সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৩৯
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পুষ্পিতার মনের ভেতর গলা ফাঁটাল,
“ ক্লাস গোল্লায় যাক। এই মুহুর্তে আপনার থেকে আমার কাছে দামি কিচ্ছু নেই। আমি আর আপনাকে ভুল বুঝব না স্যার। আর কক্ষনও না জেনেবুঝে আপনাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা ভাবব না।”
তরুণীর অন্তঃপটের তোলপাড় ছাপ ফেলল মুখবিবরেও। কিন্তু এত অব্যক্ত কথা তীব্র কি বুঝেছে? হয়ত,হয়ত না। তবে এর মাঝেই স্বীয় কক্ষ ছেড়ে প্রিন্সিপাল বেরিয়ে এলেন। পুষ্পিতার পেছনে ওনাকে দেখে তীব্র নড়েচড়ে দাঁড়াল। এই এক লোক! কলেজে আসা থেকে তার পেছনে পড়ে আছেন। কেন ফোরকানের ওর প্রতি এক্সট্রা তোষামোদ,সেটা ওনার যাচাই করা চাই-ই চাই।
তীব্রর নজর তখন ভদ্রলোকেই। এইতো পুষ্পিতাকে ওর পাশে দেখে কপাল কুঁচকে ফেলেছে। ঝড়ের গতিতে হেঁটে আসছে এদিকে।
তীব্র ব্যস্ত ভাবে বলল,
“ ক্লাসে যাও । স্যার আসছেন!”
তারপর সোজা লাইব্রেরির পথ ধরল সে। অনুকূলের পরিস্থিতি হুট করে বদলে যাওয়ায় প্রিন্সিপাল নিজেও দাঁড়িয়ে গেলেন। কিন্তু পুষ্পিতার এতো মন খারাপ হোলো! ও যা বলতে এসেছিল,
স্যার তো শুনলেনই না।
কিছুক্ষণ তার যাওয়ার দিকে ঠোঁট উলটে চেয়ে,হুট করে হাসল পুষ্পিতা। স্যার আর ওর গন্তব্য তো একই। এখন না হয় চলে গেছে। তাতে কী! ছুটির পরে তো বাড়ি একইসাথে ফিরবে। তখন যা বলার ছিল,সব বলে দেবে পুষ্পিতা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পুষ্পিতা ভেবেছিল কলেজের বাইরে তীব্র থাকবে। যেমনটা সব সময় হয়! মানুষটা ওর জন্যে জিপ নিয়ে অপেক্ষা করে। কিন্তু আজকে সে নেই। পরশুর মতোন হুস হুস করে জিপ টেনে কোথাও একটা চলে গেছে । সারাপথ এই নিয়ে রিকশায় মুখ গোঁজ করে বসেছিল বেচারি। যেই মাত্র ও মানুষটার প্রেমে একটু গভীর ভাবে পড়ল,অমনি তার পালাই পালাই শুরু।
*** নূহার পরীক্ষা শেষ হতে হতে বেলা তিনটা বেজে গেছে। পরীক্ষা ভালো হয়েছে যদিও! বলতে গেলে যা ভেবেছিল,যতটুকু ভেবেছিল তার থেকেও অনেক বেশি ভালো। অথচ কী পাহাড় সমান মন খারাপ নিয়ে ঢুকেছিল হলে! প্রশ্নপত্রে চোখ বোলাতেও যেন হাজার টন ক্লান্তি।
তাও সব ঘোড়ার গতিতে লিখে এসেছে। কিন্তু এমন মিরাকল মেয়েটার জীবনে আজ অবধি কোনওদিন হয়নি। নাহিদকে নিয়ে ভাবতে বসে এতোদিন যা যা পড়েছিল? বেমালুম ভুলে গেছিল সেসব। উত্তরপত্রে কলম ছোঁয়ানোর আগেও নূহার মাথায় কিচ্ছুটি ছিল না। তাও..
আচ্ছা, এসব কী তাহলে ঢেঁড়সটার প্রেমে পড়ার টনিক!
