সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৫

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৫
Jannatul Firdaus Mithila

কবির সাহেবকে শুইয়ে দেওয়া হলো অপারেশন টেবিলের ওপর। মানুষটার ডান হাতে ক্যানোলা লাগানো।যেটার মাধ্যমেই দেওয়া হলো জেনারেল এনেস্থেসিয়া।কয়েক মিনিটের মধ্যেই মানুষটার পুরো শরীর হয়ে গেলো অচেতন। এনেস্থেশিস্ট একটি এন্ডোট্রাকিয়াল টিউব ঢুকিয়ে দিলেন কবির সাহেবের শ্বাসনালিতে — যেন আপাতত ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শ্বাস দেওয়া যায়।
এনেস্থেশিস্ট নিজের হাতের কাজগুলো শেষ করে খানিকটা সরে দাঁড়ালেন।এবার এগিয়ে আসে কার্ডিও থোরাসিক সার্জন ড.রৌদ্র। তার সাথেই রয়েছে তার পুরো টিম।তার টিমে রয়েছে একজন দক্ষ সহকারী সার্জন, নার্স,পারফিউশনিস্ট — যিনি কি-না হার্ট -লাংস মেশিন চালাবেন।

রৌদ্র এবার নিজের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলো।লম্বা একটা শ্বাস টেনে মনে টানলো একবুক সাহস।কিয়তক্ষন বাদেই সে তার গ্লাভস পড়া ডানহাতটা বাড়ালো সার্জনের দিকে।আর তক্ষুনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সার্জন একটা ছুরি এগিয়ে দেয় রৌদ্রের হাতে। অতঃপর ছুরি দিয়ে শুরু হলো Median Sternotomy. রৌদ্র দক্ষ হাতে ছুরি দিয়ে বুকের মাঝখান বরাবর কাটতে লাগলো।তারপর Sternal Retractor দিয়ে একটা একটা করে বুকের হাড় ছাড়িয়ে দিতে লাগলো — যেন হার্টটা স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

একদিকে রৌদ্র বুক কা*টায় ব্যস্ত অন্যদিকে সহকারী সার্জন শুরু করে দিলেন নিজের কাজসমূহ।তিনি হার্ট-লান্স মেশিন চালু হবার পূর্বে কবির সাহেবের দেহে হেপারিন দিয়ে দিলেন।যাতে করে মানুষটার শরীরে রক্ত না বাঁধে। তারপর তিনি হার্ট বন্ধ করে দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ ঠান্ডা তরল যার নাম Cardioplegia সেটি পেশেন্টের গায়ে ইনজেক্ট করে দিলেন। মিনিট খানেক পেরুতেই ধীরে ধীরে হার্ট বন্ধ হয়ে এলো।হৃৎস্পন্দন থেমে গেলো পুরোপুরি। সহকারী সার্জন নিজের কাজ শেষ করে পারফিউশনিস্টকে ইশারায় তার কাজ শুরু করতে বললেন। পারফিউশনিস্টও সার্জনের ইশারা পাওয়া মাত্রই নিজের কাজে মত্ত হলেন।তিনি নিপুণ হাতে হার্ট-লান্স মেশিন চালু করে দিলেন।এখন থেকে পেশেন্টের গায়ে রক্ত চলবে এই হার্ট-লান্স মেশিন দিয়ে। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে — কার্ডিওপালমোনারি বাইপাস।

উক্ত কাজগুলো শেষে এবার শুরু হলো আরেক যুদ্ধ। কবির সাহেবের হৃৎপিণ্ডের যে জায়গাগুলোতে ব্লক হয়ে আছে তার ওপরে ও নিচে রক্ত চলাচলের জন্য একটা নতুন পথ বানাতে হবে। এরজন্য প্রয়োজন LIMA (বুকে থাকা একটি ধমনী) কিংবা Saphenous vein (পায়ের শিরা)। রৌদ্র এখনও বুকের হাড় ছাড়িয়ে হৃৎপিণ্ড উম্মুক্ত করতে ব্যস্ত।সে নিজের কাজের ফাকেঁই ইশারায় সার্জনকে কিছু একটা করতে বললো।সার্জনও হয়তো বুঝে গেলো সেই ইশারা। তিনি তৎক্ষনাৎ চলে গেলেন কবির সাহেবের পায়ের কাছে।

কবির সাহেবের ডান পায়ের ওপর লম্বালম্বিভাবে কিছুটা জায়গা ফাঁক রেখে বাকিটা ঢেকে রাখা হয়েছে একটি সবুজ কাপড়ে।এখান থেকেই তিনটে Saphenous vein (পায়ের শিরা) নেওয়া হবে।সহকারী সার্জন প্রথমে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখে নেন Saphenous vein এর অবস্থান। যেটা কি-না পায়ের ভেতরের দিকে থাকে, টাখনু থেকে উরু পর্যন্ত বিস্তৃত। কিয়তক্ষন বাদেই সার্জন শুরু করে দিলেন Harvesting. সহকারী সার্জন খুব যত্ন করে ছোট একটা কাটা দিলেন টাখনুর কাছটায়।এরপর পায়ের ভেতরে সুপ্ত অবস্থায় লুকিয়ে থাকা শিরাটি ধীরে ধীরে বের করে আনলেন তিনি। পরক্ষনেই প্রয়োজনীয় দৈর্ঘ্যের অংশটুকু কেটে নিলেন দক্ষ হাতে।এরূপ ভাবে তিন তিনটে শিরা কেটে নিলেন তিনি।সার্জনের সঙ্গেই হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন একজন নার্স। যার হাতে রয়েছে একটি মাঝারি সাইজের তরল ভর্তি স্টেরাইল কন্টেইনার।সেই কন্টেইনারে রয়েছে Heparinized Saline অর্থাৎ রক্তের মতো লবনাক্ত তরল। সার্জন একে একে সবগুলো শিরা এনে রাখলেন Heparinized saline এ। এবার এই অংশগুলোই ব্যাবহার করা হবে হার্টে নতুন করে রক্ত চলাচলের রাস্তা বানাতে।
রৌদ্র মাথা কিঞ্চিৎ নিচু করে হার্টের ব্লকগুলো দেখছে।একে একে সবগুলো ব্লককে শনাক্ত করা শেষে সে সার্জনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

