সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৬

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৬
জাওয়াদ জামী

” বাহ্ রে কুহু, তোরা দুই বোন এক্কেবারে দান মেরে দিয়েছিস। ছোটবোনকে আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে, নিজে আমার ভাইয়ের ছেলের গলায় ঝুলে পরেছিস। যখনই চিন্তা করে দেখেছিস, বাপ-মা নেই , বিয়েশাদী হবে কিভাবে? বাকি জীবন কিভাবে কাটাবি? তখনই কুবুদ্ধি এসেছে মনে। আর তখনই বুদ্ধি এঁটেছিস, কিভাবে একটা ভালো ছেলে খোঁজ করে তার গলায় ঝুলে পরা যায়। ছেলে পেয়েও গেলি। প্রথম বলির পাঁঠা হলো নিহান, আর দ্বিতীয় বলির পাঁঠা হলো তাহমিদ। তোর বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হচ্ছে। ” তাহমিদের রুমে এসে কুহুকে কথাগুলো শুনিয়ে দিল রাখী আক্তার।

কুহু অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল বড়মার দিকে। বড়মা জেনে-বুঝেই ওকে কথা শোনাচ্ছে এটা বুঝতে বাকি রইলনা কুহুর। বড়মার কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছেনা কুহুর। এদিকে কুহুকে নিরব থাকতে দেখে উৎসাহ পেল রাখী আক্তার। সে ভাবল, কুহু তার কথায় ভয় পেয়েছে। তাই সে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আবারও বলল ,
” চুপ করে আছিস কেন? তোর বাপ-মা এতো চালাক ছিলনা তোর মত। নাকি তারা তোকে শিখিয়ে-পরিয়ে দিয়েছিল আগে থেকেই? তোর মাকে দেখে কখনো মনে হয়নি, সে এত সেয়ানা ছিল। এবার বুঝতে পেরেছি, নিজে বাপের বাড়ির সম্পত্তি পায়নি বলে তোর মা মেয়েদের দিয়ে ব্যবসা করাতে চেয়েছিল। তাই আগেভাগেই তোকে শিখিয়ে দিয়েছিল সবকিছু। ধন্যি মায়ের ধন্যি মেয়ে তোরা। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বড়মার কথা শুনে কুহুর যতটা না রাগ হলো, তার থেকে বেশি ভয় ফুটল ওর চোখে। ওর চোখ তখন সেঁটে আছে দরজার দিকে। দরজার বাহিরে দাঁড়ানো নিহান আর তাহমিদকে ভয়ে ভয়ে দেখছে কুহু।
” বড়মা, থাকনা এসব কথা। ”

” কেন? থাকবে কেন? আমার কথা শুনতে ভালো লাগছেনা নাকি তোর? আর ভালো লাগবেই বা কেন! কলিজা ধরে টান দিয়েছি যে। তোকে দেখে কে বলবে, ভেতরে ভেতরে এত সেয়ানা তুই। চেহারার তো ঐ ছিড়ি। একটু পড়াশোনা করছে তাতেই আমার অমন রাজপুত্রের মত ভাতিজার দিকে হাত বাড়িয়েছিস। চেহারা ভালো হলে বোধহয় প্রধানমন্ত্রীর ছেলের দিকে হাত বাড়াতিস। আর তোর বোনের কথা আর কি বলব! সে তো আরেক জিনিস। গায়ের চামড়া সাদা, তাই নিজেকে বিশ্ব সুন্দরী মনে করে। অতটুকু মেয়ের কি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা! আমার ছেলেকে আঙ্গুলে নাচাচ্ছে। আর আমার বোকা ছেলেও দৃষ্টি, দৃষ্টি করে পাগল। দৃষ্টি ছাড়া তার চোখ অন্য কোথাও যায়না। কতটা দুর্ভাগ্য হলে মানুষের কপালে এমন ছেলের বউ জোটে। ”

