সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৮

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৮
Jannatul Firdaus Mithila

“ এসব আমার জন্য? ”
অরিনের প্রশ্নে ভ্রু গোটায় রৌদ্র। খামখেয়ালী হয়ে জবাব দেয়,
“ নাহ! তোর ভূতের জন্য!”
রৌদ্রের বাঁকা কথায় অরিনের হাসি মুখটা থমথমে হয়ে আসে।সে মুখ বাকিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘোরায়।কি আশ্চর্য! যতদূর তার চোখ যাচ্ছে, সবটাই লিচু বাগান। অরিন অবাক চোখে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। পরপর দুয়েকটা লিচু হাত দিয়ে ছুয়ে দেয় আলতোভাবে। কিছুপথ সামনে যেতেই অরিন স্থির হয়। ভাবুক হয়ে কিছু একটা ভাবতে থাকে আপনমনে। যেই না ভাবনা শেষ হলো ওমনি মেয়েটার মুখভঙ্গিতে পরিবর্তন এলো।হাসি মুখটা গম্ভীরে রুপান্তরিত হলো। ফর্সা মুখশ্রীটি হয়ে ওঠলো খানিকটা দৃঢ়। চোখেমুখে কপট রাগী ভাব।সে গটগট পায়ে ফেরত চলে আসে সেখান থেকে। পেছনে একবারও না তাকিয়ে বিরতিহীন কদমে এগিয়ে যায় গাড়ির কাছে। রৌদ্র অরিনের এমন হাবভাবে ভ্রুকুটি করলো। অরিনের পিছু পিছু গিয়ে মেয়েটার একহাত চেপে ধরে বললো,

“ কি হলো তোর? এভাবে কিছু না নিয়েই চলে আসলি যে? তুই কি এগুলো দেখে খুশি হসনি?
অরিন সন্তপর্ণে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। পেছনে ফিরে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“ প্লিজ রোদ ভাই! এমন কিছু করবেন না যার জন্য আমার নিজেকে স্পেশাল ফিল হয়! যেখানে আমি নিজেও জানি, যে আমি আপনার স্পেশাল কেউ নই তারপরও নিজ মনে এমন বদ্ধ ধারণা পুষে কি লাভ বলুন? তাই আমি অনুরোধ করবো আমার জন্য খুব বেশি কিছু না করতে। আমার এসবের প্রয়োজন নেই রোদ ভাই। সত্যিই প্রয়োজন নেই। ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে, আর একমুহূর্ত দেরি না করে গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে বসে পড়লো অরিন। অন্যদিকে রৌদ্র এখনো গম্ভীর হয়ে ঠায় দাড়িয়ে রইলো। হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছে ছেলেটা, কিন্তু সময় আর পরিস্থিতি অনূকূলে না থাকায় গলা অবধি আটকে আছে কথাগুলো। রৌদ্র কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসে। সেকেন্ডের ব্যাবধানে গাড়ি স্টার্ট দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে।
দুটো মানুষ একই গাড়িতে থাকা স্বত্তেও একে-অপরের সাথে টু- শব্দ অবধি করছে না।অথচ কিছুক্ষন আগেও দু’জনার বলার মতো কতো কথাই না ছিলো! মেয়েটার মনে ছিলো এক অজানা সুখের উচ্ছ্বাস, আর ছেলেটার মনে ছিলো তার প্রিয়তমাকে উপহার দেবার কাঙ্খিত বাসনা। কিন্তু মুহুর্তের ব্যাবধানে দু’জনার সকল আনন্দ যেন একেবারেই ফিকে হয়ে পড়লো এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নে।

গাড়ির পেছনের সিটে বসে ছলছল চোখে জানালার কাচ গলিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকায় ব্যস্ত
অরিন, মেয়েটার গলা ধরে আসছে। হয়তো ভেতরের জমানো কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলাতেই আটকে আছে বিধায়! অরিন ফোঁস করে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো।বসে থেকে মাথা এলিয়ে দিলো পেছনের দিকে। চোখ দুটো বন্ধ করে ভাবতে লাগলো মেয়েটা,
” এতোটা কাছে না টানলেও পারতেন রোদ ভাই! আমিতো আপনাকে ভুলে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি কিন্তু আমার হৃদয়টা যে তা মানতে নারাজ। সে যে আপনাকে কিছুতেই ভুলতে দেয় না। আমিতো আপনার থেকে দূরে থাকতে চাই। কিন্তু যতোবার দূরে যেতে চেয়েছি ঠিক ততোবারই আপনি নিজের যত্নগুলো দিয়ে আমায় কাছে টেনেছেন।হৃদয়টাকে আরও একধাপ সুযোগ করে দিয়েছেন আপনাকে নিয়ে ভাবার। আপনাকে উম্মাদের মতো ভালোবাসার।কেন এমনটা করেন রোদ ভাই? কেন?”

