সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৪
জাওয়াদ জামী
” ভাবী, আপনাদের বাসায় সেদিন একটা মেয়েকে দেখলাম। শ্যামলা গায়ের রং মেয়েটির। চেহারায় মায়াবী ভাব। আবার বেশ শান্তও মনে হচ্ছিল। কে মেয়েটি? ” রাশেদীন বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে তাহমিনা আক্তারকে জিজ্ঞেস করল তাদেরই একজন প্রতিবেশি।
” ও কুহু। আমার ননদ রাখীর দেবরের মেয়ে। ”
” মেয়েটা কি পড়াশোনা করে? ”
” বুয়েটে পড়ছে। ”
” ভাবী , আমার ভাইয়ের ছেলেকে বিয়ে করাবো। মেয়েও দেখছি। আপনি মেয়েটার বাবার ফোন নম্বর দিতে পারবেন? মেয়েটাকে আমার মনে ধরেছে। ”
” ওর তো বাবা-মা নেই , ভাবী। কয়েক বছর আগেই মারা গেছে। আপনাকে রাখীর হাজবেন্ডের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ”
” ঠিক আছে, উনার ফোন নম্বর দিন। আমি কথা বলব। ”
তাহমিনা আক্তার ভদ্র মহিলাকে নিয়াজ মাহমুদের নম্বর দিলেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আপনি এখানে? এমন দেখাচ্ছে কেন আপনাকে? ” ক্লান্ত, বিধ্বস্ত তাহমিদকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কুহু। রিক্সা থেকে নামতেই তাহমিদকে ওর বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সত্যিই অবাক হয়েছে কুহু।
” এসো। ” তাহমিদ সোজা নিজের গাড়ির দিকে যায়।
কুহু বুঝল তাহমিদ ওকে গাড়িতে উঠতে বলছে। বাধ্য মেয়ের মত কুহু এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। তাহমিদ ততক্ষণে গাড়িতে উঠে পাশের দরজা খুলে দিয়েছে। কুহু কোন প্রশ্ন না করে গাড়িতে উঠল।
গাড়িতে উঠে কুহু আঁড়চোখে তাকাল তাহমিদের দিকে। লোকটার হাবভাব ওর ভালো লাগছেনা। কিসের এত টেনশন করছে সে?
বাসা থেকে কিছুদূর গিয়ে একটা পার্কে গাড়ি থামাল তাহমিদ। নিজে বেরিয়ে এসে কুহুর পাশে দরজা খুলে দিল। কুহু এবারেও বাধ্য মেয়ের মত গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসল।
ঘাসের ওপর বসে অস্থির হয়ে একের পর এক ঘাসের ডগা ছিঁড়ছে তাহমিদ। কুহু ভ্রু কুঁচকে তাহমিদের কর্মকাণ্ড দেখছে। অনেকক্ষণ নীবর থাকার পর আবারও জিজ্ঞেস করল তাহমিদকে,
” কি হয়েছে আপনার? এমন অস্থির হয়ে আছেন কেন? ”
” তোমার চাচা যদি তোমাকে বিয়ে দিতে চায়, তবে রাজি হবে তুমি? ধর পাত্র বিসিএস ক্যাডার। সনামধন্য কলেজের শিক্ষক। এক্ষেত্রে তোমার মতামত কি হবে? ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুক ধুকপুক করে উঠল। তবে কি ওর বিয়ের কথা চলছে? চাচাও কি রাজি হয়েছে? তাহমিদের প্রশ্নের কি জবাব দেবে কুহু? চাচা যদি ওকে আদেশ করেন তবে কুহু কখনোই তার আদেশ অমান্য করতে পারবেনা। কিন্তু সেক্ষেত্রে এই মানুষটাকে কষ্ট দিতে হবে। যেটা কুহুর পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু চাচার কথা অমান্য করার সাধ্যও যে কুহুর নেই।
এদিকে তাহমিদ উত্তরের আশায় কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কুহু মাথা নিচু করে বসে আছে। কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে মেয়েটা।
অনেকক্ষণ পরও যখন কোন জবাব পেলোনা তাহমিদ, তখন ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল।
” তোমার সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত। এসো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই। ” তাহমিদ সোজা গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কুহুও ওর পিছুপিছু গেল।
