সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৬
Jannatul Firdaus Mithila
“ তোমার চোখেমুখের এ অবস্থা কেনো? ঠিকঠাক ঘুমাওনি না-কি?”
বাবার মুখে এমন কথা শুনে আলতো হাসলো রৌদ্র।ছেলেটা সটান হয়ে দাঁড়িয়ে, আলগোছে চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিলো ডানহাতে।এরপর আঙুল দিয়ে চোখদুটোর কার্নিশ চেপে ধরলো হালকাভাবে।এদিকে, কবির সাহেব এখনো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন ছেলের পানে।তিনি হয়তো অপেক্ষা করছেন নিজের কাঙ্ক্ষিত উত্তর পাওয়ার আশায়!রৌদ্র খানিকটা সময় নিয়ে ধীমী স্বরে বললো,
“ তুমি উঠে গিয়েছো না? তাই.. এবার ঘুমাবো! ভিষণ আরামে ঘুমাবো।”
কবির সাহেব বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের মলিন মুখটার দিকে। ছেলেটার চোখেমুখে যেন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ক্লান্তির ছাপ।কবির সাহেব খানিকটা গম্ভীর হয়ে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই বাঁধ সাধলো রৌদ্র। তড়িঘড়ি করে বললো,
“ হুঁশ! আর কথা বলো না। এই মুহুর্তে নিজেকে রেস্টে রাখো।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অগত্যা এমন কথায় চুপ করে গেলেন কবির সাহেব।এমনিতেও মানুষটার নিজেরও খানিকটা কষ্ট হচ্ছিলো কথাগুলো বলতে।তাই তিনি আর তেমন হম্বিতম্বি না করে, আলতো করে নিজের চোখদুটো বুঁজে নিলেন। রৌদ্র বাবার চুপ হয়ে যাওয়া দেখে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো খানিকটা। অতঃপর বাবার ভাইটাল সাইনস (বিপি,পালস রেট,অক্সিজেন) সবটা বেশ মনোযোগ দিয়ে পরোখ করতে লাগলো। ঠিক এমন সময় আইসিইউ তে ঢুকলো একজন ছেলে নার্স। রৌদ্র একবার আড়চোখে তাকালো তার দিকে।পরক্ষণেই নার্সকে হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডাকে।নার্সও বাধ্যদের ন্যায় মাথা নিচু করে রৌদ্রের থেকে দু’হাত দূরে এসে দাঁড়ালো। রৌদ্র তখন গম্ভীর কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ আমি এখন অফ ডিউটিতে যাচ্ছি!আমার অবর্তমানে আব্বুর….. সরি,আই মিন পেশেন্টের দিকে কড়া পর্যবেক্ষণ রাখবেন। খেয়াল রাখবেন, পেশেন্ট যেন যথাসম্ভব কম কথা বলে। আইভি ফ্লুইড যেমনটা চলছে,তেমনটাই চলতে থাকুক। আর হ্যা…ওনার সাপোর্টিভ কেয়ারে যেন বিন্দুমাত্র ত্রুটি না থাকে। গট ইট?”
নার্স বাধ্যদের ন্যায় মাথা নাড়ায়।যদিও সে মনে মনে খানিকটা অবাক হয়েছে রৌদ্রের এরুপ কথা শুনে। কেননা রৌদ্রের বলা সকল কথাগুলো নার্স হিসেবে আগে থেকেই জানা তার। তবুও ডাক্তার রৌদ্র কেনো এভাবে তাকে কথাগুলো বললো এটাই হয়তো বোধগম্য হচ্ছে না বেচারার!কিছুক্ষণ নিজের এহেন ভাবনাচিন্তায় বিভোর থেকে অবশেষে নার্স নিজের কাজে লেগে পড়লো।রৌদ্র একবার বাবার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকালো।পরক্ষণেই আর কিছু না বলে চলে গেলো রুম ছেড়ে।
প্রায় মিনিট চল্লিশেক পর রৌদ্রের গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। রৌদ্র গাড়ি থেকে বেরোতেই দেখতে পায় — বাড়ির সামনে আরও একটি অপরিচিত গাড়ি দাঁড় করানো। রৌদ্র গাড়িটির দিকে বাঁকা চোখে তাকালো।কিয়তক্ষন কিছু একটা ভেবেচিন্তে অবশেষে বাড়িতে ঢুকলো। আর ওমনি কেও একজন হুট করে হাজির হলো তার সামনে। রৌদ্র থমকায়।ভ্রু কুঁচকে তাকায় সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটির পানে। দেখতে পায় — তার বড় মামি সহাস্য মুখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রৌদ্র খানিকটা অবাক হয়ে কিছু বলতেই যাবে,তার আগেই রৌদ্রের বড় মামি কেয়া হামিদ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে ওঠে,
“ কেমন আছিস রোদ? কতগুলো দিন বাদে দেখতে পেলাম তোকে।ইউ কে থেকে ফিরে তো ভুলেই গিয়েছিস আমাদের! একটিবারও যেচে পড়ে খোঁজ নিলি না, ভাবা যায়?”
