সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৯

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৯
Jannatul Firdaus Mithila

“আমাকে মেরে ফেলার মতো সুন্দর!”
অরিন ঠোঁট কামড়ে হাসলো। রৌদ্রের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে বললো,
“ আজকের রাতটা আমায় দিবেন ডাক্তার সাহেব? কথা দিচ্ছি…. আর জ্বালাবো না আপনাকে!”
রৌদ্র ভ্রু কুঁচকালো।মেয়েটার দিকে তাকালো একরাশ বিভ্রান্তি নিয়ে। অরিনের কোমরের ওপর চেপে রাখা হাতটা আরও কিছুটা দৃঢ় করে বললো,

“ মানে?”
এহেন কথার প্রতিত্তোরে অরিন হালকা হাসলো শুধু। মেয়েটার চোখেমুখে কেমন যেন রহস্য রহস্য ছাপ! ভাব এমন — সে বুঝি খুব সন্তর্পণে কিছু একটা লুকিয়ে যাওয়ার বেশ প্রয়াস চালাচ্ছে।রৌদ্র এবার মেয়েটার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।তা দেখে অরিন তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অন্যদিকে।রৌদ্রের হাতের বাঁধনে থেকেই বলতে থাকে,
“ এভাবে তাকাবেন না ডাক্তার সাহেব! মনের কথা পড়ে ফেলবেন যে! এতো সহজে কি আর তা হতে দেওয়া যায় বলুন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এপর্যায়ে কুঁচকে থাকা ভ্রু যুগল আরও খানিকটা কুঁচকে আসে রৌদ্রের।সে তৎক্ষনাৎ অরিনের চোয়ালে আলতো করে হাত রেখে,মেয়েটার ছোট্ট মুখখানা নিজের দিকে ঘোরায়।অতঃপর কেমন অস্থির গলায় বলে ওঠে,
“ কি হয়েছে তোর? এভাবে প্রহেলিকায় কথা বলছিস কেন?”
অরিন আলতো হাসলো।প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো,
“ আমার না ভিষণ প্রেম প্রেম পাচ্ছে ডাক্তার সাহেব!”

এহেন কথায় রৌদ্র অরিনের কোমর আঁকড়ে তাকে আরেকটু কাছে টেনে আনলো। তারপর মেয়েটার মুখের দিকে চাইলো নেশালো দৃষ্টি নিয়ে। অরিনের সুশ্রী মুখখানায় ইতোমধ্যেই এসে জমাট বেঁধেছে রাজ্যের সব লজ্জা।ছেলেটার ওমন দৃষ্টি দেখলে লজ্জা কি আর না পেয়ে থাকা যায়? লজ্জা পাওয়ার দরুন মেয়েটার নাকের পাটাটাও কেমন লাল হয়ে এসেছে! গালদুটোতেও দেখা মিলেছে এক রক্তিম আভার।অরিন মাথাটা নুইয়ে রেখেছে।হয়তো লজ্জার ভারে মাথাটা আপনা-আপনি নুইয়ে এসেছে তার।রৌদ্র হাসলো একটুখানি।সে হাত বাড়িয়ে মেয়েটার মুখের ওপর এসে আছড়ে পড়া অবাধ্য চুলগুলোকে আলতো করে সরিয়ে, কানের পিঠে গুঁজে দিলো।অতঃপর ধীরেসুস্থে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে বসলো মেয়েটার ফোলা ফোলা ডান গালটায়!অরিন মাথা নিচু রেখেই নিঃশব্দে হাসলো।রৌদ্র হয়তো টের পেলো সে-ই হাসিটা! সে আবারও চুমু খেয়ে বসলো একই জায়গায়। এবারেও অরিন মুচকি হাসলো।রৌদ্র তা টের পেয়ে অরিনের থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে মুখটা খানিক উঁচু করে তুললো।অরিন চোখ তুলে তাকালো।তার চাহনিতে বুঝি একরাশ মাদকতা লেপ্টে আছে আজ! রৌদ্র অবাক হয়ে দেখলো মেয়েটার এহেন গভীর চাহনি। সে অরিনের থুতনি হতে আঙুল সরিয়ে, মেয়েটার গালের ওপর বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে কেমন শান্ত কন্ঠে বলে ওঠলো,

“ কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেনো আজ? কি চাই?”
“ তোমাকে!”
রৌদ্রের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কথাটা বলে ওঠে অরিন।রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে ধরলো নিজের। মেয়েটার দিকে কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফের বলে ওঠলো,
“ আমাকে দিয়ে কি করবে হানি?”
অরিন ঢোক গিললো সামান্য।এপর্যায়ে শব্দ বুঝি হারিয়ে ফেলেছে সে! সে খানিকক্ষণ দোনোমোনো করতে লাগলো। রৌদ্র দেখলো সবটা। সে নিজের মুখটা এগিয়ে নিলো অরিনের কান বরাবর। তারপর কেমন ফিসফিস করে বললো,
“ বাসর করবে হানি?”

ছেলেটার এহেন কথায় তৎক্ষনাৎ অরিনের শীরদাড়া বেয়ে বুঝি এক শীতল স্রোত নেমে গেলো। মাথাটা কেমন ভো ভো করছে তার! কানদুটোও কেমন ঝা ঝা করছে এখন।আর দেহখানার কথা না-ই বা বলি! সেটাতো কেমন অবশ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। অরিন ফাঁকা ঢোক গিললো কয়েকটা। রৌদ্র তখন আলতো করে কামড় বসিয়ে দিলো অরিনের কানের লতিতে।এহেন স্পর্শ পেয়ে তৎক্ষনাৎ মৃদুস্বরে গুঙিয়ে ওঠে মেয়েটা।তার হাতদুটো অজান্তেই খামচে ধরে রৌদ্রের উম্মুক্ত বক্ষ।রৌদ্র বাঁকা হাসলো। অরিনের কান থেকে গাল অবধি নিজের নাক ঘষে দিয়ে,কেমন হাস্কি স্বরে বলতে লাগলো,