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অরিনের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোটা অশ্রু। অরিন সেগুলোকে মুছলো না।গড়িয়ে পড়তে দিলো আনমনে। থাক না এভাবেই, গড়িয়ে পড়ুক না কিছু কিছু ব্যাথা অশ্রু হিসেবে।
অন্যদিকে গম্ভীর মুখে দৃঢ় চোয়াল ফুটিয়ে একহাতে ড্রাইভ করতে ব্যস্ত রৌদ্র। মুখের সামনে একহাত ঠেকিয়ে বারংবার আড়চোখে পেছনে তাকাচ্ছে সে, কিন্তু মেয়েটা একেবারে জানালা ঘেঁষে বসায় দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না তার। রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবতে থাকে। গাড়ির ভেতরের নিরবতার প্রতিটি মূহুর্ত যেন তার হৃদয়ে কাঁটার ন্যায় বিঁধছে। বারবার ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে কাছে এনে তার সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে। কিন্তু হায়! এ মুহুর্তে রৌদ্র যে বড্ড অসহায়।

প্রায় অনেকক্ষণ পর গাড়িটি এসে থামলো বাড়ির উঠোনে। গাড়িটি থামতেই অরিন তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে বের হয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। তার এমন চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রৌদ্র। মিনিটের ব্যাবধানে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে গাড়ির স্টিয়ারিং এর ওপর সজোরে ঘুষি মেরে বসে।হয়তো নিজের ভেতরকার রাগ কমানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে ছেলেটা।পরপর কয়েকটা ঘুষি মেরে অবশেষে থামলো ছেলেটা। ডানহাতের আঙুল গুলো লাল হয়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা! রৌদ্র তখন দাত কিড়মিড়িয়ে বিরবির করলো,
“ এতো অভিমান তোর সানশাইন? কেন তোর অভিমান ভাঙানোর অধিকার পেলাম না সানশাইন! কেন তোর প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারলাম না আমি? কেন তোকে বলতে পারলাম না, তুই আমার জীবনে ঠিক কতোটা স্পেশাল! ”
রৌদ্র থামলো।সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আবারও বিরবির করলো,
“ তুই আমার জন্য খুব স্পেশাল সানশাইন! খুব স্পেশাল।বিশ্বাস কর! তুই আমার কাছে বড্ড স্পেশাল! ”

দোতলা বাড়িটির বসার ঘরে এখন যেন ভিড় জমেছে।শুধুমাত্র রৌদ্র বাদে বাড়ির গৃহিণীরা হতে শুরু করে ছেলেমেয়ে অবধি কেউই বাদ নেই এখানে। সকলেই বসে আলোচনা চালাচ্ছে কালকের মেহেদী অনুষ্ঠান নিয়ে। আলোচনার মূল বিষয়বস্তুগুলো হচ্ছে — ড্রেস থিম সিলেকশন, কে কি পারফরম্যান্স করবে ইত্যাদি। সবাই একে একে নিজের মতামত দিয়ে যাচ্ছে। কেও কেও বলছে ড্রেস থিম সালোয়ার- কামিজ তো অন্যরা বলছে শাড়ি।আবার কেও কেও দুটোই নাকচ করে দিয়ে লেহেঙ্গাকে এগিয়ে রাখছে। এতো সব বাকবিতন্ডার মাঝেও অরিন মেয়েটা একেবারেই নির্বাক হয়ে শুনে যাচ্ছে সবার কথা। মেয়েটার ফর্সা আদলের মুখখানায় কেমন ঘোর আমাবস্যা লেপ্টে আছে। অদূরেই বসে থাকা রাফিয়া বেগম বেশ খেয়াল করলেন মেয়ের মলিন মুখটা। সোফা ছেড়ে উঠে আসেন মেয়ের কাছে। আলতো হাতে কাঁধে হাত রাখলেন মেয়ের। হঠাৎ কাঁধে কারো শীতল স্পর্শ পাওয়া মাত্রই হকচকিয়ে ওঠে অরিন। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখতে পায় মায়ের মিষ্টি মুখটা। অরিন মৃদু হাসলো। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,

— কিছু বলবে মা?
রাফিয়া বেগম মেয়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরেন। আলতো সুরে বললেন,
“ একটু বাইরে আয়। কথা আছে। ”
অরিনও মায়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। অতঃপর মায়ের সাথে চলে যায় বাড়ির খোলা উঠোনের একপাশে। সেখানে যেতেই অরিন প্রশ্ন করে,
“ কি বলবে আম্মু? ”