“ হেভ ইউ ডান?”
সার্জন মাথা নাড়ায়। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
“ ইয়েস স্যার!”
বলেই সে নার্সের হাত থেকে স্টেরাইল কন্টেইনারটা নিজের হাতে করে নিয়ে আসে রৌদ্রের নিকট।বলে,
“ হিয়ার ইট ইজ স্যার!”
রৌদ্র একপলক সরু চোখে তাকায় কন্টেইনারটার দিকে।ছেলেটা হালকা মাথা নাড়িয়ে পরবর্তী ধাপের দিকে এগোয়।কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয় বাইপাস সার্জারির সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং জটিল অংশ — হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে শিরা লাগিয়ে সুক্ষ্ম হাতে সেলাই করা। রৌদ্রের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন একজন বিচক্ষণ নার্স। যার হাতে ধরে রাখা একটা বড় মাপের স্টেরাইল ট্রে। যেখানে আছে সেলাই করার সকল সামগ্রী।

রৌদ্র হৃৎপিন্ডের দিকে নজর রেখেই হাত বাড়ায় নার্সের দিকে।নার্স তৎক্ষনাৎ একটা ছোটো পয়েন্ট ১১নং ব্লেড এগিয়ে দেয় রৌদ্রের হাতে।রৌদ্র ব্লেডটা হাতে নিয়ে হার্টের ব্লক অংশের নিচে থাকা ধমনীর ওপর একটা সুক্ষ্ম কাট দেয়।তারপর Potts scissors দিয়ে কাটটা একটু বাড়িয়ে শিরার মুখ ঢোকানোর মতো জায়গা করে নেয়।
রৌদ্র হাতে থাকা সিজারটা ট্রে-তে রেখে দেয়।তারপর সে নিজের দক্ষ হাতে কন্টেইনার থেকে একটি শিরা উঠিয়ে, শিরার এক প্রান্ত subclavian artery-তে লাগিয়ে দেয় — যেখান থেকে রক্ত আসে।তারপর শিরার অন্য প্রান্ত লাগিয়ে দেয় ব্লক অংশের নিচের দিকে coronary artery-তে।এতে রক্ত নতুন পথে ব্লক এড়িয়ে চলে যায়, ব্যাপারটা ঠিক তেমন যেমনটা বাইপাস রোডে গাড়ি এসে ঘুরে যায়।

রৌদ্র আবারও নার্সের দিকে হাত বাড়াতেই নার্স একটা Atraumatic Needle এগিয়ে দেয়।রৌদ্র হাত বাড়িয়ে তীক্ষ্ণ ছোট সুচঁটা নিয়ে নেয় একহাতে। অন্যহাতে নিয়ে নেয় সূতা।তারপর শুরু হয় তার দু’হাতের সাহায্যে কাপঁন হীনভাবে সার্কুলার সেলাই। প্রতিটি সেলাইয়ের দূরত্ব প্রায় ১ মিলিমিটারেরও কম।সেলাই গুলো হচ্ছে এমনভাবে, যেন রক্ত বের না হয় আর পথটা থাকে মসৃণ — কারণ বিন্দুমাত্র খসখসে থাকলেও রক্ত জমাট বাঁধতে পারে।এ মুহূর্তে রৌদ্রের দক্ষ হাতের আঙুলগুলোর মাঝে কোনপ্রকার কাঁপন নেই। রৌদ্রের সম্পূর্ণ কার্যক্রমে স্পষ্ট ফুটে উঠছে তার চমৎকার পেশাদারিত্ব।

প্রায় ঘন্টা খানেক পর একে একে তিনটে শিরা বসিয়ে গ্রাফট সম্পন্ন করলো রৌদ্র। এবার দেখার পালা শিরা দিয়ে সঠিকভাবে রক্ত চলাচল করছে কি-না। রৌদ্র গ্লাভস পড়া হাতে সদ্য জোড়া লাগানো শিরায় হালকা চাপ দেয়।উদ্দেশ্য — শিরার মাঝে কোনো লিক হচ্ছে কি-না তা দেখা। রৌদ্র একসঙ্গে তিনটে শিরাই পরিক্ষা করে দেখলো, নাহ! কোথাও কোনো লিক অথবা ড্যামেজ নেই।সবগুলোই ঠিকঠাক ভাবে বসেছে। রৌদ্র মাস্কের আড়ালেই ফোঁস করে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। তারপর তার হাত এগিয়ে গেলো বন্ধ হয়ে থাকা হার্টের দিকে। রৌদ্র হার্টের কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সেথায় গরম স্যালাইন ঢালে।এরপর অপেক্ষা করে মিনিট দুয়েকের জন্য। সাধারণত হার্ট শক্তিশালী হলে গরম স্যালাইন দেওয়ার প্রায় সাথে সাথেই নিজে থেকে রেসপন্স করতে শুরু করে কিন্তু তার বাবার বেলায় এটা যে হচ্ছে না। হয়তো মানুষটার হৃৎপিণ্ড বয়সের ভারে বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছে! নির্ধারিত সময় পেরোনোর পরও কবির সাহেবের হার্ট রেসপন্স না করায় খানিকটা চিন্তায় পড়লো উপস্থিত ডাক্তারবৃন্দ!রৌদ্র এবার আর কালবিলম্ব না করে হার্টের গায়ে Pacing Wire বসিয়ে দেয়। এরপর মেশিন চালু করে হালকা ইলেকট্রিক ইমপালস দেওয়া শুরু করে।

