সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৫
Jannatul Firdaus Mithila
দিন যতো যায় মানুষের অতীতের কথাগুলো স্মৃতিতে পরিনত হয়। চোখদুটো বন্ধ রেখে রুহির জন্মানোর মুহুর্তটাকে আরেকবার মনে করলেন কবির সাহেব। ভাবছে, সেদিনকার ছোট্ট মেয়েটা তার আজ যে বড্ড বড় হয়ে গেছে। কবির সাহেব এসব ভেবে চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর রাশভারী গলায় সাব্বির সাহেবকে বলেন,
~ হুম। কালকেই ওদের বিয়ের ডেটটা ফিক্সড করে ফেলবো।
সাব্বির সাহেব বড় ভাইয়ের চাপা আর্তনাদটি স্পষ্ট টের পেলেন। মাথানিচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে থেকে সম্মতি জানালেন ভাইয়ের কথায়। ঠিক তখনি তার মস্তিষ্কে এসে হানা দিলো অন্য চিন্তা। আচ্ছা আজ যেমন তার বড় ভাইজানের অবস্থা হচ্ছে, ঠিক তেমনটা তারও তো হবে তা-ই না? তাকে-ও তো মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বুকটায় হঠাৎ কেমন চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে সাব্বির সাহেবের। বাহ! মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতেই তার এ-অবস্থা হচ্ছে না জানি বিয়ে দেওয়ার সময় কি হয়!
~ হেলো মিস! শুনছেন, এই যে হেলো!
কাঠফাটা রোদে ফাঁকা রাস্তায় অতিষ্ঠ হয়ে একমনে হেঁটে যাচ্ছিলো আহিরা। ঠিক তখনি পেছন থেকে ভেসে আসে কারো হাঁক ছোড়া। বিরক্তিতে নাক-মুখ কুচকে আসে তার। একবার তার ইচ্ছে করলো মোটেও পেছনে ফিরবে না কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো,তখন না আবার কেও তার ম্যানার্স নিয়ে প্রশ্ন উঠিয়ে বসে! তাইতো ভ্রু জোড়া কুচকিয়ে পেছনে ফিরে সে। দেখতে পায় অদূরে দাড়িয়ে থাকা সেদিনের রেস্টুরেন্টে দেখা হওয়া ছেলেটিকে। ইফতিকে দেখামাত্র আহিরার কুচকানো ভ্রু আরো কিছুটা কুচকে যায়। মুখভঙ্গি আগের ন্যায় রেখে নিজের কাঁধের ব্যাগটিকে ঠিক করে দুহাত ভাজ করে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাড়িয়ে খেঁকিয়ে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
~ হোয়াট? এভাবে পিছু ডাকছেন কেন?
ইফতি আহিরার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে এগিয়ে আসে। প্রায় অনেকটা কাছাকাছি এসে দাড়ায়। ইফতিকে এতোটা কাছে আসতে দেখে আহিরা আরো দুকদম পিছিয়ে যায়। মেজাজ হারিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে আবারও,
~ আজব! কাছে আসতে আসতে কি এখন কোলে চড়বেন!
