সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৩৬+৩৭
Jannatul Firdaus Mithila
অরিনের চোখ ভিজে আসে।নিজ অজান্তেই দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো হাতে মেলে রাখা চিঠিটার গায়ে। অরিন চোখ বন্ধ করে চিঠিটা বুকে চেপে ধরে। মুখ হা করে নিশ্বাস ফেলছে মেয়েটা।বোঝাই যাচ্ছে, হয়তো নিশ্বাস ফেলতেও ভিষণ রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে তার।অরিনের চোখ বেয়ে এখনও টুপ টুপ করে অশ্রুকণা ঝড়ছে।কিয়তক্ষন বাদে সে বুকে চেপে রাখা চিঠিটা আবারও সামনে আনে।তারপর একের পর এক চুমু একে দেয় চিঠিটার গায়ে। অরিন ভেজা চোখেই আলতো হাতে চিঠিটায় হাত বুলালো। এ মুহুর্তে তার ইচ্ছে করছে মানুষটার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। কি দরকার তাকে এতো ভালোবাসার? কি দরকার তাকে এতোবার মুগ্ধ করার? শ্যামবরণ সুদর্শন মানুষটা কি জানে না? — তার এহেন কান্ড মেয়েটাকে ঠিক কতোটা ভয়ংকরভাবে তার প্রতি আসক্ত করছে!
অরিন আলতো করে হাতের উল্টো পিঠে দুচোখ মুছলো।তারপর বিছানার পাশ হাতড়ে মোবাইলটা হাতে নিলো।ভাবলো, — একবার কি মানুষটার কাছে ফোন দেওয়া উচিৎ? পরক্ষণেই আবার কি মনে করে মনে উঠা এহেন ইচ্ছেকে একপ্রকার ধামাচাপা দিয়ে ফোনটা পাশে রেখে দিলো অরিন।তারপর হাতে থাকা চিঠিটা নিয়ে খানিকক্ষণ নিজের মতো করে কথা বলতে লাগলো। দূর থেকে কেও এসব দেখলে নিসন্দেহে বলতো — মেয়েটা পাগল হয়েছে! কিন্তু তাতে অরিনের কিছু যায় আসলে তো! এভাবেই হয়তো মিনিট পাঁচেক পেরুলো।তারপরই পাশে থাকা ফোনটা হুট করেই কর্কশ শব্দ তুলে বেজে ওঠে। অরিন তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নেয়।স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বারটার দিকে একবার তাকিয়ে তৎক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে, তারপর আবারও চোখ মেলে মেয়েটা।হয়তো সে নিশ্চিত হলো, এটা আদৌও তার ডাক্তার সাহেবের কল কি-না।নিশ্চিত হওয়া শেষে অরিন যেই-না ফোনটা রিসিভ করবে তার আগেই কলটা কেটে যায়। অরিন কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো ফোনটার দিকে।পরক্ষণে যেই না সবটা বোধগম্য হলো, ওমনি শুরু হলো মেয়েটার হাসফাস। ইশশ্ কি করলো এটা ও? মানুষটা নিজ থেকে কল দিলো আর ও কি-না….
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অরিনের ভাবনার মাঝেই আবারও কল এলো তার ফোনে। মেয়েটা এবার আর আগের ন্যায় ভুল করলোনা। সে তড়িঘড়ি করে ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকায়।ওপাশ তখনও নিশ্চুপ! অরিনও চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ বাদেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো রৌদ্রের ভরাট কন্ঠ!
“ সানশাইন!”
অরিন চোখ বন্ধ করে নেয় আবারও। গলার কাছটায় কেমন যেন ব্যাথা ব্যাথা করছে তার। তাইতো কথাগুলোও কেমন গলার কাছেই আটঁকে যাচ্ছে বারংবার। মেয়েটা শুষ্ক ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো।অথচ ফলাফল বরাবরই শূন্য! ওপাশে রৌদ্র হয়তো কিছুটা হলেও আচঁ করতে পেরেছে বিষয়টা! সে কেমন নরম গলায় বললো,
“ বউজান? ও বউজান! কথা বলবে না আমার সাথে?”
অরিন আহত হাসলো।ধরে আসা গলায় কোনমতে বললো,
“ সেটা কি আদৌও কোনদিন সম্ভব হয়েছে আমার দ্বারা?”
রৌদ্র স্মিত হাসলো। গাড়ির ব্যাকসিটে গা এলিয়ে বসলো খানিকটা। তারপর চোখ বন্ধ করে মেয়েটার স্নিগ্ধ সুশ্রী মুখখানাকে কল্পনা করতে করতে বললো,
“ কাঁদছিলি এতক্ষণ তাই-না?”
অরিন নাক টানলো।ধীরে ধীরে পুরো গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। তারপর মোটা কন্ঠে কপট ভাব নিয়ে বললো,
“ কে বললো এমনটা? আমি মোটেও এমন কিছু করিনি ডাক্তার সাহেব! তাছাড়া এইটুকু ব্যাপার নিয়ে কাঁদারই বা কি আছে?”
রৌদ্র এবার ফিচেল হাসলো। একহাত দিয়ে চুলগুলো ব্রাশ করতে করতে মিহি স্বরে জবাব দিলো,
“ ব্যাপারটা এইটুকুই? আসলেই?”
অরিন চুপ করে গেলো।এ কথার প্রতিত্তোরে এখন ঠিক কি বলা যায় তাই হয়তো ভাবছে সে। অরিনকে চুপ করে থাকতে দেখে ওপাশে রৌদ্র হয়তো খানিকটা ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেললো। কেননা সে নিশ্বাসের আছড়ে পড়ার শব্দ যে স্পষ্ট কানে এসেছে অরিনের। অরিন এবার আর কোনো ভনিতা না করে ধরে আসা গলায় বললো,
“ আপনি ভিষণ পঁচা ডাক্তার সাহেব!ভিষণ পঁচা… আমায় একটু দেখা দিয়ে গেলে কি এমন ক্ষতি হতো শুনি? আমি নিশ্চয়ই এতোটাও নির্বোধ না যে,কান্নাকাটি করে আপনাকে যাওয়া থেকে আটকাতাম!”
