সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫১

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫১
জাওয়াদ জামী

” বউ , সারাক্ষণ কি এত ভাবো বলতো ? যখনই তোমাকে দেখি তখনই মনে হয় কিছু একটা ভেবেই চলেছো। কি হয়েছে তোমার? কোন সমস্যা? ” তাহমিদ চিন্তিত নয়নে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে।
” আপনি যতটা চিন্তা করছেন , ততটা চিন্তা করার মত কিছুই হয়নি । আমি তমাপুকে নিয়ে ভাবছি । আচ্ছা ডক্টর ফারদিন মানুষ হিসেবে কেমন ? তার স্ত্রী নেই ? তমাপুকে নিয়ে তার কাছে যাচ্ছি প্রায় নয়মাস ধরে। কিন্তু তার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। ”

” ফারদিন ভাইয়া মানুষ হিসেবে অসাধারণ । সে আমার ফ্রেণ্ডের বড় ভাই । তাই তাকে খুব ভালোভাবেই চিনি। একসময় তাদের বাসায় যাতায়াত ছিল আমার । তাদের ফ্যামেলির প্রতিটা সদস্যই ফ্রেণ্ডলি এবং ইসলামিক মাইন্ডের। মেডিকেলে পড়ার সময় ফারদিন ভাইয়া তারই ব্যাচমেটের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। আংকেল সেটা জানতে পেরে ছেলের পছন্দের মানুষের সঙ্গেই ভাইয়ার বিয়ে দেয়। তখন তারা থার্ড ইয়ারে পড়ছিল। এরপর দু’জন একসঙ্গে পড়াশোনা শেষ করল। জয়েন করল মেডিকেলে। সুখের সংসার ছিল তাদের । একসময় ভাইয়া ডক্টর হিসেবে বেশ নাম করল। কিন্তু ভাবী খুব একটা নাম করতে পারল না। কারন সে ছিল আপাদমস্তক সংসারী একজন নারী । সংসার আর পেশা দু’টোর মধ্যে সংসারকেই মনেপ্রাণে গ্রহন করে নিয়েছিল সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আর সবাই সেটা বুঝতেও পারছিল। এবং মেনেও নিয়েছিল। অবশ্য ভাবী কখনো মেডিকেল ছাড়ার কথা চিন্তাও করেনি। সে জানত , ভাইয়া সব সময়ই একজন ডক্টরকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে চেয়েছে। তাই ভাইয়ার চাওয়াকে সম্মান জানিয়েছে সে। এভাবেই চলছিল তাদের সংসার। একদিন আমার ফ্রেণ্ডের কাছে শুনলাম ভাবী প্রেগন্যান্ট। তার কিছু ইন্টারনাল প্রবলেম দেখা দিয়েছে। সেই সাথে অ্যানিমিয়াও। আমি দুইবার রক্ত দিয়েছি তাকে। এমনকি ডেলিভারির সময়ও ফারদিন ভাইয়ার পাশেই ছিলাম। ডেলিভারির সাত ঘন্টা পর যখন ভাবী সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল, তখনও ভাইয়ার পাশেই ছিলাম। ভাবীর মৃত্যুর পর থেকে ভাইয়া ধীরে ধীরে বদলে গেল।আগের সেই সদাহাস্যজ্বল মানুষটা পরিনত হল গম্ভীর মানুষে। আংকেল, আন্টি ছেলেকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে ভাবীর মৃত্যুর পর থেকে। কিন্তু ভাইয়া রাজি হচ্ছে না। হঠাৎ ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? ”

