সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৩৫
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
মোজাইকের সিঁড়িগুলোয় যেন আমাবস্যা নেমেছে। সদ্য সন্ধ্যের সবটুকু দাপট এখানেই । এক গাদা কাপড় কোনওরকমে বাহুতে আগলে সুইচ টিপল পুষ্পিতা। অমনি ঝকঝকে আলোয় ভরে গেল সিঁড়িঘর। পুষ্পিতা ঘরে ঢুকতে গিয়েও থামে,
আড়চোখ ঘুরে চায় তীব্রদের ফ্ল্যাটে। ভ্রু বাঁকায় সহসা। যাওয়ার সময় তালা দেখেছিল,এখন তো নেই। স্যার কী ফিরেছেন?
তীব্রর কথা ভাবতেই, পুষ্পিতার বুক জুড়ে উচাটন নামে। সব কিছু আগের মত আবেগে ফেঁপে আসতে চায়। কিন্তু আজকে ওদের নদীর মতো বইতে সে দিলো না। বরং ক্লেশের সেই যন্ত্রণা গিলে নিলো সাগ্রহে । স্যার এলেও বা। ওর কী! সে তো এখন তনুজার।
স্যার নিশ্চয়ই তখন প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছেন? অবশ্য হওয়ারই কথা। তনুজা ভালো ঘরের মেয়ে। দেখতেও ভালো। কত প্রফুল্ল,চটপটে! ওর মতো সারাদিন ভয়ডরে নেতিয়ে থাকে না। ওর মতো এক পা ফেলতেও দশবার ভাবে না।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
পুষ্পিতা ঢোক গিলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঘরে ঢুকল নজরের সাথে মন ফেরানোর প্রয়াস নিয়ে। পারল কী? কে জানে!
কিন্তু দোর চাপানোর সেই শব্দ পৌঁছে গেল তীব্রর সজাগ কানে। সহসা নূহার মুখ ছেড়ে সরে এলো ও। মেয়েটা যেন এতক্ষণে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বুকে হাত দিয়ে রুদ্ধ শ্বাস ফেলল ক-বার। হাঁপানি রোগীর মত দম টেনে বলল,
“ আপনি এতো অভ…”
পুরো কথা উচ্চারণের আগেই, ফের মুখ চেপে ধরল তীব্র। ফুঁসে উঠল শিখার ন্যায়,
“ তুইত সুবিধের মেয়ে না। তোকে এখানে রাখা যাবে না। আয়..”
তারপর আরেকবার টানতে টানতে নূহাকে ভেতরে নিয়ে চলল তীব্র। মেয়েটা তখন স্তব্ধপ্রায়। যে ভয় জেগেছিল মনে? বিস্ময়ের দোলাচলে ছাপিয়ে গেল সব। তীব্রর মুখের “তুই’’ শব্দ লেলিহানের ন্যায় ঝাঁঝিয়ে তুলল কান। মনে পড়ল সেই প্রথম সাক্ষাৎ-এর দিন। যে মানুষটা অভিভাষণ শুরু করেছিল আপনি-আজ্ঞে দিয়ে। আলাপচারিতায় বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘’ জি ভালো আছি,আপনি?”
অথচ ভেতর ভেতর তার আচরণ এতটা নিকৃষ্টও?
