সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৫

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৫
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

নূহার আচমকা ধেয়ে আসা প্রশ্নের জবাব নাহিদের কাছে নেই। কেন নেই,কী জন্যে,সেসব জানার কথাও না। তবে ঐ দোলাচলের ভার সামলাতে ছেলেটার ফরসা আদল অস্তমিত রবির ন্যায় রক্তিম হয়ে উঠল। শুষ্ক গলবিলে সাহারা দিতে ঢোক গিলল ক-বার। সুতনু পুরুষের ফ্যাকাশে মুখে এক যোগে চেয়ে রইল নূহা। কিছু দীর্ঘশ্বাস আটকে থাকল বক্ষপিঞ্জরের ফাঁকফোকড়ে ।

নাহিদের মনের কোথাও সে নেই! থাকলে কি উত্তর দিতে এত সময় নিতো ছেলেটা? নূহার হঠাৎ আকাশ ভেঙে কান্না পেলো। কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়ার তুখোড় প্রয়াস, কাঁদতে দিলো না আজও। বরং
বিভ্রমের অর্ণবে ডুবতে থাকা এক নাবিককে বাঁচাতে, তক্ষুনি হুহা করে হেসে উঠল সে। নাহিদ আশ্চর্য চোখে চায়। একটু আগে কথার বানে খেই ছোটানো তরুণী খলবলাল ঠিক ঢেউয়ের মতো। হাসতে হাসতে বলল,
“ ভয় পাচ্ছেন কেন? একটা সামান্য কথায় মানুষ এত ভয় পায়? আমি তো মজা করছিলাম?”
‘মজা করছিলাম’ শব্দটায় নাহিদ যেন প্রাণ ফিরে পেলো। মরুর ন্যায় খরখরে ওষ্ঠপুট এবার সরল দুদিকে। কপালের ঘাম মুছে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ ওহ! তাই বলুন। আসলে হঠাৎ করে আপনাকে এত অচেনা লাগছিল,আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম!”
“ সেতো যাবেনই। আপনি যে ঢেঁড়স!”
নাহিদের মুখখানা অপমানে আজ থমথমে হলো না। ঠোঁটের হাসিটাও কমেনি। আনন্দ চিত্তে বলল,
“ আবার বলুন তো! আপনার মুখে ঢেঁড়স শুনতে ইদের মতো লাগে।”
নূহা চেহারা গোটায়,
“এ আবার কী উদাহরণ!”

কথার পিঠে বোকার মতো হেসে গেল নাহিদ। সত্যি বলতে ও এখনও নার্ভাস৷ এখনও সমানতালে বুক ধুকপুক করছে।
নূহার মজা করে বললেও এই প্রসঙ্গ আগামী সপ্তাহখানেক দখল চালাবে মনে। নাহিদ বোকা ঠিক আছে। কিন্তু প্রেমিক তো! একটা প্রেমের ছোঁয়ায় গভীর অনুভূতির সাক্ষাৎ পেয়েছিল জীবনে। তাই একেবারেই যে কিছু বুঝবে না তাতো নয়।
নূহা কি সত্যিই মজা করেছে? নাকি ও-ই একটু বেশি বেশি ভাবছে?

নাহ, ওর মাথাটা আসলেই গেছে। একেবারে মাড়ির চিপায় ফেলে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছে মিরাজ। নাহলে নাহিদ তো এমন নয়। স্কুল-কলেজে তার মত ভদ্র ছেলে দুটো ছিল না। আর সেই ছেলে কী না!
না নাহিদ,আজ এর একটা বিহিত তোর চাই। তোকে সরল পেয়ে ছেলেগুলো চিংড়ি ভাজা করছে। কখনও কচুর মত কাটছে। এসব তো আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। আজ না হয় নূহার সামনে ইজ্জতটা যেতে যেতে বাঁচল। কিন্তু কদিন? যে স্পিডে ছুটছিস তাতে কোনদিন ইজ্জত সত্যিই চলে যাবে কোনও নিশ্চয়তা নেই। তোকে আরো সতর্ক হতে হবে। চোখ-কান খোলা রেখে মুখ বন্ধ করতে হবে। বন্ধুদের ওসব নষ্ট কথা ছেড়ে দিয়ে ভালো হওয়ার পরামর্শ দিতে হবে। শুনলে ভালো, না শুনলে সবকটাকে ডিভোর্স!

