সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৫
জাওয়াদ জামী
তাহমিদ নিচে এসে দিদুনের কাছে গেল। কিছুক্ষণ পরই সে রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে বসে ফোনে মনযোগ দিল। পনের-বিশ মিনিট পর কুহু ভেতরে আসতেই দিদুনের ডাক শুনে তার রুমে গেল। কুহু জানতেও পারলনা সে ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই তাহমিদ দিদুনের ফোনে মিসডকল দিয়েছে।
” আমাকে ডাকছিলে, দিদুন? ” রুমে ঢুকে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল কুহু।
” আমার কাছে এসে বস। কিন্তু তার আগে বল, তোমার মুখটা এত মলিন দেখাচ্ছে কেন? ”
দিদুনের প্রশ্নে কুহু একটু ইতস্তত করে মলিন হেসে বলল,
” কিছু না, দিদুন। ”
” মিথ্যে বলছ আমাকে? কিছু না হলে তোমার মুখটা এমন মলিন দেখাচ্ছে কেন? ”
” দৃষ্টির সাথে কথা বলেছি কিছুক্ষণ আগে। ওকে অনেকদিন দেখিনা। আগে কখনোই আমাদের ছেড়ে এতগুলো দিন বাহিরে থাকেনি ও৷ সেজন্য ওর ও মন একটু খারাপ। ” দিদুনকে সত্যিটা বলতে পারলনা কুহু। দিদুনের সাথে মিথ্যা বলতে চায়নি। কিন্তু ও নিরুপায়।
” তাহলে এবার বাড়িতে সরাসরি না গিয়ে দৃষ্টিকে নিয়েই গ্রামে যেও । আমি রাখীকে বলে দেব। কিছুদিন তোমার কাছে দৃষ্টিকে রেখ। এবার একটু হাসতো। তোমার বিরল হাসি দেখে প্রানটা জুড়াই। ”
দিদুনের কথায় কিছু একটা ছিল। তার কথাগুলো শোনামাত্রই কুুহুর বুকটা হালকা হলো। ফলশ্রুতিতে মেয়েটা মৃদু হাসল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাত একটা পঞ্চাশ। দৃষ্টি বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। সন্ধ্যার পর থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত কুহুপু ওকে চারবার ফোন দিয়েছে। বোনের সাথে কথা বলে দৃষ্টির মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিছানায় আসার পর থেকেই আবারও মন খারাপের মেঘ ওর হৃদাকাশে হানা দিয়েছে। থেকে থেকেই ফুঁপিয়ে উঠছে মেয়েটা। নিজেকে বড্ড একা লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে, এই ধুলির ধরায় ও সম্পূর্ণরূপে একা। কেউ ওকে ভালোবাসেনা। কেউ ওর কথা ভাবেনা। কথাগুলো মনে আসতেই হু হু করে কেঁদে উঠল দৃষ্টি। এভাবে কতক্ষণ বালিশ ভেজালো অশ্রুজলে সেকথা দৃষ্টিও বলতে পারেনা। দরজায় নকের শব্দ পেয়ে হুঁশ হল ওর।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আড়াইটা বাজে। এত রাতে ওর বেডরুমের দরজায় কে নক করছে? চোখ মুছে দরজার কাছে গেল। দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল দৃষ্টি। নিহান ভাইয়া উসকোখুসকো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! নিহানকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মেয়েটা। দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা দিব্যি ভুলে গেল। দৃষ্টির হতভম্ব চেহারা নিহান যা বোঝার বুঝে গেল। ও দৃষ্টিকে ঠেলে ভেতরে