সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৪
জাওয়াদ জামী
” কুহু সোনা, তোমাকে আগেই বলে রাখছি, বুয়েটে চান্স পেলে তোমাকে কিন্তু আমাদের বাসায় থাকতে হবে। এখান থেকেই ক্লাস করবে তুমি। ” দিদুন কুহুর ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন।
” সেটা পরে দেখা যাবে, দিদুন। আগে তো চান্স পাই। ”
” কেনো? তোমার পরীক্ষা ভালো হয়নি? সিক্তার নাকি চান্স পাওয়ার সুযোগই নেই। ও কিছুই পারেনি শুনলাম। ”
” পরীক্ষা ভালো হয়েছে। কিন্তু এখনই বলতে পারছিনা কি হবে। ”
” টেনশন হচ্ছে? ”
” হুঁ। ”
” এদিকে সিক্তাকে দেখ, পরীক্ষা খারাপ হওয়ার পরও সে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরীক্ষা খারাপ হওয়ার পরও যে এমন নিশ্চিন্তে থাকা যায় ঘুরে বেড়ানো যায়, ওকে না দেখলে জানতেই পারতামনা। ওকে দেখে শেখ, রিল্যাক্স কিভাবে থাকতে হয়। ”
দিদুনের কথা শুনে হাসল কুহু।
” দিদুন, তুমি মেডিসিন নিয়েছ? ” তাহমিদ রুমে ঢুকে কুহুকে দেখে মাথা চুলকে হাসল।
” কুহু সোনা প্রেসক্রিপশন দেখে সবগুলো ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। এখনে আসার পর থেকে কুহু সোনাই আমাকে ঔষধ খাওয়ায়। আমার যত্ন নেয়। ”
” তাহলে ওকে আমাদের বাড়িতে রেখে দেই, দিদুন? ও তোমার যত্ন করবে। তুমি একটা গল্প করার সাথী পাবে। ”
” আমি সেকথা কুহু সোনাকে বলেছি। ও বুয়েটে চান্স পেলে ওকে এখানেই রেখে দেব। ”
” সে রাজি হয়েছে? ”
” এখনো না। কিন্তু আমি রাজি করিয়েই ছাড়ব দেখ। ”
” এই যে মেয়ে, দিদুনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও। তুমি রাজি হওয়া মাত্রই শিহাবকে এখানে ভর্তি করে দেব। ”
” আগে তো চান্স পাই। তারপর দেখা যাবে কোথায় থাকব। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” সিদ্ধান্ত আগে থেকেই নিতে হয়, কোকিলা । চান্স পাওয়ার পর দেখা গেল খুশিতে তুই কয়েকদিন বাকরুদ্ধ হয়ে থাকলি। তখন আমাদের তোকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে। টেনশনে ভুলে যাব তুই কোথায় থাকবি। ঠিক বলেছিনা, নানীমা? ” আনান রুমে ঢুকেই কথাগুলো বলে দিদুনের পাশে ধপ করে শুয়ে পরল।
” খুশিতে সবাই বাকরুদ্ধ হয়না রে, গাধা। খুশিতে বাকরুদ্ধ থাকে তোর মত গোবর গনেশরা। এজন্যই ঢাবিতে চান্স পাওয়ার পর খুশিতে তিনদিন ধরে কেঁদেছিলি৷ স্বপ্ন পূরণ হওয়ার খুশিতে নিজেকেই চিনতে পারতিসনা তুই। ”
” অপমান্স করোনা, ভাই। তুমি গোবরে পদ্মফুল জন্য বাকি সবাইকেই গোবর গনেশ মনে করবে এটা হতে পারেনা। অরিজিনাল গোবর গনেশ তো তুমি। তোমার দাদার বংশের প্রথম ডক্টর তুমি। তাই তোমার এত বাহাদুরি। আর আমার দাদুর বংশে অলরেডি চারজন ডক্টর আছে। এবার তুমিই বল কে আসল গোবর গনেশ? ”
