সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৭ (২)
Jannatul Firdaus Mithila
“ অনিক! হলো তোদের? ”
রৌদ্রের ডাকে পেছনে ঘুরলো অনিক। হে হে করে হেসে দিয়ে বললো,
“ সেটা আমায় জিজ্ঞেস না করে তোমার ভগ্নিপতিকে জিজ্ঞেস করো না!”
বিরক্ত হলো রৌদ্র। ভ্রূদ্বয় কুচকে এগিয়ে আসে গেটের সামনে। আশেপাশে তাকাতে গিয়েও দোনোমোনো করতে থাকে ছেলেটা। শত হলেও ছোট বোন তো! তার ওমন প্রাইভেসির সময়ে বড় ভাই হয়ে কিভাবে হস্তক্ষেপ করে বলুনতো!
রৌদ্র পাশে না তাকিয়েই গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে একে-অপরকে ছেড়ে দাঁড়ায় রুহি আর রেহান। বেচারি রুহিরতো লজ্জায় মাথাকাটা যাবার মতো অবস্থা! সে মাথানিচু করে হাসফাস করতে থাকে। তখনি তার কর্ণগোচর হয় রৌদ্রের ভরাট কন্ঠ,
“ রুমে যা বুড়ি।”
ভাইয়ের কথায় তড়িঘড়ি করে মাথা ঝাকিয়ে জায়গা ত্যাগ করে রুহি। তার চলে যেতেই রৌদ্র এগিয়ে যায় রেহানের কাছে। প্রথমেই কোন কথা না বলে হালকা করে ঘুষি মেরে বসে রেহানের পেট বরাবর। রেহান চোখমুখ কুচকে পেটে হাত দিয়ে উবু হয়ে দাড়ায়। তখনি রৌদ্র গলায় ঝাঁঝ এনে বললো,
“ আর ক’টাদিন বাদেই তো বিয়ে হচ্ছে! এটুকু সময় কি ধৈর্য্য ধরে থাকতে পারতিস না?”
রেহান এবার সটান হয়ে দাড়ায়।চোখেমুখে তার দুষ্টুমির রেশ, টেনে টেনে বললো,
“ আহারে! আসছে আমার উলামায়ে সেরা ধৈর্য্যশীল পুরুষ! বলি আমিতো যাও লিমিটেই আছি,কিন্তু আপনি কি আর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর এতো লিমিটে থাকবেন? ”
একথা শোনা মাত্র পাশ থেকে অনিক ফোড়ন কেটে বললো,
“ কিরে ভাই! তোমরা তোমরা কথা বলছো, এখানে আবার আমার বনুকে টানছো কেন? ”
ফট করে হেসে ওঠে রেহান। রৌদ্রের সামনে থেকে সরে এসে দাঁড়ালো অনিকের কাছে। কাঁধে হাত দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ আরে বাডি! শুধু শুধু টানছি না তো।আসলে দেখ, আমার বউ রুহি।আর রৌদ্রের বউ অরিন।আমি যেমন আমার বউয়ের সামনে এলেই কন্ট্রোললেস হয়ে যাই,ঠিক তেমনি আমাদের রোদ মশাইও নিজের বউয়ের সামনে গেলেই কন্ট্রোললেস হয়ে যায়। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করতে পারিস ও-কে!”
অনিক ক্ষুদ্র চোখে তাকালো রৌদ্রের দিকে। সেদিকে একপলক আড়চোখে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো রৌদ্র। এদের এমন চোখাচোখিতে মিটমিটিয়ে হাসে রেহান। মনে মনে বললো, —- আমায় জব্দ করতে এসে নিজেই আচ্ছা জব্দ হয়েছো সম্বন্ধি সাহেব। এবার ঠেলা সামলাও!
রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে রেহানের উদ্দেশ্যে বললো,
“ বিয়ের আগে আর আসবি না তুই!”
