সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৯
Jannatul Firdaus Mithila
“ আমার জীবনে শুরু থেকে শেষ অবধি শুধু একজনই ছিলো,আছে এবং সারাজীবন থাকবে। ”
রৌদ্রের এহেন বাক্যে থমকে যায় শিশিরের পদযুগল।বুকটা বুঝি খানিকটা কেঁপে ওঠলো কথাটায়। শিশির ফাঁকা ঢোক গিলে। শুষ্ক অধর জোড়া জিভ দিয়ে খানিকটা ভিজিয়ে আমতা আমতা স্বরে বললো,
“ কে সে?”
পেছন থেকে তৎক্ষনাৎ রৌদ্রের জবাব এলো না। কিছুক্ষণ পরও নিজের কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে বিচলিত হয়ে পেছনে ফিরে শিশির। রৌদ্রের দিকে তাকাতেই দেখতে পায়, ছেলেটা কেমন চোখ বন্ধ করে আছে। শিশির একটু এগিয়ে আসে রৌদ্রের নিকট। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
“ রোদ তোর বলতে হবে না কে সে। তুই শুধু এটুকুই বল, মেয়েটা কি তোর খুব কাছের কেও?”
কথাটা কর্নগোচর হওয়া মাত্র রৌদ্রের মুখে একটি মুচকি হাসির দেখা মিললো।সে তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে শিশিরের দিকে একপলক তাকালো। পরক্ষণেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো কাঠের ওপর মোটা শিক দেওয়া জানালার কাছে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভরাট কন্ঠে জবাব দিলো,
“ হুম সে আমার ভিষণ কাছের কেও।”
রৌদ্রের জবাবে শিশিরের অস্থিরতা বাড়লো।সে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ রোদ?”
“হুম” — রৌদ্রের ছোট উত্তর পেয়ে শিশির কিছুটা সাহস জুগিয়ে বললো,
“ মেয়েটা কি তোর আত্মীয়ের মধ্যে পড়ে? ”
তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে রৌদ্র।বাইরে থেকে মুখাবয়ব যথেষ্ট গম্ভীর রেখে সরু চোখে শিশিরকে আপাদমস্তক পরোখ করলো একবার। তারপর শান্ত অথচ নিরেট কন্ঠে বললো,
“ হঠাৎ করে তাকে নিয়ে তুই এতোটা কৌতুহলী হয়ে পড়লি যে?”
শিশির কিছুটা থতমত খেয়ে যায় এরুপ কথায়। হাত বাড়িয়ে ঘাড় চুলকে আমতা আমতা করে বললো,
“ এমনিতেই! একটু বলনা প্লিজ! ”
রৌদ্র নিজের দৃষ্টি আবারও জানালার বাইরে নিবদ্ধ করলো। খানিকক্ষণ সময় চুপ করে থেকে ধীমি কন্ঠে বললো,
“ হ্যা! ও আমার আত্মীয়ের মধ্যে পড়ে।ইনফ্যাক্ট,আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তগুলো তার সঙ্গেই কাটিয়েছি। ”
থামলো রৌদ্র। কিছু একটা ভেবে আবারও বললো,
“ শিশির! আমি তাকে খুব ভালোবাসি রে। খুব ভালোবাসি। আমার এই হৃদয়টা জুড়ে প্রথম থেকেই শুধু তারই বসবাস। জানিস? মাঝে মধ্যে নিজের এই বেহায়া মনটার ওপর না, আমি খুব বিরক্ত হই।কেননা মনটা থাকে আমার দেহের মাঝে অথচ সারাক্ষণ ভাবতে থাকে তাকে নিয়ে। এটা একটা বেইনসাফি না বল?”
রৌদ্রের কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো শিশির। মেয়েটার মুখাবয়বে স্পষ্ট খুশির ঝিলিক। হয়তো রৌদ্রের কথার সারাংশে নিজেকে বসিয়েছে বোকা মেয়েটা! অথচ মেয়েটা কি একটিবারও বুঝলো তার সামনে দাড়ানো দৃঢ় মানবটার মনের মনিকোঠায় আসলেই কার ছবি আকাঁ?
রৌদ্র পেছনে ফিরলো। শিশিরকে ওমন অন্যমনস্ক হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুকুটি করে ডাক দিলো।
“ শিশির! ”
হঠাৎ ডাকে হকচকিয়ে ওঠে শিশির।এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো রৌদ্রের গম্ভীর মুখখানা। হঠাৎ করে কি জানি হলো মেয়েটার! রৌদ্রের দিকে তাকাতেই তার শ্যামবরন মায়াবী মুখটায় এসে ভিড় জমায় একরাশ লজ্জা!
