সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৯
জাওয়াদ জামী
” কুহু, কাল আমরা চলে যাব। দৃষ্টি কিছুদিন শ্বশুর বাড়িতে থাকুক। এরপর ওকে আমাদের ঢাকার বাড়িতে নিয়ে যাব। তোর মামা কথা বলেছেন রাখীর সাথে। দৃষ্টির জন্য কোন চিন্তা করবিনা তুই। দৃষ্টির যাবতীয় খরচ তোর মামা দেবে। শিহাবের পড়াশোনার দ্বায়িত্বও সে-ই নিতে চায়। তোর নিজের চিন্তা করার সময় এসেছে এখন। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। অ্যাডমিশনের দেরি নেই। ভালো কোন ভার্সিটিতে চান্স পেতে হবে তোকে। এবং সেটা অবশ্যই ঢাকার কোন ভার্সিটিতে। তোর মামাও অবসরে যাবে ততদিনে। আমরা তখন ঢাকায় শিফট করব। দৃষ্টি থাকবে আমাদের কাছে, তুইও যাবি মাঝেমধ্যে। ” আফরোজা নাজনীন কুহুকে বললেন। তিনি ওদের বাড়িতে এসেছেন। তার সাথে তাহমিনা আক্তারও আছেন।
” আপনারা দৃষ্টিকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যাবেন, ওর সকল দ্বায়িত্ব পালন করবেন। এগুলো ঠিক আছে। সে এখন আপনাদের ছেলের বউ৷ কিন্তু শিহাবের দ্বায়িত্ব আমাকেই পালন করতে দিন, মামী। বড় বোন হিসেবে একমাত্র ভাইয়ের দ্বায়িত্ব পালন করতে হবে আমাকেই। ওর দ্বায়িত্ব অন্য কারোর ওপর দিয়ে আমি আমার মৃত বাবা-মাকে ছোট করতে চাইনা। আমার কথাগুলো হয়তো আপনাদের খারাপ লাগতে পারে। সেজন্য আমি ক্ষমা চাইছি। তারপরও আমি বলব, আমার দ্বায়িত্ব আমাকেই পালন করতে দিন। ” কুহু মৃদুস্বরে কথাগুলো বলল।
” তুই নিজেই ছোট মানুষ। কায়েস, আইরিনের মৃত্যুর পর ভাইবোনের দ্বায়িত্ব পালন করেছিস তুই। আর কত? এবার আমাদেরও একটু সুযোগ দে। জিদ করিসনা, মা। ” তাহমিনা আক্তার এবার বললেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” জিদ নয়, মামী। আপনাদের আমি বোঝাতে পারবনা আমার ভেতরে কি চলছে। আপনারা যাওয়ার পর আমার ওপরে কোন ঝড় আসবে, সেটা সামাল দেব কিভাবে। এগুলো ভেবেই আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। নিহান ভাইয়ার সাথে দৃষ্টির বিয়ে বড়মা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। যাবতীয় ঝড়-ঝঞ্ঝা আমি সামাল দিতে পারব। কিন্তু দৃষ্টি? ও কি পারবে? এরপর যদি বড়মা শোনে, আপনারা শিহাবের দ্বায়িত্ব নেবেন। এটা তিনি মানবেননা। আপনাদের কিছু কিছু সিদ্ধান্তের প্রভাব আমাদের ওপর পরবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা আমার বোনটার ভালো থাকার দ্বায়িত্ব নিন। বাকিগুলো আমিই সামলাবো। বড়মা চাইলে দৃষ্টির পড়াশোনার খরচও আমিই দেব। সবকিছুর বিনিময়ে আমি দৃষ্টিকে সুখী দেখতে চাই। ”
আফরোজা নাজনীন এবং তাহমিনা আক্তার দু’জনেই কুহুর মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছেন। মেয়েটা যে রাখী আক্তারকে ভয় পাচ্ছে, এটা তারা বুঝতে পারছেন। দুই জা একে-অপরের দিকে চাইলেন। নিঃশব্দ কিছু আলাপ হলো তাদের। বড় জা’কে কথা বলতে দিয়ে নিশ্চুপ থাকলেন তাহমিনা আক্তার।
