সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৮

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৮
Jannatul Firdaus Mithila

“ আমি চলে যাচ্ছি, তার মানে এই নয় আমার সানশাইনকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে পারবে! উঁহু… এমন ভুলে মোটেও বাস করোনা।আমি যদি সারাজীবন একা থাকি তাহলে ও নিজেও একা থাকবে।আমি যদি সারাজীবন ওর অনুপস্থিতির দহনে পুড়ি তাহলে ও নিজেও পুড়বে।তবুও যদি আমার কথার বিন্দুমাত্র হেরফের করে ওকে আমার কাছ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টাও করো,তাহলে শুনে রাখো — আমার সানশাইনের গায়ে যেদিন আমি বাদে অন্যকারো নামের লাল শাড়ি উঠবে, সেদিনি কিন্তু আমার গায়ে কাফনের কাপড় উঠবে! এবং আমি এটা কথা দিচ্ছি!”

কথাগুলো বলার একপর্যায়ে রৌদ্রের কন্ঠটা কেমন মোটা হয়ে আসলো মনে হচ্ছে! হয়তো এটুকু বলতে গিয়েই রাজ্যের কষ্ট হচ্ছে ছেলেটার।রৌদ্র আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না সেথায়।ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলো সিঁড়ি বেয়ে। অথচ তার চলে যাওয়ার পথে কয়েক জোড়া ছলছল দৃষ্টি যে একযোগে তাকিয়ে আছে সে খবর কি আর আছে তার? থাকবেই বা কিভাবে? ছেলেটা যে একটিবারের জন্যও পেছন ফিরে চাইলো না। জুবাইদা বেগম এবার যেন পাথর বনে গেলেন।তিনি স্তব্ধ হয়ে ধপ করে বসে পড়লেন ফ্লোরে। তা দেখা মাত্রই হকচকিয়ে ওঠে বাড়ির সকলে। রাফিয়া বেগম তড়িৎ বেগে ছুটে আসেন প্রানপ্রিয় বান্ধবীর দিকে।তিনি হাত বাড়িয়ে যেইনা মানুষটাকে ধরতে যাবেন ওমনি তাকে হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলেন জুবাইদা বেগম। রাফিয়া বেগম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন এহেন কান্ডে। তিনি অবাক নেত্রে তাকালেন জুবাইদা বেগমের দিকে।জুবাইদা বেগম মাথা নিচু করে রেখেছেন। তার ছলছল দৃষ্টি ফ্লোরের উপর নিবদ্ধ। মানুষটার মুখাবয়ব কেন যেন শক্ত হয়ে আছে! রাফিয়া বেগম বিচলিত হলেন এবার।তিনি আবারও এগিয়ে এসে বলতে লাগলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ জবা তুই….”
পুরোটা শেষ করতে পারলেন না তিনি।তার আগেই শোনা গেলো জুবাইদা বেগমের কাঠকাঠ কন্ঠধ্বনি!
“ কিচ্ছু বলিস না রাফু।এমুহূর্তে ছেলের শোকে পাথর হয়ে গিয়েছি আমি।এমনও হতে পারে, ছেলের পাওয়া কষ্টগুলো বিষাক্ত তীর হয়ে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে।বিশ্বাস কর….আমি চাইনা এসব।আমার…..
আমার মানিকের উর্ধ্বে আমার সকল সম্পর্কের বাঁধনই তুচ্ছ।”

কন্ঠ জুড়িয়ে আসছে জুবাইদা বেগমের।সেই সাথে বুকটাতেও হচ্ছে অসহ্য কম্পন। মাথাটায় হচ্ছে তীব্র যন্ত্রণা। জুবাইদা বেগম খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালেন।শাড়ির কুঁচিতে পা আঁটকে খানিকটা টলতে লাগলেই রুহি এসে চেপে ধরলো মা’কে। জুবাইদা বেগম মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলেন নিজের সঙ্গে। রুহি কাঁদছে নিঃশব্দে। মেয়েটা বুঝি নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তাছাড়া শক্ত না রেখে উপায় আছে?একদিকে ভাই টা তার চলে যাচ্ছে, মা ও ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছে,অন্যদিকে,বাবাও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি।রুহি নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে মা’কে বুকে চেপে ধরে এগিয়ে গেলো মায়ের রুমের দিকে। জুবাইদা বেগমের চোখমুখ লাল হয়ে আছে কিন্তু তিনি কাঁদছেন না মোটেও।হয়তো এ ক’দিনের কান্নায় চোখের পানিগুলো শুকিয়ে গেছে তার।

সাব্বির সাহেব এতক্ষণ মাথানিচু করে,দেয়ালের সঙ্গে গা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ড্রয়িং রুমের এককোণে।মানুষটার দৃষ্টি নত করে রাখা।বোধহয় তিনিও নিজের অশ্রুসিক্ত আঁখিদুটোকে লুকাতেই এমন প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তাশরিক সাহেব অদূরে দাঁড়িয়ে বুকের বাঁ-পাশে অনবরত হাত ডলছেন। কি আশ্চর্য! এমন একটা তাগড়া মানুষেরও কি বুকে ব্যাথা উঠে? উঠে হয়তো! তাশরিক সাহেব মুখ হা করে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছেন।রাইসা বেগম স্বামীর এহেন ভাবভঙ্গি দেখে অস্থির হয়ে ছুটে এলেন। তিনি স্বামীর গায়ে হাত রাখতেই তাশরিক সাহেব ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লেন। রাইসা বেগম তৎক্ষনাৎ ঘর কাপিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠেন।

উপস্থিত সকলেই একপ্রকার হকচকিয়ে ছুটে আসেন তাশরিক সাহেবের নিকট।মেহরিন বেগম তো বুক ভাসিয়ে কাঁদছেন।জুবায়ের সাহেব স্ত্রীকেই সামলাবেন, না-কি শ্যালকের দিকে ছুটে আসবেন এ নিয়ে পড়লেন চরম বিপাকে। অতঃপর বিবেককে একপাশে রেখে আবেগের কাছে ছুটে গেলেন তিনি। মেহরিন বেগমকে সামলাতে লাগলেন নিজের মতো করে। মাইমুনা বেগম রাগে গজগজ করছেন একপাশে দাঁড়িয়ে। মানুষটার আবার ধৈর্য্য-সহ্য কম কি-না! এমন একচেটিয়ে কার্যক্রম দেখে সে-ই শুরু থেকেই মেজাজ খারাপ তার।তার মতে — ছেলেমেয়ে দুটোতো স্রেফ ভালোই বেসেছে,কারও খুন তো আর করেনি।কি দরকার নিজেদের ওমন খোঁকলা ইগোর জন্য বাচ্চাগুলোকে কষ্ট দেওয়ার? এমনিতেই তার রাগের শীর্ষে আছেন কবির সাহেব। তবুও তিনি মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছেন না।পারবেনই বা কিভাবে? ঘরের কর্তার সামনে কি আর ওতো মুখ চলে?

