সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৬

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৬
Jannatul Firdaus Mithila

রৌদ্রর রুম থেকে ফিরে নিজের রুমে চলে আসে অরিন।রুমে প্রবেশ করেই নিজের হাতে থাকা জিনিস গুলোর দিকে একনজর তাকিয়ে বিছানায় রাখে সব,অতপর নিজেও বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। অরিন সিলিংয়ের দিকে নজর দিয়ে ভাবতে থাকে,
” আচ্ছা রোদ ভাই কি সত্যি আমাকে পছন্দ করে না? তার মনে কি আমার জন্য তেমন কোন ফিলিংসই নেই? আমি কি শুধু শুধুই একটু বেশি ভাবছি? সে কি আমাকে শুধুই তার কাজিন মনে করে?”

এ-সব ভাবনার মাঝেই অরিন বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় চলে যায়। বারান্দায় গিয়ে নিজের এটাচ দোলনা টায় বসে পড়ে সে।কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার।এডমিশন টেস্টটাও আরও মাসখানেক পড়ে হবে।ভেবে রেখেছে এডমিশন টেষ্টটা কম্পলিট করেই একটু কিছুদিনের জন্য নানাবাড়িতে যাবে নাহয়। মন এবং মাইন্ড দুটোই আপাতত ফ্রেশ করা প্রয়োজন। অরিন বেশ বুঝতে পারছে,তার বয়সের ঝোকটা একটু বেশিই হচ্ছে। নাহ এমনটা চললে তো হয় না,নিজেকে সামলাতে হবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অরিন বারান্দা ছেড়ে রুমের বাহিরে চলে যায় ইতোমধ্যেই রুহি এসে তাকে খাবারের জন্য বেশ কয়েকবার ডেকে গেছে। ডাইনিং রুমে গিয়েই নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ার টেনে বসে পড়ে অরিন।তার পাশেই বসে আছে তার ভাইয়ু অনিক। অনিক আবার তার বনুর পাশ ছাড়া বসে না।অরিনের একদম মুখোমুখি চেয়ারে রৌদ্র বসেছে। অরিন রৌদ্র কে দেখে প্রথমে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলেও পরক্ষণেই নিজেকে মানিয়ে নেয়।মনে মনে ভাবতে থাকে,” এখন থেকে তো রোজই রোদ ভাই কে উঠতে, বসতে, খেতে দেখতে হবে, তাই এখন থেকেই এ-সবে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া বেটার।” অরিনের এমন খাবার পাতে নিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে ভাবনায় পড়ে থাকতে দেখে অনিক তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,

— বুড়ি খাচ্ছিস না কেন? আজ তো তোরও পছন্দের আইটেম রয়েছে। খেয়ে ফেল চটজলদি।
— হু,হ্যা ভাইয়ু খাচ্ছি।
এদিকে রৌদ্রর পাশে বসেছে রুহি।কতদিন পর নিজের ভাইয়ের সাথে বসে একসঙ্গে খাবার খাবে সে,ভাবতেই প্রচন্ড ভালো লাগছে তার।রৌদ্র একে একে সকলের দিকে চেয়ে থেকে সার্ভ করতে থাকা তার মা এবং চাচিদের কে বলে উঠে,
— মা তুমি আমার এ পাশে এসে বসো।মেজো মা,সেজো মা, ছোট মা তোমরাও বসো।আজকে সবাই একসঙ্গে খাবার খাবো।
— বাবা তুই খা,,জবা তুই রোদের পাশে গিয়ে বস।আমি বেড়ে দিচ্ছি যা।
রাফিয়া বেগম বলেন।

