সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৩
Jannatul Firdaus Mithila
রৌদ্রের চকচকে কালো গাড়িটা ধূলো উড়িয়ে এসে থামলো হসপিটালের সামনে। কিয়তক্ষন বাদেই গাড়ি থেকে সগৌরবে বেরিয়ে আসে ছেলেটা। তারপর গটগট পায়ে এগিয়ে যায় হসপিটালের ভেতরে।
কেবিনের বেডে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে রেহান। তার বেডের পাশে দু’ধারে দাঁড়িয়ে আছেন দু’জন নার্স। একজনের হাতে রুহির রিপোর্ট ফাইল। রৌদ্র কেবিনে ঢুকতেই মুখ কুঁচকে নিলো বিরক্তিতে। চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে গটগট পায়ে এগিয়ে আসে রেহানের বেডের পাশে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সদের উদ্দেশ্য বলে,
“ কতক্ষণ যাবত সেন্সলেস?”
নার্স দু’জনের মধ্য থেকে একজন মুহুর্ত ব্যায়েই বলে ওঠে,
“ স্যার, ৩৫ মিনিটের মতো হবে।”
রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে ভাবলো কিছু একটা। পরক্ষণেই নার্সকে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“ স্মেলিং সল্ট আনুন। আর আপনি… আপনি গিয়ে ঠান্ডা পানি আনুন।”
কথাটা বলতে দেরি, নার্স দু’জন ছুটতে দেরি হলোনা। প্রায় মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তারা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হলো রৌদ্রের সামনে। রৌদ্র নার্সের হাত থেকে ঠান্ডা পানিটা নিয়ে হালকা ছিটিয়ে দিতে লাগলো রেহানের চোখেমুখে। অচেতন ছেলেটার গালে আলতো করে চাপড় দিয়ে ডাকতে লাগলো ধীরে ধীরে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ রেহান! ও রেহান।উঠ ভাই!”
নাহ! এতেও কাজ হচ্ছে না তেমন।রৌদ্র এবার অন্য নার্সের হাত থেকে স্মেলিং সল্টটা হাতে নিয়ে নেয়।তারপর সেটি রেহানের নাকের কাছে ধরে রাখলো কিছুক্ষণ। মিনিট দুয়েক পেরুতেই রেহানের বন্ধ চোখের পাতাগুলোয় হালকা নড়াচড়া হতে লাগলো যেন। তা দেখে রৌদ্র খানিক ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। রেহান ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। নিজেকে বিছানায় ওমন পড়ে থাকতে দেখে খানিকটা হকচকিয়ে ওঠে ছেলেটা। সে তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলেই বাঁধ সাধে রৌদ্র। গম্ভীর মুখে সে বলে ওঠে,
“ আস্তে! কোথাও পালাতে হবে না তোর।এতো তারাহুরোর কিছু নেই!”
রেহান কি বুঝলো কে জানে! ছেলেটা কেমন হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে। কিয়তক্ষন বাদেই রেহান নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে বলে,
“ জানিস ভাই? আমি না একটা স্বপ্ন দেখেছি। যেখানে কে যেন এসে আমাকে বলছে — আমি বাবা হচ্ছি! স্বপ্নটা সুন্দর না রোদ?”
এহেন কথায় উপস্থিত নার্স দু’জন মুখ টিপে হাসতে লাগলো। রৌদ্র তাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই মানুষ দু’টোর মুখ থেকে হাসিটা যেন সরে গেলো তৎক্ষনাৎ। রৌদ্র তাদের ইশারায় কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলে। নার্সরাও বাধ্যদের ন্যায় মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো কেবিন ছেড়ে। তারা যেতেই রেহান কেমন বোকা বোকা স্বরে বললো,
“ ওরা আমার কথায় মুখ টিপে হাসলো কেনো রে? আমি কি এমন বললাম?”
রৌদ্র এবার শক্ত চোখে তাকালো রেহানের দিকে। ছেলেটার এমন দৃষ্টি দেখে রেহান বুঝি ঢোক গিললো সামান্য। সে কিছু বলতে উদ্যোত হতেই রৌদ্র তখন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ তুই কোনো স্বপ্ন দেখিসনি গাধা! ঐটা সত্যি ছিলো।রুহি ইজ প্রেগন্যান্ট,এন্ড ইউ আর গোয়িং টু বি আ ফাদার! ইডিয়ট একটা!”
হঠাৎ এহেন বাক্যে হতভম্ব হয়ে গেলো বেচারা রেহান। এতক্ষণ সে যেটাকে স্বপ্ন ভেবে এসেছিলো তাহলে সেটা সত্যি ছিলো? সে সত্যি বাবা হতে চলেছে? রেহান তবুও হয়তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলোনা পুরোপুরি। সে রৌদ্রের ফুলেফেঁপে থাকা বাহুটা ধরে আলগোছে ঝাঁকি দিয়ে বলে,
“ তুই সত্যি বলছিস রোদ? এম আই গোয়িং টু বি আ ফাদার?”
এপর্যায়ে মুচকি হাসলো রৌদ্র। রেহানকে একহাতে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বললো,
“ ইয়েস বাডি! আমি মামা হচ্ছি!”
কথাটা শোনামাত্রই খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লো রেহান। অতিরিক্ত খুশিতে ছেলেটার চোখ ভরে উঠেছে অশ্রুতে। একদিকে তার চোখের কোটরে অশ্রুভর্তি অন্যদিকে তার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে প্রশান্তির হাসি।রৌদ্র আশ্চর্য হয়ে দেখলো রেহানকে। ছেলেটা কাঁদছে আবার হাসছেও? বাবার হওয়ার সুখ কি সত্যিই এতোটা প্রশান্তিদায়ক? রৌদ্র আলগোছে রেহানের ঘাড়ে হাত রাখলো। ভরাট কন্ঠে বললো,
“ এভাবে ছিচকাদুঁনে মেয়েদের মতো কাঁদছিস কেনো বোকা?”
রেহান এবারেও ভেজা চোখে হাসলো খানিকটা। চোখদুটো নামিয়ে রেখে,হাতদুটো নিজের সামনে এনে ছেলেটা কেমন ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ ভাই….আমার অংশ আসতে যাচ্ছে পৃথিবীতে।আমার আর আমার শ্যামবতীর অংশ! আমি, আমার শ্যামবতী আর আমাদের ছোট্ট জাদুসোনা! আমি…আমি এই আনন্দ কিভাবে প্রকাশ করবো ভাই? আমার যে সত্যি নাচতে ইচ্ছে করছে।”
রৌদ্র অনিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো রেহানের দিকে। ছেলেটার চোখেমুখে সে কি প্রশান্তির ছাপ! আশ্চর্য! হঠাৎ করেই রেহানের চেহারায় এতো জৌলুশ দেখা যাচ্ছে কেনো? বাবা হতে চলেছে বলেই কি ছেলেটার রুপ বেড়ে যাচ্ছে? হয়তো বা!
