সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৭
জাওয়াদ জামী
” একটা কথা বলব, রাগ করবেন না তো? ” কুহু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।
কুহুর ভীতু চোখ দেখে তাহমিদ থমকায়। বুকে জড়িয়ে নেয় তার ভীতু হরিণীকে। গলায় আবেগ ঢেলে বলল,
” আমাকে কিছু বলতে চাইলে কখনো অনুমতি নেবেনা। যখন যেটা বলার প্রয়োজন সোজাসাপটা বলে দেবে। আমাদের সম্পর্ক এখন আর কোন অনুমতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অনুমতি চেয়ে আমাদের সম্পর্ককে কখনোই ছোট করবেনা। মনে থাকবে , বউ? ”
” থাকবে। ” তাহমিদের মুখে ‘ বউ ‘ ডাক শুনলে কুহুর বুকের ভেতর ছলকে উঠে। খুশিতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে।
” এবার বলুন মহারানী, কি বলতে চান? ” তাহমিদ টুপ করে কুহুর গালে চুমু দিয়ে বলল।
কুহু তাহমিদের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কিছুক্ষণ নিরব থাকল। ও কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। খানিকক্ষণ পর ধীর গলায় বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আমরা সবাই জানি বড়মা কেমন। তাই বলে তাকে আমরা দূরে সরিয়ে দিতে পারিনা। আপনারা বড়মাকে দূরে সরিয়ে দেবেন না। শুনলাম দিদুন নাকি বড়মাকে ত্যাগ করতে চান। এটা তাকে করতে দেবেন না। গতকাল থেকে বড়মা ভিষণ কষ্ট পাচ্ছে। আর তাছাড়া চাচার কানে যদি এসব কথা যায়, তবে চাচা বড়মাকে হয়তো ছেড়েই দেবে। হয়তো বলছি কেন? সত্যিই চাচা বড়মাকে ছেড়ে দেবে। আবার আমরা হয়তো চাচাকেও হারিয়ে ফেলব। বড়মার কালকের আচরণের কথা শুনলে চাচা সত্যিই বাঁচবেন না। সে লজ্জায়-অপমানেই মরে যাবে। বাবা-মাকে হারিয়ে আমরা তিন ভাইবোন চাচাকে আঁকড়ে ধরেছি।
সেই চাচাও যদি আমাদের ছেড়ে চলে যায়, তবে আমরা কিভাবে থাকব বলুন? আরেকটা কথা ভাবুন একবার, আনান ভাইয়ার পড়াশোনা এখনো শেষ হয়নি। নিজের পরিবারের মধ্যে অশান্তি থাকলে যে কেউই পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারবেনা। আনান ভাইয়াও তাই। আমাদের একটা ভুল সিদ্ধান্তে হয়তো ভাইয়ার জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। আবার দৃষ্টির কথাটা একবার ভাবুন। নিহান ভাইয়া আলাদা ফ্ল্যাটে চলে যেতে চায়। এরজন্য লোকজন দৃষ্টিকেই দায়ী করবে। এসবকিছুর সমাধান আপনার হাতেই আছে। আপনি দিদুনকে বললে দিদুন আপনার কথা ফেলতে পারবেননা। বাড়ির প্রত্যেকেই আপনার কথা শোনে। আপনি তাদেরকে বলুন, বড়মাকে ক্ষমা করে দিতে। প্লিজ, বড়মার সংসার ভেঙে যেতে দেবেন না। ” কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
কুহুকে কাঁদতে দেখে হকচকিয়ে গেল তাহমিদ। কুহুকে শক্ত করে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিল।
