সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৯

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৯
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

উষ্ণ বাতাবরণ যেমন আচমকা ঝড়ে শীতল হয়ে ওঠে?
জামশেদের একটি ঘোষণা তেমন করে কক্ষের সব পালটে দিলো। পুষ্পিতাকে অপহরণ , তারপর খুন! কী লোমহর্ষক পরিকল্পনা এ!
অথচ আবুলের প্রৌঢ় চেহারা চকচক করে ওঠে। দুই কালচে ঠোঁটের ভাঁজে বিভৎস হাসি। তাহলে এতদিনে একটা দারুণ সুযোগ মুঠোয় আসছে তার?
এই যে তীবে ফ্ল্যাট কিনে মালিকানা একটা মেয়ের নামে দিয়েছে?
খবরটা তো জামশেদকে আবুলই পৌঁছে দিলেন।

মেয়েটা কে! বাবা-মায়ের পরিচয়, কোথায় থাকে সব তার নিজের যোগাড় করা। তীব্রর সঙ্গে যে বেশ ক-মাস ধরে পুষ্পিতার মেলামেশা আছে,শুধু সেটুকু চেপেছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন, ছেলে নিজে তার ফষ্টিনষ্টির কথা স্বীকার করে যাক। এই সুযোগে বাপ-ছেলের একটা তুমুল লড়াই হবে। হচ্ছিলও। কিন্তু জামশেদের নেতিয়ে পড়ায় কিছু আশাহত হন আবুল। যে আশা ফের দপ করে জ্বলে উঠল চোখে।
তীব্রর কথা শুনে তো মনে হলো প্রেমের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। আর সেই প্রেমের বলি চড়াতে,মেয়েটাকে যদি জামশেদ সরিয়ে ফেলতে চান, দুজনের মাঝে কুরুক্ষেত্র বাঁধবে নিশ্চিত।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আর এই যুদ্ধই হবে আবুলের ভ্রম্মাস্ত্র! এক ঢিলে দুই পাখি মারবেন তিনি। তীব্র না থাকলে জামশেদের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করা। আবার জামশেদের ছাঁয়া না থাকলে ওই অসভ্য ছেলেকে একটা উচিত শিক্ষা দেয়া! সেদিন চড় মেরেছিল ওনাকে। ওই চড় আবুল কোনওদিন ভুলবেন না। একটা উপায় শুধু আসুক! চড়টার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেবে ওকে।
আবুলের বক্ষে তখন পৈশাচিক শ্বাস। চেহারায় উদ্বোলিত আনন্দ।

স্ফূর্ত চিত্তে বললেন,
“ ঠিক আছে, স্যার। আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি।”
জামশেদ মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছিলেন। উনি যেতে নিলেই বললেন,
“ না, দাঁড়াও।”
থামলেন ভদ্রলোক। চশমাটা নাক থেকে ওপরে ঠেললেন একটু।
জামশেদ নিজেই বললেন,
“ দরকার নেই। বাদ দাও।”
আচমকা সিদ্ধান্ত বদলে হোচট খেলেন আবুল। অবাক কণ্ঠে বললেন,
“ কেন স্যার? হঠাৎ কী হলো?”

জামশেদ চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে বড়ো আরাম করে বসলেন। চোখেমুখে পাকা রাজনীবিদের ছাপটা স্পষ্ট ফুটে উঠল। বললেন,
“ কিছু হয়নি। আসলে ভেবে দেখলাম,মেয়েটাকে মেরে আমার কোনো লাভ নেই। বরং ক্ষতি!”
আবুল বুঝলেন না। মুখায়বে
কৌতূহল। জামশেদই বললেন
“ যাকে তীব্র এত ভালোবাসে,তাকে সরানোর কাজ যে একমাত্র আমার হবে এটুকু বোঝার মত বুদ্ধি আমার ছেলের আছে। যা বেপরোয়া, একবার চেতে গেলে পুরো গণভবনের সেনা পাঠিয়েও রাখতে পারব কী না সন্দেহ!(কথার কথা লিখলাম। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই) ব্যাপারটায়
অহেতুক সম্পর্ক খারাপ হবে বুঝলে।
আমার একমাত্র বংশের প্রদীপকে চটিয়ে কী লাভ বলো তো, আবুল?”
ভ্রু উঁচালেন ভদ্রলোক।
আবুলের মুখ কালো হয়ে গেল। উদ্বেগ নিয়ে বললেন

“ কিন্তু স্যার, তাই বলে অমন চালচুলোহীন,অনাথ মেয়ে কী না ছোটো স্যারের বউ হবে? আপনার সম্মান কোথায় যাবে তাহলে ভেবেছেন?”
কথার পিঠে শব্দ করে হেসে উঠলেন জামশেদ। মাথা নেড়ে বললেন,
“ তুমি ভীষণ বোকা। আর এজন্যেই তোমার নাম আবুল।”
হাসি আর কথা, দুটোই সূচের মত আবুলের ইগোতে গিয়ে ফুটল। ভেতর ভেতর ফেটে পড়লেন রোষে।
জামশেদ বললেন,

