সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৩

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৩
জাওয়াদ জামী

” তুমি কেন এসেছ ? চলেই তো গিয়েছিলে আমাকে ছেড়ে , তবে আবার ফিরে আসলে কেন? দয়া দেখাতে এসেছ? চাই না তোমার দয়া। ” সিক্তা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আনান অসহায় চোখে সিক্তার কান্না দেখছে । সহ্য করতে পারছে না ও সিক্তার চোখের পানি। কিন্তু ও নিরুপায়। সিক্তা ওকে কিছুতেই নিজের কাছে ভিড়তে দিচ্ছে না।

” সরি । আর কখনোই এমন ভুল হবে না। তুই জানিস না আমি কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম । কিছুতেই নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছিলাম না। নিজের পরিবারটা ভেঙে যেতে দেখে রাগ হচ্ছিল । বারবার মনে হচ্ছিল , তোকে কখনোই পাওয়া হবে না আমার। মামা-মামী কখনোই আমাদের সংসারে তোকে বউ করে পাঠাবে না । আর এ সবকিছুর জন্য দায়ী আমার আম্মু। তাই আম্মুকে শাস্তি দিতে , একজন ব্যর্থ সন্তান হওয়ার দায়ে নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম। আমার এই সিদ্ধান্তে তুই কষ্ট পাবি এটাও আমি জানতাম। কিন্তু নিরুপায় ছিলাম। নিজের গোপন কষ্ট কাউকে বলতেও পারছিলাম না, আবার সহ্যও করতে পারছিলাম, না। ” দু হাতের তালুতে মুখ ঘষলো আনান। অপরাধবোধে ভুগছে সবকিছুর জন্য। সিক্তার চোখে চোখ মেলাতে পারছে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আগেই এতকিছু ভেবে নিয়েছ ? আমি তোমার সঙ্গে সংসার করব, এরমধ্যে ফুপুর কথা আসছে কেন ? তুমি ফুপুর ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেকে সাধু বানাতে চাচ্ছ ? তুমিও কম দোষী নও। আমাকে কাঁদিয়েছ তুমি। পাগলের মত হয়ে গেছিলাম। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। সবকিছুর জন্য দায়ী তুমি। তুমি আজ এসেছ আমাকে শান্তনা দিতে? পালিয়ে যাওয়ার আগে তোমার একবারও মনে হয়নি , আমি কষ্ট পাবো? ” হেঁচকি তুলে কাঁদছে মেয়েটা। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না।

” তুই যে শাস্তি দিবি , আমি মাথা পেতে নেব। তবুও কাঁদিস না। তোর কান্না আমি সহ্য করতে পারছি না। ” অপরাধীর মতো মিনমিন করে বলল আনান।
” আমি বিয়ে করে অন্য একজনের হাত ধরে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। আর তুমি সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে। এটাই তোমার শাস্তি। ”
সিক্তার কথায় ওর দিকে চমকে তাকালো আনান। ওর বুকটা ঢিবঢিব করছে। এই মেয়ে বলে কি?
” এমন কথা বলিস না , প্লিজ। আমি মরে যাব । তোকে ছাড়া বাঁচার কথা আমি ভাবতেই পারি না। তোকে ছাড়া আমি শূন্য। আমার পৃথিবী জুড়ে শুধু তোরই বাস। তোর ওপর শুধু আমারই অধিকার। ” এতটুকু বলতেই গলা কেঁপে উঠল আনানের। সিক্তাকে হারানোর ভয় বুকে বাসা বাঁধল। সত্যিই কি সিক্তা ওকে ছেড়ে চলে যাবে? না এটা হতে পারে না।

” ডায়লগ বন্ধ কর। পালিয়ে যাবার আগে কথাগুলো মনে হয়নি? তুমি যখন আমার কথা ভাবোনি, তখন তোমার কথা আমি ভাববো এটা ভাবছ কেন ? ভাববো না আমি তোমার কথা। ” সিক্তা হাঁপাচ্ছে।
” এভাবে বলিস না। মরে যাব। ” কান্না পেল আনানের। চোখের পানি লুকানোর কোন চেষ্টাই করল না।
আনানকে কাঁদতে দেখে চমকায় সিক্তা । ও আনানকে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু এই ছেলে তো দেখি কাঁদছে! সিক্তা চেয়েছিল গত কয়েকদিন ও যত কেঁদেছে তার থেকেও বেশি কষ্ট দেবে আনানকে। কিন্তু এই ছেলেটা দেখছি সিক্তা কষ্ট দেয়ার আগেই কান্নাকাটি শুরু করেছে। প্রমাদ গুনল সিক্তা। আনানকে এই মুহূর্তে কতটা অসহায় দেখাচ্ছে , সেটা যদি এই বাড়ির কেউ দেখত, তবে নির্ঘাত সিক্তাকে দু ঘা বসিয়ে দিত। নাহ্ এই ছেলেটাকে আর কাঁদানো উচিত হবে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিক্তা এগিয়ে গেল আনানের দিকে।

