছোট পাথরের টুকরোতে মুখ থুবড়ে পড়ে, ফর্সা মুখশ্রীর নরম চামড়া নানান জায়গায় থ্যাতলে গিয়েছে! সেখান থেকে পানির কণার মতো ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত বের হচ্ছে। আগুন গাছের একটা শুকনো ডাল কুড়িয়ে এনে সেটা দিয়ে আকষ্মিকভাবে এলোপাতাড়ি নাঈমার শরীরের উপর একের পর এক আঘাত করতে থাকে। নাঈমা ধুলোবালিময় মাটিতে গড়াগড়ি করে চিৎকার করছে! আগুন সর্বশেষ মাথায় আঘাত করল। ডালটা শুকনো ছিল বলে, মাথার শক্ত খুলির উপর পড়ায় ভেঙে গেল।

আগুন দু কদম পিছিয়ে গিয়ে মাটিতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। নাঈমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চেঁচিয়ে বলল,
” বা*ন্দির বাচ্চা! তোর শরীরের এত জ্বালা হলে, আমাকে বলতি। আমি তোকে নিষিদ্ধ পল্লীতে রেখে আসতাম। এত বছরের নিয়ম ভঙ্গ করে আজ প্রথম তোর মতো নারী নামের কলঙ্ক একজন মেয়ের গায়ে হাত তুলেছি। সেটা করতে তুই আমাকে বাধ্য করেছিস! বলেছিলাম না? এমন কিছু করিস না, যাতে তোর গায়ে হাত তুলতে আমাকে দ্বিতীয় বার ভাবতে না হয়! বলেছিলাম কি না? তবুও তুই এই জঘন্যতম কাজটা কিভাবে করতে পারলি? ”
নাঈমা হাঁপাচ্ছে। আগুন পুনরায় একই ভঙ্গিতে বলল,

” যতটা আঘাত, কষ্ট তুই আমার কোমলমতি’কে দিয়েছিস? তার থেকেও হাজার গুণ যন্ত্রণা তোকে ফিরিয়ে দিবো আমি। তোর জীবন আমি নরক বানিয়ে ছাড়বো। আমাকে এখনো তুই চিন্তে পারিসনি। শুধু বন্ধুত্বই দেখেছিস, রাগ দেখিসনি! ছোটবেলা থেকে আমি আমার সকল জিনিস নিয়ে বড্ড সিরিয়াস ছিলাম। সেখানে কোমলমতি তো আমার কলিজা! আমার কলিজায় আঘাত করেছিস, তোকে এত সহজে ছেড়ে দেই কিভাবে বল? তুই মোম’কে মারতে চেয়েছিলি, তাই না? আমি বলছি, আজ এই সোনারগাঁওয়ের মাটিতে তোর সমাধি দিয়ে তবেই আমি ক্ষান্ত হবো! মেরে এমন জায়গায় তোর লাশ লুকাবো, যেন কাকপক্ষী তোর লাশ ঠুকরে খাওয়ার জন্য খুঁজে না পায়! পুলিশের ভয় আমি পাই না। তোকে খু*নের দায়ে আমাকে জেলে যেতে হলে যাবো। এপর্যন্ত বাবার টাকায় কখনো ফুটানি মারিনি। তবে এখন যদি বাবার টাকায় নিজেকে বাঁচানোর জন্য তোর মৃত্যু ধামাচাপা দিতে হয়, দরকার হলে তাই দিবো। আর তুই ভালো করেই জানিস, আমার বাবার সেই ক্ষমতা আছে। ”

আগুনের দীপ্তিশীল ধমকিতে নাঈমার আত্মা কেঁপে উঠে। আগুন উঠে দাঁড়ায়। রাগে শরীর থরথর করে কাঁপছে। চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল হয়ে রয়েছে। মুখটা হিংস্র জন্তুর ন্যায় দেখাচ্ছে। এই বুঝি শিকার পেলে আক্রমণ করবে! এর আগে কখনো আগুনের এমন রুপ দেখেনি নাঈমা। কাঁপা গলায় অনুরোধ করে বলল,
” আমাকে যেতে দে আগুন। আমি এমন কাজ আর কক্ষনো করবো না। আমাকে মারিস না। ”
” সেই সুযোগ তোকে দিলে তো! মনে পড়ছে নাঈমা? আমার বাচ্চা বউটাও তোকে আকুতিভরা মন নিয়ে আর্জি জানিয়েছিল, তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তুই দিয়েছিলি? দিসনি! তাহলে আমি তোকে মুক্তি দিবো, সেটা আশা করিস কিভাবে? ”