রাফিয়া বেগম মুচকি হাসলেন।প্রতিত্তোরে কিছু না বলে মেয়ের হাত ধরে তাকে নিয়ে গেলেন পুকুরের ঘাটে।ঘাটের প্রথম দুটো সিঁড়ি অতিক্রম করে পরবর্তী সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাড়ান। হালকা ফু দিয়ে সিঁড়িটাকে কোনরকম পরিষ্কার করে বসে পড়েন তিনি।তারপর মেয়ের হাত টেনে তাকেও নিজের পাশে বসিয়ে দেয়। এতসব কান্ডের পুরোটা সময় অরিন শুধু নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে দেখছিল সবটা। মেয়েকে পাশে বসিয়ে তার মাথাটা নিজ কাঁধের ওপর রাখলেন রাফিয়া বেগম। অতঃপর নরম কন্ঠে বললেন,

“ অরি! তুই কি কোন কারনে ডিস্টার্ব মা?”
অরিন কিছুটা হকচকায়। মায়ের কাঁধে মাথা রেখেই আমতা আমতা করলো খানিকটা। রাফিয়া বেগম বেশ টের পেলেন সবটা। তিনি আলতো হেসে মেয়ের একটা হাত নিজের হাতের ওপর এনে বলতে লাগলেন,
“ আমি তোমার মা অরিন। তোমায় দশ মাস পেটে ধরেছি আমি। তোমার সকল আচার-আচরণ আমার নখদর্পনে। তাই তোমার মুখভঙ্গি দেখলে আমি নিমিষেই বুঝে ফেলি তোমার অন্তরের অবস্থা। আচ্ছা সত্যি করে বলোতো, কোন বিষয়টা তোমায় খুব ডিস্টার্ব করছে?”
অরিন মায়ের কথায় খানিকটা ভরসা পেলো। মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের বুকে নিজের মুখটা লুকিয়ে ফেললো। অতঃপর মিনমিনে স্বরে বলতে লাগলো,

“ আম্মু! আমি একটু শক্ত হতে চাই। এতোটা শক্ত হতে চাই,যাতে করে আমার মনের ওপর আমার,শুধুমাত্র আমারই পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। অন্যকারো না।”
রাফিয়া বেগম বুঝে গেলেন সবটা।মেয়ে যে তার কোন কারণে এতটা ডিস্টার্ব তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। তিনি মেয়ের মাথায় আলতো চুমু খেয়ে বলতে লাগলেন,
“ অরিন জানো? প্রতিটি মানুষের একমাত্র দূর্বলতা কি? ”
অরিন মায়ের বুকে থেকেই জবাব দিলো,
“ কি?”

“ প্রতিটি মানুষের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হচ্ছে তার মন।মানুষের মন আসলেই বড় দুর্বল — একটু ভালোবাসায় যেমন খিলখিলিয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি একটু অবহেলায়, কিংবা অল্প কিছু দুঃস্বপ্নেই ভেঙে পড়ে। আচ্ছা অরিন! তুমি তোমার মনকে শক্ত করতে চাও তো? তাহলে শুনে রাখো,
মন শক্ত করতে চাইলে, প্রথমে নিজের প্রেমে পড়ো।
তোমার হাসি, তোমার কষ্ট, তোমার স্বপ্ন— এগুলোকে ভালোবাসো।
তাহলে যখন কেউ তোমাকে ভাঙতে আসবে,

তখন তুমি ওদের বলবে, ‘আমি আমার নিজের ভালোবাসায় এতটাই পূর্ণ যে,
আপনার মন ভাঙা নিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। বুঝলে কথাটা?”
অরিন আরও কিছুটা শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলো মা’কে। মায়ের বুকে নাক ঘষে দিয়ে বললো,
“ তুমি আমায় এতো ভালো করে কিভাবে বুঝো আম্মু? ”
রাফিয়া বেগম হাসলেন মেয়ের কথায়। মেয়ের মাথার চুলগুলোকে ঠিকঠাক করে দিয়ে বললেন,
“ যাকে জন্ম দিয়েছি তাকে বুঝবো না তো কাকে বুঝবো?”
অরিন হিহি করে হেসে ওঠে মায়ের কথায়।বাহ, দারুণ তো! কিছুক্ষণ আগের মন খারাপগুলো এখন বুঝি লেজ গুটিয়ে পালালো কোথাও। অরিন মায়ের বুক হতে মাথা উঠিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো। তারপর টুপ করে মায়ের গালে চুমু খেয়ে বললো,

