শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ৩

শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ৩
ইনায়া রোজ

সকাল সকাল শান্তিনিকেতন নামের বাড়িটিতে যেন এক শোরগোল বয়ে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা যেন সকাল সকাল ভূমিকম্পের রূপ নিয়েছে। নিলয় যার শরীরে একাধিক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তার মাকে নিয়ে হাজির হয়েছে শ্রাবণদের বাড়ি শান্তিনিকেতনে। তবে এ শান্তিনিকেতন এখন মোটেও শান্তির জায়গায় নেই।
সকাল সকাল নিজের ভাইয়ের বউ আর ভাইয়ের ছেলেকে এইভাবে উপস্থিত হতে দেখে টেবিলে বসে খেতে থাকা বাড়ির সকল সদস্য যেন অবাক হয়ে যায় সাথে রাহেলা বেগম নিজেও। নিলয়কে এই অবস্থায় দেখে রাহেলা বেগম দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়।

– কি হয়েছে তোর নিলয়? এই অবস্থা কেন তোর?
নিলয় রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে ওঠে,
– সেটা তোমাদের ছেলে শ্রাবণকেই না হয় জিজ্ঞেস করো ফুফু।
– মানে?
অবাক হয়ে বলে ওঠে রাহেলা বেগম। ছেলের কথা শুনতেই কিছুটা এগিয়ে আসে আফসানা বেগম। নিলয়ের মা কহিনুর বেগম চিৎকার করে বলে ওঠে,
– রাহেলা আফা তোমার ভাসুরের ছেলে শ্রাবণ আমার ছেলেকে অন্যায় ভাবে মেরেছে আমি এটার বিচার চাই।
শ্রাবণ আগের রাতে নিলয়কে আঘাত করেছিল, কিন্তু কেন? সেটা নিয়ে প্রশ্ন জাগলো সবার মনে। সকলের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় শ্রাবণের। ভোরে ভোরে মেঘের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসেছিল শ্রাবণ। আজকে শুক্রবার ভার্সিটি বন্ধ তাই তেমন ঝামেলা নেই ভেবে আবারো শুয়ে পড়েছিল সে। কিন্তু সকলের হট্টগোলে সে ঘুমটা ছুটে যায় শ্রাবণের।
ধীর পায়ে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে শ্রাবণ। এরপর পা বাড়ায় নিচে নামার উদ্দেশ্যে। সিঁড়ি দিয়ে শ্রাবণকে নিচে আসতে দেখে কহিনুর বেগম আবারো চেচিয়ে উঠে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– ওই তো আপনাদের গুণধর ছেলে এসে গেছে আমার ছেলেকে মারার সঠিক বিচার চাই আমি।
সকলের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের ট্রাউজারের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে টেবিলের উদ্দেশ্যে হাটা ধরে শ্রাবণ। যেতে যেতে বলে ওঠে,
– মা খিদে পেয়েছে খেতে দাও।
সকলের সামনে এ রুপ অবজ্ঞা করায় কোহিনুর বেগমের রাগ যেন এবার সপ্তম আকাশে চড়ে বসল। তিনি আবারও চিৎকার করে বলে ওঠে,
– আমার ছেলেকে মেরে এখন ভাব ধরা হচ্ছে।
এরপর রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
– আপা তুমি কিছু বলবে না?
এবার তাদের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে শ্রাবণ বলে ওঠে,
– আপনার ছেলে যা করেছে তার শাস্তি পেয়েছে, বেশি কথা বললে আবারও শাস্তি পাবে।
নিলয়ের রাগ এবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, সে চিৎকার করে বলে ওঠে,

– আমি কি করেছি? মেঘের সঙ্গে একটু কথা বলতে গিয়েছিলাম সেটাই কি অন্যায়? তুমি এমন ভাব করছো যেন আমি চোর!
শ্রাবণের চোখগুলো এবার আগুনের মত জ্বলে উঠে। ক্রোধে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার। দাঁতে দাঁত চেপে শ্রাবণ বলে ওঠে,
– মেঘের নাম আর একবারের জন্য মুখে নিলে তোর এই মুখ আমি ভে*ঙ্গে দেব। কালকে ছেড়ে দিয়েছি বলে ভাবিস না আজকেও ছেড়ে দিব।
তাদের চেঁচামেচি হট্টগোলে সেখানে উপস্থিত হয় মেঘের বাবা ফয়েজ আহমেদ। ফয়েজ আহমেদকে ডেকে ডুকরে কেঁদে উঠে কহিনুর বেগম। এতক্ষণ তো ভালোই ছিল হঠাৎ এমন অভিনয়ে সকলেই তাজ্জব বনে তাকায় কহিনুর বেগমের দিকে। কোহিনুর বেগম দৌড়ে ফয়েজ আহমেদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