বলেই আগুন শব্দ করে হেসে ফেলল। যাকে বলে দমফাটা হাসি। আগুন সচারাচর শব্দ করে হাসে না। হাসলেও সবসময় মুচকি হাসি দেয়। নাঈমা শুষ্ক ঢোক গিলল। রাতের বেলা এই নিস্তব্ধতা বিরাজমান জায়গায় আগুনের হাসিটা কেমন ভুতুড়ে শোনাচ্ছে৷ সুদূরে নেড়ি কুকুরের দল হাঁক ছেড়ে ডাকছে। গা ছমছম করে উঠল নাঈমার!
আগুন আস্তে আস্তে হেঁটে নাঈমার নিকট এগিয়ে আসে। নাঈমা এক হাতে পেট চেপে, অন্য হাতে মাটিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ক্রন্দনরত হতবিহ্বল রক্তাক্ত মুখে, অসহায় চোখে আগুনের দিকে চেয়ে ছোট কদমে পেছাতে থাকল। পেছাতে পেছাতে একটা বড়সড় গাছের সাথে পিঠ ঠেকে গেল। আগুন বলিষ্ঠ হাতে গাছের সাথে মাথা লাগিয়ে নাঈমার গলা চেপে ধরে। কন্ঠনালীর উপর শক্তপোক্ত চাপ পড়ায় চোখ দুটো যেন কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসবে এক্ষুনি! ইতোমধ্যে নাঈমার জিহ্বা কিঞ্চিৎ বেরিয়ে এসেছে। সমান তালে মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে। পা নাড়াতে পারছে না! কারণ, আগুন জুতো দিয়ে দুই পা পিষে ধরেছে। শুধু হাত দুটো আছড়াচ্ছে! নাঈমার প্রাণপাখী যায় যায়, সেই মুহূর্তে রাফি এসে আগুন’কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নাঈমার থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আগুনের শরীরের যেন আজ অশরীরী আত্মা ভর করেছে। যার দরুন রাফি নিজেও বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আগুনের সাথে পেরে উঠছে না!

হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ পর পুনরায় আগুন’কে হন্তদন্ত হয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে, রাফি আগুনের পিছু নেয়। আগুন, নাঈমার কথোপকথন রাফির কানে পৌঁছেছে। রাফির মা ফোন করায় সে ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল। কথা শেষ করে ফিরে এসে দেখে, যা অঘটন ঘটার ঘটে গিয়েছে।
অনেক চেষ্টার পর নাঈমার থেকে আগুন’কে সরিয়ে নিতে সক্ষম হলো রাফি। আগুন রাগে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস শব্দ তুলছে। অশ্রাব্য ভাষায় নাঈমা’কে গালাগালি করছে। রাফি আগুন’কে শান্ত করতে বলল,

” স্যার ভাবি তো অসুস্থ। সে রুমে একা আছে। তার আপনাকে প্রয়োজন। কি করতে যাচ্ছিলেন? আর একটু হলে উনি মারা যেতো। ”
আগুন তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে জানায়,
” ওর মরে যাওয়াই উচিত। ”
শান্তশিষ্ট মানুষ হুট করে রেগে গেলে ভয়ংকর রুপ ধারণ করে। আগুন’কে এতটা রেগে যেতে রাফি কখনো দেখেনি, আর না নাঈমা। রাফি আরও কিছু কথা বলে বুঝিয়ে শুনিয়ে, ঠেলেঠুলে আগুন’কে হোটেলে পাঠিয়ে দিল। আগুন যাওয়ার আগে নিরব ধমকিতে, তর্জনী উঁচিয়ে নাঈমা’কে শাসাতে ভুলল না।
রাফি এসে নাঈমা’কে ধরে। ওর মুখের দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