” সিক্তার বাবা, তুমি কি নিয়াজের সঙ্গে কথা বলেছিলে? ওরা কুহুর বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলেছে? ” আফরোজা নাজনীন স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন।
” নিয়াজকে কেউ একজন ফোন দিয়েছিল। পাত্রের ডিটেইলস শুনে নিয়াজ তাৎক্ষণিকভাবে না করেনি। আনানকে দিয়ে পাত্র এবং তার পরিবার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে তারপর জানাবে। সবকিছু ভালো হলে নিয়াজ বোধহয় রাজি হবে। এমনটাই মনে হলো ওর কথা শুনে। ”
” তোমার পরিচিত কেউ থাকলে খোঁজ নিতে পাঠাও। বাবা-মা হারা মেয়েকে তো আর যারতার হাতে তুলে দেয়া যায়না। কুহুর মত মেয়ে আজকাল দেখা যায়না। তাই ওর বিয়েও দেখেশুনেই দিতে হবে। ” আফরোজা নাজনীন স্বামীর কথায় সায় জানিয়ে বললেন।
তাহমিদ এতক্ষণ বড় চাচা আর বড়মার কথা শুনছিল। রাগে ওর মাথা ফেটে যাবার উপক্রম হয়েছে। কুহুর বিয়ের কথা আর ও শুনতে চায়না। তাই আগ বাড়িয়ে বলল,
” বড়মা, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”
” কি সিদ্ধান্ত , বাপ? ”
” আমি বিদেশে পড়তে যাবোনা। ”
” কেন? হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলি কেন? ” তাহমিদের একটা কথাই ড্রয়িং রুমের সবাইকে স্তব্ধ করে দিল। তাহমিনা আক্তার কোনোমতে জিজ্ঞেস করলেন।
” হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার কারন তোমরা সৃষ্টি করেছ তাই। ”
” আমরা আবার কি করলাম? ”
” তোমরাই বলছ , কুহুর মত মেয়ে হয়না। আবার সেই তোমরাই ওকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছ! কোথাকার কোন ছেলেকে ওর জামাই বানাতে চাচ্ছ! বাবা-মা হারা মেয়েকে যারতার হাতে তুলে দেবেনা ঠিক আছে। আমি তো আর যে সে নই। আমাকে কি তোমাদের চোখে পরেনা? একটা ভালো মেয়েকে বউ হিসেবে চাইতে পারিনা কি আমি? তোমরা কি ওর মত লক্ষ্মী মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে চাওনা? ”
তাহমিদের কথা শুনে সকলে যারপরনাই অবাক হয়ে গেছেন। তাহমিনা আক্তার হা করে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আফরোজা নাজনীনও তাই। একমাত্র সাদিক আহমেদ রাশেদীন ব্যাতিক্রম। তিনি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন,
” বড়দের সামনে নিজের বিয়ের কথা বলতে লজ্জা করছেনা তোমার? লজ্জাশরম কি মেডিকেলে রেখে এসেছ? নির্লজ্জ ছেলে একটা। সামান্য বিয়ের জন্য বিদেশে পড়তে যাবেনা! ”
” তোমরা আমার কলিজা টেনে ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম করছ আর আমি নিরবে তোমাদের তামাশা দেখব এটা কি করে হয়? এতদিন যাকে দেখেশুনে রাখলাম তাকে কি করে অন্যের হতে দেই বল? তোমরা আমাকে যতই নির্লজ্জ বল, এতে আমার কিছুই যায় আসেনা। আমার একটাই কথা, কুহুকে আমার চাই। ওকে যদি অন্য কোথাও বিয়ে দেয়ার চেষ্টা কর তবে আমি ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। ”
” আফরোজা, তাহমিনা, তোমরা শুনছ , এই বেয়াদব কি বলছে? কোন ডক্টরের মুখের ভাষা এমন হতে পারে সেটা এই বেয়াদবকে না দেখলে জানতামনা। কি ছেলে জন্মেছে আমাদের পরিবারে? একদম উৎকৃষ্ট মানের বেয়াদব। যার ভেতর কোন ভেজাল নেই। ”
” বড়মা, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে মেজাজ খারাপ করতে চাইনা আমি। তোমাদের মতামত জানতে চাইছি। তোমরা কি কুহুকে আমার বউ হিসেবে মানবে? অবশ্য না মানলেও কোন সমস্যা নেই। বিয়ে আমি ওকেই করব। ”