” তোর অবস্থা আমরা বুঝতে পারছি, সোনা মা। একদমই ভয় পাবিনা। আমরাতো আছিই। তোর মামারা পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রাখীই একটু আলাদা। একটু বলছি কেন? পুরোটাই আলাদা। চার ছেলের পর যখন রাখী জন্ম নেয়, তখন স্বভাবতই ওর আদরও বেশিই ছিল। আব্বা-আম্মা, ভাইদের আদরে ও অহংকারী হয়ে উঠেছিল। বিয়ের আগে ওকে অনেক বুঝিয়েছি। আমরা ভেবেছিলাম, বিয়ের পর হয়তো ওর নাকউঁচু স্বভাবটা থাকবেনা। কিন্তু না। আমরা ভুল ছিলাম। ও তো বদলায়নি, বরং ওর সংসারটাকে বদলে নিজের মত করে নিয়েছে। এটা আমাদের ব্যর্থতা। তবে তুই একটুকু নিশ্চিত থাকতে পারিস, দৃষ্টি সুখে থাকবে। সেই ব্যবস্থা আমরা করব। আমরাই যেমন জোর করে নিহানের সাথে দৃষ্টির বিয়ে দিয়েছি, তেমনি আমরাই দৃষ্টির সুখী হওয়ার কারন হব। তবে তোকেও কথা দিতে হবে, নিয়মিত আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখবি। তোর বাবা-মা যেভাবে আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখত। কি রাখবি তো? ”
” রাখব, মামী। ”
” এই তো সোনা মেয়েটা আমার। শোন, আমরা যতই তোর কাছে না থাকি, রাখী তোদেরকে কিছু বলার সাথে সাথে আমাকে অথবা তাহমিনাকে জানাবি। রাখীর স্বেচ্ছাচারীতা অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। এবার তাকে ও বুঝতে হবে, সে ও ভুল করে। ”
কুহুকে আরও নানান উপদেশ দিলেন দুই জা মিলে। কুহু মন দিয়ে তাদের কথাগুলো শুনল।
” থ্যাংকস, ভাই। বাড়ি ভর্তি লোকজনের সামনে তোমাকে থ্যাংকস বলার সুযোগই পাইনি। তুমি না থাকলে, আমার কি যে হত সেটা আমার অজানা। ” আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল নিহানের গলা।
নিহানকে আবেগি হতে দেখে মুচকি হাসল তাহমিদ। নিহানকে খোঁচা দিতে একটুও ভুল করলনা।
” কি আর, হত! ফুপু আরেকটা পৃথুকে খুঁজে বের করত। এরপর তোর ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিত। তোর জীবনটা পৃথুময় হয়ে যেত। মন্দ হতোনা, কি বলিস? ”
” ভাই , প্লিজ পৃথু নামটা আর শুনতেই চাইনা। আম্মুকে হাজারবার বলেছি, আমি ঐ মেয়েকে বিয়ে করতে চাইনা। ওর চালচলন আমার ভালো লাগেনা। কিন্তু আম্মু আমার কথা শুনলে তো? গত দুইটা মাস আমার কিভাবে কেটেছে, সেটা আমি ছাড়া আর কেউই জানেনা। মাঝেমধ্যে মনে হত, আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। ”
” সবকিছু তোর দোষেই হয়েছে। তুই দৃষ্টির কথা বাড়িতে জানাসনি কেন? আমি যদি বিষয়টা না জানতাম তবে পৃথুকেই তোর বিয়ে করতে হত। পড়াশোনা জলাঞ্জলী দিয়ে ওকে নিয়ে পুরো দেশ ঘুরতিস আর টিকটক করতিস। পৃথু এমনিতেই টিকটক সেলিব্রিটি, বিয়ের পর তুইও সেলিব্রিটি হয়ে যেতিস। ”
” তুমি দৃষ্টির বিষয়টা জানতে? কিন্তু কিভাবে? আমি আম্মুর ভয়ে বিষয়টা গোপন রেখেছিলাম। আম্মু জানতে পারলে শুধু দৃষ্টি নয়, কুহুরাও এই গ্রামে থাকতে পারতনা। অনেককিছু ভেবেই আমি নিজের ভালোবাসা গোপন রেখেছিলাম। ”