ইফতি সঙ্গে সঙ্গে থতমত খায়। হতবিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে রইলো কিয়ৎকাল। অপ্রস্তুত হয়ে নিজেকে শুধরে নেবার ভঙ্গিতে বললো,
~ ছিঃ ছিঃ কিসব বলছেন! আমি আপনার কোলে ওঠতে যাবো কেন? তাছাড়া আপনার মতো পাটকাঠির ন্যায় বাচ্চামানুষ কখনোই আমাকে কোলে নিতে পারবে না।
এবার আহিয়ার মেজাজ পৌঁছে যায় সপ্ত আসমানে।একে-তো মাথার ওপর কাঠফাটা রোদ তারওপর এই অদ্ভুত লোকটার উদ্ভট কথা-বার্তা! সবটাই মিলেমিশে আহিরার মেজাজ বিগড়ে ফেলতে যথেষ্ট। আহিরা ইফতির দিকে কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
~ ওই মিয়া! কাকে কি বলছেন আপনি? আমি বাচ্চা! লাইক সিরিয়াসলি! আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি ওকে।সো সেই তুলনায় আমি মোটেও বাচ্চা নই।
ইফতি যেন বেশ মজা পেলো আহিরার কথায়। না চাইতেও তার ঠোঁট ফুঁড়ে এক চমৎকার হাসি বেরিয়ে আসে। হাসির তোড়ে দেখা মিলে লুকিয়ে থাকা গজদন্ত! আহিরা বিরক্ত চোখেই তাকায় সে হাসির দিকে কিন্তু তৎক্ষনাৎ তার সকল বিরক্তি বুঝি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সে অনিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো সেই চমৎকার হাসির পানে। আহিরা খেয়াল করলো ইফতিকে। একটু গভীর চোখেই খেয়াল করলো আজকে।ছেলেটা হাসলে কেমন তার চোখ দুটোও হাসে। দৃঢ় চোয়াল, লম্বা থুতনি। থুতনির গোড়ায় শোভা পাচ্ছে এক গোছা দাড়ি। সহজ ভাষায় আহিরা যেটাকে ছাগল দাড়ি বলে সম্বোধন করে। কথাটি ভেবে মনে মনে হাসলো সে। আবারও দৃষ্টি আনে ইফতির দিকে।ছেলেটা বেশ লম্বা, কিন্তু ওতোটাও স্বাস্থ্যবান না।এইতো ছিমছাম গড়নের। ইফতিকে পা থেকে মাথা অবধি একবার অবলোকন করে মনে মনে আহিরা বলেই বসলো, ” মানুষটা যতটা বিরক্তিকর তার হাসিটা ঠিক ততোটাই মনোমুগ্ধকর! ”
আহিরা আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয় ইফতির দিকে।
ঠিক তখনই ইফতির কানে আসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সম্ভাষণ!
“চমৎকার হাসেন আপনি ”
সঙ্গে সঙ্গে হাসি থেমে যায় ইফতির।সে হাসি থামিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় আহিরার পানে।
এদিকে নিজের ভাবনায় এতোটাই বিভোর হয়ে পড়লো আহিরা, যে কখন তার অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত সম্ভাষণ সে টের অবধি পেলো না। ইফতির এমন তাকানোতে ভড়কে যায় আহিরা। তক্ষুনি অপ্রস্তুত হয় নিজের করা বোকামির জন্য। মনে মনে ইতোমধ্যে একশ গালাগাল দিয়ে ফেলেছে নিজেকে ও। কিন্তু এতে আর কি-ই বা হবে? যা বলার তাতো বলেই দিয়েছে।
ইফতি সরু চোখে আহিরার কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে। তারপর ফিসফিস করে বলতে থাকে,
~ ব্যাপার কি মিস! এভাবে তাকিয়ে ছিলেন যে,প্রেমে পড়লেন নাকি?
ইফতির কথায় থতমত খেয়ে যায় আহিরা। দৃষ্টি হয় এলোমেলো। ফাঁকা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে,
~ কিসব যাতা বলছেন! আমি কেন আপনার প্রেমে পড়তে যাবো?
ইফতি নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আহিরার পানে।ঘামে ভেজা কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো এ মুহুর্তে বড্ড মোহনীয় ঠেকছে তার কাছে। ইফতি নিজেকে স্বাভাবিক করে। গলায় কৌতুকের রেশ টেনে বললো,
~ কেন পড়তে যাবেন তাতো জানি না, কিন্তু এটা জানি যে– এভাবে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকলে যেকোন সময় প্রেমে পড়বেন। শুধু পড়বেন না একেবারে পিছলে পড়বেন।
~ হাহ! এটা নিতান্তই আপনার ভুল ধারণা মিস্টার। আহিরা এহসান এতো সহজে কারো প্রেমে পড়বার নয়।
এ-পর্যায়ে ইফতি বাঁকা হাসে। ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভাবার ন্যায় বলে ওঠে,
~ উমম.. কিছুক্ষণ আগে কে যেন বলছিলো আমার হাসি নাকি চমৎকার। তা সেটা কি কেও ঘোরে পড়ে বলেছিলো?