“ এইটুকুতেই এই হাল বউজান? বাকিটা করতে গেলে আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাবে তো?”
অরিন বুঝি ভাষা হারিয়ে ফেললো এবার।মেয়েটা নিজের কাঁপা কাঁপা ঠোঁটদুটো মৃদুমন্দ নাড়াতে লাগলো।হয়তো কিছু বলার চেষ্টা চালাচ্ছে সে,কিন্তু বেইমান শব্দগুলো গলা থেকে বেরুলে তো! রৌদ্র আড়চোখে তাকালো অরিনের দিকে। কিয়তক্ষন বাদেই সে মেয়েটার কোমর ছেড়ে দিয়ে একহাত দূরে সরে দাঁড়ালো।অরিন তখন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে। রৌদ্র হালকা হেসে বললো,
“ জোর করে তোর সাথে এসব কিছু করার হলে এতোদিন ধৈর্য্য ধরে থাকতাম না সানশাইন! আমি ঠিকই নিজের ব্যাক্তিগত জিনিস আদায় করে নিতাম এতোদিনে।তাছাড়া… তুই না-কি আমায় ভালোবাসিস না! যাকে ভালোবাসিস না, তার ছোঁয়া পেলে নিশ্চয়ই খুব একটা ভালো লাগবে না তোর।তাই-না?”
অরিন তৎক্ষনাৎ ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। নিজের হয়ে সাফাই দেওয়ার সুরে বলতে থাকে,

“ না..আপনি ভুল ভাব….”
বাকিটা বলার আগেই রৌদ্র হাত উঠিয়ে মেয়েটাকে থামিয়ে দেয়।মুখাবয়বে যথেষ্ট গম্ভীরতার ছাপ ফুটিয়ে বলে,
“ নো মোর লেইম এক্সকিউজেস!এক্ষুনি ঘরে যা!”
অরিন বুঝি এবার গো ধরে বসলো একপ্রকার। সে রৌদ্রের দিকে দু-কদম এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। রৌদ্রের হাতদুটো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে করুণ সুরে বললো,
“ এমন করছেন কেনো? আমাকে এটলিস্ট বলতে তো দিন!”
রৌদ্র নিজের হাতদুটোকে অরিনের হাতের মাঝ হতে ছাড়িয়ে নিলো।তারপর নিজের ঠোঁটের কোণে কেমন তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলে ওঠলো,

“ এতোদিন তো শুনতেই চেয়েছিলাম সানশাইন! কিন্তু তুই বলিসনি।আজকে তুই বলতে চাচ্ছিস কিন্তু আমি শুনতে মোটেও ইচ্ছুক নই।সিম্পল ব্যাপার…ঘরে যা প্লিজ।”
এহেন কথায় অরিন কেমন আহত চোখে তাকালো রৌদ্রের পানে।মেয়েটার চোখদুটোও যেন আজ চিৎকার দিয়ে কথা বলতে চাইছে কিন্তু কপাল দেখো…. আজকে তার একান্ত মানুষটাই তার কোনো কথা শুনতে চাচ্ছে না।অরিন কিছুক্ষণ নিরব রইলো।তার চোখবেয়ে টুপ করে ঝড়ে পড়লো দুফোঁটা নোনাজল। রৌদ্র অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। মেয়েটার দিকে তাকালেই নিজেকে দূর্বল লাগে তার।তাই বোধহয় অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে।কিয়তক্ষন বাদে অরিন নিজের হাতের উল্টো পিঠে চোখদুটো কোনমতে মুছে নিয়ে রৌদ্রের দিকে তাকালো।ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলো,

“ যাবো না আমি!”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ নিজের কটমট দৃষ্টি এনে তাক করলো অরিনের ওপর। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,
“ তুই যাবি না মানে? তোর ঘাড় সহ যাবে…চল!”
বলেই সে এগিয়ে এসে অরিনের হাতের কনুই চেপে ধরলো।মেয়েটাকে নিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,
“ অনেক নাটক করেছিস হানি!তোর এই নাটক দেখার জন্য আমার মধ্যে আর ধৈর্য্য অবশিষ্ট নেই। সো লিভ!”
অরিন নিজের হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টায় তৎপর। কিন্তু ছেলেটার ওমন পুরুষালী শক্তির সাথে তার মতো চুনোপুঁটি কি আর পেরে ওঠে? তবুও সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দরজার কাছে আসতেই সে নিজের হাতটা রৌদ্রের হাত থেকে ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়।অতঃপর রৌদ্রের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে জোরালো কন্ঠে বলে ওঠে,
“ কি সমস্যা আপনার? এমন করছেন কেনো আমার সাথে? শুধু শুধু কেনো এমন ভাব নিচ্ছেন?”
রৌদ্র নিশ্চুপ!সে হয়তো প্রয়োজন মনে করলোনা মেয়েটার প্রশ্নের জবাব দিতে। সে আগের ন্যায় মুখভঙ্গি যথেষ্ট শক্ত রেখে বলে,

“ তোর সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে না আমার।তাই বলছি চলে যা!”
এমন কথায় অরিন তৎক্ষনাৎ শ্লেষাত্মক হেসে ওঠে।তা দেখে রৌদ্র ভ্রু কুঁচকায়।অরিন তখন খানিকটা এগিয়ে এসে রৌদ্রের বুকের ওপর হাত রাখলো।ছেলেটার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চুক চুক চুক শব্দ করে ধীমী স্বর বললো,
“ কার সামনে কেমন তা জানিনা,কিন্তু আমার সামনে অভিনয়ে আপনি বড্ড কাঁচা ডাক্তার সাহেব! তাই বাদ দিন এসব!”
রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো।মেয়েটার দিকে চাইলো সন্দিগ্ধ চোখে।অতপর ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে ভরাট কন্ঠে বলতে লাগলো,

