শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩৩
সুমাইয়া সুলতানা
রাতের ঘুটঘুটে আঁধার সরে গিয়ে সকালটা ধীরে ধীরে জাগ্রত হয় তার রোজকার নিয়মে। ভোর পাখিরা মিষ্টি সুরে কলকলিয়ে গান গাইতে শুরু করে তখন। এই ভোর পাখিদের মতো ধরিত্রীর বুকে এক চঞ্চল কিশোরী সকাল সকাল উঠে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। আগুন তড়িঘড়ি করে দৌড়ে আসে। সে ব্রেকফাস্ট আনতে নিচে গিয়েছিল। মোমের চিৎকারে ব্রেকফাস্ট না নিয়েই মাঝ পথ থেকে ছুটে আসে। উত্তেজিত কন্ঠে শুধায়,
” কি হয়েছে? চিৎকার করছো কেন? শরীরের কোনো অংশে ব্যথা করছে কি? ”
মোম কটমট করে জিজ্ঞেস করলো,
” আমার গায়ের পোশাক পাল্টেছে কে? গায়ে তো অন্য জামা ছিল। ”
আগুন গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
” আমি তোমার ড্রেস চেঞ্জ করেছি। ”
মোম চোখ বড়ো বড়ো করে শুধাল,
” আপনি করেছেন? কেন করেছেন? ”
” কেন করবো না? কালকের জামায় রক্ত লেগে ছিল, সেটা পড়ে থাকতে নাকি? ”
মোম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
” তাই বলে আপনি আমার জামা পাল্টে দিবেন? ”
আগুন চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। রাশভারী গলায় বলে,
” আমি ছাড়া এখানে আর কে আছে যে তোমার ড্রেস চেঞ্জ করবে? ”
মোমের মুখটা চুপসে যায়। বার কয়েক পলক ঝাপটায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” কখন করেছেন? ”
” রাতে, যখন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে। ”
” আপনার এত কষ্ট করার কি দরকার ছিল? আমাকে ডাকলে আমি নিজেই জামা পাল্টে নিতাম। ”
আগুন ফোঁস করে শ্বাস টানে। গমগমে গলায় বলে,
” একটু সুস্থ হয়েছো কি হওনি, তোতাপাখির মতো বুলি আওড়ানো শুরু করে দিয়েছো? ”
মোমের ব্যথা আগের তুলনায় অনেক কমে গিয়েছে। তবে আঘাত পাওয়া স্থান এখনো তরতাজা। আঘাতের জায়গায় চারপাশের চামড়া কুঁচকে জটলা বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে। আশাকরা যায় খুব শীগ্রই ক্ষতস্থান শুকিয়ে যাবে। মরা চামড়া উঠে গিয়ে স্বাভাবিক চামড়ার দেখা মিলবে।
মোম চঞ্চল কন্ঠে ঠোঁট উল্টে জবাব দিল,
” আপনি কি চান আমি চুপ করে থাকি? আমার কি বাকস্বাধীনতা নেই? আমি কথা বলবোই। আমি তো আর আপনার মতো কুমড়ো মার্কা লোক না, যে সারাক্ষণ গম্ভীর মুখে বসে থাকবো। ”
আগুন বিরক্তিকর মুখভঙ্গিতে বলে,
” এসব লেইম কথাবার্তার জন্য এভাবে চিৎকার করছিলে? কুমড়ো মার্কা লোক মানে? কি সব ভাষা বলো তুমি? কার থেকে এসব শিখেছ? আর আমি তোমাকে বাকস্বাধীনতা দেই না বলছো? আচ্ছা, বলো। তোমার যতক্ষণ মন চায়, একা একাই বকবক করো। আমি চললাম। ”
আগুন আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। ত্রস্ত পায়ে প্রস্থান করল। মোমের ওষ্ঠ কিঞ্চিৎ ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। ব্যাপার টা কি হলো? আগুন কি তাকে ইনডিরেক্টলী অপমান করল? মোম’কে কিছু বলতে না দিয়ে এভাবে ভাব নিয়ে চলে গেল? আশ্চর্য লোক তো! মোম ভেঙচি কাটে। বিড়বিড় করে আগুন’কে বকে দেয়।
হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে রাফি’কে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, আগুন তার নিকট এগিয়ে যায়। রাফি অন্যমনস্কভাবে বাইরের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে তাকিয়ে আছে। আগুন পাশে এসে দাঁড়াল। গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কি নিয়ে চিন্তা করছেন, মিস্টার রাফি? ”
রাফির ধ্যান ভাঙে। চক্ষুদ্বয় দৃষ্টি ঘুরিয়ে সরাসরি নজর রাখল আগুনের আদলে। আগুন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। রাফি স্মিথ হেসে জানালো,
” কিছু নিয়ে চিন্তা করছিলাম না। ভাবীর শারীরিক অবস্থা কেমন? ”
” আগের থেকে বেটার। ”
” একটা কথা বলবো? ”
” দ্বিধাবোধ করছেন কেন? বলে ফেলুন। ”
” কালকে আপনাকে দেখে আমি ছেলে হয়েও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আল্লাহ! কি রাগ আপনার! ডাক্তার ম্যাডাম’কে ভালোই শাস্তি দিয়েছেন। বেচারি মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছে। ”
আগুন ভরাট কন্ঠে বলে,
” নাঈমার ব্যাপারে আমি কিছু শুনতে চাই না। আপনি যদি এই ঘটনাটা ভুলে যান এবং কারো সাথে এই ঘটনার কথা শেয়ারিং না করেন, তাহলে খুশি হতাম। ”
” হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি কারো সাথে শেয়ার করবো না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। ”
” সবাই ব্রেকফাস্ট করে ফেলেছে? ”
” জ্বি, আমি এখনো ব্রেকফাস্ট করিনি। ”
” চলুন, ব্রেকফাস্ট করে নিবেন। ”
রাফি অধর কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে জানায়,
” খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি খেয়ে আসুন। ”
” অ্যাজ ইউর উইশ। ”
আগুন চলে আসার জন্য পা বাড়ায়। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে থেমে যায়। পেছন ঘুরে আবার রাফির পাশে এসে দাঁড়ায়। রাফি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। আগুন সহসা রাফি’কে জড়িয়ে ধরল। পিঠ চাপড়ে সন্তুষ্টি হেসে বলল,
” থ্যাংকস মিস্টার রাফি। আই এম রিয়্যালি গ্রেট ফুল টু ইউ। ”
রাফি অবাক হয়ে জানতে চাইল,
” কৃতজ্ঞতা জানানোর কারণ? ”
আগুন সরে আসে। গভীর দৃষ্টিতে রাফির দিকে চায়। তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।
” আপনি সময় মতো না আসলে, কালকে আমার ওয়াইফের ভালোমন্দ কিছু হয়ে যেতে পারতো। আই নৌ দ্যাট, এই ছোট্ট থ্যাংকস টা যথেষ্ট নয়! বাট তবুও থ্যাংকস অ্যা লট্। ”
রাফি ঠোঁট এলিয়ে হাসল। উৎফুল্ল চিত্তে বলে,
” ইটস মাই প্লেজার স্যার। একজন মানুষ হিসেবে আমার যা মনে হয়েছে সেটা করেছি। ভাবী আমার ছোট বোনের মতো। তাছাড়া, ভাবীর জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে থাকলে আমি তাকেও হেল্প করতাম। ধন্যবাদ দেওয়ার দরকার নেই। ”