কবির সাহেব মাত্রই ফিরে এসেছেন এহসান বাড়িতে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন নিজের বোন,ভগ্নিপতি এবং ভাগ্নে-ভাগ্নিকে। আমরিন বেগমকে পেয়েই বাড়িতে শুরু হয়ে গিয়েছে কান্নাকাটির আসর! প্রথম দিকে জুবাইদা বেগম ও রাফিয়া বেগমতো নিজেদের করা সেদিনকার বাজে ব্যাবহারে লজ্জায় চোখ মেলাতে পারেনি আমরিন বেগমের সাথে। সে-তো আমরিন বেগম নিজ থেকে এসে বড়- ভাবিদের বুকে ঝাপিয়ে পড়লেন। আর তারপর থেকেই শুরু হয়ে গেলো বাড়ির গৃহিনীদের কান্নাকাটি। মেহরিন বেগম এতক্ষণ দূরে দূরে ছিলেন।এমনিতেই মানুষটা যা ছিচকাদুঁনে, কাউকে কাঁদতে দেখলেই যেন চোখ থেকে আপনা-আপনি অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার।তারওপর আজ এতোগুলো বছর পর বড় বোনকে ওমন চোখের সামনে দেখে কি আর নিজেকে আঁটকে রাখতে পারবেন তিনি? তাইতো তিনি ছলছল চোখে ড্রয়িং পেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঘুপটি মেরে লুকিয়ে রইলেন। এদিকে কবির সাহেবরা বাড়িতে আসতেই পেয়ে গেলেন সুসংবাদ। রুহির খবর শুনতেই চার ভাইয়ের সেকি আনন্দ! তাশরিক সাহেব এবং তায়েফ সাহেব তো সে-ই কখন বেরিয়ে পড়েছেন মিষ্টি আনতে।ওতোবড় একটা সুখবর কি আর মিষ্টি মুখ ছাড়া চলে?
আমরিন বেগম সিক্ত চোখে নিজের বাবার ভিটেটায় চোখ বুলাচ্ছেন।আজ ঠিক কতগুলো বছর পর আবারও তিনি আসলেন এ বাড়িতে। আমরিন বেগম চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন সিঁড়ির কোণে ঠিক তখনি তার কাঁধে কারো হাতের শীতল স্পর্শ পেতেই পাশ ফিরে তাকালেন তিনি। দেখলেন, মাইমুনা বেগম হাসিমুখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমরিন বেগম আলতো হাসলেন। আগ বাড়িয়ে বললেন,
“ সবটা কেমন আগের মতোই আছে ভাবি!”
মাইমুনা বেগম মাথা ঝাঁকালেন। খানিকটা ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলে বললেন,
“ এতোদিন আগের মতো না থাকলেও এখন সবটা আগের মতোই লাগছে পাখি!”
আমরিন বেগম ভেজা চোখে হাসলেন একটুখানি। অন্যদিকে বাড়িতে ইফতি আর ইকরা আসার পর থেকেই ছেলেমেয়ে গুলো সব একসঙ্গে আড্ডা বসিয়েছে রুহির রুমে। ইকরা আর ইফতি অল্পতেই মিশে গিয়েছে সকলের সঙ্গে। আর মিশবে না-ই বা কেনো? কাজিন বলে কথা! একে-অপরের সাথে মিশে যাওয়া যেন চুটকির ব্যাপার ছেলেমেয়েগুলোর জন্য। কিন্তু সবার সঙ্গে ইফতির ভাব জমলেও আহিরার সাথে তার ভাব জমে ওঠেনি মোটেও। আহিরা ইকরার সঙ্গে হেসেখেলে কথা বললেও ইফতির দিকে ফিরে অব্ধি তাকায়নি একবারও। কেনো তার এমন ব্যাবহার কে জানে!
বিকেল সাড়ে পাঁচটা!
এহসান বাড়ির পরিবেশ এখন বেশ রমরমা। এইতো দুপুরের দিকেই এ বাড়িতে একঝাঁক মিষ্টান্ন নিয়ে হাজির হয়েছেন সিকদার বাড়ির লোকজন। ওসমান সিকদার এবং তার স্ত্রী তো যেন নাতি-নাতনি হবার আনন্দে আটখানা! তারা এসেছে পর থেকেই রুহিকে কেমন চোখে হারাচ্ছেন।সেই সাথে মেয়েটার পাগল বরটা তো আছেই? হসপিটাল থেকে ফিরে এসেই ছেলেটা শুরু করলো আরেক কান্ড! একটু পরপর — বউ এভাবে বসতে কষ্ট হচ্ছে? বউ এটা খেতে কষ্ট হচ্ছে? তোমার কি হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে? কোলে নিবো? তোমার কি মাথা ঘুরাচ্ছে। এ নিয়ে আরও কতো হ্যানত্যান কথাবার্তা! রুহি তো বেজায় বিরক্ত হচ্ছে ছেলেটাকে নিয়ে। এখনই এই হাল তার,তাহলে বাকিদিন কি করবেন মহাশয় কে জানে!
ড্রয়িং ভর্তি মানুষজন।একে-অপরের সঙ্গে পুরনো কথা তুলে আড্ডায় ব্যস্ত বড়রা।ছোটরা সবাই মিলে ছাঁদে গিয়েছে আড্ডা দিতে। বড়দের মাঝে থেকে থোড়াই বোর হবে তারা! রৌদ্র ছাঁদে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্রই। তার চোখদুটো যেন সাথে সাথেই আঁটকে গিয়েছে তার প্রাণভোমরার দিকে। অরিনটা কি সুন্দর হেঁসে হেঁসে কথা বলছে ইকরার সঙ্গে। মেয়েটাকে আবার আজকে কোন ভুতে ধরলো কে জানে! সেও বাকিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শাড়ি পড়েছে। তাও আবার যেনতেন রঙের শাড়ি না, রৌদ্রের পছন্দের রং মেজেন্টা রঙের শাড়ি পড়েছে মেয়েটা। ছাঁদের খোলা হাওয়ায় মেয়েটার কোমর সমান চুলগুলো আলতো করে দুলছে। রৌদ্র অপলক তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। অন্যদিকে, অনিকও আছে এখানে। সে দাঁড়িয়ে আছে ইফতির সঙ্গে।
তাদের দু’জনার মাঝে কি নিয়ে যেন আলাপচারিতা চলছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। আলাপের মাঝেই বেশ কয়েকবার অনিকের অবাধ্য চোখদুটো এসে ঠেকেছে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা কালো শাড়ি পরিহিত ইকরার পানে। যদিওবা অনিক নিজের দৃষ্টি সংযত করবার বেশ প্রয়াস চালাচ্ছে তবুও তার বেহায়া দৃষ্টি কি আর ওতো কথা শোনে? এই যেমন এখনো তার দৃষ্টি গিয়ে আঁটকে আছে ইকরার কাজলটানা চোখদুটোর মাঝে। ইফতি সরু চোখে অনিকের দৃষ্টি লক্ষ্য করলো। ছেলেটা সে-ই কখন থেকেই দেখে যাচ্ছে, এই অনিক ভাই তার বোনকে কেমন চোখে চোখে রাখছে! অনিক ভাইয়ের চোখের দৃষ্টি বুঝতে খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি ইফতির। শত হলেও — পুরুষ মানুষ বলে কথা। অনিককে এখনও ইকরার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে ইফতি খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে।হঠাৎ এহেন কান্ডে তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে আনে অনিক। ছেলেটা কেমন চোর ধরা পড়ে যাওয়ার মতো কাচুমাচু করতে লাগলো। তা দেখে ইফতি মুখ টিপে হাসলো। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
“ দৃষ্টি সংযত করুন ভাইয়া! বিয়ের পর নাহয় মন ভরে দেখবেন আমার বোনকে।ওতোদিন একটু ধৈর্য্য ধরে থাকুন নাহয়!”
