সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৭১

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৭১
Jannatul Firdaus Mithila

“ Raat ka nasha abhi… aankh se gaya nahin..
Tera nashila badan baahon ne chhoda nahin..
Aankhen to kholi magar sapna woh toda nahin..
Haan wohi wohi…”

অরিনের পাদু’টো হুট করেই জমে গেলো যেন।সে তড়াক ঘাড় বাকিয়ে পেছনে তাকায়। একহাত দুরত্বে দাঁড়িয়ে, দুষ্ট কন্ঠে গান গাইছে রৌদ্র। তার দুষ্ট চাহনি এমুহূর্তে অরিনের পানেই নিবদ্ধ। অরিন তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে আনে। লজ্জায় গালদুটো কেমন লাল হয়ে গেলো মেয়েটার! লোকটা দেখছি দিনকে দিন মাত্রাতিরিক্ত বেহায়া হচ্ছে! শুধু শুধু মেয়েটাকে লজ্জা দেবার পায়তারা খোঁজে। অরিন তৎক্ষনাৎ খুড়িয়ে খুড়িয়ে পা বাড়ায় ওয়াশরুমের দিকে। তবে যাওয়ার পথে আবারও তার কানে ভেসে আসে রৌদ্রের দুষ্ট কন্ঠ!
“ সানশাইন! একা একা মেনেজ করতে পারবি তো? নাকি আমি আসবো একটুখানি হেল্প করতে?”
এহেন কথা শোনামাত্রই আঁতকে ওঠে অরিন। তড়িৎ গতিতে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“ মাফ করেন প্লিজ!”
রৌদ্র ঘর কাপিয়ে হেসে ওঠে এবার। হাসতে হাসতে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে চট করে গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। হাসিমুখেই বিরবির করে বললো,
“ আহা! বউ আমার এটুকুতেই ভয় পেয়ে গেলো! ধূর!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ বউ! একটু খেয়ে নাও প্লিজ।আচ্ছা.. ভালো না লাগলে আবারও নাহয় আমার ওপর বমি করে দিও কেমন?”
সকাল থেকে এ নিয়ে দুবার বমি-টমি করে বেজায় ক্লান্ত রুহি।ক্লান্ত দেহটা তার কোনমতে লেপ্টে আছে রেহানের বুকে। কিছুক্ষণ আগেও দু-টুকরো কমলা মুখে দিতেই রেহানের গায়ের ওপর হড়হড় করে বমি করে ভাসিয়েছে বেচারি। এতে অবশ্য রেহানের বিন্দুমাত্র বিরক্তি নেই। ভদ্র ছেলেটা বিরক্ত হবার বদলে উল্টো বউয়ের মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে, বউকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিয়ে অবশেষে নিজেও গা ধুয়ে এসেছে। রুহিকে নিজের বুকের মাঝে গভীরভাবে লেপ্টে রেখে আদুরে কন্ঠে বলে,

“ ফ্রুটস খাবে না বউ?”
রুহি রেহানের বুকে পড়ে থেকেই দু’ধারে মাথা নাড়ায়। রেহান মুচকি হাসলো। মেয়েটার মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“ কি খাবে তাহলে?”
রুহি চট করে মাথা তুললো। রেহানের দিকে তাকালো দুষ্ট চোখে। রেহান ভড়কায় মেয়েটার এহেন চাহনি দেখে। রুহিকে ঠোঁট কামড়ে এগোতে দেখে রেহান কেমন মেকি ভাব ধরে নিজের গলার কাছের শার্টটা খানিক মুচড়ে ধরলো। অতঃপর নাটকীয় ভঙ্গিতে টেনে টেনে বললো,
“ কি চাই আপনার?”
রুহি ঠোঁট কামড়ে হাসলো। ক্লান্তিতে মুদে আসা চোখদুটো বহুকষ্টে টেনেটুনে খুলে রেখে বললো,
“ তোমাকে হ্যান্ডসাম!”
রেহান মুচকি হাসে। কন্ঠে কপট নাটকীয় ভাব ধরে বলে,

“ নাআআআ! এ আপনি করতে পারেন না! প্লিজ আমার এতোবড় সর্বনাশ করবেন না! আমার ঘরে বউ আছে! সে আমায় এভাবে দেখলে পিট্টুনি দিবে!”
রুহি ফিক করে হেসে ওঠে এরূপ কথায়। পরক্ষনেই রেহানের বুকের ওপর আলতো করে হাত রেখে ধীমী স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“ বউকে ভয় পান বুঝি?”
রেহান ফিচেল হাসলো। রুহির চকচকে হয়ে আসা চোখদুটোর পানে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, নিরেট কন্ঠে বললো,
“ সে কি আর বলতে?”
রুহি মৃদু হেসে তৎক্ষনাৎ রেহানের বুক বরাবর দু’হাতে ধাক্কা দিয়ে বসলো।ঘটনার আকস্মিকতায় বেচারা গিয়ে হেলে পড়লো বিছানায়। হতচকিত কন্ঠে বললো,
“ কি করছো শ্যামবতী?”

রুহি নির্বাক! ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসির রেশ টেনে, উঠে বসলো রেহানের বুকে ভর দিয়ে। রেহান থমকায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য। বেচারার নিঃশ্বাসের গতি যেন হুট করেই বেড়ে গেলো কয়েকগুণ! সে তৎক্ষনাৎ ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলায়। রুহির দু’পায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে হাস্কি স্বরে বলে,
“ নেমে যাও শ্যামবতী! আমি কেন যেন নিজেকে আটকাতে পারছিনা!”
রুহি জবাবে আহত হাসলো। নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে রেহানের প্রশস্ত বুকটায় মাথা এলিয়ে দিলো। দু-হাতে রেহানকে ঝাপটে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
“ তুমি আর আমায় ভালোবাসোনা তাইনা?”
ফট করে মাথা তুললো রেহান।বিস্ফোরিত নেত্রে তাকালো রুহির আঁধারে নিমজ্জিত মুখপানে। কন্ঠে ভারি গাম্ভীর্যের ছাপ ফেলে বললো,