“ আমি তোমার মত করে ভাবছি না বলেই আজকে আমি এই চেয়ারে বসে আছি। আমাদের চিন্তাধারাই আমাদের দুজনের তফাত, আবুল। শোনো,আমি মন্ত্রী। দেশের সবাই আমাকে এক নামে চেনে।
এখন কোনো মন্ত্রী যদি জেনেশুনে একটা অসহায় মেয়েকে নিজের বাড়ির বউ করে, আর খবরটা পুরো দেশের কাছে ছড়িয়ে যায়! তখন ব্যাপারটা কোথায় পৌঁছুবে ভেবে দেখেছ একবার?
পুরো দেশ আমার উদারতায় মুগ্ধ হয়ে আমাকে মাথায় তুলে নাচবে,আবুল। প্রতিটা চ্যানেলের শিরোনাম হবে,
“ অনাথ মেয়েকে বাড়ির বউ বানিয়ে মহত্ত্বের পরিচয় দিলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জামশেদ তালুকদার। চারদিক সরব থাকবে এ নিয়ে। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওরা অন্যকে উদাহরণ দেবে।

পত্রিকার হেডলাইন হব আমি। কেউ কেউ আমার এই উদারতাকে ফেরেশতার সাথে তুলনা টেনে বসবে। এ দেশের মানুষ বড্ড সরল,আবুল। এরা একটা কিছু পেলেই হোলো, একটা ভালো দেখলেই হোলো। তোমার অতীতের সব খারাপ ভুলে যাবে। একেবারে নেচে কুদে আইডল বানিয়ে ফেলবে তোমায়।
আর এটাই হবে আমার মোক্ষম চাল। সরকারের কাছে নিজের গুড ইম্প্রেশান ধরে রাখতে হলে আমাকে নিজের বংশমর্যাদার কথা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে,আবুল। তীব্র যা বলছে তাই মেনে নেব বুঝেছো!
একটু আগে যা বললাম ভুলে যাও ওসব।”

আবুল হতবাক চেয়ে রইলেন। জামশেদকে তিনি যতটা সোজা ভাবেন, এ লোক দেখি ততোধিক ঘোড়েল। কী প্যাঁচাল বুদ্ধি মাথায়!
কিন্তু স্যার, আমিও কিছু কম যাই না। আপনার স্বার্থ সিদ্ধি চেয়ে চেয়ে দেখার মত ধৈর্য আবুলের নেই। একবার যখন মেয়েটাকে নিয়ে ঝামেলা হয়েছে, বহ্নিশিখা জ্বলেছে আপনাদের দুজনের মাঝে! তখন এই শিখায় ফুলকি আবুল তুলবেই।

বাপ-ছেলের এমন টানটান লড়াইটাতো এভাবে মিটতে দেয়া যাবে না।
পুষ্পিতার গায়ে এখন আঁচ লাগলেও তীব্র আপনাকে সন্দেহ করবে।
আর ঠিক সেই চালটাই চালবে আবুল। লোকও ঠিক হবে। মরবেও মেয়েটা। শুধু আপনার আদেশের জায়গায়,আদেশ দেব আমি।
তবে আপনি কিচ্ছু ভাববেন না স্যার,ধরা পড়লে নাম আপনারই হবে। এত বছর ধরে আপনার নুন খাচ্ছি , এটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ না থাকলে হয়?
আবুলের চেহারায় হিংস্রতার আলো। বিস্তর ভাবনার ইতি টানতে ওষ্ঠপুটে ক্রূর হাসি তুললেন ।
জামশেদ টেবিল হতে মুঠোফোন ওঠান। কানে গুঁজতেই তিনি সতর্ক কণ্ঠে শুধান,

“ ইয়ে,ছোটো স্যারকে ফোন করছেন,স্যার?”
“ হ্যাঁ। যেভাবে রেগেমেগে গেল, ডেকে বলি কথাটা। খুশি হবে!”
আবুল শশব্যস্ত বললেন,
“ না না স্যার, ফোন করবেন না।
ছোটো স্যারের এখন মাথা গরম। ফোন ধরবে কী না সন্দেহ! মেজাজটা একটু ঠান্ডা হোক,
তারপর না হয় আস্তেধীরে বললেন?”
জামশেদের ভ্রুয়ের মাঝে রেখার মেলা বসল। তিতিবিরক্ত হয়ে বললেন
“ সব বিষয়ে তোমাকে এত পাকামো করতে কে বলেছে,আবুল? পিএ,পিএর মতো থাকো। আমার ছেলে আর আমার মধ্যে তোমাকে যথেষ্ট ঢুকিয়েছি,ব্যস! এখানেই ক্ষান্ত দাও। এর বেশি এক পাও বেশি ঢোকার চেষ্টা কোরো না।”
আবুল মাথা নোয়ালেন। অন্তরের ক্ষোভ অন্তরেই রইল। সেখানে জেগে উঠল সংশয়। খুব করে চাইলেন,তীব্র ফোন না তুলুক।

জামশেদের কল ততক্ষণে চলে গেছে।
কিন্তু রিসিভ হোলো না। মুখের ওপর জেদের বশে খট করে লাইন কাটল ছেলেটা। ভদ্রলোকের প্রৌঢ় আদলে কিছু হতাশার ছাপ পড়ল। যেই চিহ্ন দেখে আবুল বুঝে ফেললেন ঘটনা। অমনি স্বস্তিতে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলেন এক চোট।