মনে মনে তার এই বুঝি হাজারো প্রজাপতি ডানা ঝাপটাতে লাগলো। সে কিছুক্ষণ এলেমেলো দৃষ্টি ফেলে বললো,
“ আমি আসছি”
কথাটা শেষ হতে হয়তো ন্যানো সেকেন্ড সময় নিলো কিন্তু এরই মাঝে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো মেয়েটা। ইশশ! হুট করেই রৌদ্রের সামনে দাড়িয়ে থাকতে তার কেমন যেন হাসফাস লাগছিলো। শিশির একছুটে চলে যায় নিজের রুমে। ঘরের দরজাটা ভেতর দিয়ে লাগিয়ে সেখানেই পিঠ ঠেকিয়ে বুকে দুহাত রেখে হাঁপাতে থাকে মেয়েটা।
মনে মনে ভাবতে থাকে কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো।
—- কি বললো রৌদ্র? সে সত্যি ওকে ভালোবাসে?
ওর ভালোবাসা তাহলে সত্যি পূর্নতা পাবে? নিজের প্রথম ভালোলাগার পুরুষকে অবশেষে নিজের করে পাবে ও?
আর ভাবতে পারছেনা মেয়েটা। অতিরিক্ত খুশিতে ও আবার পাগল না হয়ে যায়। মেয়েটা খুশিতে সারা রুমে দুহাত ছড়িয়ে গোল গোল ঘুরতে থাকে। আর বলতে থাকে,
“ আমিও তোকে ভালোবাসি রোদ। ভিষন রকম ভালোবাসি।”
সম্পূর্ণ বসার ঘরে একপ্রকার হাঁক- ডাক অবস্থা। জুবাইদা বেগমের রোদ আর শিশিরকে নিয়ে বলা কথাটা যেন এ মুহুর্তের হট টপিক। প্রত্যেকেই জুবাইদা বেগমকে শুভেচ্ছা জানাতে ব্যস্ত।কেননা তিনি যে একেবারে মেয়ে বিয়ে দেবার পাশাপাশি ছেলেকেও বিয়ে দিতে যাচ্ছেন।একটু-আধটু শুভেচ্ছা না জানালে কি আর হয়? সবাই যেখানে খুশিতে আত্মহারা সেখানে বসার ঘরের এক কোনে থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছেন মেহনুর বেগম। শুরু থেকেই শিশিরকে রোদের জন্য তার মোটেও পছন্দ হয়নি। তাইতো আর সবার মতো তিনি সামিল হলেন না বসার ঘরের হাসি-ঠাট্টায়।
অন্যদিকে রাফিয়া বেগম বাইরে থেকে খুশি ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে কেমন অস্থির লাগছে তার। কেন জানি এ বিষয়টায় মন থেকে খুশি হতে পারেননি তিনি। ভেতরটা কেমন কু গাইছে তার! তিনি বেশ টের পাচ্ছেন কিছু একটার!
আহি-মাহি আর সোহেলী মিলে গল্প জুড়ে বসেছে নিজেদের মতো। পাশ থেকে যে আরেকটা মানুষের বুকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে সে খবর কি কারো আছে? নাহ নেই তো! আর থাকবেই বা কেমন করে? মনের আগুন কি আর কারোর চক্ষুগোচর হয়? কুহেলি ছলছল চোখজোড়া লুকোতে ব্যস্ত। সকলের আড়ালে কয়বার যে চোখগুলো আলগোছে মুছেছে তার আর ইয়ত্তা নেই! কিন্তু প্রতিবার মুছতেই চক্ষু কোটর যেন আবারও অশ্রুতে পরিপূর্ণ হচ্ছে। আহ! কি এক জ্বালা। মন জোড়া না লাগতেই এত কষ্ট হচ্ছে, না জানি জোড়া লাগলে তার কি হতো!
চারিদিকে নিস্তব্ধতা! গ্রামীণ এলাকায় অবশ্য সন্ধ্যা হলেই রাত্রি নেমে আসে। দূর আকাশের বুকে চাঁদটা কেমন জ্বলজ্বল করছে! আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সহস্র তারা। একদৃষ্টিতে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে আছে অরি। আঁখিদ্বয় কেমন বারংবার ঝাপসা হয়ে ওঠছে তার। কপোলদ্বয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। অরিন মুছলো না। ঝরতে দিলো তাদের। কি লাভ তাদের আটকিয়ে? আদৌও কি তারা কোনদিন বাঁধ মেনেছে তার? অরিনের বুক চিড়ে ক্ষনে ক্ষনে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। সেই নিঃশ্বাসের সাক্ষী শুধুমাত্র দূর আকাশের চাঁদ আর রাতের নিস্তব্ধতা!
