সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২
Jannatul Firdaus Mithila

” তোমরা কি আজ আর ভেতরে আসবে? নাকি বাইরে দাড়িয়েই আনন্দ উল্লাস করবে?”
সাব্বির সাহেবের কথায় সৎবিৎ ফিরে পায় অনিক আর অরিন। অনিক বোনকে সযত্নে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। তারপর অরিনের হাত ধরে ভেতরের দিকে একপা বাড়াতেই হঠাৎ থমকে যায়। কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে। গাড়ির দিকে তাকিয়ে জিভ কেটে গলা উঁচু করে বলে,
~ রোদ ভাই! বের হবে না?

সহসা হাসি মুখটা থমথমে হয়ে আসে অরিনের। ভাইয়ের হাতে হাত রেখেই আড়চোখে তাকালো গাড়ির দিকে। তখনই গাড়ি থেকে নেমে আসে রৌদ্র। রৌদ্রকে নামতে দেখে অরিনের মামা থেকে শুরু করে নানুও বাড়ির উঠোনে চলে আসেন। অরিনের নানুতো রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রৌদ্রকে দেখে। তিনি তড়িঘড়ি করে রৌদ্রকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। রৌদ্রও মুচকি হেসে তার সঙ্গে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিন্তু এতকিছুর মাঝেও একটি আশ্চর্য বিষয় হলো, রৌদ্র একবারও অরিনের দিকে ফিরে অবধি তাকালো না। অরিনের বুকের কোণে আবারও কোন এক অতিপরিচিত চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। চোখের কার্নিশে এসে ভিড় জমিয়েছে অশ্রুকনা। নিশ্বাস নিতেও বুঝি কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার।অরিন হাসফাস করতে থাকে। হঠাৎ করে অনিক বোনের দিকে খেয়াল করে।বোনের এমন হালৎ দেখে বুঝে নেয় যা বোঝার। ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলে বোনকে বাহুডোরে আগলে নেয়। তারপর বোনের কাঁধে হাত রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। অরিনও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। নিজের এমন ব্যর্থ অনুভূতিকে এতোটা প্রশ্রয় দিয়েই বা কি লাভ?

রৌদ্রকে নিয়ে এ মুহুর্তে বাড়ির সকলেই কেমন ব্যস্ত হয়ে গেলো। অরিনের বড় মামা শফিক রহমান আর ছোট মামা রফিক রহমান রৌদ্রসহ বাকিদের নিয়ে সোফায় বসে এটা-সেটা নিয়ে আলাপ করছেন।
অন্যদিকে অরিনের দুই মামি, সিঁথি বেগম আর রাহেলা বেগম এবং অরিনের নানু আনোয়ারা বেগম টেবিলে খাবার সাজাতে ব্যস্ত। যেখানে সিঁথি বেগম রান্নাঘর থেকে খাবার আনা নেওয়া করছে সেখানে রাহেলা বেগম হাতে কাচের থালা-বাটি নিয়ে টেবিলের এক কোণে দাড়িয়ে আছেন।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রৌদ্রের দিকে। বরাবরই রৌদ্রকে তার বেশ পছন্দ নিজের বড় মেয়ে কুহেলির জন্য। এ নিয়ে বহুবার আলাপও রেখেছে আনোয়ারা বেগমের কাছে, তিনি যেন রাফিয়াকে বোঝায় রৌদ্রের সাথে কুহেলিকে বিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে আনোয়ারা বেগম বারংবার এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যান। এতে অবশ্য বেশ মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন রাহেলা বেগম। তবুও শ্বাশুড়ির সাথে তেমন কোন তর্ক বির্তকে জড়াননি তিনি। কিন্তু আজ হঠাৎ চোখের সামনে রৌদ্রকে দেখে, তার এতদিনকার মনের ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছেটা বুঝি ডানা ঝাপটাতে লাগল। রৌদ্রকে তিনি এমন সামনা-সামনি দেখেনি বহু বছর হলো। তিনি শুধু মেয়েকে এহসান বাড়ির বড় বউ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন বলেই রৌদ্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের স্বপ্ন দেখতেন। আর দেখবেন না-ই বা কেন? নাম, খ্যাতি, যশ সব দিক থেকেই তো এহসান বাড়ির বেশ নামডাক। তারওপর আজকে রৌদ্রকে সামনা-সামনি দেখে তার তো প্রায় খুশিতে আত্মহারা হতে ইচ্ছে করছে।এতক্ষণে মনে মনে রৌদ্রের পাশে কুহেলিকে বসিয়েও ফেলেছেন তিনি।