“ আমার দূর্বলতা গুলোই আজকে তোর পুঁজি সানশাইন! যেভাবে ইচ্ছে খরচ কর! আমি কিচ্ছুটি বলবোনা।কিন্তু… আপাতত এখান থেকে চলে যা।”
অরিন মাথা নাড়ায়। সে কেমন উদভ্রান্তের মতো করে বলে ওঠে,
“ আজকে কোত্থাও যাবো না আমি ডাক্তার সাহেব!আজকের পুরো রাতটা আমার।”
রৌদ্র বুঝি এবার বিরক্ত হলো।মেয়েটা কেনো বুঝছে না তার মনের অবস্থাটা? কেনো এমন মিছে মিছে জেদ ধরছে সে? রৌদ্র এবার আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে যেতে পা বাড়ায়। কিন্তু তখনি ঘটলো আরেক বিপত্তি! অরিন রৌদ্রকে থামাতে তেমন কিছু না ভেবেই রৌদ্রের কোমরে বাঁধা তোয়ালেটা টেনে ধরে।আর তক্ষুনি টেনে ধরার দরুন তোয়ালেটা বুঝি খানিকটা ঢিলে হয়ে গেলো। রৌদ্র তৎক্ষনাৎ তোয়ালেটা মুষ্টিবদ্ধ করে চেপে ধরলো নিজের সঙ্গে।ইশশ্ আরেকটু হলেই ছেলেটার ইজ্জতের রফাদফা বুঝি এখানেই শেষ হতো আজ!

এদিকে,ঘটনার আকস্মিকতায় অরিন যেন হতভম্ব হয়ে গেলো!সে-তো আর ইচ্ছে করে এমনটা করেনি।হাতে টান লেগে যাওয়ায় না এমনটা হয়ে গেলো!মেয়েটা তৎক্ষনাৎ নিজের হাতদুটো গুটিয়ে নেয়। এখন কেমন নিজেরই লজ্জা লাগছে তার! ইশশ্ আরেকটু হলেই কি না-কি হয়ে যেতো তা ভাবতেই গা কেমন শিউরে ওঠছে তার।অন্যদিকে,রৌদ্রের মুখাবয়ব শক্ত হয়ে এলো এবার। ছেলেটার দৃঢ় চোয়ালখানা বুঝি আরেকটু শক্ত হয়ে
এলো এমুহূর্তে।সে সময় নিয়ে নিজের কোমরের ওপর তোয়ালেটা শক্ত করে বেধেঁ নিলো।তারপর অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকালো।অরিন ভড়কে যায় ছেলেটার এমন দৃষ্টি দেখে। সে কেমন আমতাআমতা করতে লাগলো! মুখ ফুটে যে-ই না কিছু বলতে যাবে তার আগেই রৌদ্র করে বসলো আরেক কান্ড! সে তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এসে হিংস্র থাবায় চেপে ধরলো অরিনের নরম চোয়ালখানা।আর সঙ্গে সঙ্গেই চোয়ালের ব্যাথায় মৃদু ককিয়ে উঠে অরিন। ব্যাথায় মুখটা কেমন নিমিষেই লাল হয়ে গেলো মেয়েটার! অথচ সেদিকে কোনরূপ ধ্যান নেই রৌদ্রের।সে কেমন দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,

“ঐ কি মনে করিস তুই আমাকে? আমাকে কি রাস্তার ছেলে পেয়েছিস? তুই যখন চাইবি তখন তোর পিছন পিছন ঘুরবো,আবার যখন চাইবি তখনি দূরে চলে যাবো…কেনো রে? তুই কে? নেহাৎ তোকে ভালোবাসি বিধায় তোর সকল ভুল-ত্রুটিগুলোকে একপ্রকার অদেখা করি আমি,তাই বলে কি তুই আমার মাথায় চড়ে বসবি? শুনে রাখ মেয়ে….তোর ভাগ্য ভালো আমি তোকে ভালোবাসি। তা নাহলে এতোদিনে এই ইফতেখার এহসান রৌদ্রের আসল রুপ দেখিয়ে ছাড়তাম তোরে। আমি যে ঠিক কতোটা হিংস্র তা ঘুনাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারবিনা তুই! বেয়াদব মেয়েছেলে…. আমার নাকেমুখে দম করে এখন আসছিস নাটক করতে? তোরে ভালোবাসি বিধায় তুই যা ইচ্ছে তা-ই করবি? ঐ.. যেখানে কোনো ভুল হলে আমি নিজের পরম আপনজনকেই উচিত শিক্ষা না দিয়ে ছাড়ি না, সেখানে তুই আমার কোন চ্যা*টের বাল? বেয়াদব… দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে।একদম বেরিয়ে যাবি রুম থেকে।নাহলে…. ”

বাকিটা আর বললো না রৌদ্র। দাঁত কিড়মিড় করে মেয়েটার চোয়াল ছেড়ে দিলো সাথে সাথে। অরিন মাথা নুইয়ে কাঁদছে বোধহয়। তার থেকে কেমন ক্ষনে ক্ষনে নাক টানার শব্দ আসছে।রৌদ্র কোমরের ওপর দু’হাত রেখে দাঁড়ায়।রাগে গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তার! মেয়েটাকে ইচ্ছেমতো কয়েক দফা ঝাড়ি দিতে পারলে বোধহয় শান্তি হতো তার। রৌদ্র কিছুক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। মুখভঙ্গি তার এখনো আগের ন্যায় শক্ত হয়ে আছে। কিয়তক্ষন বাদেই সে গটগট পায়ে চলে গেলো অরির সামনে থেকে। অরিন মাথা নুইয়ে কাঁদছে নিঃশব্দে। একটু পরপর হাতের উল্টো পিঠে চোখদুটো কোনমতে মুছেও নিচ্ছে। তবুও লাভের লাভ তো হলোই না কিছু… বরঞ্চ কান্না আরও বাড়ছে তার।মেয়েটার খুব করে মন চাইছে — গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে।কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় তা আর সম্ভব হচ্ছে না তার জন্য!