গেট পেরিয়ে ঢুকতে ঢুকতে নূহা আনমনে হাসল। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা ফেলবে, আচমকা পিছু ডাকল তীব্র।
“ নূহা!”
চকিতে ফিরে চায় সে। তীব্র একা নয়,সাথে নাহিদও আছে। প্রথমবার ওকে দেখে নূহার মেয়েলি শরীর গুটিয়ে আসে। পিঠের হাঁড় ছুঁয়ে দুধ সাদা সফেদ স্রোত কলকলিয়ে বয়ে যায়। সাথে কাঁধের ওপর আষ্ঠেপৃষ্ঠে এক পশলা জড়োতা এসে ভিড়ল। দেহের ভাঁজে ভাঁজেও হাজার মন সংকোচ। উফ,প্রেম কী মারাত্বক জ্বালাময়ী!
মেয়েটার ধ্যান ছুটল নাহিদের ফুর্ত কণ্ঠে,
“ পরীক্ষা কেমন হোলো?”
নূহা আনত। অমন ভাবেই জানাল,
“ ভালো!”
“ সব লিখেছেন? কোনও প্রশ্ন বাদ পড়েনি তো? ইনভিজিলেটর কেমন ছিলেন? খুব কড়াকড়ি দিয়েছে?”
একেবারে গড়গড় করে বলে থামল নাহিদ।
তীব্র বিরক্ত চোখে চাইতেই, ফের মিইয়ে এলো কিছু।
“ কী হলো? এভাবে দেখছিস কেন? আমি কী করলাম?”
“ মুখটা বন্ধ রাখলে,আমি একটু বলি?”
ঠোঁট উলটে ঘাড় নাড়ল নাহিদ।
তীব্র, নূহাকে বলল
“ তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। বিকেলে ছাদে আসতে পারবে?”
অবিলম্বে মাথা কাত করল নূহা,
“ আচ্ছা স্যার।”
“ আমি তোমাকে পড়াই না নূহা। তাই স্যার না ডাকলেও চলবে।”
নূহা আবারও ঘাড় দোলাল। রয়েসয়ে শুধাল,
“ তাহলে কী ডাকব? ভাইয়া ডাকব?”
তীব্র কাঁধ উঁচাল,
“ এ্যাজ ইয়র উইশ! এমনিতেও কিছু দিন পর তোমার বন্ধুর বর হচ্ছি! চাইলে ভাইয়া ডাকতেই পারো।”
নূহা খুশি হয়ে গেল। এতক্ষণের উদাসীনতা,শ্রান্তি সব নিমিষেই গায়েব। স্ফূর্ত চিত্তে বলল,
“ সত্যি? আমি আপনাকে ভাইয়া ডাকব? কী যে খুশি লাগছে! আসলে আমি তো বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। একটা বড়ো ভাইয়ের খুব শখ ছিল আমার, জানেন!”
বলতে বলতে নূহার মুখটা কালো হয়ে এলো। সাথে ফোস করে শ্বাস ফেলতেই,
নাহিদ মায়া করে বলল,
“ আহারে! একটা ভাইয়ের জন্যে আপনার এতো মন খারাপ হয় মিস নূহা? আপনি চাইলে কিন্তু আমাকেও ভাইয়া ডাকতে পারেন। একটার জায়গায় দু দুটো বড়ো ভাই পেলে তো আপনার আর কোনও মন খারাপই থাকবে না। তাই না?”
নূহার সদ্য ফোটা হাসিটা দপ করে নিভে গেল। বিস্ফোরিত চোখে চাইল ওর দিক। কটমটানো চাউনী দেখে ভরকে গেল নাহিদ। ঘন ঘন পাতা ফেলল চোখের। রাগে গোটা
নাহিদকেই সম্পূর্ন এড়িয়ে গেল মেয়েটা। তীব্রকে বলল,
“ আমি ফ্রেশ হয়েই ছাদে আসছি ভাইয়া। আপনি একটু অপেক্ষা করুন।”
আরেকবার নাহিদকে জ্বলন্ত নয়নে দেখে চলে গেল নূহা। নাহিদ এই দৃষ্টির অর্থ বোঝেনি। বোকা বনে বলল,
“ আমাকে এভাবে দেখল কেন রে বিট্টু? আমি কি কিছু খারাপ বললাম?”