কুহু এবার ভয়ে ঢোক গিলল। দরজার দিকে পেছন ফিরে বসে আছে রাখী আক্তার। তাই সে তাহমিদ আর নিহানকে দেখতে পায়নি। ওদেরকে দেখতে পেল সে বুঝতে পারত, ওরা দু’জন রাগে গজগজ করছে। তাহমিদের চেহারা রাগে পাল্টে গেছে। নিহানেরও তাই।
” ব..বড়মা, তুমি এবার দিদুনের কাছে যাও।দিদুনের হয়তো তোমাকে প্রয়োজন। ”
” কালকেই বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে এসে, আজকেই আমাকে রুম থেকে বের হরে দিচ্ছিস! এতবড় সাহস তোর? কোথায় পেয়েছিস এমন সাহস? ”

” কেন তুমি ওকে সাহস জুগিয়েছ। তোমার কথার যে ধার, তাতে বাড়ির মেয়ে-বউরা এমনিতেই সাহস পেয়ে যাবে। আবার তারা নিজেকে একটা বাড়ির সর্বেসর্বাও মনে করতে পারে। এই যে যেমন ধর, তোমাকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলল ৷ এটার কৃতিত্ব কিন্তু সম্পূর্ণই তোমার। তুমিই ওকে সেই সাহসটা দিয়েছ । নয়তো তুমি এই বাড়ির বহিরাগত হয়ে আমার বউকে এমন নিকৃষ্টভাবে অপমান করতে পারতেনা। ” হাসিমুখে কথাগুলো বলতে বলতে রুমে ঢুকল তাহমিদ।

তাহমিদের গলা শুনে ভয়ে আত্না খাঁচা ছাড়ার জোগাড় হয়েছিল রাখী আক্তারের। তার আত্নাটা এবার যেন সত্যিই উড়াল দিল। সেটা তাকে স্থবির হয়ে বসে থাকতে দেখেই বোঝা গেল। যখন সে দেখল তাহমিদের সঙ্গে নিহানও আছে। নিহানের চোখে ঝরে পড়া ঘৃণা দেখে রাখী আক্তার ভয়ে কাঁপতে লাগল।
” ত..তোরা! ” রাখী আক্তার আর কি বলবে বুঝতে পারলনা।

” চমকে গেছ আমাদের দেখে? তাহলে আরেক বার চমকানোর জন্য তৈরী হও। আজকের পর থেকে তোমার বাবার বাড়িতে আসলে তুমি দোতলায় আসবেনা। এবং আমার সামনে তো আসবেই না। আর আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাও করবেনা। কারন তোমাকে দেখলেই আজকের কথাগুলো মনে পরবে আমার। আমি আমার মাকে বলে দেব তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে। বড়মা কি করবে, সেটা তার ব্যাপার। সরি রে নিহান, তোকে কষ্ট দেয়ার জন্য। এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা। আমার স্ত্রীকে অপমানকারীকে তার প্রাপ্য শাস্তি না দিলে, তবে আমি কেমন স্বামী হলাম? ”

” তোমার দিক থেকে তুমি সঠিক আছ , ভাই। আর আমিও এবারে সঠিক কাজটাই করতে চাই। তোমার ফুপুকে জানিয়ে দিতে চাই, আমার একটা চাকরি হয়েছে। আমি দুই-এক দিনের মধ্যেই নতুন বাসা দেখে দৃষ্টিকে নিয়ে সেখানে উঠব। সে আমার মা সেটা অস্বীকার করার সাধ্য আমার নেই। আমি তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছ্যেদ করবনা। কিন্তু তার সঙ্গে কোনদিন কথাও বলবনা। আমি বাড়িতে যাব শুধুমাত্র আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে। আমি প্রতিমাসেই আব্বুর কাছে হাতখরচ পাঠিয়ে দেব। নয়তো তোমার ফুপু দৃষ্টির নামে মিথ্যা অপবাদ রটাবে। ওকে সবকিছুর জন্য দায়ী করবে। সেটা আমি হতে দেবোনা। আজকের বলা তোমার ফুপুর কথাগুলো রেকর্ড করেছি আমি। সেটাই এখন বড় মামাকে দেখাবো। মামারা আর দিদুন মিলেই এরপর কি হবে সেই সিদ্ধান্ত নেবে। এতদিন আমি সবকিছু জানার পরও মুখ বন্ধ করে ছিলাম। কিন্তু আর নয়। প্রতিবারই কেন দৃষ্টি, কুহুর ওপর এতটা অপবাদ আসবে? এর একটা বিহিত করতেই হবে। কুহু, আমি সবকিছুর জন্য সরি। পারলে এই অযোগ্য ভাইকে ক্ষমা করে দিস। ” তাহমিদের কথার প্রত্তুত্যরে নিহান কথাগুলো বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

সবকিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল রাখী আক্তার। তার ঘোর ভাঙ্গার আগেই সাদিক আহমেদ রাশেদীন এবং আয়েশা সালেহার কানে কথাগুলো পৌঁছে গেল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই এর খেসারত দিতে হবে রাখী আক্তারকে।

” ছিহ্ আমার পেটের সন্তান এতটা জঘন্য এটা আমি কল্পনাও করিনি কখনো। এই মেয়েকে এতবার করে সাবধান করার পরও নিজেকে বদলায়নি একটুও। ওকে নিয়ে আমাদের শুধু হেনস্তাই হতে হয়েছে। একটা দিনও আমাদের শান্তিতে থাকতে দেয়নি। আর না এখন দিচ্ছে। একে মেয়ে বলে পরিচয় দিতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। ” আয়েশা সালেহা ঘৃণাভরে ছেলেদের বললেন।
সাদিক আহমেদ রাশেদীন নতমুখে আম্মার কথাগুলো শুনছেন। সাবির আহমেদ রাশেদীনও তাই। আফরোজা নাজনীন, তাহমিনা আক্তারও নিরব থাকলেন। তারা সকলেই আজকে রাখী আক্তারের কর্মকাণ্ডের কথা শুনে অবাক হয়েছেন।

” আম্মা, একটা কথা বলি অপরাধ নেবেন না। রাখী একদম আমার শ্বশুরের বড় বোনের মত হয়েছে। ঐ ফুপু দিনরাত সবাইকে অপমান করার চিন্তা করত, আর সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক নষ্ট করার চিন্তা করত। একটা ফালতু মহিলা ছিল সে। রাখীর স্বভাবচরিত্র একদম ঐ ফুপুর মতই হয়েছে। ঐ ফুপু যেমন আপনাকে আবার তার ছেলের বউদের শান্তিতে থাকতে দেয়নি। আপনার মেয়েও তেমনি কাউকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেনা। না শান্তি দিয়েছে শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে, আবার না শান্তি দিচ্ছে ছেলের বউকে। একই সঙ্গে সে আমাদের বাড়ির বউকেও অপমান করছে। কতবড় সাহস ওর একবারও ভেবে দেখেছেন, আম্মা? আমরা যাকে পছন্দ করে ছেলের বউ করে আনলাম, তাকেই সে অপমান করছে! ” বড় দুই জা’কে নিরব থাকতে দেখে ফুঁসে উঠলেন নাজমা আক্তার। তিনি কাউকে পরোয়া না করেই কথাগুলো বললেন।

নাজমা আক্তারের কথাগুলো শুনে আয়েশা সালেহার চোখে পানি আসল। রাখীর বিয়ের পর থেকেই তিনি তার শ্বশুর বাড়িতে যাননি লজ্জায়। তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি কখনোই রাখীর নামে অভিযোগ দেননি। কিন্তু রাখীর করা আচরণের কথা ঠিকই পৌঁছাত আয়েশা সালেহার কানে। নিয়াজের চাচাতো ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি আয়েশা সালেহার বাবার বাড়ির পাশে। সেই চাচাতো ভাইয়ের বউয়ের মাধ্যমেই রাখীর সকল কথাই শুনতে পেতেন আয়েশা সালেহা। তিনি বারবার মেয়েকে সাবধান করেছেন কিন্তু রাখী তার কথা আমলেই নেয়নি। আজ প্রথমবারের মতো নিজেকে একজন ব্যর্থ মা মনে হচ্ছে বৃদ্ধার। তিনি নাজমা আক্তারের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস করতে পারলেন না। নতমুখেই বললেন,