ভাবুক নাহিদকে দেখে দেখে নূহার চোখ ভিজে ওঠে। এরকম টালমাটাল জীবন তো সে চায়নি। প্রেমেও পড়তে চায়নি কখনও। পড়লই যখন,তখন এমন মানুষের কেন? যে মানুষ ওকে নিয়ে ভাবে না। ওর চিন্তায় মরে না। ওর চোখের ভাষা দেখেও যার বোঝার সাধ্য নেই!
এই বুক ভাঙা কষ্টগুলো সারাজীবন কি ওকে একাই বইতে হবে?
এরমধ্যে আয়েশা চা নিয়ে এলেন। এসেই বললেন,
“ কী রে তুই ওকে এখনও দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন?”
এক কথায়,দু রকম চিন্তায় মগ্ন দুজনেই নড়ে উঠল একটু। তিনি বললেন,

“ বোসো নাহিদ!”
“ না না আন্টি, আমি ঠিক আছি।”
“ আহহা, বোসো তো।”
নাহিদ বসল। আয়েশা চায়ের সাথে পুডিং নিয়ে এসেছেন। পিরিচটা হাতে দিতে দিতে বললেন,
“ তুমি এসে ভালোই করেছো বুঝলে! আমার এমনিই কিছু কথা ছিল।”
“ হ্যাঁ আন্টি,বলুন না!”
“ আসলে তীব্রকে তো তেমন বাসায় পাই না। আমিও ব্যস্ত, ছেলেটাও ব্যস্ত। আমাদের স্কেজিয়ুলই মিলছে না। তাই বরং তোমাকেই আগে আগে জানিয়ে দেই!”
নাহিদ সচেতন হয়ে বসে,

“ কিছু হয়েছে আন্টি?”
আয়েশা খোশমেজাজে বললেন,
“ আরে না না। পরশু নূহার জন্মদিন সে ব্যাপারেই আর কী!”
নাহিদ স্ফূর্ত ধ্বণি তুলল,
“ ও মাই গুডনেস! তাই না কি?”
চোখাচোখিতে ঠোঁট টেনে হাসল নূহা। চোখের জল সে সন্তর্পণে কখন মুছে নিয়েছে!
আয়েশা বললেন,
“ ভাবছি একটু ছোটোখাট আয়োজন করব৷ এই নিজেরা নিজেরা আর কী! কাছের -দূরের মেহমানরা আসবে। তোমরাও থাকবে। কিন্তু আমি আসলে রান্নার ঝামেলাটা বাড়িতে রাখতে চাইছি না। এইটুকু ফ্ল্যাটে মানুষ এলেই তো গাদাগাদি হয়ে যাবে। তাই ছাদে বাবুর্চি দিয়ে ব্যবস্থা করব ভেবেছি। কিন্তু সমস্যা হলো,এখানকার তেমন কিছুই চিনি না বুঝলে। কী…”
নাহিদ কথা টেনে নিলো। আগ বাড়িয়ে বলল,

“ ওসব নিয়ে আপনি ভাববেন না আন্টি। আমি আছি তো। তীব্র সময় পাবে না,কলেজ আছে যেহেতু। তবে আমি এখন ফ্রি। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।”
“ কিন্তু বাবা,তোমারও তো অফিস আছে।”
নাহিদ ফোস করে শ্বাস ঝাড়ল,
“ নেই। চাকরিটা চলে গেছে।”
আয়েশা যেন আঁতকে উঠলেন,
“ ওমা সে কী! কেন?”
নাহিদ নূহার দিকে চাইল। ওকে পৌঁছে দেয়ার সেদিনই চাকরিটা ফুস হয়ে গেছে। মেয়েটা জানে এসব। কতবার যে আফসোস করেছিল এ নিয়ে!
এখন ওর মন খারাপ দেখলে হয়ত আরো আক্ষেপ করবে!
তাই কালো মুখে চটজলদি হাসি আনল নাহিদ। প্রফুল্লিত জানাল,
“ তেমন কিছু না। যাতায়াত সিস্টেমটা ঝামেলার ছিল। তাই ভাবলাম আরেকটু ভালো জায়গায় ট্রাই করি!”
“ ও আচ্ছা। তা যা ভালো বোঝো। তুমি কত ব্রিলিয়ান্ট, নূহা বলেছে আমাকে। তোমার জন্যে কাজের অভাব হবে না।”