— না মেজো মা।আমি সবাই কে বলেছি বসতে। আর টেবিলে সবটা রাখাই আছে আমরা নিজেদের টা নিজেরা নিয়ে খেতে পারবো।এখন আর কথা নয় বসো এবার।
রৌদ্রর এমন কথায় সকলে মুচকি হেসে বসে পড়লো চেয়ারে। রৌদ্রর ডান পাশে তার মা এবং বামপাশে রুহি।রৌদ্র একটু পর পর তার মায়ের পাতে এবং বোনের পাতে এটা ওটা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে সকলের পাতে এটা ওটা নিজে উঠিয়ে দিচ্ছে।কবির সাহেব ছেলের এমন কান্ডে মুচকি হাসছে বারংবার।রৌদ্র খাওয়ার মাঝে একফাঁকে অরিনের দিকে তাকায় যে খাবার পাতে নিয়েই একবার আহির সাথে তো একবার মাহির সাথে কি নিয়ে যেনো হাসি ঠাট্টা করছে।আর অনিক বোনকে যত্ন করে মাছ বেছে দিচ্ছে কখনো আবার মুখেও তুলে দিচ্ছে। রৌদ্র অরিনের দিকে কিছুটা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো, রৌদ্র খেয়াল করলো অরিন খাবার খাওয়ার সময় তার গাল দুটো বেশ ফুলে উঠে। কি যে সুন্দর লাগে দেখতে তখন।হঠাৎ করেই অরিন খাবার চিবুতে চিবুতে রৌদ্রের দিকে তাকায় আর সাথে সাথেই রৌদ্র চোখ সরিয়ে নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে একমনে খেতে থাকে।অরিন কিছুটা ভড়কে যায় মনে মনে বলতে থাকে,

” আচ্ছা আমার এমন কেনো মনে হলো রোদ ভাই এতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো? কিন্তু তাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না। না কি এটা আবার আমার মনের ভুল ”
পরক্ষণেই এসব ভাবনা পাশে রেখে আবারও খাওয়ায় মশগুল হয় সে।

বিকেল সাড়ে ৫ টা। অরিন তখন খাবার শেষ করে এসেই কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে পড়ে। সময় বেশি নেই,যদিও অরিনের সিলেবাস কমপ্লিট বাট তবুও সে এ বিষয়ে কোন রিস্ক নিতে চায় না।ঢাবিতে তো তার চান্স পেতেই হবে। টানা দু’ঘন্টা পড়ার পর মাত্র অরিন টেবিল ছেড়ে রুমের বাহিরে চলে যায়। হঠাৎ দোতলার ছোটো ড্রয়িং রুমে হাসির শব্দে সেদিকে হাটা দেয় অরিন,গিয়ে দেখে রুহি মোবাইলে কি যেন দেখছে আর হাসতে হাসতে সোফায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। অরিন রুহির পাশে গিয়ে বসে পড়ে আর বলতে থাকে,
— রুহিপু এমন করে হাসছো যে,খুব ফানি কিছু দেখছো নাকি? কই দেখাও না একটু।
— হুম আয় দেখ।

বলেই রুহি একটি ফানি Fails fall ভিডিও দেখাতে থাকে। এবার অরিনও সমান তালে হাসা শুরু করে।
এরই মাঝে বাসায় উপস্থিত হয় অন্য কেউ।কলিং বেলের আওয়াজেই সদর দরজা খুলে দেয় ফুলি।দরজার সামনে উপস্থিত ব্যাক্তিকে দেখে একটা লম্বা সালাম দেয় সে।পরক্ষণেই ভেতরে আসতে বলে নিজে ছুটে চলে যায় ড্রয়িং রুমে,সেখানে আগে থেকেই জুবাইদা বেগমের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলো রাফিয়া বেগম। ফুলিকে এমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে প্রশ্ন করেন রাফিয়া বেগম,
— কিরে ফুলি কি হয়েছে? এমন করে ছুটছিস কেনো?
— মেজো খালা, রোদ ভাইজানের বন্ধু আইছে। ঐ যে হের পিরিও বন্ধুডা আছে না,, উফফ কি জানি নামডা মনে আইতাছে না।

