শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২২

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২২
আলিশা

❝আমার লেখাপড়া খুবই সামান্য। এসএসসি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। হয়তো গুছিয়ে লিখতে পারবো না। যাই হোক, তোমাকে যে ছবিটা পাঠিয়েছি সেটাই আমাদের ‘নাচ গার্ডেনের’ মালকিন। এই বুবু আমাকে ক্লাস টেনের পরীক্ষার শেষ দিনে গ্রাম থেকে শহরে তুলে আনে। আমাকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে আমার নাকে কিছু একটা ধরে। তারপর আমি চোখ বন্ধ করে নেই। যখন চোখ খুলি তখন নিজেকে একটা বদ্ধ ঘরে দেখি। ফুলে সাজানো বিছানা ছিলো। আমার গায়ে ছিলো লাল শাড়ি।

উদ্ভট সাজ। কান্নায় ভেঙে পরি। অনেক ছোট বেলাতে যাদের হাত ধরে একটা সুন্দর পরিবার পাই সেই মানুষ, আমার দাদা-দাদির কথা মনে পরে কলিজাটা ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু ওরা আমাকে ছাড়েনি। একটা বুড়ো মতন লোককে সেদিন রাতে আমার ঘরে ঢোকানো হয়। তার পা ধরে আমি বলেছিলাম আমাকে আমার বাড়ি যেতে দিতে। তবে হায়না কি হরিণীকে খাঁচায় পেয়ে ছাড়ে? ছাড়ে না। ছাড়েনি ওরাও আমাকে। একাধারে দশদিন আমাকে বন্দি করে রাখে। আমি কান্না করতাম। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করেছিলাম। ওরা আমাকে অসুস্থ হতে দিতে চাইছিলো না। লোকেদের নজরও আমার দিকেই ছিলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সুন্দর হওয়া হয়তো আমার জন্য অভিশাপ ছিলো। তারপর একদিন ওরা আমাকে অনেক টাকা দিলো। আমি তখনও শুধু চিনি আমার দাদা জান আর দাদি জানকে। আমি টাকা চিনি না। আমার চোখের নিচে কালি জমলো। ওরা অবশেষে আমাকে হুমকি দিলো। আমাকে বলল যদি আমি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেই, ওদের কথা না শুনি তাহলে আমার দাদাজান, দাদি জানকে মে*রে ফেলবে ওরা। আমি ভয়ে রাজি হলাম। তার কিছুদিন পর আমাকে বুবু এক লোকের সাথে আমার গ্রামে পাঠালো।

দাদা দাদিকে সে লোকটা মিথ্যা গল্প শোনালো যে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। পাড়ার লোক এলোমেলো কথা বলতে লাগলো। তারপরও আমার দাদা দাদি আমাকে আগলে রেখেছে। গ্রাম বাসির কথার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এভাবে আমার জীবন মলিন হলো। আমি অন্ধকারে দিনাতিপাত করতে লাগলাম। কখনো বাড়িতে থাকি কখনো বুবুর আস্তানায়। আমার ছুটি হতেই দৌড়ে বাড়িতে যাই আমি। দমবন্ধ লাগে ওই আস্তানায়। শোনো, তুমি এই আস্তানা ভেঙে ফেলো। আমি তোমাকে সাহায্য করবো।

আমার স্বপ্ন ভেঙেছে এই আস্তানা। এসএসসি তে আমার প্লাস আসে। স্বপ্ন ছিলো একদিন কলেজের শিক্ষিকা হবো। দাদা দাদিকে নিয়ে পুরো রাজধানী ঘুরবো। আমরা সুখে থাকবো। আমার একটা সংসার হবে। ছোট একটা সংসার। আমার নিজের একটা পরিবার হবে। যাগ্গে বাদ দাও। আর একটা কথা বলি, তোমার স্বামীর সাথে এই আস্তানার একটা বড় যোগসূত্র আছে। আমি এর কিছু জানি না। তবে শুনেছি তোমার স্বামীর প্রথম বউকে এরাই খুন করেছে। তুমি সাবধানে থেকো। সবশেষে বলবো তোমার বন্ধু ভালো আছে। তাকে পালাতে সাহায্য করবো আমি। তুমি টেনশন কোরো না।❞

