সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৮

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৮
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

ফকফকে,ঝকঝকে সোনালী রোদ্দুরের গায়ে ঝপাৎ করে বৃষ্টি নামলে,কিংবা শান্ত থমথমে নদীর বুকে আচমকা তুফান উঠলে মানুষ যেমন ভড়কে যায়? নূহার চোখেও অমন বিস্ময়ের উর্মী তেড়ে গেল। অক্ষিকূটে অবিশ্বাস নিয়ে মিথিলার পা থেকে মাথা অবধি দেখল সে। ও এখানে কী করে এলো! হিসেব মত মিথিলার তো এখন কানাডায় থাকার কথা। ক মাস আগেই না বিয়ে হলো!
দেশে ফিরেছে তাহলে? কিন্তু এই বাড়ির ঠিকানা জানল কী করে? সবচেয়ে বড়ো কথা, ওরা যে এখন গাজীপুরে এটাতো কারোর জানার কথা নয়!

তার হাঁ করে চেয়ে থাকার মাঝে চমৎকার করে হাসল মিথিলা। কণ্ঠে বাধ বাঙা উল্লাস,
“ নূহা! কেমন আছো? কতদিন পর দেখা! পুষ্পিতা তাহলে তোমাদের সাথেই থাকে?”
ঘোর ভাঙল নূহার। আশ্চর্যের ধাক্কা এত প্রবল, একটু আগে নাহিদের দেয়া দুঃখ অবধি শূন্যে উঠে গেছে! বলল,
“ তুমি এখানে!”
প্রশ্নের পরপরই ওর চোখ পড়ল মিথিলার পেছনে। সালমা বেগম, রাহাত সবাই দাঁড়িয়ে। মেয়েটা আরেক দফা হোচট খেল এতে। ওনারা কি পুষ্পিতার কাছে এসেছে? পুষ্পিতাই কি তাহলে খবর দিয়েছিল? কই,ওকে তো কিছু বলেনি। তার ভাবনার মাঝেই রাহাত ছুটে এলো কাছে।
ধড়ফড়িয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ ছোটাপু কোথায়,ছোটাপু? তোমার কাছেই তো থাকে তাই না? দেখো আমরা সবাই এ ওকে নিয়ে যেতে এসেছি!”
ছোটো ছেলেটার ঠোঁটে চাঁদের মতো হাসি। আনন্দ তার চোখেমুখে। নূহা তখনও মূক বনে৷ সালাম কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলেন।
“ কেমন আছিস?”
নূহা মাথা নাড়ল কোনওরকম। বোঝাল,
ভালো আছে।
সালমা ঘরের ভেতরটায় এক পল উঁকি দিলেন। কণ্ঠে নিপাত অভিমান,
“ আর সে কোথায়?”
মিথিলা বলল,

“ আম্মু,সব কি এখানেই দাঁড়িয়ে শুনবে? আর নূহা,তুমিও কি আমাদের ভেতরে নিয়ে যাবে না?”
“ হুঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ এসো।”
নূহার কণ্ঠ জড়ানো। কথা বের হতেও কষ্ট হলো যেন। সালমা চপল পায়ে ঢুকলেন ভেতরে।
চারপাশ দেখে বললেন,
“ ওমা! এত সাজানো কেন? কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে বুঝি?”
“ জি।”
মিথিলা বলল,
“ তোমার জন্মদিন তাই না?”
নূহা অবাক চোখে চাইতেই,
জানাল,

“ প্রিন্সেস গাউন পরে আছো। আবার মাথায় ক্রাউন পরা! ওই দেওয়ালেও তো হ্যাপি বার্থডে লেখা দেখছি। ইস,আগে জানলে তোমার জন্যে নিশ্চয়ই একটা গিফট নিয়ে আসতাম।”
নূহার হাসি পেলো এবার। এত বিষাদে হাসলও ঠোঁট চেপে। মিথিলাকে তো ও আজ প্রথম দেখছে না। বলতে গেলে শুরুটা সেই শৈশব থেকেই। কাউকে নিজের পয়সায় একটা চকলেট খাইয়েছি কী না কে জানে! সে দেবে গিফট! নাহ,এত চাপাবাজী না করলেও চলতো!
সালমা এঘর-ওঘর সবদিকে চোখ বোলালেন। কোথাও পুষ্পিতা নেই। রাহাতটাও অধৈর্য হয়ে বলল,
“ ছোটাপু না এখানে থাকে? কোথায় গেছে? আমরা আসব শুনে কি লুকিয়ে আছে?”
নূহার মাথায় কিছু ঢুকছে না। ওনারা কী করে জানলেন পুষ্পিতা এখানে! কেউ ফোন করে না ডাকলে তো জানার কথাই নয়। কৌতূহলে জ্বিভ ফস্কে বেরিয়েই গেল,

“ পুষ্পিতার কথা আপনারা কী করে জানলেন, আন্টি?”
সালমা বললেন,
“ আমাদের ওর স্যার ফোন করেছিল।”
নূহা চমকে বলল,
“ স্যার? কোন স্যার?”
মিথিলা বলল,
“ আসলে তা জানি না। উনি নাম-ধাম বলেননি বুঝলে! হঠাৎ কাল রাতে মায়ের নম্বর ফোন করলেন। কেমন গড়গড় করে জানালেন পুষ্পিতা গাজীপুরে। তারপর এই বাড়ির ঠিকানাটা দিলেন। মা যখন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে?
শুধু বললেন, আমি ওর স্যার। ব্যস এতটুকুই! আসলে পুষ্পিতাকে আমরা এত খুঁজছিলাম! সত্য-মিথ্যে যাচাই করেও সময় নষ্ট করিনি। একেবারে সবাই মিলে একসাথে ছুট্টে এসেছি! কিন্তু কোথায় ও?”
নূহার মেজাজ খারাপ হলো।