রৌদ্র স্মিত হাসলো। কোনরূপ ভনিতা ছাড়াই গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলো —
“ কে বললো খোঁজ নেই নি মামনী? মামার সঙ্গে তো সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও যোগাযোগ হয়েছে আমার!তার কাছ থেকেই বরাবরের মতো খোঁজ খবর নিয়েছি তোমাদের।”
কেয়া বেগম খানিকটা হাসলেন বোধহয়। তিনি হাসিমুখে রৌদ্রের একহাত টেনে, তাকে সোফায় বসালেন এমনকি নিজেও তার পাশে বসলেন। পরক্ষণেই তিনি মুখ ফুটে কিছু একটা বলতে যাবেন তার আগেই ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হলেন রৌদ্রের বড় মামা হামিদুর রহমান। তিনি এসেই বলতে লাগলেন,
“ জানিস রোদ? আমি কিন্তু তোর মামনীকে প্রতিবার জানিয়েছি — তোর খোঁজ নেওয়ার ব্যাপারটা! তবুও দেখ, এখন এমন একটা ভাব করছে না…. যেন আমি তাকে কোনোদিন বলিইনি এ-ব্যাপারে!”
স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে তৎক্ষনাৎ মুখ ভেংচি কাটেন কেয়া বেগম। খানিকটা মুখ ঝামটি দিয়ে বলে ওঠেন,
“ হয়েছে থাক,আর বলতে হবে না। এই রোদ, ভাই সাহেবের এখন কি অবস্থা? শুনেছি জ্ঞান ফিরেছে!”
রৌদ্র আলতো করে মাথা নাড়লো।হাতের বাহুতে পড়ে থাকা এপ্রনটা খানিক নাড়িয়ে আবারও বললো,
“ হুম আলহামদুলিল্লাহ!এখন তারাতাড়ি সুস্থ হওয়ার পালা।”
কেয়া বেগম ফোঁস করে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।তখনি জুবাইদা বেগম ধীর পায়ে এসে দাঁড়ালেন ড্রয়িং রুমে।যদিও তার রুম থেকে ড্রয়িং এর দুরত্ব খুব একটা বেশি নয় তবুও এইটুকুন পথ আসতেই যেন হাঁপিয়ে উঠেছে মানুষটা।দূর্বল শরীরটা নিয়ে দাড়াঁতেই খানিক টলতে লাগলেন তিনি। রৌদ্র মায়ের এহেন অবস্থা দেখে তৎক্ষনাৎ বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। চটজলদি মায়ের কাছে এসে, মা’কে আগলে নেয় নিজের সঙ্গে। জুবাইদা বেগম হালকা হেসে ছেলের বাহু চেপে ধরলেন।তারপর ছেলের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে সোফায় গিয়ে বসলেন। ওদিকে, কেয়া বেগম ও হামিদুর রহমান রৌদ্রের এমন দায়িত্বশীলতা দেখে বেশ মুগ্ধ হলেন।তাছাড়া এ মুহুর্তে কেয়া বেগমের চোখদুটো কেন যেন শুধুই মুগ্ধতায় নয় বরং এক অন্যরকম খুশিতে চকচক করছে!হয়তো রৌদ্রের মতো ছেলেকে নিজের জামাতা হিসেবে কল্পনা করতেই এই খুশি তার! এমনিতেও তিনি মনে মনে বহু আগে থেকে রৌদ্রকে নিজের মেয়ের জামাই হিসেবে কল্পনা করে এসেছেন । সময়-সুযোগের অভাবে হয়তো এতোদিন বলতে পারেননি ব্যাপারটা! কিন্তু গত কয়েকদিন আগেই কবির সাহেবের ওমন অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা শুনে নিজেদের আর আঁটকে রাখতে পারলেননা হামিদ পরিবার।এইতো গতকালের ফ্লাইটেই ঢাকায় এসে পৌছেছেন তারা।
অন্যদিকে, রৌদ্র তার মা’কে সোফায় বসিয়ে, মাথাটায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।জুবাইদা বেগম মাথা নুইয়ে রেখেছেন।রৌদ্র এবার মায়ের নতমুখটা নিজের দু’হাতের তালুতে নিয়ে খানিকটা উঁচিয়ে তুলে। নরম কন্ঠে বলে,
“ এভাবে ভেঙে পড়লে কিভাবে হবে আম্মু? আর ক’দিন পর আব্বু যখন সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরবে,তখন যদি তোমায় এভাবে অসুস্থ দেখে তাহলে কি আর তার ভালো লাগবে? এটলিস্ট এটুকুর জন্য হলেও নিজেকে সুস্থ রাখার ট্রায় করো!”