রৌদ্র মনোযোগ দিয়ে শুনলো অভিমানিনীর অভিযোগ।তাকে এমন চুপ করে থাকতে দেখে অরিন ভ্রু কুঁচকালো।সন্দিগ্ধ কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“ চুপ করে আছেন যে! আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না বুঝি?”
“ মৃত্যুর আগ অবধি এই ইচ্ছে মিটবে বলে মনে হয় না সানশাইন!”
রৌদ্রের ভারিক্কি কন্ঠে বুকটা কেমন ধ্বক করে উঠে অরিনের। মেয়েটা চট করে নিজের চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। মুহুর্ত বাদেই বন্ধ চোখদুটো ছাপিয়ে বেরিয়ে আসে কয়েক ফোঁটা নোনাজল।ওপাশে রৌদ্রও নিশ্চুপ!ক্ষনে ক্ষনে শোনা যাচ্ছে তার উষ্ণ নিঃশ্বাসের আছড়ে পড়ার শব্দ। অরিন বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো সবটা।কিছুক্ষণ পেরুতেই সে বললো,
“ ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব!”
ওপাশে রৌদ্র হয়তো দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ফেললো।তারপরেই জবাব দিলো আগের ন্যায় ভরাট কন্ঠে,
“ ভালোবাসি আমার তুমিটাকে!”
সকাল গড়িয়ে বেলা নেমেছে বেশ আগে।এহসান বাড়ির সকলেই আজ প্রচুর ব্যস্ত।সেই সকাল থেকে রসুইঘরে খুন্তি নাড়ছেন জুবাইদা বেগম আর রাফিয়া বেগম।মানুষ দুটো সে-ই যে রান্নায় হাত ভরালো,তারপর তো আর একটিবারের জন্যও বেরুলো না রান্নাঘর থেকে। অবশ্য তাদের এতো খাটা-খাটুনির কারণও আছে বৈকি! আজকেই বিকেলের দিকে রেহান আর রুহি চলে যাবে নিজেদের বাড়ি।যদিও নিয়মানুসারে আরও একটি দিন থাকার কথা কিন্তু তবুও তাদের চলে যেতে হচ্ছে। কেননা, রৌদ্রের দেওয়া সুইজারল্যান্ডের টিকেটগুলোর ডেট যে কাল পেরিয়েই পরশুদিন। সবকিছু গোছ-গাছের একটা ব্যাপার আছে না? তাই রেহান আগে থেকেই সকলকে জানিয়ে দিয়েছে আজ সে চলে যাবে।অগত্যা এহসান বাড়ির মানুষও আর তেমন কিছু বলেনি তাকে।
রাইসা বেগম আর মাইমুনা বেগম মিলে হাতাহাতি করে কয়েক ধরনের পাকোয়ান বানাচ্ছেন। যদিও রান্নার ব্যাপারে তাদের জ্ঞান খুব একটা নেই,তবুও তারা আজ নিজ উদ্যোগে বড় জা’দের বলে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী হাত লাগাচ্ছেন কাজগুলোতে। কেননা একা দুটো মানুষই -বা আর কতটুকু করবে? মেহরিন বেগমও আজ বেজায় ব্যস্ত।তার স্বামীরও ছুটি শেষ। আজকের মধ্যেই তাদেরও ফিরতে হচ্ছে নিজ বাসস্থানে।মেহরিন বেগম বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড কুমুকে নিয়ে ঘর-দুয়ার গোছাচ্ছেন। সকলের এতো এতো ব্যস্ততার মাঝে তিনি কি আর বসে থাকতে পারেন? মেহরিন বেগম কাজের ফাঁকে একপলক তাকালেন ছোটো ভাবিদের দিকে।মানুষ দুটো কি সুন্দর হেসেখেলে কাজগুলো করছে।মেহরিন ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন তাদের কাছে।টেবিলের ওপর থাকা বড় ডিশটার ওপর থেকে একটা বালুসাই মিষ্টি তুলে মুখে দিলেন।মিষ্টিটা মুখে নিয়ে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তার এরূপ মুখভঙ্গি দেখে চিন্তিত হলেন রাইসা বেগম আর মাইমুনা বেগম। তারা তো ধরেই নিলেন, মিষ্টিটা হয়তো একেবারেই বিষাদ হয়েছে খেতে। মাইমুনা বেগম ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“ মেহু? কেমন হয়েছে রে?”
মেহরিন বেগম আড়চোখে চাইলেন মাইমুনা বেগমের দিকে। তারপর মুখে থাকা মিষ্টিটা গিলে বললেন,
“ কেমন হয়েছে মানে! একেবারেই ফার্স্ট ক্লাস! একদম মেজো ভাবির হাতে বানানো মিষ্টির মতো হয়েছে।”
মেহরিনের কথা শুনে হাঁফছেড়ে বাঁচলেন মাইমুনা আর রাইসা বেগম। রাইসা বেগম তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেই বসেন,
“ মেজো বু’র রেসিপি ফলো করছি,তাই রেজাল্টটাও যে তার মতোই ফার্স্ট ক্লাস হবে।তাই-না !”
মাথা নাড়ালেন মাইমুনা বেগম। হাতের তালুতে লাড্ডুর ডো নিয়ে সঠিক শেইপ দিতে দিতে বললেন,
“ তা যা বললি! মেজো বু’র রেসিপি ফেইল করার চান্সই নেই!”
সদ্য গোসল সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে অরিন।চুল মোছার একপর্যায়ে তার মনে পড়লো গতরাতে বলা রৌদ্রের প্রতিটি কথা।কথাগুলো মনে পড়তেই অরিন কেমন আনমনেই মুচকি হাসলো।
“ আসবো অরি?”