নূহা ঘুম দেখে উঠেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু তখন পুরো ঘর ফাঁকা। মা অফিসে,পুষ্পিতা কলেজে। কিন্তু মিথিলা? মিথিলা কোথায়? ও সারাঘর খুঁজল,পেলো না।
ভাবল,হয়ত ছাদে গিয়েছে। এত মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েটা কোনওরকম হাত-মুখ ধুয়েই কাজে লেগে পড়ল। আয়েশা পইপই করে বলে গেছেন মিথিলার আপ্যায়নে যেন ত্রুটি না থাকে। হালকা ছ্যাকা দেয়া রুটিগুলো টেবিলে রেখে গিয়েছেন তিনি। এখন শুধু তাওয়ায় দিয়ে ভালো করে শেক দিলেই হবে।
নূহা বড়ো থালাটা হাতে তুলতে গেল। তক্ষুনি ঘরে এলো মিথিলা। পা, আর দরজা খোলার শব্দে থামল তরুণী। কৌতূহলে প্রশ্ন করল,
“ কোথায় গিয়েছিলে,আপু?”
রাখঢাকহীন জবাব এলো,
“ নাহিদের কাছে।”

প্রশ্নে ছোটা নূহার চপল চোখ থমকায়। হকচকায় অল্প। শুধু টলল তার শীর্ণ হাত। মুখখানার ফ্যাকাশে দশায় মিথিলার বুক আনন্দে ভরে গেল।
আগ বাড়িয়ে বলল,
“ আসলে কী বলোতো, নাহিদের সাথে আমার দু বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মাঝে বিয়ে টিয়ের চক্করে আলাদা হয়ে গেছিলাম। কিন্তু ছেলেটা এত ভালোবাসে আমায়! বিয়ের পরেও আমার অপেক্ষায় পথ চেয়েছিল।
আমারও তো পলাশের সাথে তালাক হয়ে গেছে। যখন নাহিদকে বললাম কথাটা,খুশিতে সে কী কান্না ওর! খুব অনুনয় করল ওর কাছে ফিরে আসতে। ও নাকি এখনও আমাকেই ভালোবাসে। এতদিন না কি আমার জন্যে অন্য কাউকে জীবনে জড়ানো তো দূর,কারো দিকে ফিরেও দেখেনি।”

শেষ দুটো লাইনে মিথিলার গলার জোর বাড়ল। তারপর চোখের কোণা তুলে দেখল নূহার প্রতিক্রিয়া কী!
সে মেয়ে করুণ দশায় মেতে। রক্তশূন্য মুখবিবরে কোনো সজীবতা নেই। শক্ত করে চেয়ারের হাতলটাকে দুহাতে চেপে আছে। চোখের ভেতর সমুদ্র জাগার ভাব।
কানের পাশে মিথিলার কথাগুলোই শুধু গোল গোল হয়ে ঘুরল। নাহিদ মিথিলার মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে? এত ভালোবাসা মানুষটার!
সেজন্যেই বুঝি ওর ভালোবাসাকে দু পায়ে সানন্দে ঠেলে দিলো? মুখের ওপর পাষণ্ডের ন্যায় ঘোষণা করল ভালো না বাসার কথা! উদাস নূহার কাঁধে হাত রাখল মিথিলা।

“ কী ভাবছো?”
মেয়েটার চটক কাটে। নড়লেও ফিরল না। অক্ষিকূটের জল লুকিয়ে মাথা নাড়ল।
“ কিছু না। নাস্তা দিচ্ছি দাঁড়াও।”
মিথিলা ঠোঁট টিপে হাসল।
আকাশে চাঁদ উঠলে কি লুকিয়ে রাখা যায়? ও তো বেশ জানে নূহার মনের অবস্থা কী। আর এটাই যেন তার আনন্দের অন্যতম কারণ।
মনে মনে বলল,
“ আমার নাহিদের দিকে হাত বাড়ানো? কেমন লাগছে এখন,নূহা? এবার বোঝো মজা! আহারে,
বাচ্চা মেয়েটা! কেন যে মরতে নাহিদকেই ভালো লাগাতে গেল।
এখন প্রতিদিন তোমার সামনে নাহিদের সাথে প্রেম করব,আর তুমি বসে বসে দেখবে।”
তারপর টেনে টেনে বলল,

“ খাবো না বুঝলে। নাহিদটা না খাইয়ে ছাড়ল না। একেবারে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে!”
চকিতে ফিরল নূহা। নিস্তব্ধ আওড়াল,
“ উনি তোমাকে খাইয়ে দিয়েছেন?”
“ হ্যাঁ। এত অবাক হচ্ছো যে? আগেও তো খাইয়ে দিতো। আমরা যখন দেখা করতাম,ও আমার হাতই ছাড়ত না জানো!
সত্যি! ছেলেটা এতদিনে একটুও বদলায়নি।
ওর পাগলামো গুলো দেখলে মাঝেমধ্যে তো আমি খুব বিরক্ত হয়ে যাই।”
নূহার চোখ জ্বলছে। পুড়ে ছারখার তার বুক। কাষ্ঠ হেসে ভাবল,
“ একজন ভালোবাসা পেয়ে বিরক্ত হয়। আর একজন চেয়েও পায় না।”
মিথিলা বলল,