জুবাইদা বেগম কি বুঝলেন কে জানে!তিনি ছেলের কথায় ফিক করে হেসে ওঠেন।গালের ওপর ছেলের হাতদুটোকে আলতো করে মুখের সামনে এনে ঠোটঁ ছুঁইয়ে দিয়ে বললেন,
“ ছেলে আমার বড় হয়ে গেছে গো…মা’কে কেমন বড়দের মতো বোঝাতে শিখে গেছে!”
রৌদ্র হাসলো গাল ভরে। মায়ের কপালে আলতো করে ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে বলে ওঠে,
“ ছেলেমেয়ে বড় হলে বাবা-মা হয়ে যায় বাচ্চা!এই যেমন তোমরা হচ্ছো!”
অনিক নিজের রুমে ছিলো এতক্ষণ।ইকরাকে সে-ই দুদিন ধরে কলে ট্রায় করে যাচ্ছে, কিন্তু মেয়েটা যেন গাল ফুলিয়ে রেখেছে তার সঙ্গে।কিছুতেই কল রিসিভ করছেনা! এ নিয়ে ছেলেটার ভারি মন খারাপ। অনিক মুখে আধার নামিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোয়। তখনি তার সামনে এসে হাজির হয় শিশির! মেয়েটা বোধহয় এদিক দিয়েই সিঁড়ি বেয়ে নামতে যাচ্ছিলো,কিন্তু হুট করে অনিক সামনে পড়ায় থেমে যায় তার পদযুগল। শিশির মুখে খানিকটা সৌজন্যের হাসি টেনে বলতে লাগলো,
“ কেমন আছিস অনিক?”
অনিকের বিগড়ে থাকা মেজাজটা যেন আরেকধাপ বিগড়ে গেলো শিশিরকে দেখে।এই মেয়েটা এসেছে পর থেকেই অনিক নিজেকে ঘরবন্দী করেছে।আর করবে না-ই বা কেন? ওর জন্য কি আর কম ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল তার এবং রৌদ্রের মাঝে? তাছাড়া শিশির এসেছে পর থেকেই সারা বাড়ি ধেই ধেই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই মেয়ের হাবভাবে বোঝবার জো নেই, এ সত্যিই কারও অসুস্থতার খবর শুনে এসেছে কি-না! অনিক নাক ফুলিয়ে শ্বাস টানলো খানিকটা। শিশির তখন আবারও জিজ্ঞেস করে বসে,
“ কিরে? কি বললাম শুনতে পাসনি? কি ভাবছিস এতো?”
অনিক ভ্রুদ্বয় কুঁচকে ফেলে এহেন কথা শুনে। সে মুখের আদলে খানিকটা বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বলে ওঠে,
“ হুম ভালো আছি!”
ব্যস এটুকুই বললো ছেলেটা।এরপরই শিশিরকে একপ্রকার উপেক্ষা করে সরে গেলো সেখান থেকে। এদিকে শিশির হতবিহ্বল হয়ে গেলো অনিকের কর্মকাণ্ডে।ছেলেটা কি দিনকে দিন ম্যানার্স ভুলে যাচ্ছে না-কি? কই সে নিজে থেকে খোঁজ খবর নিবে তার,তা না করে উল্টো পিঠ দেখিয়ে চলে গেলো? শিশির খানিকটা অপমানিত বোধ করলো।সে তড়িঘড়ি করে অনিকের রুমের সামনে থেকে সরে গিয়ে সিঁড়িতে পা রাখলো নামার উদ্দেশ্যে।তখনি রৌদ্র এসে দাঁড়ালো সিঁড়ির শেষ প্রান্তে। ছেলেটা বুঝি দোতলার দিকেই আসছে।শিশির রৌদ্রকে দেখা মাত্রই থমকে দাঁড়ালো। মুখে খানিকটা হাসি ঝুলিয়ে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। রৌদ্র মেয়েটার দিকে একটিবারের জন্যও ফিরে তাকালো না। ছেলেটার ভাব এমন — এ মুহুর্তে তার সামনে বুঝি কেউ-ই নেই! শিশির খানিকটা আহত হলো রৌদ্রের এমন ভাবভঙ্গিতে।তবুও সে নিজের মনটাকে শক্ত রেখে এক সিঁড়ি নিচে এসে দাঁড়ালো। রৌদ্র যখন তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলো তখনি শিশির বলে ওঠে,
“ রোদ! কেমন আছিস?”
রৌদ্র থামলো না। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই কোনরকম ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে জবাব দিলো —
“ দেখতেই পাচ্ছিস!”
রৌদ্রের এমন কথায় আহত চোখে তাকায় শিশির।ছেলেটার চলে যাওয়া দেখে সে এবার তাকে পিছুডেকে বলে ওঠে,
“ রোদ! আমি তোর সাথে কিছু কথা বলতে চাই!”