কথাটা বলেই চমৎকার হাসলো ইফতি।আর অনিক? সে কেমন লাজুক হাসতে লাগলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে।
অনেকক্ষণ ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকতেই যেন হাঁপিয়ে উঠলো রুহি।মেয়েটা নিচে নেমে যেতে উদ্যোত হতেই রেহান এসে তৎক্ষনাৎ নিজের বাহুডোরে আগলে নিলো মেয়েটাকে। হঠাৎ এমন কান্ডে হকচকিয়ে ওঠে রুহি।ছেলেটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায় সে।তারপর গলায় ঝাঁঝ ঢেলে বলে,
“ কি হচ্ছেটা কি? ছাঁদ ভরা মানুষজন। সবার সামনে এভাবে জড়িয়ে ধরার মানেটা কি?”
রেহান মুচকি হাসলো। হাত বাড়িয়ে মেয়েটার চোয়ালখানা আলতো চাপ দিয়ে আদুরে কন্ঠে বললো,
“ থাকুক মানুষজন, তাতে আমার কি? আমি আমার বউ-বাচ্চাকে নিজের সঙ্গে করে আগলে নিয়ে যাবো তাতে কার কি? চলো তুমি! ঘরে গিয়ে রেস্ট নিবে।”
রেহানের এমন সোজাসাপ্টা উওরেও সন্তুষ্ট হলোনা রুহি।মেয়েটা কেমন অতিষ্ঠ কন্ঠে বলে ওঠে,
“ রেহান! আপনি কিন্তু এখন একটু বেশি বেশিই করছেন। আমি কিন্তু সাত-আট মাসের প্রেগন্যান্ট নই।আমাকে এতো আগলে-টাগলে নিতে হবে না আপনার। আমি যেতে পারবো!”
মেয়েটার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই রেহান কেমন দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,
“ হুঁশ! চুপ করো শ্যামবতী! তুমি আমায় যা ইচ্ছে বোঝাও তাতেও কোনো কাজ হবেনা। আমি তোমার খেয়াল নিজের মতো করে রাখবোই রাখবো।তাই চলোওও!”
শেষ কথাটা খানিক টেনেই বললো রেহান।ছেলেটার এমন কথা বলার ভঙ্গি দেখে না চাইতেই হেসে দিলো রুহি। হাত বাড়িয়ে মৃদু কপাল চাপড়ে বিরবির করে বললো,
“ পাগল একটা!”
বিরবির করে বলা কথাটাও যেন বেশ কানে এলো রেহানের। সে তৎক্ষনাৎ নিজের মুখটা রুহির কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বললো,
“ সে আর বলতে?”
রুহিকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে রেহান। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে অরিন।রৌদ্র যে কোন ফাকেঁ মেয়েটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে খবর নেই মেয়েটার।সে-তো তাকিয়ে আছে রুহি আর রেহানের দিকে। এদিকে রৌদ্র অরিনের পাশে এসে দাঁড়াতেই ইকরা চলে গিয়েছে অন্যপাশে। কিয়তক্ষন বাদেই অরিন আনমনেই বলে ওঠে,
“ ইশশ্! আমারও যদি বাবু হতো! তাহলে কতোই না ভালো হতো।”
ব্যস এটুকু শুনতেই ভ্রুযুগল আপনা-আপনি কুঁচকে আসে রৌদ্রের।ছেলেটা কেমন ভারি স্বরে বলে ওঠে,
“ স্ট্রেঞ্জ! এখনো পুরোপুরি কিছু করতেই পারলাম না, তার আগেই বাবু নেওয়ার কথা বলছিস তুই? ঠিকঠাক মতো কিছু করতে না পারলে বাবুটা নিশ্চয়ই আসমান থেকে টুপ করে তোর কোলে চলে আসবেনা!”
হঠাৎ এমন লাগামহীন কথায় ভড়কে যায় অরিন।সে তৎক্ষনাৎ পাশ ফিরে তাকাতেই হা হয়ে গেলো আপনাআপনি! তার পাশে না ইকরা দাঁড়িয়ে ছিলো? তাহলে মেয়েটা গেলো কই হুট করে? তাছাড়া ডাক্তার সাহেবই বা এখানে এসে দাঁড়ালো কখন? এসব ভাবতে ভাবতেই অরিনের মাথা ধরে আসার যোগাড়! মেয়েটা যখন নিজের ভাবনায় নিমগ্ন তখনি রৌদ্র মেয়েটার কোমর চেপে ধরে আলগোছে। তার এমন কান্ডে ছাঁদে উপস্থিত সকলেই যেন হা হয়ে গেলো একমুহূর্তের জন্য।অনিক বেচারার তো কাশি উঠে গেলো তৎক্ষনাৎ! ইকরা তখন বিচলিত হয়ে ছুটে এলো অনিকের দিকে। এসেই কেমন অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ কি হলো আপনার? পানি খাবেন আপনি?”
অনিকের প্রতি ইকরার এমন চিন্তা দেখে সরু চোখে চাইলো ইফতি। ছেলেটা কন্ঠে একরাশ অনিহা ঢেলে বোনের উদ্দেশ্যে বললো,
“ বাব্বাহ! তোর দেখছি এখানে সবার জন্যই বেশ ভালো টান। কিন্তু আমার জন্য তোর এই টানটা মিসিং থাকে কেনো শুনি? এখানে যদি অনিক ভাইয়ের পরিবর্তে আমি কাশতে কাশতে মরেও যেতাম তাও হয়তো তুই এগিয়ে এসে একগ্লাস পানি দিতিনা! হুহ…”
ভাইয়ের এহেন টিপ্পনী শুনে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো ইকরা। ইফতি তৎক্ষনাৎ নিজের মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো।ছেলেটা কেমন মুচকি মুচকি হাসছে! ওদিকে,আহিরা আর মাহিরা তো সে-ই কখন ছাদঁ থেকে পগারপার হয়েছে! তাদের আবার নিজেদের মধ্যেই এক ভিন্ন জগত কি-না!
রৌদ্র অরিনের কোমর চেপে রেখেছে শক্ত করে। তার নেশালো দৃষ্টি অরিনের সুশ্রী মুখখানাতেই নিবদ্ধ। এদিকে অরিন কেমন মোচড়াচ্ছে ছেলেটার হাত থেকে ছাড়া পেতে! অথচ রৌদ্রকে দেখো! ছেলেটার যেন সেদিকে কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ নেই! কিয়তক্ষন বাদেই অরিন মিনমিনে স্বরে বললো,
“ ছাড়ুন! সবাই এদিকেই দেখছে! উফফ…কি ভাবছে তারা!”
মেয়েটার এহেন কথায় ভ্রু কুঁচকায় রৌদ্র। সে তৎক্ষনাৎ মেয়েটার চোয়াল চেপে ধরে আলতো করে। হিসহিসিয়ে বলে,
“ অন্যকে নিয়ে ভাবতে হবে কেনো তোর? তুই শুধু আমাতে কনসেন্ট্রেট কর। দেট উইল বি বেটার ফর ইউ বউজান!”
এপর্যায়ে থমকালো অরিন। দৃষ্টি হলো অনড়। সে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে। রৌদ্র তখন ঠোঁট কামড়ে ধরলো নিজের। পরক্ষণেই কেমন টেনে টেনে বললো,
“ ঘরে চলো বউজান…আ’ম ফিলিং হর্নি!”