আহিরা আবারও অপ্রস্তুত হয়। দাত দিয়ে জিভ কেটে অন্যদিকে মুখ ফেরায়।অতপর গলায় দ্বিগুণ ঝাঁজ এনে বলে,
~ চমৎকার না ছাই! এই সরুন তো।যেতে দিন আমায়।এই কাঠফাটা রোদের মধ্যে দাড়িয়ে আপনার সঙ্গে এসব ফালতু কথা নিয়ে তর্ক করবার মোটেও সময় নেই আমার কাছে।
কথাগুলো বলে মুখ ঝামটি মেরে সেখান থেকে গটগট পায়ে কেটে পড়ে আহিরা।যেতে যেতে অবশ্য নিজের মাথায় জোরেসোরে একটা চাটি মারতে ভুললো না সে।
অন্যদিকে ইফতি আড়চোখে তাকিয়ে আছে আহিরার যাওয়ার পানে। মুখে তার মৃদু হাসি। হাত বাড়িয়ে মাথার পেছনের চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে, একদৃষ্টিতে আহিরার চলে যাওয়া দেখতে থাকে।তারপর হঠাৎ বিড়বিড়িয়ে বলে,
~ প্রেমে তোমায় পড়তেই হবে মেডাম! হয় আজ নয়তো কাল।
~ কিরে তুই এখন এখানে? অফিস যাসনি?
তাশরিক সাহেব অনিককে এই ভরদুপুরে নিজের টিচার্স রুমে দেখে ভারি অবাক হয়। তিনি নিজের আসন ছেড়ে উঠে আসে অনিকের সন্নিকটে। অনিককে নিয়ে টিচার্স রুমের বাইরে চলে আসে। অতপর উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে,
~ কিরে কথা বলবি তো! হঠাৎ আমার ভার্সিটিতে কেন?
অনিক এবার নিরবতা ভেঙে স্বাভাবিক গলায় বললো,
~ না তেমন কোন কারন নেই।আসলে আমার আজকে শরীরটা তেমন ভালো ঠেকছে না বলে হাফডে করে ছুটি নিয়েছি। আর রইলো বাকি এখানে আসার তাহলে বলবো কিছু একটা দরকার ছিলো তাই…
অনিকের কথা শেষ হবার আগেই তাশরিক সাহেব তাকে থামিয়ে নিজে বলতে শুরু করেন,
~ কি দরকার বল আমায়।আমিও তোকে হেল্প করি।
অনিক একবার আশপাশ তাকায়। আশেপাশে কাওকে দেখতে না পেয়ে তার চাচ্চুকে বললো,
~ তুমি ফ্রী থাকলে চলো ক্যান্টিনে বসে কথা বলা যাক!
~ হ্যা,হ্যা তা আর বলতে! চল।
বলেই দুজন হাটা ধরে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে।বলাবাহুল্য তাশরিক সাহেব রৌদ্র আর অনিকের সাথে যথেষ্ট ফ্রী। তিনি তাদের চাচ্চু কম বন্ধু হবার চেষ্টায় থাকেন বেশি। রৌদ্র আর অনিকও তাই। তাশরিক সাহেবের সাথে এমন অনেক কিছুই তারা শেয়ার করে যেটা আর কারো সাথে অতোটা শেয়ার করা যায় না।
ক্যান্টিনে এসে দু কাপ কফি অর্ডার দিয়ে খোশমেজাজে চেয়ার টেনে বসে পড়েন দু’জনে। পরমুহূর্তেই শোনা যায় তাশরিক সাহেবের কৌতুহলী কন্ঠ,
~ কিরে এবার তো বল কথাটা কি?
অনিক একটা শুষ্ক ঢোক গিলে। মনে মনে হাজারো কথা সাজাচ্ছে ছেলেটা। অথচ দেখো, মুখ ফুঁড়ে একটা শব্দও কেমন বেরোচ্ছে না! কিয়ৎক্ষন বাদে অনিক জিভ দ্বারা তার শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বলতে শুরু করে,
~ আসলে, আমি..