“ আমি একটু বের হব বুঝলে। এখানে না কি জিনিস পত্রের দাম অনেক কম? ভাবছি কিছু কেনাকাটা করি। তুমি যাবে আমার সাথে?”
আনত চিবুকে মাথা নাড়ল নূহা। মিথিলা এক কথায় ঘরে চলে যায়৷ ঠোঁটের ভেতর কুটিল হাসি । ফিরে এলো ব্যাগ হাতে।
“ থাকো হ্যাঁ? আমি যাব আর আসব।”

ও বেরিয়ে গেল৷ কিছুটা তাড়াহুড়ো পায়ে। একটা মিথ্যে বলার,বলেছে। এখন বাইরে গিয়ে সবার আগে নাস্তা করতে হবে। বিয়ের সময় পলাশ দেনমোহর শোধ করেছিল। সেসব মিথিলা নিজের একাউন্টে রেখে দিয়েছে। আপাতত হাত খরচা নিয়ে চিন্তা নেই। সামনেও হবে না। নাহিদ আছে তো!
তার প্রস্থান পথে চেয়ে চেয়ে নূহার দুচোখ জলে ছাপিয়ে যায়। আটকে রাখার ইচ্ছে হলো না। বরং বাধের সাধ খুলে দিলো। অমনি তেড়ে আসা বর্ষার ফোঁটা হয়ে সেসব ছিটকে পড়ল টেবিলে।
সকালের খাবার সামনে নিয়ে কেবল বসল নাহিদ। কিন্তু অন্যমনস্ক চিত্তে খিদের দেখা নেই। এখনও মাথার মধ্যে ছটফটিয়ে ঘুরছে মিথিলার কথা।

আর এখানেই তার সবকিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। মিথিলার বিয়ে ওর বাবা জোর করে দিয়েছিলেন? কিন্তু নাহিদের তো কখনও এমন কিছু মনে হয়নি। যতবার সে মেয়েটার সঙ্গে ফোনে অনুনয়-বিনয় করত, মিথিলা তো প্রতিবার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। নম্বরটা অবধি ব্লক করা ছিল। কারণ একটাই,তার রোজগার ছিল না৷ এখনও নেই৷ কিন্তু তফাত হচ্ছে এখন সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইছে,তখন চায়নি। প্রথম চাকরিটা যাওয়ার পর আবার অনেক জায়গায় সিভি জমা করেছে নাহিদ। কোথাও না কোথাও তো ডাকবে।
কিন্তু তখন? তখন তো মিথিলা পলাশের সাথে তাকে তুলনা করেছিল।
কানাডায় বিলাশবহুল জীবনের জন্যেই তাকে বিয়ে করবে না এসবও বলেছিল। তাহলে আজ হঠাৎ কী শুনছে সে?
কোনটা সত্যি?

মিথিলার ঐ কান্না, না ওর কথা? ও বোকা ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে সত্যি-মিথ্যের তফাত বুঝবে না?
মন তো বলছে মিথিলার কথা মিথ্যে। আর মস্তিষ্ক!
বিভ্রান্ত নাহিদ কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারল না। ফোস করে শ্বাস ফেলে রুটির টুকরো মুখে তুলতে গেল৷ কী মনে করে থামল ফের। চোখের পর্দায় নূহার মলিন মুখটা ভাসতেই তার বুক মোচড় দেয়। আচ্ছা,নূহা কি খেয়েছেন? কাল
রাতেও তো কিছু খেল না৷ অন্তত নাহিদ খেতে দেখেনি। যার জন্মদিনের জন্যে এত কিছু রান্না হোলো একটা দাঁনাও মুখে নেয়নি সে। সকালে খেয়েছেন তো!

ও কি গিয়ে দেখবে একবার? এখন তো ওনার ভার্সিটিতে ভ্যাকেশান চলছে। নিশ্চয়ই বাসায়!
নাহিদ তৎপর উঠে গেল।
দরজা খোলা তখনও। চৌকাঠে এলে ভেতরের ডায়নিং টেবিল দেখা যায়। নূহা সেখানেই বসে। শুধু টেবিলের ওপর থাকা দুহাতের ওপর মাথা ঠেসে রাখা। একটু পরপর পিঠ কাঁপছে।
নাহিদ থমকে দাঁড়াল। নূহা কি কাঁদছেন? কেন,আন্টি কিছু বলেছে? পরপর মনে হলো মায়ের বকুনিতে কেঁদে ভাসানোর মতো মেয়ে নূহা নয়। তাহলে? কোনওভাবে ওর জন্যে নয় তো!
উৎকণ্ঠায় চৌচির হয় ছেলেটা। এক পা বাড়াতে চেয়েও ফিরিয়ে নিলো আবার। বড়ো মায়া নিয়ে ডাকল,
“ নূহা!”

