শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৩

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪৩
সুমাইয়া সুলতানা

ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে জীবন থেকে দু’বছর পেরিয়ে গিয়েছে। দু’বছরে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু। সময় সদা বহমান। কোনো শক্তি পারে না সময়কে ধরে রাখতে। হারিয়ে যাওয়া সব সম্পদই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব, কিন্তু গত হয়ে যাওয়া সময়কে ফিরে পাওয়ার কোনো উপায় নেই। অন্ধকার না থাকলে আলোর যেমন কোনো মূল্য নেই। তেমনি অমঙ্গল না থাকলে মঙ্গলেরও কোনো অস্তিত্ব থাকত না। সুখ-দুঃখ, আলো-অন্ধকার, মঙ্গল-অমঙ্গল এরা প্রত্যেকেই যেন একই বস্তুর এপিঠ ওপিঠ মাত্র। যেখানে অমঙ্গলের সূচনা সেখানেই মঙ্গলের আবির্ভাব। দুয়ের সংমিশ্রণ গড়ে ওঠে মানবজীবন।

প্রকৃতির নিয়মে এই ধারা অব্যাহত প্রতিটি মানুষের জীবনে। আয়মান অনার্স কমপ্লিট করে, পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার ব্যবসায়ী কাজে সাহায্য করছে। ময়ূরী কোর্স কমপ্লিট করে এখন চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিবে। আনিকা অনার্সে ভর্তি হয়েছে। ইন্টার শেষ করার পর থেকে শ্বশুর বাড়ি থাকে। অনুষ্ঠান ছাড়াই থাকে। সে ইচ্ছাকৃত থাকতে চাইনি। সবই আয়মানের পাগলামোর জন্য। আয়মানের এক কথা, আনিকার পরীক্ষা শেষ, তাই আয়মানের সাথে শ্বশুর বাড়ি থাকতে হবে। রাশেদ বলেছেন, আগে অনুষ্ঠান হোক, তারপর থেকে আনিকা এখানে থাকবে। আয়মান মানতে নারাজ। বউ’কে কোনো মতেই বাবার বাড়ি রাখবে না। এ নিয়ে রাশেদ, আয়মান’কে অনেক বকাঝকা করেছেন। তবে তাতে খুব বেশি লাভ হয়নি। আয়মান রেগে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল, বিয়ে করেছি কি বউ ছাড়া থাকতে? আমার বউ আমার সঙ্গেই থাকবে। প্রতিত্তোরে রাশেদ পাল্টা বলার মতো কথা খুঁজে পাননি! মোম আগের তুলনায় অনেক ম্যাচিউর হয়ে গিয়েছে। তবে চঞ্চলতা কমেনি। আর না আগুন’কে জ্বালাতন করতে ভুলে! এর কারণ, আগুন এখনো আগের মতো মোম’কে ধমকা-ধমকি করে, শাসন করে। সেজন্য মোম সর্বদা প্রস্তুত থাকে আগুন’কে জ্বালাতে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আগুন তার নিজস্ব প্রফেশন নিয়ে দিব্যি আছে। আগুন এখন ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকে না। তবে ফ্ল্যাট ছেড়েও দেয়নি। সেটা এখনও আছে। মোম’কে নিয়ে নিজেদের আসল বাড়িতে ফিরে এসেছে। এখান থেকে মোমের কলেজে যেতে সুবিধাজনক। মোম থাকবে শ্বশুর বাড়ি, আর আগুন তার কোমলমতি কে ছাড়া একা-একা ফ্ল্যাটে থাকবে! সেটা আজও সম্ভব? অগত্যা বউয়ের টানে আগুনও বাড়িতে থাকতে শুরু করেছে। মোম ছাড়া আগুন যেমন এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। ঠিক তেমনি মোমও আগুন’কে ছাড়া থাকতে পারে না। আগুনের নেশায় তীব্র ভাবে আসক্ত হয়ে গিয়েছে। মোম বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য বায়না ধরে না। আগুন ছাড়া মোমের এক মুহূর্ত চলে না। মাঝে মাঝে আগুনের সাথে বাবার বাড়ি গিয়ে দেখা করে, আবার আগুনের সাথেই ফিরে আসে আগুন নামক স্বামীর সুখ নীড়ে।