ঢুকল। বন্ধ করে দিল দরজা৷ এরপর দৃষ্টির হাত ধরে ওকে নিয়ে বিছানায় বসালো। এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরল দৃষ্টির। নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা। ঝাঁপিয়ে পরল নিহানের বুকে। কেঁদে উঠল হাউমাউ করে। দৃষ্টিকে কাঁদতে দেখে নিহানের বুকের ভেতর তোলপাড় করলেও ছেলেটা দৃষ্টিকে কাঁদতে একটুও বাঁধা দিলনা। ও শুধু বুকের মাঝে দৃষ্টিকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখল।
” তুমি খুব খারাপ একটা মানুষ। খুব খারাপ তুমি। ” কান্নার দমকে কথা বলতে পারছেনা দৃষ্টি।
দৃষ্টির অভিযোগ শুনে নিহান মুচকি হাসল। দৃষ্টির কথার জবাব দিলনা। এদিকে দৃষ্টির চোখের পানি, নাকের পানিতে ওর টি-শার্ট ভিজে একাকার। বুকের কাছে ঠান্ডা অনুভূত হলেও নিহান কোন প্রতিক্রিয়াই দেখালোনা। অনেকক্ষণ পর কান্না থামালো মেয়েটা। কিন্তু নিহানের বুক থেকে মাথা তুললনা। চুপটি করে অনুভব করতে থাকল নিহানের হৃৎস্পন্দন। হৃদস্পন্দনের ঢিব ঢিব শব্দে শিহরণ জাগছে দৃষ্টির তনু মনে।
” আমার হৃৎস্পন্দনের প্রতিটি শব্দ তোরই নাম করছে। শুনতে পাচ্ছিস? ”
নিহানের কথা শুনে চমকে উঠল দৃষ্টি। ও বুঝতে পারলনা নিহান ভাইয়া কিভাবে বুঝল ও ভাইয়ার হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনছে। মনে মনে নিজেকেই শুধাল। কিন্তু উত্তর পেলোনা। যেহেতু নিজের প্রশ্নেরই উত্তর পেলোনা, সেহেতু নিহানের প্রশ্নের উত্তর দেবারও প্রয়োজনবোধ করলনা। তাছাড়া আরেকটা কারনও আছে। ও এখন অব্দি নিহানের হৃৎস্পন্দনের শব্দে নিজের নাম শুনতে পায়নি।
” মন ভালো হয়েছে? নাকি আরেকটু কাঁদবি? ”
” তুমি কিভাবে বুঝলে আমার মন খারাপ? ” নাক টেনে পাল্টা প্রশ্ন করল দৃষ্টি।
” টেলিপ্যাথি বুঝিস? ” আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল নিহান।
মাথা নেড়ে সায় জানাল দৃষ্টি।
” এত বেশি বুঝতে যাস কেন? বাচ্চাদের এত বেশি বুঝতে নেই। এরপর থেকে এত বেশি বুঝতে যাবিনা। মনে থাকবে? ” দৃষ্টিকে সায় জানাতে দেখে এবার ধমকে উঠল নিহান।
এবারও দৃষ্টি মাথা নেড়ে সায় জানাল।
” হঠাৎ করেই বাঘিনী বিড়ালে রুপান্তরিত হয়েছে! ঘটনা কি? ”
” আমাকে একবার বাড়িতে নিয়ে যাবে? ” আবারও প্রশ্ন করল দৃষ্টি।
” তুই কি এখন রাস্তায় আছিস? ”
” আমি আমাদের বাড়িতে যেতে চেয়েছি। ”
” এটা কি তোর বাড়ি নয়? ”
” ধ্যাত্তেরি। আমি বাবার বাড়িতে যেতে চেয়েছি, আহাম্মক। তুই কি আমাকে নিয়ে যাবি? নিয়ে গেলে বল৷ আর যদি না নিয়ে যাস, তবে আমি একাই যাব। ” এবার রেগে গেল দৃষ্টি। নিহানের বুক থেকে মাথা তুলতে চাইল। কিন্তু নিহান ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। আর শক্তির সাথে পেরে ওঠার সাধ্য ওর নেই।
” এই দেখ, স্বামীকে ‘ তুইতোকারি ‘ করছিস কেন! তুই জানিসনা, স্বামীকে ‘ তুই ‘ বলতে নেই? ”