রান্নাঘর থেকে মাংসের বাটিটা হাতে নিয়ে টেবিলের দিকেই আসছিলেন আনোয়ারা বেগম। পাশেই রাহেলা বেগমকে ওমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে কনুই দিয়ে গুতো দিলেন। হঠাৎ এমন কান্ডে হকচকিয়ে ওঠেন রাহেলা বেগম। হাতে থাকা কাচের থালাবাসনগুলো পড়তে গিয়েও কোনরকমে বেচে যায়।
আনোয়ারা বেগম ছেলের বউয়ের এমন হাবভাবে ভ্রুকুটি করে তাকায়। ধীর স্বরে গলায় ঝাঁঝ এনে বললেন,
~ এত্তো মনোযোগ দিয়া কি দেহো কুহেলির মা? মেহমানগোরে কি আইজকে আর খাওন দিতে পারমু নাকি এক্কেবারে তাগো যাওনের কালে খাওয়াইয়া পাঠামু?
শাশুড়ীর ওমন খোটা দেওয়া কথায় নাক ফুলান রাহেলা বেগম। হাতে থাকা বাসনগুলো টেবিলে রাখলেন সশব্দে। এখানেও আনোয়ারা বেগম টিপ্পনী কাটতে ভুললেন না,

~ আরে আস্তে রাহো। এগুন কি তোমার বাপের বাইত্তে আনছোনি? এমনে তেজ দেহাও কিল্লেগা?
একেরপর এক খোটা দেওয়া কথায় চোখমুখ বিরক্তিতে কুচকে ফেলেন রাহেলা বেগম। মনে মনে শাশুড়ির গুষ্ঠিসহ উদ্ধার করতে ভুললেন না তিনি। হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠেন,
~ আম্মা! অন্তত এখনের জন্য একটু নিজের মুখটাকে লাগামে রাখেন।বাড়ি ভর্তি মেহমান। এসব যদি কারো কানে যায় তাহলে কি কেলেঙ্কারিটাই না হবে ভাবতে পারছেন?
যদিও কথাটায় যথেষ্ট যুক্তি আছে তবুও ছেলের বউয়ের মুখে শোনায় দমলেন না আনোয়ারা বেগম। বরঞ্চ আরও খানিকটা ফুঁসে ওঠে গজগজ করতে করতে বললেন,
~ কি কইলা? আমার মুখে লাগাম টানতাম মানে?
রাহেলা বেগম কিছু বলবেন তার আগেই সেখানে উপস্থিত হন সিঁথি বেগম।একহাতে তার সালাদের বাটি। অন্যহাত দিয়ে জা’য়ের হাত চেপে ধরে ইশারায় চুপ থাকতে বললেন। তারপর শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে অনুনয় করে বললেন,

~ আম্মা! আপনারা নিজেদের এই গৃহযুদ্ধ নাহয় মেহমানগুলো চলে গেলে আবারও শুরু করিয়েন। এখন আপাতত এখানেই সবটার ইতি টানুন।
নিরপেক্ষ পক্ষের কথায় দুজনেই চুপ করে গেলেন। আনোয়ারা বেগম চুপ করলেও মুখ ঝামটি মারতে ভুললেন না। ওদিকে রাহেলা বেগম সিথি বেগমের হাত ধরে বললেন,
~ আপা, আপনি একটু থাকেন আমি এই যাবো আর আসবো। মেয়েগুলোকে একটু ডেকে নিয়ে আসি। বাড়িতে মেহমান অথচ তাদের নিচে নামার নামগন্ধও নেই!
বলেই তিনি সিঁথি বেগমকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাঁটা ধরলো মেয়েদের রুমের দিকে। যাওয়ার পথে অবশ্য শাশুড়ির এক কথায় আবারও আড়চোখে তাকালেন।
~ হ হ, যাইবই তো।খালি কামেরতে বাচোনের ধান্দা। কামচোর একটা! বুঝি না লাগে আমি।আমার চুলগুলান তো আর বাতাসে পাকে নাই।
অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে রাহেলা বেগম বলেই বসলেন,