তায়েফ সাহেব ছুটে এসে ছোট ভাইয়ের সামনে বসে পড়লেন হাঁটু গেড়ে। তাশরিক সাহেবের লাল রক্তবর্ণ হয়ে আসা মুখখানা নিজের খসখসে দু’হাতের তালুতে নিয়ে মোটা হয়ে আসা কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“ কি হয়েছে তোর? এই তশু! চোখ খোল ভাই… তাকা আমার দিকে।”
তাশরিক সাহেব চোখ মেলছেন না। কিন্তু তার বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়ছে নোনাধরা।তায়েফ সাহেবেরও চোখ ভরে আসলো ভাইয়ের কান্না দেখে।তিনি তৎক্ষনাৎ তাশরিককে নিজের বুকে চেপে ধরলেন।মানুষটার গরম হয়ে আসা মাথাটা খানিকটা চেপে ধরে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“ চোখ খোল ভাই! নিজেকে সামলা!”

তাশরিক সাহেব নিঃশব্দে কাঁদছেন।কিয়তক্ষন বাদেই তিনি কাঁপা কাঁপা হাতদুটো দিয়ে তায়েফ সাহেবকে আঁকড়ে ধরলেন।কান্নার তোড়ে থেমে থেমে বললেন,
“ সেজো ভাইজান! আমার…আমার বুকটায় এতো ব্যাথা হচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে এক্ষুণি বুঝি বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।আমি…আমি ঠিকমতো নিশ্বাস ফেলতে পারছিনা কেন? কেউ কি আমার গলা চেপে ধরেছে? ও ভাইজান…. আমি কি আর বাঁচবো না?”
এহেন কথা শোনামাত্র রাইসা বেগম চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। ভাগ্যিস ছেলেমেয়ে গুলো এখানে নেই! বড়দের আলাপকালে ছোটরা সবাই একযোগে একটা ঘরে গিয়ে বসে থাকে।আজও যে তাই হলো।নাহলে কি যে একটা হাউকাউ অবস্থা হতো কে জানে! রাইসা বেগম স্বামীর পিঠ মরিয়ে দিতে লাগলেন। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

“ আল্লাহর দোহাই লাগে এভাবে বলো না। আমার কষ্ট হচ্ছে পুতুলের আব্বু! ভিষণ ভয় করছে আমার।তুমি..প্লিজ কান্না থামাও।”
তাশরিক সাহেব শুনছেন কি? কে বলবে তা! মানুষটা যে এখনো সেজো ভাইয়ের বুকে পড়ে বাচ্চাদের মতো করে কাঁদছে। সাব্বির সাহেব ধীর পায়ে হেঁটে এলেন তাশরিক সাহেবের কাছে।মানুষটা কাঁদছেন না তবুও তার চোখদুটো কেমন ফোলা ফোলা। মুখটা হয়ে আছে গুরুগম্ভীর! সাব্বির সাহেব ছোট ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখলেন। গম্ভীর মুখে বললেন,

“ ওঠ তশু!”
তাশরিক সাহেব ধীরে ধীরে তায়েফ সাহেবের বুক থেকে মাথা উঠালেন।ঘাড় বাকিয়ে সাব্বির সাহেবের মুখের দিকে তাকালেন।কাঁদতে কাঁদতে মানুষটার চোখেমুখের যাচ্ছে তা-ই অবস্থা! সাব্বির সাহেব এবার খানিকটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। বললেন,
“ কাঁদবি না আর! এবার যা হওয়ার তাই হবে।ওঠ তুই!”
তাশরিক সাহেব অবাক হলেন এমন কথায়। এমন একটা মুহুর্তে সাব্বির সাহেবের এতো শান্ত থাকাটা ঠিক হজম হচ্ছে না তার।তাশরিক সাহেবকে এভাবে একদৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাব্বির সাহেব অন্যদিকে মুখ ঘোরালেন। গম্ভীর কন্ঠে রাইসা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ ছোটো বউ, তশুকে ঘরে নিয়ে যাও।”
রাইসা বেগম বাধ্য মানুষের মতো মাথা নাড়লেন। তাশরিক সাহেবের একহাতের বাহু চেপে তাকে ধীরে ধীরে বসা থেকে দাঁড়লেন।অতঃপর মানুষটাকে ধরে ধরে নিয়ে গেলেন নিজেদের রুমে। এদিকে, তায়েফ সাহেব হতবাক চোখে তাকিয়ে আছেন সাব্বির সাহেবের দিকে। তার চোখেমুখে কিছু একটা বুঝতে চাওয়ার স্পষ্ট আকাঙ্খা! কিয়তক্ষন বাদেই তিনি ধীমী স্বরে বলতে লাগলেন,