” একটা সত্যি কথা বলি ডাক্তার ম্যাডাম? আমি আপনাকে বেশ কয়েক মাস আগে থেকে পছন্দ করি। আগুন স্যার চাকরিতে জয়েন হওয়ার পর থেকে কলেজে আপনার আনাগোনা ছিল। তখন আপনাকে দেখে ভালো লেগে যায়। আমি প্রথমে মনে করে ছিলাম আপনারা দুজন দুজনকে ভালোবাসেন। তাই আপনাকে মুখ ফুটে আমার মনের কথা বলার সাহস পাইনি। পরবর্তিতে বুঝতে পারলাম, আপনি আগুন স্যারকে পছন্দ করলেও সে আপনাকে করে না। আর আজকে যা নিজের চোখে দেখেছি, যতটুকু নিজ কানে শুনতে পেলাম, এতে একটা ব্যাপার ক্লিয়ার। আগুন স্যারের জীবনে আপনার কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধু বন্ধু ছিলেন আপনি তার, হয়তো আজকের ঘটনার পর সেটাও রইলেন না! ”
নাঈমা চোখ ভর্তি পানি নিয়ে পিটপিটিয়ে চাইল। রাফি মুচকি হেসে পুনরায় বলল,

” আপনার আজকের কাজের জন্য, আমার মনে আপনার জন্য যে সম্মান ছিল? সেটা নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। ওই ছোট্ট মেয়েটা’কে আপনি মারতে চাচ্ছিলেন? যাকগে, আপনি আমার প্রথম অনুভূতি যা আমি চাইলেও কখনো ভুলতে পারবো না। তবে আমি মনে প্রাণে চাইবো, আপনার মতো টক্সিক টাইপের মেয়ে যেন কারো জীবন সঙ্গী না হয়! কারো ভাগ্যে যাতে আপনার মতো মেয়ে না জুটে। কাউকে ভালোবাসা অন্যায় না, ভালোবেসে পাগলামো করাটাও ভুল না। কিন্তু একতরফা ভালোবেসে রাগের বসে কারো ক্ষতি করা চরম অন্যায়! ভুল মানুষকে ভালোবেসে পাগলামো করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। যা হয়েছে ভুলে যান৷ কাল নতুন সূর্য ওঠার সাথে সাথে নিজের জীবনটাও নতুন ভাবে গুছিয়ে নিন। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। আশাকরি আপনি পারবেন নিজেকে সামলে নিতে। ”

হোটেলের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল আগুন। দরজা লক করে হাতে থাকা প্যাকেট বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলে রেখে, পুরো রুমে নজর বোলালো। থেমে থেমে নাক টানার শব্দে সেদিকে ঘুরে চাইল। মোম ফ্লোর পা ছড়িয়ে খাটের কোণার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিকে তাকায় মোম। আগুন’কে একপলক দেখে মুখ ফিরে নিলো। একদম কথা বলবে না লোকটার সাথে। খারাপ লোক! মোম’কে ব্যথা দিয়েছে। আগুন নিঃশব্দে এগিয়ে এসে টুপ করে কোলে তুলে নিলো। মোম হকচকিয়ে যায়। পড়ে যাওয়ার ভয়ে নড়বড়ে পেলব দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে। আগুনের দিকে চেয়ে অভিমানে পুনরায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

আগুন আস্তেধীরে মোম’কে বিছানায় বসিয়ে দিল। প্যাকেট টা হাতে নিয়ে ভেতর থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার টুকটাক জিনিসপত্র বের করল। আসার সময় ফার্মেসি দোকান থেকে নিয়ে এসেছিল। গম্ভীর মুখে চুপ করে তুলার সাহায্যে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত পানি দিয়ে মুছে নিলো। ক্ষত স্থানে এন্টিসেফটিক লাগিয়ে কপালে ব্যান্ডেজ করে দিল। থুতনি, পায়ের পাতা তে ব্যথানাশক মলম লাগিয়ে দেয়।
এটা কি হচ্ছে? লোকটা চুপ করে আছে কেন? কড়া কথা কেন শোনাচ্ছে না? ধমক কেন দিচ্ছে না? এতক্ষণে তো ধমকে ধমকে মোমের শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার কথা! মোম ভেবেছিল কুমড়োটার সাথে কথা বলবে না। এখন এই কুমড়ো মার্কা লোকই ওকে পাত্তা দিচ্ছে না! এটা তো ঘোর অন্যায়!
মোমের ঠোঁটের রক্ত মুছছে সে। কাটা জায়গায় পানি লাগায় জ্বলন অনুভব হলো। মোম মুখ কুঁচকে জানায়,