আজ আগুনের জন্মদিন উপলক্ষে শিকদার বাড়িতে সকাল থেকে আয়োজনের তোড়জোড় চলছে। শাশুড়ির থেকে যখন মোম শুনতে পেয়েছে আজ আগুনের জন্মদিন। তখন থেকেই আগুন’কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। মোমের ষোলো তম জন্মদিন আগুন ওকে সারপ্রাইজ দিয়েছিল। তাই মোমও নিজের মতো করে তার মাস্টার মশাই কে সারপ্রাইজ দিতে চাইছে।
মিনা রান্নাঘরে কাজ করছেন মোম, আনিকা তাকে হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে। হরেকরকমের খাবারের আইটেম রান্না করা হয়েছে। আগুনের জন্য মোম নিজের হাতে পায়েস বানিয়েছে। অবশ্য শাশুড়ির সহায়তায়। রান্না করার বেশির ভাগ আইটেম মোম নিজে রেঁধেছে। খেতে কেমন হবে মোম জানে না। তবে রান্না গুলো ভীষণ যত্ন নিয়ে করেছে।

আনিকা মুরগীর মাংস পানি দিয়ে ধৌতকরণ করছে। মিনার দিকে একবার লক্ষ্য করে, মোম’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
” ভাবী শুধু রান্না করলেই হবে? রাতে রোমান্টিক মুহূর্তের জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যানিং করবে না? ”
মোম চুলার আচ কমিয়ে, চোখ পাকিয়ে তাকায়। কন্ঠ খাদে এনে মৃদুস্বরে ধমকে বলল,
” ভালো হচ্ছে না কিন্তু আপু! সম্পর্কে আমি তোমার ভাসুরের বউ। তাই আমার সঙ্গে হিসাব করে কথা বলবে। এসব কথা বলবে না! হুহ্! ”

মোম বয়সে ছোট বলে আনিকা’কে আপু বলে সম্বোধন করে। দুইজন বোনের মতো মিলেমিশে থাকে। আনিকা দুষ্টু কথা বলে মোম’কে খোঁচাখোঁচি করে। কিন্তু মোম স্বভাবসুলভ চুপ থাকে।
আনিকা ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হেসে বলে,
” জানি জানি, ঠিকই রাতে আগুন ভাইয়ার জন্য সারপ্রাইজের প্ল্যানিং করেছো। কিন্তু আমার কাছে স্বীকার করতে চাইছো না। ”
মোম কটাক্ষ করে বাঁকা হেসে বলল,
” তুমিও কম যাও না! সেদিন তো দেখালাম, ড্রয়িংরুমে আয়মান ভাইয়ার সঙ্গে চিপকা-চিপকি করছিলে। সে হিসেবে আমি যা করি সকলের দৃষ্টিকোণের আড়ালে। ”
মোমের মুখের উপর খোঁচা মারা কথায় নিমেষই আনিকার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা চুপসে গেল। ও ভেবেছিল সবসময়ের মতো মোম এবারও চুপ থাকবে। মোম যে জায়গা মতো খোঁচা টা দিয়ে দিবে আনিকা সেটা ঘুনাক্ষরে টের পায়নি!
মাছের আঁশটা গন্ধে হঠাৎ মোমের গা গুলিয়ে উঠল। রান্নাঘরের বেসিনে গলগল করে বমি করে দিল। আনিকা খেয়াল করে চিৎকার করে ওঠে। চিৎকারের শব্দে মিনা ঘাড় ঘুরিয়ে মোম’কে দেখে আঁতকে উঠলেন! তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে মোম’কে আগলে ধরলেন। মোমের শরীর টলছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। হাত,পা অবশ অবশ লাগছে। মোম টিকতে না পেরে শাশুড়ির উপর ঢলে পড়ল।