অরিন চোখ বন্ধ করলো।ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো মেয়েটা। কান্নার তোড়ে বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠছে তার ক্ষুদ্র শরীর। মেয়েটা কান্নার জোয়ারে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। মাথাটা নিচু রেখে মনে মনে বলতে লাগলো,
“ কেন এতো কষ্ট হচ্ছে রোদ ভাই! কেন বুকটা হাহাকার করছে তখনের কথাটা শুনে। কেন আপনার পাশে অন্য কাওকে মেনে নিতে পারছি না আমি? রোদ ভাই! আপনি তাহলে সত্যি অন্য কাওকে ভালোবাসেন? সেদিন তাহলে শিশির আপুর জন্যই আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন? ”
অরিন মাথাটা উচু করলো।হাত দিয়ে চোখদুটো মুছে নিয়ে আবারও ভাবলো,
“ কেন আপনাকে ভালোবাসতে গেলাম আমি? কেন এই বিরহের নীল ব্যাথায় নিজের মনটাকে বিষাক্ত করলাম? কিভাবে ভুলবো আপনাকে?”
অরিন এবার আকাশের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ অনিমেষ চোখে তাকিয়ে থেকে বিরবিরিয়ে বলতে লাগলো,
“ আপনার সব ইচ্ছে পূরণ হোক রোদ ভাই! আপনার প্রিয় মানুষটা আপনার হোক। এতে যদি আমার হৃদয়টা নীল বিষাক্ত ব্যাথায় জর্জরিত হয়েও থাকে তাহলে তা হোক তবুও আপনার ভালোবাসা পূর্ণতা পাক। আমি আজ এই মুহুর্তে কথা দিচ্ছি, আমি অরিন কখনোই আপনার ভালোবাসার মাঝে দাড়াবো না। কখনোই না।”
কথাগুলো বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো মেয়েটা। এ কান্না থামবে কখন? ওতো সহজে কি আর থামবে?
“ শুনছো! একটা কথা বলব ভাবছিলাম। ”
বিছানায় হাটুগেড়ে বসে, সামনে কিছু কাগজপত্র নিয়ে মনোযোগ সহকারে কাজ করছিলেন কবির সাহেব। স্ত্রীর কথা কানে যেতেই চোখের মোটা ফ্রেমের চশমাটা হাত বাড়িয়ে আরেকটু এটেঁ দিয়ে বললেন,
“ হ্যা বলো, শুনছি!”
স্বামীর কথায় খানিকটা ভরসা পেলেন জুবাইদা বেগম। আরেকটু এগিয়ে এসে বললেন,
“ জানো! আমাদের রোদ না, একজনকে পছন্দ করে। ”
মুহুর্তেই হাতদুটো থেমে যায় কবির সাহেবের। মুখটা হয়ে ওঠে আরেকটু গম্ভীর। তিনি স্ত্রীর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“ কি বলতে চাইছো?”
জুবাইদা বেগম আলতো হাসলেন। খুশিমনে বললেন,
“ আরে! আমাদের রোদ একজনকে ভালোবাসে। এমনকি মেয়েটাও নাকি রোদ ভালোবাসে।তাই ভাবলাম তোমায় বিষয়টা জানিয়ে রাখি।”
কবির সাহেব মাথাটা নিচু রেখে গম্ভীর গলায় শুধালেন,
“ কে সে?”
জুবাইদা বেগম শোয়া ছেড়ে উঠে বসলেন। একগাল হেসে ওঠে বললেন,
“ আর কে? আমাদের শিশির। ”
ভেতরে ভেতরে খানিকটা চমকালেন কবির সাহেব। কিন্তু বাইরে থেকে মুখাবয়ব একদম স্বাভাবিক রেখে গম্ভীর গলায় বললেন,
“ তুমি কি নিশ্চিত এ বিষয়ে?”
জুবাইদা বেগম প্রতিত্তোরে দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলো।
“ হ্যা! আমিতো জিজ্ঞেস করে তারপরই নিশ্চিত হলাম!”
“ কাকে জিজ্ঞেস করেছো?”
“ কাকে আবার! শিশিরকে।”
“ আর রোদ? ওকে জিজ্ঞেস করেছো? ও কি নিজ মুখে বলেছে একথা?”