চেনা স্বরে ত্রস্ত মাথা তুলল মেয়েটা। অদূরে দাঁড়িয়ে নাহিদ। প্রসস্থ,লম্বাটে ছেলের মুখে অপার সাঁঝের প্রভা। এই মুখ স্বপ্নে কতবার দেখে দেখে নূহার দিন কেটেছে,কে বুঝবে! বোঝাবেই বা কাকে! তবে প্রেমের তাণ্ডবে তার বুকে ক্ষণিকের কিরণ ছুটে এলো। সেকেন্ড কয়েক কাটল,পরপরই তা নিভে গেল আবার।
নাহিদ এখানে কেন এসেছে? নিশ্চয়ই মিথিলা আপুর জন্যে!
নুহা চোখ মুছল। ওপাশ থেকে হেঁটে এলো হনহন করে। দাঁড়াল মুখোমুখি।
শক্ত কণ্ঠে শুধাল,
“ কী চাই?”

নাহিদ উত্তর দিলো না। তার পূর্ণ চোখ নূহার মুখবিবরে। প্রথম কী না কে জানে! তবে আজকে মেয়েটার শ্যামলা বদন দেখতে বড়ো মনোযোগ দিলো নাহিদ। লালচে,ভেজা চোখ দুটো কী টানা টানা! তেজে ফুঁসে ওঠা চোখা নাক,শুষ্ক ঠোঁট কাঁপছে। আচ্ছা,এই চোখ দেখে দেখে নাহিদ কি একটা কবিতা লিখতে পারবে না?
জীবনানন্দের মত বলতে পারবে না?
“মিস নূহা,আপনার রূপ শ্রাবন্তীর কারুকার্যের মতো। বহুদূর হতে দেখেও কোনও
দক্ষ নাবিক নির্নিমেষ দিশা হারাতে পারবে!”
পরপরই সচেতন হলো নাহিদ। ছি!ছি! এসব কী ভাবছে? নূহা তো ওর বন্ধু। বন্ধুকে নিয়ে এমন নিচু চিন্তা ওর মনে এলোই বা কেন!
তার চুপ থাকা আর চেয়ে থাকা,দুইয়ে মিলে যেন নূহার দুঃখে এক মুঠো ঘি ঢেলে দেয়। স্ফূলিঙ্গের ন্যায় জ্বলে ওঠে ক্রোধ। থমথমে গলায় বলে,

“ মিথিলা আপুকে খুঁজতে এসেছেন,তাই না? আপু নেই। যান এখন।”
নাহিদ নড়ে উঠল। ধ্যান ভাঙল তার। তাজ্জব চোখে বলল,
“ তা কখন বললাম?”
নূহা বলল,
“ বলেননি,আমি বুঝেছি।
নাহলে আপনি আমাদের ঘরে কেন আসবেন? মিথিলা আপু ছাড়া তো এখানে আর আপনার কিছু নেই।”
কথাটায় কী ছিল জানা নেই। কিন্তু নাহিদের বুকে দুম করে লাগল। মনের ভেতর জেগে ওঠা প্রশ্নের পিছু নিয়ে ভাবল,
“ সত্যিই কি আমার এখানে কিছু নেই?”

নাহিদের প্রতিত্তোর না পেয়ে নূহার অন্তঃপট খানখান হয়। মানুষটা তাহলে সত্যিই মিথিলার খোঁজে এসছে? তার রাগের বশে উগড়ে দেয়া কথাটাও কী আরামসে মেনে নিলো!
ভালো না বাসুক,বন্ধুত্বের খাতিরেও কি বলতে পারতো না,
“ কে বলেছে আমার এখানে কিছু নেই? এই যে আপনি আছেন,নূহা। আমার বন্ধু!”
নূহার কান্নার ঢেউ আবার ধেয়ে এলো।
ফ্যাসফ্যাসে চিত্ত হতে মুক্তি চাই তার। কিন্তু নাহিদ সামনে থাকলে আদৌ কি সম্ভব ওসব?
বোজা স্বরে অতীষ্ঠতার সুর টানল সে।
বিরক্ত গলায় বলল,

“ আপনি প্লিজ এখন আসুন। আপনাকে আমার সহ্য হয় না!”
ঘোষণা দিয়ে মুখের ওপর ধড়াম করে দরজা চাপায় নূহা। নাহিদের কণ্ঠ বিহ্বলতায় রোধ হয়ে পড়ল।
পোড়া-মরণ শ্বাস ঠিকড়ে এলো বুকে। মিথিলার বিয়েতে কি এমন কষ্ট হয়েছিল? না কি এর চেয়েও বেশি! নাহিদ হিসেব মেলাতে পারল না। শুধু বুঝল,
নূহার অবজ্ঞা দেখার মতো যন্ত্রণা তার জন্যে পৃথিবীতে নেই।

মাথার ওপর জেদি সূর্য আড়াআড়ি বসেছে। বাতাসে কেমন খরখরে ভাব। পুষ্পিতা মুখ কালো করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। তীব্র কলেজে আসেনি।
আর এখন স্যার না এলে সব কিছু বিবর্ণ লাগে তার। কত কষ্টে ক্লাসে মন টিকিয়ে রেখেছিল!
পুষ্পিতা হাঁটতে হাঁটতে তীব্রর নম্বরে ডায়াল করল।