ইমপালস দেওয়ার ফাঁকে রৌদ্র নিজের সরু দৃষ্টি ফেলে অদূরের মনিটরের ওপর। যেখানে ইসিজির ঢেউ দেখা যাবে এবার। মিনিট খানেক পেরুতেই ইসিজি মনিটরে স্পষ্ট ফুটে ওঠে কয়েকটি ঢেউ… P..Q..R..S…..T অবশেষে প্রতিটি ঢেউয়ের দেখা মিললো। রৌদ্র আবারও দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। সার্জন আর নার্সরাও হাসলো একটুখানি।যাক,অবশেষে হৃৎপিণ্ডের নতুন বাইপাসের রাস্তাগুলো দিয়ে ঠিকঠাক মতো রক্ত বইছে তবে।
রৌদ্র আর সময় নষ্ট না করে পারফিউশনিস্টকে ইশারা করে হার্ট-লান্স মেশিন বন্ধ করে দিতে।যেহেতু এতক্ষণ রোগীর রক্ত চলাচল ও শ্বাস Heart-Lung Machine চালাচ্ছিলো, সেহেতু এখন হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা ফিরে আসায় মেশিনটি চালু রাখার কোনো দরকার নেই।পারফিউশনিস্ট ধীরে ধীরে হার্ট-লান্স মেশিন অফ করে দিলেন। এদিকে, রৌদ্র আবারও সর্তক চোখে শেষবারের মতো সব শিরা/ধমনির সেলাই ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা দেখে নেয়।এমনকি কোথাও রক্ত ফাঁস, চাপ কম কিংবা রক্ত জমাট বাঁধছে কিনা—এইসবও ভালোভাবে পরীক্ষা করে নেয়।সবশেষে কোথাও কোনো ত্রুটি না পেয়ে সে উদ্যত হয় চেস্ট ক্লোজ করতে।

রৌদ্র বুকের হাড় (sternum) যেটা কেটে রেখেছিলো, তা স্টেইনলেস স্টিলের তার (wire) দিয়ে নিপুণ হাতে জোড়া লাগাতে শুরু করে। প্রায় ঘন্টা খানেক চললো এই কাজ।তারপর শুরু হলো পেশি, চামড়া সব স্তর একে একে সেলাই করে ঢেকে ফেলার কাজ।রৌদ্র নার্স এবং সহকারী সার্জনকে সাথে নিয়ে বাকি কাজটুকু করে নেয়।যদিও প্রতিটি কাজ সময়সাপেক্ষ এবং ভিষণ ধৈর্যের! তবুও রৌদ্র বিন্দুমাত্র হেরফের করছেনা নিজের দায়িত্ব পালনে। আর করবেই বা কেন? আজ তো ছেলেটা শুধু ডাক্তার হিসেবে নয়,সে একজন সন্তান হিসেবেও নিজের দায়িত্ব পালনে তৎপর হয়ে আছে!

অবশেষে চামড়ার সকল স্তরও সেলাই করা শেষ হলো।এবার হার্ট ও ফুসফুসের চারপাশে যে রক্তটা জমে গিয়েছে তা বের করার জন্য chest drain tube বসিয়ে দেয় রৌদ্র। এই টিউব সাধারণত ২-৩ দিন থাকবে, এরপর সেটি খুলে ফেলা হবে নিজ আঙ্গিকে।
প্রায় ঘন্টা পাচেঁক বিশাল এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কবির সাহেবের বিরাট অপারেশন সম্পন্ন হলো। অপারেশন থিয়েটারের সকল ডাক্তার, নার্স একযোগে আলহামদুলিল্লাহ বলে ওঠেন।সহকারী সার্জন মৃদু হেসে বললেন,
“ আলহামদুলিল্লাহ স্যার!অপারেশন তো সাকসেসফুল।”

রৌদ্র ধীরে ধীরে মাথা ঝাকায়।ছেলেটার চোখদুটোর কার্নিশে ইতোমধ্যেই অশ্রু এসে হানা দিয়েছে।ভাব এমন — হালকা একটু টোকা পড়লেই বুঝি আলগোছে গড়িয়ে পড়বে তারা! রৌদ্রের বুকটাও কেমন কেমন যেন করছে।আশ্চর্য! ছেলেটা এতক্ষন ধরে এতবড় একটা অপারেশন করলো সেখানে কিন্তু একবারের জন্যও তার বুক কাঁপেনি, অথচ এখন দেখো! ছেলেটার শুধু বুক না তার সম্পূর্ণ শরীর জুড়েই যেন বইছে মৃদুমন্দ কম্পন! হয়তো এখনো নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছেনা রৌদ্র! হয়তো এখনো নিশ্চিত হতে পারছেনা — অপারেশনটা সাকসেসফুল।সহকারী সার্জন বুঝি বুঝে গেলেন রৌদ্রের মনের অবস্থা।তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন রৌদ্রের সন্নিকটে। নিচু কন্ঠে বললেন,

“ স্যার! আর ইউ ওকে?”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ চমকে ওঠে খানিকটা। ছেলেটা বুঝি এতক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভাবছিলো।তাইতো সার্জনের ডাক পেতেই সে কেমন হকচকিয়ে ওঠলো।খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে, রৌদ্র গম্ভীর কন্ঠে সার্জনকে জিজ্ঞেস করলো —
“ হু? কিছু বললেন আমায়?”
সার্জন ছলছল চোখজোড়া নিয়ে হাসলো খানিকটা। কিন্তু মুখে মাস্ক পড়ে থাকায় সে-ই হাসি চক্ষুগোচর হলো না রৌদ্রের। সার্জন কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন,

“ স্যার! অপারেশন তো সাকসেসফুল। এবার আমরা পেশেন্টকে আইসিইউ তে শিফট করে দেই?”
রৌদ্র একপলক বাবার দিকে তাকায়।কবির সাহেবের নিস্তেজ মুখটার ওপর এসে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।বুকের ওপর অসংখ্য কা*টা-ছেঁ*ড়ার চিহ্ন। কোথাও কোথাও লহু লেগে আছে এখনো।দু’জন নার্স মিলে যত্নসহকারে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন সেগুলো। রৌদ্রের বুক চিঁড়ে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘ নিশ্বাস। সে কবির সাহেবের নিস্তেজ মুখটার পানে চোখ রেখেই বলে ওঠে,