দরজার কাছ থেকে ভেসে আসা পরিচিত কন্ঠে সেদিকে ফিরলো অরিন।দেখতে পেলো — রুহি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।অরিন তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
“ একি! আমার রুমে আসতে তোমার আবার অনুমতির প্রয়োজন পড়ছে কেনো রুহিপু? চলে এসো ভেতরে। ”
রুহি স্মিত হেসে রুমে ঢুকলো।অরিনের কাছে এসে মেয়েটার হাত ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসলো।তারপর নিচু কন্ঠে অভিমান মিশিয়ে বললো,
“ আচ্ছা আমি কি তোর এতটাই পর অরি? কেনো একটিবারও নিজের মনের কথাগুলো বললি না আমায়? কেনো বললিনা তুই আমার ভাইকে ভালোবাসিস? আমায় কি সত্যি এগুলো বলার মতো যোগ্য মনে করিসনি অরি? আজ যদি রেহান আমায় সবটা না বলতো,তাহলে হয়তো কোনোদিন এই বিষয়ে কিছু জানাই হতো না আমার”
অরিন তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়ায়।রুহির কোলের ওপর পড়ে থাকা হাতদুটো চেপে ধরে বলে,
“ এই না না…তুমি ভুল ভাবছো রুহিপু।আমি… আসলে কিভাবে বলতাম সবটা সেটাই বুঝে উঠতে পারিনি।প্লিজ তুমি মন খারাপ করো না।আমি সত্যিই বলতাম তোমায়।কিন্তু তেমন কোনো সুযোগ না পেয়ে আর বলতে পারিনি..”
বলেই মাথাটা নিচু করে নেয় অরিন।তা দেখে রুহি আলতো হাসলো।অরিনের চিবুক উপরে তুলে মিহি স্বরে বললো,
“ থাক! আর মন খারাপ করতে হবে না।এখন একটা কথার উত্তর দে তো!”
অরিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলো রুহির দিকে।রুহি নিজের মুখটা আরেকটু কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
“ আমার ভাইকে স্বামী হিসেবে পেয়ে আপনার ফিলিংস কেমন মেডাম?”
এহেন কথায় খানিকটা লজ্জা পেলো অরিন।মেয়েটা তৎক্ষনাৎ নিজের মুখটা নুইয়ে ফেলে। গালদুটোতে হুট করেই দেখা মিলে লালাভ আভার।রুহি এই মুহূর্তটাকে একটুও বৃথা যেতে দিলো না। সে তৎক্ষনাৎ নিজের ফোনটা দিয়ে নিঃশব্দে মেয়েটার লজ্জা রাঙা মুখখানার দু-তিনটে ছবি তুলে নেয়। মাথা নুইয়ে রাখা অরিন একেবারেই টের পেলোনা তা।রুহি এবার দুষ্ট হাসলো।দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে আবারও ফিসফিসিয়ে বললো,
“ এইটুকু কথাতেই এতোখানি লজ্জা পেলে মেয়ে? যখন আমার ভাই এসে আদর করবে তখন তো তোকে হয়তো খুজেই পাওয়া যাবে না!”
রুহির বলা এমন লাগামহীন কথায় হাসফাস করতে থাকে অরিন।মেয়েটা পারেনা লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে।অরিনের এমন অবস্থা দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে রুহি।দু’হাতে মেয়েটাকে ঝাপটে ধরে অরিনের কাঁধে চিবুক ঠেকালো রুহি।বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলতে লাগলো,
“ আ’ম সো প্রাউড অফ মাই ব্রাদার! এমন একটা লাল টুকটুকে ভাবি এনে দেওয়ার জন্য হলেও ভাইয়াকে খুব খুব খুব ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে আমার!”
“ কাকে এতো ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে মামনীর? আর কিসের জন্যই বা এতো এতো ধন্যবাদ?”
হুট করে পেছন থেকে ভেসে আসা রাফিয়া বেগমের কন্ঠে হকচকিয়ে ওঠে রুহি, অরিন।রুহি অরিনকে ছেড়ে দিয়ে পেছনে ফিরে। রাফিয়া বেগম হাতে থালাভর্তি পিঠা নিয়ে তাদের কাছেই আসছেন। অরিন মা’কে দেখে শুষ্ক ঢোক গিলে। তার মা আবার সবটা শুনে ফেলেনি তো? অরিন ভয়ে ভয়ে তাকালো রুহির দিকে। রুহির মুখেও স্পষ্ট উদ্বিগ্নতার ছাপ! অরিন আর রুহিকে এভাবে ভড়কে যেতে দেখে রাফিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকান।হাতের থালাটা টেবিলের ওপর রেখে মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ কি ব্যাপার? আমায় দেখেই তোমরা এমন চুপ করে গেলে কেন? আমি কি ভুল সময়ে এসে পড়লাম?”
রুহি তড়িৎ ডানে-বামে মাথা নাড়ায়।মুখে মেকি হাসি টেনে বললো,
“ আরে না না মেজো মা! আমরা আসলে… আমার বিয়ের একটা ইন্সিডেন্ট নিয়ে আলোচনা করছিলাম।”
রুহির বলা কথাটা কেমন যেন বিশ্বাস হলোনা বিচক্ষণ রাফিয়া বেগমের।তিনি সরু চোখে একবার তাকালেন মেয়ে দুটোর মুখপানে। সেথায় তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন ভয় আর কিছু লুকানোর প্রচেষ্টা।রাফিয়া বেগম স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, মেয়েগুলো তার থেকে কিছু একটা লুকচ্ছে।কিন্তু পরক্ষণেই মনে মনে ভাবলেন,
— মেয়েদের তো নিজেদের ব্যাক্তিগত কতকিছুই থাকে।মা হিসেবে নিশ্চয়ই সেখানে হস্তক্ষেপ করাটা খুব একটা শোভা পায় না।
তাই তিনি আর কিছু না বলে চেপে গেলেন বিষয়টা।শুধু আস্তে করে বললেন,
“ ওহ! আচ্ছা ওসব বাদ দে। এই দেখ তো, আমি কি নিয়ে এসেছি তোদের জন্য!”
বলেই তিনি টেবিলের ওপর থেকে থালাটা নিয়ে এলেন অরিন,রুহির কাছে। রুহিতো থালা ভর্তি মিষ্টি পাকোয়ান দেখে পারেনা লাফিয়ে পড়তে। মেয়েটা আবার বড় মিষ্টপ্রিয়! রুহি চটপট করে দুটো পাকন পিঠা তুলে নিয়ে মুখে পুরে নিলো।আহা! সে কি স্বাদ। মুখে দিতেই বুঝি মিলিয়ে গেলো সবটা।রুহি বেশ আয়েশ করে চিবুচ্ছে তার পছন্দের পিঠা।রাফিয়া বেগম মেয়েটার এহেন কান্ডে স্মিত হাসলেন।সযত্নে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন রুহির।তারপরই তিনি তাকালেন অরিনের দিকে।মেয়েটাকে ওমন উদাস হয়ে অন্যমনস্ক থাকতে দেখে রাফিয়া বেগমের কপালে দু-তিনেক ভাজ পড়লো যেন।তিনি মৃদু স্বরে বললেন,
“ কিরে? কি ভাবছিস এতো?”