” আরও বছরখানেক আগে থেকেই আমি জানতাম, তুই দৃষ্টিকে পছন্দ করিস। সৌভাগ্যবশত তোর ওয়ালেটের গোপন জায়গায় দৃষ্টির একটা ছবি দেখেছিলাম। কিন্তু আমাকে এটা বল, ফুপুকে ভয় পাওয়ার কি আছে? আমি যতটুকু জানি, ফুপা তার ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের অনেক ভালোবাসে। তুই ফুপার সাথে কথা বলতি? সবকিছু জানতে পারলে ফুপা নিশ্চয়ই তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করত। ”
” তুমি তোমার ফুপুকে চেনোনা, তাই সহজেই কথাটা বলতে পারলে। এই বাড়িতে আম্মুর কথার ওপরে কথা বলার সাহস কারো নেই। আম্মুর সিদ্ধান্তই এই বাড়িতে আইন। কেউ যদি এর বিপক্ষে যেত, তবে বাড়িতে কেয়ামত ঘটে যেত। মানসম্মানের ভয়ে আব্বু চুপ থাকে। আমরাও তাই। চাচা-চাচী বেঁচে থাকতে আম্মুর তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর যেদিন আম্মু শুনল, কুহুরা তিন ভাইবোন নিঃস্ব, সেদিন থেকেই আম্মু পাল্টে গেল। কুহুদের ঘৃণা করতে শুরু করল। এই বাড়ির দরজা ওদের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। আব্বু ওদেরকে সাহায্য করতে গেলেই শুরু হত অশান্তি। কখনো কখনো আম্মু তিন-চার দিন রান্না করতনা। আব্বু না খেয়ে থাকত। আনান বাহিরে খেত। আমিও বাহিরে খেতাম। কোন কারন ছাড়াই কুহুদেরকে অপমান করে আম্মু। এরকম অনেক ঘটনাই আছে। তাই কাউকে জানানোর সাহস আমার হয়নি। ”
” কথাগুলো আমাদের বাড়িতে জানাসনি কেন? সবাইকে জানাতে যদি সমস্যা থাকত, তবে দিদুনকে জানাতে পারতিস। চল আমার সাথে। দিদুনকে বলবি সবকিছু। নয়তো দৃষ্টি ফুপুর রোষানলে পরবে। একমাত্র দিদুনই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। ”
নিহান কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকল। কিছুক্ষণ নিজের সাথে বোঝাপড়া করল। ও বুঝতে পারছে, দৃষ্টি আর কুহুর ভালোর জন্যই নানুকে সবকিছু জানানো দরকার।
” চল, ভাই। ”
নিহানের মুখে সবকিছু শুনে থম মেরে বসে থাকলেন আয়েশা সালেহা। তিনি নিজের মেয়ের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। তার রাগও হচ্ছে ভিষণ। মেয়েকে মানুষ করতে ব্যর্থ হওয়ায় নিজের গালে নিজেরই চপেটাঘাত করতে ইচ্ছে করছে। তিনি এই কয়দিনে বুঝতে পেরেছেন, তার মেয়ে অত্যন্ত বেয়াদব এবং মুখরা। যখন খুশি যাকে ইচ্ছে তাকেই অপমান করে সে। এবং কুহুদের তিন ভাইবোনকেই অপছন্দ করে। এর একটা বিহিত করা দরকার। এবং সেটা দৃষ্টি এবং কুহুর স্বার্থে।
” এতদিন কথাগুলো আমার কাছ থেকে লুকিয়ে তুমি অন্যায় করেছ, নিহান। আরও আগে আমাকে কথাগুলো বলা উচিত ছিল তোমার। আমার পেটের সন্তান যে এতটা নীচ সেটা ভাবতেই আমার ঘৃণা হচ্ছে। ” রাগে-দুঃখে কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধা।
” এখন কান্নার সময় নয়, দিদুন। কোন সন্তানই চায়না অন্যের কাছে তার বাবা-মাকে ছোট করতে। নিহানও চায়নি। তবে এখন সময় পাল্টেছে। নিহান এখন বিবাহিত। তুমিই পারো বিরূপ পরিস্থিতি থেকে দৃষ্টি আর ওর ভাইবোনকে বাঁচাতে। ” তাহমিদ দিদুনের হাত ধরে মৃদুস্বরে বলল।