~ কচু বোঝেন।
ব্যস আগুনে বুঝি ঘি ঢালার উপক্রম হলো কথাটা। আনোয়ারা বেগম ফুঁসে ওঠে বললেন,
~ দেখছো বড় বউ, দেখছো! কি কইলো আমারে?
অবস্থা বেগতিক দেখে এগিয়ে এলেন সিঁথি বেগম। চোখ দিয়ে ইশারায় রাহেলা বেগমকে জায়গা ত্যাগ করতে বললেন। নাহলে কে জানে কোন অঘটন ঘটে যায় মুহুর্তেই! সিঁথি বেগম শাশুড়ির কাঁধে হাত রেখে নমনীয় কন্ঠে বলেন,

~ থাক আম্মা বাদ দেন।
~ হ হ।বাদ তো দিমুই।প্রতিবার তো এডাই করি। হায় মোর কপাল।কোন কুক্ষণে যে পোলাডা আমার এমন এক বিশালির করল্লারে বিয়া কইরা ঘরে তুলছিলো।
শাশুড়ির হা-হুতাশে অলক্ষ্যে মুখ টিপে হাসছেন সিঁথি বেগম। পাছে না আবার দেখতে পেয়ে রেগে বোম হয়ে তার ওপরেই না ফেটে যায়!

কারুকাজের সুসজ্জিত খাবার টেবিল জুড়ে হরেকরকম খাবারের বাহার। রান্নার সুঘ্রাণ যেন সম্পূর্ণ বাড়ি জুড়ে মো মো করছে। শফিক রহমান, আর রফিক রহমান মিলে কবির সাহেব আর সাব্বির সাহেবের পাতে সযত্নে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন। অনিক বসেছে নিজের বনুর পাশে।বরাবরের নিয়মমাফিক বোনের পাতে মাছের কাটা বেছে দিচ্ছে সতর্কতার সহিত। রৌদ্র বসেছে অরিনের একেবারে মুখোমুখি।তাকে ঘিরে রেখেছে বাড়ির গৃহিণীরা।এটা-সেটা দিতে দিতে খাবারের স্তুপ বানিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে। এতকিছুর মাঝেও দু-একবার আড়চোখে অরিনের দিকে তাকিয়েছে ছেলেটা কিন্তু মেয়েটা কেমন নির্জীব হয়ে নিজের খাবারের দিকেই মনোযোগ দিয়ে রেখেছে। এসব দেখে রৌদ্রের বুকটা চিনচিনিয়ে ওঠে। বাহির থেকে নিজেকে সামলে খাবারে মনোযোগ টানে রৌদ্র। ঠিক তখনি কেও একজন চুড়ির রিমঝিম শব্দ তুলে রৌদ্রের পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়ে। অরিন খেতে খেতে আড়চোখে একবার তাকায় কুহেলির দিকে। তখনি তার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে আসে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে সামনে বসা কুহেলির পানে। মেয়েটা আজ একটু বেশিই সেজেছে মনে হচ্ছে! কানে পাথরের ঝুমকো, কালার করা চুলগুলো ফুলিয়ে বেধে রাখা।ঠোঁটের ওপর লেপ্টে আছে গাঢ় গোলাপি লিপস্টিক। চোখের ওপর আইলাইনারের বাহার দেখে অরিনের বুঝি প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এদিকে কুহেলি বারবার চুড়ির শব্দ তুলে বিশেষ কোন একজনের মনোযোগ কাড়বার ব্যাপক চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু এতোগুলাে মানুষের মাঝে তাকে কি আর দেখা যাবে?