মুহুর্তেই কাঁদো কাঁদো গলায় রেহান বললো,
“ এই, তুই এতো স্বার্থপর কেন রে? আমার বউয়ের কাছে আমি আসলে তোর এতো জ্বলে কেন? এই অনিক তুই কিছু বল এই একপাক্ষিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। ”
অনিক ভড়কে যায় রেহানের কথায়। রেহানের দিকে তাকাতেই দেখে, ছেলেটা কেমন অনুনয়ের চোখে তাকিয়ে আছে তার পানে। অনিক তখন আমতা আমতা করে বললো,
“ ইয়ে, রোদ ভাই! মানুষটা তো বেশি কিছু না, একটু দেখাই করবে। এতে আর এতো দোষের কি বলো!”
“ নিজের বেলায়ও এই কথাটা মাথায় রাখিস!”
অনিক এবার ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বললো,
“ কথায় কথায় আমার বোনরেই কেন টানো তোমরা? ধ্যাত! ”
কথাটা বলে আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না অনিক।গটগট পায়ে এগিয়ে গেলে বাড়ির ভেতর।সেদিকে তাকিয়ে রৌদ্র, রেহান মিটমিটিয়ে হাসছে। রেহান হাসতে হাসতেই রৌদ্রের কাছে এসে বললো,
“ যাইহোক, আসছি আমি।ভালো থাকিস!”
“ একা যেতে পারবি?”
“ হুম, হোটেল তো আর মেইন রোড থেকে বেশি দূরে না। ”
“ আঙ্কেল, আন্টি কবে আসবে?”
“ চলে আসবে আর দুদিনের মধ্যে। ”
“ আচ্ছা ”
কথা শেষ করে হাঁটা শুরু করলো রেহান।তখনি রৌদ্রকে নিজের সাথে হাঁটতে দেখে মুচকি হাসলো ছেলেটা।সে বেশ ভালো করেই জানে, ওপরে ওপরে যতই কঠোর ভাব রাখুক না কেন, ভেতর থেকে মানুষটা খুব ভালো। রৌদ্র রেহানকে তার গাড়ি অবধি পৌঁছে দেয়। তারপর যতক্ষণ পর্যন্ত গাড়িটি চক্ষুগোচর হয় ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে আধপাকা সড়কটিতে।
পরদিন সকাল বেলা🍁
“ এই ছোটো! তুই একটু খাবারের ট্রে গুলো রান্নাঘর থেকে নিয়ে যা- তো। ”
মাইমুনা বেগমের কথায় মাথা কাত করে কাজে লেগে পড়ে রাইসা বেগম। দু-জা মিলে আজকে ভোর থেকে রান্নাঘরে আমেনা বেগমের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে।বিয়ে বাড়িতে এসে শুধু শুধু মেহমানের মতো বসে থাকলে কি আর হবে? এ-ই দু-জা মিলে যেখানে রান্নাঘর সামলাচ্ছে, সেখানে বাড়ির বড় দু-বধু মিলে পুরো বাড়ি পরিষ্কার -পরিচ্ছন্ন করতে ব্যস্ত। কাজের জন্য বরাদ্দকৃত দু’জন মহিলার সাথে তারাও সমান তালে হাত মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কেননা হাতে যে সময় একেবারে নেই বললেই চলে!
বাড়ির মস্ত বড় উঠোন জুড়ে পুরোদমে ডেকোরেশনের কাজ চলছে। রৌদ্র, অনিক আর তাশরিক সাহেব এ নিয়েই ব্যস্ত সেই সকাল থেকে।
কবির সাহেব, সাব্বির সাহেব আর তায়েফ সাহেব মিলে অনুষ্ঠানের যাবতীয় লিষ্ট সাজাচ্ছেন। কাকে দাওয়াত দিবে, কতজনকে দিবে এ নিয়ে সকলে আলোচনা করছেন আবুল চাচার সাথে। বৃদ্ধ আবুল চাচা প্রথম প্রথম বেশ চমকে ওঠেন।কেননা তিনি এ বাড়ির সামান্য একজন কেয়ারটেকার আর তার মতামতই কি-না এরা এত সুন্দর করে নিচ্ছে, এটুকু কারনই কি যথেষ্ট নয় চমকানোর জন্য?