একদমে চিঠিটা পড়েই বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের করলাম। ইশ! কি নিষ্ঠুর নিয়তি! খাইরুনের জন্য বুকটা আমার হুহু করে উঠলো। আবার শান্তর কথা জেনে একটু স্বস্তি পেলাম। বন্ধুত্বে যে নিজেকেও বলি দেওয়া যায় তা আমার বন্ধুদের না দেখলে আমি জানতাম না।

ভাবনা ছেড়ে হাতের কাগজটা বক্সে রেখে ছবিটা হাতে তুলে নিলাম। অতঃপর বুকের মাঝে আমার ধ্বক করে উঠলো। কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো আমার। ভারি সাজে সজ্জিত এক নারীর ছবি। ছবিতে সে চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসা। নারীটি অথৈ। গুলিয়ে গেলাম আমি। অথৈ? কিভাবে? সে স্মরণ কে এভাবে ঠকিয়ে গেলো? কিন্তু একটা প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ালো। স্মরণ যাকে দাফন করেছে সে তাহলে কে? মন বলে উঠলো হতে পারে অন্য কোনো মেয়েকে অথৈ বলে চালিয়ে দিয়েছে স্মরণের কাছে। কিন্তু কেন? আমার মন উত্তর করলো, তা তো কেবল অথৈই ভালো জানবে।
ভাবনা সঙ্গে নিয়ে তৎক্ষনাৎ দরজা বন্ধ করলাম। আরো কিছু উত্তর জানার আশায় পাল্টা চিরকুট লিখলাম খাইরুনের কাছে ।

❝ তোমার বুবু কি বেঁচে আছে? যদি আর একটু কষ্ট করো খাইরুন তবে হয়তো আমার জীবনটা সহজ হবে। খোঁজ নিয়ে বলতে পারবে তোমার বুবুর সাথে কোনো নারী পাচারকারী, ড্রাগ ব্যাবসায়ীর যোগাযোগ আছে কিনা?” তোমার বুবুর আগে বিয়ে হয়েছিল কিনা?❞

এটুকু লিখেই খাইরুনের বক্সে তুলে আটকে দিলাম বক্স। আর তার পাঠানো চিঠি ও ছবি রেখে দিলাম নিজের কাছে। হয়তো আমি গোয়েন্দা বিভাগের কেউ নই। আমার এসব ঘাটাঘাটি করে সত্য উদ্ধার করার কথা ছিলো না। তবে করতে হচ্ছে। কারণ এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার পুরোটা জীবন। আমার সন্তানের ভবিষ্যত। মাঝে মাঝে ভাগ্যের প্রতি অভিমান হয়। এই বিদ্রূপ, এই নিষ্করুণ ঘটনাগুলোর শেষ কোথায়? খাইরুনেরই বা আশ্রয় হবে কোথায়? ওর জীবনের বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই তো অন্ধকারে ঢাকা।

ভালো মন্দ খাবারের ব্যবস্থা জয়নব খালাই করলেন। আমি শুধু খাইরুনের দাদাজানকে খাবার পরিবেশ করতে পারলাম। আর সব শেষে বিদায় দিলাম। ততক্ষণে স্মরণও বাসায় এলো। দাদাজানকে দেখে সে খুশি হলো বেশ। কিছুদিন থাকার আমন্ত্রণ জানালে দাদাজান নাকচ করলেন। বাড়িতে দাদিজান একা আছে। থাকা যাবে না। আমি আর স্মরণ তাকে বাড়ির শেষ গেইট অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসলাম। দাদাজান চলে যেতেই স্মরণ আমাকে শুধালো