” কেঁদোনা, জান পাখি। তোমার চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারছিনা। আমি দিদুনকে বলব। আজকেই বলব। এবার কান্না থামাও। ”
কুহু কান্না থামিয়ে চোখ বন্ধ করে তাহমিদের বুকেই আছে। ওর গতকাল থেকে সত্যিই ভয় হচ্ছিল। আনান ভাইয়া কষ্ট পাচ্ছে। অথচ সে কাউকে কিচ্ছুটি বুঝতে দিচ্ছেনা। সেটা কুহুর জন্য আরও চিন্তার। হয়তো আনান ভাইয়া কাউকে কোন কিছুই বলবেনা। কিন্তু তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দেবে। যেটা কুহু সহ্য করতে পারবেনা।
” বউ, আমি দিদুনকে বলে সবকিছু ঠিক করে দেব। কিন্তু নিহানের সিদ্ধান্তকে অসম্মান করতে পারবনা। ওকে নতুন ফ্ল্যাটে যেতে বাঁধা দেবোনা। বাঁধা দেয়া আমার উচিতও হবেনা। আবার ফুপুকেও বোঝাতে হবে, সে অন্যায় করেছে। নিহান কিছুদিন ফুপুর থেকে দূরে থাকলেই ফুপু নিজের ভুল বুঝতে পারবে। দৃষ্টিকে মন থেকে মেনেও নেবে। তোমার কথা রাখতে আমি সবকিছুই করব কিন্তু এর মাঝে ফুপুকে শাস্তিও পেতে হবে। ”
তাহমিদের কথায় কুহু আশাহত চোখে তাকালে মেটা তাহমিদের নজরে পরে গেল। তাই তাহমিদ আবারও কথা বলল।
” মন খারাপ করছ? আমার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা কর। প্রমান থাকার পরও এবার যদি আমরা ফুপুকে ছেড়ে দেই, তবে ফুপু ভবিষ্যতে তোমাদের সঙ্গে আরও খারাপ কিছু যে করবেনা তার নিশ্চয়তা দিতে পারবেনা কেউই। তোমার কথা না-হয় বাদ দিলাম। দৃষ্টির কথা চিন্তা কর। তুমি আমার কাছে থাকবে কিন্তু দৃষ্টি? ওকে তো সেই ফুপুর সংসারে গিয়েই থাকতে হবে। তখন যদি ফুপু দৃষ্টির কোন ক্ষতি করে দেয়? তুমি পারবে আটকাতে? তাই ফুপুর শাস্তির প্রয়োজন আছে। তবে ফুপা কিছুই না জানিয়ে যা করার করতে হবে। ”
এবার কুহুর বোধদয় হলো। ও তাহমিদের কথায সায় জানালো।
” আচ্ছা ফুপু , তুমি কি জীবনেও বদলাবেনা? কিভাবে পারলে এতিম মেয়ে দুটোকে ঐ কথাগুলো বলতে? তার ওপর একজন তোমার ছেলের বউ, আরেকজন তোমার ভাইয়ের ছেলের বউ। দু’জনেই তোমার আপন। ছেলেদের বউ হওয়ার আগে ওরা তোমার দেবরের মেয়ে। তোমার দেবর বেঁচে থাকতে তার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কিন্তু খারাপ ছিলনা। তবে এখন কেন ওদের অবহেলা কর? তুমি কি ভেবেছিলে, নিহান সারাজীবন তোমার বাধ্য ছেলে ছিল বলে, বিয়ের পরও সেরকমই থাকবে? এটা ভেবে থাকলে ভুল করেছ তুমি। নিহানের চোখে দৃষ্টির জন্য ভালোবাসা দেখেছি আমি। আর সেই ভালোবাসার জন্য তোমাকে ছাড়তে দু বারও ভাববেনা সে, এটাও বুঝতে পেরেছিলাম। আর সেটা কালকেই প্রমানও হয়ে গেল। ওর চোখে তুমি নিজেকে নিচে নামিয়ে ফেলেছ , এটা কি বুঝতে পারছ ? তোমার আবার নিহানের চোখে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে, নিজেকে ওর প্রিয় করে তুলতে, নিজের যোগ্যতা প্রমান করতে কতটা কষ্ট করতে হবে জানো?