হঠাৎ ডাকে কিছুটা হকচকিয়ে ওঠে অরিন।রাফিয়া বেগম এবার কেমন সন্দিহান গলায় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ এতো মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছিস তুই?”
অরিন তড়িৎ মাথা নাড়ায়। বলে,
“ কই.. নাতো,তেমন কিছু না। ”
“ সত্যি?”
“ হ-হ্যা”
মেয়ের মুখের কথাতে কেমন যেন রহস্য রহস্য গন্ধ পেলেন রাফিয়া বেগম। তিনি কিছুটা ভাবুক হলেন।পরক্ষণেই কি যেন মনে করে বলে ওঠেন,
“ তুই আজকে সারাদিন ঘরে নতুন বউদের মতো বসে আছিস কেন? নিচে নামিসনি কেনো একটিবারের জন্যও? শুনলাম, ছোটো না-কি রুমে এসে তোকে খাবার দিয়ে গেছে? কি হয়েছে বল তো একটু!”
মায়ের কথায় পরপর ঢোক গিলে অরিন।এবার কি জবাব দিবে সে? মা যদি কিছু টের পেয়ে যায় তখন? অরিন একবার আড়চোখে তাকালো রুহির পানে।রুহি মেয়েটাও এহেন পরিস্থিতে গালভরে মিষ্টি ঠুসে চাবাতে ভুলে গেলো যেন।অরিন ভয়ে ভয়ে আবারও তাকায় মায়ের দিকে।রাফিয়া বেগমের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। এরূপ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে এই বুঝি মেয়েটার মনের কথাগুলো টুস করে পড়ে ফেলবেন তিনি। অরিন আমতা আমতা করে বলে,
“ ইয়ে… আসলে আম্মু! আজকে.. শরীরটা কেমন ভালো লাগছিলো না তাই..”
“ কি হয়েছে? সিরিয়াস কিছু?”
অরিন ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। তা দেখে রাফিয়া বেগম ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন।হাতে থাকা থালাটা বিছানায় রেখে নিজে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।মেয়ে দুটোকে বললেন,
“ মিষ্টি গুলো শেষ করবি কিন্তু! একটাও যেন বাকি না থাকে। ওকে?”
রুহি মুখের অবশিষ্ট খাবারটুকু গিলে কোনমতে মাথা কাত করে। রাফিয়া বেগম একবার তাকালেন সেদিকে। তারপর তিনি গটগট পায়ে বেরিয়ে এলেন ঘর ছেড়ে। এদিকে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো অরিন,রুহি।অরিনতো রীতিমতো মায়ের ভয়ে ঘেমে-নেয়ে একাকার। তার মা যা বিচক্ষণ বুদ্ধির! কে জানে কিছু একটা আচঁ করতে পারলো কি-না!
গোধূলির বিষন্ন আকাশ ছেয়ে গেছে সন্ধ্যার মৃদুমন্দ আবছা আলোয়। এহসান বাড়ির প্রতিটি মানুষের মনেও ছেয়ে গিয়েছে খানিকটা আধার। এইতো কিছুক্ষণ আগেই রুহিটা চলে গেলো নিজ বাড়িতে। এবারেও যাওয়ার সময় সেকি কান্না মেয়েটার! মনে হচ্ছিলো — এখনি বুঝি নতুন বিয়ে দিয়ে বিদায় করা হচ্ছে তাকে।জুবাইদা বেগম তো এমনিতেই নরম-সরম মানুষ। মেয়ে চলে যাবার কষ্টে সে-ই সকাল থেকেই মূর্ছাপ্রায় মানুষটা।তার ওপর মেয়ের ওমন আর্তনাদ ভরা কান্না দেখে আরেকটু ভেঙে পড়লেন তিনি।মানুষটাও কেমন বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদলেন মেয়েকে জড়িয়ে। রুহিকে গাড়িতে তুলে দিতেই তার কান্নার রোল বুঝি আরও বাড়লো।রুহিও যে এক্ষেত্রে কম যায়না।সেও গাড়িতে বসে বাচ্চাদের মতো কেঁদে কেটে অস্থির।
শেষমেষ উপায়ন্তর না পেয়ে কবির সাহেব ইশারায় রেহানকে গাড়ি ছাড়তে বললেন। রেহানও বাধ্য জামাইয়ের মতো শুনলো শ্বশুরের কথা।সে ড্রাইভারকে বলে গাড়ি ছাড়তে। আর নিমিষেই গাড়িটি পেছনে ধূলো উড়িয়ে এহসান বাড়ির আঙিনা ত্যাগ করে। ওদিকে জুবাইদা বেগমের কান্না তখনও চলমান। রাফিয়া বেগমসহ জনে জনে এসে তাকে থামাবার প্রয়াস চালিয়েও যখন ব্যর্থ হলো,তখনি কবির সাহেব এগিয়ে গেলেন স্ত্রীর কাছে।স্ত্রীর মূর্ছান্বিত দেহটা টেনে নিজের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে মাথায় আলতো করে হাত বুলালেন কিছুক্ষণ।
তন্মধ্যেই ঘটলো আরেক বিপত্তি। সাব্বির সাহেবেরও হুট করেই প্রেসার উঠে গেলো।তখন আবার প্রতিটা মানুষ রুহির যাওয়ার শোক ছেড়ে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।কবির সাহেব যদিও সাথে সাথে রৌদ্রের সঙ্গে কথা বলে টুকটাক প্রাথমিক চিকিৎসা করলেন ভাইয়ের। এতে অবশ্য আগের চেয়ে বেশ খানিকটা সুস্থ আছেন সাব্বির সাহেব। এখন বাড়ির প্রতিটি মানুষ তার ঘরেই বসে আছেন।অরিনটা তো সেই কখন থেকে বাবার বুকের ওপর পড়ে কেঁদেই যাচ্ছে। মাঝে বেশ কয়েকবার অনিক এসে বোনকে সামলাতে চেয়েও লাভের লাভ তো হলোই না উল্টো বাবার মুখের শক্ত কথা শুনতে হলো তাকে।তাইতো ছেলেটা এখন অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে। না আসছে বোনের কাছে আর না আসছে বাবার কাছে।
সাব্বির সাহেবের বুকটা ইতোমধ্যেই ভারি হয়ে আসলো মেয়ের কান্নায়।তিনি আলতো করে আদুরে হাত বুলালো মেয়ের মাথায়।ধীর স্বরে বললো,
“ আর কাঁদে না মা! মাথা ব্যাথা করবে তো তোমার!”