“ কিসব বলছো তুমি? হঠাৎ করে এমনটা মনে হবার কারণটাই বা কি?”
রুহি মাথা নুইয়ে মিনমিনে স্বরে বলতে লাগলো,
“ এই যে! তুমি আমায় নিজের কাছে টেনে নাও না! একটু আদর দাওনা আগের মতো! এটা কি আমায় দূরদূর করে দেওয়া নয়?”
রেহান হতবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। রুহি অসুস্থ বলেই না সে ইদানিং বহুকষ্টে নিজেকে সামলে রাখছে। এখন কি-না তার অবুঝ বউটা উল্টো তাকেই দোষী বানাচ্ছে! রেহান নিজ ভাবনায় নিমগ্ন থেকেই ঠোঁট কামড়ে হাসলো। পরক্ষণেই হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে আলতো করে বুকে চেপে ধরলো।দুষ্ট কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো,
“সরাসরি বললেই হতো… বাসর বাসর ফিল হচ্ছে! তারজন্য এভাবে নাক-মুখ লাল করে ফেলার কি আছে শুনি?”
রুহি তৎক্ষনাৎ মুখ কুঁচকায়। রেহানের বুক থেকে সরে আসার প্রয়াস চালিয়ে নাক কুঁচকে বলে ওঠে,

“ ছিহঃ মুখে কিছু আটকায় না তাইনা? দেখি ছাড়ো আমায়।”
রেহান ছাড়লো না মেয়েটাকে।উল্টো গভীরভাবে মিশিয়ে নিলো নিজের সঙ্গে। প্রায় মিনিট খানেক পর রুহি নড়চড় থামিয়ে স্বাভাবিক হলো। বিরবির করে বললো,
“ ছেড়ে দাও রেহান! এখন এসব না!”
রেহান কি আদৌও শুনলো সে কথা? সে উল্টো মেয়েটার কাঁধ বরাবর নাক ঘষে হাস্কি স্বরে বললো,
“ এসবের জন্য সময় নয় বউ, মুড দরকার! আর এমুহূর্তে আমার ভিষণ মুড হচ্ছে এসবের। সো কথা না বাড়িয়ে জাস্ট কো-অপারেট উইথ মি !”

একে একে বেশ কয়েকবার কল এসে কেটে গিয়েছে ইকরার ফোনে। তবুও মেয়েটার সেদিকে কোনরুপ ধ্যান নেই। তাছাড়া ধ্যান থাকবেই বা কিভাবে? সে যে নাক টেনে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। ওদিকে ইকরাদের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিক। ছেলেটা গত আধঘন্টা যাবত একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে ইকরার ফোনে। কিন্তু ওপাশ থেকে কলটা যেন আজ আর রিসিভ হবার নয়। অনিক অবশেষে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। বিরবির করে বললো,

“ কি ঘুম রে বাবা!”
পরক্ষনেই আর গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে না থেকে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। সম্মুখ দরজার কলিং বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করলো মিনিট দুয়েকের মতো। কিয়তকাল বাদেই ধীরসুস্থে দরজা খুলেন শাহানুর সাহেব। সামনেই ঘেমে-নেয়ে একাকার অনিককে দেখে গালভর্তি হাসি টানলেন মানুষটা। দরজার কাছ থেকে হাত সরিয়ে বলতে লাগলেন,
“ আরে! ছোটো সাহেব যে! আয় ভেতরে আয়।”
অনিক সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে প্রবেশ করতেই হাতের বা-দিকে ছোট্ট একটা ড্রয়িং রুমের মতো বসার জায়গা। অনিক মৃদু হেসে সেথায় গিয়ে বসলো। এদিকে শাহানুর সাহেব তৎক্ষনাৎ গলা উঁচিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“ আমরিন! দেখো কে এসেছে!”

আমরিন বেগম চুলোয় রান্না চড়িয়েছেন। স্বামীর ওমন হাঁক ডাকে তিনি বোধহয় খানিকটা বিরক্ত হলেন। সম্পূর্ণ কথাটা ঠিকঠাক না শুনেই খুন্তি হাতে বেরিয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। বিরক্ত কন্ঠে যে-ই না কিছু বলতে যাবেন ওমনি তার দৃষ্টি গিয়ে আটকালো অনিকের ওপর। এদিকে ফুপুকে খুন্তি হাতে আসতে দেখে অনিক বুঝি ভড়কে গেলো খানিকটা! সে হকচকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই আমরিন বেগম জিভে দাঁত বসিয়ে খুন্তিটা পিছিয়ে নিলেন। পরক্ষণেই হাসিমুখে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন অনিকের পাশে। বললেন,

“ কখন এলি আব্বু?”
“ বেশিক্ষণ হয়নি ফুপ্পি! এইতো মিনিট পাঁচেক হবে মেবি!”
আমরিন বেগম ঠোঁট গোল করলেন। খানিকটা রয়েসয়ে ফের জিজ্ঞেস করলেন,
“ ও বাড়ির সকলের কি অবস্থা এখন?”
“ ভালো! আর শোনো, বড়আব্বু পাঠিয়েছে আমায় তোমাদেরকে নিয়ে যেতে। তাই তারাতাড়ি রেডি হও।”
আমরিন বেগম একপলক স্বামীর দিকে তাকালেন।শাহানুর সাহেব মুচকি হাসলেন তক্ষুনি। আমরিন বেগম আশ্বস্ত হয়ে পরক্ষণেই বললেন,

“ কিন্তু চুলোয় তো রান্না চাপানো! রান্নাটা নাহয় আগে শেষ করি।তারপর…”
বাদবাকি কথাটা শেষ করবার পূর্বেই অনিক মাঝ থেকে বলে ওঠে,
“ রান্না যা হওয়ার হয়েছে। এখন গিয়ে রেডি হও যাও।তোমাদের বাড়িতে দিয়ে এসে আমার আবার একটা কাজে বেরোতে হবে। তাই প্লিজ তারাতাড়ি করো!”