“ তুমি পৃথিবীর বেস্ট মা আম্মু!”
রাফিয়া বেগমও মেয়ের কান্ড অবিকল করে মেয়ের গালে আলতো চুমু খেয়ে বললো,
“ আর তুমি পৃথিবীর বেস্ট দুষ্ট-মিষ্টি মেয়ে! ”
তারপর দুজনেই একসাথে খিলখিল করে হেসে ওঠে। বেশকিছুক্ষন পর তারা আবারও বাড়ির বসার ঘরে চলে আসে। অরিন বসার ঘরে উপস্থিত হয়েই সবার আগে নিজের মতামত দিতে শুরু করে।এতক্ষণ পর মনমতো একটা থিম পেয়ে সবাই অরিনের মতামতকে সমর্থন জানায়। অতঃপর অরিনের মতামতের ভিত্তিতেই সবাই সবটা লিস্টে টুকতে শুরু করে।
রাফিয়া বেগম অদূরে দাঁড়িয়ে মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।মনে মনে দোয়া করলেন, —– আল্লাহ যেন মেয়েটার মুখের হাসি সবসময় কায়েম রাখে।

সেই কখন থেকে বসার ঘরে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে শিশির। মনটা যে তার বড্ড ব্যাকুল হয়ে আছে একটা মানুষের জন্য। কিন্তু কাঙ্খিত মানুষটা যে নিচে আসার নাম-ই নিচ্ছে না। বেশকিছুক্ষন অপেক্ষা করবার পর অধৈর্য হলো মেয়েটা।গটগট পায়ে সিড়ি ভেঙে ওপরে চলে গেলো রৌদ্রের রুমের দিকে। পেছন থেকে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলেন জুবাইদা বেগম। মুচকি হেসে হাতের কাজগুলোকে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন তিনি। পাশ থেকে মেহনুর বেগম বাঁকা চোখে তাকালেন জুবাইদা বেগমের দিকে।কৌতুকের সুরে বলে ওঠেন,
“ তা বড় ভাবি! কি এমন কথা মনে পড়লো যার জন্য তুমি এমন মিটমিটিয়ে হাসছো?”
কথাটা শোনামাত্র উপস্থিত সকলের দৃষ্টি পড়লো জুবাইদা বেগমের দিকে। জুবাইদা বেগম খানিকটা ভড়কে গেলেন। তা দেখে মাইমুনা বেগম হেসে ওঠে বললেন,

“ আরে! জানো না! আমাদের বড় বু তো মেয়ের বিয়ের সাথে ছেলেকেও বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। ”
কথাটা শোনামাত্র উপস্থিত সকলে নড়েচড়ে বসলেন। কেও কেও তো হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মাইমুনা বেগমের দিকে। রুহি এতক্ষণ আরামসে পাকোড়া চিবুচ্ছিলো।কিন্তু যেই না কথাটা তার কানে এসে ঠেকলো ওমনি মেয়েটা চিবুতে ভুলে গেলো। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। আহি-মাহি আর শশী, সোহেলী মিলে কালকের জন্য মেহেদী ডিজাইন সিলেক্ট করছিলো কিন্তু এখন হয়তো মেয়েগুলো নিজেদের কাজটাই ভুলে বসেছে। পাশ থেকে কুহেলি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো জুবাইদা বেগমের দিকে। মনটা তার মুহুর্তেই বিষিয়ে উঠলো কথাটা শুনে।
সবার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে না চাইতেও হেসে দিলেন মাইমুনা বেগম। কিছুক্ষণ পর নিজের হাসি থামিয়ে বলে ওঠেন,

“ আরে, এভাবে তাকিয়ে আছো কেন তোমরা? আমি কি ভুল কিছু বললাম না-কি? ”
রুহি এবার হাতের পাকোড়ার বাটিটা নিচে রেখে এগিয়ে এলো মায়ের কাছে। ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“ আম্মু কথাটা কি সত্যি? আর যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে কে সেই মেয়ে? ”
মেয়ের কথায় জুবাইদা বেগমের মুচকি হাসিটা দীর্ঘ হলো। মেয়ের গালে হাত রেখে হাসি মুখে শুধালো,
“ হ্যা, হ্যা সত্যি! খুব শীঘ্রই তোর রোদ ভাইয়ের বিয়ে দিবো। ”
“ আর মেয়েটি কে?”