“ অপারেশন সাকসেসফুল হলেও পরবর্তী আশঙ্কা এখনো কেটে যায়নি ডক্টর। যতক্ষণ না আব্বুর…..”
কথাটা শেষ হবার আগেই থমকে যায় রৌদ্র। সে পরপর দুটো শুকনো ঢোক গিলে আবারও বলতে লাগলো,
“ আই মিন…পেশেন্টের জ্ঞান যতক্ষণ না ফিরছে ততক্ষণে কিছুই বলা যাবে না।আপাতত ওনাকে আইসিইউ তে শিফট করার ব্যাবস্থা করুন।”
কথাটা বলেই রৌদ্র চলে গেলো থিয়েটারের ওয়াশরুমের দিকে। সার্জন তড়িঘড়ি করে পেশেন্টকে আইসিইউ তে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলো। নার্সরা সকলে মিলে সকল যন্ত্রপাতি চেক করে কবির সাহেবকে একটি স্ট্রেচার বেডে শুইয়ে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে বেডটি ঠেলতে ঠেলতে বাইরে বের করে আনে।বেডের পাশাপাশিই হেঁটে আসছেন সহকারী সার্জন।

অন্যদিকে,ওটির বাহিরে অপেক্ষার বিষাক্ত প্রহর গুনছেন রেহান, তায়েফ সাহেব এবং তাশরিক সাহেব। তাশরিক সাহেব অস্থিরতায় সারা করিডরে পায়চারি চালাচ্ছেন। অপারেশন চলছে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা যাবত।এখনো ভালোমন্দ কোনো খবর আসেনি ভেতর থেকে। রেহান চুপচাপ মুখের সামনে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে করিডরের একপাশে লাগোয়া বেঞ্চির ওপর। তায়েফ সাহেব অদূরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। মানুষটা বারেবারে রুমাল হাতে কপালের ঘাম মুছছেন। এ মুহুর্তে মনটা বড় অস্থির কি-না! ওদিকে বাড়ি থেকে একের পর এক কল এসেই যাচ্ছে সকলের ফোনে। কিন্তু কেউই কারো ফোন তোলবার সাহস কিংবা ধৈর্য্য অব্ধি পাচ্ছে না। পাবেই বা কি করে? অপারেশন শুরু হবার পর থেকে এ নিয়ে একশোটা ফোন এসেছে বাড়ি থেকে। যতোবারই তারা ফোন তুলেছে ততবারই শোনা গেছে বাড়ির সকলের ক্রন্দনরত কন্ঠ!

তায়েফ সাহেব মুখ হা করে নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন। তিনি মনে মনে রবকে ডাকছেন একটু পরপর। ঠিক তখনি অপারেশন থিয়েটারের গেট খুলে যায়।আর নার্সরা স্ট্রেচারে করে কবির সাহেবকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন ধীরে ধীরে। রেহান তৎক্ষনাৎ বসা থেকে উঠে এগিয়ে আসে। তাশরিক সাহেব করিডরের শেষ সীমানায় ছিলেন, তিনি এসব দেখা মাত্রই একপ্রকার দৌড়ে এলেন। তায়েফ সাহেবও দুরুদুরু বুকে কাঁপা কাঁপা বদনে এগিয়ে এলেন স্ট্রেচারের কাছে। রেহান তড়িঘড়ি করে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করে বসে,

“ ডাক্তার!ইজ এভরিথিং ওকে?”
সার্জন হাসলেন একটুখানি। তিনি মুখ থেকে মাস্কটা সরিয়ে সহাস্য মুখে বলতে লাগলেন,
“ আলহামদুলিল্লাহ! অপারেশন সাকসেসফুল।”
একথা শোনা মাত্রই যেন একবুক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন সকলে। তায়েফ সাহেব সশব্দে বলে ওঠেন,
“ আলহামদুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ।”
তাশরিক সাহেব নিস্তব্ধ চোখে বড় ভাইয়ের নিস্তেজ মুখটার পানে তাকিয়ে আছেন।মানুষটা মুখ ফুটে বলতে অব্ধি পারছেন না কিছু। কেন যেন এ মুহুর্তে গলাটা ধরে আসছে তার। ইচ্ছে করছে — চিৎকার দিয়ে কাঁদতে।কিন্তু তা আর পারছেন কই? রেহান তৎক্ষনাৎ দেরি না করে বাড়িতে কল লাগায়। ওপাশে একটিমাত্র রিং হতেই কলটা রিসিভ করে কানে ঠেকায় রুহি।মেয়েটা তৎক্ষনাৎ অস্থির হয়ে বলতে থাকে,

“ আব্বুর কি অবস্থা? অপারেশন কি কমপ্লিট? অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে তো? আব্বুকে…. ”
রুহির একের পর এক জিজ্ঞাসায় ভেজা চোখে হাসলো রেহান।ছেলেটা শার্টের হাতায় চোখদুটো মুছে নিয়ে ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলো —
“ আলহামদুলিল্লাহ! অপারেশন সাকসেসফুল।”
থমকায় রুহি।নিঃশ্বাসের উঠানামা বেড়ে যায় তার।সারা শরীরে বয়ে যায় অনিয়ন্ত্রিত কম্পন। রুহির পাশেই বসে আছে বাড়ির সকলে। মেয়েটার হঠাৎ এহেন স্তব্ধতা দেখে কলিজায় মোচড় দিয়ে ওঠে জুবাইদা বেগমের।তিনি মেয়েকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
“ কি হয়েছে? ক-কথা বলছিস না কেনো?”
নাহ! এহেন কথাতেও স্তব্ধতা কাটছে না রুহির।অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা রাফিয়া বেগম এবার খানিকটা অস্থির হলেন। তিনি ছুটে এসে রুহির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কানে ঠেকান নিজের। কাঁপা কন্ঠে রেহানকে জিজ্ঞেস করেন,