— রেহান।আমার নাম রেহান মেহবুব ফুলি।
সহসা নরম কন্ঠে পেছন থেকে বলে উঠে রেহান।
রেহানকে দেখে জুবাইদা বেগম ও রাফিয়া বেগম বেশ খুশি হয়।তারা বসা ছেড়ে উঠে রেহানের কাছে এগিয়ে তার হাত ধরে সোফায় বসায়,জুবাইদা বেগম বলেন,
— কি বাবা,কেমন আছিস তুই।কতগুলো দিন পরে এলি। শুনলাম তুই তো নাকি দু’বছর আগেই দেশে ফিরেছিস তাহলে একবারও এ বাড়িতে এলি না যে? আমাদের কথা মনে পড়ে নি বুঝি তাই না? আজ রোদ আসলো বলেই এ মুখো হলি তাই তো?

— ছিঃ ছিঃ আন্টি কি বলছেন। এমন কিছুই না।আসলে এ বাড়িতে আসলে রোদকে খুব বেশি মনে পড়তো তাই আরকি ওর অনুপস্থিতিতে আসিনি।আর রইলো বাকি মনে পড়ার কথা, তাতো অবশ্যই মনে পড়েছে। আপনার হাতের খিচুড়ির কথা কি আর আদৌ ভোলা যায় বলুন।
অমায়িক একটি হাসি দিয়ে বললো রেহান।সে আবার বলে উঠে,
— আন্টি রোদ কই?
— বাবা ও তো রুমে,তুমি বরং ওর রুমে চলে যাও।আর হ্যা আজ কিন্তু ডিনার না করিয়ে ছাড়ছি না তোমায় কেমন।বলেই মিষ্টি হাসলো রাফিয়া বেগম।

রেহান ও তাদের কথায় সায় জানিয়ে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়।এদিকে রেহানের চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো দুই বান্ধবী। রেহানকে তাদের দুজনেরই বেশ পছন্দ। ৬ ফুট উচ্চতার ফর্সা ত্বক,গালে হালকা চাপ দাড়ি কি সুন্দর অমায়িক দেখতে ছেলেটা।রেহানও এতবছর বিদেশেই পড়াশোনা করেছে এই তো দু’বছর হলো দেশে ব্যাক করে নিজের বাবার ব্যাবসায় যোগ দিয়েছে। ইতোমধ্যেই বেশ নামডাক হয়েছে ছেলেটার।রৌদ্র আর রেহান দুজনেই দু’জনার বেস্ট ফ্রেন্ড। রাফিয়া বেগম তো প্রায়ই এই ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন।জুবাইদা বেগমও অবশ্য তেমনটাই মনে করেন।অতঃপর এসব ভাবনার ইতি টেনে দু’জন চলে যায় রান্নাঘরে সন্ধ্যার নাস্তা তৈরিতে।

রেহান সিড়ি দিয়ে উঠতেই কারো খিলখিল হাসির আওয়াজে ত্রস্ত পায়ের গতি কিছুটা শিথিল করে সামনে এগোতেই এক শ্যামবতীর মুক্তোঝরানো হাসিতে থমকে দাঁড়ায়।এই শ্যামবতীকে যে তার বড্ড চেনা।এই মুক্তোঝরানো হাসিতে যে সে ঘায়েল হয়েছে বারংবার। পৃথিবীর এত এত সুন্দরীর ভিড়েও যে সে আটকে আছে এই শ্যামাঙ্গনা মায়াবতীর হাসিতে।আচ্ছা এই মেয়ে কি জাদু জানে? যদি না-ই জেনে থাকে তাহলে তার কাছে আসলেই রেহানের সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় কেনো? রেহান কেনো নিজের ভেতর থাকে না? কেনো হারিয়ে যায় সে বারবার এই শ্যামাঙ্গীনির মায়াবী স্নিগ্ধ মুখশ্রীটিতে?
আচ্ছা ও তো ওর বন্ধুর বোন। বন্ধুর বোনের দিকে এমন করে তাকানো টা যে অন্যায় রেহান কি তা জানে না? জানে তো, কিন্তু রেহানের বেহায়া চোখ যে তা মানতে নারাজ। সে ঘুরে ফিরে ঐ শ্যামবতীর তরেই আটকায়।
অরিনের হঠাৎ চোখ যায় সামনে দাড়িয়ে থাকা রেহানের দিকে।রেহানকে দেখেই সে ছুটে তার সামনে গিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠে,