রৌদ্রের পদযুগল এ পর্যায়ে থামলো।ছেলেটা ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলে ওঠে,
“ তোর আবার কিসের কথা আমার সাথে? শুনে রাখ মেয়ে, তোর সঙ্গে কথা বলতে মোটেও ইন্টারেস্টেড নই আমি।সো নেক্সট টাইম আর এসব বলতে আসবিনা,খবরদার!”
কথাটা বলেই রৌদ্র গটগট পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো।এদিকে, তার চলে যাওয়ার পথে আহত চোখে তাকিয়ে রইলো শিশির। হয়তো সে ভাবছে —তাদের এতোগুলো বছরের বন্ধুত্বও কি ফিকে হয়ে গেলো রৌদ্রের কাছে? একতরফা ভালোবেসেছে বলেই কি এতোটা অবহেলা তার প্রতি?
রৌদ্র বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের রুমের দিকে। এসেছে পর থেকেই একটার পর একটা বিরক্তিকর কান্ড হয়েই যাচ্ছে তার সঙ্গে। এ মুহুর্তে ছেলেটা যেন একেবারেই তিতিবিরক্ত! রৌদ্র শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় অরিন বের হয় রুম থেকে। রৌদ্র একমুহুর্ত থামলো মেয়েটাকে দেখে।এতক্ষণে যেন তার সকল ক্লান্তির অবসান ঘটলো। ছেলেটার কুঁচকে রাখা ভ্রু-দ্বয় কেমন শিথিল হয়ে এলো আপনা-আপনি। রৌদ্র অনিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। অরিন খানিকটা নড়েচড়ে দাঁড়ালো।মেয়েটার আবার ইদানিং কি হয়েছে কে জানে! সে কেন যেন রৌদ্রের চোখে চোখ রাখতে পারছেনা। ভাব এমন —তার চোখে চোখ রাখলে বুঝি তার সকল মনের কথাগুলো এক নিমিষেই পড়ে ফেলবে রৌদ্র! যদিও অরিনের এমনসব ভাবনাগুলো মোটেও অহেতুক না! রৌদ্র যে সত্যিই মেয়েটার চোখের দিকে তাকালে তার মনের কথাগুলো পড়ে ফেলার সক্ষমতা রাখে! অরিন কিছুক্ষণ দোনোমোনো করলো নিজের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। কি একটা অবস্থা! মেয়েটা না পারছে রৌদ্রের সামনে থেকে সরতে,আর না পারছে রৌদ্রকে উপেক্ষা করে যেতে।মেয়েটার পাদু’টো ফ্লোরের সঙ্গে কেমন যেন আঁটকে গিয়েছে বোধহয়। এ মুহুর্তে অরিনের মনে হচ্ছে — তার পাদু’টো যেন তারই শত্রু! ভাবা যায়, কেমন হুট করেই বেইমানি করে বসলো তার সঙ্গে…
অরিন যখন নিজের ভাবনায় নিমগ্ন তখনি রৌদ্র এগিয়ে আসে দু-কদম। মেয়েটার কাছ থেকে খানিকটা দুরত্বে দাঁড়িয়ে, তার হাতদুটো নিয়ে নেয় নিজের হাতের মুঠোয়। অরিন ভড়কে যায় এহেন কান্ডে। সে অবাক চোখে তাকায় রৌদ্রের দিকে। রৌদ্র মেয়েটার ওমন দৃষ্টিতে তেমন কোনো পাত্তা না দিয়েই নমনীয় কন্ঠে বলে ওঠে,
“ হাতের ব্যাথা কমেছে?”
অরিন মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মাথা নাড়ায়। মেয়েটার আবার কি হলো কে জানে, সে কেমন মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে। রৌদ্র তখন চমৎকার হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে। আলতো স্বরে ফের বলে,
“ খেয়েছিলি ঠিকমতো?”
অরিন এবারেও মাথা নাড়ায়। রৌদ্র এবার কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। ছেলেটার চোখেমুখে স্পষ্ট লেপ্টে আছে এক অগাধ তেষ্টার ছাপ! ভাব এমন — তার চোখদুটো বুঝি মেয়েটার মুখপানে তাকিয়ে থেকেই নিজেদের তেষ্টা নিবারনে ব্যস্ত! রৌদ্র তখন হঠাৎই কেমন অদ্ভুত শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
“ নিজের খেয়াল রাখতে শেখ জানবাচ্চা! সবসময় তো আর আমি থাকবো না তোর খেয়াল রাখার জন্য।এবার নাহয় নিজেকে সামলাতে শিখে নে!”
এহেন কথায় হুট করেই মুখের আদলে পরিবর্তন নামলো অরিনের। মেয়েটার মুখ থেকে যেন একমুহূর্তের জন্য রক্তই সরে গেলো। সে কেমন অস্থির হয়ে বলতে লাগলো,
“ মানে? আপনি থাকবেন না মানে কি? কোথায় যাবেন আপনি?”