প্রায় আধঘন্টা পর, বাড়ির সম্মুখ গেট দিয়ে একটি কালো রঙের গাড়ি সামান্য হর্ন বাজিয়ে সগৌরবে প্রবেশ করে। সকলেই নিজেদের হাতের কাজ রেখে একপলক তাকিয়ে এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে। রৌদ্ররাও চলে আসে গাড়ির নিকট। তখনি গাড়ি থেকে বের হয় মেহরিন বেগম আর তার স্বামী, রিমঝিম, রাতুল। রিমঝিম আর রাতুল তো গাড়ি থেকে বের হয়েই অনিকের কোমর জড়িয়ে ধরে। উচ্চতা ছেলেমেয়ে গুলো ছোট কি-না! অনিকও হেসে ওদের জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
“ কেমন আছো তোমরা?”
দুজনেই একসাথে জবাব দেয়,
“ ভালো, এখন তোমাদের দেখে আরও ভালো আছি।”
ওদের এমন পাকা কথা শুনে সকলেই একসঙ্গে হেসে ওঠে। কবির সাহেব মেহরিন বেগম ও তার স্বামীর সাথে কুশলাদি বিনিময় করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যান।
অন্যদিকে, গাড়ির শব্দ পেয়ে জুবাইদা বেগম ও রাফিয়া বেগম এগিয়ে আসেন নিজেদের কাজ ছেড়ে। মেহরিন বেগমতো ভাবিদের পেয়ে একেবারে জড়িয়ে ধরে। জুবাইদা বেগম হেসে ওঠেন ননদের এমন কান্ডকারখানায়। মেহরিন বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করেন,
“ গতকাল রাতে আসার কথা বলে আজকে সকালে এলে যে!”
মেহরিন বেগম রাফিয়া বেগমের বুক হতে মাথা উঠায়। বড় ভাবির প্রশ্নের জবাবে আহ্লাদী হয়ে টেনে টেনে বলে,
“ আর বলো না! গতকাল বিকেলেই রওনা দেবার কথা ছিলো।কিন্তু হুট করে রাতুলের বাবার একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় আর রওনা দেওয়া হলো না।”
“ বাব্বাহ! মেহু তো দেখছি আমাদের ভুলেই গেলো?”
পেছন থেকে মাইমুনা বেগমের টিপ্পনীতে ঘাড় বাকিয়ে তাকালো মেহরিন বেগম। মুখে আলতো হাসি নিয়ে এগিয়ে গেলো তার দিকে। দুহাত দিয়ে মাইমুনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন,
“ তোমাদের কি আর ওতো সহজে ভোলা যায় বলোতো? ”
মাইমুনা বেগম হেসে ফেললেন। মেহরিন বেগমকে বুক থেকে ছাড়িয়ে বললেন,
“ থাক আর বলতে হবে না বোন। আগে বল আসতে কোন অসুবিধে হয়নি তো?”
মেহরিন বেগম ঘাড় নাড়ালেন। আশপাশে নজর বুলিয়ে বললেন,
“ ছোট ভাবি কোথায়?”
তখনি পেছন থেকে কেও একজন জড়িয়ে ধরেন তাকে।মেহরিন বেগম বেশ বুঝলেন কে এটা। তিনি আলতো হাতে নিজেকে ছাড়িয়ে পেছনে ফিরলেন। সামনে দাড়িয়ে থাকা রুহিকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সযত্নে। তারপর পরপর কয়েকটা ভালোবাসার পরশ একে দিলেন মেয়েটার মাথায়, কপালে। নরম স্বরে বললেন,
“ কেমন আছে আম্মুটা?”