আদিখ্যেতা দেখাচ্ছে! ছোটো থেকে তো কম জ্বালাসনি মেয়েটাকে। এখন দরদ উথলে পড়ছে তাই না? পুষ্পিতা যেখানে ইচ্ছে থাক,তোর মরতে গাজীপুরে আসতে হবে কেন? বেশভূষা দেখো,বিয়ে হয়েছে অথচ সেই আগের মত চলাফেরা! আঁটোসাটো জিন্স-টপ্স! শরীরের ভাঁজ গুলোও হাঁ করে চেয়ে আছে। চালচলন আগেও এমন ছিল, এখন বিদেশে থেকে আরো বেড়েছে। তা ওখানে যেমন ইচ্ছে চল। এটাতো বাংলাদেশ। বাঙালি মেয়ে! একটু শাড়ি,থ্রিপিস পরে ভদ্র সাজলে কী হয়?
সে মুখ গোঁজ করে বলল,

“ ছাদে।”
এক কথায় লাফিয়ে উঠল রাহাত।
“ ছাদে! আমি যাই?”
মায়ের অনুমতির আশাতেও সে রইল না,একেবারে ঝট করে দৌড় লাগাল বাইরে। হেসে, দুদিকে মাথা নাড়লেন সালমা । পুষ্পিতার কথা শোনার পর থেকেই রাহাতটা আনন্দে উদ্বেল হয়ে ভাসছে। অবাক করা ব্যাপার, মিথিলাও তাই। খোরশেদের অসুস্থতা কমেনি! পুরো বেড রেস্টে আছেন। তবে বারবার করে বলেছেন পুষ্পিতাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সাথে নিয়ে যেতে। দরকার হলে ফোনে মাফ চাইবেন তিনি। সালমার তখন হৃদয় জুড়িয়ে গিয়েছিল। সবার এত পরিবর্তন! পুষ্পিতার প্রতি ভালোবাসা! ধর্মের কল তবে সত্যিই বাতাসে নড়ে?

ছাদে মোট আটটি টেবিল পাতানো গিয়েছে। এর বেশি জায়গা হয়নি। তার একটা টেবিলে পরিবেশনের দায়িত্ব নিয়েছে নাহিদ। রাতের সবটুকু অন্ধকার মুখে নিয়ে কোনওরকম হাত চালাচ্ছে কাজে। কিন্তু মন! মনের খেয়াল যে অন্য কোথাও আটকে। চোখের পর্দায় কেবল নূহার বিষণ্ণ মুখের পায়চারি।
ও যখন বলল,

“ আমি আপনাকে শুধু বন্ধুই ভাবি? সুন্দর হাসিটা কেমন দপ করে মুছে গেল মেয়ের! দৃশ্যটা ভেবেই নাহিদের বুকটা আরেকবার মুচড়ে উঠল ব্যথায় । সে নূহাকে কষ্ট দিতে চায়নি। কিন্তু মেয়েটা কদিনে ওকে নিয়ে যে অবান্তর স্বপ্ন বুনছে সেসবের লাগাম টানা প্রয়োজন। সব তো ভালোই চলছিল। কিন্তু
নূহার ওই আচানক সান্নিধ্যই তার পুরোটা এলোমেলো করে দিয়েছে। কাল সারারাত ঘুমায়নি নাহিদ। নূহার হঠাৎ জড়িয়ে ধরা, চোখের ভাঁজে লোকানো স্পষ্ট প্রেম,কথার ধারে লুটিয়ে দেয়া অনুভূতি এসবে পুরো মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। কেন মেয়েটা বন্ধুত্বের গণ্ডি পেরিয়ে ওর প্রেমে পড়তে গেল?
মিথিলার বিষয়ে সবইতো বলেছিল নাহিদ। তারপরেও!

এই ব্যাপারটা নাহিদ আর বাড়াতে চায়নি। এক সেকেন্ডের জন্যেও না। তাইতো সব ভুলে আজকেই মুখের ওপর অমন করে বলল কথাটা। নূহা কষ্ট পেলে পাক। কী করার আছে? কতক হাহাকার আর যন্ত্রণা মিশিয়ে তৈরি রশিতে যে নাহিদের হাত পা বাঁধা। মিথিলাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ও ভালোবেসেছিল। এক উন্মুক্ত কাঙাল সে এখন! অমন একটা ধাক্কার পর নতুন করে কাউকে ভালোবাসার মত সাহস ওর নেই। নূহা না হয় বন্ধুই থাকুক। কিছু সম্পর্ক ভালোবাসায় নয়,বন্ধুত্বেও সুন্দর!
নিজের মতো যুক্তি সাজিয়ে ফোস করে শ্বাস ফেলল নাহিদ। সময় তো বেশি গড়ায়নি। হয়ত নূহার অনুভূতিও স্বল্প। একদিন ঠিক সামলে উঠবে। বিট্টু তো বলেছিল সেদিন,পুষ্পিতা ফ্ল্যাটে যেতে রাজি হয়েছে। সাথে নিশ্চয়ই নূহারাও যাবে! তখন আর সকাল বিকাল দেখা হবে না। বিট্টুকে বলে নাহয় ও অন্য ফ্ল্যাটে উঠবে। একবার দুরুত্ব বাড়লে প্রেম সবাই ভুলে যায়।
তার ধ্যান ভাঙল এক প্রৌঢ়ার আওয়াজে। প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“ আমাকে আরেক পিস রোস্ট দাও তো, বাবা!”
নাহিদ মাথা নাড়ল। রোস্টের জায়গায় চামচ ভরে ভাত তুলে দিলো থালাতে। রমণী বললেন,
“ এ মা,রোস্ট চাইলাম যে!”
ছেলেটা কিছু হতভম্ব হয়! বেখেয়ালে দিয়ে ফেলেছে। জ্বিভ কেটে বলে,
“ সরি, আন্টি! দিচ্ছি।”
রোস্ট তুলল নাহিদ। একটার জায়গায় দু পিস দিতেই হেসে ফেললেন তিনি।
“ তুমি মনে হয় কিছু নিয়ে চিন্তায় আছো।”
নাহিদ লজ্জিত চোখে চাইল। কিছুটা হতাশাও মিশে এলো তাতে। ও আসলেই ভাবছে। যে ভাবনার আদ্যপ্রান্ত সবখানে শুধু নূহা মিশে। মেয়েটার প্রেম ফিরিয়ে দিলেও,মোমের ন্যায় স্নিগ্ধ মুখখানা চোখের পর্দায় আসা ফেরাবে কী করে!