তীব্র বলল,
“ কথা খারাপ হোক,ভালো হোক। মেয়েরা সব সময় এভাবেই তাকায়।”
নাহিদ একটু ভেবে বলল,
“ কই, পুষ্পিতাতো তোর দিকে এভাবে তাকায় না।”
তীব্র কপাল কুঁচকে বলল,
“ ওর সাথে তুলনা করছিস কেন? আমার ভীতু মেয়ের মতো মেয়ে পৃথিবীতে এক পিসই আছে । ওকে জড়িয়ে আর কখনও কিছু বলবি না।”
তীব্র নিজেও ঘরের পথ ধরল তারপর। নাহিদ কণ্ঠ শৃঙ্গে নিয়ে বলল,
“ বাবাহ! এখনও প্রেম হলো না৷ তাতেই এতো! প্রেম হলে কী করবি?”
সে যেতে যেতে ঘোষণা দেয়,
“ প্রেম না হতে নিজেকে পাল্টেছি। প্রেম হলে দুনিয়া পালটে দেব।”
পুষ্পিতা পড়ার টেবিলে বসেছে। পড়তে নয়,চিন্তায়। বাইরে থেকে যত উন্মনা তরুণী? ভেতরখানা ঠিক ততটাই ছটফটে। যার পুরোটাই সে নূহাকে জানাতে চাইছে। অথচ দ্যাখো! মেয়েটা ঘরে নেই। একটু আগেই পরীক্ষা দিয়ে ফিরল। খেলোও না। নিচে কাজ আছে বলেই বেরিয়ে গেল আবার। গেছে তো গেছে, বাইরে থেকে দরজার হূকটা অবধি টেনে দিয়ে গেছে। পুষ্পিতা যে ওকে খোঁজার অজুহাতে একটু তীব্রর ফ্ল্যাটে উঁকিঝুঁকি দেবে,সেটাও বা হচ্ছে কই?
এর মধ্যেই ঘরে এলো নূহা। দোর খোলার শব্দে পুষ্পিতা নড়েচড়ে উঠল। ওইদিনের মতো আবার স্যার আসেননি তো! ত্রস্ত চেয়ার ছেড়ে এ ঘরে এলো ও। তীব্রকে না দেখে যে মন খারাপ হোতো? নূহাকে পেয়ে তা বদলে গেল উত্তেজনায়।
নূহার মুখে শ-খানেক তারার কিরণ। এতো ঝলমল করছে! তেমন তুফান নেমেছে অধরদ্বয়ে। ক্ষুদ্র আদলেই যেন পৃথিবীর সব খুশি লুটিয়ে।
কিন্তু পুষ্পিতার আনচানে চিত্ত এসব দেখল না। শশকের ন্যায় ব্যস্ত ভাবে বলল,
“ কোথায় গিয়েছিলি? এতো দেরি হলো কেন আসতে?”
“ এইতো, একটু নিচে গেলাম। কেন,কিছু হয়েছে?”
পুষ্পিতা ঝট করে ওর হাত টেনে খাটে এনে বসাল।
অমন চটপট করে বলল,
“ আমার তোকে কিছু বলার আছে!”
নূহা ভ্রু নাঁচাল,
“ ভাইয়ার ব্যাপারে?”
পুষ্পিতা বুঝতে না পেরে বলে,
“ ভাইয়াটা কে?”
“ কেন,তোমার আশিক। তীব্র ভাইয়া।”
পুষ্পিতা চোখ ঝাপটে বলল,
“ তুই না ওনাকে স্যার ডাকিস?”
