সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১২
জাওয়াদ জামী
” কুহু, চলনা ছাদে যাই। আর পড়তে ইচ্ছে করছেনা। চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে কোমড় ব্যথা হয়ে গেছে। ” আড়মোড়া ভেঙে বলল সিক্তা।
কুহু আর সিক্তা দু’জনে এক রুমে আছে। ওরা একসাথেই রাত জেগে পড়ছে।
” এত রাতে ছাদে যাব! মামী বকবেনা? ” ঘড়ির দিকে তাকায় কুহু। ঘড়ির কাঁটা দুইটা ছুঁয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কুহু।
” কিচ্ছুটি বলবেনা। চল যাই। ” সিক্তা কুহুকে টেনে রুমের বাহিরে যেতে যেতে বলল।
ছাদে এসে মন ভালো হয়ে গেল কুহুর। হরেক রকম ফুলের গাছ ভর্তি ছাদ। হাসনাহেনা, কামনী, গন্ধরাজ, বেলীর সুবাস বইছে ছাদের শীতল হাওয়ায়। কুহু অবাক হয়ে ধীর পায়ে হেঁটে গেল কামিনী গাছের দিকে। কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ফুলের সুবাস নিল। নিমেষেই ওর মন ভালো হয়ে গেল।
” সিক্তা, তোদের ছাদ আসলেই মনোমুগ্ধকর। এই ছাদ বাগান দেখে আমার মন এক নিমেষে ভালো হয়ে গেছে। যে এই গাছগুলো লাগিয়েছে তার রুচি আছে বলতে হবে। ” কুহু রজনীগন্ধার শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল।
” পছন্দ হয়েছে তোর? ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” পছন্দ হওয়ার মত নয় কি? জানিস সবগুলোই আমার পছন্দের ফুল? কামিনী, রজনীগন্ধা, বেলি, গন্ধরাজ সবগুলোই আমার ভিষন পছন্দের ফুল। জানিস, যখন ঢাকা ছিলাম, তখন আমাদের ফ্ল্যাটে অনেকরকম ফুল গাছ লাগিয়েছিলাম? নিয়মিত গাছেদের পরিচর্যা করতাম। গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে যেত। কত রাত বেলকনিতে ফুলের সুবাস নিয়ে কাটিয়েছি। বাবা-মার মৃত্যুর পর আমার শখের গাছগুলোকে ঐ ফ্ল্যাটে রেখেই গ্রামে ফিরে যেতে হয়েছিল। আর জানতেও পারিনি আমার শখের গাছগুলোর কি হয়েছিল। ” কুহু অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করছে। সে যেন আর সিক্তাদের ছাদে নেই। চলে গেছে ওদের সেই পুরোনো ফ্ল্যাটে।
” তাই! ভাইয়া কি তবে জানত তোর পছন্দের কথা! ” সিক্তা বুঝতে পারল অতীত রোমন্থন গিয়ে কুহুর মন খারাপ হয়ে গেছে। তাই ওকে চমকে দিতেই কথাটা বলল সে।
সিক্তার কথা শুনে সত্যিই চমকে গেল কুহু। রিনরিনে গলায় জিজ্ঞেস করল,
” ভাইয়া? ভাইয়া কে? আর কেনইবা সে আমার পছন্দের কথা জানবে! ”
” ছাদে বাগানের প্ল্যান তাহমিদ ভাইয়াই তো করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে মনের মত করে বাগান করেছে। ছাদের সবগুলো গাছই ভাইয়া কিনেছে। ”