নাহিদ গ্লাসে পানি ঢালল, অথচ সব কেমন আনাড়ি হাতের মতো ছড়িয়ে পড়ল টেবিলে। ভুলগুলো তার কমছেই না। হতেই থাকল পরপর। শেষে ক্ষান্ত দিলো ছেলেটা। চাইল অদূরে। পুষ্পিতার হাতে কাজ নেই।
যে টেবিলে খাবার দিচ্ছিল ওরা উঠে গেছে। নাহিদ হাত তুলে ডাকল ওকে। কাছে আসতেই বলল,
“ আপু,কিছু মনে না করলে এখানে খাবার দিতে পারবে? আমি একটু বসতাম!”
“ হ্যাঁ, ভাইয়া নিশ্চয়ই। আপনি যান।”
প্রসন্ন হেসে চলে গেল নাহিদ। পুষ্পিতা দাঁড়ানো মাত্রই তীব্র হাজির । ওৎ পেতে থাকা শিকারীর ন্যায় নজর তার। মেয়েটা অমনি চোখ নামাল নিচে। তীব্র খুব ঘনিষ্ঠে এসে থামল। জিজ্ঞেস করল,
“ খাবে কখন?”

স্বাভাবিক কথা। কণ্ঠ,চাউনী সবই তাই। এতক্ষণ যেমন অকথ্য মধুর যাতনায় মারছিল অমন আর নেই। পুষ্পিতা স্বস্তি পেলো একটু! ফিরে বলল,
“ আপনার খিদে পেয়েছে?”
“ না। যে স্ট্রবেরি খেয়েছি,কাল অবধি কিছু না খেলেও চলবে।”
পুষ্পিতা চেহারা টানটান করে ফেলল। কুণ্ঠায় হাঁসফাঁস করে দেখল চারিদিক। তীব্র আস্তে
বলায় বাকিরা শোনেনি। কিন্তু ওতো শুনেছে,বুঝেছেও। স্যার কী শুরু করেছেন? লজ্জার বান ছুড়ে ছুড়ে মেরে ফেলবে ওকে? স্ট্রবেরি খেতে সে বলেছে? উনিই তো জোর করলেন। কী ধারশোধের চক্করে ঠোঁটটাও কেটে গেছে। একটু মাংস মুখে দিতে গেল,ঝোল লেগে জ্বলছে এখনও। নূহা তখন অমন আইঢাই করে চলে গেল কেন,পুষ্পিতা বেশ জানে। নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছে সব। ছি! কী বিশ্রী ব্যাপার!
ওদের কথার মাঝেই আচমকা এক জোড়া নরম হাত হাওয়ার মত এসেই পুষ্পিতার কোমর চেপে ধরল। সজোরে ডাকল,

“ ছোটাপুউউউউ!”
পুষ্পিতা চমকে যায়। থমকে ডাকে,
“ রাহাত!”
ছেলেটা সাথে সাথে কেঁদে ফেলল। ঠোঁট ভেঙে উঠে এলো চূড়ায়,
“ তুমি কত খারাপ!
আমাকে ছেড়ে এখানে এসে এত মাস থাকতে পারলে? আমার জন্যে একটুও মন খারাপ করেনি?”
কিছুক্ষণ তাজ্জব বনে চেয়ে রইল পুষ্পিতা। পরপর ধপ করে বসেই, ওকে টেনে আনল বুকে। রাহাতের ছোট্টো মুখটা হাতে তুলে সংখ্যাতীত চুমুতে ভাসিয়ে দিলো পুষ্পিতা। দু ভাইবোনের মিলন মেলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তীব্র। প্রস্থে চওড়া বুকটা ফুলিয়ে এক টুকরো তৃপ্ত শ্বাস ফেলল সে।
টের পেলো

পুষ্পিতার কান্নার শব্দ বাড়ছে। চারপাশ থেকে মুখ তুলে চেয়েছে অতিথিরা। আয়েশাও অবাক হয়ে দেখছেন।
হঠাৎ পুষ্পিতা সচকিত হলো।
চট করে রাহাতকে সরিয়ে এনে বলল,
“ তুই, তুই এখানে কী করে এলি?”
রাহাত উত্তর দিতে গেলে,আচমকা নজর পড়ল পাশে। যেমন হুট করে কান্নায় গাল ভাসিয়েছিল,অমন করেই উবে গেল সেটা। চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“ বিট্টু ভাইয়া! আপনিও এখানে থাকেন?”