এহেন কথা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই মৃদুভাবে কেঁপে ওঠে অরিন।মেয়েটার শীরদাড়া বেয়ে মুহুর্তেই নেমে গেলো একটি শীতল স্রোত। ছোট্ট মুখখানাতেও লেপ্টে গিয়েছে খানিক লজ্জালুভাব। মেয়েটা তৎক্ষনাৎ নিজের মাথাটা নিচু করে নিলো। মিনমিনে স্বরে বললো,
“ মুখে লাগাম টানুন! কিসব কথা বলছেন আপনি? এখন আমি কোত্থাও যেতে পারবোনা।”
রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে হাসলো খানিকটা।পরক্ষণেই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মেয়েটার হাতের কনুই চেপে তাকে নিয়ে হাঁটা ধরলো সামনের দিকে। অরিন নিজের হাতটা ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টায় তৎপর। রৌদ্রের ওমন পুরুষালি শক্তির সাথে তার কি আর ওতো সহজে পেরে ওঠা সম্ভব?
“ এই যে মিঃ ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?”
পেছন থেকে ভেসে আসা পরিচিত কন্ঠে সেদিকে ফিরে ইফতি।ছেলেটা মাত্রই ছাঁদ থেকে নেমে এসে দোতলার করিডরটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। আদৌও সেটা শুধুমাত্র ঘুরে দেখা না-কি কাউকে খোঁজা কে জানে! মাহিরা স্মিত হেসে এগিয়ে আসে। ইফতির থেকে খানিকটা দুরত্বে দাঁড়িয়ে বলে,
“ কি বললেন না যে! কোথায় যাচ্ছিলেন?”
ইফতি প্রসঙ্গ ঘোরাতে তৎপর। ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি টেনে ছেলেটা বললো,
“ তেমন কোথাও না।এমনিতেই বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম।”
“ ওহ! শুধু কি বাড়ির ভেতরটাই দেখবেন? না-কি বাইরের বাগানটাও দেখবেন? আমাদের বাড়ির বাগানটা কিন্তু খুব সুন্দর। আমাদের রোদ ভাইয়ের হাতে করা বাগান! চলুন আপনাকে সেদিকটায় নিয়ে যা-ই!”
অগত্যা এমন কথায় ইফতি আর যেচে পড়ে না বলতে পারলোনা। ছেলেটা আলতো করে মাথা নাড়িয়ে হাঁটা ধরলো মাহিরার পিছুপিছু। অথচ তার চোখদুটো যেন হন্যে হয়ে কোনো এক নির্দিষ্ট ব্যাক্তিকে খুঁজতে ব্যস্ত!
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইফতি এবং মাহিরা এসে উপস্থিত হয় বাড়ির বাগানে। সেথায় আসতেই তারা দেখতে পায় — আহিরা এবং ইকরা আগে থেকেই বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। আহি মনের সুখে ইকরার সঙ্গে এটা-সেটা বলে যাচ্ছে। ইকরাও মনোযোগ দিয়ে শুনছে মেয়েটার কথা। মাঝেমধ্যে দুয়েকবার হু,হা বলে সাড়াও দিয়েছে আহিরার কথার তালে। ইফতির পদযুগল থামলো।তার চোখদুটো যেন এতক্ষণে নিস্তার পেলো সে-ই খোঁজাখুঁজি হতে।
ইফতি মনে মনে নিজের এহেন অনুভূতি নিয়ে বেজায় আশ্চর্য হচ্ছে দিনকে দিন। আহিরাকে চিনেছে সে খুব একটা বেশিদিন হয়নি কিন্তু তারপরও এই মেয়েটার প্রতি এক অন্যরকম টান অনুভব করে কেনো সে? তাছাড়া মেয়েটার কথার যা তেজ! কথা না যেন কুড়ালের কোপ! বিশেষ করে ইফতির সঙ্গে কথা বলার সময় মেয়েটার কথায় যেন এক থাবা মরিচ গুঁড়ো ঢেলে দেয় কেউ। ইফতি ভেবে পায়না, মেয়েটা তার সাথেই কেনো এমন ব্যাবহার করে? এ-ই যে এখন ইকরার সঙ্গে হেসেখেলে কথা বলছে, অথচ ইফতিকে দেখলেই মুখ ঝামটি দিয়ে বসবে মেয়েটা। মাঝেমধ্যে নিজের অনুভুতির প্রতি বড্ড নাখোশ হয় ইফতি। দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব পড়েছিলো, যে পরিশেষে এমন একটা ধানি লঙ্কার মতো মেয়ের মায়ায় পড়তে হলো তাকে! অন্য কাউকে মনে ধরলে কি এমন হতো?
মাহি ইফতিকে নিয়ে এগিয়ে যায় আহিদের কাছে।আহিরা বুঝি দূর থেকে লক্ষ্য করেছে ইফতিকে এতেই যেন মুহুর্তেই মুখভঙ্গির ভাবভঙ্গিমা পাল্টে গেলে মেয়েটার।এতক্ষণের হাসিহাসি মুখটায় ছেয়ে গেলো কপট ঝাঁঝালো ভাব। ইফতি সেখানে আসা মাত্রই মেয়েটা অন্যদিকে পা বাড়ালো একা একাই।তা দেখে পেছন থেকে হতভম্ব হয়ে গেলো ইফতি।মাহিরা জোর গলায় পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে বসে,
“ কিরে কোথায় যাচ্ছিস? আমরা আরও তোকে দেখে এখানে এলাম! যাহ বাবাহ! কি হলো আবার?”
আহিরা থামলো না। গটগট পায়ে বাগান থেকে বেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো আলগোছে। এদিকে ইকরা যেন মেয়েটার হঠাৎ পরিবর্তনে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলো মনে মনে।
রৌদ্র অরিনকে টেনেটুনে অরিনের রুমে নিয়ে এসেছে। মেয়েটা সে-ই কখন থেকে চলে যাওয়ার জন্য কতশত কথা বলেই যাচ্ছে অথচ রৌদ্র তাকে কিছুতেই ছাড়ছেনা।ছেলেটা অরিনকে পাঁজা কোলে তুলে হাটছে পুরো ঘরময়।অরিন এবার অতিষ্ঠ কন্ঠে বলে ওঠে,
“ ছাড়ুন না আমায়! পুরো বাড়ি ভর্তি মানুষজন। কেউ একটা কিছু ঘুনাক্ষরেও টের পেয়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। নামান আমায়!”
কে শুনে কার কথা। রৌদ্র মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসছে আর হাঁটছে। কিছুক্ষণ পর রৌদ্র তার হাঁটা থামালো।মেয়েটাকে কোলে নিয়ে খাটে গিয়ে বসলো। তারপর নেশালো চোখে মেয়েটাকে আপাদমস্তক পরোখ করে হাস্কি স্বরে বললো,
“ ইউ আর লুকিং ড্যাম প্রিটি হানি! উফফ…”
কথাটা বলেই নিজের নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো রৌদ্র।অরিন শুষ্ক ঢোক গিললো পরপর। ছেলেটার চোখের দিকে তাকাতে পারছেনা মেয়েটা। লজ্জায় যেন হাসফাস করছে সে! রৌদ্র মেয়েটার লজ্জাগুলোকে আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিতে দুষ্ট কন্ঠে বললো,
“ শাড়িটা খুলে ফেলি জান?”