সিক্তার কথা শুনে চুপসে গেল কুহু। তাহমিদ নামক ছেলেটিকে ওর কেমন যেন লাগে। কখনো মনে হয় সে ভিষণ ভালো, তো আবার পরক্ষনেই মনে হয় লোকটা ঝগড়ুটে, আবার কখনো কখনো তার কথা শুনে মনে হয়, সে বুঝদার। আবার অনেক সময় কুহুর পূর্বের সকল ভাবনাকে গুড়িয়ে দিয়ে তাহমিদ অহংকারী রূপে আত্নপ্রকাশ করে। কুহু এখন পর্যন্ত ভেবে পায়নি, তাহমিদ আসলে কি। হঠাৎই চোখমুখ কুঁচকে সিক্তার দিকে তাকায় কুহু।
” সিক্তা, সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছিস? অনেকক্ষণ থেকেই মনে হচ্ছে আশেপাশে কেউ সিগারেট খাচ্ছে। ”
কুহুর কথা শুনে সিক্তা বাতাস শুঁকতে শুরু করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বুঝে গেল কুহু সত্যিই সিগারেটের গন্ধ পেয়েছে। কারন বাতাসে সিগারেটের গন্ধ প্রকট হয়ে উঠেছে।
” সত্যিই তো! সিগারেট কে খাচ্ছে? আমাদের বাসায় তো কেউই সিগারেট খায়না। ” সিক্তা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু ছাদ অন্ধকার থাকায় কিছুই দেখতে পেলোনা।
” সিক্তা, চোর আসেনি তো? ”
” চোর এসে চুরি করার বদলে সিগারেট খাবে! এমন বোকা চোরও কি হয়? ”
” হতেই পারে। জানিসনা নেশা জিনিসটা খুব খারাপ? মনে কর, চুরি করতে এসে হঠাৎই চোরের সিগারেটের নেশা হল। তখন কি সে সিগারেট খাবেনা? নেশাখোরদের কাছে চুরির থেকেও বড় হল নেশার বস্তু। ”
” সিক্ত, তোর মহাজ্ঞানী বন্ধুটিকে বলে দে, এই বাড়িতে চোর আসেনি। সামান্য সিগারেটকে সে নেশার বস্তু মনে করে! তার বিদ্যার বহর দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আমার তো তাকে রীতিমত বিদ্যার নদী মনে হচ্ছে। কুহুরানী বিদ্যানদী। ” হঠাৎই চিলেকোঠার পেছন থেকে বেরিয়ে আসল তাহমিদ। সেই সাথে কুহুকে শুনিয়ে দিল কতগুলো খোঁচা মারা বাক্য।
এই মাঝরাতে ছাদে তাহমিদের গলা শুনে চমকে উঠল সিক্তা কুহু দু’জনেই। পেছনে তাকাতেই দেখল তাহমিদ ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার আঙুলের ফাঁকে জলন্ত সিগারেট। সিক্তা তাহমিদের হাতে সিগারেট দেখে অবাক হয়ে গেছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল ওর ভাইয়ার দিকে। আর কুহু তো পারলে লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়।
” ভাইয়া, তুমি স্মোক কর? ”
” কেন বড়মাকে বলে দিবি নাকি সিনিয়র রাশেদীনকে বলবি? কাউকে বলার কথা মাথায়ও আনিসনা। ”
” কাউকেই বলবনা। কিন্তু তুমি সিগারেট খাও কেন? তুমি নিজে মেডিকেল স্টুডেন্ট হয়ে এসব ছাইপাঁশ খাও কেন? জানোনা, ধুমপান ক্যান্সার ঘটায়? ”
” এই যে এসে গেছে, সিক্তা কুমারী বিদ্যাসাগরী। যার নিজের মাথায় গোবরে ঠাসা, সে আবার একজন ভবিষ্যৎ ডক্টরকে জ্ঞান ঝাড়ছে। আরে গাধী, ভাই কি জানেনা সিগারেট খেলে কি হয়? না জেনেই কি ভাই সিগারেট খায়? ”