“ আলহামদুলিল্লাহ। ভিষণ ভালো।তুমি কেমন আছো? ”
“ আমিও বেশ ভালো আছি।”
“ ফুপ্পি! আমরাও কিন্তু পেছনে আছি!”
পাশ থেকে অরিনের কথায় বসার ঘরে উপস্থিত সকলে একযোগে হেসে ওঠে। মেহরিন বেগম রুহিকে ছেড়ে এগিয়ে আসেন আহি,মাহি আর অরিনের কাছে। তিনজনই তৎক্ষনাৎ একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে মেহরিন বেগমকে।
তাদের সবার এমন মিল দেখে দূর থেকে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ আবুল চাচা। মনে মনে বললেন, —– একজনকে ঠিক কতোটা ভালোবাসা দিচ্ছে এরা, অথচ আরেকজনের যে সামান্যতম খোঁজ খবরও রাখা হচ্ছে না। পরক্ষণেই আবারও তিনি ভাবলেন, — দোষটা তো আর তাদেরও না! সবটুকুই যে কপাল!
সকলেই মাত্র একসাথে সকালের খাবার খেলো।যেহেতু গ্রামের বাড়িতে এসেছে, তাই সকালের খাবারটা একটু ভারিই খেয়েছে তারা। মেহরিন বেগম আর তার চার ভাবি মিলে বাড়ির ছাদ পরিষ্কার করছিলেন। ঠিক তখনি মেহরিন বেগম খেয়াল করলেন বাড়ির বা- পাশে সিড়ি দেওয়া পুকুর ঘাটে। তিনি দেখলেন, শিশির দু মগ কফি নিয়ে রৌদ্রের সাথে বসে বসে হেসে খেলে কথা বলছে। মেহরিন বেগম কিছুক্ষণ পলকহীনভাবে তাকিয়ে থেকে ভাবিদের ডাকলেন। সকলেই তার ডাক শোনামাত্র এগিয়ে আসেন। পরক্ষণেই মেহরিন বেগমের দৃষ্টি অনুসরণ করে সকলে একসাথে পুকুর ঘাটে দৃষ্টি ফেললেন। তখনি মেহরিন বেগম বললেন,
“ বড় ভাবি! এই মেয়েটা তোমার বড় ভাইয়ের মেয়ে না? কি যেন নামটা!”
“ শিশির ” পাশ থেকে রাফিয়া বেগম বললেন। নামটি মনে পড়া মাত্রই মেহরিন বেগম আবারও বললেন,
“ ওহ, হ্যা, শিশির! ও কবে আসলো দেশে? ”
“ এইতো গত দুদিন আগে এসেছে। ”
জুবাইদা বেগমের কথায় মাথা নাড়িয়ে আবারও বললেন,
“ আচ্ছা! ” বলেই চুপ রইলেন মেহরিন বেগম। মুখটা কেমন নিশপিশ করছে তার কিছু বলার জন্য। তিনি কিছু বলবেন তার আগেই রাফিয়া বেগম বলে বসলেন এক অদ্ভুত কথা!
“ জবা! আমি যা ভাবছি তুইও কি তাই ভাবছিস?”
পাশ থেকে জুবাইদা বেগম মুচকি হেসে তাকালেন রাফিয়া বেগমের দিকে। বললেন,
“ আচ্ছা তুই কিকরে প্রতিবার আমার মনের কথা বুঝে যাস বলতো?”
দু-বান্ধবীর এমন রহস্যময় কথাবার্তায় বাকি তারা একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।রাইসা বেগম ফট করে বলে উঠেন,
“ কি এমন কথা বলছো দুজনে, আমাদেরও একটু বলো।”
জুবাইদা বেগম আর রাফিয়া বেগম মুচকি হাসলেন। জুবাইদা বেগম নিজ থেকে বলতে লাগলেন,
“ আসলে বহুদিন যাবত একটা কথা মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম আমি। ”
“কি কথা?”