~ আরে এতো আমতা আমতা করছিস কেন? নির্বিঘ্নে বল সবটা।
অনিক এবার লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়। মনে মনে কনফিডেন্স জমিয়ে তাশরিক সাহেবের চোখে চোখ রাখে। তারপর বলে,
~ আমি একটা মেয়েকে খুঁজছি। তোমার ভার্সিটিরই। এন্ড আই থিংক আ’ম ইন লাভ উইথ হার!
অনিক খেয়াল করলো তাশরিক সাহেব কেমন হা করে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। চোখের পাতাটাও পলকহীন। এরম অবস্থা দেখে অনিকের ভ্রুদ্বয় কুচকে আসে। সে খানিকটা চাপা স্বরে বললো,
~ কি ব্যাপার! কি এমন বললাম যে এমন হা হয়ে রিয়াকশন দিচ্ছো।
তৎক্ষনাৎ তাশরিক সাহেব মুখ বন্ধ করে নেয়। আমতা আমতা করে বলেন,
~ আর ইউ শিওর?
অনিক কোনরূপ ভনিতা ছাড়াই সহসা জবাব দেয়।
~ইয়াহ, ১১০% শিওর।
এবার বুঝি কথাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো তাশরিক সাহেবের কাছে। তিনি অনিকের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘোরান। টেবিলের ওপর হাত টেনে মুখের সামনে ধরে মিটমিট করে হাসতে থাকেন অনিকের আড়ালে। কিন্তু এ হাসি কি আর অলক্ষ্যে থাকে? অনিকতো ঠিকই টের পাচ্ছে তার হাসি।
অনিক এবার মুখ ফুলিয়ে বললো,
~ কি এমন বললাম যে এতো হাসি পাচ্ছে তোমার? আমি কি কোন জোকস বললাম?
তাশরিক সাহেব এবার হো হো করে হেসে ওঠলেন।তার হাসির শব্দে আশ-পাশের টেবিলের দু-একজন আড়চোখে তাকায় তাদের দিকে। তৎক্ষনাৎ নিজের অট্টহাসি থামিয়ে মিটমিটিয়ে হাসতে থাকেন তিনি।অনিকের মেজাজ বুঝি তার খেই হারালো।সে যখন টেবিল ছেড়ে উঠে পড়তে নিবে ওমনি তার হাতে টান পড়ে। অনিক ঘাড় বাকিয়ে তাকায়। দেখতে পায় তাশরিক সাহেব একহাতে কান ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তখনি তার কানে আসে তাশরিক সাহেবের আলতো কন্ঠ।
~ সরি রে! এভাবে উঠে পড়িস না।বস এখানে।
অনিকের রাগ গুলো যেন মুহুর্তে উধাও হয়ে গেলো। তবুও সে মুখভঙ্গিতে মেকি অভিমান টেনে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে। তাশরিক সাহেব অনিকের অভিমানে মুচকি হাসে। তারপর স্বাভাবিক গলায় বললেন,
~ যাক তাহলে, আমার অনিকও তবে কাওকে পছন্দ করলো শেষমেশ। তা মেয়েটা কে জানতে পারি?
তাশরিক সাহেবের প্রশ্নের প্রতিত্তোরে অনিক মুচকি হাসে। গলায় কোমলতা এনে বললো,
~ কে তা ঠিক বলতে পারবো না।কিন্তু হ্যা, ও তোমার এই ভার্সিটিরই স্টুডেন্ট। সেদিন যখন তোমার ব্যাগটা দিতে এসেছিলাম তখনি তাকে দেখেছি। বিশ্বাস করো! সেদিনের পর থেকে প্রতি মুহুর্তে শুধু ওর চেহারাটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠছে। এমনকি কয়েকদিন আগে অফিসের এক ছেলে কলিগকে ঐ মেয়েটা মনে করে হাতও ধরে ফেলেছি।ইশশ, সে কি লজ্জা! কি যে একটা অবস্থা হলো আমার।
অনিকের আফসোস ভরা কন্ঠ শুনে বহুকষ্টে নিজের হাসি গুলো ধামাচাপা দিচ্ছে তাশরিক সাহেব। পাছে না আবার হেসে দেয়ার জন্য ছেলেটা রেগে যায়।
প্রায় মিনিট খানেক পর তাশরিক সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
~ হুম! তুমি তাহলে মেয়েটার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানোনা। কিন্তু অনিক! নাম না জেনে, কিসে পড়ে তা না জেনে এতো বড় ভার্সিটিতে তাকে খুজবে কেমন করে? ভার্সিটিতে-তো আর এক-দুজন পড়ছে না তাইনা?