অগত্যা এমন কথার পিঠে বলার মতো আর কথা খুঁজে পেলেন না আমরিন বেগম। চুপচাপ চলে গেলেন মাথা নাড়িয়ে। শাহানুর সাহেব অনিকের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে পরমুহূর্তেই চলে গেলেন তৈরি হতে।অবশেষে ড্রয়িং রুমের সোফায় একা বসে রইলো অনিক।বেচারা একহাতে ফোন নিয়ে এখনো কল দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটাকে। তবে এখনো সেই কল রিসিভ হবার নাম-গন্ধটিও নেই।শান্তশিষ্ট অনিকের মেজাজ বিগড়ে যায় এপর্যায়ে। কি এত ঘুম মেয়েটার? যার জন্য এতগুলো কলের একটাও টের পেলো না সে! অনিক তৎক্ষনাৎ উঠে চলে যায় সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়। ইফতির ঘরের পাশ কাটিয়ে চলে যাবার সময়,হুট করেই তার চোখাচোখি হয় ইফতির সঙ্গে। অনিক থামলো একমুহূর্তের জন্য! ইফতি তাকে দেখেই ঠোঁটের কোণে সৌজন্যমূলক হাসি টেনে বললো,

“ কি অনিক ভাই? কেমন আছো তুমি?”
অনিক গম্ভীর মুখেই হাসলো খানিকটা। মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ এইতো আলহামদুলিল্লাহ! তোমার কি অবস্থা?”
“ চলছে কোনরকম! তা ওদিকে যাচ্ছিলে কোথায়?”
এহেন কথায় থতমত খেয়ে বসলো অনিক।এবার কি উত্তর দিবে সে? অনিককে ওমন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাঁকা হাসলো ইফতি। বিচক্ষণ মস্তিষ্ক কাজে লাগিয়ে হুট করেই বললো,
“ কল ধরছেনা না-কি?”
তড়াক হতভম্ব চোখে তাকায় অনিক।চোখেমুখে তার এক আকাশসম অবাকের রেশ। হয়তো মনে মনে ভাবছে — তার মনের কথা ইফতি টের পেলো কিভাবে?
এদিকে ইফতি খানিক মুচকি হেসে বলতে লাগলো,
“ এতো অবাক হবার কিছুই নেই ভাই। আপনার যে খুব বেশি তাড়া আমার দুলাভাই হবার সেটা আমি জানি!”
এপর্যায়ে স্মিত হাসলো অনিক। হাত ঘুরিয়ে ইফতির কাঁধ জড়িয়ে ধরলো মুহুর্তেই। নিচু কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ দুলাভাই হিসেবে কেমন লাগলো আমায়?”
ইফতি একহাতে অনিকের হাতটা আরও খানিকটা টেনে ধরে মৃদুস্বরে বললো,

“ রেটিং করলে ১০০/১০! কি চলবে না?”
অনিক কেমন বিজয়ী হাসলো।ইফতির পিঠ বরাবর শক্ত হাতের থাবা বসিয়ে আপ্লূত কন্ঠে বললো,
“ আবার জিগায়? চলবে মানে! এতো এক্কেবারে দৌড়াবে!”
এদিকে অনিকের ওমন শক্ত পোক্ত হাতের থাবা পিঠে পড়তেই মৃদু ব্যাথায় নাকমুখ কুঁচকে আসে ইফতির। ছেলেটা একহাতে পিঠ ডলতে ডলতে বললো,
“ ধূর মিয়া! আমার গায়ে হাত তোলার অপরাধে তোমার কাছে বোনের বিয়ে দিবোনা যাও।”
অনিক বাঁকা হাসলো। একহাতে শার্টের কলারটা খানিক টেনেটুনে ভিষণ ভাবের সাথে বললো,
“ না দিলে নাই! এহসান বাড়ির ছেলেরা কারো অনুমতির অপেক্ষায় থাকেনা।যাকে ভালোবাসে, তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে হলেও নিজের করে ছাড়ে! তুমি চাইলে ইতিহাস ঘেটে দেখতে পারো সম্বন্ধী!”

লাল-খয়েরী রঙের সুতির শাড়ি পড়ে খাটের মাঝখানে লজ্জালু ভঙ্গিতে মাথানিচু করে বসে আছে অরিন।তার সামনেই একগাদা খাবার-দাবার নিয়ে বসে আছে রৌদ্র। অরিন আড়চোখে তাকায় প্লেট ভর্তি খাবার দেখে। লোকটা কাল থেকে যে কি শুরু করেছে! ক্ষনে ক্ষনে প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে চলে আসে খাওয়াতে। সে-কি জানেনা,অরিন এতো খাবার খেতে পারেনা? নাকি সবটা জেনেও ইচ্ছে করে এমনটা করছে সে কে জানে! রৌদ্র মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

“ খাবারটা খেয়ে নে সানশাইন!”
অরিন মুখ কুঁচকায়। বিরক্তি নিয়ে বলে,
“ এতোগুলো খাবার খেতে পারবোনা!”
রৌদ্র শুনলোনা কথাগুলো। উল্টো নিজ উদ্যোগে প্লেট হাতে নিয়ে খাবার মাখাতে লাগলো যত্নের সাথে। অতঃপর ক্ষুদ্র লোকমা তুলে অরিনের মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“ হা কর!”
অরিন আর্তনাদ করে ফের বললো, “ সত্যি এতো খেতে পারবোনা!”
রৌদ্র ফিচেল হাসলো। শান্ত কন্ঠে বললো,
“ সেটা আমি দেখবো।তুমি হা করো বউজান! তাছাড়া শরীরে শক্তি না থাকলে, আমার আদরগুলো সইবে কিভাবে হানি? আমাকে হ্যান্ডেল করতে হলেও তো তোমার বেশি করে খাওয়া উচিত!”
এহেন বাক্য কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই নাকেমুখে উঠে গেলো অরিনের। বেচারির কাশতে কাশতে যাচ্ছে তাই অবস্থা! রৌদ্র তৎক্ষনাৎ বিচলিত হয়ে পড়লো মেয়েটাকে নিয়ে। একহাত বাড়িয়ে গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে অরিনকে খাইয়ে দিতে লাগলো ধীরে ধীরে। অন্যহাতে মেয়েটার পিঠের ওপর আলতো করে মালিশ করতে লাগলো সে। প্রায় কিয়তক্ষন পর অরিনের কাশি থামলো। রৌদ্র তক্ষুনি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ আর ইউ ওকে হানি?”
অরিন নিঃশব্দে ওপর নিচ মাথায় নাড়ায়।রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো তা দেখে। পরক্ষণেই আবারও জিজ্ঞেস করে,
“ এবার দেই?”
অরিন তক্ষুনি হকচকিয়ে ওঠে। খানিকটা পিছিয়ে হতচকিত কন্ঠে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করে,
“ এই না!”
রৌদ্র সরু চোখে তাকায় এবার। মেয়েটার আগাগোড়া একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরোখ করে পরমুহূর্তেই ঠোঁট কামড়ে হাসলো ছেলেটা। দুষ্ট কন্ঠে বললো,
“ না কেনো?”
অরিন আগের ন্যায় পিছিয়ে যেতে যেতে বললো,