“ দোয়া রাখবেন আন্টি। তবে আপাতত যখন ফ্রি আছি নূহার জন্মদিনে আপনাকে সাহায্য করার সব দায়িত্ব আমার। আপনি শুধু জানাবেন কোথায় গিয়ে কাকে ডাকতে হবে।”
এত খুশি হলেন আয়েশা। আপ্লুত কণ্ঠে বললেন,
“ যাক বাবা! নিশ্চিন্ত করলে আমাকে। তুমি পাশে থাকলে আর কোনও চিন্তাই হবে না।”
নাহিদ ততক্ষণে চা শেষ করেছে। উঠে দাঁড়াল এবার।
“ আচ্ছা আন্টি, এখন আমি আসি।”
“ ঠিক আছে,যাও। এসো আবার।”

নাহিদ বেরিয়ে গেল। দরজার ওপাশে গিয়ে হাত নেড়ে হেসে ‘বাই’ বোঝাল নূহাকে। ঘরে না ঢুকে নেমে গেল নিচে। কিন্তু যাওয়ার আগের ওই হাসি সহ্য হয় না মেয়ের।
বুকের উত্তালতায় অতিষ্ঠ হয়ে ধড়াম করে দোর চাপাল সে। পেছন থেকে আয়েশা বললেন,
“ সত্যি,ছেলে দুটোকে যত দেখি তত অবাক হই। এই যুগে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে দুটো স্বর্ণ থাকে বুঝলি। নাহিদ যে এত চমৎকার ছেলে প্রথমে তো ধরতেই পারিনি। এখন দিনদিন কী যে মুগ্ধ হচ্ছি ওর ওপর!”
নূহা এক টুকরো মরণ শ্বাস ফেলল। ভাবল মনে মনে,
“ এই মুগ্ধ হওয়ার চক্করেই যে আমি আটকে গেছি আম্মু। ঢেঁড়সটা আমার মন নিয়ে,ভেতর থেকে আমাকে পুরো শেষ করে দিলো!
এরা স্বর্ণ না ছাই!
একজন আমাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। আরেকজন পুষ্পিতাকে নিয়ে এই রোদের ভেতর কোথায় কোথায় ঘুরছে কে জানে!”

ঘড়িতে একটা ছুঁইছুঁই ভাব। অমনি ছুটির ঘন্টাটা তারস্বরে বাজল। ইন্টারমিডিয়েটের মেয়েগুলো দৌড়ে বের হলো আগে। গায়ের সাদা সাদা ইউনিফর্ম যেন উজ্জ্বল সকালে শ্বেত বকের লোমের মতো লাগছে। ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছাড়ল পরে। করিডোরে
তনুজার সাথে সাথে পা মিলিয়ে হাঁটছিল পুষ্পিতা।

আচমকা ঝোড়ো হাওয়ার মতো কেউ একজন পাশ কাটিয়ে গেল। পুষ্পিতার নরম বাহুতে দেহের সংঘর্ষ স্পষ্ট।
মেয়েটা চমকে সরতে যায়। প্রকট চোখ সামনে পড়তেই নিভে আসে পরপর। তীব্র হেঁটে যাচ্ছে। লম্বা লোকটার হাঁটার ভঙ্গি এত দারুণ! দশজনের ভেতর নিঃসন্দেহে আলাদা করা যাবে।
এগিয়ে যাওয়া পুরুষটিকে দেখে প্রেমের স্বভাবে পুষ্পিতার বুকটা ধ্বক করে কাঁপে।
অদ্ভুতুরে লজ্জায় কপোল জোড়া লালিত। মানুষটা ইচ্ছে করে এমন করল তাই না? কী খারাপ!
তক্ষুনি কানে এলো একটা লম্বা-দীর্ঘ শ্বাসের শব্দ। হতাশ চোখে তীব্রর প্রস্থান দেখছে তনুজা। ভীষণ আফসোস করে বলল,