অরিন ধীরে ধীরে মাথা তোলে।মেয়েটার শুভ্র মুখশ্রীটার কি হালটাই না করেছে সে! কাঁদতে কাঁদতে ইতোমধ্যেই মুখটা লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। সাব্বির সাহেব টেনে মেয়েকে বুকে আনলেন।মেয়ের মাথাটায় পরপর কয়েকটা চুমু দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলেন। মোটা হয়ে আসা কন্ঠে ঘরভর্তি মানুষদের বললেন,
“ আমি কিভাবে নিজের মেয়েকে বিদায় দিবো?”
তারপর তিনি বড় ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ছলছল হয়ে আসা চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ ভাইজান! আমি এতোটা দূর্বল কেনো হলাম বলোতো? কিভাবে আমি নিজের কলিজার টুকরোকে বিদায় দিবো? কিভাবে ওকে অন্যের ঘরে পাঠাবো?”
কবির সাহেবের গম্ভীর মুখে খানিকটা পরিবর্তন এলো।তিনি কোমরের পেছনে দু’হাত বেধে অন্যদিকে মুখে করে চাইলেন। তারপর কেমন অদ্ভুত কন্ঠে বললেন,
“ বাবাদের এতো দূর্বল হলে হয়না সাব্বির! মেয়ে নামক প্রিয় অতিথিকে একদিন না একদিন বিদায় দিতেই হবে।এটাই যে অবধারিত নিয়ম!”
ঘরভর্তি উপস্থিত সকলের চোখই কেমন ভিজে আসলো হুট করে। যদিও কথাটা তিক্ত, কিন্তু চিরন্তন সত্য বটে!
রাত সাড়ে ১০ টা।চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এলাকায় প্রায় নিশুতি নেমে এসেছে বৈকি! প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় মানুষজন বেশ আগেভাগেই কাজ কারবার সেরে শুয়ে পড়েছে।রৌদ্রসহ তাদের টিম মেম্বাররা মোট ১২ জন।প্রত্যেকের জন্যই একটি খোলা মাঠে ক্যাম্পের সুব্যাবস্থা করা হয়েছে। এলাকাটা এককথায় মাফস্বল হওয়ায় হোটেল ব্যাবস্থা একপ্রকার স্বপ্ন বৈকি!
সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ভিষণ ক্লান্ত দেহটা কোনরকমে টেনে এনে নিজের তাবুতে ঢুকলো রৌদ্র।নাহ! দেহ বুঝি আর চলছেই না।ছেলেটা গায়ের এপ্রোন,হাতে থাকা স্ট্যাথোস্কোপটা রাখলো টেন্টের ভেতর রাখা ছোট্ট টেবিলটার ওপর। বেশ বড়সড়ভাবেই টেন্টগুলো তৈরি করা হয়েছে।প্রতিটি টেন্টে একটি করে চৌকি,একটা পড়ার টেবিল রাখা।রৌদ্র গায়ের শার্টটা খুলে কোনরকমে ক্লান্ত দেহটা নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো চৌকিতে। এ মুহুর্তে বউটার কথা ভিষণ মনে পড়ছে তার।মেয়েটা নিশ্চয়ই তার এই অবস্থা দেখে খুব চিন্তিত হতো।ব্যস্ত হয়ে তার সেবা করতো। তার ছোট ছোট আঙুল গুলো দিয়ে ধীরে ধীরে রৌদ্রের মাথাটা টিপে দিতো।আর রৌদ্র কি করতো? সে মেয়েটাকে হুটহাট লজ্জা দিতো।মেয়েটার লজ্জা রাঙা মুখখানা প্রাণভরে দেখতো।এসব ভাবতে ভাবতেই রৌদ্রের চোখ লেগে আসে খানিকটা। ঠিক তখনি রৌদ্র টের পেলো তার নগ্ন পিঠে কারো হাতের স্পর্শ। রৌদ্রের ঘুমন্ত মস্তিষ্ক তড়াক করে জেগে ওঠে। সে একলাফে বিছানা ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। তক্ষুনি দেখতে পায় মৌটুসীকে তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। মেয়েটার পরনে সেই উদ্ভট ড্রেসআপ। আর চোখেমুখে লেপ্টে আছে একরাশ মাদকতা। মেয়েটা রৌদ্রের উম্মুক্ত দেহে কয়েকবার নজর বুলালো।ইতোমধ্যেই তার হার্টবিট বুঝি ফার্স্ট হয়ে এসেছে অনেকটা। সে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে আবেদনময়ী হাসলো। পা বাড়িয়ে খানিকটা এগোতেই রৌদ্র ধমকে উঠলো।
“ এই আপনি এতো রাতে একজন পরপুরুষের তাবুতে কেনো এসেছেন? মিনিমাম লজ্জা বোধটুকুও কি নেই আপনার?”
মৌটুসী কেমন অদ্ভুতভাবে হাসলো।সে রৌদ্রের কথাগুলোকে তেমন পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে আসে নিজের মতো। রৌদ্রের প্রায় অনেকটা কাছে আসতেই রৌদ্র সরে যায় দু-কদম।মৌটুসী এবার বাঁকা চোখে তাকায় রৌদ্রের দিকে।সন্দিহান গলায় বলে ওঠে,
“ আর ইউ ডাম্ব হ্যান্ডসাম? আমার মতো একটা হট এন্ড বোল্ড মেয়ে নিজ থেকে আপনাকে সিগনাল দিচ্ছে, আর আপনি কি-না এমন দূরে পালাচ্ছেন! হেই…আপনার সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?”