তীব্র জোরালো পায়ে নিজের ঘরে এলো। নূহাকে কাছ থেকে ছিটকে ফেলল ভেতরে। বিদ্যুৎ বেগে ছিটকিনি তুলল দরজার। মেয়েটা আঁতকে উঠল অমনি,
“ দরজা আটকালেন কেন? কী মতলব আপনার? দেখুন,বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু আমি সবাইকে সব…”
তার চ্যাঁচামেচির মাঝে তীব্র চোখ বুজে দাঁত পিষে ধরল।
দরজার পাশের দেয়াল ঘেঁষেই একটা ছোট্ট টেবিল বসানো। ওপরে এক ঝুড়ি ফলের কাছে চকচক করছে ছুড়ি। প্রখর আক্রোশে সেটা হাতে নিয়েই তেড়ে এলো তীব্র। গাত্রের সমস্ত রক্ত অবধি ছলকে উঠল নূহার। মুখ খোলার আগেই, তীব্র ক্ষ্যাপা ষাড়ের ন্যায় নিকটে আসে। শক্ত মুঠোয় গলা টিপে দেওয়ালে মিশিয়ে নেয় । নূহার মুখ-চোখ ফ্যাকাশে। ছুড়ির ধারালো ডগা কণ্ঠনালী বরাবর তাক করেছে তীব্র। হুঙ্কার ছুড়ল সাথে,
“ একদম চুপ। ভুলে যাবি না আমি এখন তীব্র নেই। তুই বিট্টু মাস্তানের সামনে দাঁড়িয়ে আছিস। এতটাও সাহস দেখাতে আসিস না।”
নূহা ঢোক গিলতে চাইল। অথচ তীব্র গলা এত শক্ত করে ধরেছে। দম আটকে আসছে প্রায়। সর্বদা ফটফট করা মেয়েটা তুঁতলে উঠল কথা বলতে গিয়ে,
“ ককী কররতে চচাইছেন আপপনি? ছাড়ুন আমাকে। পুষ্পিতা আপনার এই রূপ দেখলে, কতটা ঘৃনা করবে আপনাকে আপনি নিজেও জানেন না।”
তীব্র বাঁকা হাসল। রক্তে মাখোমাখো চোখদুটোতে নূহাকে ঝলসে দেয়ার ইচ্ছে।
“ কে বলবে ওকে? তুই? কীভাবে বলবি? আজকে যদি তোকে এখানেই পুতে ফেলি? তোর জ্বিভটা কেটে ওয়াশরুমে ফ্ল্যাশ করে দেই? তখন?”
আনন্দ চিত্তে ভ্রু উঁচায় সে। আতঙ্কে নূহার বুকটা ধ্বক করে উঠল। পিঠের হাড় চুইয়ে নেমে চলল উষ্ণ ঘামের ধারা।
কপালের দরদর করা নদী, রেখার মতো ঘাড় অবধি আসে। শঙ্কায় শরীর চূর্ন হলেও, নূহা ধরা দিতে চাইল না।
অটল কণ্ঠে থেমে থেমে বলল,
“ আপনার কোনও হুমকিতেই আমি ভয় পাচ্ছি না। একটা মাস্তানের থেকে আর কী আশা করা যায় বলুন তো! অবশ্য রাগ তো আমার নিজের ওপর হওয়া উচিত। এতগুলো দিন ধরে আপনি ওই অনাথ মেয়েটাকে ঠকিয়ে গেলেন,অথচ আমি? আমি কী না আপনার সম্পর্কে ভালো করে না জেনেশুনে ওকে এসবে এগিয়ে দিয়েছিলাম? ছি! আপনার মতো নোংরা,জঘন্য মানুষ তো…”
তীব্র চ্যাঁচিয়ে উঠল মাঝ পথে,
“ হ্যাঁ তাই। আমি জঘন্য, আমি নোংরা। আমি ঠকিয়েছি তো? আচ্ছা, যা করেছি, বেশ করেছি।”
নূহা হতবাক হয়ে বলল,
“ বেশ করেছেন?”
তীব্র ছেড়ে দিলো ওকে। প্রতাপ সমেত বলল,
“ ইয়েস। বেশ করেছি। বিট্টু মাস্তানকে চিনিস তুই? জানিস সে কেমন? এই মাস্তানটা একসময় যা করত,সব নিজের আনন্দের জন্য। আর এখন,এখন সে ভালোবাসার জন্য করছে। তাতে অন্যায়ের কী আছে? এভ্রিথিং ইজ ফেয়্যার ইন লাভ এন্ড ওয়্যার।”
বলতে বলতে ডানার মতো দুহাত মেলে দেয় সে।
নূহা তুচ্ছ হাসল।
“ আপনি বলছেন ভালোবাসার কথা? ভালোবাসা কি আপনি বোঝেন?”
তীব্র তুরন্ত ছুড়ি ধরতেই ও ফের ঠেকে গেল দেওয়ালে। তীব্র এবার থামল না। শাণে জ্বলজ্বল করা ছুড়ি নূহার গালে বুলিয়ে বলল,
“ জীবনে অনেক পাপ করেছি। কিন্তু এখনও কোনও মানুষ খুন করিনি। তুই আমার এই রেকর্ড ভাঙতে চাইছিস তাই না? একটা কথা পরিষ্কার শুনে রাখ নূহা,যা হচ্ছে সেসব আমার আর আমার ভিতু মেয়ের ব্যাপার। এর মাঝে যে আসবে তার প্রতি বিট্টু মাস্তান সদয় হবে না কিন্তু। তাকে এক কোপে আমি টুকরো টুকরো করে ফেলব। এতে বিন্দু মাত্র হাত কাঁপবে না আমার।”
রক্তশূন্য চেহারায় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল নূহা। মুখে টু শব্দ নেই। অথচ
তীব্র চিৎকার করে উঠল,
“ তুই আমাকে দোষ দিচ্ছিস? আমার দোষ? আর তোর বন্ধুর, তার কোনও দোষ নেই? এসব কার জন্যে হয়েছে? ওর জন্যেই তো। ওকে ওই সময় বাড়ির পেছনে আসতে কে বলেছিল? ও না এলে শাফিন ওকে তুলে নিয়ে যেত? ওকে তুলে না নিলে আমি ওকে দেখতাম?”