“ আপনি এমন করছেন কেনো? একটু তো সবুর করুণ। আমি কিভাবে এতোকিছু সহ্য করবো?”
রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে কিয়তক্ষন চুপ করে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই বাঁকা হেসে সন্দিহান গলায় বলে ওঠলো,
“ কিন্তু খাবার খাওয়ার সাথে সহ্য করার টপিকটা আসলো কোথা থেকে হানি?”
এবার যেন আকাশ থেকে পড়লো অরিন। হতবুদ্ধির ন্যায় অবুঝের মতো বললো,
“ আপনি খাবার খাওয়ার কথা বলছিলেন?”
রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে রেখেই ওপর নিচ মাথা নাড়ায়। অরিন থতমত খেয়ে বসলো তখন। মানুষটা তাকে খাবার খাওয়ার কথা বলছিলো আর সে-কিনা ভেবে বসেছিলো কতকিছু! হায়রে! দু’দিনেই মাইন্ডটা তার এক্কেবারে পাপিষ্ঠ হয়ে গেলো মনে হচ্ছে! রৌদ্র অরিনের নিরবতা দেখে বাঁকা হাসলো। দুষ্ট কন্ঠে কপট ভাব নিয়ে বললো,

“ কেনো হানি? তুমি কি ভেবেছিলে?”
অরিন হকচকায়।থতমত খেয়ে আমতাআমতা করে বলে,
“ কই নাতো! তেমন কিছু না!”
“ সত্যি?”
“ হ-হ্যা!”
রৌদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরক্ষণেই দুষ্ট কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ রাতের জন্য প্রস্তুত হও হানি!এখন নাহয় তোমায় খাইয়ে দিচ্ছি,তবে রাতের নিস্তব্ধতায় খাবার সামনে রেখে আমি কিন্তু আর উপোস করে থাকতে পারবোনা। সো বি রেডি!”
অরিন শুকনো ঢোক গিললো পরপর। এবার আর কি বলবে সে? কিভাবে বাঁধা দিবে এই পাগল লোককে? তাছাড়া বাঁধা দিলেও কি এই লোক শুনবে তার কথা?

“ কি সম্বন্ধিমশাই? বাসর রাত কেমন কাটলো আপনার? যদিওবা আপনার ওয়াইল্ড নেসের নিদর্শন সকাল সকালই পেয়ে গেছি আমরা! তা বলছিলাম কি… একটু রয়েসয়ে করলে হতোনা?”
ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র। হসপিটাল থেকে ইমার্জেন্সি একটা মেইল এসেছে তার। সেটাতেই আপাতত যত ফোকাস তার।কিন্তু এরইমাঝে পেছন থেকে ভেসে আসা রেহানের দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে তৎক্ষনাৎ ঘাড় বাকিয়ে তাকায় রৌদ্র। রেহান দুষ্ট হেসে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো রৌদ্রের পাশাপাশি। ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বিজ্ঞের ন্যায় বললো,

“ দেখ ভাই! বাসর শুধু তুই একা না,আমরাও করেছি।তবুও তোর মতো কাট ভাঙিনি এটলিস্ট! বলি এতোটা কন্ট্রোললেস হলে কি আর হয় ডাক্তার?”
রৌদ্র চোয়াল শক্ত করে তাকায়। কর্কশ গলায় বলে,
“ অয়েল অন ইউর ওন মেশিন! আমারটা নাহয় আমাকেই বুঝতে দে!”
রেহান মুখ বাঁকায়।কাঁধ ঝেড়ে বলে,
“ তুমি করলে রঙ্গলিলা,আমি করলে পাপ!
বেশি কথা বলতে গেলে কয় হাজি সাহেবের মুখটা খারাপ! তাই-না? তুমি মনা বাসর করতে গিয়ে খাট ভাঙতে পারবা,আর আমি একটু বলতেই তোমার গায়ে লেগে গেলো? এ কেমন স্বৈরাচারী আচার-আচরণ রে ভাই? আমি এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি!”
রৌদ্র আর নিজের গম্ভীর মুখভঙ্গি ধরে রাখতে পারলোনা। রেহানের ওমন নাটকীয় কথায় না চাইতেও হেসে ওঠে সে।পরক্ষণেই চোখের পলকে একহাতে রেহানের কাঁধ আঁকড়ে ধরে বললো,

“ আরকিছু বলবি?”
রেহান বুঝি সুযোগ পেয়ে গেলো খানিকটা। সে খানিক গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“ ইয়ে মানে বলছিলাম কি! আমার বউমা আসবে কবে?”
রৌদ্র ভ্রু কুঁচকায়।বুঝতে না পেরে আবারও জিজ্ঞেস করে,
“ এই বউ মা-টা কে?”
রেহান কেমন গালভর্তি হাসি টানলো মনে হচ্ছে! সে খানিক সময় নিয়ে রয়েসয়ে বললো,
“ আরে! আমার ছেলের বউ।মানে তোর মেয়ে! সে আসবে কবে?”
রৌদ্র আগের ন্যায় মুখভঙ্গি ধরে রেখে সন্দিষ্ট কন্ঠে বলে,
“ সেটা আমি…”
পুরোটা শেষ করার পূর্বেই সম্বিৎ ফিরলো রৌদ্রের।রেহানের কথার গভীরতা টের পেয়ে চোখ সরু করে তাকায় সে।গম্ভীর গলায় বলে,

“ আমার মেয়ে তোর ছেলের বউ হতে যাবে কেনো?”
এপর্যায়ে চটে গেলো রেহান।তেতে ওঠা কন্ঠে বললো,
“ এই কি বললি? হতে যাবে মানে? তোর মেয়ে ভূমিষ্ট হবার সাথে সাথেই সে হবে আমার ছেলের বউ।এখন তুই এটাকে পাগলামি বল আর যাই বল,এটা আমি করেই ছাড়বো দেখিস।তোকে আমি আমার বেয়াই বানাবোই বানাবো!”
রৌদ্র গা-ছাড়া ভাব নিয়ে হাঁটতে লাগলো। প্যান্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে রেখে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো,
“ আশায় বান্ধো বাসা!”