— রেহান ভাইয়া।কখন এলে তুমি? কেমন আছো বলো? আর এতদিন এলে না যে? আমাকে একবার ও মনে পড়লো না বুঝি?
অভিমানী ভনিতা করে অনবরত বলতে থাকে অরিন।রেহান এতক্ষণে রুহির থেকে চোখ ফিরিয়ে অরিনের দিকে তাকায়,অরিনকে দেখে দাত বের করে লম্বা হাসি দেয় রেহান। অতঃপর সাফাই দেওয়ার ভঙ্গিতে বলতে থাকে,
—আসলে অরিন সোনা হয়েছে কি,ভাইয়া একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই আর কি।

— হয়েছে হয়েছে, সব বুঝি। আমাকে একটু ও মনে পড়েনি তোমার। আজও তো এসেছো নিজের বন্ধু আসছে বলে।
বলেই মুখ ভেঙচি কাটে অরিন।অরিনের মুখ ভেঙচি দেখে হো হো করে হেসে উঠে রেহান।অরিন ও হেসে দেয় তার সাথে। এদিকে কারো বুকে যে রেহানের হাসি তোলপাড় তুলে দিচ্ছে তা কি রেহান বুঝছে? এভাবে হাসে কেনো লোকটা? সে কি জানে না তাকে হাসলে কেমন মারাত্মক লাগে?রেহানের হাসির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে এসবই ভাবছিলো রুহি,আচমকা রেহান তার দিকে তাকাতেই কিছুটা থতমত খায় রুহি তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরায় সে।এদিকে রুহির এমন অবস্থা দেখে মুচকি হাসে রেহান।অরিনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

— অরিন।আসলে ভাইয়ার না খুব তেষ্টা পেয়েছে। একগ্লাস পানি দিতে পারবে আমায়?
— হ্যা অবশ্যই তুমি বসো আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।
— ওকে।বলেই রেহান রুহির পাশের সোফার সামনে সটান হয়ে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে, তার নজর এখন ঠিক তার সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকা শ্যামাঙ্গীনির ওপর।রেহানের মনে এখন খুব ভয়ংকর রকমের কিছু ঘটাতে ইচ্ছে করছে,পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করে রেহান। রেহানকে এতটা কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বুক ধড়ফড়িয়ে উঠে রুহির, না এই লোকের সামনে আর এক মুহূর্ত বসে থাকলে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করবে সে।ভেবেই উঠে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিবে এমন সময় রেহান পেছন থেকে বলে উঠে,
— আমি যেতে বলি নি রুহি।