“ তোমার এইরূপ দেখে মনে কেমন খচখচানি হচ্ছে মেজো ভাই!”
সাব্বির সাহেব তীক্ষ্ণ নজরে চাইলেন ভাইয়ের দিকে। ঠোঁটের কোণে একটুকরো ব্যাথাতুর হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
“ কেঁদেও দেখেছি, দোহাই দিয়েও দেখেছি। তবুও ছেলেটার ওপর বয়ে যাওয়া কষ্টের এক চিলতে পরিমাণও উপলব্ধি করতে পারিনি।আমরা শুধু মুখেই বলি তায়েফ,আমরা কারো কষ্ট উপলব্ধি করতে পারি।কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে — কেও কখনো চাইলেই অন্যের কষ্ট অনুভব করতে পারেনা।যার ওপর দিয়ে যায়,একমাত্র সে-ই বোঝে কষ্ট কি জিনিস! আমরা তো শুধু দর্শক মাত্র!”
তায়েফ সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন এহেন কথায়। সাব্বির সাহেবের কথাগুলো তো মিছে নয়,তবুও কেনো এই কথাগুলো তার কাছে ওতো ভারি ঠেকছে? কি ছিলো কথাগুলোতে? সাব্বির সাহেব ভাইয়ের ওমন হতভম্বতা দেখে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চাইলেন। কন্ঠ খাদে নামিয়ে মোটা স্বরে বললেন,
“ ঘরে যাও সবাই।”

উপস্থিত সকলেই যেন ভারি অবাক হলেন সাব্বির সাহেবের এমন রুপ দেখে। মানুষটা আসলে চাইছেই বা কি,এ নিয়েই যতো রাজ্যের চিন্তা সকলের! রাফিয়া বেগম মাথানিচু করে চলে গেলেন নিজের রুমে। তায়েফ সাহেব একপলক বড় ভাইয়ের দিকে তাকালেন। হয়তো চেয়েছিলেন কিছু বলতে, কিন্তু পরক্ষণেই ভাইজানের শরীরের অবনতির কথা মাথায় রেখে মুখে থাকা কথাটা একপ্রকার গিলে নিলেন তিনি। তারপর গটগট পায়ে চলে গেলেন বাড়ির বাইরে। মেহনুর এবং তার স্বামী বহু আগেই চলে গিয়েছেন নিজেদের রুমে।মেহনুর বেগমতো এমনিতেই ছিচঁকাদুনে! খালি একটা সুযোগ পেলেই হয়, কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে দেওয়া যে তার জন্য একেবারেই পানি-ভাত ব্যাপারস্যাপার।

সকলের প্রস্থানের পর ড্রয়িং রুমে উপস্থিত রইলেন শুধুমাত্র তিনটে মানুষ। ড্রয়িং রুমের সোফায় মুখাবয়ব যথেষ্ট গম্ভীর রেখে বসে আছেন কবির সাহেব। তার থেকে কয়েক হাত দূরে, তারই দিকে তাকিয়ে আছেন সাব্বির সাহেব। মানুষটার অনিমেষ চোখ তার বড় ভাইয়ের দিকে নিবদ্ধ। খানিকটা দূরে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরিন।মেয়েটার মাথা নিচু করে রাখা। সবাই চলে গেলেও সে কেনো যেতে পারছেনা? তার কেনো মনে হচ্ছে — তার পাদু’টো বুঝি কেও সজোরে আঁটকে দিয়েছে ফ্লোরের সঙ্গে। শরীরটায় যেন এক অদ্ভুত অবশতা নেমেছে। মস্তিষ্ক মনে হচ্ছে পুরোই ফাঁকা হয়ে গেছে তার!চোখদুটোর জল শুকিয়ে গেছে বহু আগেই। বুকের খাঁচায় হৃদয় নামক বস্তুটা যে বড় আগেই পাথর বনে গেছে !এখন কি আর আগের মতো কষ্ট হয় তার? হয় না তো! একটা মৃত আত্মার কি আর ওতো কষ্ট হয়? তার আত্মাটা যে সেদিনই মরে গেছে, যেদিন সে সবার সামনে তার প্রেমিক পুরুষের প্রতি থাকা তার এক আকাশসম ভালোবাসাকে অস্বীকার করেছে।

মানুষতো দেহের মৃত্যু দেখে কিন্তু… আত্মার মৃত্যু ক’জনই বা দেখে? এ-ই যে সে এখন অনুভূতিহীন, পাথরের মতো সবটা দেখলো-শুনলো। কই, তার চোখ থেকে তো একফোঁটা অশ্রুও বেরোলো না! সে তো শক্ত হয়ে গেছে। একেবারে পাথরের মতো শক্ত। পাথরের যেমন প্রাণ আছে তেমনি তারও ভেতরে তথাকথিত প্রাণ আছে। পাথর যেমন নিঃশব্দে কাঁদে, তাদের অশ্রু যেমন কারও চক্ষুগোচর হয়না তেমনি তার কান্নাগুলোও কারও চক্ষুগোচর হয়নি।সে কেঁদেছে,ভিষণ ভয়ংকরভাবে কেঁদেছে সে-ই মানুষটার জন্য।অতিবাহিত প্রতিটা রাতের নিস্তব্ধতা জানে — তার জন্য সে-ই নিস্তব্ধতা মোড়ানো রাতগুলো ঠিক কতোটা কষ্টকর ছিলো।তার বিছানায় অবহেলিত আকারে পড়ে থাকা মাথার বালিশগুলো জানে,প্রতিটা রাতে ঠিক কতোটা চোখের পানি বিসর্জন দিয়েছে সে।শুধু কি তাই?

তার ডাক্তার সাহেবের অবহেলা গুলো যে এতোটাই পুড়িয়েছে তাকে যার জন্য রোজ রাতের নিস্তব্ধতায় সে নিজেকে ভিজিয়েছে পানির মাঝে।ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছে শাওয়ারের নিচে।তবুও বুঝি অন্তরের দহন, একাংশও কমেনি তার।যে-ই মেয়েটা বেশিক্ষন পানিতে ভিজলেই জ্বরে কুপোকাত হয়ে বিছানা ধরতো সে-ই মেয়েটা আজ দিনের পর দিন এভাবে নিজেকে সামলাচ্ছে,কই এখন দেখি অসুস্থ হচ্ছে না সে! হয়তো তার মনের অসুখ শরীরের সকল অসুখের উর্ধ্বে! তাছাড়া এ আর এমন কি ব্যাপারস্যাপার? সবার মতে — সে-তো বিশ্বাসঘাতক, পাষাণী! তার ডাক্তার সাহেবের হাহাকার গুলো শুনেছে সবাই, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেঁদেওছে কেউ কেউ।কিন্তু… তার কষ্ট গুলো? সেগুলো কি আর আদৌও চোখে পড়েছে কারো?