সন্ধ্যার দিকে ড্রয়িং রুমে গোল হয়ে বসে আছে এহসান বাড়ির বড় সদস্যরা। নিজেদের মধ্যে স্মৃতিচারণে ব্যস্ত সকলে। অন্যদিকে, বাড়ির ছোট সদস্যরা দোতলার ড্রয়িং এ বসে আড্ডা জমিয়েছে বেশ। ইকরা এবং ইফতিও যেগ দিয়েছে তাতে। ইফতি এখানে থাকায় আহিরা কিছুক্ষণ পরেই চলে গেলো নিজের রুমে। ইদানিং ইফতিকে আশেপাশে দেখলেই গা জ্বলে তার।কিন্তু তা কেনো? সেটা সে নিজেও জানেনা। আহিরা বিরক্তি নিয়ে ঘরে আসে। রুমে পা রাখতেই দেখে — মাহিরা চুপচাপ খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ছে। আহিরা একপলক সেদিকে তাকিয়ে নিজের খাটে গিয়ে বসলো। তার উপস্থিতি টের পেতেই মাহিরা নড়েচড়ে উঠে বসলো। গম্ভীর মুখে খানিকটা সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আহি?”
আহিরা তেমন গুরুত্ব না দিয়েই বললো,
“ ঝেড়ে কাশ!”
মাহিরা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। মুখে সামান্য লাজুক ভাব টেনে বললো,
“ তুই কি কাউকে পছন্দ করিস?”
থমকায় আহিরা। ঘাড় বাকিয়ে তাকায় মাহির দিকে। সন্দিহান গলায় বলে ওঠে,
“ হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“ আহা! বল না!”
“ না!”
মাহিরা বোধহয় বিশ্বাস করলোনা কথাটা।তার চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে অবিশ্বাসের ছাপ! সে মেয়েটাকে খানিক বাজিয়ে দেখতে বললো,
“ কিন্তু সে যে বললো তুই তাকে ভালোবাসিস!”
তড়িৎ ভড়কে তাকায় আহিরা।তৎক্ষনাৎ কর্কশ গলায় নাকচ করে দিয়ে বলে,
“ মোটেও না। আমি ঐ ইফতিকে একদম ভালোবাসি না।”
মাহিরা মুচকি হাসলো। উঠে এসে নিঃশব্দে পাশে বসলো আহির।আলতো স্বরে বললো,
“ কিন্তু আমিতো একবারও ইফতি ভাইয়াকে মেনশন করিনি। তাহলে তুই কিভাবে বুঝলি, আমি ইফতি ভাইয়ার কথাই বলছিলাম?”

এহেন কথায় আরেকদফা থমকায় আহিরা। আমতাআমতা করতে থাকে সে।মাহি আলতো হেসে কাঁধে হাত রাখলো মেয়েটার।কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
“ যাকে মনে মনে পছন্দ করিস,তার প্রতি মনের কোণে জমে থাকা ভালোবাসার কথাটা মুখে নিয়ে আসতে এতো দ্বিধা কেনো বলতো? এটা কি আদৌও ঠিক বল?”
আহিরা নিশ্চুপ। মাথাটা আলগোছে নিচু করে রেখেছে সে।মাহিরা স্মিত হেসে বোনকে পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। থুতনি রাখলো বোনের কাঁধে। অতঃপর বলতে লাগলো,
“ জানিস আহি? আমি না..এসব লাভ-সাবে বিশ্বাস করতাম না কখনোই। আমি প্রায়ই মনে হতো, পৃথিবীতে হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসা বলতে কিচ্ছুই নেই।তবে আমার এই ভুল ধারণাটা একদম ভেঙে গিয়েছে সেদিন, যেদিন আমি প্রথমবার রোদ ভাইকে অরিপুর জন্য সবার সঙ্গে লড়তে দেখেছি। সেদিন রোদ ভাইয়ের চোখে অরিপুর জন্য যেই অনুভুতি গুলো ছিলো, বিশ্বাস কর সেটা সবকিছুর উর্ধ্বে! ঠিক তেমনি অনুভুতি আমি আরেকজনের চোখে উপলব্ধি করেছি তাও আবার তোর জন্য। জানিস কে সেটা?”

আহিরা জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। মাহিরা মুচকি হেসে বলে ওঠে,
“ আরে বুদ্ধু! ইফতি ভাই।সে তোকে সত্যি ভালোবাসে।ইভেন আমার সাথে এ নিয়ে যে কয়েকবার তার দেখা হয়েছে, সে কয়েকবার তার সবগুলো কথাই ছিলো একমাত্র তোকে ঘিরে! আমি বরাবরই মনোযোগ দিয়ে শুনতাম সবকিছু। কেন যেন ভালো লাগতো শুনতে। তুই আবার ভুলেও ভাবিস না, আমি তাকে পছন্দ করি! উঁহু! যার চোখে অন্যের জন্য মুগ্ধতা প্রকাশ পায়,তাকে আবার ভালোবাসতে যাবো কোন দুঃখে?”
আহিরা ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে।বোধহয় কাঁদতে চাইছে মেয়েটা।মাহিরা হয়তো বুঝলো সে কান্ড। সে তৎক্ষনাৎ আহিরাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে এনে বললো,
“ ধূর বোকা! এতবড় মেয়ে হয়েও কেউ কাঁদে? যা তো।না কেঁদে ইফতি ভাইকে বলে দে মনের কথাগুলো। তাহলেই তো হয়!”