নূহার মনে হলো কোনও দাপুটে মাস্তান নয়,সে এক শিশুর যুক্তি শুনছে।
তীব্র উন্মাদের ন্যায় বলে যায়,
“ ওর মাঝে কী আছে হ্যাঁ? ও কি বিশ্বসুন্দরী? পৃথিবীতে ওর একার চোখ সুন্দর? ভয় পেলে ওর একার ঠোঁট কাঁপে? কাঁদলে ওর একার নাক লাল হয়? হয় না । তাহলে আমার কেন ওকে ভালো লেগেছিল? এর জন্য কে দায়ি? আমি? না। ও দায়ি, ওই পুষ্পিতা দায়ী। ওইটুকু মেয়ে আমার মত একটা মাস্তানকে টেনে এনেছে গাজীপুরে। কী করিনি আমি ওর জন্যে? প্রথম বার শার্টের সব কটা বোতাম লাগিয়েছি। এই, এই দ্যাখ,এই দ্যাখ.. দ্যাখ।
তীব্র বোতামের কাছটা খামচে ধরে টানল। ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে দেখাল নূহাকে। মেয়েটা বুদ্ধিভ্রষ্টের ন্যায় দাঁড়িয়ে।
সে হড়বড়িয়ে বলে,
“ আমার এত বছরের মাস্তানি,আমার ডেরা, আমার বন্ধুদের,আমার দলবল, আমার মা সব ছেড়ে আমি এখানে এসে উঠেছি। যে বিট্টু কোনওদিন নিজের জন্য পড়েনি। ভার্সিটির প্রফেরসরদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে সেমিস্টার পার করেছে,
সে একজন ভুয়া শিক্ষক সেজে বসে আছে এখানে। প্রতিদিন রাত জেগে পড়ে, দিনের বেলা ক্লাস করানো কত কষ্ট তুই জানিস? জানবি কী করে? তুই তো শুধু ফটরফটর ছাড়া কিচ্ছু পারিস না। এসব করেছিস কখনও?
তীব্র নিজের বুকে জোরে জোরে থাবা মেরে বলল,
“ আমি করেছি,আমি। কেন করেছি? তোর ওই বন্ধুর কাছাকাছি থাকব তাই। শালার যে আমি কখনও আস্তে কথাই বলতে পারতাম না,তাকে এখন সবার সাথে বিনয় দেখাতে হয়। আশি বছরের বুড়ো যেখানে আমাকে চার আঙুল ঠেকিয়ে সালাম দিত,সেই আমি এখন অন্যকে সকাল-সন্ধ্যা স্যার বলে ডাকি। তুই ছাড়া আমার মুখে কোনও শব্দ ছিল না যেখানে, সেখানে আমাকে ভদ্রের প্রতিনিয়ত নাটক করতে হচ্ছে।
একটা মাস্তানকে তোর বন্ধু উত্তম কুমারের ম্যারম্যারে গান শিখিয়েছে। ভালো কাজ,ভালো মানুষ, মানুষ মানুষের জন্য, স্যার বিপদে সবাইকে সাহায্য করা উচিত, এসব বলে বলে আমার কী অবস্থা করেছিল যে আমার এতদিনের মাস্তানি আমি এক দিনে ধ্বংস করে দিয়ে এসেছি। কেন করেছি এসব? হ্যাঁ? তোর ওই বন্ধুর জন্যে। তাহলে দোষ কার? কার অন্যায়? ওর। পুষ্পিতার অন্যায় এসব। আমি ওকে ভালোবেসে এসব করছি। ভবিষ্যতেও করব। আমার যা ইচ্ছে হবে আমি তাই করব। ও কেন আমাকে উষ্কে দিয়েছিল? ও কেন রাত নেই,দিন নেই চোখের সামনে ঘুরঘুর করত আমার? আমি কি ওকে ডেকেছিলাম? তাহলে কেন এসেছিল বল? বল? তোর কাছে উত্তর আছে এসবের? হাঁ করে কী দেখছিস, আছে উত্তর?