” আন্টি মানে ডক্টর ফারদিনের আম্মা আমাকে গতকাল কিছু কথা বলেছে। তমাপুকে আন্টির ভিষণ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু কথাটা সে সাহস করে কাউকে বলতে পারছে না। তার ছেলেকেও না । এদিকে ফারজাহ তো তমাপু বলতে পাগল। সে নাকি বাসায় সব সময়ই আপুর জন্য কান্নাকাটি করে। আংকেলেরও আপুকে ভিষণ পছন্দ। ”
কুহুর কথা শুনে তাহমিদ কিছু একটা ভাবল ৷
” এজন্যই কি গতকাল ফাইয়াজ আমার সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ের বিষয়ে আলোচনা করছিল ! তোমার কথা শুনে সেটাই মনে হচ্ছে। তবে বিষয়টা নিয়ে আমি কথা বলতে পারি। কিন্তু আপুর বিয়ে ঠিক করার অধিকার আমার নেই। অন্তত যতদিন আপুর অভিভাবক আছে ততদিন তো অবশ্যই নয়। আমি খালামণির সঙ্গে আলোচনা করেই তবে ফাইয়াজের সঙ্গে কথা বলব। ”
তাহমিদের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হয় কুহু। ও জানে তাহমিদ ভুল কোন কাজ করতে পারে না।

” তুমি আদ থেতে থত্যিই আমাল, মাম্মাম ? তুমি এথন থেতে আমাদেল বাথাতেই থাতবে ! আমাকে থেলে আল তোথাও দাবে না তুমি? ( তুমি আজ থেকে সত্যিই আমার, মাম্মাম? তুমি এখন থেকে আমাদের বাসাতেই থাকবে! আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না তুমি?) ” ফারজাহ তমার কোলে বসে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল। মেয়েটা খুশিতে একটু পরপর চুমু দিচ্ছে তমাকে।

ফারজাহ ‘ র দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল তমা। ও মাস দুয়েক আগে যখন ডক্টর ফারদিনের স্ত্রী ‘ র মৃত্যুর কথা শুনেছিল , সেদিন মেয়েটার জন্য ওর বুকটা হু হু করে উঠেছিল। কিন্তু যখন তাহমিদ ওকে জানায় , ডক্টর ফারদিনের আব্বা-আম্মা তাদের ছেলের জন্য তমাকে পছন্দ করেছে , সেদিন তমা একবাক্যে না করে দিয়েছিল। ও জীবনে বাজেভাবে ঠকেছে। তাই অন্য কাউকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না। নিজের ভাঙাচোরা হৃদয়ে অন্য কাউকে জায়গা দেয়া সম্ভব নয় । তাই ইচ্ছে করেই তমা কঠোর হয়েছিল। ও পরপর দুইমাস ডক্টরের কাছে যায়নি । ওকে দীর্ঘদিন না দেখতে পেয়ে ফারজাহ অসুস্থ হয়ে যায়। নাওয়াখাওয়া বন্ধ করে দেয়।

ওকে হসপিটালে অ্যাডমিট করা হয়। কিন্তু কিছুতেই মেয়েটা সুস্থ হয় না। বাধ্য হয়ে ডক্টর ফারদিন ছুটে যায় তমার কাছে। প্রথমে সে-ও নাকি বিয়ে করতে চায়নি। কিন্তু মেয়ের অসুস্থতার কাছে হার মানে সে। ফারজাহ ‘ র অসুস্থতার কথা শুনে তমা ছুটে যায় হসপিটালে। সেদিন ও দেখেছিল , ছোট্ট শরীরটাকে বিছানার সাথে লেপ্টে থাকতে। সেই শরীরে শুধু প্রান ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ছোট্ট পুতুলকে নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে কেঁপে উঠে তমার হিয়া। তারই ফলশ্রুতিতে আজ সে ডক্টর ফারদিনের স্ত্রী হয়ে এই বাড়িতে এসেছে। এখন তমা ফারজাহকে কোলে নিয়ে বসে আছে ফারদিনেরই রুমে।

” হ্যাঁ , পুতুল সোনা, আজ থেকে আমি তোমার মাম্মাম। তোমাকে ছেড়ে আর কখনও , কোথাও যাব না আমি। এবার ঘুমিয়ে পর , সোনা। অনেক রাত হয়েছে। আমি তোমাকে ঘুম পারিয়ে দিচ্ছি । ”
ফারজাহ বাধ্যে মেয়ের মত বালিশে মাথা রাখল। তমা ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ফারজাহ ‘ র মাথায়। সেই সাথে রুপকথার গল্প শোনাচ্ছে।