” জ্বলছে। ”
আগুন ঝুঁকে আসে। ঠোঁট দুটো গোল করে ফু দিচ্ছে। মোম চোখ বন্ধ করে ফেলল। গলাতে আলতো করে এন্টিসেফটিক লাগিয়ে দিল। ফর্সা চামড়া কেমন কালচিটে দাগ বসে গিয়েছে! চিকিৎসার কার্যক্রম সম্পূর্ণ করে, মোমের পেছনে এসে দাঁড়ায়। লম্বা চুল এলোমেলো হয়ে আছে। চিরুনি দিয়ে আঁচড়ালো না, হাতের আঙুল চালিয়ে আলতো করে গুছিয়ে দিয়ে খোঁপা বেঁধে দিল। চিরুনি দিয়ে আঁচড়ালে চুলে টান পড়বে, তখন মাথায় ব্যথা পেতে পারে। খোঁপার বয়স এক মিনিটও হতে পারলো না, তার আগেই খুলে গেল।

মোমের হাসি পেলো। অধর ছড়িয়ে হাসতে না পারলেও অধর চেপে মিটিমিটি হাসল। আগুন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মোম তুরন্ত মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে ফেলে। আগুন ব্যাগ হাতরিয়ে ছোট একটা হেয়ার ব্যান্ড পেলো, সেটা দিয়ে কোনো রকম ঝুঁটি বেঁধে দিল।
রুটি ছিঁড়ে মোমের মুখের সামনে ধরল। মোম মৃদুস্বরে বলে,
” গলা ব্যথা করছে। ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। এগুলো খেতে পারবো না। ”
আগুন উঠে দাঁড়ায়। ফটাফট বাইরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর হাতে স্যুপের বাটি নিয়ে ফিরে আসে। গরম গরম স্যুপ চামচ দিয়ে তুলে, ফু দিয়ে ঠান্ডা করে মোমের ঠোঁটের সম্মুখে তুলে ধরে। মোম ঠোঁট ফাঁকা করে খেতে যেয়েও থেমে গেল।

” আপনি খাবেন না? ”
আগুন উত্তর দিল না। মোম ত্যাড়া কন্ঠে সল্প আওয়াজে বলল,
” আপনি না খেলে আমিও খাবো না। ”
স্যুপের বাটিতে নজর রেখে গমগমে গলায় আগুন বলে,
” চুপচাপ খেয়ে নাও। খেয়ে ঔষধ খেতে হবে। কথা না শুনলে রুম থেকে বেরিয়ে যাবো। ”
মোম পাল্টা কিছু বলতে পারলো না। চুপ করে খেয়ে নিলো। বালিশ ঠিক করে মোম’কে ধরে শুইয়ে দিল। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতেই মোমের চোখে তন্দ্রা লেগে গেল।

সোনারগাঁয়ের নিস্তব্ধ রাত, আকাশে তারারা জ্বলজ্বল করছে। প্রকৃতিতে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। রাস্তায় জনমানুষের তেমন দেখা নেই। বেশ কিছু গাড়ি এখনো চলাচল করছে। আগুন বারান্দা থেকে রুমে চলে আসে। রুমের লাইট বন্ধ। খোলা জানালে দিয়ে বাইরে থেকে আলো এসে রুমটা অল্প আলোকিত করে তুলেছে। মোম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আগুন এসে মোমের উপর আধশোয়া হলো। আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল। আচমকা মোমের কপালে কপাল ঠেকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। আবেগ সমেত বলে উঠলো,
” আই এম রিয়েলি সরি টু স্যা মাই কোমলমতি। আমি তোমাকে প্রটেক্ট করতে ব্যর্থ হয়েছি। প্রয়োজনে পাশে থেকে সাপোর্ট করতে পারিনি। প্লিজ ফরগিভ মি। ”