মেহরিন বেগম ভ্রুকুঞ্চন করে প্রশ্ন করলেন।তার চেহারা দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে তিনি জুবাইদা বেগমের মনের কথা হয়তো কিছুটা হলেও আচঁ পেলেন। জুবাইদা বেগম আবারও বললেন,
“ আমার মনে হয়, রোদ আর শিশির একে অপরকে পছন্দ করে। ”
“ কিহ! সত্যি! ”
তৎক্ষনাৎ কিছুটা জোরে কথাটা একযোগে বলে ওঠেন মাইমুনা বেগম আর রাইসা বেগম। তাদের এমন হতবাক হওয়ায় মৃদু হেসে রাফিয়া বেগম বললেন,
“ হুম আমারও তাই মনে হয়। এই যে দেখছিস না, আমাদের রোদ কি সুন্দর করে হেসেখেলে কথা বলে শিশিরের সাথে। আমারও মনে হয় জানিস,ওরা হয়তো একে অপরকে পছন্দ করে। আর তাছাড়া এতগুলো বছর তো একসঙ্গেই ছিলো তারা।ভালো লাগাটা স্বাভাবিক নয়কি?”
রাফিয়া বেগমের যুক্তিতে সবাই একমত হলেও মেহরিন বেগম একমত হলেন না।তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে নাখোশ হবার চিহ্ন। তিনি এবার মুখ খুললেন,
“ একটা মানুষ অন্য একটা মানুষের সাথে হেসেখেলে কথা বলার মানেই কি সে তাকে পছন্দ করে ভাবি? এটা কেমন বাচ্চাদের দেওয়া যুক্তির মতো হয়ে গেলো না?”
রাফিয়া বেগম চুপ রইলেন কথাটায়। মনে মনে ভাবলেন, —- ঠিকই তো! কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো বলেনি মেহু।
পাশ থেকে জুবাইদা বেগম বলে ওঠেন,
“ হয়তো তুই ঠিকই বলছিস মেহু। কিন্তু আমার মন বলছে রোদ ওকে পছন্দ করে। আচ্ছা, আমি নাহয় ওদেরকেই জিজ্ঞেস করবো ব্যাপারটা।”
এ-কথাটায় উপস্থিত সকলে একমত পোষণ করলো।রাফিয়া বেগমও বাহির থেকে একমত জানালেও ভেতর থেকে কেমন অদ্ভুত লাগছে তার। মনে হচ্ছে, খুব বড় একটা ভুল হতে যাচ্ছে কোথাও।তিনি টের পাচ্ছেন কোন এক পরিস্থিতির অশনি সংকেত!
পুরো বাড়ি কেমন নিস্তব্ধতায় মোড়া। কেননা বাড়ির কর্তারা গিয়েছেন বিয়ের কার্ড বিলি করতে। এ মুহুর্তে বাড়িতে আছে শুধু অনিক আর রৌদ্র। গৃহিণীরা রান্নাঘরে দুপুরের আয়োজনে ব্যস্ত। আর ছেলে-মেয়েগুলো পুকুর ঘাটে বসে পেয়ারা খাচ্ছে। পুকুর ঘাট সংলগ্ন একটা বড় পেয়ারা গাছে উঠেছে শশী। সেখান থেকেই কিছু পেয়েরা বাকি সবার উদ্দেশ্যে পেরে দিয়ে নিজে গাছে বসে খেয়ে যাচ্ছে আপনমনে। ভাগ্যিস তার বাবা এ মুহুর্তে বাড়িতে নেই।নইলে আজকে ওর কপালে শনি লাগতো নির্ঘাত। শশীকে নিয়ে বরাবরই বৃদ্ধ আবুল চাচা আর আমেনা বেগমের চিন্তাটা একটু বেশি। কেননা এই মেয়েটাই যে তাদের শেষ সম্বল! তাদের বিয়ের উপযুক্ত বড় ছেলেটা এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রান হারায়। সেই থেকে আমেনা বেগম পাগলপ্রায়।তখন থেকে বহুদিন চেষ্টার পর আল্লাহ তাদের কোলজুড়ান।মধ্য বয়সে শশী আসলো তাদের কোলজুড়ে। তাইতো এ মেয়েটাকে নিজেদের চাইতেও বেশি ভালোবাসেন তারা।