” আসছি। মোম’কে ব্রেকফাস্ট করিয়ে মেডিসিন খাওয়াতে হবে। ”
রাফি মাথা ঝাঁকাল। আগুন চলে যায়। রাফি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে আকাশে সাদা মেঘের দিকে দৃষ্টি রাখে। সেখানে নজরে আসছে, একটা পাখি একা একা উড়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে রাফি জানে না। আচ্ছা, পাখিটা কি শুরু থেকেই নিঃসঙ্গ? নাকি কেউ ছিল তার সাথে? মাঝপথে এসে পাখিটা’কে একা রেখে চলে গিয়েছে কি? হ্যাঁ অথবা না! উত্তর নেই রাফির কাছে। রাফিও তো স্বল্প সময়ের মধ্যে কারো মায়ায় আটকে ছিল। কারো সঙ্গ পাওয়ার তীব্র বাসনা মনে লালন করেছিল। কাউকে একান্ত নিজের করে একজন থেকে দুজন হতে চেয়েছিল। সেটা আর হলো কই? পাখির মতো সেও উন্মুক্ত ভূপৃষ্ঠে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাল নাঈমার শারীরিক অবস্থা দেখে বুকের গহীনে এক চাপা কষ্ট অনুভব করছিল। যতোই কড়া কথা শোনাক না কেন? সত্যি এটাই রাফি এখনো নাঈমা’কে ভালোবাসে। ফাস্ট ফিলিংস, ফাস্ট লাভ বলে কথা! এত সহজে ভুলে যাওয়া যায় নাকি?
কাল আধমরা নাঈমা’কে নিয়ে গিয়ে কাছাকাছি একটা হসপিটালে ট্রিটমেন্ট করিয়ে ছিল রাফি। নাঈমার থেকে ফোন নাম্বার কালেক্ট করে নাঈমার বাবাকে ফোন করে নাঈমার অসুস্থতার কথা জানায়। কিভাবে আহত হয়েছে, সে কথা বলেনি। শুধু বলেছে, নাঈমা অনেক অসুস্থ। রাফি, নাঈমা’কে বাসে উঠিয়ে দিবে, আর নাঈমার বাবা যেন তাকে রিসিভ করতে চলে আসে। ট্রিটমেন্ট করিয়ে, নাঈমা’কে বাসে তুলে দিয়ে, রাফি হাসি মুখে বিদায় জানায়। অতঃপর হোটেলে ফিরে আসে।
আগামীকাল সকাল বেলা সকলে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। সোনারগাঁওয়ে কাটানোর শুধু আজকের সময় টুকুন হাতে আছে। তাই যে যার মতো ঘুরতে বেরিয়ে গিয়েছে। যদিও সবাই ঘুরতে বের হয়নি। কয়েকজন দম্পতি আর সিঙ্গেল কয়েকজন গিয়েছে। বাকিরা হোটেলে আছে।
সময়টা এখন বিকালের মধ্যভাগ। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। গরমের প্রখরতা কমে এসেছে। এমন একটি গোধূলি বেলায়, যখন দিন কেটে যায় এবং রাত আসে, তখন প্রকৃতির মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করে। আমাদের মনে তখন নতুন দিনের প্রত্যাশা জাগে। এই সময়টিতে জীবন যেন নতুন করে সজীব হয়ে ওঠে, এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের মনে একটি গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে।
রাত থেকে মোম হোটেলের রুমে রয়েছে। একবারের জন্যেও বের হয়নি। হবে কি করে? সে তো অসুস্থ, আর আগুন তাকে এ অবস্থায় বের হতে দিলে তো? যা যা প্রয়োজন আগুন সব এনে দিয়েছে। একবার বারান্দায় গিয়ে বসে থাকে, একবার রুমে আসে, তো একবার বিছানায় শুয়ে থাকে। এভাবেই এই পর্যন্ত সময়টা পার করেছে। কিন্তু এখন বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে। কতক্ষণই বা রুমে ভালো লাগে?