আহিরা মাথা নাড়ায়। হাতের উল্টো পিঠে চোখদুটো মুছে নিয়ে তৎক্ষনাৎ প্রস্থান ঘটালো ঘর থেকে। সে চলে যেতেই মাহিরা উঠে এসে নিঃশব্দে ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিলো আলগোছে। তারপর ছুটে চলে গেলো বারান্দায়। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে বসে পড়লো ফ্লোরে। বুকটা তার দুমড়েমুচড়ে আসছে এখন। নিশ্বাসটাও আঁটকে আসছে ক্রমাগত। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে কান্নার তোড়ে।মাহিরা তৎক্ষনাৎ মাথাটা পেছনের দেয়ালে হেলিয়ে রাখে। চোখদুটো আলগোছে বুঁজে নিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে মেয়েটা। কান্নার শব্দ যখন একটুখানি বেড়ে গেলো তখনি সে তৎক্ষনাৎ দু’হাতে মুখটা শক্ত করে চেপে ধরে। অথচ কান্না তার বাড়ছে বৈ কমছে না।নিজের প্রথম প্রনয়কে অন্যের জন্য ছেড়ে দেওয়াটা কি আর এতোই সহজ? উঁহু! এ যে জীবন্ত মৃত্যুর সমতুল্য। যা নিতান্তই ভয়ংকর অভিশাপ স্বরুপ। আজ যে সেই ভয়ংকর অভিশাপ নিজ হাতে গায়ে মেখেছে মাহিরা। মাহিরা কাঁদতে কাঁদতে চোখ মেলে তাকায় দূর আকাশ পানে। আজ আর চাঁদ উঠেনি। এতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। কথায় আছে আমাবস্যায় নাকি কষ্টগুলো বেশ ভালোভাবে প্রকাশ করা যায়! আজ নাহয় মাহিরাও নিজের বুকভাঙা আর্তনাদ গুলো একা একা জাহির করবে ঐ দূর আকাশ পানে তাকিয়ে। মাহিরা বেশ কিছুক্ষণ পর কান্না থামায়। আকাশের পানে চোখ রেখে তাচ্ছিল্যের হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে। বিরবির করে বলতে লাগলো,

“ কেনো আপনার -আমার দেখা হলো ইফতি? আপনি যদি আমার নাই-বা হবেন,তাহলে নিয়তি কেনো আপনাতে আমায় এতোটা ভয়ংকরভবে মুগ্ধ করলো? আপনি আমায় ভালোবাসেননি কখনো, তবুও আপনার প্রতি এহেন একতরফা ভালোবাসার মতো ঘোর পাপ কেনো করতে গেলাম আমি? আপনি আমার ভাগ্যে নেই,তাহলে শুধু শুধু আমার জীবনে এসে আমাকে নিজের নিছক মায়ায় জড়াতে গেলেন কেনো? আচ্ছা.. এতে কি সত্যি আপনার ভুল আছে? নাকি আমিই আপনাকে নিয়ে একটু বেশি বেশি ভেবে ফেলেছিলাম? আপনি আমার হলেন না ইফতি,আপনি আমায় ভালোবাসলেন না।এতে আমার কোনো আফসোস নেই। শুনছেন হে মায়াবী পুরুষ? সত্যি এতে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি নাহয় আপনাকে পেলাম না,তাতে কি? আপনি তো আপনার প্রিয় মানুষটাকে পাচ্ছেন।এটাই বা কম কিসে? বিচ্ছেদ আর ধোঁকা দেয়ার এই কঠিন যুগে আমি নাহয় আপনাকে হারানোর একবুক ব্যাথা নিয়ে পড়ে রইলাম। আর আপনি? আপনি নাহয় প্রাপ্তির হাসি টানলেন ঠোঁটের কোণে। সেটাই শান্তি আমার জন্য!”
মেয়েটার এহেন আর্তনাদ কি শুনছে কেউ? উঁহু! শুনছেনা তো।অদূরের আকাশটাও কি সুন্দর মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার বুকভাঙা আর্তনাদ! বিনিময়ে স্বান্তনার বাণী দিতে পারুক বা না পারুক,অন্তত মনোযোগ দিয়ে শুনছে তো! এটাই বা কম কিসে?

রাতের নিকষ কালো অন্ধকার ছাপিয়ে ভোরের আলো এসে উঁকি -ঝুঁকি দিচ্ছে ঘরের ভেতর। বারান্দার শিমুল ফুলের গাছটার ডালে বসে পাখিরা মনের সুখে গেয়ে যাচ্ছে গান। ইতোমধ্যে অরিনের ঘুমটাও কেমন হালকা হয়ে এলো! মেয়েটা খানিক নড়চড় করতে চাইলেই বাঁধা পড়লো রৌদ্রের শক্তপোক্ত বাহুডোরে। অরিন ঘুমঘুম চোখে পিটপিট করে চাইলো মানুষটার দিকে। রৌদ্র বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। ছেলেটার মসৃণ গালে দেখা মিলছে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির উপস্থিতি। গায়ের রংটা বোধহয় আরও খানিকটা ফর্সা হয়ে গিয়েছে ইদানীং! অরিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার স্বামী নামক মানুষটার দিকে। রোজ ঘুম থেকে উঠে কায়দা করে মানুষটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে না পারলে, তার যেন ঘুমই কাটেনা!

অরিন হালকা হেসে নিজের একহাত কোনমতে বের করে আনলো রৌদ্রের বাহুডোর থেকে। তারপর ধীরে ধীরে ছেলেটার গালে হাত রাখলো আলতো করে। একটু করে ছুঁয়ে দিলো রৌদ্রের গাল,নাক অতপর কপাল। ঘুমন্ত ছেলেটাকে কি নিষ্পাপই না লাগছে এখন! অথচ রাত হলেই এ মানুষটা যে কি পরিমাণ অস্থির হয়ে ওঠে, তা মনে পড়তেই অরিনের দুগাল জুড়ে ছেয়ে গেলো রক্তাভ লালিমা। মেয়েটা নিঃশব্দে লাজুক হাসলো। খানিকটা নড়েচড়ে রৌদ্রের বুকে নাক ঘষে দিলো আলতো করে। এহেন স্পর্শে খানিকটা নড়েচড়ে উঠে রৌদ্র। মেয়েটার কোমর চেপে তাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে, ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,

“ গুড মর্নিং সানশাইন!”
অরিন মুগ্ধ হয়ে শুনছে ছেলেটার ঘুম জড়ানো কন্ঠ। রৌদ্রের এমন কন্ঠে সে-তো রোজ নতুনভাবে প্রেমে পড়ে। অরিন মুচকি হেসে রৌদ্রের উম্মুক্ত লোমহীন বক্ষে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। আদুরে কন্ঠে বললো,
“ গুড মর্নিং ডাক্তার সাহেব!”
রৌদ্র চোখবুঁজে থেকেই হাসলো একটুখানি। হাত বাড়িয়ে রাখলো মেয়েটার পেটের ওপর। সেথায় শার্টের উপস্থিতি পেয়েই ভ্রু কুঁচকে আসে তার। সে ফট করে চোখ মেলে অরিনের দিকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“ কতোবার বলেছি বউজান? নট টু ওয়্যার এনিথিং হোয়েন ইউ স্লিপ!”