কুহেলি মুখ ফুলিয়ে খাবার খেতে শুরু করে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো আসিফ আর সোহেলী। আসিফ শফিক -সিঁথি দম্পত্তির একমাত্র ছেলে। আসিফ এখন উপজেলার একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আছে। আর সোহেলী হচ্ছে কুহেলির ছোট বোন। সবেমাত্র এসএসসি শেষ করে ইন্টারে উঠলো মেয়েটা। আসিফের বাড়ি আসার পথেই সোহেলীর কলেজ তাই রোজ দুজনে একসঙ্গেই বাড়ি পেরে।আজও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। আসিফ বাড়িতে প্রবেশ করেই অবাক হয়ে একটু জোরেই বললো,
~ অনিক! রৌদ্র!

আসিফের কন্ঠ পেয়ে বাড়ির সকলেই দরজার দিকে দৃষ্টি ফেলে। আসিফ তৎক্ষনাৎ গটগট পায়ে এগিয়ে এসে টেবিলের সামনে দাড়ায়।তাকে দেখে রৌদ্র খাবার ছেড়ে দাড়িয়ে পড়ে। অতঃপর বুকে জড়িয়ে ধরে আসিফকে।
~ কেমন আছো আসিফ ভাইয়া?
আসিফ রৌদ্রকে ছেড়ে দিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বললো,
~ আলহামদুলিল্লাহ! আমি তো বেশ ভালো আছি।তা হ্যান্ডসাম তুই কেমন আছিস? ফরেইন থেকে এসেতো একবারও এলিনা দেখা করতে!

আসিফের কথায় মুচকি হাসলো রৌদ্র। মাথা চুলকে কিছু বলবে তার আগেই আসিফ বললো,
~ আচ্ছা পরে শুনবো সব।তুই আগে খাবার খা।আমিও জয়েন করছি তোদের। জাস্ট গিমমি টেন মিনিটস!
বলেই সে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ওদিকে সোহেলী এখনো তাকিয়ে আছে চলে যাওয়া মানুষটার দিকে। কে জানে এই আধবুড়ো বয়সের লোকটাকে দেখলে তার জানি কি হয়! লোকটা সামনে আসলেই বেচারির হৃৎপিণ্ড তার গতি মিস করে। তবুও তার ভালো লাগে এই উৎপীড়ন।তাইতো ইচ্ছে করে বিভিন্ন বাহানা দিয়ে রোজ লোকটার সঙ্গে বাড়ি ফিরে মেয়েটা। সোহেলী একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলে নিজের ভাবনার সুতো ছিড়ে হাঁটা ধরলো নিজের রুমের উদ্দেশ্যে। এতক্ষনে ঘামে এক গোসল হয়ে গিয়েছে তার। এক্ষুণি ফ্রেশ হতে না পারলে মাথা ধরবে নিশ্চিত!

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে সেই কখন। রৌদ্র, অনিক,অরিন,আসিফ,সোহেলী আর কুহেলি সবাই মিলে বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডা দিচ্ছে বললে ভুল হবে, বরং সবাই বিরক্ত হয়ে কুহেলির কথা শুনে যাচ্ছে। মেয়েটা সেই কখন থেকে ন্যাকামো করে এটা-সেটা বলে যাচ্ছে বিরতিহীনভাবে। থামার নামই যেন নিচ্ছে না। অরিন আর টিকতে না পেরে উঠে দাড়ায়। তাকে উঠে পড়তে দেখে সকলের দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ হয় কেবল রৌদ্রের বাদে। অনিক “কি হয়েছে ” জিজ্ঞেস করতেই অরিন জোরালো কন্ঠে জবাব দেয়,
~ আসলে, আরেকটু পরেই তো রওনা দিতে হবে তাই শেষমেষ নানুর সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে চাচ্ছি, আবার কবে আসি না আসি।