নূহা মুখ খুলল না। বললও না কিছু। শুধু জড়ের মত মূক দুটো নয়ন মেলে রইল। তীব্র হাঁসফাঁস করে ছুড়ি ছুড়ে মারল। মত্তের ন্যায় চুল খামচে ধরল মাথার। প্রলাপ করল বিড়বিড়িয়ে,
“ ওই মেয়ে আমায় পাগল করে দিচ্ছে। খেতে দেয় না ,ঘুমোতে দেয় না। আমি ঠিক করে কিছু করতেই পারছি না ওর জন্য। শুধু ওর দিকে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ওর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ, ওর চুপসে থাকা মুখ,ওর হাসি সারাক্ষণ আমার মাথার মধ্যে কিলবিল করে বেড়ায়। কোন জন্মের শত্রুতা মেটাচ্ছে ও হ্যাঁ? আমি কি ওকে চিনতাম? ও কেন এসেছিল সেদিন, কেন?”
বলতে বলতে আস্ত টেবিল উলটে দিলো তীব্র। জগ-গ্লাস থুবড়ে পড়ল ফ্লোরে। কাঁচ গুলো ভেঙেচুরে ছড়িয়ে গেল চারদিক। নূহার অন্তরাত্মা লাফিয়ে বেড়ায়। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। তীব্র নিজেতে নেই। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য সে।
রাগে-আক্রোশে জোরে জোরে ঘুষি মারল দেওয়ালে। নূহা কেঁদে ফেলল। শব্দ পেয়ে আগুন চোখে ফিরল তীব্র।
“ তুই ভিতু মেয়েকে সব বলে দিবি তাই না? আমার এত কষ্ট,এত পরিশ্রম সব নষ্ট করে দিবি? তুই এখন মুখ খুললে তো ভিতু মেয়ে আমাকে ভালোবাসবে না। ভালোবাসবে কী, কাছেই তো আসবে না । সেই আগের মত পালিয়ে বেড়াবে। আমাকে দেখলে,আমার কথা শুনলে যেভাবে ভয় পেতো অমন করবে। তাহলে কী হবে? আমার তো ওকে লাগবেই। আই নিড হার ব্যাডলি! আমি ওকে ছাড়তে পারব না। আমি ওকে ভালোবাসি। ও দূরে যাবে কেন? না না।
আমি কিন্তু তোকে সত্যিই খুন করে ফেলব। ছুড়িটা কোথায় গেল?”
তীব্র আশেপাশে চাইল। তার হন্যে দুই চোখ ছুড়ি খুঁজছে। নূহা ভেজা চোখ মুছল। দম টেনে শক্ত করল চিবুক। পায়ের কাছ থেকে ছুড়িটা তুলে বাড়িয়ে ধরল ওর দিকে। বলল মিহি স্বরে,
“ নিন।”
তীব্র থামে,থমকায়। সহসা গাঢ় ভাঁজে গুছিয়ে আসে কপাল। এক পল ছুড়ির দিক চেয়ে নূহার দিক দেখল। ও বলল,
“ নিন ধরুন। মারবেন না আমাকে? মারুন। তবে গলা কাটবেন না। এসবে অনেক কষ্ট। আপনি বরং সিনেমার মত পেটে ঢুকিয়ে দিন। তাহলে সব ল্যাটা চুকে যাবে।”
তীব্র বিভ্রান্ত হলো। ছুড়িটা কেড়ে নিলো তবে। কর্কশ কণ্ঠে বলল,
“ নাটক করছিস আমার সাথে?”
ও মুখের ওপর বলে দেয়,
“ না। আপনার মত এতো ভালো নাটক আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি পুষ্পিতাকে আমি কিছুই বলব না।”
তীব্রর ললাট রেখা প্রগাঢ় হলো। সন্দিহান তার চাউনী।
নূহা নিজেই বলল,
“ ভাববেন না আপনার গলা কাটার হুমকিতে ভয় পেয়েছি। ওসব আমার গায়েও লাগেনি।”
মেয়েটার কণ্ঠে চোটপাটের রাজত্ব। একটু আগেই যে মারাত্মক ভয়ে কেঁদে ফেলেছিল, থমকে গেছিল বক্ষস্পন্দন? এসব ও কিছুতেই বুঝতে দেবে না। তবে পুষ্পিতাকে কিছু না জানানোর সিদ্ধান্ত ভিন্ন। ভয় পেলেও নূহা দমে যেত?