পানিরকণা চোখমুখে পড়তেই মোম পিটপিট করে তাকায়। মাথাটা ভাড় ভাড় লাগছে। মিনা রান্নাঘরে চেয়ার এনে মোম’কে বসিয়ে দিয়েছেন। মাথায় তৈল পানি দিয়ে দিচ্ছেন। আনিকা ফ্লোরে বসে মোমের হাতের তালু ঘষছে। ময়ূরী প্রেশার চেক করছে।
মিনা অস্থির গলায় শুধালেন,
” তোমার শরীর খারাপ, আমাকে বলোনি কেন? হঠাৎ কি হলো তোমার? ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করো না নাকি? ”
ময়ূরী ফট করে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
” মা, আমার মনে হচ্ছে বাড়িতে নতুন সদস্য আসতে চলেছে। ”
ময়ূরীর কথার মানে মোম বুঝতে পারলো। তবে মোমের মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। মুখবিবর স্বাভাবিক রেখে শান্ত কন্ঠে জানালো,
” তেমন কিছু না। বছর খানিক আগে মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে ওনার কলেজের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। তখনও এরকম বমি হয়েছিল। কালকে রাতে খাইনি। সকালে অল্প সেমাই খেয়েছিলাম। হয়তো খালি পেটে মিষ্টি খাবার খাওয়ায় বমি করেছি। ”

ময়ূরী জহুরি চোখে মোমের আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল। চোখের দিকে চেয়ে সন্দেহী গলায় প্রশ্ন করলো,
” তোমার লাস্ট পিরিয়ড ডেট কবে ছিল? ”
মোম লজ্জা পেলো। আড়চোখে শাশুড়ির দিকে তাকায়। মিনা ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন। মোমের নিঃশ্চুপতা কাটিয়ে মিনা অধৈর্য্য সহিত উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,
” চুপ করে আছো কেন? ময়ূরী যা জানতে চাইছে উত্তর দেও। ”
মোম মাথা নিচু করে মিনমিন করে বলল,
” গত দুই মাস যাবত পিরিয়ড মিস হচ্ছে। ”
ময়ূরী ব্যগ্র কদমে তুরন্ত ছুটল নিজের কক্ষে। ওয়ারড্রব হতে একটা কিট নিয়ে ব্যস্ত কদমে পুনরায় রান্নাঘর এলো। হসপিটালের একজনের জন্য ভালো ব্রান্ডের কিট নিয়ে এসেছিল। কালকে তাকে দেওয়ার কথা। কিন্তু আজকে এটা দ্বারা বাড়ির লোকের কাজ সারবে।
আগুনের বেডরুমে একরাশ অস্থিরতা নিয়ে তিন মানবীয় নারী অপেক্ষা করছে। মোম ওয়াশরুমের দরজা খুলে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসলো। কিট টা ময়ূরীর হাতে দিল। মোমের কেমন যেন লাগছে।
ময়ূরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিটের স্পষ্ট লম্বালম্বিভাবে দুটো দাগ লক্ষ্য করে উৎফুল্লতা সমেত চিৎকার করে ওঠে,

” ভাবী প্রেগন্যান্ট! ”
রুমের মধ্যে যেন ছোটখাটো একটা ব্লাস্ট হলো। মোম চমকে ওঠে। আবেগে চোখ দুটো জলে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছে। আনিকা লাফিয়ে উঠল। মেম’কে আলিঙ্গন করে শুভেচ্ছা জানালো আনিকা, ময়ূরী। মিনা খুশিতে গদগদ হয়ে মোম’কে জড়িয়ে ধরে কপালে দৃঢ় চুমু এঁটে দিলেন। কত বছর পর শিকদার বাড়িতে নতুন সদস্য আসতে চলেছে।
মাথায় হাত রেখে মুচকি হেসে মিনা বললেন,
” আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে বলে বোঝাতে পারবো না। সদা সুখে থাকো মা। ”
মোম ঠোঁট চেপে কান্না আটকে ধীর গলায় বলল,
” মা আপনার ছেলেকে কিছু বলবেন না। আমি নিজে তাকে খবর টা দিতে চাই। ”
মিনা সম্মতি প্রকাশ করলেন,
” আচ্ছা। ”