” একটু ভুল বললি। আমার দাদুর বংশেও আমি ছাড়া চারজন ডক্টর আছে। ঢাবিয়ানও আছে। কিন্তু তোর মত গাধা একটাও নেই। যে ঢাবিতে চান্স পাওয়ার সুযোগ পেয়ে খুশিতে সাতদিন ধরে কাঁদে। এদিকে আমরা এখানে খাবার খেয়ে কুলি ফেলি ঢাবির ক্যাম্পাসে। যে ক্যাম্পাস তোদের স্বপ্ন, সেই ক্যাম্পাসই আমাদের কাছে খেলনা। এখন বল, কে অরিজিনাল গোবর গনেশ আর কে অরিজিনাল বংশীয়? ”
” দিদুন, উনাকে বলুন আমার বংশের কাউকে অপমান না করতে। আমার বংশের তিনজন ঢাবিতে পড়াশোনা করেছে। ” কুহু মুখ ভার করে দিদুনকে বলল।
কুহুকে মন খারাপ করতে দেখে ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা চিন্তা করল। এরপর আনানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আনান, তুই তোর কোকিলাকে বলে দে, যেটাকে সে নিজের বংশ বলে দাবী করছে, আদতেও সেটা তার বংশ নয়। সেই বংশের টেম্পোরারি বাসিন্দা সে। তার হাজবেন্ডের বংশই হবে তার অরিজিনাল বংশ । সে গর্ব করবে তার হাসবেন্ডের বংশ নিয়ে। যে বংশে সে তার বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। যে বংশের উত্তরাধিকার তার মাধ্যমে বৃদ্ধি পাবে। আফটার অল সে একজন গর্বিত বংশের গর্বিত পুত্রবধূ হবে। ”
” এটা কিভাবে, ভাই? তুমি কিভাবে জানলে কোকিলা গর্বিত বংশের পুত্রবধূ হবে! ”
” এইজন্যই তো তোকে গাধা বলি। একটু চোখকান খোলা রাখলেই সবকিছু জানতে পারা যায়। ”
শুধু আনানই নয় কুহুও তাহমিদের যুক্তি বুঝতে পারলনা। ওর কাছে মনে হল, লোকটা আবোলতাবোল বকছে। একমাত্র দিদুনই তাহমিদের কথা শুনে মুখ টিপে হাসলেন।
নিহান ঢাকা গেছে প্রায় একমাস। ও প্রতিদিন কয়েকবার করে ফোন করে দৃষ্টিকে। কিন্তু দৃষ্টি একবারও নিহানের ফোন রিসিভ করেনা। তবুও নিহান হাল ছাড়েনা। ও সময় পেলেই ফোন, ম্যাসেজ সবই দেয়।
বেলকনির গ্রীলে দাঁড়িয়ে সূদুর পানে চেয়ে আছে নিহান। আজকাল ওর কিছুই ভালো লাগেনা। রাতে ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছেনা। ক্ষুধা লাগলেও খেতে ইচ্ছে করেনা। পড়াশোনায় মনযোগ দিতে পারছেনা। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে গ্রামে যেতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু কুহু ঢাকায় যাওয়ায় গ্রামেও যাওয়া হচ্ছেনা। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে দৃষ্টির।
” এই যে রাজকন্যা, এখানে এভাবে সঙের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কাজকর্ম নেই তোর? আমার ছেলের বউ হয়ে এসে সাপের পাঁচ পা দেখেছিস নাকি? যেই দেখলি সবাই মাথায় তুলে নাচছে, অমনি নিজের স্বরূপ প্রকাশ করলি? তিনবেলা গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে পায়ের ওপর পা তুলে খু্ বসে থাকতে শিখেছিস। এটাতো আমার বাড়ি নয়, যেন ধর্মশালা। ” রাখী আক্তার ঝাঁঝালো গলায় দৃষ্টিকে আঘাত করল।
বড়মার গলা শুনে প্রথমে চমকে উঠেছিল দৃষ্টি। পরে তার এরূপ কঠোর বাক্য শুনে ওর ভেতরটা হু হু করে উঠল। আজকে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা দৃষ্টি। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