“ কি অবস্থা ওখানকার?”
রেহান আবারও একই উত্তর দিলো। রাফিয়া বেগম আলগোছে চোখদুটো বন্ধ করে নিলেন। ফোনটা ধীরে ধীরে তার কান হতে নেমে এলো বুক বরাবর। রাফিয়া বেগম ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন,
“ আলহামদুলিল্লাহ!”
জুবাইদা বেগম ছলছল চোখে বান্ধবীর পানে তাকায়।মানুষটার দৃষ্টিতে স্পষ্ট লেপ্টে আছে একরাশ জিজ্ঞাসাবোধ। তিনি কাঁপা কাঁপা হাতটা দিয়ে কোনমতে রাফিয়া বেগমকে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
“ কি হলো?”
রাফিয়া বেগম তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকান। তিনি হুট করেই কোনো আগাম সংকেত ছাড়াই জড়িয়ে ধরলেন জুবাইদা বেগমকে।জুবাইদা বেগম হতবিহ্বল হয়ে গেলেন এহেন কান্ডে। রাফিয়া বেগম খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলতে লাগলেন,
“ আমার রোদ পেরেছে জবা! অপারেশন সাকসেসফুল।”
জুবাইদা বেগমের ছলছল চোখজোড়া এবার আর বাঁধ মানলো না যেন।তার চোখ ফেঁটে বেরিয়ে এলো অশ্রুধারা। তিনিও তৎক্ষনাৎ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন রাফিয়া বেগমকে।কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“ আলহামদুলিল্লাহ!”

কবির সাহেবকে আইসিইউ তে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। আগামী ৪৮ ঘন্টা খুব ক্রিটিকাল তার জন্য। এরইমধ্যে যদি জ্ঞান না ফিরে তাহলে বেঁচে থাকা খুব মুশকিল হয়ে পড়বে মানুষটার জন্য। রেহান রৌদ্রের কেবিনে আসে।এসেই তার চোখ পড়ে, কেবিনের একপাশের সোফায় মাথা এলিয়ে বসা থাকা রৌদ্রের দিকে।রেহান ধীর পায়ে এসে বসলো রৌদ্রের পাশে।রৌদ্র রেহানের উপস্থিতি টের পেলো কি-না কে জানে! ছেলেটা এখনো আগের ন্যায় মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।তার একহাত নিজের উরুর ওপর, অন্যহাত সোফার হাতলের ওপর রাখা।রেহান এবার নিজ থেকেই খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে। রৌদ্রকে ওমন নির্বিকার ভাবে বসে থাকতে দেখে বলে ওঠে,

“ ভাই তুই ঠিক আছিস?”
রৌদ্র হয়তো ঢোক গিললো একটা।ঐ যে, তার এডামস এপেলটা হুট করেই কেমন ওপর থেকে নিচ বরাবর নেমে আসলো।কিয়তক্ষন বাদেই রৌদ্র নিজের ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ আমার আর কি হবে বলতো? আর কি’বা বাকি আছে হওয়ার মতো?”
এহেন কথায় রেহান আহত চোখে তাকালো রৌদ্রের দিকে। ছেলেটা কি এখনো ঐ বিষয় গুলো নিয়ে ভাবছে? এখনোও কষ্ট পুষে রেখেছে মনে? রেহান নিজের এহেন ভাবনাগুলোর সমাপ্তি ঘটিয়ে বলে ওঠে,
“ রোদ! কি নিয়ে টেন্সড তুই?”
রৌদ্র এবার চোখ মেলে। ঘাড় বাকিয়ে তাকায় পাশে বসা রেহানের দিকে। রেহান তৎক্ষনাৎ খানিকটা ভড়কে যায় রৌদ্রের দৃষ্টি দেখে। হঠাৎ ছেলেটার চোখদুটো এমন লাল হয়ে গেলো কেনো? চোখেমুখে ফুটে উঠেছে একপ্রকার বিষাদের ছাপ! রেহান অস্থির হয়ে বলতে লাগলো,

“ কি হয়েছে তোর? আমায় খুলে বল সবটা।এক্ষুণি বলবি।”
রৌদ্র ব্যাথাতুর হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে। ছেলেটা আবারও সোফায় মাথা এলিয়ে বসলো।তারপর নিজের শুষ্ক অধরজোড়া জিভ দিয়ে খানিকটা ভিজিয়ে নিয়ে বলতে লাগলো,
“ আব্বু সুস্থ হয়ে যাবে তো রেহান? আমি.. আব্বুকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবো তো? ছেলে হিসেবে এবারেও কি ব্যর্থ হয়ে যাবো আমি?”
রেহান ভ্রু কুঁচকায়।সন্দিহান গলায় বলে ওঠে,
“ মানে?”
রৌদ্র আবারও আহত হাসলো।ঠোঁট গোল করে খানিকটা নিশ্বাস ফেলে মোটা হয়ে আসা কন্ঠে বললো,

“ এক ভালোবাসার পরিনতি হিসেবে নিজের সবগুলো প্রিয় মানুষকে হারাতে বসেছি আমি রেহান! এই দেখ না…আজ আমার জন্যই আব্বুর কি হাল হয়েছে।আমি এখনো শতভাগ নিশ্চিত নই…আব্বু ফিরবে কি-না। আমি….আমি এখনো আমার মা’কে দৃঢ় কন্ঠে বলতে পারছিনা — কখন আব্বুর জ্ঞান ফিরবে।বিশ্বাস কর রেহান, আজ যদি আব্বুর কিছু হয়ে যায় — তাহলে নিজেকে কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারবোনা।”
রেহান ফোঁস করে এক ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেললো।রৌদ্রের কাঁধ চেপে খানিকটা আশ্বাস দেওয়া কন্ঠে বললো,
“ আল্লাহ কে ডাক ভাই! ইনশাআল্লাহ আব্বুর ঠিক জ্ঞান ফিরবে। তুই দেখে নিস!”
রৌদ্র মাথা নাড়ায়। খানিকটা নাক টেনে ওভাবেই পড়ে রইলো নিজের মতো করে। ছেলেটার মনের মধ্যে চলতে থাকা ঝড়টা যে এত সহজে থামবার পাত্র নয়। কে জানে… পরবর্তীতে আবারও কোন পরিক্ষার সম্মুখীন হতে হয় তাকে!