তীব্র কি বোকা? মেয়েটার কথায় চতুরের ন্যায় হাসল সে।
সন্দেহী কণ্ঠে বলল,
“ তাহলে? এই তো একটু আগে লাফালি সব বলে দিবি,বলে দিবি করে। হঠাৎ মত বদলের কারণ?
নূহা উত্তর দিলো না। ভেজা কণ্ঠে পালটা প্রশ্ন ছুড়ল,
“ আপনি কি সত্যিই পুষ্পিতাকে এতটা ভালোবাসেন স্যার?”
তীব্রর শক্ত গড়ন বদলে যায়। নিভে আসে উষ্ণ চোখ।
নূহার কোটর দুটো ছলছল করে উঠল। মনস্তাপে হাবুডুবু খেল কণ্ঠস্বর,
“ আসলে পুষ্পিতাটার অনেক দুঃখ জানেন। ছোটোবেলা থেকেই তো দেখছি ওকে। যে বয়সে আমি বাবার কোল চড়ে খেলনা কিনতে যেতাম? সেই বয়সে ও খোরশেদ চাচার জুতো মুছে দিতো। যে বয়সে মা আমার পেছনে খাবার সমেত ছুটতেন? সেই বয়সে ও মিথিলার জামা আয়রণ করত। যখনই আমাদের বাসায় আসতো না? বাবার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকত পুষ্পিতা। চোখে টইটুম্বুর জল নিয়ে ছুটে পালিয়ে যেত আবার। তখন ওসব বুঝতাম না। কিন্তু এখন বুঝতে পারি,পুষ্পিতাটা আমার বাবার মধ্যে ওর বাবাকে খুঁজে বেড়াতো৷ আমাদের পরিবার দেখে নিজের পরিবারের জন্যে কাঁদত।
ও ছোটো থেকেই এত নরম গোছের,শান্ত মেয়ে না? একদম আমার উলটো। সেজন্য আমার অন্য রকম একটা মায়া জন্মেছিল ওর প্রতি। আমিই ওকে ডেকে ডেকে মিশতাম। এমন করতে করতে কখন যে ও আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। তারপর জানলাম মেয়েটার নিজের বলতে কেউ নেই। এই গোটা পৃথিবীতে ও একটা বিন্দুর মতো একা। হ্যাঁ, সালমা আন্টি ওকে খুব আদর করেন! কিন্তু মা তো মা-ই হয় বলুন!
সত্যি বলতে আমি, আন্টি ছাড়া পুষ্পিতাকে নিঃস্বার্থ ভাবে কেউ কখনও ভালোবাসেনি। আত্মীয় স্বজন সবাই ওকে এতো করুণার চোখে দেখত না? তারওপর মেয়ে মানুষ। বাগে পেলেই কাজের লোকের মতন খাটিয়ে নিতো সবাই। শেষ বার যখন পুষ্পিতা চরিত্র নিয়ে কথা শুনল? অপমানিত হয়ে বাড়ি ছেড়ে এলো? সেসময়ও আমি মন-প্রাণ দিয়ে চেয়েছিলাম এই দুঃখী মেয়েটার জীবনে এমন কিছু ঘটুক যাতে ওর সব দুঃখ মিটে যাবে। যে কোনও স্বার্থে নয়, ভালোবাসার জন্যেই ভালোবাসবে ওকে। মন খুলে হাসবে পুষ্পিতা। প্রানবন্ত হবে।”
থামল নূহা। গাল বেয়ে চোখের জল গলার ভাঁজে এলো। ঘরজুড়ে নীরবতা নামে। তীব্র মনযোগ দিয়ে শুনছে।
ও ফিরে চাইল এবার। চোখেমুখে আনন্দ নিয়ে বলল,
“ এমন হয়েছিল স্যার। আপনি আসার পর সত্যিই এমন হয়েছে। যেদিন আপনার জন্যে দুটো ছেলেকে পুষ্পিতা থাপ্পড় মেরেছিল? সেদিন ওর মুখের আলোটুকু আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওভাবে হাসতে,খুশি হতে আমি ওকে কোনওদিন দেখিনি। আপনি আসার পর থেকেই পুষ্পিতার মধ্যে কী চমৎকার বদল এসেছিল! হাসত,গল্প করত,কথা বলত। অল্পতে ঘাবড়ে যেতো না। ভয় পেতো না। আপনি নিজেও জানেন না,ম্যাজিক শুধু আপনার ক্ষেত্রে নয় ওর ক্ষেত্রেও হয়েছে।”