“ স্যার আমার সাথে এমন না করলেই পারতেন। আমি কী দেখতে ভালো নই?
সেদিন ধমক না দিয়ে ফুলটা নিলে এতদিনে আমাদের বিয়েও হয়ে যেতো বলো৷ সবই ভাগ্য! স্যার বুঝলেনই না,ওই ধমকের জন্যে তার কপাল থেকে কত ভালো একটা বউ মিস হয়ে গেছে!”
কথা শেষ করে আবার শ্বাস ফেলল মেয়েটা। পরতে পরতে কেবল অনুতাপ। পুষ্পিতা ফিক করে হেসে ফেলল আজ। নীরব হাসিটা তনুজার কানে যায়নি।
মেয়ে এখনও তীব্রর যাওয়া দেখতে ব্যস্ত। আজ আর এতে পুষ্পিতার মন খারাপ হোলো না। উহু,একটুও না। বরং আত্মগরিমায় শীর্ণ বুক ফুলেফেঁপে উঠল!
যে মানুষটাকে পেতে কেউ কেউ আফসোস করছে,সে মানুষ নিঃশ্বাসের মতো ওকে ভালোবাসে। এতকাল জীবনটাকে তুচ্ছ ভাবা পুষ্পিতার এখন এমন মানুষ আছে,যার কাছে তার একটু দুরুত্বও দুঃসহ আজকাল। বেঁচে থাকতে এর বেশি আর কী চাই?

গেট অবধি এসে তনুজা নিজের মতোন বাড়ির পথ ধরল। কিন্তু পুষ্পিতা দাঁড়িয়ে রইল অমন। কাধব্যাগটা বুকে চেপে এদিক ওদিক দেখছিল সে।
হন্যে ডাগর চোখ কারো হদিস পেতে মরিয়া।
ঠিক সেই সময় পেছনে এসে দাঁড়াল তীব্র। গলার শ্লেষা কাটিয়ে মেয়ের মনোযোগ আনল নিজেতে। পুষ্পিতা ফিরলও চকিতে।
তীব্র ভ্রু নাঁচায়। অমনি লজ্জায় এক প্রস্থ গুটিয়ে গেল তরুণী। আনত চিবুকে মাথা নাড়ল দুপাশে। বোঝাল,
“ কিছু না।”

তীব্র কথা বাড়াল না। পার্কিং-এ গাড়ি আনতে গেল। পুষ্পিতা চেয়ে রইল নির্নিমেষ। মানুষটা চওড়া কাঁধ দেখে দেখে হাসল ঠোঁট চেপে। কখনও কি ভেবেছিল,একটা অচেনা-অজেনা পুরুষের প্রেমে এমন উতলা হবে ও? যাকে দেখা মাত্র আন্দোলন চলবে হৃদয়ে। ধড়ফড় করবে বক্ষপট। পিঠ বেয়ে ঘাম ছুটবে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাগবে শিউরে ওঠার আঁচ?
তীব্র জিপ নিয়ে সামনে এসে থামে। পুষ্পিতা লাজুক হাসি পিষে নিলো ঠোঁটে। ও
দরজা ঠেলে দিলো,
“ এসো।”
পুষ্পিতা বসল জড়োসড়ো হয়ে৷ এতো লজ্জা লাগছে!
কথা বলতে পারছে না। না পারছে পাশের মানুষটাকে দেখতে।
তীব্র গাড়িতে টান বসাল। হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে পাশ ফিরে চাইল এক পল। বড্ড সাবলীল শুধাল,

“ বেশি লজ্জা পাচ্ছো?”
পুষ্পিতা আইঢাই করে ওঠে। শক্ত পিঠে সতর্ক হতে চায়। ঘনঘন মাথা নেড়ে বলে,
“ না মানে…..”
তীব্র বলল,
“ আমার সাথে এত লজ্জা পাওয়া কি ঠিক হচ্ছে?”
পুষ্পিতা হাত তুলে নাকের ডগায় জমে থাকা ঘুম মুছল। জড়িয়ে যাওয়া জ্বিভে কথা এড়াতে বলল,
“ আজ অনেক রোদ তাই না?”
“ কাছে এসো। বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখি। এখানে রোদ নেই।”
পুষ্পিতার শ্বাস আটকে গেলো কুণ্ঠায়। ঠোঁট গোঁজ করতেই তীব্র বলল,