তীব্র হাসল। ছোটাপুকে ফিরে পাওয়ার আবেগ নিমিষেই ভুলে গেল রাহাত। পুষ্পিতাকে মুহুর্তে ছেড়ে লাফিয়ে তীব্রর কাছে এলো। তার একপাশে আচড়ে রাখা ঝাঁকড়া চুল হাত বাড়িয়ে এলোমেলো করে দিলো তীব্র। পুষ্পিতার সব কিছু তখনও প্যাঁচ বেধে আছে। রাহাত এখানে আসবে কী করে? এটা কি কল্পনা? কল্পনা এত জীবন্ত হয়?
তীব্র ভ্রু উঁচাল তখন,
“ কী, কথা নেই কেন?”
“ ও এখানে…”
পুরো কথার আগেই রাহাত খই ফোটাল জ্বিভে,
“ শুধু আমি নই তো,মাও এসেছে। নিচে ডাকছে তোমায়!”
পুষ্পিতা আকাশ থেকে পড়ল। কিছুকাল হতবাক থেকেই,সহসা ছুট লাগাল নিচে। তীব্র সেপথ হতে চোখ ফেরায়। রাহাতের দিক চাইতেই দেখল, তার ঠোঁটে হাসির জোয়ার ছুটেছে ।
ভ্রু উঁচাল তীব্র,

“ খুশি?”
রাহাত জবাব দেয় না। দুহাতে ওর বলবাণ শরীর জাপটে ধরে। কণ্ঠে
উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে,
“ ইউ আর দ্য বেস্ট ব্রাদার ইন ল্য ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড!”

সালমা বেগম অনেকক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে আছেন। মুখায়বে প্রতীক্ষার আলো। ততটা সময়ে বিস্ময়ের ধাত সামলে নিয়েছে নূহা। চিত্ত গগণে সহজ হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা তার। যাতে একটু আগের মনঃকষ্ট ভুলেও চেহারায় চিহ্ন না ফেলে। হেসে বলল,
“ আন্টি,দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। পুষ্পিতাটা আপনার কথা শুনলেই উড়ে আসবে!’’
ভদ্রমহিলার চোখদুটো ছলছলে। অহেতুক বুক কাঁপছে। কতদিন পর মেয়েটাকে দেখবেন!
যে মেয়েটা কাঁথায় মোড়ানো অবস্থায় একদিন তার কোলে এসেছিল। আপা মারা যাওয়ার সময় যখন হাতদুটো ধরে বলল,

“ ওকে একটু দেখিস! ওর বাবার ভরসায় রাখিস না কিন্তু।”
সেই দাফন-কাফন সাড়তে সাড়তেই জানা গেল,পুষ্পিতাকে ওর বাবা এতিমখানায় দিয়ে এসেছে। আরেকটু দেরি করলে অন্য এক পরিবার দত্তক নিয়ে ফেলতো!
অবশ্য ভালোই হোতো! এমন উচ্ছিষ্টের মতো মেয়েটাকে বড়ো হতে হোতো না। ভাগ্যিস নূহাটা ছিল,নাহলে কোথায় থাকত পুষ্পিতা? উনি তো থানায় একটা ডায়েরি,আর কাছেপিঠের কয়েকজনের থেকে খোঁজ নিয়ে হাত ধুয়ে বসেছিলেন। যদি মেয়েটার সত্যিকারের মা হতেন,পারতেন এসব?
খামতি তাহলে তার ভালোবাসাতেও কিছু কম ছিল না!
সালমা পোড়া শ্বাস নিলেন। সেসময় তিরের বেগে ঘরে ঢুকল পুষ্পিতা। দম টানা ঢেউ যেমন দূর হতে তেড়ে আসে? ডাকটা ঠিক অমন শোনাল,

“ মণি!”
সালমা চোখ তুলতেও পারলেন না,পুষ্পিতা ছুটে এসেই জাপটে ধরল দুহাতে। টাল সামলাতে চেয়ারের হাতলটা চেপে ধরলেন তিনি। সহসা একটা কান্নার তুবড়ি ছিটকে উঠল ঘরে। কখনও আবার চারদেওয়ালের সাদা রং-এ মিশে মিশে হাওয়ায় উড়ে বেড়াল সেসব।
পুষ্পিতা এত জোরে কোনওদিন কাঁদেনি। দুরুত্ব নিবারণের আহাজারি তার কান্নায়। অন্তত নূহা এমনটা দেখেনি কখনও। প্রকোপে তার জোর করে শুকনো রাখা চোখও ফের জলে ভরে উঠল।
পাশে দাঁড়ানো মিথিলা মুচকি হাসল তখন। পুষ্পিতাকে যখন একবার পেয়েছে ওর প্রতি আর কোনো অন্যায় সে করবে না। পেছনের সব ভুলও শুধরে নেবে এবার।
সালমা বেগম কাঁদছেন,তবে শব্দ নেই। লাগামহীন মেয়েটার মাথায় নিবিড় হাত বোলাচ্ছেন তিনি। আহা,বুকখানা কেমন ভরা ভরা লাগছে!

পুষ্পিতা মুখ তুলল। প্রলাপ করল ভেজা গলায়,
“ মণি তুমি, মণি… আমি…”
হেচকির তোড়ে অর্ধেক কথাই অস্পষ্ট ওর। সালমা হেসে বললেন,
“ একটু শ্বাস নে ! আমি কি কোথাও চলে যাচ্ছি?”
পুষ্পিতা আবার জড়িয়ে ধরল। বুকের ভেতর তৃপ্তির একটা লম্বা স্রোত বইছে। এই তৃপ্তি মণির গা থেকে ছুটে আসা মা মা গন্ধের! যেটা ও আর কারো থেকে পায় না ৷ …
আচমকা পিঠে আরেকটা কোমল হাত পড়ল। পুষ্পিতা মুখ তুলে চায়। মিথিলা হেসে শুধায়,
“ কেমন আছিস?”
ও অবাক হয়ে বলল,
“ তুমি!”
মিথিলার হাসি গাঢ়,
“আশা করিসনি, তাই না?”
সালমা বললেন,

“ ও কদিন আগেই দেশে এসেছে। তোর কথা শুনে নিজেই ছুটে এলো।”
মিথিলার কণ্ঠস্বর বুজে এলো হঠাৎ,
“ মাকে জড়িয়ে ধরলি, আমাকে ধরবি না?”
নূহা বিস্ময়ে দুই ভ্রু উঁচাল। বাবাহ! এ কী শুনছে?
পুষ্পিতা তো রাগ ধরে রাখার মেয়ে নয়। একটু ভালো কথার তাপেই তার সমস্ত ভালোবাসা গলে গিয়ে নদী বানিয়ে ফেলল।
হাত বাড়িয়ে মিথিলাকেও জড়িয়ে ধরল মেয়েটা।
কিন্তু মিথিলার চোখের পানি নূহা মানতেই পারল না। এসব কী দেখছে ভাই! মরুভূমিতে সুইমিংপুল?
হাউ!