গভীর রাত।সময় বোধহয় সাড়ে তিনটে। হসপিটালের চারিদিকে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে একপ্রকার। রেহান, তাশরিক সাহেব শুয়ে আছেন অন্য একটি কেবিনে।আর রৌদ্র? সে বসে আছে বাবার আইসিইউ তে। দু’জন নার্স দুয়েকবার তাকে বলে গিয়েছে, কেবিনে গিয়ে খানিকটা রেস্ট নিতে কিন্তু কে শোনে কার কথা! ছেলেটা সেই কখন থেকে একই ভঙ্গিমায় বাবার বেডের পাশের টুলটায় বসে আছে। তার ঘোলাটে দৃষ্টি বাবার নিস্তব্ধ মুখটার ওপর নিবদ্ধ। রৌদ্র খানিকটা নাক টানে এবার।সে টুল ছেড়ে উঠে গিয়ে বাবার পা ঘেঁষে ফ্লোরের ওপর বসে।তারপর বাবার পাদু’টো নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে থাকে। এ নিশ্বাস যে সাধারণ কোনো নিশ্বাস নয়, এ নিশ্বাসের প্রতিটি আসা-যাওয়ায় স্পষ্ট বোধগম্য হচ্ছে ছেলেটার বুকের কষ্টগুলো। রৌদ্র খানিকক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎই কান্না শুরু করে। যে-ই কান্নায় নেই কোনো শব্দ! আছে শুধু ব্যাথার নিঃশব্দ উপস্থিতি! রৌদ্র বাবার পায়ের ওপর মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিচু কন্ঠে বললো,

“ আমি কেনো ওকেই ভালোবাসতে গেলাম আব্বু? কেনো আমার অবচেতন মন ওর জন্যই দূর্বল হয়ে পড়লো? ওকে এতোটা ভালোবাসার আগে আমি মরে গেলাম না কেনো? ওকে ভুলে থাকার মতো অভিশাপ আমার কপালেই কেনো আসলো আব্বু? কেনো আমার এই দূর্ভাগ্য হলো, যেখানে তোমার আর ওর মাঝে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে? আমি কেনো এতোটা দূর্ভাগা হলাম আব্বু? কেনো হলাম?”
নিরবতায় ছেয়ে থাকা কেবিনটিতে রৌদ্রের এহেন বিলাপ কি আর কারো কান অব্ধি গেলো? নাহ গেলো না-তো! রৌদ্র ধীরে ধীরে নিজেকে সামলানোর প্রয়াস চালায়।ইশশ্! কাদঁতে কাদঁতে ছেলেটার চোখেমুখের যাচ্ছে তা-ই অবস্থা! রৌদ্র নাক টেনে কেমন অবুঝের মতো বলতে লাগলো,

“ আব্বু! ও আব্বু! পৃথিবীতে না-কি সেসব মানুষই সবচেয়ে বড় হতভাগ্য যারা কি-না নিজেদের ভালোবাসাকে পেয়েও হারায়! আব্বু! জানো? আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি, পৃথিবীর সেই সকল হতভাগ্যদের তালিকায় শেষপর্যন্ত আমার নামটাও থাকবে! ও যদি আমার ভাগ্যে না-ই থাকতো,তাহলে ওর সঙ্গে এতো ভয়ংকর রকমের ভালোবাসা হলো কেনো আমার? কি করে এই অনুভুতির যন্ত্রণা ভুলবো আমি? ভাগ্যে না থাকলে মনের ওপর কেনো বসতি গড়তে এলো ও? আমি… আমি এখন কি করবো আব্বু? কি করলে তোমরা সবাই ভালো থাকবে?”
কথাগুলো বলে খানিকটা দম নিলো রৌদ্র। পরক্ষণেই ছেলেটা কেমন ভেজা চোখে ব্যাথাতুর হাসি দিয়ে বলতে লাগলো,

“ এমন যদি হতো, আমি মরে গেলে যদি সবটা ঠিকঠাক হয়ে যেতো তাহলে বিশ্বাস করো আব্বু! আমি রৌদ্র অনেক আগেই মরে যেতাম! কিন্তু…. এটা যে আমার দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। একটুও পারছিনা এতোটা সাহসী হতে।কেনো পারছি না জানো? কারণ… আমি চাই আমার শেষ নিশ্বাস অব্ধি তোমাদের সঙ্গে বাঁচতে, আমার সানশাইনের কোলে মাথা রেখে মরতে। এই লোভেই এখনো মরতে পারছিনা আমি! এদিকটায় আমি এতোটা লোভী হলাম কেনো আব্বু? কেনো আমার ভেতরে এতোটা লোভ এলো?”
কথাটা শেষ করে রৌদ্র বাবার পায়ের ওপর নিজের গাল ঠেকায়।তারপর নিজের সিক্ত চোখদুটো বাবার দিকে তাক করে হালকা হেসে বলতে লাগলো,
“ আশা করি আমার পরবর্তী সিদ্ধান্তে তুমি এবং আমার সানশাইন… দু’জনেই ভালো থাকবে আব্বু! ভিষণ ভালো থাকবে।”

সকালের আলো ফুটেছে বেশ আগে।এরইমধ্যে আইসিইউ তে এসে ঢুকলেন দু’জন নার্স। আর মুহুর্তেই তারা চমকে ওঠলেন ভেতরকার পরিবেশ দেখে।রাতের ডিউটিরত নার্স শুয়ে আছেন সোফার ওপর। শুয়ে আছেন বলতে আবার কি? তিনি তো রীতিমতো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন।আর রৌদ্র? সে পেশেন্টের ড্রেন ফ্লুইড চেক দিচ্ছে, ইউরিনের পরিমাণ হিসাব করছে। কিয়তক্ষন বাদেই নার্সদের মধ্যে একজন এগিয়ে আসেন দ্রুত কদমে। অন্যজন ছুটে যান ঘুমন্ত নার্সের দিকে। তিনি ঘুমন্ত নার্সকে প্রায় ঠেলেঠুলে ডাকতে লাগলেন,
“ এই সিথি আপু।এই সিথি আপু…উঠুন! আপনি রোগীর খেয়াল রাখা বাদ দিয়ে ঘুমাচ্ছেন?”