অনিক নিরব হয়ে সবটা শুনলো। তার চাচ্চুর কথা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। ঠিকই তো, এতো বড় ভার্সিটিতে মেয়েটাকে ও খুজবেই বা কোথায়?
অনিক আশাহত হলো। মনটা কেমন ভার হয়ে আসলো ক্ষনিকেই। চোখেমুখে ছেয়ে যায় রাজ্যের আধার। তাশরিক সাহেব সামনে বসে সবটাই অবলোকন করছেন। অতপর তিনি এক ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলে টেবিলের ওপর রাখা অনিকের হাতের ওপর নিজের হাত রেখে আশ্বস্ত করে বললেন,
~ অনিক! ডোন্ট বি সো চাইল্ডিশ ম্যান! জাস্ট বি স্ট্রং। একটা কথা সবসময় মনে রাখবি, কেও যদি কারো ভাগ্যে থাকে তাহলে হাজার বাঁধার পরও আপন হয়েই ছাড়ে। ঠিক তেমনি ঐ মেয়েটা তোর ভাগ্যে থাকলে তোদের আবারও দেখা হবে দেখে নিস!
চাচ্চুর কথায় অনিকের মনটা বেশ হালকা হয়। সে মাথা ঝাকিয়ে চাচ্চুর কথায় সায় জানায়। তাশরিক সাহেব সেদিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।
তারপর তিনি প্রসঙ্গ পাল্টাতে এটা-সেটা নিয়ে আলাপ চালালেন। এরই মাঝে তাদের কফিও এসে পড়ে। তাশরিক সাহেব কফিতে একটু একটু চুমুক দিচ্ছেন আর অনিকের সাথে আলাপ করছেন। ঠিক তখনি এক মেয়েলি সুর তাদের কথোপকথনে ব্যাঘাত ঘটায়।
~ এক্সকিউজ মি স্যার!
অনিক বেচারা মাত্রই কেবল কফিটা ঠোঁটের সংস্পর্শে এনেছিলো, ওমনি মেয়েলি ডাকের উৎসের দিকে তাকাতেই তাল সামলাতে না পেরে গরম কফিতে জিভ পুড়িয়ে ফেলে। বিদঘুটে যন্ত্রণায় জিভটা কামড়ে ধরে তৎক্ষনাৎ। কিন্তু মুহুর্তেই নিজের সব ব্যাথা,যন্ত্রণা ভুলে সামনে তাকায় আবারও। অনিক ভাবলো — সে স্বপ্ন দেখছে না তো? অনিক একবার -দুবার পরপর কয়েকবার চোখ কচলে আবারও সামনে উপস্থিত মেয়েটির দিকে তাকালো।প্রথমে সে ভেবেছিলো মেয়েটা হয়তো আবারও তার কল্পনার ভুল কিন্তু এখন যে সে একশভাগ নিশ্চিত এটিই সেই মেয়ে যাকে সে এতদিন মনে মনে খুঁজছে। অনিক নিজের হতবাকতা কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার প্রানপন চেষ্টা চালায় কিন্তু তাতে কাজ হলেতো! এই যে মেয়েটার সামনে আসাতেই কেমন বুকের মাঝে ঢিপঢিপ শব্দটা তুলনামূলক বেশ জোরে চলছে।অনিক এবার চিন্তিত হয়, বুকের মাঝে যে এতো জোরে আওয়াজ হচ্ছে বাইরে থেকে না কেও আবার সবটা শুনে ফেলে। পরক্ষণেই অনিক নিজের এমন উদ্ভট ভাবনায় প্রচুর বিরক্ত হয়। নিজেকে কোনরকম সামলে নিয়ে কান খাঁড়া করে মেয়েটির কথা শুনতে।