আয়েশা খাতুন ছাদ থেকে হুটোপুটি করে নেমে এলেন। সালমা এসেছেন শুনে আর বসে থাকা যায়? মিলনমেলার এক চোট কান্নাকাটি অতক্ষণে শেষ!
পুষ্পিতা মেঝেতে বসে আছে। মাথাটা সোফায় বসা সালমার কোলের ওপর রাখা। ভদ্রমহিলা কত কথা বলছেন! আদর করছেন। পাশেই মিথিলা।
নূহা ওদের জন্যে চা বসিয়েছে চুলায়।
আয়েশা এসেই বললেন,
“ আপা,কেমন আছেন? আল্লাহ! আপনাদের সাথে দেখা হবে ভাবতেও পারিনি।”
সালমা উঠে দাঁড়ালেন।

“ খুব ভালো আপা! আপনি কেমন আছেন? এখানে কবে এলেন!”
“ সে তো অনেক দিন। মেয়ের খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন বুঝি!”
“ আর বলবেন না,আমিতো প্রায় চিন্তায় পাগল ছিলাম ও কোথায় গেল! থানাতেও ডায়েরি করেছিলাম। হঠাৎ কাল ফোন এলো, বলল পুষ্পিতা গাজীপুরে। একটা ঠিকানা দিয়ে বলল এখানে আসতে। আমরা তখনও জানতাম না ও আপনাদের কাছে। এখানে আসার পর নূহাকে দেখেই বুঝেছি!”
পুষ্পিতা চোখ ঝাপটাল দুবার,
“ ফোন! কে ফোন করেছিল মণি?”

“ নাম বলেনি। শুধু বলেছেন তোর স্যার হন। তুই সঙ্কোচ করছিস,তাই ফোনটা উনি করেছেন।”
পুষ্পিতার বুঝতে সময় লাগেনি। মাথায় প্রথমেই এলো তীব্রর নাম। সেদিন মানুষটা বলেছিল সবাইকে ডাকার কথা। পুষ্পিতা খোরশেদের ভয়ে সাহস করেনি। সেজন্যে কী উনিই এসব করলেন?
তাহলে কাল এই কারণেই পুষ্পিতার ফোন নিয়েছিলেন উনি?
এর মাঝেই রাহাতকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকল তীব্র। হাস্যোজ্জ্বল মুখটা তৎক্ষনাৎ উবে গেল মিথিলাকে দেখে। এই গোল্ড ডিগার এখানে কেন?
তীব্র চোখমুখ কুঁচকে এসে দাঁড়াল। রাহাত তার আঙুলটা খাঁচার মত আটকে রেখেছে। লম্বাচওড়া মানুষটা আসা মাত্রই বাকিদের চোখ সবেগে আছড়ে পড়ল এদিকে। মিথিলা আঁতকে উঠল অমনি। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,

“ বিট্টু মাস্তান! এ এখানে কী করছে?”
সালমা শোনেননি। বিট্টু মাস্তানকে দেখেনওনি কখনও? চিনতে না পেরে বললেন,
“ উনি কে?”
তীব্রর প্রসঙ্গ এলেই আয়েশার হাসি বেড়ে যায়। এবারেও তাই হলো। গদগদ ভাষায় জানালেন,
“ ওই তো পুষ্পিতার স্যার। আমার মনে হয় ওই আপনাদের ফোন করেছিল। কী তীব্র, তুমিই ওনাদের ফোন করেছিলে,তাই না?”
তীব্র কপাল কুঁচকে রেখে মাথা নাড়ল। ফোন করেছিল পুষ্পিতাকে খুশি করতে। কিন্তু এখন নিজের মেজাজেরই রফাদফা দশা। নাহিদ এখানে,আবার মিথিলাও। যা একটু সামলেছিল নিজেকে,গোরুটার এখন তাও শেষ হবে!
মিথিলার অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম! বিট্টু মাস্তান পুষ্পিতার স্যার মানে,কী শুনছে এসব? হতভম্ব চোখে পুষ্পিতার দিক চাইল সে। কিন্তু এসবের কানাকড়িও মেয়েটার মাঝে নেই। বরং কেমন হাঁ করে ছেলেটাকে দেখছে পুষ্পিতা! ও কি জানে না,তার বিয়ের দিন এই অসভ্য ছেলেই ওকে তুলে নিয়ে গেছিল? কী আশ্চর্য!

সালমা খুশি হয়ে বললেন,
“ ওমা তাই? আপনিই ফোন করেছিলেন আমাদের? কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো!”
তীব্র রাগে ভদ্রতা বজায় রাখতে পারল না। কর্কশ কণ্ঠে বলল,
“ দিতে হবে না। আপনার ধন্যবাদ, আপনার কাছেই রেখে দিন।”
তারপর রাহাতের হাতটা ছাড়িয়েই বেরিয়ে গেল সে। প্রত্যেকে একটু থতমত খেল। আয়েশাও ভীষণ অবাক হলেন। তীব্রর এমন আচরণ তিনি আজ অবধি দেখেননি। হতবাক সালমাকে বললেন,
“ মনে হয় আজকে মন মেজাজ ভালো নেই। এমনিতে ছেলেটা কিন্তু খুব ভালো আপা! কী যে বিনয়ী কী বলব!”