এহেন কথায় রৌদ্রের মুখাবয়বে পরিবর্তন এলো।ছেলেটার দৃঢ় চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। হাতদুটো হয়ে আসে মুষ্টি বদ্ধ। চোখদুটোতে কেমন রক্তাভ আভা ফুটে উঠেছে। রৌদ্র চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“ আমার রুম থেকে বের হোন। আদার ওয়াইস এখন যা হবে তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী কেবল আপনিই থাকবেন।”
মৌটুসীর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে আসে এহেন কথায়।সে রৌদ্রের কাছে এসে আবেদনময়ী কন্ঠে বলে,
“ হ্যা,হ্যা! আই হেভ নো প্রবলেম ইন দিস!প্লিজ কাম!”
বলেই সে রৌদ্রের একহাত ধরতে নিলে রৌদ্র তার হাতের কব্জি চেপে ধরে।মৌটুসী ভড়কায়।কব্জির ব্যাথায় মৃদু ককিয়ে উঠে সে।বলে,
“ রৌদ্র! ইট’স হার্টিং মি!”
শুনলোনা রৌদ্র। মেয়েটার চেপে রাখা কব্জিটা ধরে তাকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে পেছন দিয়ে সেই হাতটা মুচড়ে ধরে রৌদ্র। মৌটুসী ব্যাথায় চিৎকার করতে নিলে অন্যহাতে তার মুখ শক্ত করে চেপে ধরে রৌদ্র। কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
“ আমি বিবাহিত! বউ আছে আমার।আমাকে ছোঁয়ার একমাত্র অধিকার আমার বউয়ের। যেখানে ঘরে পবিত্র ফুল আছে সেখানে তোর মতো নর্দমার কীটকে কেন নিজেকে ছুঁতে দিবো আমি?”
ব্যাথায় চোখমুখ নীল হয়ে আসছে মৌটুসীর।মেয়েটা কেমন ছটফট করছে নিজেকে ছাড়ানোর। অথচ রৌদ্রের পুরুষালি শক্তির সঙ্গে একদমই পেরে উঠছে না সে।রৌদ্র মৌটুসীর মুখ চেপে রেখেই বিছানার ওপর থেকে পড়ে থাকা শার্টটা তুলে মৌটুসীর মুখে বেঁধে দেয়।যেন তার চিৎকার এই তাবু ছাড়িয়ে অন্য কোথাও না যায়।রৌদ্র একবার এদিক ওদিক তাকায়।পরক্ষণেই মৌটুসীর গলায় ঝুলানো স্কার্ফটা দেখতে পেয়ে সেটা টেনে এনে পেছন দিয়ে মৌটুসীর হাতদুটো টাইট করে বেধে দেয় রৌদ্র। তারপর রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
“ প্রচুর শখ না তোর,আমার সংস্পর্শে আসার? ঠিক আছে। আজকে তোর এই শখ জনমের মতো ঘুচিয়ে ছাড়বো আমি।”
মৌটুসী এখনো গুঙিয়ে কাঁদছে। তার চোখদুটো বেয়ে অসীম ধারায় অশ্রুকণা ঝড়ছে।হয়তো চোখদুটো তার অনুনয় করছে রৌদ্রের কাছে।যেন তাকে ছেড়ে দেয় এই যাত্রায়।কিন্তু রৌদ্র কি আর ওতো সহজে থামবার পাত্র? রৌদ্র মৌটুসীর হাতদুটো বেধে দিয়ে তাঁবুর চেইনটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দেয়।তারপর রাগে কটমট করতে করতে এদিক-ওদিক খুজে প্যান্টের বেল্টটা হাতে তুলে নিলো।মৌটুসী ভড়কে যায়। মাথা নাড়িয়ে বারবার গুঙিয়ে কাঁদছে মেয়েটা।অথচ রৌদ্র দাঁত খিচেঁ বলে,
“ কত্তবড় কলিজা তোর? আমার গায়ে হাত দেস? আমার শরীরে স্পর্শ করার অধিকার শুধুই আমার বউয়ের। সেখানে তোর ঐ নোংরা হাতে ছোবার সাহস কোত্থেকে পেলি তুই?”
বলেই আর কোনরূপ কালবিলম্ব না করে একের পর এক বেল্টের আঘাত করতে থাকে মৌটুসীর গায়ে।ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে মাটিতে হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় কাতরাতে থাকে মেয়েটা। অথচ সেদিকে বিন্দুমাত্র দয়ামায়া হলো না রৌদ্রের। সে তো রাগের মাথায় ভুলেই বসেছে তার সামনে পড়ে থাকা মানুষটা একটা মেয়ে। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ বেধড়ক মারধর করার পর রৌদ্র থামলো।মৌটুসীর অবস্থা একেবারেই খারাপ। মেয়েটার সর্বত্র গায়ে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে কেমন! কিছু কিছু জায়গার চামড়া ফেটে রক্তও ঝড়ছে খানিকটা। রৌদ্র এবার শক্ত হাতে মৌটুসীর চুল চেপে ধরে রাগে হিসহিসিয়ে বলে,
“ইউ ব্লাডি বিচ! কান খুলে শুনে রাখ, তোর মতো যাকে তাকে নিজের পুরুষত্ব প্রমাণ দিতে মোটেও ইন্টারেস্টেড নই আমি! সেটা প্রমাণ যাকে দেবার সে পেলেই হলো!”
কথাটা বলেই রৌদ্র মৌটুসীর চুল ছেড়ে দিয়ে, মেয়েটার দু-গাল বরাবর থাপ্পড় দিলো কয়েকটা। এতেও বুঝি শান্তি হলোনা তার।সে আরেকবার হাত উঠাতেই তার ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে। রৌদ্র বিরক্ত হয়ে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিতেই তার সকল বিরক্তি বুঝি নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো।অরিন ফোন করেছে। রৌদ্র ফোনটা হাতে নিয়ে মৌটুসীর পানে তাকায়।মেয়েটা কেমন জোরে জোরে গোঙাচ্ছে।রৌদ্র আবারও শক্ত হাতে মৌটুসীর চোয়াল চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ হুশশশ! আমার বউ কল করেছে। আমি এখন কথা বলবো ওর সাথে। এর মধ্যে তুই যদি বিন্দু পরিমাণ আওয়াজও করিস তাহলে কসম,এক্ষুণি তোকে জ্যান্ত মাটিতে পুতেঁ দিয়ে আসবো।এন্ড আই প্রমিস,কোনো কাকপক্ষীও টের পাবেনা বিষয়টা!”