রুহির কথায় স্পষ্ট জানতে চাওয়ার আগ্রহ। জুবাইদা বেগম ফটফট কন্ঠে বলেন,
“ আর কে? তোর ভাই যাকে পছন্দ করে। আমাদের শিশির! ”
কথাটা শোনামাত্র থমকে যায় সকলে।ঠিক সেই মুহুর্তে সকলের কানে আসে এক বিকট শব্দ। সকলেই তড়িঘড়ি করে তাকায় শব্দের উৎসের দিকে।দেখতে পায়,মেঝেতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে আছে একটি কাচের গ্লাস। তার সামনেই হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে অরিন। দৃষ্টি তার একদম স্থির। চোখের কার্নিশে এসে ভিড় জমিয়েছে রাজ্যের অশ্রুদানা। হাত-পায়ে ধরেছে অসহনীয় কাঁপন। মেয়েটা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সামনের মানুষগুলোর দিকে। তার এমন অবস্থা দেখে বিচলিত হলো সকলে। মেহরিন বেগম ব্যস্ত হয়ে মেয়েটার হাত ধরে ধীরে ধীরে সরিয়ে আনলো ভাঙা কাচের সামনে থেকে। চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন করেন,

“ অরি! মা তোর কোথাও লাগেনি তো?”
অরিন কি শুনলো কথাটা? কই মেয়েটা কে দেখে তো বোঝা যাচ্ছে না! মেয়েটা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছে ফ্লোরের দিকে। মিনিটের মাথায় জুবাইদা বেগম এক গ্লাস পানি এনে ধরলো অরিনের মুখের সামনে। মেয়েটার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে আওরায়,
“ কিচ্ছু হয়নি তো মা! এতোটা শক হবার কিছুই নেই। তুই একটু পানি খা!”
অরিন মুখ তুলে চাইলো জুবাইদা বেগমের পানে। থেমে থেমে বললো,
“ রোদ ভাই কি সত্যি শিশির আপুকে ভালোবাসে?”
জুবাইদা বেগম আলতো হেসে বললো,
“ হ্যা মা।ওরা দুজন দু’জনকে বহু আগে থেকেই ভালোবাসে। আচ্ছা ওদের জুটিটা কেমন হবে অরি?”
জুবাইদা বেগমের প্রশ্নে ভেজা চোখে হাসলো অরিন।আলতো করে মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে বললো,
“ ভিষণ ভালো লাগবে বড়মা। ভিষণ ভালো লাগবে। ”

রৌদ্রের ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে হাসফাস করছে শিশির। কেন জানি আজকে তার বড্ড অস্বস্তি ঠেকছে রৌদ্রের সামনে যেতে। খানিকক্ষণ দোনোমোনো করে অবশেষে টোকা দিলো রৌদ্রের ঘরের বন্ধ দরজায়। পরপর দুটো টোকা দেবার পর খট করে দরজাটা ভেতর থেকে খুলে দেয় রৌদ্র। শিশিরের দিকে একপলক তাকিয়ে আবারও ভেতরে চলে যায় সে। গিয়ে বসে পড়ে নিজের আরাম কেদারায়। এদিকে শিশির দরজা খোলা মাত্র চট করে ঢুকে পড়ে ভেতরে। রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলে ওঠে,

“ রোদ তুই ঠিক আছিস?”
“ হু” ছোট্ট করে উত্তর দিলো রৌদ্র। চোখ বন্ধ রেখেই আবারও প্রশ্ন ছুড়লো শিশিরের উদ্দেশ্যে,
“ এখানে কেন এসেছিস?”
শিশির কিছুটা থতমত খায়। খানিকটা এলোমেলো হয়ে আসে তার কথাগুলো।
“ ইয়ে, আরকি, একটা কথা জানতে এসেছিলাম। ”
“ কি?”
শিশির কিছুক্ষণ থেমে থেকে আবারও বলতে লাগলো,
“ রোদ! তুই কি কাওকে ভালোবাসিস?”
ফট করে চোখদুটো মেলে তাকায় রৌদ্র। সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করলো,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৭ (২)

“ তুই এসব কেন জিজ্ঞেস করছিস?”
শিশির আবারও আমতা আমতা করলো,
“ এমনেই একটু জানতে চাচ্ছিলাম আরকি!”
“ সবকথা জানার আগ্রহ না থাকাই ভালো। ”
এ পর্যায়ে থামলো শিশির। বলার মতো আর কোন কথা না পেয়ে চলে যেতে নেয় ঠিক তখনি পেছন থেকে ভেসে আসে রৌদ্রের গম্ভীর কণ্ঠ!
“ আমার জীবনে শুরু থেকে শেষ অবধি শুধু একজনই ছিলো,আছে এবং সারাজীবন থাকবে। ”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here