লজ্জায় পড়লো অরিন। তার হচ্ছে এই এক জ্বালা! লোকটা প্রতিরাতেই এই এক আবদার জুড়ে বসবে তার কাছে। অথচ তার-ও যে লজ্জা লাগতে পারে, সে খবর কি আর রাখে সে? অরিনকে চুপ করে থাকতে দেখে রৌদ্র নিজে থেকেই মেয়েটার পরনে তারই শার্টের বাটনগুলো খুলতে শুরু করে।
অরিন বাঁধা দিলোনা।দিয়েই বা কি লাভ? এই লোক শুনবে তার কথা? একে একে সবগুলো বাটন খোলা শেষে রৌদ্র থামলো। মেয়েটার দিকে তাকালো নেশালো চোখে। অরিন শুষ্ক ঢোক গিললো পরপর। রৌদ্রের এহেন দৃষ্টি যে তার সর্বাঙ্গে কাঁপন ধরিয়ে দিতে সক্ষম। অরিন কিছুটা সময় নিয়ে বলতে লাগলো,
“ ইয়ে মানে… সকাল হয়েছে.. আমি বরং উঠি!”

বলেই সে চাদরটা গায়ে পেচিয়ে উঠতে নিলেই বাঁধ সাধে রৌদ্র। অরিন থমকায়। দৃষ্টি তুলে চায় রৌদ্রের পানে। রৌদ্রের ঘোলাটে দৃষ্টিতে তার প্রতি এক নিরব আহবান। অরিন তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অন্যদিকে। রৌদ্র ফিচেল হাসলো। মেয়েটার দিকে ঝুঁকে এলো আলগোছে। হাত বাড়িয়ে মেয়েটার গায়ের ওপর থেকে চাদরটা হালকা সরাতেই, অরিনের ফর্সা মসৃণ কলারবোনের ত্বকে তারই দেওয়া মিষ্টি অত্যাচারের চিহ্নগুলো জ্বলজ্বল করে ওঠে। মেয়েটার কন্ঠদেশ এবং কলারবোনের বেশ কিছু জায়গায় একপ্রকার কালসিটে দাগ বসে গিয়েছে। রৌদ্র সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। মেয়েটার চোখে চোখ রেখে দুষ্ট কন্ঠে বললো,
“ দাগগুলোতে কিন্তু বেশ মানিয়েছে তোমায়!”

অরিন লজ্জায় হাসফাস করতে লাগলো। লোকটা তো ভারি অসভ্য! খালি সুযোগ বুঝে তাকে জ্বালাতন করার পায়তারা! রৌদ্র মেয়েটার কন্ঠদেশে মুখ গুঁজে দিলো। সেথায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে লাগলো। মাঝেমধ্যে দাগ বসে যাওয়া জায়গায় গভীর চুম্বন একেঁ দিয়ে কাপিয়ে তুলতে লাগলো মেয়েটাকে। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ নিজের এহেন পাগলামি চালিয়ে পাগল রৌদ্র অবশেষে বলে ওঠে,
“ আই ওয়ান্ট ইউ হানি!”

অরিন ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজের। রৌদ্রের এমন সোজাসাপ্টা প্রস্তাবে নাকচ করবার ক্ষমতা নেই তার। সে ধীরে ধীরে নিজের ঠান্ডা হাতদুটো উঠিয়ে আনলো রৌদ্রের উম্মুক্ত পিঠে। মেয়েটার কাছ থেকে এহেন নিরব সম্মতি পেয়ে স্মিত হাসলো রৌদ্র। পরক্ষণেই অরিনের ওপর ঝুঁকে এসে বা-হাতে নিজের পিঠের ওপর চাদরটা টেনে দিলো খানিকটা। অরিন নেশালো চোখে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে। রৌদ্র তখন কোনরূপ কালবিলম্ব ছাড়াই মেয়েটার নরম অধরযুগল নিজের ওষ্ঠপুটের মাঝে টেনে ধরে। সেথায় আলতো করে বসিয়ে দেয় দাঁতের স্পর্শ। তার হাতদুটো ইতোমধ্যেই চলে গিয়েছে মেয়েটার সর্বাঙ্গে। তাদের বেহায়া স্পর্শে মেয়েটাকে বেসামাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে তারা! এদিকে অরিনও বাধ্যের ন্যায় সাড়া দিয়ে যাচ্ছে তার প্রেমিক পুরুষের কার্যে। তার হাতদুটো খামচে ধরেছে রৌদ্রের পিঠ। তাতে যেন আরেকটু পাগল হলো ছেলেটা! সে নিজের ওষ্ঠপুটের কাজ বহাল রেখেই অরিনের গা থেকে শার্টটা টেনে খুলে ফেললো এক নিমিষে। অতঃপর মুহুর্তেই ভিষণ উন্মাদনার সাথে ডুব দিলো তার সানশাইনের মাঝে!