আগুন বুঝদার হওয়ার পর থেকে শেষবার মায়ের অসুস্থতায় সকলের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে কেঁদে ছিল। এত বছর পর আবার আজকে কাঁদছে। কান্নার কোনো শব্দ নেই অথচ নিরবে নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে! আগুনের চোখের নোনতা পানি মোমের ভ্রুর উপর পড়ে, সেখান থেকে গড়িয়ে চোখে পড়ছে। মোমের তন্দ্রা ছুটে যায় কারো ফোঁপানোর শব্দে। আবছা আলোতে আগুনের ক্রন্দনরত মুখশ্রী খুব ভালো ভাবেই দেখতে পারছে মোম। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল কিয়ৎকাল। পরমুহূর্তেই আগুনের পিঠে এক হাত রেখে শব্দ করে কেঁদে ওঠে। আগুন তড়িৎ গতিতে মাথা উঠায়। গালে হাত দিয়ে উদ্বিগ্ন সমেত জানতে চাইল,

” ব্যথা করছে? যন্ত্রণা হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো আমায়? ”
আগুনের হাত টেনে মোম বুকের বাম পাশে রেখে জানালো,
” এখানে কষ্ট হচ্ছে। এবার বলুন, আপনি কাঁদছিলেন কেন? ”
আগুন থমথমে খায়। এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে রাশভারী কন্ঠে বলল,
” কোথায় কাঁদছি? কাঁদবো কেন? কাঁদার কি আছে? অদ্ভুত! ”
মোম হাত বাড়িয়ে আগুনের চোখে ছুঁয়ে দেয়। আগুনের চোখের নোনাপানি মোমের আঙুলে লেগে গেল। মোম মুচকি হাসে। আগুন সরে যেতে চায়, মোম আটকে দিল। আগুনের দু’গালে হাত রেখে লাজ লজ্জা ভুলে তার কপালে খসখসে ঠোঁট দ্বারা দৃঢ় চুম্বন করল। আগুন চোখ বুঝে ফেলে। ভারিক্কি নিঃশ্বাস ছেড়ে মোম বলে,
” ভালোবাসি। ”

আগুন প্রতিত্তোর করতে পারলো না। হুট করে টেনে ধরল মোমের শুষ্ক ঠোঁট জোড়া। পাগলের মতো ছুঁয়ে যাচ্ছে, যেন কত সময় ধরে তৃষ্ণার্ত ছিল সে। কাটা স্থানে আগুনের ঠোঁটের ঘর্ষণে ব্যথা পলেও মোম টু শব্দ করল না। সহ্য করে নিলো। ঠোঁট ছেড়ে লম্বা শ্বাস টেনে আগুন ধীরেধীরে শান্ত হলো। বালিশে শুয়ে পড়ল। মোম আগুনের বুকে মাথা রাখতে চায়, কিন্তু আগুন দিল না। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
” ব্যথা পাবে। বালিশে শুয়ে পড়ো। ”
মোম জেদ দেখিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
” পাবো না ব্যথা। বুকেই ঘুমাবো। ”
” আবার ত্যাড়ামি করছো? ”
” হ্যাঁ, করছি। তো? ”

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩২

আগুন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। মোম নিমেষেই প্রসস্থ বুকে লেপ্টে শুয়ে পড়ল। পরপরই চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। বুকের সাথে থুতনি, কপাল লাগায় ব্যথা করছে। বরং বালিশে সটান হয়ে শুলে ব্যথা পেতো না। মোম এই ক্ষুদ্র ব্যথাকে পাত্তা দিল না। মোম জানে আগুন তখন ওর জন্যই কাঁদছিল। লোকটা মুখে স্বীকার না করলেও, মোম বুঝতে পারে সে তাকে কতটা ভালোবাসে। মৃদু হেসে আগুন’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করল।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৩