কিছুক্ষণ পর রৌদ্র শক্ত মুখে এগিয়ে এলো অরিনের কাছে।ছেলেটার সারা মুখে কেমন পানির ফোঁটা লেপ্টে আছে! এতক্ষণ বোধহয় ওয়াশরুমেই ছিলো সে।রৌদ্র সরু চোখে তাকালো মেয়েটার নুইয়ে রাখা মুখটার দিকে।আহারে!মেয়েটার দুগালে কেমন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার শক্তপোক্ত আঙুলের ছাপ।রৌদ্র আহত হলো তা দেখে। সে নিজের কৃতকর্মের জন্য মনে মনে একরাশ অপরাধবোধ অনুভব করলো।কিছুক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই মেয়েটার শাড়ির আঁচল ধরে টেনে বললো,
“ আয় আমার কাছে!”

অরিন নড়লো না।সে নিজের শাড়ির আঁচল খামচে ধরে দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে। রৌদ্র শান্ত চোখে চাইলো মেয়েটার দিকে। অতঃপর আর কোনোদিক না তাকিয়ে ফট করে মেয়েটাকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো রৌদ্র। হঠাৎ এহেন কান্ডে অরিন খানিকটা হকচকিয়ে ওঠে। সে তৎক্ষনাৎ চেপে ধরে রৌদ্রের কাঁধ। রৌদ্র মুখভঙ্গি যথেষ্ট গম্ভীর রেখে মেয়েটাকে নিয়ে এগিয়ে গেলো নিজের বিছানায়। তারপর মেয়েটাকে আলতো করে বসিয়ে দিলো বিছানার ওপর। অরিনটা এখনো মাথা নুইয়ে রেখেছে।ক্ষনে ক্ষনে শুধু নাক টানছে সে।রৌদ্র তড়িঘড়ি করে টেবিলের ওপর আগে থেকেই বের করে রাখা ফার্স্ট এইড বক্সটা হাতে নিয়ে অরিনের মুখোমুখি হয়ে বসলো। তাকে নিজের সামনে বসতে দেখে অরিন নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিলো। রৌদ্র তখন দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে মৃদু ধমকে বললো,
“ এই মেয়ে…এবার কিন্তু কোলে তুলে আছাড় মারবো! চুপচাপ কাছে আয়।”

অগত্যা এহেন ধমকে অরিন পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে এগিয়ে এলো কিছুটা। রৌদ্র মেয়েটার অলক্ষ্যে মুচকি হাসলো। হাত বাড়িয়ে ফার্স্ট এইড বক্স থেকে অয়েন্টমেন্ট বের করে নিলো।তারপর সেখান থেকে বিন্দু পরিমাণ অয়েন্টমেন্ট নিয়ে মেয়েটার গালের ওপর দাগ বসে যাওয়া জায়গাগুলোতে একটু একটু করে লাগিয়ে দিলো।এই পুরোটা সময় অরিন ছিলো একেবারেই নির্বিকার। রৌদ্র নিজের হাতের কাজ শেষে মেয়েটার থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে মুখটা খানিক উঁচু করে তোলে।তারপর কেমন শান্ত কন্ঠে বলে,
“ খুব ব্যাথা লাগছে বউজান?”

অরিন আবারও ক্ষুদ্র নাক টানে। মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে না জানায়।তা দেখে রৌদ্র বুঝি হাসলো খানিকটা।সে মেয়েটার সিক্ত চোখদুটো নিজের হাত দিয়ে মুছিয়ে বলে,
“ বড় হয়ে গিয়েছিস জানবাচ্চা! যাক আলহামদুলিল্লাহ! এবার থেকে নাহয় নিজের খেয়ালটা নিজেই রাখতে পারবি!”
অরিন নিশ্চুপ! মুখে কোনো রা-শব্দ নেই মেয়েটার।তা দেখে রৌদ্র কেমন ফিচেল হেসে বলতে লাগলো,
“ সানশাইন! জানিস? এর আগেও এভাবেই একবার সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম আমি।কিন্তু তখন ব্যাপারটা ছিলো একেবারেই ভিন্ন। তখন আমার মধ্যে ছিলো এক অজানা তৃষ্ণা!ছিলো বাড়িতে ফিরে এসে কাওকে নিজের খুব আপন করে নেওয়ার মতো এক অবাধ আকাঙ্খা। কিন্তু এখন? এখন সে-ই আকাঙ্ক্ষা গুলো কোথায় পালালো সানশাইন?”

রৌদ্র থামলো।অরিনের দিকে চাইলো আহত চোখে। মেয়েটার একেবারে কাছে এসে, তার কোমর আকড়ে ফের বললো,
“ জানিস? তখন আমার যাওয়া নিয়ে আমার ছোট্ট জানবাচ্চাটা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলো।তার কান্না আমার সহ্য হবে না বিধায় তাকে ঘুমে রেখেই চলে গিয়েছিলাম আমি।কিন্তু এখন? এখন আমি আমার সে-ই ছোট্ট জানবাচ্চাটাকে কাঁদিয়ে চলে যাচ্ছি!হুট করেই আমি কেমন নিষ্ঠুর হয়ে গেলাম তাই-না?”
অরিন বোধহয় ভেজা চোখে হাসলো খানিকটা। সে নিজ থেকে একহাত বাড়িয়ে রাখলো রৌদ্রের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আবৃত বাম-গালের ওপর। রৌদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হয়তো বুঝতে চেষ্টা চালাচ্ছে মেয়েটার এহেন কর্মকান্ডের কারণ! কিয়তক্ষন চুপ থেকে অরিন কেমন অদ্ভুত শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
“ আমাকে সাজিয়ে তুমি চলে যাবে? আবারও একা করে দিবে আমায়?”