আনানকে দেখে আরেক দফা চমকায় সিক্তা, কুহু। আনানের হাতেও সিগারেট।
” ভাইয়া, তুমিও? বড়মা জানলে তোমাকে কি করবে জানো? ” এবার কুহু আননকে বলল।
” কোকিলা, তুই না আমার লক্ষ্মী বোন? খবরদার আম্মুকে কিছু বলিসনা। আম্মু যদি আমাকে প্যাদানি দেয়, তবে তুইও তো কষ্ট পাবি। আমি জানি তুই আমাকে কতটা ভালোবাসিস। আমি এ-ও জানি, আমার কষ্ট তুই সহ্য করতে পারিসনা। এরপরও কি আম্মুকে বলে দিবি? ”
আনানের ইমোশনাল কথাবার্তা শুনে গলে গেল কুহু। মাথা নেড়ে জানাল, সে বড়মাকে কিছুই বলবেনা।
এতক্ষণ তাহমিদ তীক্ষ্ণ চোখে কুহুকে লক্ষ্য করছিল। সেই সাথে লক্ষ্য করছিল আনানকেও।
” এই ছুঁচোও এখানে! ভাইয়া, সিগারেট কে কিনেছে? তুমি নাকি আনাইন্না? তুমি যদি কিনে থাক, তবে আনাইন্না যে কয়টা সিগারেট খেয়েছে, সেগুলোর দাম দিতে বল। তোমার টাকার সিগারেট এই ছুঁচো মার্কা ছেলে খাবে এটা হতে পারেনা। আমি হতে দেবোনা। ”
” হুররর, যা হাট্। আসছে ভাইয়ার চামচা। কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওর সিগারেট নয় ওর ভাইয়ার কলিজা খেয়েছি আমি। তোর মত কিপ্টে আমি আমার দাদার জন্মেও দেখিনি। তোর মত এক পিস যে বাড়িতে থাকবে, সেই বাড়িতে কিপ্টের জলোচ্ছ্বাস ঘটবে। তুই নিজের সাথে সাথে বাড়ির প্রতিটা সদস্যকেও কিপ্টে বানাবি। ”
” আমি কিপ্টে হই আর না হই তাতে তোর কি? তুই তোরটা ভাব। কয়টা সিগারেট খেয়েছিস সেটা বল আগে? ”
” বলবনা। যা পারিস করে নে। ”
” সিক্তা, চল নিচে যাই। এত রাতে ঝগড়া করে কাজ নেই। ”
কুহুর কথা শুনে মুচকি হাসল তাহমিদ। ও বুঝতে পারে, কুহু ওকে দেখলেই কেমন মিইয়ে যায়। ভুল করেও ওর দিকে তাকায়না মেয়েটা।
” সিক্ত, লজ্জাবতীকে নিয়ে রুমে যা। এরপর থেকে ওকে আপাদমস্তক ঢেকে বাহিরে আসতে বলিস। এতে অনন্ত লজ্জার হাত থেকে রেহাই পাবে সে। ”
” লজ্জাবতী! ভাই, তুমি এ কেমন নামে ডাকলে ওকে? তুমি কিভাবে জানলে কোকিলা একটু বেশিই লজ্জা পায়! ওর সাথে তো তুমি তেমন কথাও বলোনি! ”
” তুই বুঝবিনা। বোঝার বয়স হয়নি তোর। এসব বোঝার চেষ্টা না করে, বরং তুই ঝগড়াটা ভালো করে শিখ। ঝগড়ায় তুই বড্ড কাঁচা। সিক্তর মত বাচ্চা মেয়ের সাথে যে ছেলে ঝগড়ায় জিততে পারেনা, সে আদৌ কোন পুরুষ কিনা সেটা আমার সন্দেহ হয়। কি রে আমার সন্দেহ ঠিক না ভুল? ”
তাহমিদের কথায় দুই ধাপ পিছিয়ে যায় আনান। লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরল ছেলেটা।
” ছোট বোনের সামনে এভাবে ইনসাল্টিং করোনা, ভাই। তোমার কথায় আমার থেকেও বেশি লজ্জা পেয়েছে কুহু। বিশ্বাস না হলে ওর দিকে তাকিয়ে দেখ। ”
আনানের কথা শুনে কুহুর দিকে তাকায় তাহমিদ। মেয়েটার দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল সে। সত্যিই মেয়েটা লজ্জায় কুঁকড়ে গেছে। মাথা নিচু করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছে সে।