কি হলো রুহির কে জানে? সে সহসা থমকে দাঁড়ালো। মনে হচ্ছে তার পা দুটো বুঝি ফ্লোরে কিছুর সাথে আটকে গেছে,কই একপা ও নড়বার শক্তি পাচ্ছে না কেনো সে? হঠাৎ তার নাকে এসে ঠেকে পুরুষালী মনোমুগ্ধকর পারফিউমের সুবাস।বেশ বুঝতে পারছে রুহি লোকটা তার বেশ কাছে এসে দাড়িয়েছে। আচমকাই রেহান রুহির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
— এতো পালাই পালাই করো কেনো তুমি? আমার সামনে থাকলে কি আমি তোমায় খেয়ে ফেলবো? অবশ্য তার জন্য বহু সময় পড়ে আছে। নিজেকে আমার সাথে সহজ করো।এতটা পালাই পালাই করতে থাকলে আই সয়্যার, আমি কিছু একটা করে ফেলবো।
ব্যস এই সামান্য কথাটুকুই যথেষ্ট ছিলো রুহিকে অস্থির করে তুলতে। রুহি আর এক মুহূর্ত ও সেখানে দাড়ালো না। দৌড়ে ছুটে পালালো নিজের রুমে। রুমে গিয়েই দরজা আটকে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে থাকে রুহি,, ইশশ লোকটা এসব কি বললো তাকে? রুহির এত লজ্জা লাগছে কেনো এসব শুনে।উফফ হৃৎপিণ্ড টা কেমন দুরন্ত গতিতে লাফাচ্ছে।এসব ভাবতে ভাবতেই রুহি নিজের দুহাত দিয়ে বুকের বা পাশটায় চাপ দিয়ে ধরে রাখে।উদ্দেশ্য এই অনিয়ন্ত্রিত হৃৎস্পন্দনের গতিটা থামানো,কিন্তু এ কি আর এত সহজ।

অরিন পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এসে দেখে রেহান একা একা হেসেই চলছে। অরিন সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— রেহান ভাইয়া তুমি একা একা হাসছো কেনো? আর রুহিপু কই গেলো?
— রুহির নাকি কি কাজ ছিলো তাইতো তুমি যাওয়ার পরই সেও চলে গেলো।হাসি থামিয়ে বলে উঠে রেহান।
— ওহ আচ্ছা সে যাকগে এই নাও তোমার পানি।
গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে অরিন।
— থ্যাংকস অরিন।
পানি খেয়েই অরিনের থেকে বিদায় নিয়ে রৌদ্রর রুমের সামনে গিয়ে দাড়ায় রেহান,দরজা ভেতর থেকে লক তাই সে নক করতে থাকে।বেশকিছুক্ষন পর রৌদ্র দরজা খোলে।ঘুমঘুম চোখে সামনে তাকিয়ে দেখে রেহান আর ওমনি ওর সকল ঘুম দূর।রেহান রৌদ্রর দিকে কিছুপল তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো করে অভিযোগ করতে শুরু করে,
— এই তুই এসে একটা বারও কল দিলি না ক্যান হ্যা? তুই এতটা পাষাণ,যাহ তোর সাথে কাট্টি।আর কথা কমু না যাহ।

— আচ্ছা বলিস না। বলেই বন্ধু কে টাইট হাগ করে রৌদ্র। রেহানও গলে পানি।রৌদ্রর সামনে কি আর ওর এমন রাগ টিকে থাকে।রেহানকে ছেড়ে দিয়ে ভেতরে আসতে বলে রৌদ্র আর সে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে যায়। এরইমধ্যে রুমে আসে অনিক, এসেই রেহানের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে উঠে,
— কেমন আছো রেহান ভাই। এতদিন কই ছিলে? একবারো আসলে না যে?
— তুই তো জানিস অনিক রৌদ্র না থাকলে আসতে ইচ্ছে করে না।এ বাড়িতে আসলেই রৌদ্র কে খুব মনে পড়তো তাই আর কি!
ওদের কথার মাঝেই রৌদ্র ও ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসে। ফুলিও ততক্ষণে ট্রে ভর্তি নাস্তা নিয়ে হাজির।
বলাবাহুল্য রৌদ্রর রুমটি বেশ বড়।রৌদ্রর রুমটি আধুনিক ডিজাইনে ডেকোরেট করা। রুমটির একপাশে একটি কিং সাইজ বেড, তার দুপাশে বেড সাইড টেবিল,তার পাশে একটি পড়ার টেবিল,তার সাথেই দেয়ালের সাথে এটাচড ওয়্যারড্রোভ।বিছানার বাম পাশে আছে একটি বড় ড্রেসিং টেবিল তার পাশে একটি শোপিসের ক্যাবিনেট ইত্যাদি।
ফুলি নাস্তাগুলো টেবিলের ওপর রেখে চলে যায়। রৌদ্র, অনিক আর রেহান একসাথে গল্প গুজবে মেতে উঠে। বেশখানিকটা সময় পেরিয়ে যাবার পর তারা উঠে বাহিরে ঘুরতে চলে যায়।