মোমের হাত ধরে মাথার নিকট চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে আগুন। আজ কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হয়েছে। বাড়িতে আসতেই আনিকা দরজা খুলে দিয়েছে। নিজের মধ্যকার উত্তেজনা দমিয়ে রাখতে না পেরে গড়গড়িয়ে বলে ফেলেছিল, মোম খুব অসুস্থ। ভাগ্যিস আর কিছু বলেনি। ব্যস! তখন থেকেই মোমের পাশে ঘাপটি মেরে বসে আছে। মোমের অসুস্থতার কথা শুনতেই আগুনের বেগতিক অস্বাভাবিক অবস্থা। বক্ষস্পন্দনে কেমন চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছিল। সুস্থসবল বউ বাড়িতে রেখে গিয়েছিল, আর এসে দেখে বউ অসুস্থ! সেটা কি আগুনের সহ্য হয়?
মোমের বিরক্ত লাগছে! এভাবে গা ঘেঁষার মানে কি? কলেজ থেকে এসে ফ্রেশ হয়নি, এমনকি খায়নি। পোষাক চেঞ্জ করেনি। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, আর এ লোকের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই! বাড়ির সদস্যরা কি ভাবছে? নিশ্চয়ই আগুন’কে বউ পাগল ভাবছে? কিন্তু মোম তো লজ্জা পায়!
মোমের গালে হাত রেখে, মায়াভরা চাউনী নিক্ষেপ করে আগুন উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধাল,

” কোথায় কষ্ট হচ্ছে? অসুস্থ হয়েছো কিভাবে? বেশি খারাপ লাগছে? ”
মোম গাল হতে হাত সরিয়ে দিল। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে বলল,
” আমার কিছু হয়নি। একদম ঠিক আছি। যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আসুন। ”
” চিন্তা হচ্ছে আমার। ”
মোম হতাশ কন্ঠে বলে,
” বললাম তো ঠিক আছি। আপনি এত ব্যস্ত হবেন না। কথা শুনছেন না কেন? ”
মোম ঠেলেঠুলে আগুন’কে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিল। আগুন ঝটপট ফ্রেশ হয়ে, খাওয়া দাওয়া করে মোমের পাশে এসে শুয়ে পড়ল। টেবিলে এক সাথে এত এত খাবার আইটেম দেখে আগুন ভীষণ অবাক হয়েছিল। তাও সবগুলো আগুনের পছন্দের খাবার। তবে বেশি ঘাটেনি। ভেবেছে হয়তো এমনি এত রান্না করেছে। খাবার মজা হওয়ায় আগুন তৃপ্তি সহ পেট ভরে খেয়েছে। ক্লান্ত থাকায় কখন যে চক্ষু জোড়ায় তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল আগুন টেরই পায়নি। যখন তন্দ্রা ছুটেছে তখন রাতের দ্বিতীয় প্রহর শুরু। হাতড়িয়ে মোম’কে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা চালাল। মোমের নাগাল না পেয়ে উঠে বসলো। পুরো বাড়ি জুড়ে অন্ধকার। শুধু ড্রয়িংরুমের ঝাড়বাতি জ্বলছে। সেটার সুক্ষ্ম আলোক শিখা রুমে প্রবেশ করছে। দরজা খোলা। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো, রাত বারোটা বেজে গিয়েছে।

আগুন রুমের লাইট অন করে ফ্রেশ হয়ে আসলো। ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখমন্ডলের পানি মুছছে। তক্ষুণি দেখতে পেলো, ড্রেসিং টেবিলের দর্পণে ছোট একটা কাগজের টুকরো আটকানো। কাগজে কিছু লেখা রয়েছে। আগুন ললাটে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে, কাগজের টুকরো অংশ টা হাতে তুলে নিলো। কাগজের গোটা গোটা অক্ষরের লেখা বাক্যদ্বয় ভ্রু কুঁচকে রুক্ষ স্বরে বিড়বিড়িয়ে আওড়াল,
” বিছানার এক পাশে একটা প্যাকেট রাখা আছে। প্যাকেটে যা রয়েছে পড়ে, ড্রয়িংরুমে চলে আসুন। আপনার অপেক্ষায় থাকবো। ”