আচ্ছা… তার ডাক্তার সাহেবের জীবনে সে যেমন প্রথম প্রনয়,ঠিক তেমনি তার জীবনেও তো ডাক্তার সাহেবই প্রথম এবং শেষ প্রনয়! সে-কি আর কম কষ্ট করেছে তার ডাক্তার সাহেবের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য? রোজ দিনের পর দিন বেহায়া হয়েছে সে শুধুমাত্র মানুষটার মুখ থেকে ‘ ভালোবাসি ’ কথাটা শোনার জন্য। দিনকে দিন পাগলামি করেছে, অভিমান করেছে মানুষটার একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য! সে’বার যখন শিশিরের সঙ্গে তার ডাক্তার সাহেবের বিয়ের কথাটা শুনেছিলো, তখন তো তার প্রাণটাই বুঝি গলাতে এসে থমকে গিয়েছিলো।রৌদ্রের করা প্রতিটি রাগের মাঝে নিজের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসা খুঁজে নিয়েছিলো মেয়েটা।অথচ কপাল দেখো! নিজের সর্বস্বটা দিয়ে যাকে ভালোবাসলো অবশেষে নিয়তির গেরাকলে তাকেই দূরছাই করতে হলো!

অরিন নিজের এহেন পরিস্থিতির কথা ভাবতে ভাবতেই অদ্ভুতভাবে হেসে ওঠলো।সাব্বির সাহেব ভ্রুকুটি করে তাকালেন মেয়ের দিকে। মেয়েটা কি-না এহেন পরিস্থিতিতে হাসছে? সাব্বির সাহেব কয়েকটা শক্ত কথা বলতে উদ্যত হতেই যাবেন ঠিক তখনি তার দৃষ্টি আঁটকে গেলো অরিনের নুইয়ে রাখা মুখপানে।লাল লাল কি যেন একটা দেখতে পেলেন তিনি। সাব্বির সাহেব দৃষ্টি সরু করলেন। মাথাটা খানিক নিচু করে মেয়ের মুখপানে তাকালেন। ওমনি চমকে ওঠলেন তিনি! মেয়েটার ঠোঁট কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে! অথচ মেয়েটাকে দেখো,সে এখনো কেমন করে দাঁত দিয়ে চেপে রেখেছে নিজের ঠোঁট খানা! সাব্বির সাহেব হতচকিত কন্ঠে খানিকটা জোরে বলে ওঠেন,
“ কি করছিস অরি! দাঁত সরা!”

অরিন তৎক্ষনাৎ নিজের রক্তবর্ণ চোখদুটো তুলে চাইলো বাবার দিকে। অতঃপর কি যেন একটা মনে করে আবারও হাসলো মেয়েটা।সাব্বির সাহেব থমকে গেলেন মেয়ের ওমন ব্যাথাতুর হাসি দেখে। এ কি দেখছেন তিনি? তার মেয়ের চোখভর্তি অশ্রু, ঠোঁট থেকে ঝড়ে পড়ছে লহু তবুও তার মেয়েটা কি-না হাসছে!সাব্বির সাহেবের বুকটা অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে তৎক্ষনাৎ। তিনি কদম বাড়ালেন মেয়ের দিকে। খানিকটা এগোতেই অরিন হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলো বাবাকে। সাব্বির সাহেবের পদযুগল থামলো।তার চোখদুটোতে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা লেপ্টে গেলো তখন।অরিন কেমন ঠোঁট কামড়ে হাসে তাকে দেখে। কিয়তক্ষন সময় নিয়ে সে বললো,
“ এটুকু রক্ত দেখেই এতো কষ্ট হচ্ছে তোমার আব্বু? অথচ আমার হৃদয়ে যে এরচেয়ে কয়েকগুণ বেশি রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সেটা কি আর আদৌও দেখছো তোমরা?”

সাব্বির সাহেব হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। এমুহূর্তে ঠিক কি বলা উচিত তার?অরিন বাবার দিক হতে চোখ সরিয়ে আনলো বড় আব্বুর দিকে। কবির সাহেব আগে থেকেই অরিনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অরিন তাকাতেই তিনি নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন তৎক্ষনাৎ। অরিন বাঁকা হাসলো।গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো বড় আব্বুর সামনে। অতঃপর কবির সাহেবের পাদু’টোর সামনে বসে পড়লো পা-ভাজ করে।কবির সাহেব খানিক চমকে ওঠলেন মেয়েটার এমন কৃতকর্মে।তিনি পাদু’টো তৎক্ষনাৎ সরিয়ে নিতে চাইলে অরিন শক্ত করে চেপে ধরলো সেই পাদু’টো। কবির সাহেব এবার যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি হতভম্ব হয়ে বলতে লাগলেন,

“ কি করছো তুমি? উঠে বসো!”
অরিন শুনলো কি? কে জানে! তার হাবভাবে তো বোঝবার জো নেই, সে আদৌও কারো কথা শুনছে কি-না। অরিন খানিকটা হাসলো। ভরে আসা চোখদুটো কবির সাহেবের মুখপানে তাক করে ধরে আসা কন্ঠে বহুকষ্টে বলতে লাগলো,
“ তোমার ছেলেকে ভালোবাসি আমি বড় আব্বু! ভিষণ রকমের ভালোবাসি!এতোটা, যতোটা ভালোবাসলে গোটা একটা জীবন অনায়াসে কাটানো সম্ভব! কিন্তু…. যাকগে..একটা কথা শোনাে! তোমায় বলছি কাওকে বলো না যেন!”