” সিক্ত, নিচে যা। এখন যদি নিচে না যাস, তবে এবার আনানের কোকিলা সত্যিই লজ্জায় হার্ট অ্যাটাক করবে। একবার ভেবে দেখ, লজ্জায় কেউ হার্ট অ্যাটাক করলে সেটা একটা ভাইরাল নিউজ হবে। ঘন্টায় ঘন্টায় সাংবাদিক আসবে ইন্টারভিউ নিতে। বিভিন্ন চ্যানেলে দেখাবে আনানের কোকিলাকে। ওকে একনজর দেখার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যাবে। এই লজ্জায় সে আরেকবার হার্ট অ্যাটাক করবে। মানে এভাবে চলতেই থাকবে। আর একটা লজ্জাবতী অচঞ্চল নারীর অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হার্ট অ্যাটাক ঘটানোর দায়ে আমাকেই দোষী হতে হবে এটা আমি নিশ্চিত। আমি কারো হার্ট অ্যাটাকের কারন হতে চাইনা। ”
” ভাই, মনে কর রাগের চোটে তোমার আদরের ন্যাকুবতী সিক্তই হার্ট অ্যাটাক করল। তবে কেমন হবে? ন্যাকুবতীর যে রাগ। কোনদিন দেখবে রাগের কারনে ওর হার্ট বলে দিল, আমি আর এ্যাক্টিভ থাকতে পারছিনা, আমাকে রেহাই দিন। সেদিন কি হবে বুঝতে পারছ? অবশ্য এতদিন ওর হার্ট যে নেগেটিভ রিভিউ দেয়নি, এটা ভেবে আমি অবাক হচ্ছি। নাকি ওর হার্টই নেই? ”
” আনাইন্না রে, তোকে আমি আজ কাঁচা চিবিয়ে খাব। ” সিক্তা তেড়ে গেল আনানের দিকে।
সিক্তাকে তেড়ে আসতে দেখে আনান এক দৌড়ে নিচে গেল। সিক্তাও ওর পেছনে দৌড় দিল।
একা ছাদের মাঝখানে হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে কুহু। একটু সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। ভয়ে কুহুর হাত-পা কাঁপছে। এমন পরিস্থিতিতে ও আগে পরেনি। মাঝ রাতে কখনো কোন পুরুষের আশেপাশে থাকেনি।
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১১
” কাঁপছ কেন! আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? খেয়ে ফেলব তোমাকে? ”
” আজকাল কাউকে বিশ্বাস নেই। ” কথাটা বলেই দু হাতে নিজের মুখ চেপে ধরল কুহু।
” কিহ! আমাকে তোমার ক্যারেক্টারলেস মনে হয়! ” কুহুর দিকে দুই ধাপ এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাহমিদ।
তাহমিদকে নিজের কাছে আসতে দেখে কাঁপুনি বেড়ে গেল কুহুর।
কুহুকে অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে দেখে ভড়কে গেল তাহমিদ। আরেকটু এগিয়ে গেল কুহুর দিকে। উদ্দেশ্য কুহুকে ধরার। কারন কুহুকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা যেকোন মুহূর্তে ছাদের মেঝেয় লুটাবে।
তাহমিদকে নিজের খুব কাছে দেখে ভয়ে কেঁদে উঠল কুহু। মাথা ঘুরে উঠল ওর।
কুহুকে পরে যেতে দেখে দ্রুত এগিয়ে গেল তাহমিদ। মেঝেতে পরবার আগেই ধরে ফেলল ওর শ্যামাঙ্গিনীকে।