এদিকে রাত নয়টা বাজতে চললো অরিন এখনও পড়ছে।তখন রেহানের থেকে বিদায় নিয়ে ছাদে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে আবারও পড়তে বসেছে অরিন। সেই থেকে টানা পড়ছে এখনও।অনেক্ক্ষণ একইভাবে বসে থাকার ফলে পিঠ ধরে আসছে তার তাই সে পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে বারান্দায় চলে যায়।আকাশে আজ মস্ত বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে। অরিন একমনে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। মৃদুমন্দ বাতাসে তার কোমরের নিচ অবধি চুলগুলো দুলছে,মাঝেমধ্যে কিছু ছোটো ছোট অবাধ্য চুল চোখে মুখে এসে পড়ছে,অরিন তাদের মোটেও সরাচ্ছে না,থাকুক না এগুলো এভাবে, ক্ষতি কি বেশ ভালোই তো লাগছে এই মুহূর্ত টা।চাঁদনী রাত,মৃদুমন্দ বাতাস,শিউলি ফুলের মিষ্টি সুবাস সবটাই যেনো মুহূর্ত টাকে এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে উপনীত করেছে।অরিন কিছু একটা ভেবে রেলিঙের পাশে আসা শিউলি ফুলের ডাল থেকে দুটো ফুল ছিড়ে নিজের কানের পিঠে গুঁজে নেয়।আবারও সে আগের ন্যায় মুহূর্ত টা উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে দূর থেকে যে একজোড়া বিড়ালচোখের অধিকারি কেউ তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে খেয়াল কি আছে অরিনের? নাহ নেই তো।এদিকে এতক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে অরিনের দিকে তাকিয়ে আছে রৌদ্র। কি ব্যাপার রৌদ্রর পলক পড়ছে না কেনো? আচ্ছা অরিনকে এই মুহূর্তে তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মায়াবীনী মনে হচ্ছে কেনো? এই মেয়েটা আর কত পাগল করবে তাকে? সে কি বুঝে না তার প্রতিটি রুপ যে কারো মনে গভীর ভাবে দাগ কাটে? ঠিক কতক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে অরিনের দিকে তাকিয়ে ছিলো রোদ তার খেয়াল নেই হঠাৎ তার ঘোর ভাঙে অনিক আর রেহানের ডাকে,
— ভাই আর কতক্ষণ বাইরে দাড়িয়ে থাকবে,এবার তো ভেতরে আসো।
— হু,ওহ হ্যা চল। বলেই নজর সরিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে সে।

রাতে রেহান সহ সকলে ডিনার করতে বসে পড়ে একসাথে। রেহানের সাথে বাড়ির কর্তারা একে একে ব্যাবসা, পরিবার এসব নিয়েই টুকটাক কথা বার্তা করতে করতে ডিনার শেষ করে তারা।ডিনার শেষে বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে আছেন বাড়ির কর্তারা সাথে রৌদ্র, অনিক রেহানও আছে।বেশকিছুক্ষন ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করে বিদায় নেয় রেহান।সকলে মিলে তাকে বেশ কয়েকবার থেকে যাওয়ার জন্য বলেছেন কিন্তু সে থাকেনি।রৌদ্র তাকে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিতে গেছে।রেহান যদিও না বলেছিলো কিন্তু রৌদ্র শুনেনি।অগত্যা রেহানও আর কথা বাড়ায় নি, না জানি বেশি না না করলে কখন জানি গম্ভীরমুখো বন্ধু রাগ করে বসে।