“ কাল যে আমাকে জড়িয়ে ধরল,বলল আমাকে ভালোবাসে। আজ তার গলা দিয়ে শব্দই ফুটছে না। আজব!”
পুষ্পিতা চোখ খিচে বাইরে তাকায়। কী লোক রে ভাই! কালকের ওসব নিয়ে ওকে লজ্জা দিচ্ছে? এখন যদি সেও পালটা কিছু বলে দেয়? বলে যে,
কাল তো আপনিও কিছু কম করেননি। কে আমাকে বুকের ভেতর ঠেসেঠুসে বলেছিল তোমাকে ছাড়া আমি মরে যাব?

হুহ! নেহাত পুষ্পিতা ভালো মেয়ে। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ওসব বলতে পারছে না।
ও হঠাৎ খেয়াল করল তীব্র অন্য রাস্তায় ঢুকছে। এটাতো বাড়ির রাস্তা নয়। সম্পূর্ণ উলটো পথ। কৌতূহলের দাপাদাপিতে জিজ্ঞেস করল,
“ এদিকে কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“ ঘুরতে।”
পুষ্পিতা চোখ বড়ো করল,
“ এই দুপুর বেলা?”
“ রাত হলে ভালো হোতো?”

তীব্রর মিটিমিটি হাসি দেখে শিরদাঁড়া শক্ত করল পুষ্পিতা। মুখ ফিরিয়ে বলল,
“ আপনি খুব খারাপ!”
তীব্র হাসল। কিছু বলল না। আধঘন্টার মাথায় গাড়ি এসে থামল একটা বড়ো পার্কের সামনে।
ঝুলন্ত সাইনবোর্ড দেখে পুষ্পিতা অবাক হয়ে বলল,
“ আমরা এখন পার্কে যাব? কত রোদ! এর মধ্যে ঘুরলে শরীর খারাপ করবে না?”
তীব্র ততক্ষণে নেমে গেছে।
কথার পিঠে জবাব এলো,

“ নামো।”
পুষ্পিতা নিঃশ্বাস ঝাড়ে। কাল রাতে তার প্রেমের তাপে হাহুতাশ করা লোকের সঙ্গে আজ এর কোনও মিল নেই। একটা উত্তরও দ্যাখো ঠিকঠাক করে দিচ্ছে না। চুপচাপ নামতে নিলে তীব্র হাত বাড়াল ।
মেয়েটার ফর্সা মুখ তুরন্ত রাঙা হয়ে আসে।
লাজুক ভঙ্গিতে প্রেমিকের বাড়ানো হাত ধরল সে। কোমল ফুল যেমন যত্নে,সাবধানে ধরা হয়? তীব্র অমন সন্তর্পণে নামিয়ে আনল তাকে।
“ এসো।”
মেয়েটা কলের পুতুল বনে পা বাড়ায়। বিশালাকার পার্কের এ মাথায় দাঁড়ালে ও মাথা দেখা যায় না। এত গাছ! সবুজের বুকে হলদে রোদ যেন ডালে ঝোলানো জীবন্ত সোনালু।
দুপুর হলে কী হবে,লোকের তো অভাব নেই।

পুষ্পিতা চারপাশ দেখছিল। উদাম পার্কে কড়া রোদে ঘুরবে ভেবেই মাথার দুপাশ নেচে উঠল ব্যথায়।
তীব্র টিকিট কাটল ঠিকই। তবে পার্কের খোলা অংশে গেল না। লম্বা পায়ে উলটো দিকের রিসোর্টের পথ ধরল। ছাউনীর নিচে পাতানো যে রেঁস্তোরাটা এখানে রমরমিয়ে চলছে,ভীতু মেয়েকে নিয়ে এলো সেথায়।
বেতের চেয়ারটা টেনে দিয়ে আগে বসাল ওকে। মুখোমুখি আরো দুটো চেয়ার আছে। অথচ তীব্র এসে বসল ঠিক পুষ্পিতার পাশে,গা ঘেঁষে।
মেয়েলি দেহটা লজ্জাবতীর ন্যায় চুপসে গেল অমনি। তীব্রর উষ্ণ গতর, নেশালো চোখ,শরীর হতে ছুটে আসা ঘ্রাণ সব মিলিয়ে পুষ্পিতার রুহু এসে গলায় ঝুলে থাকে।
তীব্রর ওসবে মন নেই। পুষ্পিতার নরম আঙুলে নিজের খসখসে আঙুল গুঁজল সে।
কানের পাশে তার নিখাদ স্বর,