– ভাইজান দেখুন আমার ছেলে নিলয়কে শ্রাবণ মেরে কি অবস্থা করেছে, আমি এটার বিচার চাই ভাইজান।
কোহিনুর বেগমের কথায় খুব্দ দৃষ্টিতে রাহেলা বেগমের দিকে তাকায় ফয়েজ আহমেদ। চুপচাপ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহেলা বেগম। ফয়েজ আহমেদ এবার কহিনুর বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
– কেন মেরেছে তোমার ছেলেকে?
নিলয় যেন এবার একটা মোক্ষম সুযোগ পেল। সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে ওঠে,
– ফুফা আমি শুধু মেঘের সাথে কথা বলার জন্যই ওকে একটু ডেকেছিলাম আর সেজন্যই শ্রাবণ ভাই আমাকে এমন মেরেছে।
এবার যেন ফয়েজ আহমেদের রাগ আরো তিরতির করে বেড়ে গেল। তিনি দৌড়ে গিয়ে শ্রাবণের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রাবণের গেঞ্জির কলার চেপে ধরলেন দুহাতে।

– হারা*মজা*দা তোকে কতবার বলেছি আমার মেয়ের কোন ব্যাপারে নাক না গলাতে। ক্ষমা চা নিলয়ের কাছে এক্ষুনি।
ফয়েজ আহমেদের কথায় তাচ্ছিল্য হাসে শ্রাবণ। সে চাইবে ক্ষমা তাও ওই নিলয়ের কাছে, অসম্ভব! আবারও শ্রাবনের কলার ঝাকি দিয়ে উঠলো ফয়েজ আহমেদ।
– কি হলো ক্ষমা চা।
শ্রাবণ এবার তাকালো নিজের মা আফসানা বেগমের দিকে। তিনি ইশারায় মাথা দুলিয়ে ছেলেকে রেগে যেতে বারণ করলেন। এবার শ্রাবণ তাকালো মেঘের মা রাহেলা বেগমের দিকে তিনি আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দুজনের দিকে। শ্রাবণ এবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিলয়ের উদ্দেশে বলে উঠে,
– সরি!
নিলয় যেন চাঁদ হাতে পাওয়ার মত খুশি হল। শ্রাবণ সরি বলতেই ফয়েজ আহমেদ তার কলার ছেড়ে দিলেন। এরপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,

– আমার মেয়ের ত্রিসীমানায় যেন আর তোকে না দেখি।
শ্রাবণ খেতে বসতে বসতে বলে উঠলো,
– আমার বউয়ের কাছে আমি যাব সেখানে আমাকে আটকানোর কোন ক্ষমতা কারো নেই।
এরপর তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– খিদে পেয়েছে মা খাবার দিবে নাকি বাহিরে গিয়ে খাব।
শ্রাবনের এমন ভাব ভঙ্গিমা দেখে আবারো তেলে বেগুনি তেঁতেঁ উঠলেন ফয়েজ আহমেদ। তিনি আবারো চেচিয়ে বলে ওঠেন,

– কে তোমার বউ? আর কিসের বউ? মেঘ আমার মেয়ে, আমার মেয়ের জীবনে হস্তক্ষেপ করতে আসলে সেটার ফল কিছুতেই ভালো হবে না।
বলে তৎক্ষণাৎ সেই স্থান ত্যাগ করে ফয়েজ আহমেদ। তা দেখে বাকা হেসে খাওয়ায় মনোযোগ দেয় শ্রাবণ। তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কোহিনুর বেগম আর নিলয়। তখনই রাহেলা বেগম বলে ওঠে,
– ভাবি এত কষ্ট করে এসেছো চলো কিছু খেয়ে নিবে।
– না বাপু তোমাদের এসব কাহিনী দেখার পর আমার কোন খাবারই গলা দিয়ে নামবে না আমি বরং যাই পরে কখনো আসবো।
বলে নিলয়ের হাত ধরে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় কহিনুর বেগম। রাহেলা বেগম এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় খাবারের দিকে। একটা প্লেটে মেঘের জন্য খাবার বাড়তে বাড়তে শ্রাবণের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