ঘুমের মাঝে হঠাৎ এমন হাঁক- ডাকে একপ্রকার হকচকিয়ে ঘুম ছেড়ে উঠে বসে নার্স সিথি।আশেপাশের পরিস্থিতি বুঝতেই মিনিট খানেক লেগে যায় তার। পরক্ষণেই নিজের কৃতকর্মের কথা মনে পড়তেই একপ্রকার লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু রেখে দাঁড়ায় সে।এমনিতেই সারারাত ড.রৌদ্রই কেবিনে থেকে পেশেন্টের দেখভাল করেছে।সে-তো এসেছে ভোরের দিকে। সেই ভোরে এসেই কখন যে এভাবে শুয়ে পড়লো টেরই পেলো না মেয়েটা!সিথি এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেলে।তার পাশে দাঁড়ানো নার্সটি তাকে কনুই দিয়ে হালকা গুঁতো দিয়ে ফিসফিস করে বলে—
“ কি করলে আপি? স্যার তো এক্ষুণি ক্লাস নেওয়া শুরু করে দিবে!”

এহেন কথায় ভয়ে ভয়ে বার-দুয়েক শুষ্ক ঢোক গিললো সিথি।পরক্ষণেই রৌদ্রের দিকে তাকাতেই দেখতে পায়, রৌদ্র ব্যস্ত হাতে পেশেন্টকে ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড এবং ঔষধ দিয়ে যাচ্ছে। যেটা কি-না তাদের দায়িত্ব।নার্স সিথি তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসেন রৌদ্রের নিকট। তিনি কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলতে লাগলেন,
“ স্যার আপনি আমায় দিন! আমি করে দিচ্ছি!”
কথাটা বলতে দেরি,তার দিকে আগুন চোখে তাকাতে দেরি নেই রৌদ্রের।ভাব এমন — এই আগুন চোখেই বুঝি সে ঝলসে দিবে এই নার্সকে! নার্স ভড়কে যায় রৌদ্রের এমন দৃষ্টি দেখে। সে খানিকটা ঢোক গিলতেই তার কানে আসে রৌদ্রের কাঠকাঠ কন্ঠ!

“ আউট”
নার্স হকচকিয়ে ওঠে আবারও। সে তৎক্ষনাৎ মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।হাতে হাত রেখে কচলাতে থাকে অস্থিরতায়।মুহুর্ত বাদে রৌদ্র আবারও বললো,
“ আই সেইড,গেট আউট!”
এবার বুঝি টনক নড়লো নার্সের। সে তড়িৎ রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।না জানি এখানে আরেকটু থাকলে এই ড. আর কি কি বলে বসে তাকে। সিথি বেরোতেই বাকি দুজন নার্স জড়সড় হয়ে নিজেদের কাজে মনোযোগ টানে।রৌদ্রও তাদের সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে পেশেন্টের সবকিছু চেক করে যাচ্ছে।

সময় ছুটে যাচ্ছে তার আপন গতিতে।দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে ৪৫ ঘন্টা। এই সময়টুকুর মাঝে রৌদ্র খুব একটা জরুরি না হলে হসপিটাল থেকে সরেনি একটুর জন্যও।এর মধ্যে বাসায় গিয়েছিলো শুধু একবার। তাও শুধু গোসলটা সেড়ে আবারও ছুটে এসেছে হসপিটালে।তাছাড়া এহসান বাড়ির সকলে একবার -দু’বার এসে দূর থেকেই দেখে গিয়েছেন অচেতন কবির সাহেবকে।সাব্বির সাহেব আজ বেশ কিছুক্ষণ হসপিটালে ছিলেন। এইতো, মিনিট দশেক হবে তিনি চলে গিয়েছেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।কেননা এই মানুষটাও তো বেশ দূর্বল। জ্বরটা বোধহয় নেমেছে একটুখানি।আর ওমনি ছুটে এসেছেন ভাইকে দেখতে।এভাবে হসপিটালে-বাড়িতে দৌড়াতে থাকলে তিনিও যে অচিরেই বিছানা ধরবে সে খবর কি আর আছে তার?

রৌদ্র নিজের রাউন্ড সেরে আবারও কবির সাহেবের কেবিনে আসে।দেখতে দেখতে সময়ও ফুরিয়ে আসছে অথচ মানুষটার জ্ঞান এখনো ফিরছে না।সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রৌদ্রের চিন্তা। সে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে বাবার কাছে। বেডের পাশের টুলটায় বসলো নিঃশব্দে। তারপর বাবার মুখপানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিয়তক্ষন। হুট করেই তার চোখ বেয়ে আবারও গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা নোনাজল। রৌদ্র সেগুলোকে মুছলো না।ঝড়তে দিলো আপনমনে। তাছাড়া কি লাভ তাদের মুছে? সেই-তো আবারও ঝড়ে পড়বে তারা।রৌদ্র এবার কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলতে থাকে,

“ আর কতো শাস্তি দিবে আব্বু? এবার নাহয় একটু উঠো।দরকার বকো।মারো,দরকার হয় বাড়ি থেকে বের করে দাও আব্বু! তবুও প্লিজ উঠো।আব্বু… আমার বুক কাঁপছে… বিশ্বাস করো আমি ভয় পাচ্ছি আব্বু।ও আব্বু! তুমি না আমায় বলেছিলে একবার… তুমি সবচেয়ে বেশি আমায় ভালোবাসো! তাহলে আজকে এতো ডাকার পরও উঠছো না কেনো আব্বু? আমি কি এতোটাই খারাপ হয়ে গিয়েছি তোমার কাছে আব্বু? আমায় কি একটু ক্ষমা করা যায় না? আব্বু…. তুমি যা বলবে আমি তাই করবো আব্বু।দয়া করে তুমি এবার উঠো।তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার মা-ও যে মরে যাবে আব্বু!…… ”
কথাগুলো আদৌও শুনলেন কি কবির সাহেব? নাহ! অচেতন মানুষ কি আর শোনে এসব? রৌদ্র মাথা নুইয়ে রেখে কাঁদছে নিঃশব্দে। কাঁদার প্রকোপে শরীরটা ক্ষনে ক্ষনে কাঁপছে তার। শ্যামবরণ মুখশ্রীটা হয়ে গেছে রক্তবর্ণ। রৌদ্র ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা রিপোর্টটা তুলে চেক করতে থাকে কিছু একটা। পরক্ষণেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় একজন নার্স। রৌদ্র তাকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে আইসিইউ থেকে।