রৌদ্রের এহেন বাক্যে ভিষণ ভয় পেলো মৌটুসী। সে মুখ বুজে রইলো তখন।রৌদ্র উঠে দাঁড়ায়।গলা মৃদু খাঁকারি দিয়ে কলটা রিসিভ করে কানে ঠেকায়।নরম গলায় শুধায়,
“ সানশাইন!”
ওপাশে অরিন মৃদু হেসে জবাব দেয়,
“ এতক্ষণে রিসিভ করার সময় হলো? কি এমন জরুরি কাজ করছিলেন শুনি?”
রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে হাসে। কপালে আঙুল ঠেকিয়ে একবার আড়চোখে তাকায় মৌটুসীর পানে।বলে,
“ তেমন কিছু না। শুধু একটা উচ্ছিষ্টকে তার জায়গা চিনিয়ে দিচ্ছিলাম!”
অরিন হতভম্ব হলো। রৌদ্রের কথার গভীরতা উপলব্ধি করতে না পেরে বললো,
“ বুঝিনি! কি বললেন? ”
“ বুঝতে হবেনা।আচ্ছা আগে এটা বল তো,তোর গলা ভাঙলো কিভাবে? কার জন্য কাঁদতে হলো তোর?”
অরিন এবার খানিকটা অবাক হলো বটে।মানুষটা কতো সহজেই বুঝে গেলো তার কাঁদার ব্যাপারটা! অবশ্য না বোঝারই বা কি আছে।যেই মানুষটা তার মনের প্রতিটা খবর রাখে, তার জন্যে কি আর এটুকু জানা কোনো বিষয় হলো? অরিন শোয়া অবস্থায় ওপাশ ছেড়ে এপাশে ফিরলো।কাছে থাকা একটা বালিশ নিয়ে বুকে চেপে ধরলো।তারপর মিহি স্বরে বললো,
“ ও ডাক্তারসাহেব! আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে গো!”
রৌদ্রর ঠোঁট আপনা-আপনি প্রসারিত হলো খানিকটা। সে তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
“ এমন আদুরে কন্ঠে বললে আমি আমার জানটাও দিয়ে দিতে প্রস্তুত জানবাচ্চা! সেখানে দেখা দেওয়া এ আর এমন কি?”
রৌদ্রর কথা শেষ হবার পূর্বেই অরিন কেমন খেঁকিয়ে ওঠে বললো,
“ এই..এই.. কি বললেন আপনি? জান দিবেন মানে? আপনি এই কথাটা মুখে আনলেন কেন?”
রৌদ্র ভড়কায়।সে বুঝতে পারলো,ভুল সময়ে ভুল কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়েছে তার।সে তক্ষুনি অভিমানিনীর অভিমান ভাঙাতে বললো,
“ সরি,সরি! এক্সট্রিমলি সরি জানবাচ্চা।আমিতো এমনিই বলে ফেলেছিলাম…! ”
“ রাখেন আপনার এমনি! এসব কথা আপনার জন্য এমনি হলেও আমার জন্য একেবারেই নয় ডাক্তার সাহেব!”
রৌদ্র বুঝলো ব্যাপারটা বেগতিক যাচ্ছে। যে করেই হোক মেয়েটার রাগ ভাঙাতে হবে তার। সে কিছু একটা বলবে তার আগেই অরিন ফট করে মুখের ওপর কল কেটে দেয়।রৌদ্র তখন হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো ফোনটার দিকে।পরক্ষণেই তার মুখটা শক্ত হয়ে এলো।সে শক্ত হাতে ঘাড় চেপে ধরে নিজের। বিরবির করে বলতে থাকে,
“ উফ! ইউ হেভ ডান টু মাচ সানশাইন!”
কিয়তক্ষন বাদেই রৌদ্র মৌটুসীর পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে।তারপর মেয়েটার দিকে তেড়ে এসে তার চুলের মুঠি ধরে তাকে দাঁড় করায়। শক্ত কন্ঠে বলে,
“ আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা যদি ঘুনাক্ষরেও কেও টের পায়,তাহলে মনে রাখিস তোর মৃত্যু অবধারিত। আর ভুলেও এটাকে ফোকলা ধমকি হিসেবে ভাবিস না যেন, কেননা আমার কাছে কিন্তু তোর অতি অসাধারণ একটা ভিডিও যেটা কিনা মিস্টার সো কলড ম্যানেজিং ডিপার্ট্মেন্টের ডিরেক্টরের সাথে… বুঝতেই পারছিস কি বলতে চাইছি! জাস্ট একটা ক্লিক করবো, ওমনি পুরো মিডিয়া জুড়ে ব্রেকিং নিউজ হবে — এতোবড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের মেয়ের চরিত্র নিয়ে! তখন নিশ্চয়ই ব্যাপারটা খুব একটা ভালো হবে না তোর জন্য!”
মৌটুসীর চোখদুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম। মেয়েটা হতবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র আর কিছু না বলে মেয়েটাকে টেনেহিঁচড়ে তাঁবুর বাইরে ছুড়ে ফেলে।তারপর মৌটুসীর হাতের বাঁধন আর মুখের বাঁধন আলগা করে তাকে হাতের ইশারায় সরে যেতে বলে।মৌটুসীও আর কিছু না বলে কাতরাতে কাতরাতে নিজের তাঁবুর দিকে হাঁটা ধরে।
রৌদ্র নিজের তাঁবুতে আসে।তারপর একটা টাওয়েল নিয়ে নিজের ঘর্মাক্ত শরীরটা মুছে নিয়ে বসে পড়ে চৌকিতে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে ভিডিও কল লাগায় অরিনের নাম্বারে। প্রথম কলটা রিং হতেই কেটে দেয় অরিন।রৌদ্র ফের কল লাগায়। এবারেও ঘটলো একই ঘটনা। রৌদ্রের এবার মেজাজ খারাপ হয়।সে তখনি ভয়েস নোট পাঠায় অরিনকে।
“ এবার কল কাটলে আই সয়্যার অরি,আমি আর কোনোদিন তোকে কল দিবো না!”