” বাপ! এই ছিল তোর মনে? কুহু মাকে তোর পছন্দ সেটা আমাদের আগে বলিসনি কেন? ”
” সেই সুযোগ কি আগে এসেছিল যে বলব! এখন সুযোগ এসেছে তাই বললাম। ”
” বিয়ের পর কি বিদেশে যাবি? ”
” নাহ্। বউকে ছেড়ে কোথায় গিয়ে থাকতে পারবনা আমি। ”
” তাহলে বিদেশ থেকে এসেই বিয়েটা কর? ”
” না বড়মা, এটা করতে পারবনা। ঐ মেয়েকে নিয়ে কোন রিস্ক আমি নিতে চাইনা। ওকে আমার চেনা হয়ে গেছে। চাচার কথা ফেলতে পারবেনা ও। তোমাদের কথা রাখতেই দেখা যাবে অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাবে। টেনশন করতে করতে দেখা যাবে আমিই পটল ক্ষেতে চলে যাব। এমন টেনশন নিয়ে আর যাইহোক পড়াশোনা করা যায়না। ”
” তাহলে কি বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল? ”
” একবারে আমার বউয়ের পড়াশোনা শেষ হলে ওকে নিয়ে যাব। ”
” তাহমিনা, তাহলে আর কি তোর ছেলের বউ নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর। আমাদের আদরের কুহু মাকে পুত্রবধূ হিসেবে বরণের ব্যবস্থা কর। ”
” ভাবী, আমি এতদিন কাউকে বলার সাহস পাইনি। মনে মনে আমি কুহুকেই ছেলের বউ হিসেবে চেয়েছি। আপনি আম্মার সঙ্গে কথা বলুন। ”
” আমি সেই অনেক আগে থেকেই রাজি , বউমা। তোমরা বিয়ের আয়োজন কর। নিয়াজকে ফোন দাও। প্রয়োজনে ওকে প্লেনে আসতে বল। ”
কুহু স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ওর পাশে বসে সিক্তা ওকে খোঁচাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আনান এসে হা-হুতাশ করছে। একবার তো নিহান এসে ওকে ‘ ভাবী ‘ বলে ডেকেছে। কুহুর এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা তাহমিদ নামক মানুষটার সঙ্গে ও আজীবনের মত জড়িয়ে গেছে। ওর এখন একটাই পরিচয় আর সেটা হলো ‘ তাহমিদের বউ ‘। কিন্তু যাকে ঘিরে এতকিছু সেই মানুষটা কোথায়? বিয়ের দুইঘণ্টা পেরিয়ে গেছে কিন্তু তার দেখা নেই। কোথায় গেছে সে?
” কোকিলা রে, তোকে নাকি এবার থেকে ‘ ভাবী ‘ বলে ডাকতে হবে! এটা ঐ হিটলারের আদেশ। তোকে নাকি আর নাম ধরে ডাকা যাবেনা! বইন রে, তুইই বল, বড় ভাই হয়ে তোকে ‘ ভাবী ‘ডাকতে আমার লজ্জা করবেনা? তুই একটু ঐ স্বৈরাচারকে বোঝাস। বাসা থেকে বেড়োনোর আগেই আমাকে বলে গেছে তোকে ‘ ভাবী ‘ ডাকতে আর ‘ তুমি ‘ করে বলতে। ” অসহায় মুখে বলল আনান।
আনানের কথায় লজ্জা পেলো কুহু। সেই সঙ্গে ঐ মানুষটার ওপরও রাগ হচ্ছে। সে ইচ্ছে করেই আনান ভাইয়াকে বিপদে ফেলে এটা বোঝে কুহু।
” আমাকে আগে যেভাবে ডাকতে সেভাবেই ডেকো, ভাইয়া। কারও কথা শুনে সম্মোধন পাল্টাতে হবেনা তোমাকে। ”
” কারও কথা শুনে বলছিস? ঐ ব্যক্তি নিজেকে আমেরিকা মনে করে। সে ভাবে তার কথাই আইন। বাহিরে যাওয়ার আগে আমাকে যেভাবে হুমকিধামকি দিয়েছে তাতে আমার ভয় হচ্ছে। সে যদি এসে দেখে আমি সম্মোধন পাল্টাইনি তখন নির্ঘাত আমার কান মলে দেবে। ”
” এত ভয় পাচ্ছ কেন, ভাইয়া! তুমি তাকে বলবে, সে যেন তোমাকে ‘ ভাইয়া ‘ ডাকে। কারন তুমি আমার বড় ভাই। এতটুকু সম্মান তার কাছে পাও তুমি। ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৩
” উফ্ বাঁচালি আমাকে। আজকে আসুক সেই স্বৈরাচার, আমি তাকে বুঝিয়ে দেব আমিও কম নই। সে আমাকে সম্মান করবেনা? আমাকে সম্মান করতে বাধ্য সে। ”
আনানের ভাবভঙ্গি দেখে সিক্তা হেসে বিছানায় লুটিয়ে পরল। কুহুও হাসছে মিটিমিটি।