ঠিক সে সময় সেখানে উপস্থিত হয় তামিম।হাতে তার দু-গোছা লিচু। লিচুগুলোর কেমন বড়বড়,আর লাল টুকটুকে দেখতে। উপস্থিত সকলের বড় লোভ লাগলো লিচুগুলো দেখে।
একসাথে হৈ হৈ করে এগিয়ে এসে নিয়ে গেলো লিচু গুলো তামিমের হাত থেকে। তামিম সবাইকে একগোছা লিচু দিয়ে আরেক গোছা নিজের হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলো ঘাটের ওপর ঢালাই করা বেঞ্চিতে বসে থাকা অরিনের কাছে। সবাই লিচু গুলো নিতে গেলেও অরিন ঠায় বসে রইলো নিজ জায়গাতে। মেয়েটা কেমন একমনে পেয়ারা খেয়ে যাচ্ছে। তামিম গিয়ে বসলো তার পাশে। তাকে দেখে অরিন মৃদু হাসলো। আরেকটু দূরে চেপে বসলো সে। তামিম সেদিকে পাত্তা না দিয়ে হাতে থাকা লিচু গুলো এগিয়ে দিলো অরিনের কাছে।
“ নাও। এগুলো তোমার! ”
অরিনের পেয়ারা চাবানো মুখটা থমকে যায়। চোখ দুটো গোলগোল করে তাকায় লিচুগুলোর দিকে।তারপর কোনরকম মুখে থাকা পেয়ারা গুলো গিলে নিয়ে বলে,
“ এত্তগুলা আমার?”
তামিম মুচকি হেসে মাথা ঝাকায়। অরিন সেদিকে তাকিয়ে নিজেও হাসলো। অতঃপর যে-ই না হাত বাড়িয়ে লিচুগুলো নিতে যাবে ওমনি কেও গম্ভীর কণ্ঠে হাঁক ছুড়ে,
“ অরি!”
অরিন ভড়কে যায়। সামনে তাকাতেই দেখতে পায় রৌদ্র চোয়াল শক্ত করে দাড়িয়ে আছে। সে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।কিছু বলবে তার আগেই রৌদ্র এসে তার হাতটা খপ করে ধরে নেয়। তারপর তামিমের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সেখান থেকে অরিনকে টেনে নিয়ে যায় নিজের সাথে। তামিম চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের কর্মকাণ্ডে।পরক্ষণেই বাঁকা হেসে পায়ের ওপর পা তুলে মনে মনে বলে,
“ কতদিন পাখিকে খাচায় তুলে রাখবেন জনাব! আজ নাহয় কাল তো পাখি উড়াল দেবেই!”
অন্যদিকে অরিন এখনো হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে। রৌদ্র তাকে উঠোনে নিয়ে দাড় করায়।তারপর খেঁকিয়ে ওঠে বলে,
“ ভেতরে যা!”
অরিন অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে। কিছু বলবে তার আগেই কানে আসে রৌদ্রের শক্ত কন্ঠ!
“ ভেতরে যা অরি!”
অরিনও গাল ফুলিয়ে ভেতরে চলে যায়। ঠিক তখনি রৌদ্রের সামনে আগমন ঘটে অনিকের। সে রৌদ্রের দৃঢ় চোয়াল দেখে সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে,
“ ভাইয়া! আর ইউ জেলাস?”