মিথিলা নাক ফোলাল কথাটায়। মাস্তান আবার বিনয়ী? কয়েক মাস আগে তাদের বিল্ডিংয়ের সামনে যে রঙ্গ দেখিয়ে এসেছিল তা সে জীবনে ভুলবে না। এই কুলাঙ্গারটার জন্যেই পলাশ ওকে অতীত নিয়ে খোঁচা দিতো! সমস্ত পাড়ার লোক এখনও কেমন বাঁকা চোখে তাকায়! এসব তো এই অসভ্যটার জন্যেই। একে মিথিলা ছাড়বে না। একটা সুযোগ আসুক,এমন অবস্থা করবে! বাপ মন্ত্রী বলে দুনিয়া হাতে নিয়ে বসে থাকা তাই না?
তীব্র বের হতেই নাহিদের মুখোমুখি হলো। সে এদিকেই আসছে। তীব্র অমনি সচেতন হয়ে দাঁড়াল। একবার ঘরের দিক দেখে বলল,
“ দাঁড়া!’’
আচানক তর্জণে সাদাসিধে ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। দাঁড়াল চটপট।
তীব্র বলল,
“ ভেতরে যাবি না।”

নাহিদ ভড়কালো খুব! ও কি কিছু করেছে? বিট্টু এত রেগে আছে কেন? মিস নূহা কি ওকে নালিশ-টালিশ ঠুকেছে না কি? দুজনের তো এখন খুব ভাব! ভাইবোন পাতিয়েছে না!
ভয়ে ভয়ে বলল,
“ ককেন?”
তীব্রর কণ্ঠ পুরূ,
“ আমি বলেছি তাই।”
“ কিন্তু আন্টির সাথে যে কাজ ছিল । হিসেবটা দিতাম।”
“ বলছি তো এখন যাওয়া যাবে না? নিচে যাব চল।”
“ এখন?”
তীব্র এত কথা বাড়াল না। টেনেটুনে ওকে নিচে নিয়ে চলল। কিন্তু কথার প্রতিধ্বনি খোলা দোর হতে পৌঁছে গেল ও ঘরে। মুহুর্তে সজাগ হলো মিথিলা। বসা থেকে চকিতে উঠে দাঁড়াল । কণ্ঠটা একদম নাহিদের মত না?
সে ত্রস্ত পায়ে দোর অবধি আসে।
দরজার বাইরে থেকে এদিক-ওদিক চায়। কেউ নেই। ভাবল, মনের ভুল। পরপরই মাথায় এলো অন্য এক ভাবনা।

বিট্টু মাস্তান আর নাহিদ তো বন্ধু। যদি মাস্তানটা এখানে থাকে,নাহিদও থাকতে পারে তাই না? হ্যাঁ পারেই তো। নাহিদ তো বাড্ডায় ছিল না। হতে পারে এখানেই আছে।
নূহা তখন চা নিয়ে এসেছে। মিথিলার কাপটা তুলে দরজার কাছে, ওর পাশে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
“ কাউকে খুঁজছো?”
মিথিলা নড়ে ওঠে,
“ হু? না মানে…”
টুপ করে কথাখানা গিলে নিলো সে। প্রসঙ্গ ঘোরাতে বলল,
“ আচ্ছা, পুষ্পিতার স্যারকে তোমরা আগে থেকে চেনো?”
“ চিনব না কেন? উনি তো বাড্ডার সেই বিট্টু মাস্তান। তুমি চেনো না?”
ও চমকে বলল,

“ তোমরা জানো এটা? পুষ্পিতাও কি জানে?”
নূহা কাঁধ উঁচাল,
“ হয়ত জানে।”
“ কিছু বলেনি? এই ছেলেই তো ওকে তুলে নিয়ে গেছিল!”
“ সেটাও জানি। তবে আম্মু কিছু জানে না।”
পরপরই কাঁদোকাঁদো মুখ করল সে। বলল,
“ আসলে কী বলোতো, আপু! আমি জানাতে চেয়েছিলাম আম্মুকে। কিন্তু ও না অনেক বড়ো মাস্তান! কথায় কথায় খুন করে জানো? পকেটে সব সময় ছুড়ি নিয়ে ঘোরে। এত ধার সেটাতে। তুমি একবার দেখলেই ভয়ে ইয়ে করে দেবে। ইয়ে বুঝেছ তো?
আমাকে তো একবার হুমকিই দিয়েছিল, যদি ওর পরিচয় এখানে ফ্ল্যাশ করে দেই, ও আমাকে জবাই করে ফেলবে। শুধু আমি না,কাজটা যে করবে সবারই একই অবস্থা করবে বলল। মেয়ে-ছেলে কিচ্ছু মানবে না। এর আগেও নাকি তিনটে খুন করেছে। সব গুলো লাশ গুম। মন্ত্রীর ছেলে বলে কেউ টেরও পায়নি।”