থমকায় অরিন। ভড়কে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকালো মেয়েটা। কন্ঠ তার হয়ে গিয়েছে বাকরূদ্ধ। শরীরে বয়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ কম্পন। বুকটা কাঁপছে জোরালো ভাবে। রৌদ্র বেশ টের পেলো মেয়েটার অবস্থা! সে আলগোছে মেয়েটার কোমরের পিঠে হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে নিজের সঙ্গে নিঃশব্দে মিশিয়ে নিলো। কিয়তক্ষন চুপ থেকে হঠাৎ করেই দুষ্ট কন্ঠে বলে ওঠলো,
“ নাইস ফিটিংস হানি!”
এহেন কথায় আবারও লজ্জায় পড়লো মেয়েটা।অরিন তৎক্ষনাৎ রৌদ্রের বুক হতে সরে আসতে চাইললেই রৌদ্র তাকে আরেকটু চেপে ধরলো নিজের সঙ্গে। মেয়েটার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,
“ বরের সামনে এতো লজ্জা পেতে নেই সানশাইন! আদুরে লাগে তো!”
অরিনের এবার লজ্জায় মরিমরি অবস্থা! লোকটা দিনকে দিন কেমন ভয়ংকর কথাবার্তা বলা শুরু করেছে! সে কি বুঝে না? মেয়েটা তার এমন লাগামহীন কথাবার্তায় বরাবরই লজ্জায় কুপোকাত হয়ে পড়ে! অরিন মাথা নুইয়ে রেখেছে লজ্জায়। রৌদ্র মেয়েটার নতমুখ পানে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ চোখে। আজও ছেলেটা কেমন হারিয়ে যাচ্ছে মেয়েটাতে! রৌদ্র ধীরে ধীরে অরিনের ঠোঁটের দিকে এগোতেই অরিন তৎক্ষনাৎ রৌদ্রের কোল থেকে নেমে দাঁড়ায়। কেঁপে কেঁপে দু-কদম পিছিয়ে যেতেই রৌদ্র টেনে ধরে মেয়েটার শাড়ির আঁচল। অরিনের পদযুগল থামলো সেই সঙ্গে দ্রুত হলো তার হৃৎস্পন্দনের গতি। বদনে নেমে এলো চিরচেনা কাঁপন! মেয়েটা থেমে থেমে অনুনয়ের সুরে বললো,
“ ছাড়ুন না! নিচে সবাই ডাকছে হয়তো!”
মেয়েটার এহেন কথায় রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে হাসলো।তার হাতের মুঠোয় এখনো ধরে রাখা অরিনের শাড়ির আঁচলটা। সে ধীরে ধীরে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।তার নেশালো দৃষ্টি এখনো অরিনের পিঠের দিকে নিবদ্ধ। এদিকে অরিনের বুকটা ক্রমশ ধুকপুক করেই যাচ্ছে! নিচ তলার ড্রয়িং ভর্তি মানুষজন,অন্যদিকে রৌদ্রের ওমন হুটহাট পাগলামি। কই যাবে এখন মেয়েটা? অরিন কেমন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ফের বললো —
“ ছেড়ে দিন না প্লিজ!”
রৌদ্র মেয়েটার কথার পিঠে কিছু না বলে, মুচকি হেসে শাড়ির আঁচলটা হাতের মুঠোয় পেঁচাতে লাগলো। যার দরুন ধীরে ধীরে টান পড়তে লাগলো মেয়েটার শাড়িতে। অরিন তা বুঝতে পেরে তৎক্ষনাৎ খামচে ধরলো শাড়িটা।রৌদ্র তার হাতের মুঠোতে শাড়ি পেচিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। কিয়তক্ষন বাদেই অরিন আবারও থেমে থেমে কিছু বলতেই যাবে ওমনি তার ডানহাতের কনুই চেপে তৎক্ষনাৎ তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় রৌদ্র। অরিন ভড়কায়।হঠাৎ আক্রমণে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে। রৌদ্র মেয়েটার কুঁচকে রাখা চোখের পাতায় আলতো করে চুমু খেলো। তারপর মেয়েটার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
“ বেবি নিতে চেয়েছিলে না বউজান? তাহলে এসো… বেবি নেওয়ার প্রিপারেশনটা এখনি সেরে নেই। আমার তো আবার দয়ার শরীর, তোমার কোনোকিছুতেই না বলতে পারিনা আমি! যাকগে… কাম হানি..তোমার এই ইচ্ছেটাও পূরণ করে দেই!”
অরিন থমকালো।তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে দাঁড়ালো মেয়েটা।তার চোখদুটো যেন এক্ষুণি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবার যোগাড়! মুখটাও কেমন হা হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে! তাকে এমন হা করে থাকতে দেখে রৌদ্র চোখ টিপে হাস্কি স্বরে বললো,
“ এসো…এসো হানি! তোমার আবদারটা ফুলফিল করে দেই!”
এই বলে রৌদ্র মেয়েটার কোমর চেপে ধরতেই অরিন সঙ্গে সঙ্গে রৌদ্রের হাতের নাগাল হতে দূরে সরে দাঁড়ালো। বেচারি দূরে সরতে গিয়ে তার শাড়ির আঁচলটা যে অবহেলায় নিচে গড়িয়ে পড়েছে সেদিকে কি আর ধ্যান আছে তার? নাহ নেই তো! থাকলে কি আর ওতো সহজে রৌদ্রের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো? লজ্জায় কুপোকাত হয়ে যেতো না মেয়েটা! অন্যদিকে তাকে এভাবে দেখে রৌদ্রের যেন নিশ্বাস আঁটকে আসার উপক্রম হলো। সে মেয়েটার দিকে নেশালো চোখে তাকিয়ে থেকে বাঁকা হাসলো খানিকটা। মেয়েটাকে আপাদমস্তক পরোখ করে, জিভ দিয়ে নিজের শুষ্ক অধরজোড়া ভিজিয়ে নিলো একবার। তারপর কেমন দুষ্ট কন্ঠে বললো,
“ সাবধান বউজান! আপনি একটা খুললে আমি কিন্তু বাকিগুলোও খুলে ফেলবো নিজ দায়িত্বে।”
অরিন ভ্রু কুঁচকায়।বোঝার চেষ্টা চালায় রৌদ্রের এমন কথার গভীর অর্থ। সে রৌদ্রের দৃষ্টি খেয়াল করে নিজের দিকে তাকাতেই বেশ বড়সড় একটা ঝটকা খেলো যেন। একি! তার শাড়ির আঁচল ওভাবে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে যে! অরিন তৎক্ষনাৎ নিজের অবহেলিত আঁচলটা ফ্লোর থেকে উঠাতে নিলেই তার হাতদুটো চেপে ধরে বাঁধ সাধলো রৌদ্র। অরিন থামলো। রৌদ্রের হাত হতে নিজের হাতদুটো ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে মেয়েটা। এদিকে রৌদ্রের দৃষ্টি অন্য কোথাও। ছেলেটা সেদিকে তাকিয়ে ক্ষনে ক্ষনে ঢোক গিলছে। থেমে থেমে বলে,
“ থাক না এভাবেই।”
অরিন এবার লজ্জায় হাসফাস করতে লাগলো যেন। মেয়েটার এলোমেলো দৃষ্টি মোটেও স্থির নয় এক জায়গায়। রৌদ্র এবার মেয়েটার ঘাড়ের পেছনে আলতো করে হাত বাড়িয়ে, অরিনের মুখটা নিজের একেবারে কাছে নিয়ে এলো। অরিনের গালের ওপর নিজের গাল ঠেকিয়ে বললো,
“ আ’ম লুজিং মাই কন্ট্রোল হানি! একটু আদর করি তোকে?”