ফারদিন রুমে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল । সে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে বধু বেশে আধশোয়া এক রমনীর দিকে। সেই রমনী মৃদুস্বরে গল্প শোনাচ্ছে তারই মেয়েকে ! রমনীর চোখেও যেন রাজ্যের ঘুম এসে হানা দিয়েছে । সে ঝিমাচ্ছে। এবার ফারদিন তাকাল তার মেয়ের দিকে। মেয়েটা ঘুমিয়েছে।
” ফারজাহ ঘুমিয়ে গেছে। এবার তুমিও ঘুমাও । সারাদিন অনেক ধকল গেছে । তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে । ” রিস্টওয়াচ খুলে ড্রেসিংটেবিলের ওপর রেখে কথাগুলো বলল ফারদিন।

ফরদিনের গলা শুনে চমকে উঠে বসল তমা। ওর মনে সংশয়। কিভাবে সামলাবে সবকিছু ? ওর ও যেমন একটা অতীত আছে , তেমনি ডক্টরেরও একটা অতীত আছে। কিন্তু ডক্টরের অতীত ওর মত বাজে নয়। হ্যাঁ, ডক্টর নিশ্চয়ই তার অতীতের কারনে দুঃখ পায়, কষ্ট পায়। কিন্তু সে তো তমার মত ঠকে যায়নি। তাই তমার দুঃখ-কষ্ট বোঝার ক্ষমতা হয়তো তার নেই । সে কি আদৌও বুঝবে তমাকে? হ্যাঁ, হয়তো সে এতদিন তমার সঙ্গে ডক্টর হিসেবে ট্রিট করেছে। স্বীকার করতেই হবে সে ডক্টর হিসেবে যথেষ্টই ভালো। কিন্তু স্বামী হিসেবে কি সে নিজেকে প্রমান করতে পারবে? নানান চিন্তা ভর করল তমার মস্তিষ্কে। হঠাৎই ও অনুভব করল, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভিষণ। গত দুইমাস সে ডক্টরের কাছে আসেনি। তবে নিয়মিত ঔষধ খেয়েছে । এমন কেন হচ্ছে ?

” তমা , ঠিক আছ তুমি ? আজ ঔষধ খেয়েছ? নাকি সঙ্গে করে ঔষধ আনোনি? ” তমার মুখের দিকে তাকিয়েই ফারদিন বুঝতে পারে মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। ও ছুটে গিয়ে তমার পাশে বসল।
ফরদিনের উদগ্রীব গলা তমার কর্নকুহরে ঠিক পৌঁছে গেল। তার কৃত্রিমতা বিবর্জিত গলা শুনে তমা একটু ধাতস্থ হল। আঁড়চোখে তাকাল মানুষটার দিকে। তার চেহারাও দেখার মত হয়েছে। তমা বুঝতে পারল, মানুষটা সত্যিই ওকে নিয়ে চিন্তিত।

” হঠাৎ মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠলো। ঔষধও নিয়ে এসেছি। কিন্তু খাওয়া হয়নি। ”
” যাইহোক না কেন ঔষধ বাদ দেবে না। তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি আসছি। ” ফারদিন রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর একটা প্লেটে বিরিয়ানি নিয়ে রুমে ঢুকল।
” তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, ঔষধ খেতে হবে। ”
” কিন্তু এখন যে খেতে ইচ্ছে করছে না। ”
” ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে। আর কোন কথা নয়। যা বলছি তাই কর। ”
বাধ্য হয়ে তমা বিরিয়ানির প্লেট হাতে নিল। কষ্ট করে কয়েক লোকমা মুখে দিল। এরপর ঔষধ খেল।
” এবার ঘুমাও। কালকে সকাল সকাল উঠতে হবে । ফারজাহ ও কিন্তু খুব সকালে ওঠে। আর একবার ওর ঘুম ভাঙলে, ও কিন্তু কাউকে ঘুমাতে দেয় না। ”
ফারদিনের কথা শুনে ওর দিকে অবাক চোখে তাকায় তমা। মানুষটা কেমন স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে ওর সঙ্গে ! যেন ওদের দু’জনের বিয়েটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা!