মিথিলার চায়ের কাপ ধরা হাতটা ঠকঠক করে উঠল। চোখ প্রকট করে বলল,
“ কী বোলছো? তিইইইনটেএএ খুউউন?”
“ হ্যাঁ, তবে আর বলছি কী? কিডন্যাপিং কেসও আছে ওর নামে। ঢাকায় থাকাকালীন কয়েকজনের কাছে শুনেছিলাম আমি।
তাহলে বলো, অমন তারছেড়া গুণ্ডার সাথে আমি পাঙ্গা নেব? না বাবা, অত সাহস আমার নেই।”
মিথিলার গলা শুকিয়ে গেল। ছেলেটাকে কী সুন্দর দেখতে! অথচ এত ভয়ঙ্কর! খুন,আবার কিডন্যাপিং? বাবা তো শুধু বলেছিল টুকটাক মারামারি আর চাঁদাবাজি করে। মেয়েদের বিরক্ত করে। কিন্তু ভেতরের এসব কথা তো ও শোনেইনি। একে কী না ও শায়েস্তা করতে চায়? হায় আল্লাহ! নূহা ঠোঁট টিপে হাসল। ফিসফিস করে বলল,
“ শোনো আপু, তোমাকে একটা বুদ্ধি দেই। একদম মুখ খুলতে যেও না। চুপ করে থাকো বুঝলে। মাস্তানটা কিন্তু সত্যিই ভালো নয়! ওর কালো হাত অনেক লম্বা। এধার-ওধার করলেই তোমাকে কিডন্যাপ করে পৃথিবী থেকে হাপিস করতে কিন্তু দু মিনিটও লাগবে না।”
মিথিলা ঢোক গিলে মাথা কাত করল,

“ আ আচ্ছা।”
নূহা ঠোঁটের হাসি বহুকষ্টে চাপা দিয়ে রাখল।
তারপর অপেক্ষা করল নাহিদের। ঢেঁড়সটার মনের মানুষ এখানে এসেছে! দেখলে ঢেঁড়সটা কী করবে? খুশিতে মরেই যাবে হয়ত!
আচ্ছা, সেই খুশি নূহা সইতে পারবে তো? ওই সময় টুকুতে ওকে অন্ধ করে দিলে হোতো না?

তীব্র চার কাপ চা খেয়েছে। পাঁচ নম্বর কাপটা হাতে এখন। কয়েকবার ঘড়ি দেখেছে মাঝে। সময় মোটে যাচ্ছে না আজ। রাত তো প্রায় অনেক! পুষ্পিতার মণিরা চলে যাবে? না থাকবে? ভালো করতে গিয়ে আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়ল তো!
সে পাশ ফিরে নাহিদের দিক চাইল এক পল। ছেলেটা চুপচাপ! সাথে মনমরা। হঠাৎ হলোটা কী?
যাক গে, যা হয় হোক। আপাতত গোল্ড ডিগারটার সামনে না পড়লেই চলবে।
তীব্র আবার ঘড়িতে সময় দেখল। এগারটা ছাড়াবে প্রায়!
এতক্ষণে নির্ঘাত চলে গেছে।

তীব্র উঠে দাঁড়াল। নাহিদ তখনও হাতে কাপ নিয়ে বসে। চা অর্ধেকও শেষ হয়নি৷ নূহার ওই বিষাদে ডোবা চেহারা মনে পড়লেই গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না। এই যে আজ এত আয়োজন,নাহিদ নিজের হাতে মাংস সার্ভ করল সবাইকে। আনা-নেওয়াও করল। সব কিছুর তদারকিতেও সে। অথচ একটুখানি জ্বিভে ছুঁয়েও দেখেনি। কী করে দেখবে? কাল রাতে যখন বুঝতে পারল নূহা ওকে পছন্দ করে! নাহিদের মস্তিষ্ক সাত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা নিতে পারেনি। নূহা ওর বন্ধু! বন্ধুত্ব থেকে এসব প্রেম ট্রেমে গিয়ে কেন সম্পর্ক খারাপ করতে হবে? নাহিদ আর এসবে জড়াতে চায় না। সাহস নেই তার!
এক মিথিলাতেই ঢেড় শিক্ষা হয়েছে। সব চেয়ে বড়ো কথা, ও তো নূহাকে ফিলই করে না। অনুভূতি না থাকলে সেখানে ভালোবাসা
আসবে কী করে?

কিন্তু এখনও জ্বালা কমেনি। উলটে বাড়ছে। এক ফোঁটাও স্বস্তি পাচ্ছে না নাহিদ। হ্যাঁ ভেতর ভেতর যে ছটফটানো ছিল নূহাকে সাবধান করা নিয়ে, সেটা নেই।
কিন্তু এখন মরছে পরিতাপে। আজকে মেয়েটার জন্মদিন। এত তাড়াহুড়ো করে আজ এসব না বললেও পারত! মিস নূহা সারাদিন হাসিখুশি ছিল!
সাদা গাউনে একদম শরতের মেঘের মতো লাগছিল দেখতে।
সেই সব মুছে গেল ওর ঐ একটা কথায়। ভালোবাসা না বাসা পরের ব্যাপার, নাহিদ তো নিজের বন্ধুকে এভাবে দুঃখ দিতে পারে না।
যতটুকু দিয়েছে তাতেই ভেতরকার সব শান্তি শেষ। কী করবে এখন? সুন্দর করে একটা সরি বলে দেবে?

কী দিয়ে সরি বলবে?
ফুল? না না, এবার অন্য কিছু।
নাহিদ তৎপর উঠে দাঁড়াল।
তীব্র ততক্ষণে চায়ের বিল মিটিয়েছে। ও ধড়ফড়িয়ে বলল,
“ আমি একটু আসছি!”
“ কোথায় যাবি?”
“ ওই যে মেইন রোডের বড়ো মার্কেটটা আছে না? ওখানে। ”
তীব্র আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলো না। নাহিদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে দৌড়ে গেল সামনে।
তীব্র কপাল কুঁচকে আবার বেঞ্চে বসল। সিগারেট বের করে ঠোঁটে বসাতে গেলে থমকাল একটু! এখানে তার ভীতু মেয়ের গভীর ছোঁয়া লেগেছে। সিগারেটের আগুনে সেই ছোঁয়া ঝলসে যাবে না?
আজ থাক,কাল খাবে!