আমি তোমার ছোট হয়েও যদি এতকিছু বুঝতে পারি, তবে তুমি কেন বোঝনা, ফুপু? তুমি আমাদের একটাই ফুপু , তোমাকে কেন আমরা বোঝাতে আসব? উল্টো তুমিই আমাদের০ সংসারের নিয়মকানুন শেখাবে। কিন্তু সেটা তুমি কখনোই করোনি। বরং আমরাই সবসময় তোমাকে নিয়ে চিন্তায় থেকেছি। বাড়ির সবাই তোমার এমন কর্মাকাণ্ডে কতটা কষ্ট পাচ্ছে জানো? দিদুনের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। এই বয়সে দিদুন এতবড় আঘাত কিভাবে সামাল দেবে ভেবে পাচ্ছিনা আমরা। তুমি যে কুহুকে কথাগুলো বলেছ , সেটাকে চাচা-চাচী, তাহমিদ কিভাবে নেবে সেটা কেন ভাবলেনা , ফুপু? চাচী লজ্জায় কুহুর সামনে যেতে পারছেনা। যে চাচী তোমাকে নিজের বোনের আসন দিয়েছিল, তার ছেলের বউকে কেন তুমি অপমান করলে , ফুপু? ”
একে একে অনেকগুলো প্রশ্ন রাখী আক্তারকে করল দ্যুতি। ওর পাশে সুপ্তি মন খারাপ করে বসে আছে। ফুপুর এই ধরনের কথাবার্তা শুনে ও খুব কষ্ট পেয়েছে। তবে মায়ের মত সহনশীল হওয়ায় ফুপুকে কিছুই বললনা। কিন্তু দ্যুতি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ওকে দেখে কেউই বলবেনা ও আফরোজা নাজনীনের মেয়ে। বাবার বাড়িতে থাকতেও সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে ও। শ্বশুর বাড়িতেও সেটাই করে। কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়না। দ্যুতির কথাগুলো শুনে মাথা নিচু করল রাখী আক্তার। তার কাছে দ্যুতির প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।
” কথা বলছনা কেন , ফুপু? যখন কুহুর বাবা-মার টাকা ছিল, ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি ছিল, তখন তো তাদের প্রশংসা করে মুখ দিয়ে ফেনা তুলতে। যেই তারা মরে গেল, তাদের সবকিছু কুহুর বাবার ব্যবসায়িক পার্টনার নিজের নামে করে নিল, তখন ওরা তোমার কাছে খারাপ হয়ে গেল? টাকাই কি সব? কক্ষণো না। টাকা কখনো মানুষকে মাপার চাবিকাঠি হতে পারেনা। তুমি যে অর্থ সম্পদের বড়াই করো, সেটাও কিন্তু চিরস্থায়ী নয় , ফুপু। অর্থ কখনোই চিরস্থায়ী হয়না। তাই আবারও বলছি নিজেকে শোধরাও। এবং সেটা তোমার নিজের ভালোর জন্য। তোমার কাছে তোমার ছেলেরা যতটা প্রিয়, ঠিক তেমনি ওদের কাছে ওদের বউরাও ততটাই আপন। ওরা যেমন তোমাকে আঁকড়ে বাঁচতে চায়, ঠিক তেমনি নিজের স্ত্রীর সম্মান রক্ষার্থে পুরো দুনিয়ার বিপক্ষেও যেতে পারে। তাই ছেলেদের অবহেলা পেতে না চাইলে নিজের আমূল পরিবর্তন কর। দেখবে ওরা তোমাকে মাথায় তুলে রাখবে। তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারবেনা। ” রাখী আক্তারকে চুপচাপ থাকতে দেখে আবারও কথাগুলো বলল দ্যুতি। দ্যুতির কথা শুনে এবার কেঁদে ফেলল রাখী আক্তার। কিছুই বললনা সে।