কবির সাহেব স্তম্ভিত নয়নে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে। মেয়েটার কথাগুলো কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছে তার নিকট।মনে হচ্ছে, অতিরিক্ত শোক পেলে মানুষ যেমন বেভুলো হয়ে যায় না? ঠিক তেমন! আচ্ছা.. মেয়েটারও কি তাই হলো? না.. না.. কি ভাবছেন তিনি।কবির সাহেব তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে বসলেন।আলতো করে হাত বাড়িয়ে মেয়েটার কাঁধে হাত রাখলেন। অরিন তৎক্ষনাৎ সরিয়ে দিলো সে-ই হাতদুটো। অতঃপর দৃষ্টি এলোমেলো করে হাত নাড়িয়ে বিরবির করে বলতে লাগলো,
“ ছোঁবে না কেউ…আমার ডাক্তার সাহেব আছে।আমায় কেও ছুঁয়ে দিলে সে খুব রাগ করবে।পেটাবে সবাইকে।”
সাব্বির সাহেব এবার মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লেন। মেয়ের এমন পরিনতি কি-না এ বয়সে এসে দেখতে হলো তার? কবির সাহেব শুকনো ঢোক গিললেন বোধহয়। তিনি নিজের শুষ্ক অধরজোড়া জিভ দিয়ে খানিকটা ভিজিয়ে নিয়ে আবারও বললেন,

“ মা..তুমি উঠো।”
অরিন আবারও ছলছল চোখজোড়া ওপরে তুললো।কবির সাহেবের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলতে লাগলো,
“ তুমি জানো বড় আব্বু? আমি তোমায় দেওয়া ওয়াদাটা রেখেছি।তুমি আমায় বলেছিলে না? হয় আমি ডাক্তার সাহেবকে ভুলে যাবো,নয়তো তার ভালোবাসাকে সবার সামনে অস্বীকার করবো! দেখো না…তোমার ছেলেকে ভুলতে পারার চাইতে মরনটাকে বেশি সহজ মনে হয়েছে আমার কাছে।কি করবো বলো? তোমার ছেলে যে রক্তে মিশে গেছে আমার।এখন এর থেকে পরিত্রাণ পেতে কেবল একটিমাত্র পন্থাই অবলম্বন করা যাবে,আর সেটা হচ্ছে আমার মতো অভাগীর মৃত্যু!”

“ তুমি অভাগী না মা!”
কবির সাহেবের কথাটা শেষ হতে না হতেই অরিন তেতে উঠলো।চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো,
“ হ্যা হ্যা..আমি অভাগী! কে বললো আমি অভাগী না? বোধ-বুদ্ধি হবার পর থেকে যাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে এসেছি,ছোট এই জীবনটার প্রতিটা দিন যার বউ হবার স্বপ্ন দেখে এসেছি, শেষ পর্যন্ত তাকেই কি-না হারাতে হচ্ছে আমার! নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে এতোটা ভালোবাসার পরও কি নিখুঁতভাবে অপরাধীর অভিনয় করতে হচ্ছে আমার.. তাহলে আমি অভাগী নাহলে কে হবে অভাগী? ”
কবির সাহেব স্তব্ধ হয়ে গেলেন অরিনের কথাগুলোতে।মানুষটা মনে মনে কি ভাবছেন কে জানে! তিনি একই ভঙ্গিমায় তাকিয়ে রইলেন।অরিন এবার খানিকটা দম নিয়ে আবারও বলতে লাগলো,
“ আমার ডাক্তার সাহেব চলে যাচ্ছে… থাক চলে যাক।আমি নাহয় এই কষ্টটাও সয়ে নিবো।এপর্যন্ত তো আর কম সইলাম না! অভ্যাস হয়ে গেছে আমার।”

বলেই মেয়েটা ফ্লোরে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।মাথা চুলকাতে চুলকাতে কদম বাড়ালো সেখান থেকে। কিন্তু দু-কদম এগোতেই আবারও কি যেন একটা মনে করে পেছনে ফিরে চাইলো। কবির সাহেবের স্তম্ভিত মুখখানার দিকে তাকিয়ে শ্লেষাত্মক হাসলো মেয়েটা।অতঃপর অদ্ভুত শান্ত কন্ঠে বললো,
“ দেখো কারবার! আসল কথাটা তো বললামই না। শোনো তাহলে… আমি তাফসিরা এহসান অরিন,আজ এমুহূর্তে এখানে দাঁড়িয়ে কথা দিচ্ছি — আমি যদি কারো বউ হই তাহলে তা কেবল আমার ডাক্তার সাহেবের,নয়তো আর কারোর না।আমি আমার গোটা একটা জীবন একলা কাটিয়ে দিবো তবুও অন্যকারো হবোনা। আমি তার ছিলাম, আছি এবং আমরন থাকবো।

তার স্মৃতি গুলো নিয়ে এই ছোট্ট জীবনটা অনায়াসে কাটাতে পারবো।তারপরও আমায় কেও এ নিয়ে জোর করতে আসলে… এবার তো অপরিপক্ক হাতে হাতের কব্জি কেটেছিলাম, পরবর্তীতে পরিপক্বতার সাথে গলা কাটবো নিজের। আশা করি বুঝেছো ব্যাপারটা!”
কথাটা শোনামাত্রই বসা ছেড়ে হকচকিয়ে ওঠে গেলেন কবির সাহেব। সাব্বির সাহেব তো ভুলেই গিয়েছেন রিয়েকশন দিতে।অরিন হাসলো আবারও। তারপর গটগট পায়ে চলে গেলো সিঁড়ি বেয়ে। অথচ পেছনে পড়ে রইলো হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দুটো!