রেহানকে বাড়িতে পৌছে দিয়ে আসতে আসতে ১২ টা বেজে যায় রৌদ্রর। বাড়িতে প্রবেশ করেই ড্রয়িং রুমে তার মাকে বসে থাকতে দেখে।মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠে রৌদ্র,
— আম্মু এখনো ঘুমাও নি? এভাবে এখানে এত রাত অবধি বসে আছো কেন? যাও রুমে যাও।আমার জন্য এভাবে আর কখনো যেনো অপেক্ষা করতে না দেখি।এমন চলতে থাকলে শরীর খারাপ হতে বেশিদিন লাগবে না।
কথা শেষ করেই মায়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় মায়ের রুমের সামনে। রুমের দরজা খুলে মাকে ভেতরে প্রবেশ করায় রৌদ্র এরপর গুডনাইট বলে চলে আসে সে।এদিকে ছেলের এমন আদুরে ব্যাবহারে কলিজাটা শীতল হয়ে আসে জুবাইদা বেগমের। রৌদ্র নিজের রুমে প্রবেশ করার আগে অরিনের রুমের সামনে এসে থমকায়।কি ব্যাপার! মেয়েটা এত রাত অবধি পড়ছে, হ্যা পড়ার আওয়াজি তো শোনা যাচ্ছে।
অরিনের রুমের দরজা হালকা ভিড়ানো ছিলো বিধায় রৌদ্র সহজেই সবটা অবলোকন করতে পেরেছে। কিছু একটা ভেবে রৌদ্র ভিড়ানো দরজায় হালকা করে টোকা দেয়।দরজায় আওয়াজ হওয়ার সাথে সাথেই অরিন পড়া থামিয়ে ঘাড় বাকিয়ে তাকায়,দেখে রৌদ্র দুহাত প্যান্টের পকেটে রেখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অরিন কিছুক্ষণ রোদের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বলে উঠে,

— রোদ ভাই বাহিরে দাড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন। কিছু বলবেন?
— তুই এত রাত অবধি পড়ছিস কেনো? দিনে পড়তে পারিস না। রুমে প্রবেশ করতে করতে বলে রৌদ্র।
— না আসলে দিনেও পড়তে বসেছিলাম। কিন্তু আমার কিছু ম্যাথে প্রবলেম ছিলো তাই ঐটাই একটু চেষ্টা করছিলাম আরকি।ভেবেছিলাম ভাইয়ুকে বলবো কিন্তু ভাইয়ু বাসায় লেট করে ফিরেছে তাই তাকে বলতে পারিনি।
—ওহ দেখি কোনটায় সমস্যা?
— নাহ মানে আপনাকে দেখাবো? আপনি সলভ করতে হেল্প করবেন আমায়? কিছুটা অবাক হয়ে বলতে থাকে অরিন।
— কেনো কোন সমস্যা?
— না না কি সমস্যা হবে। হে হে। বোকার মতো হেসে বলতে থাকে অরিন।
— দাড়িয়েই থাকবি নাকি দিবিও?
— ওহ হ্যা এই যে।বলেই বই থেকে তার প্রবলেম গুলো রোদের সামনে এগিয়ে দেয় অরিন।