” আমাকে ক্ষমা করে দে , দৃষ্টি। আমি তোদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে অন্যায় করেছি। আমার ইচ্ছাকৃত ভুলগুলোর জন্য তোদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। তোরা ক্ষমা না করলে মরেও শান্তি পাবো না আমি। আমি কুহুর কাছেও ক্ষমা চাইব। তোদেরকে নিয়ে আমি সংসারে বাকিটা জীবন সুখে কাটাতে চাই। ” রাখী আক্তার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
দৃষ্টি বড়মার হাত দুটো ধরে তাকে শান্তনা দিতে চাইল। বড়মার মন ভালো করতে চাইল।
” কেঁদো না , বড়মা। বড়রা যেমন ছোটদের আদর করে, তেমনি প্রয়োজনে শাসন করার অধিকারও রাখে তারা। আর তুমি তো আমাদের মা। আমাদেরকে শাসন করার অধিকার তোমার আছে। আমরা অন্যায় করেছি, তুমি শাসন করেছ। এতে কষ্ট পাচ্ছ কেন ? তোমার ছেলেকে দেখ। সে তোমাকে কাঁদতে দেখে নিজেই কাঁদার আয়োজন করছে। তোমার ছেলেটার মন মেয়েদের মতই নরম সরম। এর তো ছেলে না হয়ে মেয়ে হওয়া দরকার ছিল। ”
দৃষ্টির কথা শুনে আঁচলে চোখ মুছল রাখী। ছেলের দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে বলল ,

” রাগ করে থাকিস না , নিহান। তুই ক্ষমা না করলে আমি মরেও শান্তি পাবো না। আমি ভুল করেছি, আর ভুলের শাস্তিও পাচ্ছি । তোর আব্বু আমার সঙ্গে কথা বলে না অনেকদিন ধরে। আনানও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আম্মা , ভাইয়া-ভাবীরা কেউই আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। সবার এত এত ঘৃণা আমি নিতে পারছি না। আমার বেঁচে থাকাটা নিরর্থক মনে হচ্ছে। বেঁচে থাকার কারণই নেই আমার। ” রাখী কাঁদছে। অঝোরে কাঁদছে সে।
আম্মুকে কাঁদতে দেখে কষ্ট হয় নিহানের। মা যতই খারাপ হোক না কেন, সে তো মা-ই।

” আম্মু , কেঁদো না। একটা কথা সব সময়ই মনে রেখ , তুমি চাইলেই সবকিছু নিজের মত করে পাবে না। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু চাওয়া থাকে, স্বপ্ন থাকে। প্রত্যেক মানুষেরই চাওয়া আলাদা আলাদা হয় , আম্মু। তোমার যেমন অন্যের চাওয়াকে সম্মান করতে হবে , মেনে নিতে হবে। তেমনি দেখবে অপরজনও তোমার চাওয়াকে সম্মানের সহিত মেনে নেবে। তুমি সংসারে যা যা দেবে , একটা সময় সেগুলোই ফেরত পাবে । একজন মানুষের অতীতের কর্মফলের ওপরই নির্ভর করে তার ভবিষ্যৎ। এটা মেনে চলতে পারলেই জীবনটা সুন্দর হবে। জীবনে দুঃখ কিংবা হতাশা থাকবে না। ”

রাখী তাকিয়ে আছে নিহানের দিকে। ছেলেটা কি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল তার কি করনীয়। আফসোস হচ্ছে তার। এতদিন এই ছেলেদেরই চিনতে সে ভুল করেছে। সে কষ্ট দিয়েছে তার ছেলেদের।
” আমি সব বুঝতে পেরেছি। চোখ খুলে গেছে আমার। আমার দোষেই এতদিন আমার সংসারে সুখ আসেনি। এবার থেকেই আমিই হব আমার সংসারে সুখের কারণ। তোরা শুধু আমাকে ক্ষমা করে দে। ”

” সন্তানের কাছে বাবা-মার কখনোই ক্ষমা চাইতে নেই , আম্মু । বাবা-মার সম্মানহানি হয় এতে। আর আমি চাই না আমার আব্বু-আম্মুর সম্মানহানি হোক। তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ , এতেই আমি খুশি । সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকার মজাটাই অন্যরকম, সেটা একবার বুঝতে পারলে তুমিও সবাইকে নিয়েই থাকতে চাইবে, আম্মু। ”
” থাকবো, আব্বা। আমি তোদের সবাইকে নিয়েই বেঁচে থাকব । যে ক’টাদিন বাঁচব সবার সঙ্গে মিলেমিশেই থাকব। এবার আনানকে একটা ফোন কর। কতদিন ছেলেটা হয়ে গেছে ছেলেটা আমার সঙ্গে কথা বলে না। তবে আর আগে গিয়ে তোর আব্বুকে নিয়ে আয়। সে নিচে বসে আছে। আমি তোদের কাছে ক্ষমা পেলেই তবে সে ভেতরে আসবে। ”
” কি বলছ তুমি! আব্বুও এসেছে? এতক্ষন ধরে আব্বু নিচে বসে আছে ! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি একাই এসেছ। এক্ষুনি যাচ্ছি আমি। ”