“ এদিকে তাকাও।”
পুষ্পিতা শুনল না। চেয়ে রইল নিচে। তীব্র চিবুকটা ধরে নিজের দিকে ফেরাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ এখনই এত লজ্জা পেলে বিয়ের পর কী করবে? তখন তো এর থেকেও বেশি কাছাকাছি থাকব।”
পুষ্পিতার চোখ মারবেল! তীব্রর সেদিনের কথাটাই কানে বাজল আবার,
“সামনে এর থেকেও অনেক বাজে অবস্থায় থাকতে হবে!”
আজকে যেন সেই কথার অর্থ সাফ সাফ ভাবে বুঝে নিলো মেয়েটা। চৈত্র মাসে বৃষ্টি পডার মত শুকনো গলায় হেচকি উঠে গেল। অমনি হেসে ফেলল তীব্র।

“ রিল্যাক্স! আ’ম কিডিং! এতো বড়ো বড়ো করে তাকানোর কিছু নেই!”
পুষ্পিতার হেচকি তাও কমছে না।
তীব্র তেড়ে হাসি আটকাতে ঠোঁট পিষল দাঁতে। মেয়েটার মনোযোগ ঘোরাতে
ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলল,
“ ফ্ল্যাটে যেতে চাইছো না কেন?”
পুষ্পিতা সত্যিটা মুখে আনতে পারল না। পুরন্ত ঠোঁট নামিয়ে রাখল কোলে রাখা ব্যাগের ওপর। তীব্র নিজেই বলল,
“ আমার জন্যে?”

চিবুক গলায় ঠেকিয়ে মাথা ঝাঁকায় সে।
তীব্র হাতের বাঁধন দৃঢ় করল আরও।
“ যদি আমিও যাই? তাহলে যাবে?”
পুষ্পিতার হেচকি-টেচকি উধাও। অবাক হয়ে বলল,
“ আপনিও যাবেন?”
কিন্তু, কিন্তু কীভাবে?”
“ আমি ওই ফ্ল্যাটের চারতলা ভাড়া নিয়েছি।”
এক ঘোষণায় তরুণীর নিভন্ত আঁখি চকচকিয়ে উঠল। কণ্ঠ শৃঙ্গে তুলে বলল,
“ সত্যি?”

কিন্তু চারতলা নিলেন কেন? এই বাসার মতোই পাশাপাশি নিতেন।”
“ চেয়েছিলাম। খালি নেই।”
একটু মন খারাপ করল পুষ্পিতা। পরপর স্ফূর্ত হেসে বলল,
“ থাক,আপনি যাচ্ছেন তাতেই হবে।”
ওর ফরসা হাতটা একটু উঁচুতে তুলল তীব্র। চিকণ আঙুলে স্লাইড করে বলল,
“ আচ্ছা,এখন তো তোমার নিজের একটা বাড়ি আছে। তুমি কারো দ্বারস্থ নও। তাহলে নিজের মণির সাথে যোগাযোগ করছো না কেন?”