অরিন কাঁপছে। বাক শক্তি যেন ফুরিয়ে এসেছে তার। গলায় নেমেছে চিরচেনা শুষ্কতা। মেয়েটা বারকয়েক শুকনো ঢোক গিলে কোনমতে বললো,
“ বাড়িতে অনেক মানুষ ডাক্তার সাহেব! কেউ কিছু টের পেলে…. ”
মেয়েটার কথা শেষ হবার আগেই রৌদ্র তৎক্ষনাৎ আলতো করে চেপে ধরে অরিনের গলা।তারপর হাস্কি স্বরে বললো,
“ হু দা হেল কেয়ারস এবাউট দেট হানি? এটা তোর আমাকে টার্ন অন করার আগে ভাবা উচিত ছিলো। তখন যেহেতু ভাবিসনি, তাহলে আমি কেনো ভাবতে যাবো এখন? সো কথা না বাড়িয়ে কাছে আয়!”
বলেই রৌদ্র ছেড়ে দিলো অরিনের গলা। তারপর মেয়েটাকে আগ বাড়িয়ে ফ্লোরে শুইয়ে দিলো সে। পরক্ষণেই নিজেও অরিনের পাশে শুইয়ে, একহাত উঁচিয়ে সেথায় মাথা ঠেকিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। অরিন নিজের মুখটা অন্যদিকে ঘোরায়।রৌদ্র তখন আলতো হেসে অরিনের থুতনিটা ধরে তাকে আবারও নিজের দিকে ঘোরায়।তারপর শান্ত কন্ঠে বলে,
“ এমন করছিস কেনো জানবাচ্চা? আমাকে ভালো লাগছে না তোর?”
অরিন তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে উঠে খানিকটা। নিজের সাফাই দেওয়ার সুরে বলে ওঠে,
“ এই না না..আপনি ভুল ভাবছেন! আমি আসলে…”
তার কথার মাঝেই রৌদ্র এসে আলগোছে দখল করে নিলো মেয়েটার নরম অধরযুগল। তার হাতদুটো সঙ্গে সঙ্গে নেমে গেলো মেয়েটার কোমরের কাছে। সেথায় আলতো করে চেপে ধরেই মেয়েটার ওষ্ঠপুটে গভীর চুম্বনে লিপ্ত হলো রৌদ্র। প্রথম দিকে আলতো পরশ একেঁ দিলেও পরবর্তীতে তা হয়ে ওঠেছে তীব্র! রৌদ্র ডেস্পারেটলি মেয়েটার ওষ্ঠপুট টেনে নিচ্ছে নিজের মাঝে। অরিন হয়তো নিজেকে আর সামলাতে না পেরে ছেলেটাকে সরিয়ে দিতে চাইছে অথচ রৌদ্র! সে-তো ছাড়ার নামগন্ধটিও নিচ্ছে না। সে ধীরে ধীরে অরিনের ঠোঁটের ওপর আলতো করে দাঁত বসায়। তারপর সেথায় আবারও নিজের জিভের পরশ দিয়ে মাতিয়ে তুললো বেপরোয়া ছেলেটা। অরিনের হাতদুটো ধীরে ধীরে উঠে এলো রৌদ্রের ঘাড়ে এবং পিঠে।অরিন রৌদ্রের চুলগুলো খানিক চেপে ধরতেই,তক্ষুনি দরজার ওপাশ থেকে কড়া নাড়বার শব্দ ভেসে আসে। হঠাৎ এহেন শব্দ থামলো দু’জনে। ওষ্ঠপুট ছেড়ে দিয়ে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।এরইমধ্যে আবারও দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসে জুবাইদা বেগমের কণ্ঠধ্বনি!
“ অরি! মা গেটটা খোল তো!”
অরিন ভয়ে ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো পরপর। রৌদ্রের দিকে চাইলো ভীতু চোখে। অথচ রৌদ্রের চোখেমুখে নেই কোনো ভয় কিংবা সংশয়।সেথায় লেপ্টে আছে একরাশ দুষ্টুমির ছাপ! রৌদ্র তৎক্ষনাৎ কথা না বাড়িয়ে মেয়েটার কন্ঠদেশে মুখ গুঁজে দিলো। অরিন কেঁপে ওঠে খানিকটা। রৌদ্রের ঘাড়ে আঙুল দাবিয়ে বলে ওঠে,
“ বড়মা ডাকছে! কি করবো এখন?”
রৌদ্র মেয়েটার কন্ঠদেশে মুখ গুঁজেই নাক ঘষতে লাগলো। দুষ্ট কন্ঠে বললো,
“ রেসপন্স করো হানি! কথা না বললে তারা উল্টো পাল্টা ভেবে বসবে তো!”
অরিন অবাক হয় এমন কথায়। সে রেসপন্স করবে মানে? পরক্ষণেই মেয়েটার মনে পড়ে — এটাতো তারই রুম। এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে আবারও ডেকে উঠেন জুবাইদা বেগম,
“ কিরে মা! দরজাটা একটু খোল না সোনা।”
অরিন ভয়ে ভয়ে গলা উচিঁয়ে জবাব দিলো,
“ জ্বি বড়মা! কিছু বলবে?”
ঠিক তখনি রৌদ্র মেয়েটার পিঠ খামচে ধরে। হঠাৎ আক্রমণে খানিকটা চেচিয়ে উঠে অরিন।পরক্ষণেই নিজের করা বোকামিতে মুখের ওপর হাত দিয়ে চেপে ধরে মেয়েটা। অন্যদিকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা জুবাইদা বেগম ও রাফিয়া বেগম ভড়কালেন মেয়েটার এমন চেচিয়ে উঠাতে।তারা কেমন বিচলিত হয়ে দরজার গায়ে কড়া নাড়িয়ে বলে ওঠেন,
“ কিরে? তুই এভাবে চেচাচ্ছিস কেনো? এই গেট খোল তুই!”
অরিন পড়লো এবার মহা বিপাকে। মেয়েটা রৌদ্রকে নিজের ওপর থেকে সরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে অনবরত। অথচ ফলাফল শূন্য! রৌদ্র এবার মেয়েটার কন্ঠদেশে দাঁত বসিয়ে দিলো মৃদুভাবে। অরিন তৎক্ষনাৎ নিজের মুখের ওপর হাত দিয়ে চেপে ধরে। ওদিকে তার মা,জেঠিমা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বারেবারে ডেকে যাচ্ছে তাকে।অরিন নিজেকে কিছুটা সময় নিয়ে সামলে বলে,
“ ইয়ে মানে… বড় মা… আসলে আমি ড্রেস চেঞ্জ করছি। এখন খুলতে পারবোনা।”
জুবাইদা বেগম কি বুঝলেন কে জানে। পাশ থেকে রাফিয়া বেগম তখন হুট করেই চেচিয়ে বলে ওঠে,
“ তাহলে তুই এভাবে চেচাচ্ছিলি কেনো?”