” বউমা, তোমরা চাইলে রাখীকে চিরতরে এই বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারো। সন্তানের খাতা থেকে ওর নাম আজকে কেটে দিলাম আমি। দরকার নেই আমার তার মত সন্তান। তবে তোমাদের কাছে একটাই অনুরোধ, তোমরা নিয়াজকে এসব কথা এখনই জানিওনা। সে অসুস্থ। এসব শুনলে হয়তো তাকে আমরা হারিয়ে ফেলব। ”
” বের করে দেয়া কোন সমাধান নয়, আম্মা। রাখীকে এই বাড়ি থেকে বের না করেও আমরা ওকে একটা শিক্ষা দিতে পারি। ও এই বাড়ির মেয়ে। এখানে ওর অধিকার আছে। আপনি এখন ওকে এখানে ডেকে পাঠান। ওকে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে বলুন। এবং ওকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করান, ভবিষ্যতে এমন কিছু করলে ওকে আইনত ত্যাগ করবেন আপনি। তবেই দেখবেন ও ঠিক হবে। ওর একটা শক্ত শাস্তির প্রয়োজন। ” নাজমা আক্তার শ্বাশুড়িকে শুধরে দিয়ে বললেন।

” নাজমা ঠিকই বলেছে, আম্মা। ওর শাস্তির প্রয়োজন। আমরা যদি ওকে আগেই শাস্তি দিতাম তবে ও এতটা বাড়তে পারতনা। ওর এমন আচরণের জন্য দায়ী আমরা। আমরাই ওকে শাসন করতে পারিনি। তবে আজকে সেই ভুল করবনা। আজকে ওকে শাস্তি পেতেই হবে। ” সাদিক আহমেদ রাশেদীন এবার বললেন।
” ছোট বউমা, রাখীকে ডেকে নিয়ে এস। ”

” দিদুন, তোমরা তোমার মেয়েকে নিয়ে যা খুশি কর। আমার কোন আপত্তি নেই। তবে তার তোমাদেরকে একটা কথা জানিয়ে দেই। আগামী তিনদিনের মধ্যেই আমি দৃষ্টিকে নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠব। কুহু যেই ফ্ল্যাটে থাকত সেটা তো এখন থেকে ফাঁকাই থাকবে। আমি ঐ ফ্ল্যাটেই উঠতে চাই। যেহেতু একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে , সেহেতু আলাদা ফ্ল্যাটে বউ রাখার সামর্থ হয়েছে আমার। আমি আর তোমার মেয়ের কাছে দৃষ্টিকে রাখতে চাইনা। ”
” নিহান, তোমরা চাইলে এখানেই থাকতে পারবে। কেন অযথা অন্য ফ্ল্যাটে যেতে চাচ্ছ? এখানে থাকলে অন্তত ফ্ল্যাট ভাড়া বাঁচবে তোমার। আরও অনেক খরচই বাঁচবে। নানু ভাই, এখানেই থাক দৃষ্টি সোনাকে নিয়ে। তোমার মায়ের জন্য আমাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করোনা তুমি। ” অনুনয় ঝরল বৃদ্ধার গলায়
দিদুনের কথা শুনে তার দিকে এগিয়ে গেল নিহান। হাঁটু গেড়ে বসল দিদুনের কাছে। কারত গলায় বলল,

” এমন কথা বলোনা , দিদুন। তোমাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার কথা ভাবতেই পারিনা আমি। আমি শুধু দৃষ্টিকে নিরাপত্তা দিতে চাই। এখানে থাকলে আম্মুর মনে অহংকার থেকেই যাবে। সে ভাববে, আমি তোমাদের ছাড়া অচল। এর প্রভাব দৃষ্টির ওপর পরবে। ওকে সারাজীবন আম্মুর কাছে ছোট হয়ে থাকতে হবে। আমি সেটা চাইনা, দিদুন। ”
” ঠিক আছে, তাহমিদ দাদু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে কুহুর ফ্ল্যাটে ওঠার ব্যবস্থা কর। তবে আমাকে তোমার কথা দিতে হবে, প্রতি সপ্তাহে আমার কাছে আসবে তুমি। আসবে তো? ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৫

” আসব, দিদুন। তোমরা ছাড়া দৃষ্টির আর কে আছে বল? আমার আর কে আছে বল? ” নিহান হঠাৎই কেঁদে ফেলল।
নিহানকে কাঁদতে দেখে সকলের চোখের কোনে পানি জমল। কতটা কষ্ট পেলে একটা ছেলে কাঁদতে পারে সেটা ভেবেই সকলে নিহানকে বুকে টেনে নিল।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৭