রৌদ্র থমকায়। অরিনের দিকে তাকায় হতবাক চোখে।হঠাৎ করেই বুকের মাঝে কেমন ব্যাথা উঠছে মনে হচ্ছে।আশ্চর্য! তার মতো ওমন তাগড়া যুবকেরও কি বুকে ব্যাথা উঠে? কি এক অলক্ষুনে কান্ড! তারও যে বুকে ব্যাথা উঠে গেলো মেয়েটার কথা শুনে। কি ছিলো মেয়েটার কথায়? কেনো তার মনে হলো — মেয়েটা বুঝি বহুকষ্টে এই কথাটুকু ঠোঁটের আগায় এনেছে। তাছাড়া মেয়েটা তো ভুল কিছু বলেনি! সে-তো সত্যি চলে যাচ্ছে কাল।চলে যাবার জন্য সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলে এখন আবার কষ্ট পাচ্ছে কেনো সে?

এহেন কথা ভাবতে ভাবতেই রৌদ্রের দমটা বুঝি বন্ধ হয়ে এলো।সে তৎক্ষনাৎ অরিনের কোমর ছেড়ে দেয়। ছেলেটার দৃষ্টি কেমন এলোমেলো। শরীরটাও বুঝি কাঁপছে মৃদুমন্দ! সে তড়িঘড়ি করে বসা ছেড়ে উঠে পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়ায়।হয়তো নিজের এহেন ভেঙে পড়াটা মেয়েটার কাছ থেকে আড়াল করতে চাইছে সে।রৌদ্র কোমরের ওপর দু’হাত ঠেকিয়ে লম্বা লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর বৃথা প্রয়াস চালায়।এদিকে, অরিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের পিঠ বরাবর। তার চোখদুটোতেও স্পষ্ট বিষাদের উপস্থিতি! বুকে জ্বলছে এক নিদারুণ হাহাকার। যে-ই হাহাকারের প্রতিধ্বনি একমাত্র তার কানে এসেই বাজছে বারংবার। অরিন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। রৌদ্রের পিঠের ওপর নিজের কপাল ঠেকায়।রৌদ্র মেয়েটার এহেন স্পর্শ পাওয়া মাত্রই ঠোঁট কামড়ে চোখবুঁজে নিলো।হয়তো নিজের মনের নরম হয়ে আসাটা খানিক ঠেকাতেই এই উদ্যোগ তার।কিয়তক্ষন বাদেই রৌদ্র টের পেলো তার পিঠের ওপরটা কেমন ভেজা ভেজা লাগছে।ছেলেটার আর বুঝতে বাকি নেই — মেয়েটা যে নিঃশব্দে কাঁদছে! রৌদ্র তৎক্ষনাৎ পেছনে ফিরে।তারপর আর কোনো সাত-পাঁচ না ভেবে কান্নারত অরিনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সঙ্গে। অরিন বুঝি রৌদ্রের ছোঁয়া পেতেই গুড়িয়ে গেলো খানিকটা। সে কেমন শব্দ করে ফুপিয়ে ওঠলো! রৌদ্র তখন অস্থির হয়ে জুড়িয়ে আসা কন্ঠে বলতে লাগলো,

“ হুঁশ! কাঁদবি না… একদম কাঁদবি না। আমার মরণ হবার আগে তোর চোখদুটো থেকে যেন আর কোনো অশ্রু না ঝড়ে!আমি যেদিন এই পৃথিবী থেকে চলে যাবো, সেদিন নাহয় বুক ভাসিয়ে কাঁদবি! কিন্তু… এর আগে কাঁদবি না তুই!”
অরিনের কান্নার বেগ বাড়লো বৈ কমলো না।সে রৌদ্রের বাহুডোরের বাঁধন থেকে ছুটতে চাইলে রৌদ্র তাকে আরেকটু চেপে ধরে নিজের সঙ্গে। মোটা হয়ে আসা কন্ঠে বলে,
“ নড়িস না সানশাইন! একটুখানি শান্তি পেতে দে আমায়।বুকটা কেন যেন খুব জ্বলছে রে!একটু ঠান্ডা হতে দে বুকটা…এরপর ছেড়ে দিবো তোকে..প্রমিস!”
রৌদ্রের এমন কথা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই হু হু করে কেঁদে উঠে অরিন।রৌদ্র তৎক্ষনাৎ মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে, তার পায়ের কাছে মাথানিচু করে বসে পড়ে।দু’হাত দিয়ে অরিনের পাদু’টো নিজের বুকে চেপে ধরে,কান্নায় ভেঙে পড়া কন্ঠে থেমে থেমে বলে ওঠে,

“ দয়া কর সানশাইন!দয়া করে কান্না থামা।তোর কান্না আমার সহ্য হয়না বউজান! আমি মরে যাচ্ছি! সত্যি মরে যাচ্ছি…. তোর… দরকার হয় তুই আমায় মেরে ফেল।কসম খোদার.. আমি কিচ্ছু বলবো না।তবুও আল্লাহর দোহাই লাগে তুই কান্না থামা।আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”
রৌদ্রের এমন আহাজারি দেখে অরিনের কান্নাগুলো যেন দলা পাকিয়ে গেলো গলার ধারে।মেয়েটা নিজের সমস্ত কান্নাগুলো কেমন গিলে নিলো একপ্রকার। সে ধীরে ধীরে নিচু হয়ে এলো।রৌদ্রের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো আলগোছে।রৌদ্র এখনো মেয়েটার পাদু’টো জড়িয়ে রেখেছে নিজের সঙ্গে। ছেলেটার বদনখানি কেমন ক্ষনে ক্ষনে কাঁপছে! আচ্ছা… সে কি কাঁদছে? অরিন রৌদ্রের নত মুখখানা নিজের নরম হাতের তালুতে নিয়ে, মুখটাকে খানিক উঁচু করে তুললো।আর তৎক্ষনাৎ সে ভড়কে গেলো ছেলেটার অবস্থা দেখে! কাঁদতে কাঁদতে মুখটার সেকি বেহাল দশা হয়েছে ছেলেটার! চোখদুটো হয়ে গেছে রক্তবর্ণ। শ্যামবরণ সুশ্রী মুখখানায় লেপ্টে আছে চোখের পানি।অরিনের বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠলো।সে তৎক্ষনাৎ রৌদ্রের মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে। কাঁপতে কাঁপতে বলে,