রাত সাড়ে ১১টা!
দুপুরের পর থেকেই গোটা বাড়ির পরিবেশ থমথমে। কারো মুখে তেমন কোনো রা-শব্দ নেই। রাতের খাবারটাও খায়নি কেও।শুধুমাত্র বাচ্চারা খেয়েছে বোধহয়। আহি-মাহি আর পুতুল মিলে বেশ কয়েকবার একে-ওকে জিজ্ঞেস করেছে — কি হয়েছে? সবাই এতোটা নিশ্চুপ কেনো! এহেন প্রশ্নের জবাব রুহি কেবল অল্প করে বলেছে,
“ কাল রোদ ভাই চলে যাবে বিদেশ।”

এছাড়া হঠাৎ করে কেনই বা যাচ্ছে, ক’দিনের জন্য যাচ্ছে এসব কিছুই বলেনি রুহি।তারাও আর আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেনি ।জানে,জিজ্ঞেস করলেও ঠিকঠাক উত্তর মিলবেনা আপাতত। বাড়ির সবাই যে-যার মতো করে ব্যস্ত।ওদিকে, অনিক ফিরেছে কেবলমাত্র। অফিসে সারাদিন ধরে যা খাটা-খাটুনি গেলো না তার! হাড়গোড় যেন জুড়িয়ে আসছে বেচারার! অনিক একহাতে অফিস ব্যাগ এবং অন্যহাতে গলায় বেঁধে রাখা টা-ই টা খুলতে খুলতে সোফায় গা এলিয়ে বসলো।হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা পাশে রাখলো।অতঃপর ক্লান্ত দেহটা খানিকটা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকলো সে। খানিকক্ষণ বাদেই কেও একজন একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলো অনিকের দিকে। অনিক চোখ বন্ধ রেখেই স্পষ্ট টের পেলো কারো উপস্থিতি।সে চোখদুটো চট করে মেলে তাকায় সামনে। দেখতে পায় — মাহিরা গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিক হালকা হেসে পানিটা নিয়ে নিলো।অতঃপর দু-চুমুকেই পুরো গ্লাসের পানিটা পগারপার করে নিয়ে, গ্লাসটা আবারও মাহি’র হাতে দিলো।মাহিয়া বিষন্ন মুখে গ্লাসটা নিয়ে চলে যেতে পা বাড়ায়। তখনি পেছন থেকে অনিক বলে ওঠে,

“ মুখটা ওমন বাংলার পাঁচ করে রেখেছিস কেনো তুই? মন খারাপ না-কি? ”
অন্যদিন হলে এতক্ষণে বুঝি তেলেবেগুনে ছ্যাৎ করে উঠতো মাহি,কিন্তু আজ যে বিষয়টা একেবারেই ভিন্ন।মাহি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটাকে তেমন কোনো রিয়েক্ট করতে না দেখে অনিক বুঝি ভারি অবাক হলো।সে তৎক্ষনাৎ মাহি’র হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো। অতঃপর নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ কি হয়েছে বাবুনি? ভাইয়ার কথায় রাগ করলি? আচ্ছা.. যা সরি বললাম আমি।সরি! এবার তো হাস!”
নাহ! মেয়েটার মুখাবয়বে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই।সে মাথা নিচু করে রেখেছে আগের মতো। অনিক এবার খানিকটা নড়েচড়ে বসলো। তারপর কানে হাত দিয়ে বলতে লাগলো,

“ আচ্ছা যা কানে ধরেছি! এবার হাসি দে।”
মাহিরা চোখ তুলে তাকালো।অনিক তৎক্ষনাৎ ভড়কে গেলো মাহিরার ছলছল চোখজোড়া দেখে। সে কেমন অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ বাবুনি! কি হয়েছে তোর? বাসার সবাই ঠিক আছে? কেউ কিছু বলেছে? কি হয়েছে একটু বলনা ভাইয়াকে।”
মাহিরা বহুকষ্টে নিজের উতরে আসা কান্নাগুলো গিলে নিলো। ধরে আসা কন্ঠে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলতে লাগলো,
“ অনি ভাইয়া।রোদ ভাই না চলে যাচ্ছে… তাও আবার কালকেই।”
এটুকু বলেই মেয়েটা থেমে গেলো।হয়তো বাকিটা বলার মতো ধৈর্য্য হচ্ছে না তার।তাছাড়া মেয়ে মানুষ কি-না! অল্পতেই ভিষণ আবেগি হয়ে ওঠে তারা।এই যেমন মাহি হচ্ছে। অন্যদিকে,অনিকের মাথার ভেতরটা যেন ফাঁকা হয়ে গেলো এহেন কথা শুনে। কি শুনলো সে? মাহি কি ঠিক বললো? সত্যি তার রোদ ভাই চলে যাবে?
নাহ! আর ভাবতে পারলোনা অনিক।ছেলেটা তড়িৎ গতিতে ছুটে গেলো দোতলার দিকে। মাহি হতবাক হয়ে গেলো অনিকের এমন দৌড়ে যাওয়া দেখে।মনে মনে হয়তো ভাবছে সে — কি এমন বললাম আবার?

“ ভাইয়া! কি শুনছি এসব? তুমি না-কি চলে যাচ্ছো?”
একপ্রকার ধুপধাপ পা ফেলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা বললো অনিক।রৌদ্র খাটের ওপর কাপড় বের করে রাখছে আলমারি থেকে।সে একপলক শান্ত চোখে চাইলো অনিকের দিকে।হাতের কাজ অব্যহত রেখে বললো,
“ হুম! যাচ্ছি।”
অনিক থমকালো। অবাক হয়ে এগিয়ে এলো রৌদ্রের কাছে।রৌদ্রের ব্যস্ত হাতদুটোকে চেপে ধরে আবারও বললো,
“ কেনো করছো এমন ভাইয়া? হঠাৎ করে আবারও কেনো…”
অনিকের কথা শেষ হবার আগেই রৌদ্র তার হাতদুটো অনিকের হাতের মধ্য থেকে ছাড়িয়ে নিলো।কাপড়গুলো ঠিকঠাক করতে করতে বললো,