এপর্যায়ে কথা হারালেন জুবাইদা বেগম। ঠিকই তো। তিনিতো রোদকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেননি। স্ত্রীর ভাবুক মুখভঙ্গি দেখে আলতো করে মাথা নাড়ালেন কবির সাহেব। স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে নমনীয় কন্ঠে বললেন,
“ একটা সম্পর্ক জোড়া দেওয়া মুখের কথা না জবা! সম্পর্ক জোড়া লাগাতে অবশ্যই দুজনের কথা ঠিকঠাক ভাবে শোনা উচিত। তাছাড়া একজনের কথা শুনে হুট করে যেকোনো সিদ্ধান্তে না যাওয়াই ভালো। তুমি আগে রোদকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করো। ও নিজেও যদি সম্মতি দেয় তাহলে নাহয় রুহির বিয়ের পরপরই ওদের দুজনের ব্যাপারে আলাপ করবো।”
স্বামীর দেওয়া যুক্তিতে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন জুবাইদা বেগম। মনে মনে ভাবলেন,
— সত্যিই কি তিনি তাড়াহুড়ো করে ফেললেন বিষয়টা নিয়ে?
“ বড় বু! মিষ্টিটা কি এখনি তৈরি করে রাখবে নাকি দুপুরের পর বানাবে?”
ব্যস্ত হাতে খুন্তি নাড়ছেন জুবাইদা বেগম। পাশ থেকে রাইসা বেগমের এমন কথায় ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“ আরে না বোকা! বিকেল হতেই বাড়িতে মেহমান চলে আসবে।তারওপর মেহেদী অনুষ্ঠান সন্ধ্যাতেই।এর মধ্যে কাজ যদি রেখে দেই তাহলে কি আর হবে বল?”
বড় জা’য়ের কথায় সায় জানালেন মাইমুনা বেগম। চুলোয় উল্টে-পাল্টে রুটি সেকতে সেকতে বললেন,
“ তা যা বলেছো! বাড়িতে অনুষ্ঠান হলে কি আর কাজের ফুরসৎ থাকে! ”
রান্নাঘরের এককোণে সবজি কুটছিলেন পৌঢ়া আমেনা বেগম। মাইমুনা বেগমের কথায় মৃদু হেসে বলে ওঠেন,
“ এক্কেবারে হাছা কতা। দেখবেন আইজ সারাদিন লাগাইয়া কাম করলেও মনে হইবো কাম বুঝি শেষ হইলোনা।”
পৌঢ়ার কথায় উপস্থিত সকলেই সায় জানায় সমস্বরে। তারপর আবারও ব্যস্ত হাতে নিজেদের কাজ করতে থাকে সকলে।
পুরো ডাইনিং টেবিল জুড়ে হরেকরকম খাবারের বাহার। একে একে সকলেই এসে উপস্থিত হচ্ছে টেবিলে। খানিক পরে অরিনও এসে বসে পড়ে চেয়ার টেনে। মেয়েটার নাক-মুখ ফুলে যাচ্ছে তাই অবস্থা! মুখটা হয়ে ওঠেছে ফ্যাকাশে।দেখে বোঝাই যাচ্ছে, হয়তো সারারাত কেঁদেকেটে ভাসিয়েছে। কিছুক্ষণ পর রৌদ্র এসে বসে পড়ে তার পাশে। অরিন আড়চোখে খেয়াল করলো একবার। পরক্ষণেই নিজ আসন ছেড়ে অন্যপাশে গিয়ে বসে পড়ে মেয়েটা। অন্যদিকে তার এমন কান্ডে হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে আছে রৌদ্র। হয়তো বুঝতে চেষ্টা করছে, অরিনের এমন করার কারনটা!
প্রায় মিনিট খানেক পর অনিক এসে বসে পড়ে অরিনের পাশে। বেখেয়ালি হয়ে একবার অরিনের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফেরাতেই তড়িৎ গতিতে আবারও খেয়াল করলো মেয়েটাকে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ বনু! কি হয়েছে তোর? চোখ-মুখের এ অবস্থা কেন? শরীর খারাপ লাগছে তোর? ”
অনিক এরূপ কথায় সকলের দৃষ্টি এসে পড়লো অরিনের ওপর। তা দেখে অরিন খানিকটা ভড়কে গেলো।আমতা আমতা করে নিজের সাফাই গেয়ে বললো,
“ না তেমন কিছু না! আসলে কাল রাতে ভালে ঘুম হয়নি, তাই হয়তো এমন দেখাচ্ছে। ”
বাকিরা আবারও নিজেদের কথায় মগ্ন হলেও
বোনের কথায় সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত হতে পারলো না অনিক। বোনের গালে আলতো হাত রেখে নমনীয় কন্ঠে বললো,
“ সত্যি? আর ইউ ওকে? ”
অরিন মাথা ঝাকায়। মৃদু হেসে খাবার খেতে শুরু করে। অন্যদিকে এখনো কেও একজন ভ্রূদ্বয় কুচকে তাকিয়ে আছে অরিনের পানে। হয়তো বুঝতে চেষ্টা করছে মেয়েটার মনে চলছে টা কি!