আগুন বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন টিপছে। ভ্রু যুগল কুঁচকানো। নিচের ঠোঁট কামড়ে একমনে কিছু দেখছে। মোম এসে আগুনের মাথার পাশে দাঁড়ায়। এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। হাত নাড়িয়ে আগুনের এ্যাটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করছে। আগুন চোখ তুলে তাকাল না। নিজের মতো ফোন দেখায় ব্যস্ত। মোম কন্ঠ খাদে এনে গলা দিয়ে উহুমম উহুমম করে শব্দ তুলল। লাভ হলো না। আগুন একবারো ফিরে তাকায়নি। এবার মোমের রাগ হলো। এমন তো নয় যে আগুন কানে কম শোনে? বা তার চোখে সমস্যা? তাহলে মোমের দিকে নজর দিচ্ছে না কেন? এত ভাব দেখায় কেন লোকটা? মোম ফুঁসে ওঠে টান দিয়ে আগুনের ফোনটা নিয়ে নিলো। আগুন সোজা হয়ে বসলো। বিরক্ত মুখভঙ্গিতে তাকায়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
” ফোন নিয়েছ কেন? এদিকে দাও। ”
” না দিবো না। ”
” কেন দিবে না? ”
মোম দাঁত চেপে কটমটিয়ে তাকায়। গোমড়া মুখে বলল,
” আমি কখন থেকে আপনাকে ডাকছিলাম, শুনতে পাননি? ”
” মিথ্যা কথা। তুমি আমাকে ডাকোনি। ”
” ডাকিনি মানে কি, হ্যাঁ? মুখের সামনে হাত নাড়ালাম। গলা খাঁকারি দিলাম, তবুও বলছেন ডাকিনি? ”
আগুন ভাবলেশহীন ভাবে জানায়,
” না ডাকোনি। এরকম করলে কিভাবে বুঝবো, তুমি আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছো? আমি তো জানি এরকম অদ্ভুত আচরণ যারা মৃগীরোগী তারা করে। ”
মোমের রাগ এবার আকাশচুম্বি! মোম’কে মৃগীরোগীর সঙ্গে তুলনা করল এই লোক? রাগে গিজগিজ করতে করতে আগুনের ফোনটা বিছানার উপর আছাড় মারল। নিজে বিছানায় উঠে এক পাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। আগুন ফোনটা হাতে তুলে নেয়। বউটা কত লক্ষী। আগুনের কতগুলো টাকা বেঁচে গেল। অন্য বউদের মতো ফোন ফ্লোরে আছাড় মারলে, আজকেই ফোনের শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করতে হতো! আগুন আড়ঁচোখে ওদিকে ফিরে শুয়ে থাকা অভিমানী বউয়ের দিকে তাকায়। ফোন সাইডে রেখে, মিটিমিটি হেসে মোমের নিকট এগিয়ে যায়। কোমর টেনে একদম নিজের সাথে লাগিয়ে নিলো। মোম ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে। আগুন শক্ত করে জড়িয়ে রাখল। মোমের কানের পিঠে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” এত রাগ ভালো না, পিচ্চি। এবার বলো, কি বলতে চাচ্ছিলে? ”
মোম উত্তর দিল না। গাল ফুলিয়ে রুমের দেয়ালের দিকে চেয়ে আছে।
” কি হলো? কথা বলছো না কেন? ”
মোম এবারেও নিশ্চুপ রইল। মোম’কে ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো আগুন। কপালে আলতোভাবে চুমু খেল। আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” বলতে বলেছি না? এরপর আমি রেগে গেলে সেটা তোমার জন্য খুব একটা ভালো হবে না। ”
মোম মুখ কালো করে তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলে,