নূহা প্রফুল্ল হেসে বলল,
“ হ্যাঁ, স্যারই তো ডাকতাম। কিন্তু ইদানীং ভেবে দেখলাম, দুদিন পরে যে আমার দুলাভাই হচ্ছে,তাকে আর স্যার ডেকে কী করব? সেজন্যেই এখন থেকে অভ্যেস করে নিচ্ছি।”
দুলাভাই শব্দটায় পুষ্পিতা লজ্জা পেলো। এতক্ষণের ছটফটানি তলিয়ে গিয়ে কুণ্ঠার বাণে ফেঁপে উঠল দুগাল। নূহা চিবুক ধরে বলল,
“ বাপ্রেহ,মেয়ে আবার লজ্জাও পায়। এত লজ্জা এখন না পেয়ে বাসর রাতের জন্য বাঁচিয়ে রাখ। ভাইয়া যখন রুমে এসে…”
পুষ্পিতা চট করে মুখটা চেপে ধরল ওর। চোখ রাঙিয়ে বলল,
“ ছিঃ চুপ কর ফাজিল মেয়ে!”
নূহা হাসছে। পুষ্পিতা হাত নামিয়ে ঠোঁট টিপে মাথা নুইয়ে রইল। লজ্জায় বুক কাঁপছে তার। তীব্রর পাশে বাসর ঘর এমন শব্দে ঝাঁঝিয়ে উঠছে কান।
নূহা পুরোপুরি ঘুরে বসল ওর দিকে।
“ আচ্ছা, এসব এখন বাদ। বল,কী বলবি!”
পুষ্পিতা বিছানার চাদর খুটতে খুটতে বলল,
“ আসলে আমি চাইছি যে ওনাকে সব বলে দেব।”
“ কোন সব?”
“ আরেহ,আমার মনের সব। মানে আমি যে ওনাকে ভালোবাসি সেটা।”
“ হঠাৎ?”
পুষ্পিতা নিসঃহায়ের মতোন বলল,
“ আমি আর এসব মনের ভেতর চেপে রাখতে পারছি না রে নূহা। ওনাকে দেখলেই এতো হাঁসফাঁস লাগে। মনে হয় এক্ষুনি…”
নূহা কথা কেড়ে নিলো,
“ মনে হয় এক্ষুনি গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরি,তাইতো?”
“ এমা, ছিঃ তা না। ।”
“ তাহলে এতো তাড়াহুড়ো কীসের? এই সবে নিজের অনুভূতি টের পেয়েছিস। একটু সময় নে।”
“ কিন্তু…”
“ কিন্তু টিন্তু বাদ। আর তুই আগে কেন বলবি? এসব প্রেম ভালোবাসার কথা ছেলেদের দিক থেকেই প্রথমে আসা উচিত। তাহলে মেয়েদের একটা ওজন থাকে বুঝলি। তুই হলি আমার বন্ধু। লাখে একজন। তারওপর দেখতে পুরো ঐশ্বরিয়া রায়। তুই কেন আগে আগে স্যারেন্ডার করে আসবি? উনি তোকে হ্যাংলা ভাববে না?”
পুষ্পিতা চিন্তায় একশেষ,
“ তাহলে কী করব?”
“ কী করব মানে? অপেক্ষা করবি। প্রেমে যত বেশি অপেক্ষা,প্রেম তত বেশি মধুর।”
“ ততদিনে যদি ওনাকে অন্য কেউ নিয়ে যায়? বা উনি যদি অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেন,তখন?”
পুষ্পিতার আশঙ্কা দেখে নূহা মনে মনে হাসল। বোকা মেয়ে! তীব্রর প্রেমের তীব্রতা জানে না! যে ছেলে ওর জন্যে ঢাকার সব ছেড়ে এখানে এসে পড়ে থাকে,তার মনে আরেকজনের বসত গড়া এতো সোজা?
গাল ছুঁয়ে বলল,
“ কেন,ওনার প্রতি তোর ভরসা নেই?”
পুষ্পিতা সময় নিয়ে বলল,
“ আমি ওনাকে বুঝতে পারি না। তাই ভরসা আছে না নেই,তাও জানি না। ওনার প্রত্যেকটা আচরণ সাজালে মনে হয় উনি আমাকে পছন্দ করেন। এবং সেটা অনেক বেশি! তারওপর কাল যা বললেন…”
নূহা ভ্রু বাঁকাল,
“ কী বলেছেন?”