অনিকও প্রতিত্তোরে কিছু না বলে মাথা ঝাকায়। অরিন সেখান থেকে চলে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আরেকটু সেথায় থাকলে নিশ্চিত তার মাথা ধরে যেত। অরিন গুনগুন করতে করতে নিজের রুমে চলে যায়। ব্যাগ গুলো আগেই গুছিয়ে রেখেছে সে।তবুও আরেকটু নাহয় চেক করা যাক। অরিন সবকিছু উল্টে -পাল্টে দেখছিল তখনি তার খুলে রাখা ঘরের দরজায় টোকা পড়ে।অরিন সেদিকে না তাকিয়ে “হুম” বলে। কয়েকপল কেটে যাবার পরও কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে অরিন পেছনে ফিরে। তৎক্ষনাৎ থতমত খেয়ে যায় দরজার সামনে রৌদ্রকে দাড়ানো দেখে।
~ রোদ ভাই আপনি? ওভাবে বাইরে দাড়িয়ে আছেন কেন ভেতরে আসুন!
রৌদ্র বুঝি এ কথাটারই অপেক্ষায় ছিলো।বলতে দেরি কিন্তু তার ভেতরে ঢুকতে দেরি হলোনা। সে নিজেদের মাঝে বেশ খানিকটা দুরত্ব রেখে সটান হয়ে দাড়ায়। অতঃপর পকেটে দুহাত গুজে গম্ভীর গলায় শুধায়,

~ তুই ঠিক আছিস?
অরিন ভড়কে যায়। ভড়কানো সুরে বলে,
~ মানে? আমার আবার কি হলো?
উওর শুনে রৌদ্রের দৃষ্টিতে কোন তফাৎ পরিলক্ষিত হলো না। তার দৃষ্টি একেবারেই শান্ত। দৃঢ় চোয়ালের ওপর কালো কুচকুচে তিলটা শোভা পাচ্ছে নিজ সৌন্দর্যে। অরিন সেদিকে একপলক তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নজর ফিরিয়ে নেয়। তারপর কেমন করে যেন বলতে শুরু করলো,
~ রোদ ভাই! আসলে কি হয়েছে বলুনতো! আমার বয়সটা না বড্ড খারাপ জানেন তো? এই বয়সে সু-বুদ্ধির চেয়ে আবেগটা বরাবরই একটু বেশি। হয়তো এই আবেগের রঙিন আলোয় ভুলে বসেছিলাম নিজের বাস্তবতাকে। তাইতো আপনার সাথে সেদিন এমন উদ্ভট আচরণ করে ফেলেছি। আমি অত্যন্ত দুঃখীত রোদ ভাই! আমি সত্যিই সেদিনকার আচরণের জন্য লজ্জিত। পারলে আমায় ক্ষমা করবেন নাহয়।

এ পর্যায়ে গলা ধরে আসে অরিনের। বুকটা কেমন কাপছে! অরিন রৌদ্রের সামনে দাড়ানোর ক্ষমতা হারায়।ছুটে বেরিয়ে আসে নিজের রুম থেকে। অন্যদিকে রৌদ্র এখনও দাড়িয়ে একইভাবে। তার ভাবভঙ্গি বাইরে থেকে দেখে একেবারেই বোঝার জো নেই ভেতরে এ মুহুর্তে তার কি চলছে! ছেলেটার দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ। মুহুর্তের মধ্যে দৃঢ় চোয়াল আরও কিছুটা শক্ত হয়ে আসে তার। চুলগুলো পেছনের দিকে রাব করে বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে,
~ তুই এটাকে আবেগ বল আর যাই বল সানশাইন। তোর শেষ গতি শুধু এই আমিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এন্ড আ’ল মেক শিওর অফ ইট!