“ তোর বাবার জ্ঞান ফিরেনি রোদ?”
কাঁপা কাঁপা দূর্বল কন্ঠে কোনমতে ফোনে কথাটা বললেন জুবাইদা বেগম। রৌদ্র মায়ের কথার প্রতিত্তোরে মৌন রইলো কিছুক্ষণ। হয়তো মনে মনে কথা গোছাচ্ছে ছেলেটা। রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে যেই-না কিছু বলতে যাবে ওমনি একজন নার্স একপ্রকার ছুটে আসে তার কেবিনে।রৌদ্র হকচকিয়ে ওঠে নার্সের ওমন ছুটে আসা দেখে।সে কানে ফোন রেখেই অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করে বসে,
“ হোয়াট হেপেন্ড?”
নার্স হাঁপাচ্ছে। আর এদিকে রৌদ্র হচ্ছে বিরক্ত! সে দাঁতে দাঁত চেপে আবারও জিজ্ঞেস করে,
“ কথা তো বলবেন?”
নার্স এবার বহুকষ্টে মুখ খুলেন।তিনি থেমে থেমে বলে ওঠেন,
“ স্যার! আপনার বাবার জ্ঞান ফিরেছে! ”
ব্যস! এটুকু কথাই বুঝি শুনলো রৌদ্র। এরপরই সে কান থেকে ফোনটা ফেলে তড়িৎ গতিতে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে।

রৌদ্র ছুটে আসে আইসিইউ তে। আইসিইউ তে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন আরও দুজন ডক্টর। তারা রৌদ্রকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে সাইডে সরে দাঁড়ালেন।রৌদ্র কাঁপা কাঁপা বদনে বাবার দিকে এগিয়ে আসে। কবির সাহেব চোখদুটো বন্ধ করে রেখেছেন। চোখের পাতা নড়ছে সামান্য। রৌদ্র ধীরে ধীরে বাবার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ায়।আলতো করে থেমে থেমে ডাকে,
“ আব্বু?”
কবির সাহেবের চোখের পাতায় আবারও নড়নচড়ন দেখা দিলো। রৌদ্র ভেজা চোখে হাসলো খানিকটা। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও ডাক দিলো বাবাকে,
“ আব্বু? শুনতে পাচ্ছো আমায়?”

কবির সাহেব ধীরে ধীরে মাথা কাত করে পাশে তাকালেন। তারপর চোখ মেলে খানিকটা ভ্রু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালেন। খানিকটা গম্ভীর কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“ হ্যা শুনতে পাচ্ছি আমি! এতে ওতো ডাকাডাকির কি আছে?”
কবির সাহেবের এহেন বাক্যে আইসিইউ তে উপস্থিত সকলেই একযোগে হেসে ওঠলেন।রৌদ্র হাসলো নিঃশব্দে। চোখ দিয়ে তার এখনো গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। সে অশ্রু বুঝি খুশির অশ্রু! কিয়তক্ষন বাদে সহকারী সার্জন এবং ড.আহমেদ সহাস্য মুখে বলে ওঠেন,
“ ওয়েল ডান ড.রৌদ্র! আপনি করে দেখালেন তবে।আমরা গিয়ে প্রেসিডেন্টকে এক্ষুনি খুশির খবরটা দিয়ে আসি তাহলে। বায়!”
বলেই তারা বিদায় নিলেন আইসিইউ থেকে।তাদের বের হওয়া মাত্রই রৌদ্র অস্থির হয়ে বলতে লাগলো,
“ আব্বু? তুমি কি ঠিক মতো দেখতে পাচ্ছো সব? কোথাও কি ব্যাথা লাগছে তোমার? কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে না তো? আমায়…”

বাকিটা আর বলতে পারলোনা রৌদ্র। তার আগেই কবির সাহেব থেমে থেমে বলতে লাগলেন,
“ শান্তিতে তো মরতেও দিচ্ছো না আমায়।যতবার যাচ্ছি, ততবারই বুঝি টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসছো আবার।কি শুরু করলে তুমি? আমার তো বয়স হয়েছে না-কি? এবার নাহয় যেতে দিতে পারতে!”
এহেন কথায় রৌদ্র আবারও ভেজা চোখে হাসলো। এবার সে হাসিতে শব্দ হলো কিছুটা।রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে বাবার দিকে তাকায়।কবির সাহেব এখনো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে।মুখে কেমন কপট ভাব একে রেখেছেন তিনি।রৌদ্র এবার নিচু কন্ঠে বললো,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৪

“ বলেছিলাম না? আমার সব আয়ু তোমার হোক! আমার আয়ু কি এতো কম না-কি, যে তোমায় চলে যেতে দিবো এতো তারাতাড়ি? তাছাড়া আমার তো এখনো বিয়েই হয়নি! আগে আমার বিয়েটা হোক,তারপর ১০/১২ টা বাচ্চা হলে তাদের সঙ্গে তো তোমাকেই খেলতে হবে তাই না? এতকিছু না করে কিভাবে তোমায় যেতে দেই বলো তো?”
কবির সাহেব ছেলের এহেন লাগামহীন কথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলেন সঙ্গে সঙ্গে। মুখ কুঁচকে বলেই বসেন,
“ বেয়াদব ছেলে!”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here