সে মানুষ ড্রাইভিং-এ তখন। বাবার সাথে একটা শক্ত লড়াইয়ের পর ক্ষিপ্ত মেজাজ তুঙ্গে। এই সময় মুঠোফোনের শব্দটা সেথায় কেরোসিন ঢালার মতো। বড্ড বিরক্ত হলো তীব্র। পাশের সিটেই রাখা ফোন।
ও কপাল কুঁচকে চায়। দৃষ্টিতে অনীহা। অথচ স্ক্রিনের সেভ করা নম্বরটা সেই অনীহা ভাসিয়ে নিলো দূরে।
ফোন তুলল তীব্র। কল কেটে ব্যাক করল। তুখোড় রাগ এক লহমায় চাপা দিয়ে,
খুব শান্ত গলায় বলল,
“ বলো!”
পুষ্পিতা মন খারাপ করে বলল,
“ আপনি কলেজ এলেন না কেন, স্যার?”
প্রশ্ন নয়,তীব্রর ক্ষুব্ধতার অনলে এ এক পশলা মাখা বৃষ্টি। মুহুর্তেই কঠিন চিবুক শিথিল হলো তার। শুধাল,

“ মিস করেছো?”
মেয়েটার আর্দ্র জবাব,
“ হুম্ম!”
সারাদিন পর হাসল তীব্র।
জানাল,
“ কাছাকাছিই আছি। আর কিছুক্ষণ লাগবে।”
“ তাড়াতাড়ি আসবেন।”
“ কেন? তাড়াতাড়ি এলে সেদিনকার ধারটা কি আজ ফ্রিতে দেবে?”
পুষ্পিতা আইঢাই করে ওঠে। অসহ্য আওড়ায়,
“ উফ, আবার!”

মেয়েটা রাস্তার এক পাশ ধরে হাঁটছিল। পূর্ণ মনোযোগ মুঠোফোনে। প্রিয় পুরুষের সাথে কত কথা তার! কড়া রোদটা অবধি সেই আলাপ তোড়ে প্রতাপ দেখাতে ব্যর্থ।
ঠিক সেসময় সজোরে একটা মাইক্রো ব্রেক কষল পাশে। পুষ্পিতা হকচকায়। বুকটা কেমন ছ্যাত করে ওঠে। শীর্ণ হাত থেকে খসে পড়ে ফোন। খট করে লাইন কেটে গেল। তীব্রর কথা থামে। অবাক হয়। কথার মধ্যে ভীতু মেয়ে লাইন কাটবে কেন?
সে ত্রস্ত কল দিলো। কিন্তু মেয়েলি রিনরিনে স্বর ছুটে এসে জানাল,
“ নম্বর সুইচ অফ!”

তীব্র অস্থির হয়ে পড়ল। সাথে বাড়িয়ে দিলো ড্রাইভিং-এর গতি।
তার ভেতরটায় অশনী সংকেত বাজনা ছুটিয়েছে। মনে হচ্ছে সামনে কিছু একটা হবে। যার ক্ষমতা আচমকা জাগা সুনামির থেকেও ভয়ানক। যা এক ধাক্কায় লণ্ডভণ্ড করে দেবে তার জীবনের সমস্ত সুখ।

গাড়ির ভেতর হতে দুজন মুখোশধারী লোক লাফিয়ে নামায় পুষ্পিতার মস্তিষ্ক রুদ্ধ হয়ে যায়। চ্যাঁচাবে,পালাবে? কিন্তু বিবশ চিত্তে মেয়েটা নড়তেই পারল না। একজন তার হাত চেপে ধরল। অন্যজনের হাতে ক্লোরোফোমে মাখা রুমাল।
পুষ্পিতার শ্বাস থেমে যায় আসন্ন দশা ভেবে। রুমাল হাতের লোকটি যখনই হামলে আসবে,সম্মুখ হতে তেড়ে আসা প্রকাণ্ড লাথিতে ছিটকে পড়লেন দূরে। ভীতসন্ত্রস্ত পুষ্পিতা চকিতে পেছন ফিরল। ফরসা মুখের আগন্তুক তার দৃষ্টির তোয়াক্কা করেনি। অন্য লোকটাকেও প্রহার করল সহসা। দুজনেই পিচের বুকে লুটিয়ে থাকে। ঘাবড়ে যায়। পালটা আঘাতের সাহস না করে ত্রস্ত গাড়িতে উঠে বসে। তাদের ওপর দায়িত্ব কেবল পুষ্পিতাকে তুলে নিয়ে যাওয়া।
সাই সাই ছোটা গাড়ির পিছে দু পা দৌড়েও থামল আগন্তুক।

পুষ্পিতা ত্রাসে জবুথবু। পরপর ঘটা ঘটনায় স্নায়ুরাও বিকল হয়ে আছে।
আগন্তুক মাটি হতে তার কাঁধের ব্যাগ তুলল। ধুলো ঝেড়েঝুড়ে এগিয়ে দিলো সামনে,
“ নাও।”
পুষ্পিতা বিস্মিত। ব্যাগটা ধরল বিভ্রমে ভুগে। লোকটাকে ও আগে কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ে না। অথচ তুমি করে বলছে! তারপর আশপাশ চেয়ে ফোন খুঁজল সে। মানুষটা শুধালেন,
“ কী খুঁজছো?”
পুষ্পিতা ছোটো কণ্ঠে বলে,
“ না মানে আমার ফোনটা….