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা!
বিকেল চারটের দিকে রওনা দেবার কথা থাকলেও এখনো কেও রওনা দিতে পারলো না। কেননা সেই বিকেল থেকে আকাশ ভেঙে ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। গ্রামে হয়তো কালবৈশাখীর ঝড় বলেই আখ্যায়িত এই বৃষ্টি। কবির সাহেব,সাব্বির সাহেব, শফিক রহমান ও রফিক রহমান ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে চা পান করছেন। এ মুহুর্তে এটি ছাড়া আর কি-ইবা করবে তারা। বাড়ির গৃহিণীরা ভাজাপোড়া ভাজতে ব্যস্ত। বৃষ্টির দিনে ওমন চায়ের সঙ্গে ভাজাপোড়া নাহলে কি আর চলে?
কুহেলি আর সোহেলী মিলে সেই যে সন্ধ্যার দিকে ঘুম দিয়েছে আর তো উঠলো না। আসিফ, রৌদ্র আর অনিক মিলে রাজ্যের গল্প জুড়ে বসেছে। যদিও রৌদ্র সবটাই নির্বিকার হয়ে শুনছে আর মাঝেমধ্যে কেবল হু-হা বলে উওর দিচ্ছে এতটুকুই। প্রায় মিনিট বিশেক এমন টুকটাক আড্ডা চললো কিন্তু তখনি ঘটলো আরেক ঘটনা। হুট করে কারেন্ট চলে গেলো পুরো বাড়ির। রৌদ্রের কি হলো? সে সেকেন্ডের ব্যবধানে অন্ধকারেই ছুটে গেলো অরিনের কাছে। অনিক আর আসিফ তখনও অন্ধকারে বসে। হয়তো অন্ধকারে বুঝতেও পারেনি রৌদ্র কেমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো কোথাও!

রৌদ্র দৌড়ে চলে আসে অরিনের রুমে। দরজা খোলাই ছিলো তাই সে আর দেরি না করে ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে ভেতরে ঢুকলো। ধীরে ধীরে ঘরের সর্বত্র আলো দিতেই ফ্লোরে চোখ পড়লো তার। অরিনটা কেমন ভয়ে গুটিসুটি মেরে হাঁটুতে মুখ গুজে ফুপিয়ে যাচ্ছে। ফুঁপানোর দরুন বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে মেয়েটা।অরিনের এ অবস্থা দেখে মুহুর্তেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে রৌদ্রের। সে কোনোরূপ কালবিলম্ব না করে এগিয়ে আসে অরিনের কাছে। অরিনের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ফ্লোরে। তারপর হাত বাড়িয়ে আলতো হাতে মাথা বুলিয়ে আওরায়,
~ জানবাচ্চা! খুব ভয় করছে?

অরিন তখন মুহুর্তের ব্যাবধানে ঘটিয়ে ফেললো এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার! সে চট করে জড়িয়ে ধরে রৌদ্রকে।তার কাঁপা কাঁপা হাতগুলো দিয়ে খামচে ধরে রৌদ্রের পিঠ। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
~ আমার খু-উব ভ-ভয় করছে রোদ ভাই। প্লিজ আমায় ছেড়ে যাবেন না। প্লিজ!
রৌদ্রের কানে এ মুহুর্তে কোন কথাই যাচ্ছে না! বুকটায় বেড়ে গেছে হৃৎস্পন্দনের হার। শুরু হয়ে গেছে পরিচিত তান্ডব। প্রথম, এই জীবনের প্রথমবারের মতো অরিন তাকে এতোটা কাছ থেকে স্পর্শ করলো। রৌদ্রের সারা শরীর কাপছে। এ মুহুর্তে ঠিক কি করা উচিৎ ছেলেটার বুঝে আসছে না একদম! সে যখন নিজের এমন ভাবনায় নিমজ্জিত ঠিক তখনি তার কানে আসে অরিনের ফুপিয়ে কান্নার শব্দ। তৎক্ষনাৎ সকল ঘোর কেটে যায় রৌদ্রের। নিজেও অরিনকে বুকে চেপে ধরে আলগোছে। একহাত মাথায় রেখে নরম সুরে আশ্বস্ত করে বলতে থাকে,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১

~ হুশ! কাঁদেনা জানবাচ্চা! এইতো আমি। আমি থাকতে তোর কিসের ভয় শুনি?
অরিন কি শুনলো সবটা? হয়তো শুনলো! এই যে কেমন চুপটি করে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে রৌদ্রের বুকে।ভাব এমন, এই মুহুর্তে এর চেয়ে বেশি সুরক্ষিত জায়গা হয়তো পৃথিবীতে আর একটিও নেই!

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here