আগুনের বুঝতে বাকি নেই এটা তার কোমলমতির হাতের লেখা। এখন প্রশ্ন হলো, এত রাতে উধাও কেন হয়েছে মেয়েটা? আগুন ফোঁস করে তপ্ত শ্বাস টেনে, এত না ভেবে প্যাকেট খুলে দেখলো, দারুণ পায়জামা-পাঞ্জাবি সেট! দেখতে ভীষণ সুন্দর। আগুন চটজলদি রেডি হয়ে ধীর কদমে বেরিয়ে আসলো। ও আসা মাত্র ঝাড়বাতি নিভে গেল। এর পরিবর্তে জ্বলে উঠল কতগুলো বার্থডে ল্যাম্প। ল্যাম্পের আলোতে আপন মানুষদের মুখগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলো। ড্রয়িংরুমে নজর বুলিয়ে বার্থডে সাজসজ্জা দেখে আগুন অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে গেল। মুহূর্তে পুরো বাড়ি পুনরায় কৃত্রিম আলোয় ভরে উঠল।
রাশেদ নিজ ইচ্ছায় প্রথমবারের মতো বড়ো ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিষ্প্রভ গলায় বলে উঠলেন,
” শুভ জন্মদিন, আব্বাজান! ”
আগুন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটাই ভুলে গিয়েছে। একের পর এক ঝটকা সহ্য করতে পারছে না।
মোমের প্রেগন্যান্ট হওয়ার খবর রাশেদ মিনার থেকে শুনেছেন। আগুন’কে চুপ থাকতে দেখে তৃপ্তিময় হেসে রাশেদ মিহি কন্ঠে ফের বললেন,

” আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? কেক টা কাটো। সেই কখন বারোটা পেরিয়ে গিয়েছে। ”
সকলে মিলে আগুন’কে বার্থডে উইশ করল। মাথায় হাত রেখে মিনা প্রাণপণে ছেলের জন্য দোয়া করলেন। আগুন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। প্লাস্টিকের ছুরি হাতে, জমকালো শাড়ি পরিহিত মোম’কে কেকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আগুনের চক্ষু চড়কগাছ! এই সাজে মোম’কে কোনো অপ্সরা থেকে কম লাগছে না। ল্যাম্পের হলদেটে আলোয় মোমের স্নিগ্ধ মুখবিবর আগুনের বুকে ঝড় তুলে দিচ্ছে! এই ঝড় কেবল মোম থামাতে পারে। আজ তো মোম’কে ভালোবাসার যাঁতাকলে আগুন পিষে মেরে ফেলবে!

আগুন এগিয়ে যায়। বাড়ির লোকদের তোয়াক্কা না করে, মোমের হাতে হাত রেখে কেক কাটে। সবাই একত্রে হাততালি দিয়ে আবারও শুভেচ্ছা জানালো। আয়মান স্নো স্প্রে করে তুষারের ন্যায় কৃত্রিম সাদা সাদা বরফ খন্ড ঘটাল। আনিকা, ময়ূরী লাভ শেপড বেলুন ঠাসঠুস শব্দ করে ফাটাল। আয়মান বাচ্চাদের মতো প্যাপু বাঁশি বাজাচ্ছে।
বাবা-মা, বোন, ভাই, ভাইয়ের বউ সবাইকে কেক খাইয়ে দিল। শুধু মোম’কে কেক খাওয়াল না, আর না নিজে খেলো! আগুনের এমন ব্যবহারে মোমের মুখটা ছোট হয়ে গেল। ইতোমধ্যে চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে। বাকিরা আগুন’কে কেক খাওয়ালে আগুন মুখে নিলেও গিলেনি! আড়ালে ফেলে দিয়েছে।
অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। মিনা, রাশেদ নিজেদের রুমে চলে গিয়েছেন। ঘুমে ময়ূরীর চোখ ঢুলুঢুলু অবস্থা। আনিকা’কে বলে ও ঘুমাতে চলে যায়। আনিকা আস্থা দিয়ে বলেছে, ও সবকিছু গুছিয়ে রাখবে। চিন্তা করতে হবে না। আয়মান, আনিকা’কে জোরজবরদস্তি টেনে ছাদে নিয়ে গেল।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪২

ড্রয়িংরুম এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা। শুধু আগুন, মোম রয়ে গিয়েছে। মোম গাল ফুলিয়ে একরাশ বিষন্নতা নিয়ে চুপচাপ ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আগুন এগিয়ে আসে। মোম ছিটকে দূরে সরে যায়। আগুন কোমর টেনে কাছে নিয়ে আসে। কেকের ছোট একটা টুকরো উঠিয়ে মোমের মুখে লাগিয়ে দেয়। মোম’কে কিছু বুঝে উঠার পূর্বাভাস না দিয়ে আচমকা মোমের ঠোঁটে ঠোঁট মেশায়।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা শেষ পর্ব