অরিন মুখ খুললো জবাব দিতে অথচ জবাবটা আর দিতে পারলোনা মেয়েটা। তার আগেই তার ঠোঁটদুটো ফের দখল করে নিয়েছে রৌদ্র। অরিন রৌদ্রের বুকে দু’হাত দিয়ে ঠেলছে, অথচ ছেলেটা একবিন্দুও নড়ছেনা।স্বাভাবিক অরিনের মতো একটা চুনোপুঁটি কি আর রৌদ্রের মতো ওমন দামড়া পুরুষের সাথে পেরে ওঠে? কিয়তক্ষন বাদেই দরজাটায় ফের সশব্দে কড়া নাড়িয়ে উঠেন রাফিয়া বেগম। দাঁত কিড়মিড় করে তিনি বলতে লাগলেন,
“ এই মেয়ে? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি আমরা? গায়ে লাগে না তোর? কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেনো?”
রৌদ্র তখন ছেড়ে দিলো মেয়েটার ঠোঁট।সে-ই সঙ্গে সরে গেলো মেয়েটার ওপর থেকে। তার কাছ থেকে ছাড়া পেতেই অরিন তৎক্ষনাৎ উঠে বসে।পরক্ষণেই দ্রুত কদমে এগিয়ে আসে দরজার কাছে। খানিকটা হাঁপিয়ে উঠে বলে,
“ ইয়ে মা… আমি সত্যি ড্রেস চেঞ্জ করছি। তুমি একটু পরে এসো প্লিজ!”
রাফিয়া বেগম কান পেতে রেখেছেন মেয়ের ঘরের দরজায়। মেয়ের কথা শেষ হতেই তিনি কেমন ভ্রুকুটি করে সন্দিহান গলায় বললেন,
“ তুই ওমন হাঁপাচ্ছিস কেনো? ড্রেস চেঞ্জ করছিস না-কি পুরো ঘরে দৌড়াচ্ছিস?”
বেচারি অরিন।মায়ের এমন বিচক্ষণ প্রশ্নে এবার কি উত্তর দিবে মেয়েটা? অরিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে কথা গোছাচ্ছে বলার জন্য, ওমনি তাকে পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো রৌদ্র। মেয়েটার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে নিশ্বাস টানতে লাগলো ছেলেটা।এদিকে অরিন কাঁপছে। না.. এবার আর রৌদ্রের স্পর্শে নয়,বরং মায়ের ভয়ে কাঁপছে মেয়েটা। রৌদ্র তখন মেয়েটার উদরে আঙুল স্লাইড করে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এহেন কান্ডে অরিনের শরীর যেন অসার হয়ে আসার উপক্রম। মেয়েটা মিনমিনিয়ে অনুরোধ করছে রৌদ্রকে,
“ প্লিজ থামুন!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা? রৌদ্র তো ব্যস্ত নিজের দুষ্টুমিতে। অরিন তখন ফের নিচু বলে ওঠে,
“ আপনি এখন না থামলে আমি কিন্তু বলে দিবো আপনি এ রুমে।”
এহেন কথায় দুষ্ট হাসলো রৌদ্র। মেয়েটার ঘাড় থেকে মুখ উঠিয়ে, তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
“ বলে দাও হানি! হু স্টপড ইউ?”
এহেন কথায় ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো মেয়েটা। হয়তো সে বুঝে গিয়েছে, এ ছেলেকে কিছু বলেও লাভ নেই। তাইতো মেয়েটা অসহায়ের মতো মুখ করে, খানিক গলা উঁচিয়ে বললো,
“ আম্মু! তুমি নিচে যাও।আমি মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।”
কথাটা শুনে রাফিয়া বেগম আরও কিছু বলতে উদ্যোত হতেই পাশ থেকে জুবাইদা বেগম তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন,
“ থাক না! ও যেহেতু একটু প্রাইভেসি চাচ্ছে তাহলে সেটাই হোক। এরচেয়ে বরং চল.. আমরা ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসি। ওদিকে মেহু না জানি কি করছে।চল চল আয়!”
কথাটা বলেই আর একমুহূর্ত সেথায় দাঁড়ালেন না জুবাইদা বেগম। দ্রুত কদমে চলে গেলেন সেখান থেকে। পিছুপিছু রাফিয়া বেগমও চলে গেলেন। অন্যদিকে, রৌদ্র তখন মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে পা বাড়ায়। ঠিক তখনি পেছন থেকে রৌদ্রের শার্টের কলার টেনে ধরে অরিন। রৌদ্র ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকায়। বাঁকা হেসে দুষ্ট কন্ঠে বলে,
“ থামাস না মেয়ে! থেমে গেলে হয়ে যাবে অনেক কিছু!”
অরিন হাসলো একটুখানি। রৌদ্রকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাথা রাখলো ছেলেটার চওড়া পিঠের ওপর। তারপর খানিক সময় নিয়ে বললো,
“ হলে হোক!”
রৌদ্র হাসলো ঠোঁট কামড়ে। অরিনের হাতদুটো নিজের বুকের ওপর থেকে নামিয়ে পিছনে ঘুরে দাঁড়ালো সে।তারপর অরিনের মাথার পেছনের চুলগুলোকে আলতো করে হাতের মুঠোয় পুরে, অরিনের মুখটা আরেকটু কাছে টেনে আনলো নিজের।অতঃপর মেয়েটার গোলাপি অধরজোড়ার ওপর আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে রৌদ্র কেমন হাস্কি স্বরে বললো,
“ কপালে শনি লেগেছে তোর সানশাইন! তৈরি থাক…”
কথাটা শেষ করে আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না রৌদ্র। চলে গেলো অরিনের রুম ছেড়ে। এদিকে তার চলে যাওয়ার পথে হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে অরিন।মেয়েটার বুকে উঠেছে প্রলয়ের ঢেউ।মাথায় এসে দাঁড়ালো হাজার খানেক প্রশ্ন! কি বলে গেলো লোকটা? তার কপালে শনি লেগেছে মানে?
ড্রয়িং রুমে গোল হয়ে বসে আছেন বয়োজ্যেষ্ঠরা।ওসমান সিকদার গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে মুখে পুরছেন একটু একটু করে, কবির সাহেব নিজের ছোট বেলার সু-কীর্তি গাইছেন ভিষণ আনন্দের সাথে। সাব্বির সাহেব সামনের টেবিলের ওপর থেকে দুয়েকটা আঙুর তুলে মুখে দিচ্ছেন।অন্যদিকে তাশরিক সাহেব তায়েফ সাহেবের সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত! রেহানের মা বাড়ির গৃহিনীদের সঙ্গে রান্নাঘরে বসেই আড্ডা জমিয়েছেন বেশ। আমরিন বেগম এবং মেহনুর বেগমও সায় দিচ্ছেন তাদের সঙ্গে। কিয়তক্ষন বাদেই পায়েস রান্না শেষ হলো রাফিয়া বেগমের।তিনি কাজ শেষ করেই সকলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
“ চলুন সবাই… ড্রয়িং রুমে যাওয়া যাক।”
অগত্যা এমন প্রস্তাবে রাজি হলেন রমণীরা।সকলেই একযোগে হাঁটা ধরলো ড্রয়িং রুমের দিকে। রাইসা বেগম এবং মাইমুনা বেগম হাতে দুটো সার্ভিং ট্রে নিয়ে এগিয়ে চলছে ধীরে ধীরে।
সবাই যখন আড্ডাতে মশগুল ঠিক তখনি ড্রয়িং এ এসে উপস্থিত হলো রৌদ্র। ছেলেটা এসেই সকলের সামনে একপ্রকার জোরালো কন্ঠে বাবাকে ডাক দিয়ে বললো,
“ আব্বু!”