“ সামলান নিজেকে ডাক্তার সাহেব! এভাবে ভেঙে পড়লে কিভাবে হবে বলুন? আমারও যে কষ্ট হচ্ছে আপনাকে এভাবে দেখে।”
রৌদ্র নিজের হাতদুটো দিয়ে মেয়েটার কোমর চেপে ধরলো ।খানিকটা ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো বউজান? কেনো এতোটা দূর্বল হয়ে গেলাম আমি? আমার….আমার ভালোবাসাটা এমন অপূর্ণ রয়ে গেলো কেনো? কেনো তোকে নিজের করে পেয়েও হারিয়ে ফেলতে হচ্ছে আমার?”
অরিন পারলোনা এহেন কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলতে। পারবেই বা কিভাবে? ছেলেটার কথাগুলো যে একেবারে বুকে এসে বিঁধছে তার।এই ব্যাথা নিয়ে কি আর কিছু বলা যায়?
বেশ কিছুক্ষণ পর রৌদ্র নিজেকে সামলে নিলো।সে মেয়েটার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে পড়লো।অরিনও দাঁড়ালো সাথে সাথে। রৌদ্র তখন খানিক ফিচেল হেসে বললো,

“ যাহ! আবারও কাঁদিয়ে দিলাম তোকে! উমমম…সরি রে বউজান…”
বলেই ছেলেটা কেমন চমৎকার হাসলো। আর অরিন? সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার ওমন হাসির দিকে। আশ্চর্য! আজ ছেলেটার হাসিতে কোনো প্রান নেই কেনো? অথচ এই হাসিতেই কয়েকশো বার অনায়াসে নিজের জান কোরবান করতে রাজি মেয়েটা।রৌদ্র মেয়েটার দিকে চাইলো এক নিখাঁদ দৃষ্টিতে। যে-ই দৃষ্টি অরিনের ভেতরের সবটাই যেন লন্ড-ভন্ড করে দিতে সক্ষম! মেয়েটা তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে এনে বলে ওঠে,
““আপনার ঐ বেড়াল চোখদুটো দিয়ে এভাবে তাকাবেন না ডাক্তার সাহেব! আমার নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে।আর কত পাগল করবেন আমায়?”

রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে হাসলো। অরিনের দিকে আগের ন্যায় গভীর চোখে তাকিয়ে, নেশালো কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ চলে যা সানশাইন!আমি হয়তো নিজের খেই হারাচ্ছি ধীরে ধীরে!”
অরিন এবার চোখ সরু করে চাইলো রৌদ্রের দিকে। খানিকটা এগিয়ে এসে দাঁড়ালো রৌদ্রের মুখোমুখি। অতঃপর ঘাড় উঁচিয়ে তাকালো রৌদ্রের দিকে।মেয়েটা আবার ছেলেটার তুলনায় বেশ ছোটোখাটো কি-না! রৌদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার প্রাণভোমরার দিকে।মেয়েটা যে কেনো তাকে এতো জ্বালাচ্ছে কে জানে! এমনিতেই তার মনটা সারাক্ষণ বউ বউ করে…তারওপর মেয়েটার এমন নিজ থেকে পরীর মতো সেজেগুজে তার সামনে চলে আসা! কান্নাকাটি করে চোখমুখ লাল করে ফেলা।তাছাড়া অতিরিক্ত কান্নার তোড়ে গালদুটোও কেমন টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে মেয়েটার।রৌদ্রের বুঝি ইচ্ছে করছে এক্ষুণি কামড়ে খেয়ে ফেলতে সেই ফোলা ফোলা গালদুটো।মেয়েটার নাকটাও যেন সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় নেমেছে আজ।নাকের ডগাটা কেমন লাল টুকটুক হয়ে গেছে! উফফ!এমুহূর্তে কি যে একটা অবস্থা হচ্ছে না ছেলেটার,তা যেন বোঝানো বড় দায়! রৌদ্র তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরায়।আরও কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে একইভাবে তাকিয়ে থাকলে সে নিশ্চয়ই নিজের ধৈর্য্যের ওপর ভরসা রাখতে পারবেনা।সে হালকা ঢোক গিলে কোনমতে বলে,

“ ঘরে যা মেয়ে! আমি কিন্তু রাতের বেলায় মোটেও ভদ্র ছেলে নই!নিজের ভালো চাইলে চলে যা!”
অরিন বাঁকা চোখে তাকালো রৌদ্রের দিকে।অতঃপর কোনো বলা কওয়া ছাড়াই সে হুট করে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে বসলো ছেলেটার এডামস আপেলে। রৌদ্র তৎক্ষনাৎ কেঁপে ওঠলো খানিকটা।সে চোখবুঁজে আবারও ঢোক গিললো।তা দেখে অরিন মুচকি হাসলো।
সে তৎক্ষনাৎ ছেলেটার পানে একপ্রকার আবদার করে বললো,
“ একটু উপরে তুলবেন প্লিজ!”
রৌদ্রের একবার ইচ্ছে করলো মেয়েটাকে দুয়েকটা শক্ত কথা শোনাতে,কিন্তু বেচারার কি আর ওতো সাধ্যি আছে? কিছুক্ষণ আগের বলা কথাগুলোই এখনো মাথা থেকে সরছেনা তার সেখানে এখন আবার শক্ত কথা তার মুখ দিয়ে বেরোবে?

রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে চাইলো অরিনের দিকে। মেয়েটার নেশালো চোখের দিকে তাকাতেই তার চোখদুটো যেন আঁটকে গেলো সেথায়। ছেলেটা খুব করে চাইছে, অরিন যেন নিজ থেকেই এখান থেকে চলে যায়।কেননা সে যে ধীরে ধীরে নিজের সকল নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে!
রৌদ্র পরপর দুটো শুকনো ঢোক গিললো।এই এক জ্বালা তার! মেয়েটার কাছে এলেই কোত্থেকে যে এতো তেষ্টা পায় তার, কে জানে!গলাটা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। একটু পানি মিললে বোধহয় বেশ সুবিধে হতো এমুহূর্তে।রৌদ্র আর সাত-পাঁচ না ভেবে অরিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়,ঠিক তখনি তার একহাতের কব্জি পেছন থেকে টেনে ধরলো অরিন।রৌদ্রের পাদু’টো থামলো সেই সাথে বেড়ে গেলো তার হৃৎস্পন্দনের গতি।ছেলেটা খানিক ঢোক গিলে চোখবুঁজে নিলো আলগোছে। তারপর কেমন হাস্কি স্বরে বলে ওঠে,

“ জ্বালাস না জানবাচ্চা! নিজেকে বহুকষ্টে আঁটকে রেখেছি,দয়া করে আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিস না।বিশ্বাস কর, একবার এই বাঁধ ভেঙে গেলে — তোর কপালে শনি লাগবে।”
কথাটা শেষ হবার সাথে সাথেই অরিন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো রৌদ্রকে।রৌদ্র থমকায়।গলার স্বর যেন এমুহূর্তে হারিয়ে ফেলেছে সে।বুকের খাঁচায় বন্দীরত হৃদয়খানা যেন এক্ষুণি বেরিয়ে আসবে তার জায়গা হতে। অরিন নিজের হাতদুটো রৌদ্রের বুক বরাবর উঠিয়ে আনলো।এহেন স্পর্শে ধীরে ধীরে কাহিল হতে লাগলো রৌদ্র।কিয়তক্ষন নিরবতা চললো দু’জনার মাঝে।তারপর হুট করেই শোনা গেলো অরিনের দৃঢ় কন্ঠ!
“ আমাকে আপনার না করেই চলে যাবেন ডাক্তার সাহেব? অন্তত আপনার অবর্তমানে বেঁচে থাকার মতো শক্তিটুকু তো দিয়ে যান!”

রৌদ্র নিজের শুষ্ক অধরজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো খানিকটা।তারপর সে ধীরে ধীরে অরিনের হাতটা নিজের বুকের ওপর থেকে নামিয়ে, পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো,অরিন কেমন গভীর চাহনি নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রৌদ্র আলতো করে হাত বাড়িয়ে অরিনের কোমর চেপে, তাকে নিজের বুকের কাছে টেনে আনলো।তারপর মেয়েটাকে খানিকটা উচিঁয়ে তুলে, কেমন ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ এমনটা করিস না বউজান।পাগল হচ্ছিতো আমি! আমার লক্ষ্মী…”

বাকিটা আর বলতে পারলোনা ছেলেটা। তার আগেই তার চোখ আঁটকে গেলো অরিনের কালচে হয়ে থাকা নিচের ঠোঁটটার পানে। রৌদ্রের কপালে তৎক্ষনাৎ ভাজ পড়লো দু-তিনেক।সে কেমন অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠে,
“ এই তোর ঠোঁটে কি হয়েছে? কিভাবে কেটেছে এতোটা? কিরে… কথা বলছিস না কেনো তুই?”
অরিন চোখ তুলে চাইলো রৌদ্রের দিকে। মেয়েটার চোখদুটো কেমন ঘোলাটে হয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। আচ্ছা… সেকি কাঁদতে চাইছে? অরিনকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে রৌদ্র মেয়েটার ছোট্ট দেহখানা খানিক ঝাকিয়ে তুললো।বিচলিত কন্ঠে ফের বললো,

“ কিভাবে কেটেছে বলছিস না কেনো?”
অরিন এবারেও নিশ্চুপ!তা দেখে রৌদ্র দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো।রাগে শরীরটা যেন ফেটে যাচ্ছে তার। ভাবা যায়,মেয়েটা ঠিক কি পরিমানে অযত্নশীল নিজের প্রতি! রৌদ্র দাঁত কিড়মিড় করে যে-ই না আবারও কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঘটলো এক অভাবনীয় ব্যাপার!
রৌদ্রের ওষ্ঠপুটের মাঝে নিজের ওষ্ঠপুট চেপে ধরেছে অরিন।রৌদ্র থমকায় আবারও। ঘটনার আকস্মিকতায় ছেলেটা যেন একেবারেই হতভম্ব বনে গেলো।এমন একটা মুহুর্তে, হুট করেই মেয়েটা যে এমন কিছু করে ফেলবে তা যেন স্বপ্নেও ভাবেনি সে।হতভম্বতায় রৌদ্রের হাতদুটো খানিকটা নড়বড়ে হতেই সে আবারও মেয়েটাকে ভিষণ গভীরভাবে নিজের সঙ্গে আঁকড়ে ধরলো।অতঃপর ঠোঁটের মাঝে মেয়েটার ওমন নরম অধরযুগলের স্পর্শ পেতেই তার সকল ধৈর্য্যের বাঁধ যেন কর্পূরের ন্যায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।কিয়তক্ষনের মধ্যেই ছেলেটা তার সকল নিয়ন্ত্রণ এবং ধৈর্য্যকে একপ্রকার চুলোয় দিয়ে অরিনকে নিজের সঙ্গে আরেকটু চেপে ধরলো।

তারপর মেয়েটার নরম ওষ্ঠপুট এক ভিন্ন আঙ্গিকে ধকল করে নিলো ছেলেটা।প্রথমদিকে তার ওষ্ঠপুটের স্পর্শ ছিলো নরম,আন্দোলিত কিন্তু ধীরে ধীরে সেই স্পর্শ যেন হয়ে গেলো তৃষ্ণা নিবারনের নতুন পন্থা। ছেলেটা গভীর আক্রোশে মেয়েটার অধরযুগলের ওপর কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। আর অরিন! সে-তো চোখবুঁজে অনুভব করে যাচ্ছে তার পাগল পুরুষের প্রতিটি স্পর্শ! রৌদ্র নিজের ওষ্ঠপুটের কাজ বহাল রেখে অরিনকে বিছানায় এনে ফেললো। অতঃপর মেয়েটার সম্পূর্ণ শরীর জুড়ে নিজের অবাধ্য হাতের বিচরণ চালিয়ে, মেয়েটাকে কাঁপিয়ে তুললো।