তীব্র চোখ নামায়। শুভ্র দাঁতে চেপে রাখে নিচের ঠোঁট। নূহা বলেই গেল নিজের মতোন,
“ আমি ভেবেছিলাম আপনি পরিচয় লুকিয়ে পুষ্পিতার ক্ষতি করতে চাইছেন। ওর কাছেই শুনেছিলাম তো,ওদের বাড়ি থেকে থানা-পুলিশ হলে আপনি ওকে আবার তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। সেজন্যেই খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।
কিন্তু একটা মাস্তানের মাঝেও যে ভালোবেসে এমন আমূল পরিবর্তন আসতে পারে তা জানতাম না।
আপনি রাগের মাথায়, বেখেয়ালে আমাকে আপনার সব সত্যি বলে দিলেও আমি কিন্তু পুরোটা মন দিয়েই শুনেছি স্যার৷ তেমন অবাকও হয়েছি আপনার প্রত্যেকটা কথায়। এতোটাও ভালোবাসা যায় কাউকে? সত্যিই কি পৃথিবীতে এত গভীর ভালোবাসা বলতে কিছু আছে? আপনার চোখেও পুষ্পিতাকে হারানোর স্পষ্ট ভয় দেখেছি আমি। তাহলে আপনিই বলুন স্যার, যে মানুষটা আমার ওই দুঃখী বন্ধুটাকে ভালোবেসে এত কাঠখড় পোহালো,তার অনিষ্ট আমি করি কী করে? পুষ্পিতাকে আপনার থেকে দূরে সরিয়ে দিলে, আমার সেই পাপ কি আদৌ ক্ষমার যোগ্য হবে?”
তীব্রর মুখায়ব শান্ত৷ এতটা সময়ের দপদপে অনল ঘেরা নয়ন নিশ্চল হলো একটু৷ অথচ অনিশ্চয়তার বাণ ছুড়ল প্রশ্নে,
“ কোনওরকম চালাকি করছো না তো? এখান থেকে বেরিয়ে ঘোল পালটে…”
নূহা কথা কেড়ে নেয়। সিক্ত চোখ মুছে বলে,
“ আমি আমার আল্লাহর নামে কসম করে বলছি স্যার। এবার অন্তত বিশ্বাস করুন। নূহা এমনিতেও মনে এক আর মুখে আরেক কথা বলার মেয়ে নয়।”
এতক্ষণে স্বস্তির শ্বাস ফেলল তীব্র। নূহা এগিয়ে আসে। তেজের জোয়ার ভরতি বরাবরের সেই কণ্ঠস্বর,আজ বদলে যায় অনুরোধে।
“ আপনার ভালোবাসা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে আপনার মতো পুষ্পিতাটাকে কেউ ভালোবাসতেই পারবে না। তাই শুধু একটা জিনিসই চাইব স্যার, যে মেয়েটা ছোটো থেকে এত অবহেলা,অনাদরে বড়ো হয়েছে তার জীবনে আপনি সুখ হয়েই থাকবেন। কখনও একটুও দুঃখ দেবেন না ওকে। প্লিজ স্যার! একবার যখন ওর হাত ধরার কথা ভেবেই নিয়েছেন,যা কিছু হোক ছেড়ে দেবেন না যেন।”
তীব্র মুখে কিছু বলল না। হয়ত বলতে পারল না। চেয়ে রইল অমন। অথচ মনের মধ্যিখানটা চিৎকার করল সাথে সাথে,
“ ভিতু মেয়েকে ছাড়ব আমি? যাকে আমি নিঃশ্বাসের মতো ভালোবাসি,তাকে ছাড়লে আমার কী হবে?”