তৎক্ষনাৎ শক্ত চোখে তাকালো রৌদ্র। অনিক কিছুটা থতমত খায়। আমতা আমতা করে বললো,
“ নাহ! ঐ আরকি এমনি বললাম ”
রৌদ্র তখন গম্ভীর গলায় প্রতিত্তোরে বললো,
“ আমার সানশাইনের প্রতি আমি শুধু জেলাস না বল ভিষন রকমের অবসেসড। কেও যদি ওর দিকে সামান্যতম হাতও বাড়ায় তাহলে সে হাত গুড়িয়ে দিতে দুবার ভাবি না আমি।এখন তুই ভেবে নে এটা কি আদৌও জেলাসি নাকি অন্যকিছু”
বলেই আর একমুহূর্ত দাড়ালো না রৌদ্র। গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।অথচ পেছনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো অনিক।বেচারা ভুলেই গিয়েছে এ মুহুর্তে তার ঠিক কেমন রিয়াকশন দেওয়া উচিত।
“ শিশির! একটু দাড়া মা!”
গুনগুন করতে করতে সিড়ি বেয়ে নিচে নামছিলো শিশির। তখনি জুবইদা বেগমের ডাকে থমকে দাড়ায় ও। মৃদু হেসে প্রশ্ন করে,
“ কিছু বলবে ফুপ্পি?”
জুবাইদা বেগম মাথা নেড়ে এগিয়ে এলেন। মনে মনে কথা গোছাতে লাগলেন বলার জন্য। প্রায় কিছুক্ষণ পর তিনি আমতা আমতা করে বললেন,
“ শিশির! একটা কথা জিজ্ঞেস করবো মা? রাগ করবি না তো?”
শিশির মুচকি হেসে বললো,
“ আরে নাহ! কি বলবে নিশ্চিন্তে বলে,”
জুবাইদা কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। আরেকটু কাছাকাছি এগিয়ে এসে বললেন,
“ তুই আর রোদ কি একে অপরকে পছন্দ করিস?”
শিশির কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে লাজুক ভঙ্গিতে কানের পিঠে চুল গুজে মুচকি হাসলো। জুবাইদা বেগম পেয়ে গেলেন তার কাঙ্খিত উওর। তিনি শিশিরের কপালে আলতো চুমু খেয়ে বললেন,
“ ধূর পাগলি! এটুকু কথায় কেও লজ্জা পায়?”
শিশির তবুও মুখে লজ্জালু ভাব রাখলো। হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো,
“ ফুপ্পি প্লিজ! রোদকে এ বিষয়ে কিছু বলোনা। ও জানতে পারলে রাগ করতে পারে। কেননা ও নিজেই না বলেছিলো এখনি সবটা জানাতে।”
জুবাইদা বেগম আলতো হাসলেন। “ঠিক আছে ” বলে প্রস্থান করলেন সেখান থেকে। এদিকে শিশির মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে।মনে মনে বললো,
“ খুব শীঘ্রই তাহলে তোর বউ হচ্ছি রোদ”
পড়ন্ত বিকেল।সূর্যটা কেমন হেলে পড়েছে পশ্চিমে। যার দরুন ধরনীতে গরমের প্রকোপটাও মৃদু কমে এসেছে। অরিন মন খারাপ করে দোতলার করিডরে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটার মনটাও জানি কেমন! এই ভালো তো এই খারাপ! অরিন ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। ঠিক তখনি তার ফোনে কল আসে। অরিন ফোনটা সামনে ধরতেই ভ্রূদ্বয় কুচকে ফেলে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বারটা দেখে দোনোমোনো করতে থাকে ফোনটা তুলবে কি না! কিন্তু শেষমেষ মনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে হেরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। তখনি ওপাশ থেকে ভেসে আসে মানুষটার ভরাট কন্ঠ!
“ নিচে নাম অরি!”
অরিন ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করে,
“ কেন রোদ ভাই? ”
“ একটা জায়গায় ঘুরতে যাবো। চল!”
“ নাহ! আমার এখন ইচ্ছে করছে না। আপনি বরং অন্য কাওকে নিয়ে যান!”