” ঠিক বলেছ, দাদু ভাই। আমাকেই একটা ব্যবস্থা করতে হবে। নিজের মেয়েকে শিক্ষা দেয়ার সময় এসেছে। যা করার আমি করব। ”
” আমি জানতাম, তোমার কাছে আসলে আমাকে নিরাশ হতে হবেনা। ধন্যবাদ, দিদুন। ”
” তুমি আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছ, তাহমিদ! দাদু ভাই, তোমার সাথে আমার কি ধন্যবাদের সম্পর্ক? ”
” আমার জন্য ধন্যবাদ দেইনি। দিয়েছি নিহানের জন্য। আমার কাছ থেকে তুমি শুধু ভালোবাসা পাবে, ধন্যবাদ নয়। ”
তাহমিদ জড়িয়ে ধরল দিদুনকে। দিদুনও তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন। আরেক হাত বাড়িতে নিহানকে কাছে ডাকলেন।
” রাখী, কাল সকালেই আমরা রওনা দেব। আবার কবে এখানে আসতে পারব জানিনা। তবে তোমরা মাঝেমধ্যে ঢাকা যেও। তোমার তো আবার আমাকে দেখতে যাওয়ার সময় হয়না। কিন্তু ঢাকার বাহিরে বেড়াতে যাওয়ার সময় পাও ঠিকই। তুমি একবারও ভাবোনা, তোমাদেরকে দেখতে ইচ্ছে করে আমার। ” আয়েশা সালেহা কঠিন গলায় বললেন।
” আমি সত্যিই সময় পাইনা, আম্মা। বাপের বাড়িতে কোন মেয়ে বেড়াতে যেতে চায়না বলুন? নিহানের বাবা চায়না আমি বাড়ি থেকে বের হই। সে চায় আমি দৃঢ় হাতে সংসার সামলাই। এই সংসার সংসার করেই আমার কোথাও যাওয়া হয়না। ” নিজের পক্ষে সাফাই গাইল রাখী।
” কেমন সংসার সামলাও সেটা তো নিজের চোখেই দেখলাম। ‘ দৃঢ় হাত ‘ কথাটার মানে জানো? তোমার ভেতর কোন দৃঢ়তাই দেখিনি আমি। তার বদলে শুধু দেখলাম, অহংকার, রাগ, জিদ, হিংসা আর ঘৃণা। এগুলোকে যদি তুমি ‘ দৃঢ় ‘ মনে কর, তবে তুমি ভুল। তোমার ভেতর নমনীয়তা, সহনশীলতার অভাব দেখেছি আমি। যেটা কোন সংসারী নারীর জন্য মঙ্গলজনক নয়। মোটকথা, তুমি এখনো সংসারী নারী হয়ে উঠতে পারোনি। ”
” আম্মা, আপনি আমাকে এই কথা বলতে পারলেন? এই সংসারের জন্য কি করিনা আমি? সন্তানদের জন্য কি করিনা বলতে পারেন? এতকিছু করেও শেষমেশ অপবাদ জুটল আমার কপালে! ”
” কি করেছ তুমি সংসারের জন্য? নিজের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য তো নিহানের জীবন শেষ করে দিতে চাইছিলে। ছেলের ভালো চাইলে বিয়েতে এ্যাটলিষ্ট ওর মতামত নিতে। সেটা না করে তুমি নিজের ইচ্ছে, পছন্দ ওর ওপর চাপিয়ে দিয়েছ। এই সংসারের জন্য তোমাকে একটুও খাটতে হয়নি। তৈরী সংসার পেয়েছিলে। বিয়ের পর থেকেই নিয়াজের সাথে বিভিন্ন জায়গায় থেকেছ। শ্বশুর-শ্বাশুড়িরও সেবা করতে হয়নি। সংসারের জন্য কিছু না করেই হাঁপিয়ে গেছ? নিজের প্রশংসা নিজেই করছ। একবার চিন্তা করেছ, আশেপাশের মানুষজন তোমার সম্পর্কে কি ভাবে? ” এবার মুখ খুললেন আয়েশা সালেহার তৃতীয় পুত্রবধূ নাজমা আক্তার। তিনি শ্বাশুড়িকে হাঁপাতে দেখে তার হয়ে জবাব দিলেন।