তাশরিক সাহেব মেয়েটির ডাকে তার দিকে ফিরে তাকায়। তারপর মেয়েটির দিকে তাকাতেই মুখে টানে অমায়িক হাসি। তাশরিক সাহেব চোখের ইশারায় মেয়েটিকে কাছে ডাকলেন। মেয়েটিও ইশারা পেয়ে ধীর কদমে এগিয়ে আসে তার দিকে।অনিক খেয়াল করলো মেয়েটির চোখদুটো কেমন চিকচিক করছে। আচ্ছা ও কি কেঁদেছে? নাকি কাঁদতে চাইছে! অনিক নিজের ভাবনা চিন্তা নিজ অবধি সীমাবদ্ধ রাখলো।চেয়ারে আয়েশ করে বসলো মেয়েটার কথা শোনার জন্য। মনের মধ্যে তার অধীর আগ্রহ।
মেয়েটি তাশরিক সাহেবের কাছে এসে সালাম জানায়। তাশরিক সাহেবও তার উওর দেয়। অতপর নিজ থেকে বললো,
~ কি ব্যাপার ইকরা! হঠাৎ এখানে আসলে।কিছু বলবে?
ইকরা কি বলবে! সে-তো কেমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাশরিক সাহেবের দিকে। হয়তো মন ভরে দেখছে তার মামাকে। তাশরিক সাহেব ইকরার মৌনতায় কপালে ভাজ ফেলেন। রাশভারী গলায় বললেন,
~ কি হলো! চুপ করে আছো যে!
হঠাৎ ডাকে ইকরা হকচকিয়ে ওঠে। সৎবিৎ ফিরে পেয়ে অপ্রস্তুত হয় কিছুটা। অন্যদিকে ইকরার এমন আচরণে অনিক এবং তাশরিক সাহেব দুজনেই অবাক হয়। তাশরিক সাহেব ভাবছেন, — হলোটা কি মেয়েটার! হঠাৎ এমন উদ্ভট আচরণ করছে কেন?
ইকরা এবার আমতা আমতা করে বলতে থাকে,
~ ইয়ে, মানে স্যার আমার আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। যদি আপনি কিছুটা সময় দিতেন।
ইকরার কথায় তাশরিক সাহেব বেশ অবাক হন। মনে মনে ভাবছেন, — যেই মেয়ে আজ অবধি কোনদিন কোন টিচারের দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি এমনকি পড়া না বুঝলেও ইন্ট্রোভার্সির কারনে নিজ থেকে জানতে চায়নি সেই মেয়েটা আজ নিজ থেকে তার সাথে একা কথা বলতে চাইছে? মানে সত্যি! এটাও সম্ভব!
কিয়ৎকাল বাদে তাশরিক সাহেব নিজের সকল ভাবনার ইতি টানলেন। গলায় গাম্ভীর্যতা এনে বললেন,
~ ওকে তুমি যাও আমি আসছি।
ইকরাও তার কথায় মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে।
তাশরিক সাহেব সেদিকে একপলক তাকিয়ে অনিকের দিকে তাকায়।তখনি তার চোখ ছোট ছোট হয়ে আসে। অনিকের চোখেমুখে স্পষ্ট মুগ্ধতা। তাশরিক সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
~ কিরে! ওভাবে কি দেখছিস?
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৪
অনিক নিজের দৃষ্টি সরায় না। ইকরার প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থেকেই বিড়বিড়িয়ে বললো,
~ চাচ্চু! শি ইজ দা ওয়ান হুম আই ওয়াজ লুকিং ফর!
অনিকের কথায় তৎক্ষনাৎ বসা ছেড়ে দাড়িয়ে পড়েন তাশরিক সাহেব। চক্ষু তার ছানাবড়া। কন্ঠে অবাকের রেশ ধরে একপ্রকার জোরেই বললেন,
~ হোয়াট!