” তুই ভালো করেই জানিস, আমাকে শেখানোর মত কেউ নেই। বাবা-মা মেয়েদের বিয়ের আগে অনেককিছুই শেখায়। আমাকে শেখানোর জন্য বাবা-মা ছিলনা। যদিও একটা বোন আছে। কিন্তু সে কথা বলার চাইতে চুপচাপ থাকতে বেশি পছন্দ করে। তাই আমার কাছ কোন ফর্মালিটি আশা করিসনা তুই। এখন ছাড় আমাকে। ভুল করে নাহয় তোর বুকে হুমড়ি খেয়ে পরেছিলাম। তাই বলে কি এভাবে রেসলারের মত শক্তি দিয়ে ধরে থাকবি আমাকে! যেই সুযোগ পেয়েছে অমনি তার সদব্যবহার করতে শুরু করেছে। ” দৃষ্টি বড়মার ওপরের সব রাগ নিহানের ওপর ঝাড়ছে।
” ঠিক আছে তোর যা ইচ্ছে বলিস আমাকে। কিন্তু তার আগে ‘ রেসলারের মত ধরে রেখেছি ‘ বাক্যটা উইথড্র করে নে। আমি তোকে মোটেও রেসলারের মত শক্তি দিয়ে ধরে নেই। এটা ভালোবাসার শক্তি। ”
” করবনা উইথড্র। তুই কি করবি? ”
” কিছুই করবনা। শত ইচ্ছেকে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি। কারন বাচ্চা মেয়ের সাথে কিছু করতে আমার বিবেকে বাঁধবে। ”
” বারবার ‘ বাচ্চা মেয়ে ‘, ‘ বাচ্চা মেয়ে ‘ বলবিনা। আমার বয়স কত জানিস? ”
” জানি তো। সবেমাত্র পনের বছরের তুই। ”
” আহাম্মক, পনের বছরের মেয়েকে ‘ বাচ্চা ‘ বলে কেউ? ”
” আমি বলি। আমার বউকে আমি ‘ বাচ্চা ‘ বলি আর ‘ বুড়ি ‘ বলি তাতে তোর কি? আমি আমার বউকে আদর করে যা ইচ্ছে ডাকব। ”
নিহানের মুখে ‘ বউ ‘ ডাক শুনে দৃষ্টির হিয়ায় অদ্ভুত এক কাঁপুনি উঠল। কয়েক মুহূর্ত থাকল সেই কাঁপুনি। ঠোঁটের কোন থরথর করে কেঁপে উঠল। সেই ডাকটা এক নিমেষেই দৃষ্টির অনেকদিনের অভিমান গলিয়ে দিল। দৃষ্টি আবেগে আঁকড়ে ধরল নিহানকে।
নিহানও দৃষ্টিকে সাড়া দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। চুমু দিল দৃষ্টির কপালে, চোখে, ঠোঁটে, কপোলে। দৃষ্টি নিহানকে বাঁধা দিলনা, মদির চোখে ও নিহানকে বুঝিয়ে দিল, ও অনুভব করছে সবটা।
” খেয়েছিস? ” হুট করেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল নিহান। ঘোর লাগা গলায় জিজ্ঞেস করল দৃষ্টিকে।
দৃষ্টি মাথা নেড়ে জানাল খায়নি। নিহানের দিকে তাকাতে ওর লজ্জা করছে।
” ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি বিরিয়ানি এনেছি। তাড়াতাড়ি কর, নইলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। ”
” আমি কি ঢাকা থেকে এসেছি যে ফ্রেশ হয়ে আসব! ফ্রেশ হবে তুমি। ”
” কেঁদেকেটে আমি তো আর চোখমুখ ফোলাইনি যে ফ্রেশ হব। কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি যা। ”
দৃষ্টিকে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠাল নিহান। দৃষ্টি ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করতেই নিহান বাহিরের ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখল দৃষ্টি বিছানায় বসে আছে। নিহান দরজা বন্ধ করে এসে ব্যাগ থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট বের করল। এরপর দৃষ্টির হাত ধরে এনে ডিভানে বসালো। তারপর দৃষ্টির হাজারো বারণ স্বত্বেও ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দিল।