” আমার সম্পর্কে আবার আশেপাশের লোকজন কি ভাববে! আমি কি ওদের সাথে মিশি নাকি? কথাও বলিনা তাদের সাথে। আমি গ্রামে আসলে নিজের মত থাকি। ”
” এটাই তো তোমার দোষ। নিজেকে কেউকেটা মনে কর। তুমি শুধু তোমার বাপের বাড়ির লোকজনকে প্রাধান্য দাও। আমরা ছাড়া বাকি সবাই তোমার কাছে ফেলনা। এই যে নিহানের বিয়ের আয়োজন করেছ। কত লোকজন এসেছে। আমরা এসে নিহানের বিয়েতে মাতব্বরি করলাম। নিহানের ফুপু কোথায় ছিল? এটা তার বাপের বাড়ি। তার ভাইয়ের ছেলের বিয়ে। কিন্তু সে এসেছে হলুদের দিন সন্ধ্যায়। কেন? কারন তুমি তাকে হলুদের দিন সন্ধ্যায় আসতে বলেছ। বেচারি এসেছে ঠিকই। আসার পর থেকেই ভয়ে ভয়ে থেকেছে। বৌভাতের দিন বিকেলেই সে চলে গেল। তুমি তাকে আটকালেওনা। এই বাড়ির মেয়ে হয়ে, সে দূরের আত্নীয়দের মত করে থেকেছে। যেখানে আমরা থাকব হাত-পা গুটিয়ে। কিন্তু তুমি আমাদের হাতে সব দ্বায়িত্ব দিয়েছ। একবার ভাবোতো, তোমার ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের বিয়েতে আমাদের বাপের বাড়ির লোকজন এসে কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে, আর তুমি গিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বসে আছ। আমাদের বাড়ির কোনকিছুতে হাত দেয়ার অধিকার তোমার নেই। কেমন লাগবে তোমার? ”
নাজমা আক্তারের কথা শুনে মিটিমিটি হাসছেন তার ছোট জা শাহনাজ পারভীন। তিনি উচিত কথা বলার জন্য নাজমা আক্তারের নাম রেখেছেন মেশিনগান। অবশ্য সেটা গোপনে। নাজমা আক্তার কাউকেই পরোয়া করেননা। দোষীকে চোখে আঙুল দিয়ে তার দোষ দেখিয়ে দেন।
আফরোজা নাজনীন শ্বাশুড়িকে ইশারায় বললেন নাজমাকে থামাতে। কিন্তু বৃদ্ধার মধ্যে তার বউমাকে থামানোর কোন প্রবনতাই দেখা গেলনা।
” ভাবী, তুমি আমাকে অপমান করছ? আমি তোমাদের এত ভালোবাসি, কিন্তু তোমাদের মধ্যে আমার প্রতি ভালোবাসার ছিঁটেফোঁটাও নেই। ”
” সত্যি কথাগুলোকে সব সময় অপমানই মনে হয়। আমি ভেবে অবাক হই, আমার শ্বশুর ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা , তার চার ছেলে সরকারি কর্মকর্তা। তোমাকে বিয়েও দিয়েছেন সরকারি কর্মতার সাথে। তোমার শ্বশুর ছিলেন শিক্ষক। একটা ভালো পরিবারের মেয়ে হয়ে তোমার আচরণ বস্তির মানুষের মত। এটা কিভাবে সম্ভব? তুমি নিজেকে ভালো মনে করলে কি হবে, তোমার প্রতিবেশিরা কেউই তোমাকে ভালো মনে করেনা। তোমার ভয়ে দৃষ্টি মেয়েটা এই বাড়িতে ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করছে। কুহু, শিহাবের চোখেও তোমার জন্য ভয় দেখেছি। তারা বারবার এই বাড়িতে আসতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। অথচ এটা ওদের চাচার বাড়ি। এই বাড়িতে ওদের অধিকার সবথেকে বেশি। কিন্তু তোমার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তুমি একজন ফ্যাসিষ্ট। নিজেকে ছাড়া কাউকে তুমি ভালোবাসোনা। ভালোবাসতে জানোনা। ”