ভয়েসটা সেন্ড করে রৌদ্র অপেক্ষা করলো মিনিট খানেক।যখনি দেখলো ভয়েসটা সিন হয়েছে তখনি সে কল লাগায় আবারও। এবার তার টোটকায় কাজ হলো।অরিন বাধ্য মেয়ের মতো কল রিসিভ করে নিলো।কিন্তু সে ক্যামেরার সামনে এলোনা। রৌদ্র ভ্রু কুঁচকায়।চোখ বন্ধ করে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“ সামনে আয়!”
কথাটা খানিকটা ধমকে বলায় কেঁপে ওঠে অরিন। মেয়েটা তক্ষুনি মাথানিচু করে সামনে এলো ক্যামেরার। রৌদ্র এখনো আগের ন্যায় চোখ বন্ধ করে রাখা।অরিন ধীরে ধীরে স্ক্রিনে চোখ রাখে।হুট করে রৌদ্রকে এমন শার্টলেস দেখে তৎক্ষনাৎ চোখদুটো সরিয়ে নেয় সে।কিন্তু পরক্ষণেই আবারও চোরা চোখে একটু একটু করে বারবার তাকায় স্ক্রিনে। রৌদ্র এবার গম্ভীর কন্ঠে শক্ত গলায় বলে ওঠে,
“ একটা কথা ভালোমতো মাথায় গেঁথে রাখ মেয়ে।আমার সাথে তোর ঝগড়া হোক,মনোমালিন্য হোক কিংবা যা কিছুই হয়ে যাক না কেন,ভুল করেও কোনোদিন আমার মুখের ওপর ফোন কাঁটার দুঃসাহস করবি না।এটা ফার্স্ট টাইম করেছিস বিধায় কিছু বলিনি কিন্তু নেক্সট টাইম এমনটা করলে ইউ ইউল হেভ টু পে ফর দিস! এন্ড রিমেম্বার, আই উড ব্যাডলি টেক দেট!”
রৌদ্রর বলা এহেন কথায় সামান্য ঢোক গিলে অরিন। মাথা নুইয়ে কোনরকমে বললো,
“ হু”
রৌদ্র এবার চোখ মেলে।ভ্রু কুঁচকে যেইনা আরও দুটো শক্ত কথা বলতে যাবে তার আগেই মেয়েটার নুইয়ে রাখা সুশ্রী মুখখানা দেখে ভ্রুদ্বয় শিথিল হয়ে আসে তার।মনটা একেবারেই শান্ত হয়ে যায় তৎক্ষনাৎ। এতক্ষণের রাগ গুলো যেন গলে পানি তার। রৌদ্র কিছুক্ষণ মনভরে দেখলো তার প্রাণভোমরাকে।তারপর হুট করেই অরিনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলে ওঠে,
“ সানশাইন! ওড়নাটা সরা তো!”
অরিন হকচকিয়ে ওঠে এহেন কথায়। সে নিজের গায়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা ওড়নাটা আরেকটু চেপে ধরে নিজের সঙ্গে। মাথা নুইয়ে রেখেই আমতা আমতা করে বলে,
“কেন?”
“ এই তোকে সরাতে বলছিনা? এক্ষুণি সরা!”
অরিন মাথা নাড়িয়ে না বলে আবারও। এবার বুঝি আরেকটু খেপে গেলো রৌদ্র। সে আরেকদফা খেঁকিয়ে ওঠে,
“ এতোটা অবাধ্য হয়েছিস তুই? বড় হিসেবে তো মান্য করছিসই না, এটলিস্ট স্বামী হিসেবে মান্য করা উচিত সেটাও করছিস না।তোকে লাস্ট বার বলছি সরাবি কি-না? ”
অরিন নিশ্চুপ! তা দেখে রৌদ্র দাঁত খিঁচে বললো,
“ ওকে দ্যান রাখ!”
বলেই সে ফোনটা কাটতে নিলে বাঁধ সাধে অরিন।সে তৎক্ষনাৎ গা থেকে ওড়নাটা সরিয়ে দেয়। তক্ষুনি রৌদ্রের সামনে ভেসে ওঠে অরিনের গায়ে পড়ে থাকা তারই শার্টটা। রৌদ্র তখন অরিনকে দেখার একপর্যায়ে এটাই সন্দেহ করেছিলো।আর তার সন্দেহ বরাবরের মতো সত্যি হলো।মেয়েটার গায়ে কি সুন্দর করে ফুটে উঠেছে তার শার্টটা।ছোটখাটো দেহটায় এতোবড় শার্ট আটাতেও বেশ কসরত করতে হয়েছে হয়তো। রৌদ্র অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। মেয়েটার এমন ছোট ছোট পাগলামিগুলো বড্ড কাহিল করে তাকে। এই যে তাকে মিস করছিল বিধায় তার শার্ট পড়ে রেখেছে। এটাই যে বড্ড আদুরে ব্যাপার তার জন্য। রৌদ্র এবার গলায় একরাশ নমনীয়তা ঢেলে বললো,
“ বউজান! ও বউজান।আমায় খুব মিস করছিলে বুঝি?”
অরিন কিছু বলে না।সে শুধু নখ খুঁটে যাচ্ছে নিজের। ইশশ্ বেচারি কি লজ্জাতেই না পরলো এখন।মানুষটা না জানি কি ভাবছে তাকে নিয়ে। রৌদ্র অরিনকে চুপ থাকতে দেখে ফের বললো,
“ ও বউজান! বকুনি দিয়েছি বলে এখনও রেগে আছো? আচ্ছা ঠিক আছে আমি সরি বলছি!”
কথাটা বলেই রৌদ্র বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর কানে হাত ধরে উঠবস করতে করতে বলে,
“ সরি বউজান! খুউউববব সরি! আর রেগে কথা বলব না।”
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৩৪+৩৫
অরিন হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে মানুষটার দিকে।কে বলবে এই মানুষটাই আর বাকি মানুষদের সামনে কতটা গম্ভীর হয়ে থাকে।অথচ এখন দেখো! তার মতো মানুষের জন্য কি-না কানে ধরে উঠবসও করছে!