পুষ্পিতা কাপড় ভাঁজ করল। ঘরের জানলা লাগিয়ে পর্দা ছড়িয়ে দিলো। চা বসাল রান্নাঘরে এসে। চুল আচড়ে হাত খোপা করল। এতগুলো কাজ শেষ, অথচ নূহার কোনও খবর নেই। এতক্ষণ সে ভেবেছিল হয়ত মায়ের ঘরে আছে। কাল থেকেই তো নূহার পরীক্ষা শুরু।
কিন্তু ওই ঘরে উঁকি দিয়ে যখন দেখল কেউ নেই,তখন চিন্তায় পড়ে গেল পুষ্পিতা। দরজাও ঠা করে খোলা ছিল। নূহা বাড়িতে নেই। ওয়াশরুম,বারান্দা সব খালি। গেল কোথায় তাহলে? নূহার মুঠোফোনটা চার্জে বসানো দেখে ভেতর ভেতর আরো ঘাবড়ে গেল মেয়েটা৷ এইবার অপেক্ষায় আর বসে থাকা যায় না।
পুষ্পিতা তড়িৎ ঘরের বাইরে এলো। ছাদে তো ও থাকাকালীন নূহা আসেনি। নিচে নামল না তো! পুষ্পিতা দরজার হূক বাইরে থেকে আটকায়। গায়ের ওড়না মাথায় প্যাঁচিয়ে নামতে যাবে নিচে, আচমকা তীব্রদের ফ্ল্যাটের দরজা খুলল। শব্দ শুনে থামল ও। মনের কোণে উঁকি দেয়া আশা,স্যার বের হচ্ছেন! মানুষটাকে দেখার ইচ্ছেতে চকিতে ফিরল ওদিক। কিন্তু তীব্র নয়! বেরিয়ে এসেছে নূহা।
পুষ্পিতা চমকে গেল খুব!
অবাক হয়ে বলল,
“ তুই এতক্ষণ এখানে ছিলি?”
নূহা এতটাই অন্যমনস্ক ছিল, হঠাৎ কথায় লাফিয়ে পিছিয়ে গেল এক পা ৷ বুকে হাত চেপে চোখ বড়ো করে চাইল ওর দিক। পুষ্পিতা আরো বিভ্রান্ত হয়।
এগিয়ে আসে দ্রুত। কিছু বলতে মুখ খুলবে,আচমকা চোখ পড়ল ভেতরে। নূহার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে তীব্র। হাত দিয়ে খুব জোরে জোরে অগোছাল চুল ঠেলছে ওপরে।
তার চোখমুখ ঠিক নেই। অবিন্যস্ত চেহারায় কীসের একটা ভয়। একইরকম ভীতি নূহার মুখেও। ভীতসন্ত্রস্ত চোখে একে-অপরকে দেখছে তারা।
এই শূন্য ঘরটার মধ্যে এতক্ষণ ওরা দুজন ছিল। গোটা তিনতলাতেই পুষ্পিতা ছাড়া আর একটা কাকপক্ষীও নেই। এখন তাদের এইভাবে দেখে মেয়েটা যদি ভুল বোঝে!
তীব্রর বুক কাঁপছে। ভিতু মেয়ে ওর চরিত্র খারাপ ভাববে না তো! ও যে নূহাকে ছুঁতেও চায়নি। অতিরিক্ত ভয়,টেনশান থেকে কী করে ফেলেছে নিজেও জানে না। কিন্তু যাই হোক,খারাপ ভাবে তো স্পর্শ করেনি। এই পৃথিবীতে তার চোখদুটো বেহায়া হতে চায় শুধু পুষ্পিতাকে দেখতে। হাতদুটো অশ্লীল হতে চায় শুধু পুষ্পিতাকে ছুঁতে। ভিতু মেয়ে কি বুঝবে এসব!
পুষ্পিতার নয়ন জোড়া তীব্রর ওপর আটকে। সন্দেহ তো দূর,মেয়েটার মাথায় এসব এলোও না। শুধু দৃষ্টিদ্বয়ে লেপটে রইল তিক্ত কিছু বিষাদ। কল্পের জোর গল্প সাজাল অনাকাঙ্ক্ষিত কতক দৃশ্য নিয়ে। তখন তনুজা স্যারের অফিস রুমে ঢুকেছিল। তারপর ফুল বাড়িয়ে দিয়ে কী বলেছিল?
“স্যার,আমি আপনাকে ভালোবাসি!” আর স্যার,স্যার নিশ্চয়ই বড় আনন্দ সমেত হাতে নিয়েছে ওসব! নেবেই তো। না নেওয়ার কোনও কারণ কি আছে?
আচ্ছা,কাল থেকে কলেজে গেলে কী দেখবে পুষ্পিতা? স্যার-তনুজার চোখাচোখি? চাউনীতে প্রেম লেনদেন? এসব দেখে ও বেঁচে থাকতে পারবে? প্রতিটা মুহুর্তে ভেতর ভেতর মরে যাবে না?
পুষ্পিতার হরিণী আঁখি গুমড়ে উঠল ব্যথায়। কিন্তু সেই ব্যথা নূহার ভয়ের কাছে ধরা পড়ল না।
সে মিনসে কণ্ঠে শুধাল,
“ ততুই এখানে?”