” নাজমা, অনেক হয়েছে। এবার থাম। মানুষ ভুল করলে তাকে বোঝাতে হয়। এভাবে কঠিন কঠিন কথা বলতে হয়না। দেখবি রাখীকে আমরা বুঝিয়ে বললেইও বুঝবে। ” আফরোজা নাজনীন আর সহ্য করতে পারলেননা। রাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার দয়া হল৷
” আপনার ননদ যে কচি খুকি, তাই তাকে বোঝাতে হবে, বড় ভাবী? এর যদি বোঝার মত মন থাকত, তবে সে এমন আচরণ করতইনা। এ যদি আমার মায়ের পেটের বোন হত, তবে কবেই এর গাল থাপড়ে লাল করে দিতাম। ফ্যাসিষ্টগিরি ছুটিয়ে দিতাম। ”
” আমি কি তোমাদেরকে নিজের মেয়ে মনে করিনা, বউমা? রাখীকে শাসন করলে আমি কি তোমাকে বাঁধা দিতাম? শাসনের অভাবে এই মেয়েটা বেয়াদব হয়েছে। ওকে বুঝতে হবে, ও যা যা করে সবই অন্যায়। ও কায়েসের ছেলেমেয়েদের সাথে অন্যায় করছে, ও নিজের ননদের সাথে অন্যায় করেছে, নিজের স্বামী-ছেলের সাথে তাই করেছে। এবার ওকে শোধরাতে হবে। ও যদি না শোধরায় তবে, তোমার শ্বশুরের সহল সম্পত্তি থেকে ওকে আমি বঞ্চিত করব। ভুলেও মেয়ের পরিচয় দেবোনা। আমার বাড়ির দরজা ওর জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। ”
আম্মার কথা শুনে চমকে তার দিকে তাকায় রাখী। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আম্মা এই কথা বলল?
” আম্মা, এসব কি বলছেন আপনি? আমাকে আপনি পর করে দিতে পারেননা। ভাইয়ারা এসব মানবেনা। তারা প্রতিবাদ করবে। ”
” আমার কথার বাহিরে আমার একটা ছেলেও যায়না, এটা তুমি ভালো করেই জানো। তারপরও বোকার মত কথা বলছ কেন? তোমার ভবিষ্যতের আচার-আচরণই পারে আমার সিদ্ধান্ত বদলাতে। এবার ভেবে দেখ, তুমি কি চাও, কি করবে। ”
” রাখী, তোমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ভালোমন্দ বোঝার জ্ঞান তোমার আছে। তাই বলছি, যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। তোমার ছেলেরা আর ছোট নেই। ওরা ভালোমন্দ বোঝে। তোমার আচার-আচরণই কিন্তু ওদেরকে তোমার নিকটে নিয়ে আসতে পারে, আবার ওদেরকে দূরেও ঠেলে দিতে পারে। তাই সিদ্ধান্তটা তোমাকেই নিতে হবে। তোমার হাতেই সুখের চাবী। নিজের ভুলের জন্য সন্তানদের হারিয়ে পরে আহাজারি করার চাইতে, এখনি নিজেকে শুধরে নিয়ে সুখের সংসার গড়া কি উচিত নয়? ” আফরোজা নাজনীন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন।
” তুমি শুধরে গেলে ভালো। নয়তো আমাদেরকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। একবার তোমার ভাইয়েরা তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে কি হবে ভেবে দেখ। আমরা ঢাকা থেকেই তোমার প্রতিটা পদক্ষেপের খবর পাবো। তাই যা করবে ভেবেচিন্তে কর। ” আবারও হুমকি দিলেন নাজমা আক্তার৷
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৮
এতক্ষণ বাড়ির পেছনের বারান্দায় বসে সব শুনছিলেন নিয়াজ মাহমুদ। কেউ জানেনা তিনি এই মুহূর্তে ঐ বারান্দায় বসে আছেন । আবার নিয়াজও জানতেননা, এই রুমে এসব আলোচনা হবে। তবে সবকিছু শুনে তিনি হাসলেন। অনেক বছর পর তিনি একটু স্বস্তি পেলেন।