” তখন তো শুনতে চাচ্ছিলেন না! তাহলে এখন জানতে চাচ্ছেন কেন? ”
” তখন শুনতে চাইনি, এখন তো চাচ্ছি? এবার বলো। ”
” বাইরে নিয়ে চলুন। রুমে থাকতে ভালো লাগছে না। দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে। ”
” কোথায় যেতে চাও? ”
” আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন। কিছুক্ষণ প্রকৃতির হৃদয় জুড়ানো হাওয়া গায়ে মাখতে চাই। ”
” গলাব্যথা এখনো আছে? ”
” অল্প। ”
” ঠিক আছে। ওঠো। ”
আগুন, মোম’কে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ওড়না টেনে সুন্দর করে মোমের মাথায় ঘোমটা দিয়ে দেয়। দুই ঘোমটা দেয়, যাতে গলা ভালো ভাবে ঢেকে নেওয়া যায়। মোমের চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে আগুন বলে উঠলো,
” মোম, তোমার সাথে ঘটা কালকের ঘটনা বাড়িতে কাউকে জানিও না প্লিজ। বাবা শুনলে ঝামেলা করবে। এমনিতেই আমার সাথে তার খামোখা মনোমালিন্য আছে। মাও আমাকে কথা শোনাবে, তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি কেন সেটা নিয়ে। তারা জানতে পারলে তোমার বাবা-মা কে ব্যাপারটা জানাবে। তখন তোমার বাবা-মা কষ্ট পাবে। ”
” বলবো না। ”
আগুন কিঞ্চিৎ মুচকি হাসল। মোমের গালে ঠোঁট ডুবিয়ে চুমু খেল। নাকে নাক ঘষে কোলে তুলে নিলো। দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটা ধরল। মোম হতভম্ব হয়ে গেল। আগুনের টি-শার্ট খামচে ধরে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তড়িৎ বেগে মৃদু আওয়াজে চেঁচিয়ে বলল,
” কোলে নিয়েছেন কেন? নামান বলছি। ”
আগুন হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিল,
” তুমি কি এখন পায়ে জুতো পড়তে পারবে? পারবে, তবে এক পায়ে। অন্য পায়ের পাতার উপরে চামড়াতে ক্ষত তো এখনো শুকায়নি। জুতার বেল্ট লাগলে সেটার ঘর্ষণে টান ধরা চামড়া উঠে গিয়ে নতুন ভাবে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। আর জুতো ছাড়া খালি পায়ে হাঁটলে, পায়ের তালুতে পাথরের ছোট খন্ড অথবা রাস্তার কাঁচের টুকরো ঢুকে আবার ব্যথা পাবে। ”
” আমি তো রাস্তায় যাবো না। ”
” নিচে তো যাবে? ”
” তো এখানে কিছু আছে নাকি? ”
” থাকতেই পারে। অবিশ্বাসের কিছু নেই। আমি তোমাকে নিয়ে আর কোনো রিস্ক নিতে পারবো না। ”
মোম অসহায় মুখভঙ্গিতে বলে,
” নিচে আপনার স্যারেরা থাকতে পারে। তারা কি ভাববেন বলুন তো? দয়াকরে নামিয়ে দিন।
” নামিয়ে দিবো। তবে নিচে গিয়ে। ”
” আমার কথাটা শুনুন। ”
” মাই কোমলমতি, ডোন্ট বী এক্সাইটেড! আমি এতটাও ম্যানারলেস মানুষ না যে প্রিন্সিপাল এবং সিনিয়র স্যারদের সামনে বউ’কে কোলে করে রাখব! ”
” তাহলে নামিয়ে দিচ্ছেন না কেন? ”
” দিবো তো। ওই দেখো, কয়েকজন স্যার টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ওনাদের থেকে কিছুটা দূরে নামিয়ে দিবো। তখন হেঁটে যেও। তুমি পায়ে ব্যথা না পেলে আশেপাশে আরেকটু ভালো ভাবে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতাম। ”