রৌদ্র মেয়েটার এরূপ অস্থিরতা দেখে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। চোখেমুখে কপট ভাব নিয়ে বলতে লাগলো,
“ এতো আলগা পিরিতি দেখাতে হবে না তোর! আমি থাকলেই কি? আর না থাকলেই কি? তুই নিজের মতো থাক…. ভালো থাক।দেটস ইট!”
কথাটা বলেই রৌদ্র চলে গেলো অরিনের সামনে থেকে। অথচ বেচারি অরিন হতবাক হয়ে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। হয়তো মনে মনে রৌদ্রের ওমন প্রহেলিকায় মোড়ানো টুকরো টুকরো কথাগুলো বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছে সে।
দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরও পাঁচটি দিন।এরইমধ্যে বদলে গেছে এহসান পরিবারের অনেককিছু। এতদিন ধরে বাড়ির প্রতিটি মানুষের মাঝে যেই বিষাদ নামক শব্দটা ছিলো আজ যেন তা একেবারেই মুছে গিয়েছে সকলের মন থেকে। কেননা আজকেই কবির সাহেবকে বাড়িতে নিয়ে আসা হবে। এই কয়েকদিনের সর্বোচ্চ সেবায় কবির সাহেব এখন বেশ খানিকটা সুস্থ।আরকি হসপিটাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার মতো সুস্থ হয়েছেন! এখন থেকে তার যা ট্রিটমেন্ট হবার তা বাড়িতেই হবে।
সকাল ৭টা!
জুবাইদা বেগম আর রাইসা বেগম সে-ই ভোর থেকে রান্নাঘরে ব্যস্ত! আর বাকি দুজন, মাইমুনা বেগম ও রাফিয়া বেগম বাড়ির গোছগাছে হাত লাগাচ্ছেন।মেহরিন আর কেয়া বেগম মিলে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন। কেয়া বেগম সেদিন রৌদ্রের সঙ্গে দেখা করেই চলে গিয়েছিলেন নিজেদের বাসায়।এইতো কাল সন্ধ্যার দিকে আবারও এলেন কবির সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য।
অন্যদিকে,সাব্বির সাহেব সকাল সকাল গোসল সেরে একেবারে পরিপাটি হয়ে বসে আছেন। বড় ভাইকে আনতে যাবেন তিনি।শুধু তিনিই নন,তাশরিক সাহেব এবং তায়েফ সাহেবও যে তৈরি হচ্ছে যাবার জন্য! সাব্বির সাহেব গায়ে একখানা সফেদ রঙা পাতলা এমব্রয়ডারির পাঞ্জাবি জড়িয়েছেন।হাতে পড়েছেন গতবছর বড় ভাইয়ের দেওয়া ঘড়িটা। মানুষটা বেশ উৎফুল্লতার সাথে ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়ালো। তখনি তায়েফ সাহেব আর তাশরিক সাহেব কি নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি করে এদিকেই আসতে লাগলেন। সাব্বির সাহেব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“ কি ব্যাপার? কি নিয়ে এতো কথা কাটাকাটি হচ্ছে?”
তাশরিক সাহেব মেজো ভাইয়ের কথায় তার দিকে ছুটে এলেন।এরপর কেমন বাচ্চাদের মতো বিচার দেওয়ার সুরে বলতে লাগলেন,
“ দেখোনা ভাইজান! সেজো ভাইজানকে কতোবার করে বলছি একটু আতর মাখতে,এটা আমি কয়েকদিন আগেই সিঙ্গাপুর থেকে আনিয়েছি।কিন্তু সে বারবার বলেই যাচ্ছে — সে না-কি আতর লাগাবেই না! এটা কেমন কথা বলোতো?”
তাশরিক সাহেবের কথা শেষ হওয়া মাত্রই তায়েফ সাহেব এগিয়ে এলেন। মেজো ভাইজানের দিকে তাকিয়ে এবার তিনিও বলতে লাগলেন,
“ আচ্ছা ভাইজান বলোতো, ও কি এখনো বাচ্চা? ওরে একটা কথা না বললে ও আরও বেশি করে সেটা! কোত্থেকে কোন আজগুবি জিনিসপত্র এনে প্রতিবার আমার ওপর এক্সপেরিমেন্ট করে।এই যে গতমাসের কথাটাই ধরো না, ও না-কি ওর কোন বন্ধুকে দিয়ে কানাডা থেকে একটা পারফিউম আনিয়েছে,ও সেটা আমার কাছে নিয়ে এসে বললো — সেজো ভাইজান! একটা ভালো পারফিউম আনছি একটু মেখে দেখো তো ঘ্রাণটা কেমন!