পুষ্পিতা চমকে বলল,
“ আপনি মণিকে চেনেন?”
“ না। তবে রাহাত কে চিনি। হি ইজ সাচ আ লাভলি চাইল্ড!”
পুষ্পিতা আগের থেকেও বিস্মিত,
“ আপনি রাহাতকেও চেনেন? ও হ্যাঁ, চেনেনই তো। আপনিই তো ওর সেই বখাটে বিট্টু! ”
বিট্টু উচ্চারণ করতে গিয়ে নাক সিটকানোর মতো করল মেয়েটা।
তীব্র মজা পেলো তাতে।
বলল,

“ আশ্চর্য! বখাটের সাথেই তো প্রেম করছো এখন। তাহলে?”
পুষ্পিতা দীর্ঘশ্বাস বুকে লুকাল। নিঃসহায়ের ন্যায় জানাল,
“ কী করব? ভা…”
বলতে বলতে সে নিজেই থেমে গেল। কাল তো মনের তাল হারিয়ে ভালোবাসি বলে ফেলেছে। আজ পারবে কীভাবে? লজ্জা করছে তো!
তীব্র এক ভ্রু তুলল,
“ কী? ভালোবেসে ফেঁসে গিয়েছ,তাইতো?”
ঠোঁট উলটে মাথা নাড়ল পুষ্পিতা।
“ তাও ভালো। ফেঁসে কোথাও যেতে হয়নি। আমাকে যে ঢাকা থেকে এখানে টেনে আনলে,তার বেলা?”
পুষ্পিতা বুঝল,তীব্রর সাথে যুক্তিতে সে নাদান শিশু। কথা কাটাতে বলল,
“ রাহাত কিন্তু আপনার ফ্যান ছিল জানেন? খালুজান যখন মাঝেমধ্যে এসে আপনার কথা বলতো,সাবধান করত আমাদের? ও তখন পুরো আলাদা। সব কিছু এত মুগ্ধ হয়ে শুনতো!
আমাকে তো একদিন বলেওছিল। কিন্তু আমি যে ওকে আপনার সাথে মিশতে বারণ করেছিলাম। তারপরও মিশেছে?”

তীব্র উত্তরটা দিলো একটু ঘুরিয়ে,
“ তোমাদের ছবিটা ওই আমাকে দিয়েছিল।”
পুষ্পিতা হাঁ করে বলল,
“ কী?”
“ হুঁ। ও তোমার জন্যে কষ্ট পাচ্ছে। এখন তোমার কোনও টানাপোড়েনে নেই। চাইলে যোগাযোগ করতেই পারো।”
পুষ্পিতার কণ্ঠে শঙ্কা,
“ না না। খালুজান যদি অশান্তি করে? উনি আমাকে পছন্দ করেন না। আমার সাথে মণির যোগাযোগ আছে জানলে কুরুক্ষেত্র বাঁধাবেন।”

তীব্রর শুভ্র, উজ্জ্বল মুখটায় আচমকা কেমন রহস্য ছেঁয়ে গেল। পুষ্পিতার চেহারায় তার দৃষ্টি। অথচ ভেতরটায় অন্য কিছু। ঠোঁটের হাসিটা চতুরের ন্যায় দেখাল বেশ। ভাবল,
“ কুরুক্ষেত্র বাধানোর মতো অবস্থায় তো ও নেই ভীতু মেয়ে! যে হাত দিয়ে তোমাকে বাড়ি থেকে বের করতে চাইত, সেটা ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছি।”
“ কী ভাবছেন?”
“ হুঁ? কিছু না। শোনো, এত ভয়ের কিছু নেই। আমি বলছি তুমি একটা ফোন করো ওদের। এখানে ডেকে পাঠাও। এরপরেও কিছু হলে আমি তো আছি! আমি সামলে নেব।”

এতক্ষণের ধরে রাখা হাতের বাঁধনে এবার বাম হাতটাও রাখল তীব্র। শক্তপোক্ত কণ্ঠস্বরে অশেষ নম্রতা,
“ এখন আর তুমি একা নেই। আমি সব সময় তোমার পাশে আছি,থাকব। আর আমি যতক্ষণ থাকব,আমার ভীতু মেয়ের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাতেও পারবে না।”
কথাটায় কী ছিল জানা নেই। আনন্দে একটা কান্নার তুবড়ি পুষ্পিতার গলায় ছিটকে এলো। দুচোখ ছাপালো নোনতা স্রোতে। ভেজা গলায় বলল,

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৪

“ আপনি আমায় এত ভালোবাসবেন না স্যার! আমার কপালে ভালো কিছু বেশিদিন থাকে না। আপনার ভালোবাসা দেখে খুব ভয় হচ্ছে, এত সুখ আমার কপালে সইবে তো?”

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৬