— কি ভাবছো?
আমি কিছুটা চমকে উঠে মলিন হেসে বললাম
— কিছু না।
— আজকে কি গরম বেশি নাকি? ইশ! ঘরে চলো জলদি।
আমি ঘরে যাওয়ার বিপরীতে স্মরণ কে বললাম
— একটু কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসি?
স্মরণ না করলো না। ধীর পায়ে দু’জনে হেঁটে গেলাম গাছের নিচে। গাছটাকে ঘিরে গোল করে বসার স্থান তৈরি করা হয়েছে। আমি বসে গেলাম। বেশ খানিকটা পথ লাল ফুলে সজ্জিত। মনে হয় যেন ফুলের গালিচা। একটু দূরে পরে ছিলো বকুল ফুল। আমি কুড়িয়ে আনলাম। স্মরণ গাছের নিচে বলে বলে উঠলো

— কিসব করো তুমি?
আমি জবাব না দিয়ে একটা নারিকেল গাছের পাতা পারার জন্য মরিয়া হলাম। তবে সফল হলাম না। তখনই স্মরণ এসে একটা পাতা ছিড়ে আমার হাতে দিলো। আমি আবারও গিয়ে বসলাম কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। আগমন ঘটলো হালকা বাতাসের। মন প্রাণ জুড়িয়ে যেতে লাগলো। নারিকেলের চিড়ল পাতা আরো চিরল করে তাতে বকুল ফুল ভরতে লাগলাম। এই কাজের ফাঁকে স্মরণ কে শুধালাম

— আপনাদের ইনভেস্টিগেশন কতদূর এগোলো?
— কিচ্ছু এগোচ্ছে না।
— তাহলে এখন কি করবেন?
— সোজা সেখানে যাবো।
— কবে?
— কাল রাতে হয়তোবা।
বুকের মাঝে আমার ছ্যাৎ করে উঠলো। অথৈ যখন ঠকাতে পেরেছে স্মরণ কে তবে বুকে ছুড়ি বসাতে তার এক সেকেন্ডও লাগবে না। স্মরণ কে আটকাতে হবে। জলদি রহস্যের সূত্র খুঁজে বের করতে হবে আমাকে।

— তোমার মালা গাঁথা হলো?
— হুম।
বলেই মালাটা স্মরণের গলায় ঝুলিয়ে দিলাম। স্মরণ নাক সিটকে গলা থেকে মালা সরিয়ে ফেলল। আমি তার সিটকে ফেলা নাকও মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। তাকে যতবার দেখি ততবারই বলতে ইচ্ছে করে ‘মাশা আল্লাহ ”
— আমার এই ফুলের গন্ধ ভালো লাগে না। তোমার মালা তুমিই পরো।
বলতে বলতে আমার গলায় মালা ঝুলিয়ে দিলো। অতঃপর আমার হাতটা ধরে কৃষ্ণ চূড়ার লাল গালিচার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল

— এই কৃষ্ণচূড়া তার পাপড়িগুলো তোমার জন্য বিছিয়েছে। তুমি কি ধন্য মহারাণী?
আমি খিলখিল করে হেঁসে উঠলাম। যদিও মনে হলো চোখের কোণে জল জমেছে। তবুও বললাম
— জ্বি মহারাজা। আমি ধন্য। তবে এই সুন্দর কৃষ্ণচূড়ার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী আমি। কেননা তার গালিচার জন্য আমি যতটা ধন্য তারচাইতেও বেশি ধন্য আমার মহারাজার জন্য।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২১

স্মরণ হাসলো। আমাদের হাতের বাঁধন শক্ত হলো। তীব্র হলো আমার মনের যন্ত্রণা। আমি কি আমার মহারাজাকে হারিয়ে ফেলবো? ভাবনার মাঝেই স্মরণ হঠাৎ আমার গলার মালা খুলে নিয়ে তা মাথায় মুকুটের মতো করে পরিয়ে দিলো। চলতি পথে জবা ফুলের গাছ থেকে একটা ফুল তুলে নিয়ে আমার কানে গুঁজে দিয়ে বলল
— এবার রাণী রাণী লাগছে। আমার নিজেকেও এখন রাজা রাজা মনে হচ্ছে।
হায়! সে তার প্রতি মায়া বাড়াতে আমায় বাধ্য করলো।

শেষ বিকেলে তুমি আমি সিজন ২ পর্ব ২৩