ও সিগারেট প্যাকেটে ঢুকিয়ে আবার পকেটে ভরে রাখল।
নাহিদ ফিরে এলো দশ মিনিটে। হাতে কিছু আছে। সারাদিন গোমড়া করে থাকা মুখটায় এখন সূর্যকিরণের কমতি নেই।
তীব্র হাতের দিক চেয়ে বলল,”
“ কী এতে?”
“ চকলেট!”
দম টেনে বলল নাহিদ।
“ কার জন্য?”
উত্তরের বদলে মাথা নুইয়ে হাসল ছেলেটা। তীব্র নিম্নোষ্ঠ কামড়াল। এসব ওই গোল্ড ডিগারের জন্যে নয় এটুকু নিশ্চিত। সে মেয়ে যে এখানে এসেছে, নাহিদ তো জানেই না।
আন্দাজ করে বলল,

“ নূহার জন্য?”
সবেগে মাথা নাড়ল নাহিদ।
সন্তর্পণে হাঁপ ছাড়ল তীব্র। কপাল চুল্কানোর ভান করে হাসি ঢাকল ঠোঁটের। বলল ভারি গলায়,
“ আয়।”
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই নাহিদ স্বতঃস্ফূর্তপায়ে সামনে হাঁটা ধরে। তীব্রর পায়ের গতি শিথিল। যেন আজ ইচ্ছে করে পেছনে পড়ল ওর৷
এদিকে,
আয়েশা ছাদে এক ঝাঁক অতিথি বসিয়ে এসেছেন। সালমা, রাহাত, পুষ্পিতা সবাইকে নিয়ে আবার চললেন সেথায়। ওনাদেরও তো আপায়্যান দরকার। নূহা ফ্রেশ হয়েছে। বার্থডে গাউন পালটে সুতির জামা পড়েছে একটা।

মিথিলা তখন সোফাতে বসেই সাজগোজে ব্যস্ত! স্বভাব কি আর সহজে যায়?
ওখানে অত মানুষ! জার্নি করে এসে তার মুখের অবস্থা করুণ। চুল ঠিক নেই। কাজল মুছে গেছে। ধুলোবালিতে মুখটাও কালো লাগছে ভীষণ!
তাই নতুন করে সব কিছু ঠিকঠাক করল। নূহা তা দেখে মাথা নাড়ল দুদিকে। এই মাও না, জানে ও মিথিলাকে শুরুর দিন থেকে সহ্য করতে পারে না। তাও ওকে সাথে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। মিথিলার সাজগোজ দেখতে দেখতেই হঠাৎ ভ্রু কোঁচকাল সে।
এখানে এসেছে এতক্ষণ,অথচ একবারও ওর বরকে খোঁজ নিতে দেখেনি তো! একটা ফোনও করেনি।
সে ফটাফট জিজ্ঞেস করল,
“ দুলাভাই কেমন আছে, আপু?”
মিথিলার হাত থামে। মুঠোর ছোটো আয়না হতে চোখ তুলল। মুখশ্রীর উজ্জ্বল ভাব বিলীন করে জানাল,
“ ভা,ভালো!”

নূহার খটকা লাগে। মেয়েটার অন্ধকার আদল তার চোখে স্পষ্ট পড়েছে।
অমন সন্দিহান নজরের তোপে মিথিলা বিব্রত হয়! পলাশের কথা সে পরিবার ছাড়া এক্ষুনি কাউকে বলতে চায় না।
বলল অপ্রতিভ গলায়,
“ চলো,যাই।”
চটপট করে উঠতে যেয়ে কনুই ঠুকল দেওয়ালে লাগানো কাঠের তাকে। ওতে দাঁড় করানো মাটির ফুলদানিটা তাকের ওপরেই কাত হয়ে পড়ল।
মিথিলার চোখমুখের জড়োতা দেখে হাসল নূহা। বলল,
“ সমস্যা নেই,তুমি যাও। আমি ঠিক করে রাখছি।”

স্বস্তি পেয়ে চটজলদি হাঁটা ধরল সে। দরজা টেনে খুলল,আর অমনি এসে দাঁড়াল নাহিদ। আশাতীত এই মুখোমুখিতে চমকে উঠল দুজনেই।
নাহিদ বিস্মিত, স্তব্ধ।
সামনে কি সত্যিই মিথিলা দাঁড়িয়ে?
তবে বাকশক্তির এই রুদ্ধতা কাটানোরও সময় মিথিলা নিলো না। নাহিদকে দেখে স্থান-কাল ভুলে গেছে মেয়েটা। খুশিতে মস্তিষ্ক কেমন বেপরোয়া হয়ে পড়ল। সামনে নাহিদ! যাকে ও গত এক মাস ধরে খুঁজছে? আশেপাশে কে আছে,না আছে
সব কিছু চূলোয় তুলেই
হাওয়ার মত এসেই ছেলেটার বুকে ঢুকে গেল মিথিলা। নাহিদ থমকে গেল আরও।
মিথিলা খুশিতে হড়বড়িয়ে উঠল,
“ আমি জানতাম,জানতাম তুমি এখানেই থাকবে। তখন গলা শুনেই বুঝেছি! তোমাকে আমি কত খুঁজেছি জানো? ঢাকা থেকে এখানে এসেছো কেন?”

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৭

নাহিদ কথা বলতে পারল না৷ তবে টের পেলো বিকট শব্দে কিছু একটা আছড়ে পড়েছে মাটিতে। মিথিলার মাথা ছাপিয়ে ওই পাড়ে চাইল সে। মাটির যে ফুলদানিটা কাত হয়ে পড়েছিল তাকে? সেটা টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে আছে এখন। পাশেই শক্ত পিলারের ন্যায় দাঁড়িয়ে নূহা। হরিণী চোখ এদিকেই।
বাল্বের আলোতে মেয়েটার কোটর দুটো কেমন চকচক করছে। নাহিদ নড়তে পারল না। শরীর কেমন পাথর বনে গেছে। তবে প্রশ্ন জাগল মনে,
মিস নূহা কি কাঁদছেন?

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৮ (২)