আমিও ভোলাভালা মানুষ, ওর কথার ফাঁদে পড়ে মাখলাম গায়ে।ও আল্লাহ গো….এরপরের কথা আর কি বলবো ভাইজান! সেই পারফিউমের ঘ্রাণ এতোটাই স্ট্রং ছিলো যে আমি দুদিন যাবত মাথা ব্যাথায় ভুগেছি।দিনে তিনবার করে গোসল করেও গা থেকে গন্ধ সরাতে পারিনি! এইবার বুঝো! ও এখন আবারও আসছে নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতে…বলি হায়, তুই নিজের গায়েই মাখ না ভাই।কেন শুধু শুধু আমাকে অসুস্থ করবার পায়তারা খুঁজছিস?”
এমন কথায় সাব্বির সাহেব অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগলেন। তক্ষুনি তাশরিক সাহেব নাক-মুখ কুঁচকে তায়েফ সাহেবকে বলেই বসেন,
“ খালি আনস্মার্ট সাজার ধান্দা! বলি তোমার কি আর ওতো বেশি বয়স হয়ে গেছে না-কি হ্যা? কই এখন একটু স্মার্ট হয়ে চলাফেরা করবা তা না….ধূর! ধূর!”
এমন কথায় সাব্বির সাহেব বুঝি আর নিজেকে আঁটকে রাখতে পারলেননা। তিনি ফিক করে হেসে ফেলেন তৎক্ষনাৎ। তায়েফ সাহেব ছোট ভাইয়ের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে ওঠেন,
“ থাক ভাই! আমি আনস্মার্ট… দু’দিন পরে ছেলেমেয়ে বিয়ে করাবো, এই বয়সে এসে নতুন করে ওতো রং-ঢং করতে পারবোনা। তোরটা বরং তুইই কর!”
এই বলে লোকটা তৎক্ষনাৎ জায়গা ত্যাগ করলেন। তাশরিক সাহেবও খিলখিল করে হেসে ফেলেন ভাইয়ের কথায়। তিনিও দ্রুত কদমে পিছুপিছু গেলেন সেজো ভাইয়ের। অন্যদিকে,সাব্বির সাহেব এতোদিন পর ভাইগুলোর মুখে ওমন প্রানবন্ত হাসি দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।যাক.. অবশেষে আবারও এহসান বাড়িটা আগের মতো হলো তবে!
অনিক এসে বসেছে খাবার টেবিলে। বাড়ির বড়-ছোটরা বহু আগেই এসে বসেছেন সেথায়।শুধুমাত্র রৌদ্র বাদে। ছেলেটা বোধহয় এখনো তৈরি হচ্ছে। গতকাল রাতেও ছেলেটার অন্য আরেকটা অপারেশন ছিলো।বাড়িতে ফিরতে ফিরতেই তার রাত হয়েছে বেশ! এইতো রাত তিনটে নাগাদ ফিরেছে সে! তাই আর কেও তাকে ডাক দিয়ে ডিস্টার্ব করেনি।
অনিক নিজের প্লেটে খাবার বাড়ছে।এরইমধ্যে শিশির এসে বসে পড়ে তার পাশে।আর ওমনি অনিকের হাতদুটো যেন থেমে গেলো আপনা-আপনি। ধূর! যতই সে এর কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়,ততই যেন মেয়েটা তার আশেপাশে বেশি করে ঘুরঘুর করে! অনিক নিজের মুখাবয়ব খানিকটা গম্ভীর করে ফের নিজের খাবারের দিকে মনোযোগ টানলো।ওদিকে, অরিনটাও একহাতে চোখ ডলতে ডলতে হাজির।এখন তার হাতদুটোর অবস্থা আগের চাইতে বেশ ভালো! তেমন একটা ব্যাথাও নেই কোথাও! এই যে,এখন নিজের টুকটাক কাজগুলো নিজে থেকেই করতে পারছে মেয়েটা!অরিন লম্বা একটা হামি টেনে অনিকের মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। মেয়েটা টেবিলে বসতেই রাইসা বেগম নিজ থেকে মেয়েটার পাতে খাবার বেড়ে দিলেন। বলাবাহুল্য, রাফিয়া বেগম মেয়ের ওমন উদ্ভট কর্মকাণ্ডের পর থেকেই মেয়ের সঙ্গে সোজা মুখে কথা বলছেন না।যাও দুয়েকটা কথা বলছেন তাও ইনিয়ে বিনিয়ে! এরূপ হাবভাবে প্রথমদিকে অরিনের কষ্ট লাগলেও পরবর্তীতে যেন সয়ে গিয়েছে তার!
অরিন ধীরে ধীরে একটা রুটির খানিকটা অংশ ছিড়ে, প্লেটের ওপর পড়ে থাকা ডিম পোচটা দিয়ে বেশ আয়েশ করে খেতে লাগলো।এরইমধ্যে টেবিলে বসে কেয়া বেগম হাসি মুখে জুবাইদা বেগমের দিকে তাকালেন। খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠেন,
“ জবা! একটা কথা বলবো বলবো ভাবছিলাম… কিন্তু কিভাবে যে বলি…!”