” তোর আব্বুর শর্ত ছিল, আমি ক্ষমা না পাওয়া পর্যন্ত তার কথা তোদেরকে বলতে পারব না। সেজন্যই বলিনি। ”
নিহান দৌড়ে বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট থেকে৷
দৃষ্টি ফোন করল আনানকে।
ছুটির দিন হওয়ায় আনানও ঘুমাচ্ছিল। ফোনের আওয়াজ পেয়ে চোখ বন্ধ করেই হাতড়াতে শুরু করল। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই রিসিভ ফোন রিসিভ করল।
” হ্যালো। ”

” আনান ভাইয়াআআআআআআআ, তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় এসো। তোমার ভাতিজা তার চাচ্চুর জন্য ট্যাঁওট্যাঁও করে কাঁদছে । তুমি ছাড়া ওকে কেউ শান্ত করতে পারবে না। ”
দৃষ্টির চিৎকারে কানে তালা লেগে গেল আনানের। বিস্ময়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। দৃষ্টির চিৎকার এখনো ওর মাথার মধ্যে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। দস্যি মেয়েটা ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। আনান ভাবল , ভাইয়া এই মেয়ের অত্যাচার সহ্য করে এতগুলো দিন টিকে আছে কিভাবে ? ধৈর্য্য আছে ভাইয়ার। মাথা ঝাঁকিয়ে দৃষ্টির কথার জবাবে বলল,
” কোন ভাতিজা ট্যাঁওট্যাঁও করে কাঁদছে? ভাতিজা কোথায় থেকে টপকালো? ”
” কোন ভাতিজা মানে! তোমার ভাতিজা। তোমার আদরের ভাতিজা। ছেলেটাকে আর কাঁদিও না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পর। আধাঘন্টার মধ্যে তোমাকে এখানে দেখতে চাই। ”

” দেখ দৃষ্টি , এমনিতেই আমার আউলা ঝাউলা হয়ে গেছে। তুই আরও আউলা করে দিস না আমার মাথা। আমার আদরের ভাতিজা এখনো দুনিয়ায় টপকায়নি। সে দুনিয়ায় ল্যাণ্ড করা মাত্রই ওকে আমার কাছে এনে রাখব। কারন তোর মত স্ক্রু ঢিলা মায়ের কাছে থাকলে আমার পুচকুটারও তোর মতই স্ক্রু ঢিলা হয়ে যাবে। তাই এখন হম্বিতম্বি রেখে ফোন কেটে দে। আমি ঘুমাবো। ”
” দেবো না আমি আমার পুচকুকে । তুমি ওর মায়ের কথা শুনবে না আবার ওকেও নিজের কাছে রাখবে! কাভি নেহি। নো নেভার। কক্ষণো না। তুমি এক্ষুণি আসলেই তবে পুচকুকে পাবে। তার আগে নয়। ”
আনান এবার দৃষ্টির কথায় ধন্দে পড়ে গেল।
” দৃষ্টি বারবার ভাতিজার কথা বলছে, তার মানে কি সত্যিই আমাদের পুচকু আসবে? ” নিজেকেই শুধালো আনান। হঠাৎই ভিষণ আনন্দ লাগছে ওর। এক লাফে বিছানা ছেড়ে পোশাক পরতে শুরু করল। ওকে এই মুহূর্তে ভাইয়ার ফ্ল্যাটে যেতেই হবে ।

” দৃষ্টি , সত্যি বললি তুই ? দাদী হব আমি? ” রাখী আক্তার হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল।
বড়মার কথার মানে বুঝতে পেরে দাঁতে জিভ কাটল দৃষ্টি। লজ্জারাঙা মুখে বলল,
” তোমার ছোট ছেলেকে এই বাসায় আনতেই কথাটা বলেছি , বড়মা। সেই কবে থেকে ভাইয়াকে আসতে বলছি কিন্তু ভাইয়া আসছেই না। তাই বাধ্য হয়ে বাঁকা পথে হাঁটতে হয়েছে আমাকে। ”
” আসছে আনান? ”
” আজকে অন্তত না এসে থাকতে পারবে না সে। ”
দৃষ্টিকে অবাক করে দিয়ে রাখী জড়িয়ে ধরল ওকে। পরম মমতায় চুমু দিল দৃষ্টির কপালে। কান্না জড়ানো গলায় বলল ,

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪২

” এমনিভাবে সংসারটাকে আগলে রাখিস , মা। আপন করে নিস সবাইকে। সকলের নয়নের মনি হয়ে ওঠ। ভালোবাসার আঁচলে বেঁধে রাখ আমার ছেলেকে। আগলে রাখিস পরিবারের সবাইকে। ”
দৃষ্টি টলমল চোখে বড়মার দিকে তাকায়। আজ প্রথমবারের মত বড়মার মাঝে মায়ের ছায়া দেখতে পাচ্ছে মেয়েটা। মায়ের জন্য মনটা হু হু করে উঠল।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here