রৌদ্র এবার অরিনের মুখোমুখি হয়ে অন্য একটি চেয়ারে বসে অরিনকে বুঝাতে শুরু করে। অরিনও বেশ মনোযোগ দিয়ে সেগুলো বুঝতে থাকে।প্রায় অনেক্ক্ষণ পর অরিনকে বুঝানো শেষ হলে রৌদ্র অরিনকে একটি ম্যাথ সলভ করতে দেয়।অরিনও সেটাতে ব্যাস্ত হয়ে যায়। এদিকে রৌদ্র ব্যাস্ত তার সানশাইনকে দেখতে। রৌদ্র খেয়াল করলো মেয়েটা আগের থেকেও অনেকটা ফর্সা হয়েছে। হালকা নাদুসনুদুস ও হয়েছে বটে।কি সুন্দর ডাগর ডাগর হরিণি চোখ, বাম গালে কালো কুচকুচে তিলটা যেনো সৌন্দর্যের টিকা হিসেবে ফুটে আছে জ্বলজল করে।একটু পর পর মেয়েটা দাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরছে। এসব দেখে রৌদ্রর হার্টবিট বুঝি আবারও লাফিয়ে লাফিয়ে বের হওয়ার উপক্রম। মাঝে মাঝে রৌদ্র নিজের হৃদয়ের ওপর বেশ বিরক্ত। থাকবে তার শরীরের ভেতরে কিন্তু লাফাবে এই মেয়েটা কে দেখলে।উফফ! আর এই মেয়েটাও তো বহুত পাজি।ও কি জানে না এভাবে কোন পুরুষের সামনে ঠোট কামড়ে ধরা অপরাধ, ঘোর অপরাধ। নাহ নিজেকে এই মেয়ের সামনে সামলানো যেনো দায় হয়ে পড়েছে। অগত্যাই রৌদ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। অরিনের দিকে না তাকিয়ে বলে,

— এখন আর এগুলো পড়তে হবে না ঘুমিয়ে পড়।কাল সকাল সকাল পড়তে বসিস।
বলেই আর এক মুহূর্ত না দাড়িয়ে হনহন করে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। এদিকে রৌদ্রর এভাবে চলে যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অরিন।তার বোধগম্য হলো না হঠাৎ তাকে ম্যাথ করতে বলে চলে গেলো কেন রোদ ভাই। পরক্ষণেই সবটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে হাতের ম্যাথটা সলভ করতে লাগলো সে।প্রায় ২০ মিনিট পর পড়া শেষ করে উঠে অরিন। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে লাইট অফ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে।আজ কেনো জানি একটু ফোন টা ঘাটতে ইচ্ছে করছে তার।যেই ভাবা সেই কাজ নেট অন করে ফেসবুকে ঢুকে পড়ে সে।ফেসবুকে ঢুকে তার সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে রৌদ্রর আইডি চেক করা। যদি ও সে অরিনের ফ্রেন্ড লিস্টে নেই,অরিন অনেক আগেই রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছিলো কিন্তু রৌদ্র একসেপ্ট করে নি।কিন্তু ফেসবুকে ঢুকে অরিনের চক্ষু ছানাবড়া। রৌদ্র আরও ৭ দিন আগেই তার রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করেছে। অরিন এখন মোবাইল ঘাটে না বিধায় তার এসবের ধারণা ও ছিলো না।প্রচন্ড খুশি হয় সে।পরক্ষণেই রৌদ্রর একটি স্ট্যাটাস সামনে আসে তার।এই তো ৩০ মিনিট আগেই পোস্টটি করেছে সে। রৌদ্রর হাতের তালুতে কতগুলো শিউলি ফুল এমন একটি পিক আপলোড করেছে সে।কিন্তু উপরের লেখা গুলো পড়ে অন্তরটা যেনো চুরমার হয়ে যায় অরিনের। রৌদ্রর স্ট্যাটাস টা ছিলো এমন:-

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৫

অনুভুতিতে কাছে পাওয়া,
ধরতে গেলে মানা।
রোজ তাকে ঘুমের রাজ্যে,
কাছে টেনে আনা।
চোখ মেললেই হারিয়ে যায়-
এ কেমন পাওয়া?
তখন আরও বেড়ে যায় –
নতুন কিছু চাওয়া।
বলতে খুব ইচ্ছে হয় মিস হাসিখুশী 🌼
নিজের অজান্তেই তোমায় আমি খুব ভালোবাসি ❤️
~J.F.M~
তাহলে কি তার রোদ ভাইয়ের জিবনে অন্য কেউ আছে? রোদ ভাই তাহলে অন্য কাউকে ভালোবাসে?

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here