আগন্তুক নিজেও খোঁজে। এক কোণায় ঘাসের ওপর পড়ে আছে সেটা৷ গিয়ে তুলে আনল। বাটন ফোন খুলে তিন ভাগ হয়ে গেছে। মানুষটা নিজ দায়িত্বে ব্যাটারি সহ ব্যাকপার্ট আটকে সব ঠিকঠাক করে দিলো। বিজয়ের শ্বাস নিয়ে বলল,
“ নাও,হয়ে গেছে। ফরচুনেটলি ডিসপ্লে ভাঙেনি।
পুষ্পিতার অবস্থা দুরূহ! অচেনা-অজানা মানুষ এমন ভাবে কথা বলছে যেন বহুদিনের চেনা। প্রশ্নখানা সে মনে চেপে রাখতে পারে না। বলেই ফেলল
“ আপনি কি আমাকে চেনেন?”
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো সে,

“ হ্যাঁ, চিনব না কেন? তুমি পুষ্পিতা, তাই তো?”
মেয়েটার কণ্ঠ শৃঙ্গে,
“ আপনি কী করে জানলেন?”
সে মানুষ চমৎকার করে হাসল। গর্বের সাথে জানাল,
“ আমি শাফিন, তীব্রর বন্ধু। তোমাকে সেদিন ভুল করে আমিই তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
পুষ্পিতা চমকে বলল,
“ কী?”
হাঁ করে আগাগোড়া মানুষটাকে দেখল সে। শাফিনের চেহারা হাস্যোজ্জল। বেশ লম্বা!
কিন্তু তীব্রর বন্ধুদের তো ও চেনে। কই, একে তো কখনও দেখেনি। শাফিন বোধ হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারল । নিজেই বলল,

“ আমি ঢাকায় থাকি। চাকরি রেখে আসা হয় না এখানে। তবে এবার বেশ কদিনের ছুটি নিয়ে এলাম। বন্ধুদের ছাড়া ওখানে একা একা একদম মন টেকে না।”
পুষ্পিতার সব উত্তর মিলল। কিন্তু শাফিনকে ছাপিয়ে তার নিবেশন ঘুরে গেল ফোনের দিকে। তীব্র তো লাইনে ছিল। কিছু কি শুনেছেন?
শাফিন জিজ্ঞেস করল তখনই,

“ আচ্ছা,ওরা কারা ছিল? চেনো তুমি?”
পুষ্পিতা শুকনো মুখে মাথা নাড়ল। ভয় এখনও কাটেনি।
শাফিন বুঝে নেয়। ফোস করে শ্বাস ফেলে বলে,
“ আচ্ছা, ছাড়ো। গন্তব্য যখন এক,চলো একসাথে যাই।”
হাত তুলে চার চাকার ভ্যান ডাকল সে। আগে নিজে বসে বলল,
“ এসো।”
ভ্যান দেখে স্বস্তিই পেলো পুষ্পিতা। গুছিয়ে বসল এক পাশে। এখনও তার মাথার ভেতর একই প্রশ্ন ছুটছে,
“ লোকগুলো কারা? ওকেই বা ধরতে এসেছিল কেন?”
তীব্র গাড়িতে নয়, দুটো ডানা পিঠে বসিয়ে উড়ে এসেছে যেন। জোরালো চাকার গতিতে,

পুষ্পিতার ফোন বন্ধ পাওয়ায় আধঘন্টার রাস্তার ইতি টেনেছে,মিনিট পনের’র মাথায়। গাজীপুরে ঢোকার পরই ওদের কলেজ। সেখানটা ফাঁকা দেখে তীব্র জিপ ছুটিয়ে বাড়ির দিকে এলো।
পুষ্পিতারা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে।
শাফিন ভাড়া মেটাল ভ্যানের। এক পল আড়চোখে দেখল মেয়েটাকে। রক্তশূন্য চিবুক গলায় ঢুকেছে তার। আহারে, ভয় পেয়েছে খুব!
পুষ্পিতাকে সহজ করতে কথা খুঁজল ও। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ আমি এখন মিরাজদের বাসায় যাব বুঝলে! তীব্র তো বোধ হয় বাড়িতে নেই। তুমি যাও! আর এসব নিয়ে একদম চিন্তা কোরো না। আমরা তো সবাই আছি তোমার সাথে।”
শাফিনের এত কথায়ও,অভয় পেলো না পুষ্পিতা। মনের ভয়ডর তার মনেই জেঁকে রইল। অথচ সেই একদিন,
তীব্র সামান্য ‘ আমি আছি ‘’

বলাতেই একটা ছেলেকে ও চড় মেরে দিলো! কেন? তখনও তো ও মানুষটাকে ভালোবাসেনি। তাদের ভেতর আহামরি সম্পর্কও ছিল না। অথচ তীব্রর একটা কথা ভীতু পুষ্পিতাকে এক মুহুর্তের জন্যে কেমন সাহসী বানিয়েছিল!
ভাবতে গিয়েই পুষ্পিতা অনুভব করল,ব্রক্ষ্মাণ্ডের বুকে একটা শূন্যের ন্যায় একা দাঁড়িয়ে সে। রাস্তায় এত মানুষ, পাশে শাফিন এসবেও তার কিচ্ছু যায় এলো না।
চারপাশে আশ্চর্য এক খরখরে শূন্যতা!
যে শূন্যতায় তীব্র পাশে নেই।