এহেন ডাকে কথা থামিয়ে ছেলের দিকে চাইলেন কবির সাহেব। হাসিমুখেই ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন,
“ কি হয়েছে?”
রৌদ্র তখন কোনরূপ ভনিতা ছাড়াই ফটফট কন্ঠে বললো,
“ আব্বু! আমি বিয়ে করবো।”
অগত্যা এহেন কথায় যেন মুহুর্তেই থতমত খেয়ে বসলেন সকলে। ওসমান সাহেবের চায়ের কাপে অর্ধ-ডুবিত হাতখানা সেখানেই থমকে গেলো হত-বিহবলতায়। সাব্বির সাহেব মাত্রই চায়ের কাপে চুমুক বসিয়েছিলেন কোনরকম।কিন্তু হুট করেই রৌদ্রের বলা এহেন কথায় নাকেমুখে উঠে গেলো মানুষটার।তায়েফ সাহেব খানিকটা এগিয়ে এসে ভাইয়ের পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন। তাশরিক সাহেবও দিন-দুনিয়া ভুলে হা করে তাকিয়ে আছেন রৌদ্রের দিকে। অন্যদিকে, বাড়ির রমণীরা মাত্র পা রেখেছিলেন ড্রয়িং রুমে। তখনি রৌদ্রের বলা ওমন সোজাসাপটা আবদারে থমকে দাঁড়ালেন সকলে।
কিয়তক্ষন বাদে কবির সাহেব খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠেন। মুখে সামান্য জোরপূর্বক হাসি টেনে বললেন,
“ হ্যা,বিয়ে তো দেবই বলেছি। এইতো আগামী মাসের.. ”
বেচারার মুখের কথাটাও সম্পূর্ন হতে দিলো না রৌদ্র। এর আগেই সে মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বলে ওঠে,
“ না হবেনা…এতো ধৈর্য্য নেই আমার।আমি কালকেই অরিকে বিয়ে করবো।তোমরা ব্যাবস্থা করো।”
এপর্যায়ে খানিকটা বিরক্ত হলেন কবির সাহেব। তিনি চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি ভাব নিয়ে কাঠকাঠ কন্ঠে বললেন,
“ মাথা ঠিক আছে তোমার? একদিনের মধ্যে এতো এতো ব্যবস্থা কিভাবে হবে? তাছাড়া বিয়েটা তো আর মুখের কথা নয়।”
“ সে যাইহোক আব্বু! আমি আর অপেক্ষা করতে পারবোনা। আমি ওকে কালকেই বিয়ে করবো।”
বাবা-ছেলের ওমন বাক-বিতন্ডায় হতবাক সকলে। অনিক মাত্রই বাইরে থেকে এসেছিলো,কিন্তু এসেই রোদ ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে জায়গাতেই দাঁড়িয়ে পড়লো ছেলেটা। হয়তো ভাবছে সে..রোদ ভাইয়ের আবার হঠাৎ করে কি হলো?
কবির সাহেব মানছেন না কোনমতেই। লোকটা নিজের কথায় একপ্রকার অনড় হয়ে আছেন। অন্যদিকে রৌদ্রও থেমে যাওয়ার পাত্র নয়।সেও ত্যাড়ামি করে নিজের কথায় একপ্রকার গো ধরে বসে আছে। কিয়তক্ষন চললো দু’জনার বাক-বিতর্ক। অবশেষে অবস্থা বেগতিক দেখে মাঝ থেকে ওসমান সিকদার খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“ ইয়ে মানে.. ভাইজান রাগ করবেন না আমি একটা কথা বলি। ছেলে যেহেতু মুখ ফুটে চাইছে,তাহলে বিয়েটা নাহয় করিয়েই দিন। তাছাড়া কথায় আছে না? মিয়া বিবি রাজি তো কেয়া কারেগা কাজী? আসলে ব্যাপারটা ঐরকমি…”
অগত্যা বেয়াইয়ের মুখে এমন কথা শুনে খানিকটা দমে গেলেন কবির সাহেব। তিনি কিছুক্ষণ মুখ গম্ভীর করে বসে রইলেন। তারপর সময় নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“ ঠিক আছে। তবে তা-ই হোক! আগামী সপ্তাহেই তোমার… ”
“ না আমি কালকেই বিয়ে করবো।”
“ রোদ!!”
“ চিৎকার করোনা।হার্টে ব্যাথা উঠবে পরে। আপাতত আমি নিজের বিয়ে নিয়ে কনসেন্ট্রেট হতে চাচ্ছি,তাই এমুহূর্তে অসুস্থ হয়ে পড়লেও আমি কোনো দেখভাল করতে পারবোনা বলে দিলাম।”
ছেলের এহেন লাগামহীন কথায় হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন কবির সাহেব। অন্যদিকে বাকিরা মুখ টিপে হাসছেন। ওসমান সিকদার পা টিপে টিপে এসে দাঁড়ালেন স্ত্রীর পাশে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন,
“ ভেবেছিলাম আমার ছেলেটাই বুঝি বিয়ে পাগল ছিলো কিন্তু এখন আমার সে-ই ধারণাটা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হলো।”
সায়মা খাতুন শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে মৃদু হাসলেন। এদিকে রৌদ্র আবারও তাড়া দিয়ে বলে ওঠে,
“ তোমরা বিয়ে করাবে কি-না বলো? নয়তো আমি নিজে গিয়েই বিয়ে করে ফেলবো।”
অগত্যা এমন প্রস্তাব শুনে দাঁত কটমট করে ছেলের দিকে চাইলেন কবির সাহেব। রৌদ্র বাবার এহেন দৃষ্টি দেখে ড্যাম কেয়ার একটা ভাব নিয়ে দাঁড়ালো। কবির সাহেব কটমট করে যে-ই না কিছু বলতে যাবেন তখনি পাশ থেকে সাব্বির সাহেব তড়িঘড়ি করে বললেন,
“ ভাইজান! থাক না।মেনে যাও ব্যাপারটা।আজ নাহয় কাল তো বিয়েটা হতোই। যেটা কয়েকদিন পরে হতো সেটা নাহয় দুদিন বাদেই হোক।”
সকলের এমন মতিগতি দেখে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন কবির সাহেব। মাথাটা দুদিকে নাড়িয়ে অবশেষে তিনি ছেলের কথায় রাজি হয়ে বললেন,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬২
“ ঠিক আছে। তোমার কথাই রইলো। আগামী পরশু তোমার বিয়ে হবে।”
“ কিন্তু আমিতো পরশু বলিনি আব্বু।আমি কালকেই বিয়ে করবো বলেছি।”
এপর্যায়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলেন কবির সাহেব,
“ বিয়ের আগে একটু-আধটু হলুদ ছোঁয়াবো না তোমায় বেয়াদব ছেলে? সব কি তোমার মুখের কথাতেই হবে না-কি? আরেকটা কথা বাড়ালে একেবারে আগামী বছর বিয়ে করাবো বলে রাখলাম। যত্তসব নির্লজ্জ ছেলেপেলে।”