” শোন রাখী , কুহুর অনুরোধে তোমাকে এই বাড়িতে আসবার অনুমতি দিয়েছি আমরা। নয়তো আমি চেয়েছিলাম এই বাড়িতে যেন তোমার পা কোনদিনও না পরে। আমি মনে করি, তোমার মত মেয়েকে পেটে ধরে আমার গর্ভ দূষিত হয়ে গেছে। এই দূষিত গর্ভকে শোধন করবার একটাই উপায় তোমাকে ত্যাগ করা। যেটা করতে রাজি ছিলাম আমি। কিন্তু কুহু সবকিছু ওলট-পালট করে দিল। সে চায়না তোমাকে ত্যাগ করি আমি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি , তোমার সঙ্গে আমরা সম্পর্ক রাখব ঠিকই কিন্তু তুমি আমাকে ‘ আম্মা ‘ বলে ডাকতে পারবেনা। তোমার মত সন্তানের মুখে ‘ আম্মা ‘ ডাক শুনে মরতে চাইনা আমি। আর হ্যাঁ, নিহান দৃষ্টিকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকবে। ওর ইচ্ছে হলে ও তোমাদের বাসায় যাবে , ইচ্ছে না হলে যাবেনা ৷ তুমি ওকে জোর করতে পারবেনা। কারন সেই অধিকার হারিয়েছ তুমি। আমার কথা শেষ হয়েছে এবার তুমি যেতে পার। ” আয়েশা সালেহা কঠোর গলায় কথাগুলো বললেন।
” আম্মা , এত কঠিন শাস্তি আমাকে দেবেন না। আমি ভুল করেছি, আম্মা। প্রয়োজনে আমি দৃষ্টি , কুহু দু’জনের কাছেই ক্ষমা চাইব। আপনি বললে ওদের পা ধরে ক্ষমা চাইব আমি। তবুও আমাকে ‘ আম্মা ‘ ডাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেননা। ” হাউমাউ করে কেঁদে উঠল রাখী আক্তার।
” ওরা দু বোন তো আর তোমার মত নয়। তুমি ক্ষমা না চাইতেই ওরা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। নয়তো কুহু তোমার হয়ে সুপারিশ করতনা। তাই বলছি কি, অযথাই ওদের কাছে ক্ষমা চাইতে যেওনা। তুমি ওদের পায়ে মাথা ঠুকে মরলেও আমাকে ‘ আম্মা ‘ ডাকার অধিকার তোমাকে দেবোনা। শেষবারের মত বলছি, আমাকে ‘ আম্মা ‘ ডেকে নিজের পায়ে কুড়াল মেরোনা। কারন তোমার মুখে ‘ আম্মা ‘ ডাক শুনে আমার রাগ হলে তোমাকে চিরতরে এই বাড়িতে আসতে নিষেধ করতে পারি।
সেটা নিশ্চয়ই তোমার জন্য ভালো হবেনা? তাই নিজের ভালো চাইলে আমার কথা মেনে নাও। এবার তুমি যেতে পার। তোমার মত নিকৃষ্ট মনের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে রুচিতে বাঁধছে আমার। ” আয়েশা সালেহা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। বাধ্য হয়ে রাখী আক্তার আম্মার রুম থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল।
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৬
রাখী আক্তার অকুল পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছে। ভাবীরা কেউই তার সঙ্গে মন খুলে কথা বলছেনা। তাহমিদ তো তার আশেপাশে ভিড়ছেনা। দৃষ্টিকেও কাল থেকে দেখেনি সে। যেই মেজো ভাবী তার সঙ্গে হাসিমুখ ছাড়া কথা বলেনি, সেই মেজো ভাবীও গতকাল থেকে তার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। কষ্টে রাখী আক্তারের বুক ফেটে যাচ্ছে। সে সিদ্ধান্ত ভাইয়া-ভাবীদের কাছে নিজের
কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। অতীতে যা করেছে সবকিছুর জন্যই সবার কাছে ক্ষমা চাইবে সে। নিজেকে শুধরে নেবে। আপনজনদের ব্যথিত বদন সে আর দেখতে চায়না।