পুষ্পিতা ঠোঁট নামিয়ে নিলো। ওড়না নিয়ে তীব্রর ওসব কথা ভাবলেও তার কান গরম হয়ে আসে। কিন্তু ওসব কী আর নূহাকে বলা যায়! ওগুলো তো তাদের নিজেদের কথা! একান্ত,ব্যক্তিগত!
জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,
“ কিছু না। কিছু না।”
“ কিছু নাহলে না। খবরদার যদি আগেভাগে গিয়ে এসব প্রেমের আলাপ করেছিস! যতক্ষণ না ভাইয়া এসে প্রপোজ করবেন, হাঁটুমুড়ে ফুল দিয়ে বলবেন, পুষ্পিতা আই লাভ ইউ! ততক্ষণ তোর মুখ খোলা বারণ! মনে থাকবে?”
“ কিন্তু উনি আমাকে ভালোবাসেন না এমনি পছন্দ করেন, সেটাতো এখনও নিশ্চিত হতে পারছি না।”
“ মাথায় বুদ্ধি থাকলে না পারবি? এসবের জন্য বুদ্ধি থাকতে হয়।”
“সেই,তোর তো প্রেমের ব্যাপারে আবার অনেক অভিজ্ঞতা! আমি তো তাও প্রেমে পড়লাম। কিন্তু তুই? তোর তো কোনও ছেলেই পছন্দ হয় না।”
নূহার এতক্ষণের মুরুব্বিয়ানা ভাবটা দমে গেল এবার। বুক চিড়ে লম্বা লম্বা শ্বাসের ঝুলি তারকেঁটে বাইরে লুটিয়ে এলো। অসহায় দুটো চোখ একভাবে পুষ্পিতাকে বলে গেল,
“ পছন্দ হয়েছে রে পুষ্পিতা। পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এমন একজন কে হয়েছে,যার কথা আমি দুঃসপ্নেও ভাবিনি।”
ও প্রসঙ্গ কাটতে গলা খাঁকারি দিলো। বলল,
“ অতশত বুঝি না। যা শেখালাম তা মনে থাকবে কী না বল!”
পুষ্পিতা বাধ্যের মত ঘাড় হেলাল। নূহা তুষ্ট চিত্তে বলল,
“ এইত, লক্ষ্মী মেয়ে! চল এই উপলক্ষে তোকে একটা লটারি কিনে দেই।”
“ লটারি?
কীসের লটারি?”
পুষ্পিতা হতভম্ব।
নূহা বলল,
“ ওমা, লটারি আবার কীসের? কাগজের।”
“ লটারি দিয়ে আমি কী করব?”
“ আরেহ,বোকা। এ যে সে লটারি নয়। এটার সাথে কতো কী দিচ্ছে জানিস? টিভি, ফ্রিজ, টেলিভিশন , বাইক। ফ্ল্যাটও দেবে শুনেছি।”
পুষ্পিতা চোখ চূড়ায় তুলে বলল,
“ ফ্ল্যাট? দশ টাকার লটারিতে ফ্ল্যাট?”
“ হ্যাঁ। বিশ্বাস হচ্ছে না? জিতলে ঠিক বিশ্বাস হবে।”
পুষ্পিতা নিষ্পৃহ বলল,
“ আমি জিতবই না৷ আমার কপাল অতো ভালো না কি!”
“ আহহা, শুরুতেই নেগেটিভ ভাবছিস কেন? আসবি তো আগে। আয়।”
“ এমা এখনই? পরে যাই। খাব না?”
“ না। লটারি শেষ হয়ে যাবে। তুই আয়। দাঁড়া টাকা নিয়ে আসি।”
নূহা পার্স আনতে ছুটল। পুষ্পিতা ক্লান্ত শ্বাস ফেলে ওড়না প্যাঁচাল মাথায়।
তারপর নিগ্রহে পা বাড়াল ওর সাথে। নূহা যত উত্তেজিত,ততোধিক নিষ্প্রভ মেয়েটা। লটারি হোক যাই হোক,ও হলো দূর্ভাগা। দূর্ভাগাদের জন্যে একটা সুতোও থাকে না যেখানে,সেখানে আবার এতো দামি দামি উপহার।
ওইজন্যেই তো স্যারকে নিয়ে এতো ভয় পুষ্পিতার! স্যার হলেন হিরের চাঁদ। ওর মতো গরিবের মুঠোয় তা এতো সহজে আসবে কখনও?