ভাবিকে ওমন দোনোমোনো করতে দেখে মুচকি হাসলো জুবাইদা বেগম। তিনি কেয়া বেগমকে আশ্বাস দিয়ে বলে ওঠেন,
“ এতো ইতস্তত করছো কেনো ভাবি? যা বলার নির্দ্বিধায় বলো!”
এহেন আশ্বাস পেয়ে কেয়া বেগম বিজয়ী হাসলেন যেন।তিনি একপলক আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। পরক্ষণেই নিজের দৃষ্টি জুবাইদা বেগমের ওপর ফেলে হাসি মুখে আবদারি সুরে বললেন,
“ বোন… তুই তো জানিস আমরা রোদকে কতটা পছন্দ করি! তাছাড়া রোদ আর শিশিরও একে-অপরকে অনেক আগে থেকেই চেনে।তাই আমরা চাচ্ছিলাম…….”
“ কি চাচ্ছিলে?”
কেয়া বেগমের কথা শেষ হবার পূর্বেই ডাইনিং এ শোনা গেলো রৌদ্রের গম্ভীর ভরাট কন্ঠ!সকলে এবার একযোগে তাকালেন রৌদ্রের পানে। দেখতে পেলেন,রৌদ্র কেমন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে কেয়া বেগমের পানে।ওদিকে,বাড়ির সবার মনেই চলছে বিশাল আতঙ্ক! ইতোমধ্যেই সকলে বুঝে গিয়েছে কেয়া বেগমের কথার উদ্দেশ্য! এখন যদি ভুলক্রমেও তিনি রৌদ্রের সামনে এ কথা বলে বসেন— তখন ছেলেটা আবার কি-না কি বলে বসে..কে জানে! জুবাইদা বেগম জোর করে হাসার প্রয়াস করলেন একটুখানি। তিনি মাঝখান থেকে বলতে লাগলেন,
“ ইয়ে… মানে রোদ….”
জুবাইদা বেগম পুরোটা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই রৌদ্র তাকে আঙুলের ইশারায় থামিয়ে দিলো।পরক্ষণেই ছেলেটা তার ঢিলেঢালা ঘিয়ে রঙের ট্রাউজারের পকেটে দু’হাত গুঁজে দাঁড়ালো ভিষণ ভাব নিয়ে। শর্ট হাতার টি-শার্ট পড়ায় বাইসেপস গুলো কেমন ফুলেফেঁপে উঠেছে।ছেলেটার কপাল ছেয়ে আছে তার অবাধ চুলগুলোয়! বোঝাই যাচ্ছে — সে বুঝি মাত্রই ঘুম ছেড়ে উঠে এসেছে।রৌদ্র খানিক সময় নিয়ে আবারও গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ বললে না যে? কি চাচ্ছিলে তুমি মামনী?”
কেয়া বেগম এবার উঠে দাঁড়ালেন।তিনি রৌদ্রের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে ভিষণ আদুরে কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“ আমি চাচ্ছিলাম তোর আর শিশিরের চারহাত এক করতে!শুধু আমি না তোর মামা এবং শিশিরও…..”
বাকিটা আর বলতে পারলেন না কেয়া বেগম। তার আগেই তার কথাগুলো গলাতেই আঁটকে গেলো রৌদ্রের অগ্নিদৃষ্টি দেখে।কেয়া বেগম থমকালেন। হতবিহ্বলতায় দু-কদম পিছিয়ে গেলেন নিজ অজান্তেই! রৌদ্র তখন নিজের দৃঢ় চোয়ালটা শক্ত করে ফুটিয়ে তুলে,দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,
“ আমি বিবাহিত! ঘরে বউ আছে আমার….আমার আগাগোড়া সবটাই একজনের জন্যই বরাদ্দ! তাকে ছাড়া অন্য কারো কথাতো স্বপ্নেও ভাবতে পারবো না মামনী!”
হুট করে এমন কথাগুলো কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই যেন একপ্রকার বাজ পড়লো সকলের মাথায়।সাব্বির সাহেব তো হতবিহ্বলতায় খাবার চিবুতেই ভুলে গেলেন। তায়েফ সাহেব চমকায়নি, কেননা এর আগেও তিনি রৌদ্রের মুখে এমন কথা শুনেছেন একবার।তাশরিক সাহেব গ্লাসে পানি ঢালছিলেন। রৌদ্রের ওমন কথায় মানুষটা এতোটাই অবাক হয়েছেন যে কখন তার হাতের গ্লাসটায় পানি পুরিয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচের দিকে সেদিকে কোনো খবর নেই তার।শিশিরের যেন চোখ ফেটে যাচ্ছে কান্নায়।মেয়েটা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর প্রয়াস চালাচ্ছে।
এদিকে, কেয়া বেগম খানিকক্ষণ সময় নিয়ে নিজের সম্বিৎ ফিরে পেলেন যেন।তিনি রৌদ্রের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,
“ কি বলছিস রোদ? তুই বিয়ে করলি কবে?”