কোমর সমান চুলগুলো থেকে টপটপ করে ঝড়ে পড়ছে পানির ফোঁটা। ফ্লোরের একাংশে জমেছে বেশ কিছুটা পানির উপস্থিতি! অরিন চুপচাপ বসে আছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে। তার পরনে কেবলমাত্র একখানা গোলাপি রঙের মোটা তোয়ালে। যার দৈর্ঘ্য মেয়েটার হাঁটু অবধি। এমুহুর্তে অরিনের লাজুক দৃষ্টি আয়নায় প্রতিবিম্বিত হওয়া রৌদ্রের দিকে। যে কিনা অত্যন্ত যত্নের সাথে মেয়েটার ভেজা চুলগুলো মুছে দিচ্ছে। ছেলেটার কোমরে বেঁধে রাখা সাদা তোয়ালে। তার উম্মুক্ত লোমহীন বক্ষে এখনো লেগে আছে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা। কপাল সমান চুলগুলো থেকে চুইয়ে পড়ছে পানি। অথচ সেদিকে বেমালুম বেখবর ছেলেটা।সে-তো ব্যস্ত তার সানশাইনের যত্নে। রৌদ্র মেয়েটার চুল মুছিয়ে দিতে দিতে একপলক তাকালো আয়নার দিকে। অরিনটা এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রৌদ্র বাঁকা হাসলো। ভ্রু উঁচিয়ে দুষ্ট কন্ঠে বললো,

“ কোমরের তোয়ালেটা খুলে ফেলি বউজান? দেখবে যেহেতু, একেবারে আগাগোড়া সুন্দর মতো দেখো!”
ভড়কায় অরিন। চোখদুটো তার এক্ষুণি বেরিয়ে আসার উপক্রম যেন। সে তৎক্ষনাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে আনলো রৌদ্রের থেকে। বিরবিরিয়ে বললো,
“ যত্তসব নির্লজ্জ!”
বিরবির করে বলা কথাটাও বেশ কানে এলো রৌদ্রের। সে ঠোঁট কামড়ে হাসলো আরেকটু। কিয়তক্ষন বাদেই ফের দুষ্ট কন্ঠে বললো,
“ এমন হটি-নটি বউয়ের কাছে নির্লজ্জ না হয়ে উপায় আছে? তাছাড়া বউয়ের কাছে লজ্জাশীল হয়ে থোড়াই নোবেল নিবো আমি? বংশ আগাতে হলে নির্লজ্জ হতেই হবে গো বউজান!”

এহেন কথায় মুখ টিপে হাসছে অরিন। রৌদ্র দেখলো আড়চোখে সবটা। খানিকক্ষণ বাদে, চুল মোছা শেষ হতেই অরিন উঠে দাঁড়ায়। রৌদ্রও কেমন বাঁকা চোখে তাকায় মেয়েটার দিকে। অরিনটা বোধহয় ইদানীং খানিকটা গলুমলু হয়েছে! গালে মাংসও বেড়েছে খানিকটা। রৌদ্রের তো প্রায়ই ইচ্ছে হয়, মেয়েটার ফোলা ফোলা টসটসে গালদুটোকে কামড়ে খেয়ে ফেলতে। তবুও মনের এহেন সুপ্ত ইচ্ছেটাকে একপ্রকার ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে সে। এদিকে, অরিন রৌদ্রকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই অসাবধানতার বশত ফ্লোরে পড়ে থাকা পানিতে পা পিছলে যায় তার। মেয়েটা পড়তে নিলেই রৌদ্রের শক্তপোক্ত বাহুডোর তৎক্ষনাৎ আগলে নেয় মেয়েটাকে। অরিন ভয়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেলেছে সাথে সাথে। এই বুঝি পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙলো তার!

কিন্তু মিনিট খানেক পেরুনোর পরও গায়ে তেমন ব্যাথা অনুভূত না হওয়ায় পিটপিট করে চোখ মেললো অরিন। নিজেকে আবিষ্কার করলো রৌদ্রের বাহুডোরে। মুহুর্তেই মুখ থেকে সকল ভয়-ভীতি সরে গেলো তার। সে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে তাকালো রৌদ্রের পানে।ছেলেটার নেশালো দৃষ্টি অন্য কোথাও নিবদ্ধ! অরিন ভ্রু কুঁচকায়।ছেলেটার দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকায় নিজের দিকে, ওমনি তার মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়লো যেন! একি! তার গায়ে বেঁধে রাখা তোয়ালেটা কই? অরিন তড়িঘড়ি করে আশপাশে তাকালো।তক্ষুনি তার চোখ গেলো খানিকটা দূরে ড্রেসিং টেবিলের কাছে অবহেলায় পড়ে থাকা তারই তোয়ালেটার দিকে। অরিন পরপর শুকনো ঢোক গিললো কয়েকটা। রৌদ্রের দিকে না তাকিয়েই, সরতে চাইলে রৌদ্র তাকে আরেকটু চেপে ধরলো নিজের সঙ্গে। অরিন তখন মিনমিন করে বলে ওঠে,

“ ছেড়ে দিন না!”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো না। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। কিয়তক্ষন বাদেই সে নিজের শুষ্ক অধরজোড়া জিভ দিয়ে খানিকটা ভিজিয়ে নিয়ে হাস্কি স্বরে বললো,
“ আরেকবার চলবে হানি?”
তড়িৎ শক্ত চোখে তাকালো অরিন।মাথা দুপাশে নাড়িয়ে মুখ কুঁচকে বললো,
“ একদম না! আমায় ছাড়ুন আপনি!”
রৌদ্র ছাড়লো না। বরং এক ঝটকায় পাঁজা কোলে তুলে নিলো মেয়েটাকে। অরিনের কথায় কোনরূপ কর্নপাত না করে নিজে থেকেই বলতে লাগলো,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৭০

“ সরি সানশাইন! বাট আ’ম টার্নড অন নাউ!”
অরিন মোচড়াচ্ছে। রৌদ্রের বুকে একের পর এক মৃদু চাপড় দিয়ে করুণ কন্ঠে বলছে,
“ প্লিজ এমনটা করবেন না।আমি…আমি আর গোসল করতে পারবোনা।”
রৌদ্র হাসলো ঠোঁট কামড়ে। মেয়েটাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,
“ আমি করিয়ে দিবো হানি!”
“ নাহ! আপনি দূরে সরুন! আমার…আমার এখনো শরীর জুড়ে ব্যাথা করছে!”
রৌদ্র মেয়েটার ঠোঁটের দিকে এগোতে এগোতেই প্রতিত্তোরে বললো,
“ আমি মালিশ করে দিবো জানবাচ্চা!”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৭২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here