খোরশেদুল বজ্রাহতের মতো বসে। ভারিক্কি শরীরটায় বিন্দুমাত্র নড়ন নেই। সালমারও একই দশা। প্রৌঢ় মানুষদুটো স্তব্ধের ন্যায় কিয়ৎক্ষণ মেয়ের কান্নাই দেখে গেলেন। মিথিলা হেচকি তুলছে। ভূমিকম্পের ন্যায় নড়ছে ঠোঁট যুগল। অমন কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ পলাশ আমাকে নিয়ে থাকতে চায় না। ও তো আমাকে বিয়েই করতে চায়নি। করেছিল ওর মায়ের কথায়,আর মোটা অঙ্কের যৌতুকের লোভে পড়ে। ওর সাথে জেনি নামের এক কানাডিয়ান মেয়ের সম্পর্ক আছে। আমি সেটা ধরে ফেলাতেই,সাফ সাফ জানিয়ে দিলো আর সংসার করবে না। যদি দেশে ফিরতে হয় তাহলে ডিভোর্স পেপারে সই করে তারপর আসতে হবে।”
“ তুই সই করেছিস?”
মিথিলা মায়ের পানে চাইল। সালমার মুখবিবর ফ্যাকাশে ভীষণ! অজ্ঞাত আতঙ্কে ধুকপুক করছে বক্ষপট। মেয়ের ছ মাস হলো না বিয়ে হয়েছে,এরই মাঝে তালাক শব্দ এলে কার না এমন হবে?
প্রশ্নের উত্তরে নাক টেনে মাথা নাড়ল মিথিলা। সালমা চোখ বুজে নিলেন। দু ফোঁটা জল সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে গাল অবধি এলো। খোরশেদের মনে হলো দেহটা টলছে। একই সময় দু দুটো ধাক্কা। একটা শরীরী,আরেকটা মানসিক। কীভাবে সইবেন তিনি?
মিথিলা বাবার হাতের ওপর হাত রাখল হঠাৎ।
ভেজা কণ্ঠে বলল,
“ তুমি কি আমাকে ভুল বুঝছো বাবা?”
একটু নড়ে উঠলেন ভদ্রলোক। চোখ মুছে বললেন,
“ তোমাকে ভুল বুঝব কেন মা? ভুল তো হয়েছে আমার। খোঁজ খবর না নিয়ে শুধু ছেলের অবস্থা দেখেই সমন্ধে রাজি হয়েছিলাম। সেজন্যেই তোমাকে এইভাবে সাফার করতে হলো। নাহলে আমিও তো বলি,আমার মেয়ে এতো মাস দূরে গিয়েও একবার আমাদের মনে করছে না? এখন তো বুঝলাম সবই আসলে ওই অসভ্য ছেলের কাজ। ও ইচ্ছে করেই তোমাকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিতো না।”
“ কিন্তু এখন কী হবে? এগুলো আত্মীয় স্বজন জানাজানি হলে, মেয়েটার সম্মান কোথায় নামবে একবার ভেবে দেখেছ?”
খোরশেদ কপাল গোছালেন,
“ আত্মীয় স্বজন? কীসের আত্মীয় স্বজন! এসব বসন্তের কোকিল নিয়ে আমি ভাবি না। আমার মেয়ে যেখানে সুখি হয়নি সেখানে থাকেনি ব্যস! এখানে নতুন করে হওয়ার তো কিছু নেই।”
সালমা এক্ষুনি আর যুক্তি দিতে গেলেন না। কিন্তু মায়ের মনটায় খচখচ করছে বড্ড। নিজের মেয়েকে তো তিনি চেনেন। এক হাতে কি তালি বাজে? একটা সংসার ভেঙে যাওয়ার পেছনে শুধুই কি পলাশের দোষ? মিথিলা কি কিছুই করেনি?