রৌদ্র এবার গা ছাড়া ভাব টেনে বলে ওঠে,
“ দেড় মাস হতে চললো!”
এবার যেন আরেকদফা চমকালেন সকলে।ওদিকে, অনিক ছেলেটা কোনো দিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে খাবার খেয়ে যাচ্ছে আপনমনে। রাফিয়া বেগম ছেলের ওমন হাবভাবে ভ্রুকুঞ্চন করে রইলেন। হয়তো একে-একে দুই মিলাতে ব্যস্ত এই বিচক্ষণ নারী!
কেয়া বেগম এবার খানিকটা ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“ কে সেই মেয়ে?”
রৌদ্র এবার ফিচেল হাসলো। অরিনের দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ বউজান! স্ট্যান্ড আপ..!”
এহেন কথা শোনামাত্রই আকাশ থেকে পড়লেন হামিদ পরিবার। শিশির তো চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে কেন যেন। হয়তো রৌদ্রের বলা কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।অন্যদিকে,অরিন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে একপ্রকার। মেয়েটা চেয়ারের ওপর হাত চেপে বসে আছে শক্ত হয়ে। রৌদ্র হয়তো মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করলে।এরপরই সে কেমন খেকঁ খেকঁ করে বলতে লাগলো,
“ এই বউজান! তুই উঠবি? না-কি আমি ওঠাবো?”
অগত্যা এহেন কথায় তৎক্ষনাৎ বসা ছেড়ে দাড়িয়ে পড়ে অরিন।মেয়েটার বুঝি ভয়ে জড়সড় হয়ে যাবার মতো অবস্থা! সে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। সাব্বির সাহেব একের পর এক চমকে এবার যেন রিয়াকশনই দিতে ভুলে গেলেন। তায়েফ সাহেব চেয়ারে গা এলিয়ে বসলেন। চেয়ারের হাতলে হাত ঠেকিয়ে মুখের সামনে এনে ধরলেন হাতটা।মানুষটা বুঝি এবার ইনজয় করে দেখছেন সবটা! তাশরিক সাহেব হা হয়ে তাকিয়ে আছেন রৌদ্রের দিকে।মনে মনে ভিষণ আফসোস হচ্ছে লোকটার।কই সে ঐদিন তার বড় ভাইয়ের সামনে এই ছেলেকে নিয়ে কত বড়বড় ডায়লগ দিয়েছিলো,আর এই ছেলেটা কি করলো? তলে তলে এতোটা এগিয়ে…..
রৌদ্র এবার স্থান কাল ভুলে নিজের বলিষ্ঠ হাত দিয়ে অরিনের কোমড় চেপে তাকে নিজের সঙ্গে এনে দাঁড় করালো।অতঃপর ভিষণ গম্ভীর কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ দিস ইজ মাই গার্ল! নান আদার দেন, মিসেস ইফতেখার এহসান রৌদ্র। আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ নারী! যাকে সেই শুরু থেকে মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসে এসেছি। বাকি জীবনটাও সেভাবেই ভালোবেসে যাবো! তা দেখলেন তো আমার বউজানকে? আশা করি, আমার বউজানের সঙ্গে দেখা করতে পেরে আপনার ভিষণ ভালো লাগছে!”
অগত্যা এমন কথায় বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সাব্বির সাহেব। লোকটার মুখাবয়ব দেখলে বোঝার জো নেই, তিনি কি আদৌও রেগে আছেন না-কি! তিনি কেমন গম্ভীর মুখে বলে ওঠেন,
“ কি বলছো এসব রোদ? তুমি বিয়েটাই বা করলে কবে? আর বিয়ে করতে হলে তো অবশ্যই সাক্ষী লাগে।তোমার বিয়েতে সাক্ষী কে ছিলো?”
রৌদ্র তখন ঠোঁট কামড়ে হাসে। অনিকের দিকে তাকিয়ে বাম ভ্রুটা – উঁচিয়ে তুলে খানিকটা। অনিক ইশারায় রৌদ্রকে না বলে যাচ্ছে! অথচ রৌদ্রকে কি আর শুনছে সে-ই বারন? সে হঠাৎই মৃদু হেসে অনিকের দিকে চোখ মেরে বলে ওঠে,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৫
“ ঐ যে! আমার সম্বন্ধি মশাই ছিলো! তিনিই আমার বিয়ের প্রধান সাক্ষী!”
কথাটা শেষ হতেই কয়েকজোড়া রক্তচক্ষু একযোগে নিক্ষেপ হলো অনিকের ওপর। অনিক বেচারার তৎক্ষনাৎ নাকেমুখে উঠে যায়। ছেলেটা বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে যে-ই না কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার কর্ণকুহরে পৌঁছালো সাব্বির সাহেবের ধমক!
“ অনিক!!!”