” তুমি হুট করে বাসায় আসলে কেন? যাবার সময় বলে গিয়েছিলে দুইমাসের আগে আসবেনা। কিন্তু ফিরে আসলে একমাস পর। ” বিছানায় শুয়ে নিহানকে জিজ্ঞেস করল দৃষ্টি। আজ বিছানাতেই নিহানের জায়গা হয়েছে। ও মেঝেতে শুতে গেলেই দৃষ্টি নিষেধ করে দিয়েছে।
” তোকে দেখতে ইচ্ছে করল, তাই চলে আসলাম। ” নিহান দৃষ্টিকে সত্যি কথাটা বললনা। ও দৃষ্টিকে জানাতেও চায়না, সন্ধ্যায় তাহমিদ ওকে ফোন দিয়ে বলেছিল, দৃষ্টির মন খারাপ। আর কিছুই বলেনি সে। নিহান আর কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। কারন ও জানে দৃষ্টির মন খারাপ একটা কারনেই হতে পারে। ওর মায়ের কারনে। তাহমিদ ফোন রাখতেই নিহান ঐ অবস্থায়ই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। পথিমধ্যে দৃষ্টির জন্য বিরিয়ানি নেয়। কারন ও বুঝতে পেরেছিল, দৃষ্টি না খেয়ে আছে।
” আজকেই হঠাৎ আমাকে দেখতে ইচ্ছে করল! আগে আমাকে দেখতে ইচ্ছে করেনি তোমার? আগেতো ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা লিখতে লিখতে কাগজ ছিঁড়ে ফেলতে। ”
” তুই বললে এখনও কাগজ ছিঁড়তে পারি। আবার তুই চাইলে ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা বলতে বলতে মুখ দিয়ে ফ্যানা তুলব৷ ”
” ভণ্ডামি বাদ দাও। তোমার মুখের ফ্যানা দেখার জন্য তো আমি হাপিত্যেশ করছি। পড়াশোনা শিখছ ভণ্ড হতে? ”
” মন্দ কি। আমি ভণ্ড হলে তুই হবি ভণ্ডের বউ। দু’জনে একসাথে ভণ্ডামি করব। বেশ হবে কিন্তু। ঠিক বলেছিনা, বউ? ”
এবারেও নিহানের মুখে ‘ বউ ‘ ডাক শুনে কেঁপে উঠল দৃষ্টি। এমন মোহনীয় স্বরের ডাক যে কোন নারীর হৃদয় জুড়াতে যথেষ্ট।
হঠাৎই দৃষ্টির কেঁপে ওঠা নিহানের চোখ এড়ালোনা। ওর কেঁপে ওঠার কারন প্রথমে না বুঝলেও দৃষ্টির লজ্জা রাঙা মুখ দেখে কিছুটা ঠাওর করতে পারল নিহান। আর সেটা পরীক্ষা করতেই আবারও ডেকে উঠল,
” আচ্ছা ‘ বউ ‘ বলতো ভালোবাসা কাকে বলে? ”
আবারও কেঁপে উঠল দৃষ্টি। এবার নিহান নিশ্চিত হয়ে গেল। ও দৃষ্টিকে অবাক করে দিয়ে এক ঝটকায় ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। নিহানের এমন কাণ্ডে দৃষ্টি অবাক হয়ে গেল। তবে নিহানের বাহুডোর থেকে নিজের ছাড়ানোর চেষ্টাও করলনা।
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৪
” কত রাত যে আমি ঘুমাইনি, সেটা যদি জানতিস তবে বাসর রাতেই আমার বুকে আসতি। যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি, তোকে ভালোবাসি, সেদিন থেকে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার সব ভালোবাসা তোকে দিয়েছি। নিজের জন্য কিছুই ছিলনা আমার। আজকে একটু শান্তিতে ঘুমাব। দিবি তো আমাকে ঘুমাতে? ”
দৃষ্টি নিহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ওকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরল। নিহান ওর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।