মাকে নিজের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে মিথিলা অপ্রতিভ হয়।
জিজ্ঞেস করে নম্র স্বরে,
“ কী দেখছো?”
সালমা ঘাড় নাড়লেন দুপাশে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ অনেক জার্নি করে এসেছিস। যা,একটু বিশ্রাম কর। খিদে পেয়েছে না?”
মিথিলা কালো মুখে মানা করল,
“ খাব না। ভালো লাগছে না।”
“ তা বললে হয়! আমি ভাত বাড়ছি। যা।”
মিথিলা উঠে দাঁড়াল। বড়োদের এসব আলোচনায় রাহাতকে রাখা হয়নি। মায়ের এক কথায় শোবার ঘরে চলে গেছে সে।
মিথিলা লাগেজ নিয়ে সোজা সেখানেই এলো। কতদিন পর নিজের সেই ঘর,সেই বিছানা!
ঘরের ভেতর ঢুকে মিথিলার প্রথমেই মনে পড়ল পুষ্পিতাকে।
চোখের পর্দায় ভেসে উঠল সেসব অতীতের ছবি। আহা,কত দূর ছাই করতো মেয়েটাকে! আজ ও নেই। থাকলে এতক্ষণে আপু আপু করে নিশ্চয়ই কান পচিয়ে দিতো?
রাহাত ট্যাব দেখছিল শুয়ে শুয়ে। বোনকে দেখেই উঠে বসল দ্রুত। কণ্ঠে উদ্বেগ,
“ কিছু লাগবে আপু?”
মিথিলা মলিন বদনে একটুখানি হাসল। পাশে বসে বলল,
“ না। তুই এতো শুকিয়ে গেছিস কেন? ঠিক করে খাস না ?”
কিছুটা অবাক চোখে চাইল রাহাত। এইতো, কয়েক মাস আগে যাওয়ার সময় ওর স্বাস্থ্য নিয়ে মিথিলা খোঁচা দিয়েছিল। আর আজ বলছে শুকিয়ে গেছে? বোনটা কি ওর সত্যিই পালটে গেছে তাহলে? মিথিলাকে এতো কাঁদতে রাহাত আজ অবধি দেখেনি। এতো কী,ওকে খুব একটা কাঁদতেও দেখা যায় না। কী যে হলো হঠাৎ!
বলল,
“ খাইতো। কিন্তু আগের মতো আর খেতে ইচ্ছে করে না। ছোটাপু নেই। আম্মু তো অসুস্থ থাকে! তাই খাইয়ে দিতে বলি না। একা একা যতটুকু পারি ততটুকু খাই।”
মিথিলা বলল,
“ আচ্ছা, এখন থেকে আমি তোকে খাইয়ে দেব, কেমন?”
রাহাতের পাতলা ঠোঁট আলাদা হলো। ভীষণ বিস্ময়ে
চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“ তুমি খাইয়ে দেবে?”
“ হুঁ। কেন? খাবি না আমার হাতে?”
“ হ্যাঁ খাব তো।”
“ তাহলে এখন একটু বাইরে যা। আমি চেঞ্জ করেই আসছি!”
সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৩৮
বলা মাত্রই চপল পায়ে ছুটে গেল রাহাত। সে পথ দেখে মিথিলার চোখ ভিজে ওঠে। এই জীবনে তার সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিল,ভালোবাসার মানুষদের তুচ্ছ ভাবা । কিছু মোহ,কিছু আকর্ষণের পেছনে ছুটতে গিয়ে তাদের সঙ্গ অবহেলা করে যে অন্যায় করেছিল,এবার সব শুধরে নেবে মিথিলা। আর এই তালিকার সব থেকে উর্ধ্বে যে আছে,যাকে মিথিলা চরম ভাবে ঠকালো! সেই মানুষটা কেমন আছে এখন? মিথিলা যদি তার কাছে গিয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চায়,ক্ষমা পাবে তো!