বাড়ির উঠোনে ডেকোরেশনের কাজ চলছে। অদূরেই তৈরি করা হয়েছে বেশ সুন্দর একটি স্টেজ। বাড়ির কর্তারা উঠোনে দাড়িয়ে কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন হয়তো। ঠিক তখনি বাড়ির কেচি গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দু’জন আগন্তুক। বৃদ্ধ আবুল মিয়া কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে হেঁটেই যাচ্ছিলেন ওমনি আগন্তুকদের দেখে থমকে দাঁড়ান তিনি। মুহুর্তেই তার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে আসে। প্রথমে নিজের ভুল মনে করে চোখদুটো হাতদিয়ে আলতো ডলে আবারও সামনে তাকালেন তিনি।নাহ! এখনো দেখা যাচ্ছে তাদের। তার মানে সত্যি তারা এসেছে? বৃদ্ধ চিন্তিত হলেন।দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন কবির সাহেবদের কাছে। গিয়েই কবির সাহেবকে পেছন থেকে বললেন,
“ বাপজান! আরিফ আইছে।”
থামলেন কবির সাহেব। চমকে ওঠে পেছনে তাকালেন তিনি।চোখের সামনে সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত দু’জনকে দেখে হাসি মুখটা মুহুর্তেই কাঠিন্যে রুপ নেয় তার। পাশ থেকে সাব্বির সাহেব অবাক হলেন। অবাক কন্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো,
“ আরিফ ভাই!”
সামনে থাকা মধ্যবয়স্ক আরিফ এহসান ছলছল চোখজোড়া শার্টের হাতায় মুছলেন। এগিয়ে এসে কবির সাহেবকে জড়িয়ে ধরতে দু’হাত বাড়াতেই কবির সাহেব দু-কদম পিছিয়ে গেলেন। আরিফ এহসানের মুখটা মুহুর্তেই থমথমে হয়ে আসে। কিছু একটা বলতে যাবেন তার আগেই কানে আসে কবির সাহেবের শক্তবানী,
“ কেন এসেছেন আপনারা? এতগুলো বছর পর নতুন করে আর কি-বা কেড়ে নিতে এসেছেন? ”
এরুপ কথায় আরিফ সাহেবের ছলছল চোখজোড়া আরও কিছুটা লাল হয়ে আসে। কিছু একটা বলতে যাবেন কিন্তু পারলেন না বলতে।গলাটা কেমন ধরে আসছে তার।সম্বন্ধি ভাইয়ের অবস্থা কিছুটা আচঁ করতে পেরে পাশ থেকে তুরাগ মজুমদার এগিয়ে এলেন।একহাতে সম্বন্ধিকে জড়িয়ে ধরে তাকালেন কবির সাহেবের দিকে।বললেন,
“ কবির ভাই! আম্মার অবস্থা বেশি খারাপ। আজ পাঁচ বছর যাবত শয্যাশায়ী তিনি।কিন্তু ইদানীং তার অবস্থা বেশ খারাপ। হয়তো আর বেশিদিন নেই হাতে। তিনি আপনাদের সবাইকে শেষবারের মতো একটিবার দেখতে চেয়েছে। দয়া করে রাগ-ক্ষোভ একদিকে রেখে মরন পথযাত্রী মানুষটাকে শেষ দেখা দেখে যান।”
তুরাগ সাহেবের কথাতে বাকিরা বিচলিত হলেও কবির সাহেবের মুখভঙ্গি একেবারেই অপরিবর্তিত। তিনি কঠিন মুখে অন্যদিকে চেয়ে আছেন। আরিফ এহসান আরেকটিবার চেষ্টা করার ম্যায় বললেন,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৮
“ মানুষ কি ভুল করে না কবির? তাই বলে কি মাফ করা যায় না? ”
এপর্যায়ে কবির সাহেব তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন।বললেন,
“ ভুল করলে মাফ করা যায় কিন্তু অন্যায়ের আবার কিসের ক্ষমা? আপনারা যেটা করেছেন সেটা কোন ভুল নয় বরং পাপ।”
কথাটা শেষ করে আর একমুহূর্ত দাঁড়ালেন তিনি।গটগট পা ফেলে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন তিনি।অথচ পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো ক্রন্দনরত মধ্যবয়স্ক মানুষটা!