“ হঠাৎ করে নয়।বহু আগে থেকেই চিন্তা করে রেখেছিলাম সবটা।”
অনিক শুকনো ঢোক গিললো কয়েকটা। ক্লান্ত দেহটা নিয়ে বসে পড়লো বিছানায়। দু’হাত হাঁটুর ওপর ভর করে মাথাটা চেপে ধরলে শক্ত করে। ধরে আসা গলায় বললো,
“ যেও না ভাইয়া! বিশ্বাস করো!এসবকিছু আমি মোটেও সামলাতে পারবোনা তোমার মতো করে।তুমি প্লিজ থেকে যাও।”
রৌদ্র হাসলো।সেই হাসিতে নেই কোনো প্রাণ। ছেলেটা লাগেজে কাপড় রাখতে রাখতে বললো,
“ কে বলেছে আমার মতো করে সামলাতে? তুই সবটা নিজের মতো করে সামলাবি।”
অনিক এবার উঠে দাঁড়ায়। বলা কওয়া নেই হুট করেই রৌদ্রকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ছেলেটা।রৌদ্র থমকায়।ছলছল চোখজোড়া অন্যদিকে নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে থাকে শক্ত হয়ে। অনিক তখন কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“ এমন করো না ভাইয়া।প্লিজ.. তুমি যেও না। ”
রৌদ্র কিচ্ছুটি বললোনা।না থামালো অনিকটাকে।সে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো একই ভঙ্গিমায়। ছেলেটা যেন রীতিমতো যুদ্ধ চালাচ্ছে নিজেকে শক্ত রাখার।তখনি ঘরে আগমন ঘটে রেহানের। অনিক রৌদ্রের বুকে মাথা রেখেই দেখতে পেলো রেহানকে।সে চটজলদি রৌদ্রকে ছেড়ে দিয়ে রেহানের কাছে এগিয়ে আসে।অনুনয় করে বলতে থাকে,
“ রেহান ভাই, প্লিজ তুমি এটলিস্ট বোঝাও রোদ ভাইকে।সে কেনো এমন করছে.. আমরা নাহয় আরেকটু চেষ্টা করবো সবটার জন্য।”

রেহান রৌদ্রের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ছেলেটার চোখদুটোও কেমন চকচক করছে।হয়তো বন্ধুর মনের অবস্থাগুলো আর সহ্য হচ্ছে না তার।অনিকের কথা শেষ হতেইই রেহান কেমন নিরেট কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ ওকে বোঝানোর মতো যোগ্যতা আমার নেই অনি! যেই ছেলে ইতোমধ্যেই নিজের বুকের মাঝে নিজের সকল শখ আহ্লাদ একপ্রকার কবর দিয়ে ফেলেছে তাকে আবার নতুন করে কিসের বুঝ দিতে আসবো আমি? আমি কিভাবে বুঝবো ওর ব্যাথার পরিধি? যাকে এতোগুলো বছর নিরবে-নিভৃতে ভালোবেসে এসেছে, আজ তাকেই সারাজীবনের জন্য ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হচ্ছে, এ কি কম কষ্ট অনিক? বিশ্বাস কর ভাই… আমরা এ পৃথিবীতে দু’বার জন্ম নিয়ে আসলেও ওর সমপরিমাণ ধৈর্য্য নিয়ে জন্মাতে পারবোনা। ও কিভাবে পারলো এতোকিছু একলা সহ্য করতে? কিভাবে পারলো নিজেকে শক্ত রাখতে? আমি নাহয় দূরে ছিলাম কিন্তু তুই? তুই তো
স্বচক্ষে দেখেছিস সবটা।সবটা দেখার পরও কিভাবে স্বার্থপরের মতো ওকে থেকে যেতে বলছিস অনি? তোর কি একটুও কষ্ট হয়না আমার ভাইটার জন্য? আরে…যেখানে ওর বাবা-ই ওর কষ্ট বুঝলোনা সেখানে তোরা কি বুঝবি! থাক বাদ দে…”

অনিক মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। মাথাটা আজ তার লজ্জায় নয় বরং অপরাধবোধের বোঝায় নুইয়ে পড়েছে আপনা-আপনি। ঠিকই তো বললো রেহান ভাই। রোদ ভাই কে আঁটকে রেখে কি’বা লাভ হবে? ঠিকই তো মানুষগুলো নিজেদের জেদের ওপর অটুট থাকবে সেখানে শুধু শুধু মানুষটার কষ্ট পেয়েই বা কি লাভ? রেহান অনিকের কাঁধে আলগোছে হাত রাখলো।ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ কিছুকিছু ক্ষেত্রে দূরে যাওয়া ভালো অনিক।যেখানে ভালোবাসার চাইতে জেদের মূল্য বেশি সেখানে নাহয় দুয়েকটা মানুষ না-ই বা থাকলো তাতে কি? তাছাড়া এতে রোদ শান্তিতে নাহোক এটলিস্ট স্বস্তিতে তো থাকবে।ওটাই যথেষ্ট।”
অনিক হয়তো বুঝলো সবটা।সে কেমন নাক টানলো আলগোছে। অতঃপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে রৌদ্রের হাত থেকে কাপড়গুলো নিজের হাতে নিয়ে নিলো।নাক টানতে টানতে কাপরগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলো লাগেজে।রৌদ্র আড়চোখে দেখলো সবটা। মনে মনে হাসলো ছেলেটার কর্মকাণ্ড দেখে।

রাত দেড়টা!
চারিদিকে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও রৌদ্রের চোখে ঘুম নেই।বুকটায় কি অসহ্য মাত্রায় যন্ত্রণা হচ্ছে তার।ছেলেটা একবার এদিক, তো আরেকবার ওদিক করতে করতে বিছানায় গড়াগড়ি করলো কিছুক্ষণ। নাহ,তাতেও অশান্ত মন শান্তি পাচ্ছে না। রৌদ্র এবার কোনো কুল-কিনারা না পেয়ে দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।তড়িঘড়ি করে চলে গেলো শাওয়ার নিতে।গোসলটা নিলে যদি খানিকটা স্বস্তি আসে এ দেহে!