পুষ্পিতা যেন হুশে এলো। নড়ে উঠল একটু! চোখ সরিয়ে মৃদূ গলায় জানাল,
“ তোকে পাচ্ছিলাম না ঘরে। তাই খুঁজতে এসেছিলাম। চা বসিয়ে এসেছি, আয়।”
পুষ্পিতার কথায়,কণ্ঠে সন্দেহের আঁচ মাত্র নেই। এতক্ষণে গলায় আটকে থাকা বন্দি শ্বাস ফেলল নূহা। তীব্রকে ঘুরে দেখল একবার। ঠোঁট দুটোতে বিজয়ী হাসির স্রোত নিয়ে বোঝাল,
“ দেখলেন আমার সরল বন্ধুটাকে?”
তারপর মুচকি হেসে বলল,
“ আচ্ছা যাচ্ছি।”
পুষ্পিতার পাশ কাটিয়েই ঘরের ভেতর ঢুকতে গেল নূহা। তীব্র তখনও চৌকাঠেই দাঁড়িয়ে। পুষ্পিতা তাকে এড়িয়ে যেতে চায়। অন্যের ব্যক্তিগত পুরুষ নিয়ে এখন ভাবা অন্যায় । মন,মুখ শক্ত করে মেয়েটা ঘুরে পা বাড়াল যেতে। চট করে হাতটা টেনে ধরল তীব্র।
পুষ্পিতা ভরকে চাইল। বিস্মিত হয়ে বলল,
“ জি?”
তীব্রর ভ্রু শিথিল। জিজ্ঞেস করল,
“ তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
পুষ্পিতা একবার হাতটা দেখল নিজের। যেখানে তীব্র ধরেছে। তারপর আড়চোখে চাইল নূহার দিকে। স্বীয় দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সে। তীব্র এতদিন যতটুকু ঘনিষ্ঠ হয়েছে, সব ওকে একা পেয়ে। নূহার সামনে আজই প্রথম। পুষ্পিতা এত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। নূহা কী ভাববে!
অথচ মেয়েটা মিটিমিটি হেসে ঢুকে গেল বাসায়।
তীব্র তখনই বলল,
“ এদিক-ওদিক কী দেখছো? আমার দিকে তাকাও।”
পুষ্পিতা তীরস্থ হয়ে চাইল।
ফের বলল,
“ জি!”
তীব্র চ সূচক শব্দ করে বলল,
“ ওহঃ প্লিজ! এই জি জি ছাড়া আর যা ইচ্ছে বলো।”
পুষ্পিতা মাথা নোয়াল। নিষ্পাপের ন্যায় শুধাল,
“ কী শুনতে চান?”
তীব্র প্রেমিক রূপটা চট করে সত্ত্বায় ফিরে আসে। লম্বাটে দেহ নিয়ে ঝুঁকে গেল একটু!
ফিসফিস করল ধরা গলায়,
“ এমন কিছু! যা তুমি আমাকে বলতে চাও,কিন্তু পারছো না!’’
কানের পর্দায় তীব্রর উষ্ণ শ্বাসের বাড়িতে পুষ্পিতার সমস্ত শরীর শিরশিরিয়ে উঠল। গলা শুকনো কাঠ। যেখানে আগুন দিলেই দাউদাউ করে জ্বলেপুড়ে যাবে। সেই স্যার আবার কাছে আসছেন?
নিভু নিভু দৃষ্টিটা তুলতে চেয়েও নামিয়ে আনল সে। উত্তরে বদলে টিপে ধরল পুরন্ত দুটো ঠোঁট। এক পশলা বিষাদ ঘেরা মনটা বলল,
সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৩৪
“ সেসব আর কোনও দিন বলা হবে না স্যার। ভাগ্য যে এর আগেই আপনাকে অন্যের করে দিয়েছে!”
পূর্নিমার চাঁদের চেয়েও সুন্দর, অথচ অমানিশায় ঘনিয়ে থাকা মুখখানার দিকে এক ভাবে চেয়ে রইল তীব্র। চাউনীতে তার নড়ন নেই। পল্লবে পতন নেই। শুধু
মোহগ্রস্তের ন্যায় ভাবল,
“ আমি কিছু শুনতে চাই না ভিতু মেয়ে।
শুধু চাই, তুমি আমায় এতটাই ভালোবাসো যাতে তোমাকে ছাড়া আমার শ্বাস-প্রশ্বাসও বন্ধ হয়ে আসবে।”