অরিনের সহসা নাকচ করে দেওয়ায় মুচকি হাসলো রৌদ্র। সে বেশ বুঝলো মেয়েটার অভিমান। তাই সে এবার কন্ঠে দ্বিগুণ নমনীয়তা ঢেলে বললো,
“ সরি জানবাচ্চা! আর ওভাবে বলবো না।এবার তো নাম!”
অরিন মুচকি হাসলো। মনে মনে অবাক হলো এটা ভেবে —- মানুষটা তাকে এতো বোঝে!
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর অরিন নিচে নামে। উঠোনে এসে দেখতে পায় অদূরে কেচি গেটের সামনে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে থাকা রোদ ভাই কে।লোকটার পড়নের গাঢ় বোটল গ্রিন কালারের শার্টটা কেমন ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা! ঘিয়ে রঙের ঢোলা ট্রাউজারের দু-পকেটে হাত গুঁজে তার দিকেই নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বাতাসের মৃদু ঝাপটায় হালকা উড়ছে। লোকটার বেড়াল চোখগুলো আজকে চশমা বিহীন। উজ্জ্বল শ্যামবরন মুখটার কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। থুতনির বাঁপাশে শোভা পাচ্ছে কালো কুচকুচে তিলটা। আচ্ছা! মানুষ টা কি আগের থেকেও কিছুটা সুন্দর হয়ে উঠেছে? না-কি অরিনই তাকে এতোদিন পর কিছুটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে বলে এমন লাগছে? অরিনের ভাবনার মাঝেই রৌদ্র বাঁকা হেসে বললো,
“ দেখা শেষ? নাকি আরও বাকি আছে? ”
থমকায় অরিন। যাহ লোকটা তাহলে বুঝে গেলো, অরিন যে তাকে এতক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো।পরক্ষণেই আবার ভাবলো, এভাবে হেবলার মতো তাকিয়ে থাকলে তো যেকেউ বুঝবেই! হুহ!
অরিন কিছুটা লজ্জা পেলো।ঘাড়ে হাত রেখে হাসফাস করতে লাগলো মেয়েটা।রৌদ্র তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গাড়ির দরজা খুলে দিলো।বললো,
“ বস!”
অরিনও মাথা ঝাকিয়ে বসে পড়লো গাড়িতে। রৌদ্র হাত বাড়িয়ে তার ওড়নার অংশ সযত্নে তুলে দিলো গাড়িতে অতপর দরজা আটকে দিয়ে নিজেও গিয়ে বসে পড়লো ড্রাইভিং সিটে।
প্রায় মিনিট বিশেক পর রৌদ্রের গাড়ি এসে থামলো একটি বাগানের সামনে। অরিন গাড়ির কাচ গলিয়ে বাহিরে তাকিয়ে চেষ্টা করলো জায়গাটা চেনার। কিন্তু তার আগেই রৌদ্র এসে তার দরজাটা খুলে দিয়ে বললো,
“ বেরোবি না?”
অরিন মাথা নাড়িয়ে বের হলো। বাইরে বের হতেই কয়েকদফা চমকালো মেয়েটা। এটা যে একটা বড়সড় লিচুর বাগান।অরিন অবাক চোখে তাকালো রৌদ্রের পানে।রৌদ্র অরিনের দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে তার হাতটা ধরে এগিয়ে যায় বাগানের দিকে। বাগানের দারোয়ানের কাছ থেকে কিছু একটা নিয়ে চলে যায় ভেতরের দিকে।তারপর অরিনের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললো,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৭
“ এখান থেকে তোর যত ইচ্ছে খেতে পারিস জানবাচ্চা। যতদিন আমরা গ্রামের বাড়িতে থাকছি,ততদিন এই বাগানটা তোর। ”
অরিন ভড়কালো। চমকে তাকালো মানুষটার দিকে। মনে মনে বললো,
“ রোদ ভাই সবটা আমার জন্য করেছে? ”