প্রায় আধঘন্টার লম্বা শাওয়ার শেষে বেরিয়ে আসে রৌদ্র। ছেলেটার কোমড় বরাবর শুধুমাত্র একটা তোয়ালে পেচিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তাড়াহুড়ায় ট্রাউজার কি আর নিয়েছে সে? রৌদ্র ধীরে ধীরে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়।হাত বাড়িয়ে বিছানার ওপর থেকে এসির রিমোটটা তুলে নেয়।অতপর এসির টেম্পারেচার ১৯° তে রেখে রিমোটটা ছুড়ে ফেলে বিছানার ওপর। রৌদ্র কোমড়ের ওপর দু’হাত রেখে দাঁড়ালো। ছেলেটার উদোম শরীরজুড়ে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা। চুলগুলো থেকে অনায়াসে ঝড়ে পড়ছে পানি।কিন্তু সেদিকে মহাশয়ের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। রৌদ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ঠিক সেই মুহুর্তে তার ঘরের দরজায় কড়া নাড়বার শব্দ হয়।রৌদ্র ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকায়। গলার স্বর উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“ কে?”
ওপাশ থেকে ভেসে আসেনি কোনো শব্দ। রৌদ্র ভ্রু গোটায়। বুকটায় কেমন কেমন যেন অনুভুত হচ্ছে তার।বারেবারে মনে হচ্ছে — ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটি বুঝি তার সানশাইন। রৌদ্র অপেক্ষা করলো একমুহূর্ত।ঠোঁট কামড়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। তখনি আবারও ভেসে আসে কড়া নাড়বার শব্দ। রৌদ্র আর কিছু না ভেবে তড়িৎ গতিতে এসে দরজাটা খুলে দিলো। দরজাটা খুলতেই তার চোখদুটো আপনাআপনি বড়সড় হয়ে গেলো।এ কাকে দেখছে সে? তার সামনে এমুহূর্তে কালো শাড়ি পড়ে দাড়িয়ে থাকা অসম্ভব সুন্দর রকমের মেয়েটা কি সত্যি তার সানশাইন? না-কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে তার? রৌদ্র একবার চোখদুটো বন্ধ করে আবারও খুললো।

নাহ..এবারেও একই দৃশ্য ফুটে উঠেছে চোখের সামনে। অরিন নিখাঁদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে।সে বেশ বুঝতে পারছে, এমুহূর্তে তাকে এভাবে দেখতে পেয়ে ছেলেটা বুঝি ভিষণ অবাক হয়েছে। কিছুক্ষণ পর অরিন নিজে থেকেই রৌদ্রকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে পড়লো।রৌদ্র এখনো হতবিহ্বল। কেন যেন মাথাটা কাজই করছেনা তার।কিয়তক্ষন বাদেই নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিলো রৌদ্র। তারপর অরিনের কাছে এসে, মেয়েটার কনুই চেপে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। উদ্দেশ্য ছিলো মেয়েটাকে দুটো শক্ত কথা বলা কিন্তু ছেলেটার অবস্থা তো যায় যায়! সে কিভাবে বলবে শক্ত কথা? অরিন রৌদ্রের পানে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ চোখে। মেয়েটার চোখদুটোতে কি সুন্দর করে চিকনরেখায় কাজল টানা।

তারওপর আবার আইলাইনারের রেখার স্পষ্ট উপস্থিতি! ঠোঁটে শোভা পাচ্ছে ন্যুড কালার লিপস্টিক। কোমড় সমান ঝলমলে চুলগুলো ছেড়ে রাখা।দেখলে মনে হবে একরাশ কালো মেঘপুঞ্জ! সেই সাথে সোনায় সোহাগা হিসেবে মেয়েটাও কেমন কালো শাড়িতে নিজেকে সাজিয়েছে।কালো শাড়ি পড়ার দরুন মেয়েটাকে বুঝি আরও বেশি সুন্দর লাগছে।রৌদ্র ধীরে ধীরে নিজের খেই হারাচ্ছে। সে তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে সরায়।ইশশ্ বুকটা কেমন কাপছে তার। অরিন মুচকি হাসলো তা দেখে। বুকের মাঝে একরাশ সাহস নিয়ে সে নিজের শীতল হাতটা বাড়িয়ে রাখলো রৌদ্রের গালের ওপর। রৌদ্র চমকালো।তড়িৎ তাকালো অরিনের দিকে। কন্ঠে অবাকের ছাপ ফুটিয়ে বললো,

“ এতো রাতে আমার সামনে এভাবে সেজেগুজেঁ দাঁড়িয়ে আছিস, ভয় লাগছে না তোর? আমি যদি এখন কিছু করে ফেলি?”
অরিন ফের মুচকি হাসলো।আর সঙ্গে সঙ্গেই তার গালদুটোতে দেখা মিললো চিরচেনা গর্তগুলোর।রৌদ্র তৃষ্ণার্ত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। ইতোমধ্যেই গলায় কেমন খরা নেমেছে ছেলেটার। সে ফাঁকে ফাঁকে ঢোক গিলেছে বেশ কয়েকটা।নাহ… তবুও গলাটা একবিন্দুও ভিজেনি তার।অরিন এবার কেমন করে যেন বলে ওঠলো,
“ যার কাছে আমার সকল ভয়ের অবসান, তার কাছে আসতে আবার কিসের ভয়?”
রৌদ্র অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। আজ ঠিক কতগুলো দিন পর আবারও মেয়েটা সে-ই আগের মতো কথাগুলো বলছে!রৌদ্রের বুক কাঁপছে। ছেলেটা ক্ষনে ক্ষনে জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিচ্ছে। অরিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবারও বললো,

“ জানেন এটা কোন শাড়িটা?”
রৌদ্র কেমন চোখে হাসলো।সে মেয়েটার চোখের দিকে চোখ রেখে নিরেট কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ এটা সেই শাড়ি যেটা পড়ে তুই প্রথমবারের মতো আমায় নিজের ভালোবাসার কথাটা জানান দিয়েছিলি।আর আজকে তুই ঠিক সেদিনের মতো করেই সেজেছিস সানশাইন।ঠিক সেদিনের মতো।”
অরিন বোধহয় বিজয়ী হাসলো।সে রৌদ্রের থেকে খানিকটা দূরে সরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ কেমন লাগছে আমায়?”
“ মারাত্মক সুন্দর!”
“ আপনাকে পাগল করে দেওয়ার মতো সুন্দর?”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৭

এপর্যায়ে রৌদ্র বাঁকা হাসলো।কদম বাড়িয়ে মেয়েটার কাছে এসে এক ঝটকায় অরিনের কোমর চেপে ধরে তাকে নিজের একেবারে কাছাকাছি নিয়ে এলো।তারপর নেশালো কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ আমাকে মেরে ফেলার মতো সুন্দর!”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here