দৃষ্টিকে কাঁদতে দেখে প্রথমে ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হল রাখী আক্তার। খেঁকিয়ে উঠল সে।
” ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না ছাড়া আর কি পারিস? ভাবখানা দেখে মনে হয় নবাবজাদী। কথায় আছেনা, ছাল নেই কুত্তার বাঘা নাম। তোকে দেখলে আমার এমনটাই মনে হয়। যেই শুনেছিল, নিহানের বিয়ে পৃথুর সাথে হচ্ছেনা, তখন নিহানের বউ হবার লোভ সামলাতে পারেনি। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছিল। একবারও ভাবেনি, নিহানের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা ওর নেই। যতসব হাভাতের দল এসে জুটেছে আমার ভাগ্যে। ”
রাখী আক্তারের এহেন আক্রমনে দৃষ্টির ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গেলেও নিয়ন্ত্রণ হারালোনা মেয়েটা। ওড়নায় চোখের পানি মুছে ঘুরে তাকাল বড়মার দিকে।
” আমাদের কেন এত ঘৃণা কর, বড়মা? কি দোষ করেছি আমরা? বাবা-মা বেঁচে থাকতে তো তোমার এই রূপ আমরা দেখিনি! কেন হঠাৎ করে পাল্টে গেলে? শুধুমাত্র আমরা আগের মত সম্পদশালী নই বলে কি এত ঘৃণা? তাহলে কি তোমার কাছে সম্পদই সকল সম্পর্কের উর্ধ্বে? একটাবারও কি তোমার মনে হয়না, আমরা এতিম? বাবা-মাকে হারিয়ে আমরা তিন ভাইবোন অকূলপাথারে খড়কুটোর ন্যায় ভাসছি? আঁকড়ে ধরবার জন্য কাউকে আমাদের প্রয়োজন, একথা একবারও তোমার মন মস্তিষ্কে জায়গা করে নেয়না? তোমার কাছে কখনো টাকাপয়সার জন্য আমরা আসিনি। তবুও তুমি আমাদের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার কর। আপু কখনোই তোমার সাহায্য চায়নি। সে কষ্ট করে আমাদের পড়াশোনা করাচ্ছে। তবুও কেন এত আঘাত কর আমাদের? নিজের সন্তানদের জায়গায় একবার আমাদেরকে বসিয়ে দেখ। দেখবে আমরাও মানুষ, আমাদেরও ভালোবাসা প্রয়োজন। তুমি পাষাণ জানতাম। কিন্তু এতটা পাষাণ সেটা জানতামনা।
এতিম, অসহায় তিন ভাইবোনের কষ্ট তোমার চোখে পরেনা। যদি চোখে পরত তাহলে বুঝতে, আমাদেরও কষ্ট হয়। আসলে মা হওয়ার কোন যোগ্যতাই নেই তোমার। যোগ্যতা থাকলে বুঝতে, বাবা-মা ছাড়া আমরা কতটা কষ্টে থাকি। ” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল দৃষ্টি। কয়েক মুহূর্ত রাখী আক্তারের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে ফোন নিয়ে সোজা চলে গেল ছাদে।
দৃষ্টির কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল রাখী আক্তার। সে ভাবতেই পারেনি দৃষ্টি তাকে এভাবে কথা শোনাবে। রাগে তার ভেতরে ফুটন্ত আগ্নেয়গিরি টগবগ করছে।
সন্ধ্যা হলেও ছাদেই বসে থাকল দৃষ্টি। বিকেলের ঐ ঘটনার পর থেকেই অঝোরে কাঁদছে মেয়েটা। আজকে বারবার বাবা-মার কথা মনে পরছে। তারা বেঁচে থাকলে ওদের তিন ভাইবোনকে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হতোনা। বড়মা ওদেরকে এভাবে আঘাত করতে পারতনা।