পুষ্পিতার মনে হলো একটা রিক্ত-শুষ্ক মরুভূমির মাঠে ছুটছে সে। জলের হাহাকারে বুক মেতেছে।
তৃষ্ণার তোপে গলা ফেটেছে। কিন্তু সুরাহার ফল হিসেবে তীব্রর দেখা মিলছে না।
ঠিক তক্ষুনি পরিচিত ঐ লাল জিপটা কোত্থেকে ছুটে এসে থামল। সিট হতে হাওয়ার মতো নেমে এলো তীব্র। পুষ্পিতার ব্যগ্র দৃষ্টি বর্তায় সে পথে।
প্রখর শুকনো গলায় এ যেন বরিষার ঝুমঝুম আগমন। মেয়েটার নির্জীব চোখ এক লহমায় পালটে সজীবতা এলো। তীব্র সামনে এসে থামে। বক্ষপটে শ্বাসের গতি জোরালো।
খসখসে হাতে পুষ্পিতার গাল ছুঁয়ে বলল,
“ কী হয়েছে তোমার? ওভাবে ফোন কাটলে কেন?”

মেয়েটা জবাব দিলো না। গালের ওপর তীব্রর হাতটা ছুঁলো বড়ো আলতো করে। এক্ষুনি যে শূন্যতায় হাহুতাশ ছিল বুকে? তড়িৎ মিটে গেছে তা। ভালোবাসার এত জোর? এত ক্ষমতা!
চোখ ছলছল করে উঠল পুষ্পিতার।
তীব্র আরো উদ্বীগ্ন হয়ে পড়ে। কিছু বলতে যাবে হঠাৎ চোখ পড়ল পুষ্পিতার পেছনে।
অমনি হাসল শাফিন।
উৎফুল্লচিত্তে শুধাল,
“ কেমন আছিস?”
তীব্র অবাক হয়ে বলল,
“ তুই এখানে? আসবি বলিসনি তো।”

“ সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দ্যাখ,এখানে এসে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেছি। আচ্ছা, ওকে একা ছাড়িস কেন তুই? এখানে এসেছে বেশিদিন তো হয়নি। গাজীপুর কেমন জায়গা তুই জানিস না? আমি সময় মতো না এলে আজ কী হোতো জানিস?”
তীব্র বুঝতে না পেরে বলল,
“ কেন,কী হয়েছে?”
শাফিন সবটা সবিস্তারিত বলল। তীব্র বিস্মিত,স্তব্ধ।
ঠোঁট ফাঁকা করে চাইল পুষ্পিতার পানে। নজরের অর্থ হয়ত বুঝে নিলো মেয়েটা। বলল মিহি গলায়,
“ আমি ঠিক আছি এখন। উনি আসায় ওরা কিছু করতে পারেনি।”
কিন্তু তীব্রর চিবুকের ধার অচিরেই কেমন কঠিন হয়ে যায়। চোখের ভেতর সদর্পে জ্বলে ওঠে শিখা। দুজন লোক পুষ্পিতাকে তুলে নিতে চেয়েছিল।
এসব তো এমনি এমনি হবে না।

এই কাজ কার? কে লোক পাঠিয়েছিল? তার মাথার মধ্যে জেগে ওঠে বাবার নাম। পরপরই তা নাকচ করল তীব্র। এতটা বোকা জামশেদ নন। ভীতু মেয়েকে নিয়ে মাত্রই যে লড়াই শুরু হলো সেখানে সেই মেয়েকে আঘাত মানে তীব্রর সন্দেহের তির যে ওনার দিকেই যাবে,সেটুকু বোঝার মত অভিজ্ঞতা মন্ত্রীর আছে। তাহলে?
ওই কক্ষে আর একজন ছিল। আবুল! তীব্রর মন বলল, তীক্ষ্ণতা বলল এসব ওই বুড়ো কুলাঙ্গারটার কাজ। সে
দাঁত খিঁচড়ে নীরব ছক সাজাল মাথায়। যাতে স্পষ্ট লেখা,
‘’ আবুল, দূর্ভোগের জন্য তৈরি থাকিস।”

তীব্রর ভাবনা কাটলো পুষ্পিতার আওয়াজে। এতক্ষণে সহজ হয়েছে মেয়েটা। বিস্তর পথের পরেও,তীব্রর এইটুকু সান্নিধ্যেই স্বস্তি ফিরেছে বুকে।
বড় বিনয়ী গলায় বলল,

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৮ (২)

“ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, ভাইয়া! আপনি ছিলেন বলেই হয়তো আজ বেঁচে গেছি!”
উত্তরে দারুণ ভঙ্গিতে হাসলো শাফিন। কিন্তু তার তীক্ষ্ণ নজর পড়ে রইল, তীব্র হাতের ওপর। যেটা পুষ্পিতার পিঠ ছড়িয়ে পেলব বাহু আকড়ে বসেছে।

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৪৯ (২)