” আপনি ঘুমাবেন না? ”
” সকালে যেহেতু মেডিকেলে যেতে হবে, সেহেতু আমাকেও ঘুমাতে হবে। ”
” কোথায় ঘুমাবেন? ”
” যদি তোমার মনে দয়া হয়, যদি বিছানার এক কোনে আমাকে একটু জায়গা দাও, তবে তোমার কাছে আজীবনের জন্য কৃতার্থ থাকতাম। ”
ফারদিনের কথায় হাসল তমা। ফারজাহ কে নিজের কাছে নিয়ে ফারদিনকে একপাশে জায়গা করে দিল।

” জানেন , আজকে আমি ভিষণ খুশি? অবশেষে তমাপুরও সংসার হল। ” তাহমিদের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে কুহু।
” সত্যিই আজ নিজেকে অনেকটাই ভারমুক্ত মনে হচ্ছে । আজ মাকে কাঁদতে দেখলাম। তবে সেটা সুখের কান্না। ”
” তবে আমার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে। ওরা কি স্বাভাবিকভাবে নেবে সবকিছু ? ডক্টর ফারদিন কি মেনে নেবে আপুকে? ”
” কেন মেনে নেবে না! ভাইয়ার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। হ্যাঁ হয়তো দু’জনের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। কিন্তু তারমানে এই নয় যে ওরা কেউ কাউকে মেনে নেয়নি। দু’জনের মধ্যে কিছুটা জড়তা আছে। সেটাও সময়ের সাথে সাথে থাকবে না। শোন বউ , কাল একবার আমরা ওদের বাসায় যাব। তুমি একটু তমাপুর সঙ্গে কথা বলবে। আর আমি ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলব। ”
” ঠিক আছে। ”

মাঝরাত। ফারজাহ ঘুমে বিভোর। ওর পাশে ঘুমাচ্ছে তমাও। শুধু ঘুম নেই ফারদিনের চোখে। রুহীর কথা মনে পরছে। আট বছরের সম্পর্ক ছিল দু’জনের। এই আট বছরে একদিনও মনমালিন্য হয়নি দু’জনের । রুহী হতে দেয়নি। সেই রুহীই একদিন ওকে একা করে চলে গেল। ফারদিন কখনোই ভাবেনি, ওর জীবন দ্বিতীয় কোন নারী আসবে। অথচ আজ সেটাই ঘটেছে। ওর জীবনে দ্বিতীয় নারীর পদার্পন ঘটেছে। এবং সেটা সারাজীবনের জন্য। ফারদিন চাইলেও এটা অস্বীকার করতে পারবে না। আবার ওকে স্বীকার করতেই হবে তমা মেয়েটা সত্যিই অসাধারণ। আর সেকারণেই ফারজাহ ওকে এতটা ভালোবাসে। মেয়েটার একটা অতীত আছে। যেটা নিয়ে ফারদিনের মাথা মাথাব্যথা নেই। মেয়েটার কাউন্সেলিং এর সময় থেকেই সবটা জানত সে।

মেয়েটা সত্যিই আঘাত পেয়েছিল। সেটা সামলে উঠতে সময় লেগেছে কয়েকটা বছর। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ফারদিন। পাশ ফিরে তাকাল স্ত্রী আর কন্যার দিকে। হঠাৎই বুকের বাম পাশে ভাঙচুর শুরু হল। ফারজাহ র পাশে রুহীর ঘুমানোর কথা ছিল। কিন্তু সে তার কথা রাখেনি। আজ রুহীর জায়গায় তমা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসল। আর বিছানায় থাকতে পারল না। বেলকনিতে এসে দাঁড়াল। ওকে সবকিছু মেনে নিতেই হবে। ফারজাহ র জন্য , নিজের জন্য, তমার জন্য।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫০

এটাই হয়তো ওর জন্য নির্ধারিত ছিল। কিছুক্ষণ উদাস হয়ে অন্ধকারে তাকিয়ে রইল ফারদিন। সে জানে রুহীকে সে কোনদিনই ভুলতে পারবে না। আবার তমাকেও আপন করে নিতে হবে । হয়তো সেটাতে সময় লাগবে। কিন্তু একটা না একটা সময় তাকে এটা করতেই হবে। দুঃখী মেয়েটাকে আরও দুঃখ দিতে চায় না সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দু হাতের তালুতে মুখ মুছে রুমের দিকে পা বাড়ায়।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here