ফোনের আওয়াজ পেয়ে চোখ মুছে ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকায় দৃষ্টি। স্ক্রীনে ‘ কুহুপু ‘ নামটা জ্বলজ্বল করছে। মলিন হেসে ফোন রিসিভ করল দৃষ্টি।
” কেমন আছো, আপু? তুমি বাড়িতে কবে আসবে? তাড়াতাড়ি এসোনা। ” নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করল দৃষ্টি।
” আমি ভালো আছি। রেজাল্ট হলেই বাড়িতে যাব। তোর কি হয়েছে, দৃষ্টি? কাঁদছিস কেন তুই? ”
হাজার চেষ্টা করেও কুহুর কাছে কান্না লুকাতে পারলনা দৃষ্টি। কুহু বুঝতে পারল ওর আদরের বোনটি কাঁদছে।
” ক..কে বলেছে আমি কাঁদছি! আমি…আমি কাঁদছিনা। অনেকদিন তোমাদের দেখিনি, তাই খারাপ লাগছে। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়িতে এস, আপু। তুমি আসলেই আমি বাড়িতে যাব। ”
” মিথ্যা বলিসনা, দৃষ্টি। আমি জানি তুই কাদঁছিস। বড়মা কিছু বলেছে? ” কুহুর বুকের ভেতরে তোলপাড় করছে। ভাইবোনদের চোখের পানি ও সহ্য করতে পারেনা। নিজে কষ্ট করে তবু ভাইবোনকে কষ্ট দিতে চায়না। কোনকিছুর অভাব বুঝতে দেয়না মেয়েটা।
” কিছু হয়নি, আপু। বললামনা, তোমাদের জন্য মন কেমন করছে। ” কান্না চেপে বলল দৃষ্টি।
” দুইদিনের মধ্যে রেজাল্ট দেবে। রেজাল্ট হলেই আমি চলে আসব। তুই মন খারাপ করিসনা। দুইদিন পর তোকে নিয়েই আমি বাড়িতে যাব। ” কুহুর মন বলছে দৃষ্টি কাঁদছে। ও দৃষ্টির গলার আওয়াজ চেনে। স্বাভাবিক অবস্থায় দৃষ্টি কিভাবে কথা বলে, আর কাঁদলে কিভাবে কথা বলে সেটা কুহুর থেকে ভালো কেউ জানেনা।
” শিহাব কোথায়, আপু? ও ভালো আছে? ”
” শিহাব আনান ভাইয়ার সাথে বেড়াতে গেছে। ও ভালো আছে। বড়মা কোথায়? ”
” রুমে আছে। ”
” তুই কোথায়? ”
” ছ..ছাদে। ” মিথ্যা বলতে চেয়েও পারলনা দৃষ্টি।
” এই ভর সন্ধ্যায় তুই ছাদে কেন? নিচে যা। রাতে খেয়ে ঘুমাবি। আমি আবার রাতে ফোন দেব। ফোন কাছে রাখিস। ”
” আচ্ছা, আপু। ”
আরও কয়েকটা কথা বলে ফোন রাখল কুহু। চিন্তায় ওর মুখাবয়ব কৃষ্ণ বর্ণ ধারন করেছে। চোখের কোনে জমেছে নোনাজল। চোখ নামিয়ে কিছুক্ষণ মৌন রইল। চোখের কোনটা ভিজে উঠেছে কিনা কুহু ছাড়া কেউই জানতে পারলনা। কুহু যখন বুঝল, ওর কষ্টে নয়ন জোড়া কাঁদছে, ঠিক তখনই অতি সন্তর্পনে ওড়নার কোনে মুছে ফেলল কেউ দেখার আগে। কিন্তু কুহু বুঝতে পারেনি ওর ‘ নয়ন জোড়া কাঁদছে ‘সেটা ও জানার আগেই অন্য কেউ জেনে গেছে। তাহমিদ বেলকনি থেকে লক্ষ্য করছিল কুহুকে। ওকে নিভৃতে কারো সাথে কথা বলতে দেখে প্রথমে কিছু মনে না করলেও, কথা বলার এক পর্যায়ে কুহুর মুখটা মলিন হতে দেখে তাহমিদের বুকের বা পাশে কষ্টেরা আলোড়ন তোলে। তাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করতে থাকে ওর শ্যামাঙ্গিনীতে।
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৩
” কার সাথে কথা বললে তুমি, শ্যামাঙ্গিনী? কেন আচমকাই তোমার হৃদাকাশে বিষন্নতার মেঘ জমল? আমাকে জানতেই হবে। ” নিজের সাথেই কথা বলল তাহমিদ। এরপর নিচে গেল।