মোম তাকিয়ে দেখলো, ওদের থেকে অনেকটা দূরে মাঠের মতো একটা জায়গায় স্যাররা বসে আছেন। সেখানে কিছু সংখ্যক টবের মধ্যে ফুলগাছ লাগানো। কয়েকটাতে ফুল ফুটে আছে। জায়গাটাতে অনেকটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে রয়েছে। বিকেলের সময় বলে দেখতে চমৎকার লাগছে। মোমের মন পুলকিত হলো। খুশিতে দন্তপাটি বের করে হালকা হাসল। কাঁধে রাখা হাত উঠিয়ে আগুনের গলা প্যাঁচিয়ে ধরল। পলকহীনভাবে চেয়ে রইল আগুনের গম্ভীর হয়ে থাকা মুখশ্রীতে। কপালটা অল্প কুঁচকে আছে।
গভীর চোখ দুটো ভাসা ভাসা। কিঞ্চিৎ উঁচু গোলগাল নাকটা কত সুন্দর, নাকে বিন্দু বিন্দু ঘামের ক্ষুদ্র ফোঁটা দেখা যাচ্ছে। ঠোঁট দুটো যেন আর্ট করা। চাপ দাঁড়ি যুক্ত ফর্সা মুখশ্রীতে গোলাপী অধর জোড়া দারুণ মানিয়েছে। লোকটার গা থেকে সবসময় মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে আসে, যেটা মোম’কে মাতাল করে দেয়। মোমের মাস্টার মশাই একটু বেশিই সুন্দর। ফর্সা বলে নয়, মুখের গঠনটা’ই সুন্দর।
মোম কি কখনো ভেবেছিল, এই মানুষটা তার স্বামী হবে? কখনো কি মনে হয়েছিল তার বরটা দেখতে এতটা মিষ্টি টাইপের হবে? লোকটা কত যত্নশীল, কত ভাবে ওর জন্য। মোম তো ভাগ্যবান। সেজন্য এই কুমড়ো মার্কা লোকটা’কে স্বামী হিসেবে পেয়েছে।
মোম স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। ঠোঁট ছড়িয়ে এক পেশে হাসল। মুখ’টা এগিয়ে হুট করে আগুনের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যুক্ত গালে টুপ করে চুমু খেল। সহসা আগুনের চলমান পা থেমে যায়। হতবিহ্বল অক্ষিপট ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল মোমের দ্বিধাহীন মুখে। বিস্ময়ে চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। ঠোঁট জোড়া আপনা-আপনি কিঞ্চিৎ ফাঁকা হয়ে যায়। মোমের কোনো ভাবান্তর হলো না। তার মুখবিবর স্বাভাবিক। ঠোঁট উল্টে বলল,
” দাঁড়িয়ে পড়ছেন কেন? চলুন। ”
জিভ দ্বারা ঠোঁট ভেজায় আগুন। অবাক হয়ে জানতে চাইল,
” তুমি আমাকে চুমু দিয়েছো? সত্যি? ”
মোম লজ্জা পেলো। আবেগর বশে দিয়ে ফেলেছিল, তখন এত কিছু ভাবেনি। এখন কি উত্তর দিবে মোম? চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে আগুনের গলায় মুখ লুকিয়ে চুপ করে রইল। এদিকে আগুনের বক্ষতলে প্রেমের ঢেউ হানা দিয়েছে। পিঞ্জরে উতাল-পাতাল শুরু হয়ে গিয়েছে। মোমের কাঁধে মুখ নিয়ে শক্ত করে কামড় বসাল। মোম ঠোঁট চেপে মৃদু ব্যথাতুর আওয়াজ তুলল। আগুন পাত্তা দিল না। নিরেট স্বরে হুমকি স্বরুপ হিসহিসিয়ে জানালো,
শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৩২(২)
” কাজটা তুমি ঠিক করোনি। আমার বুকে আগুন জ্বালিয়ে মুখ লুকিয়ে বসে আছো? বাইরে আছি, নয়তো এর জবাব এক্ষুনি ফিরিয়ে দিতাম। টেনশন করো না, এর শোধ আমি নিবোই। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সী মাই কোমলমতি! ”