– তুমি মেঘকে এইভাবে কেনো কষ্ট দিলে শ্রাবণ ? মেঘের ভয়ের ব্যাপারে তো তুমি অজানা নও। মেয়েটা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে যন্ত্রনায় ছটফট করেছে সারা রাত। কিন্তু রাতে থাকতে পারিনি আমি তার কাছে। তোমার চাচাজান এই ব্যাপারে কিছু জানে না জানলে কি হতো বলোতো?
শ্রাবণ এবার তাকায় রাহেলা বেগমের দিকে। এরপর শান্ত কণ্ঠে বলে উঠে,
– মেঝো মা মেঘের এটা পাওয়ারই ছিল। নিলয় ভালো ছেলে না ওর অনেক ক্ষতি করতে চেয়েছে। আমি মেঘকে অনেকবার সাবধান করেছি তাও শুনে নি সে। অনেক বড় বিপদ হওয়ার থেকে ভালো একটু শাস্তিই পেয়েছে ।
শ্রাবণের কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন রাহেলা বেগম। মা হয়ে এই শাসনটা তার করা উচিত ছিল। কিন্তু সে নিরুপায় নিজের মেয়েকে শাসন করারও কোন অধিকার নেই তার। আর কোন কথা না বলে রাহেলা বেগম খাবারের প্লেট টা নিয়ে এগিয়ে যেতে নিলে তাকে থামিয়ে দেয় শ্রাবণ।
টেবিল ছেড়ে উঠে খাবারের প্লেটটা নিজের হাতে নিয়ে বলে ওঠে,
– তোমাকে যেতে হবে না মেঝো মা আমি নিয়ে যাচ্ছি।
– কিন্তু,
– কিচ্ছু হবে না।
বলে খাবার নিয়ে এগিয়ে যায় শ্রাবণ।

দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে শ্রাবণ। মেঘ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে গভীর ক্লান্তি আর হতাশার ছায়া। শ্রাবনকে দেখে কিছুই বলেনি মেঘ শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে। কিন্তু মেঘের নীরব রাগ যেন তার পাশে একটা অশান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করছে।
শ্রাবণ ধীর পায়ে এগিয়ে খাবারের প্লেটটা রাখল মেঘের সামনে। মেঘ আবারও শ্রাবনের দিকে তাকালো এক দৃষ্টিতে। তার চোখে অভিমান আর অগ্নি যেন আগুনের নিচে চাপা পড়া কোন লাভা। মেঘ ধীর হাতে খাবারের প্লেট তুলে নিল। এরপর এমন ভাবে প্লেটের দিকে তাকালো যেন এই মুহূর্তেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে চাইছে প্লেটটাকে। কিন্তু পরক্ষণে আবার নিজেকে সামলে নিল।
– তুমি কি ভেবেছে শ্রাবণ ভাই এক প্লেট খাবার এনে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে?
মেঘের কন্ঠ ছিল অত্যন্ত শীতল যেন শব্দগুলো বরফের মতো ধারালো।
– তুমি আমাকে এতবড় শাস্তি দেয়ার পরেও ভেবেছো আমি চুপচাপ মেনে নিব?
মেঘের কন্ঠ ধীর হলেও ছিল অত্যন্ত গভীর যার প্রতিটি শব্দ শূন্যতায় আঘাত করছে। শ্রাবণ কিছু বলতে যাবে তার আগে তাকে থামিয়ে দেয় মেঘ।

– তুমি জানো, আঘাত শুধু শরীরেই লাগে না মনেও লাগে। তুমি যা করেছ সেটা শুধু আমাকে না আমার বিশ্বাস কেও আঘাত করেছে।
কিছুটা থেমে মেঘ আবারও বলে ওঠে,
– সবকিছু ঠিক করতে আমার সময় লাগবে শ্রাবণ ভাই আর ততদিন আমাকে একা থাকতে দাও।
মেঘের কথা শুনে চুপচাপ মেঘের দিকে এগিয়ে গেলো শ্রাবণ। মেঘের হাত থেকে খাবারের প্লেট রেখে মেঘের দুগালে হাত রাখল।
– ক্ষমা করে দে না জান আমার ভুল হয়ে গেছে।
শ্রাবণের হাতটা ঝাড়ি মেরে ফেলে দেয় মেঘ।

শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ২

– তোমার নোংরা মুখে আমাকে জান বলে ডাকবে না শ্রাবণ ভাই, চলে যাও এখান থেকে।
– কোথায় যাব ফুল? তুই আছিস বলেই তো আমার জীবনটা এতটা অর্থপূর্ণ। তোর সঙ্গে কাটানো সময় যেন আমার কাছে কোনো অসীম মহাবিশ্বের ভ্রমণ। তোকে ছেড়ে কোথায় যাবো জান তুই বল?

শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ৪