প্রায় মিনিট পাঁচেক পর রৌদ্র অরিনের ওষ্ঠপুট ছেড়ে দিলো।মেয়েটার কপাল বরাবর নিজের কপাল ঠেকিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলো সে।অরিনটা তো সেই কখন থেকে চোখ বন্ধ রেখে ভিষণ হাঁপাচ্ছে। রৌদ্র চোখ রাখলো অরিনের বন্ধ চোখের পাতায়।তারপর নিজের মুখটা নামিয়ে আনলো মেয়েটার কন্ঠদেশে। সেথায় একে একে ঠোঁটের নরম স্পর্শ দিতে লাগলো।মাঝেমধ্যে দুয়েকটা মৃদু কামড়ও বসিয়ে দিলো পাগল ছেলেটা।অরিন আরেকবার কেঁপে ওঠে।সে শক্ত করে চেপে ধরে রৌদ্রের চুলগুলো। রৌদ্র হাসলো।মুখ তুলে মেয়েটার চোখে চোখ রাখলো আলগোছে। অতঃপর কেমন গভীর কন্ঠে বলতে লাগলো ,

“ কাছে আসতে দ্বিধা নেই অথচ সবার সামনে ❝ আপন❞ বলতে এতো কেনো দ্বিধা তোর? তুই তো আমার বউজান সানশাইন! আমায় ভিষণভাবে ভালোবাসার লোভে লোভি হয়েও কেনো মাঝপথে হাতটা ছেড়ে দিতে গেলি? এ কষ্ট আমি কিভাবে ভুলবো বউজান! কিভাবে তোকে দিনের পর দিন না দেখে আবারও সামলাবো নিজেকে? দয়া করে এবার একটা পথ দেখিয়ে দে!”
অরিন ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে।কন্ঠ কেমন জুড়িয়ে আসছে তার।রৌদ্র কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে অনিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো। তারপর ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে মেয়েটার ওপর থেকে উঠে বসলো।অরিনও ধীরে ধীরে উঠে বসে। রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ কিছু কিছু কথা অজানায় থাকা ভিষণ জরুরি ডাক্তার সাহেব।আপনি শুধু এটুকুই জেনে রাখুন — আমি আপনাকে ভুলতে চাইনি! এমনকি আমার জন্য আপনার…. থাক সেটা নাহয় না বলাই থাক!”
রৌদ্র হালকা হাসলো।মেয়েটার গালে হাত রেখে আলতো স্বরে বললো,
“ এতোটা ভালোবাসা ঠিক না সানশাইন! কষ্ট হয়তো!”
“ হলে হোক! ভালোবাসায় যদি ব্যাথাই না থাকে তাহলে সেটা আবার কেমন ভালোবাসা?”
রৌদ্র হাসলো ঠোঁট কামড়ে। হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলে ওঠে,
“ এই বুকটায় হারিয়ে গেলে কি খুব অসুবিধে হতো তোর?”
অরিন হয়তো বুঝলোনা এহেন কথার গভীরতার্থ।সে রৌদ্রের বুকে মাথা রেখেই কেমন অবুঝ কন্ঠে বললো,

“ যদি পারতাম তাহলে বহু আগেই হারিয়ে যেতাম ডাক্তার সাহেব।তা এখন কি সম্ভব এটা?”
“ হুম!”
“ কিভাবে?”
রৌদ্র এবার আহত হাসলো খানিকটা। সে মেয়েটাকে আরেকটু চেপে ধরে গলায় সুর তুলে বলে,
❝♬ মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন……..
লুকালে না পায় অন্বেষণ,,,,,,(২)
কালারে হারায়ে তেমন, কালারে হারায়ে তেমন…….❞
এপর্যায়ে থামলো রৌদ্র। মেয়েটার মাথায় শব্দ করে চুমু খেয়ে আবারও গাইলো,
❝ ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে,,, ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে……
আমার মনের মানুষের সনে…আমার মনের মানুষের সনে…❞

গানটা শেষে রৌদ্রের গলাটা কেমন ধরে এলো। সে আবারও ঠোঁটের কোণে ব্যাথাতুর হাসি ঝুলিয়ে বললো,
“ আমার জীবনের হাজারটা অপূর্ণতার মাঝে একমাত্র পূর্নতা তুই বউজান! তাছাড়া সব ভালোবাসা কি আর পূর্ণতা পায় সানশাইন? কিছু কিছু ভালোবাসা যেন শুরুই হয় অপূর্ণ থাকার জন্য। আগে ভাবতাম এই পৃথিবীর বুকে তারাই বুঝি সবচেয়ে বড় হতভাগা — যাদের ভাগ্যে কি-না তাদের ভালোবাসার পূর্নতা জোটে না।

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৮

কিন্তু দেখ আমার ভাগ্য! আমি কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি, আমার ভাগ্য আমায় ঐসব হতভাগ্যদের দলে নিয়ে ফেলবে।বিশ্বাস কর সানশাইন, পরের জন্ম বলে যদি কিছু থাকে তাহলে আমি আবারও তোকে আমার জীবনে চাইবো।তখনও যদি ভাগ্য আমার সহায় নাহয় — তাহলে নিজেকে এবং নিজের এই তুচ্ছ জীবনটাকে বরাবরের ন্যায় বৃথা ভাববো।সবশেষে হাজারো ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে ফের তোর সামনে গিয়ে বলবো—
❝ আমি তোকে ভালোবাসি সানশাইন!❞
তখন তুই আমার হবি তো?”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here