সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৭ (২)
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পুষ্পিতার প্রশ্নের সাথে বুকে জমা উৎকণ্ঠারাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নিস্তব্ধ ঘরের দেওয়ালগুলোয় প্রতিধ্বনি পেলো দম ফুরানোর রব।
কিন্তু উত্তর? তার উত্তর আসেনি। সটান বুকে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক একইরকম নিশ্চুপ, নীরব,নির্লিপ্ত।
যার নিশ্চল নয়নের নির্নিমেষ চাউনীতে পুষ্পিতার ব্রক্ষ্মাণ্ড গুলিয়ে যায়। কাঠ হওয়া কণ্ঠনালিতে চাপ পড়ে কিছুর। অশান্ত সমুদ্রে বহুদূর থেকে তেড়ে আসা ঢেউটা যেমন হয়? অমন সাই সাই বেগে কিছু একটা এসেই,পুষ্পিতার গলা চেপে ধরল। তুফান নামল শ্বাসের বহরে।
হয়ত কান্না,নয়ত ভয়! কোনটা?
পুষ্পিতা হিসেব মেলাতে পারল না। খরখরে ঠোঁটদুটো জ্বিভে চুবিয়ে সাহারা খুঁজল বাঁচার। গায়ে জড়ানো পুরু কাঁথাটা বুকের সাথে দৃঢ় করল আরো।
বড্ড সাহস যুগিয়ে তীব্রর চোখের দিকে চাইল সে। মানুষটা নড়ল এতক্ষণে। দু পা ফেলে খাটের ঘনিষ্ঠে এসে থামল। চওড়া কাঠে এলিয়ে রাখল পিঠ। শক্তপোক্ত বাম পা একটু ভাঁজ করে, হাত গুঁজল বুকে।
অথচ চোখ? ওরা তেমনই অনড়,অমনই অচল। সামনের তরুণী হতে যারা এক দণ্ডও সরে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করল না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কী দেখছে এত? পুষ্পিতার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। রন্ধ্র,শিরায় সবেতে যেন তুষার ধ্বসের যোগাড়। এই অনুভূতি পুরোনো। প্রেমের শুরুতে তীব্র তাকালেই, ঠিক এভাবে তার গতর জমে যেত। কিন্তু সেই দৃষ্টির সাথে আজকের তো কোনো মিল নেই। আজকের এই তাকানোর ধরণ ভিন্ন,আলাদা।
এর কোনো ভাষা নেই,ব্যাখ্যা নেই। একটা মৃত লাশের চোখ খোলা থাকলে দেখতে যেমন লাগে? ঠিক যেন তাই।
মেয়েটার অস্বস্তি হলো এবার। নার্ভাসনেসে ডুবে গেল সব। জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
“ এভাবে কী দেখছেন?”
তীব্রর পাথুরে মুখায়বের বদল নেই। নিষ্প্রভ চেয়ে রইল সে। ঠোঁট নেড়ে বলল,
“ দেখছি,ছলনাময়ীরা দেখতে কত নিষ্পাপ হয়!”
চোখ নামিয়ে ঢোক গিলল পুষ্পিতা। কানে বাজল পরের কথা,
“ আমার গায়ের চামড়া ছিলে নিলেও এতটা যন্ত্রনা পেতাম না,যতটা তোর ছলনায় পেলাম।”
তীব্রর কণ্ঠ গাঢ়। যেন বহুকাল বৃষ্টির তোপে স্যাঁতস্যাঁতে হওয়া পথ।
পুষ্পিতা নিরুত্তর। কপালটাকে বুকের খাঁজে ঢুকিয়ে রাখার প্রয়াস।
তীব্র হেসে ফেলল। তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর বিদ্রুপের হাসি। চড়া কণ্ঠে বিস্ময় এনে বলল,
“ জীবনে অনেক প্রতারক দেখেছি। অনেক বিশ্বাসঘাতকতার গল্পও শুনেছি। কিন্তু সরলতার নাটক করে, ভালোবাসার অভিনয় করে এইভাবে মানুষ ঠকাতে দেখিনি। তোর কাছে আমার কত কৃতজ্ঞতা বল তো!”
পুষ্পিতা আনত। মিহি কণ্ঠে বলল,
“ আমাকে অপমান করতে এসেছেন?”
“ তোর মতো ধড়িবাজ মেয়েকে অপমান করার রুচি আমার নেই।
আমি শুধু জানতে চাই…
পুষ্পিতা মাঝপথেই থামাল। নিচু কণ্ঠটা দৃঢ় করে বলল,
“ কী জানতে চাইবেন?
আপনাকে বিয়ে করিনি কেন?
সেটা আমার নিজস্ব ব্যাপার, আমার নিজের ব্যাপার!”
তীব্রর আর শান্ত থাকা হোলো না। তেড়ে গিয়েই বসে থাকা পুষ্পিতার গাল চেপে ধরল। আশ্চর্য হলেও সত্যি,মেয়েটার চেহারায় চমক দেখা গেল না। যেন বিন্দুমাত্র অবাকও হয়নি সে। চোখে সাবলীলতার তুখোড় ঝরে,প্রখর সহজের ছাপ।
তীব্রর খসখসে আঙুল ডেবে বসেছে কোমল গালে। ছোঁয়ার ধাঁচে অন্তরের সমস্ত ক্ষোভ ছিটকে পড়ার ভাব। কী শক্ত সেই প্রহার!
কিন্তু পুষ্পিতার মাঝে ব্যথা পাওয়ার চিহ্ন মাত্র নেই। তার মৃগনয়নে মরু জেগেছে! কার্নিশ ডুবেছে জলে। অমন করেই
অপলক চেয়ে রইল মেয়েটা। সেকেন্ড খানেকে তীব্রর শুভ্র মুখে ঘুরিয়ে আনল নজর।
এত মায়াময় দৃষ্টিজোড়া সে পুরুষ আরামসে এড়িয়ে গেল। ক্রোধে গণগণ করছে তার গলার স্বর। দাঁত খিচে বলল,
“ ব্লাডি চিটার!
তোর নিজের ব্যাপার তাই না? আমার গোটা লাইফটা হ্যেল করে দিয়ে এখন নিজস্ব ব্যাপার মা**চ্ছিস?
অবশ্য তোর মতো মেয়ের কাছ থেকে এসবই আশা করা যায়।
সবসময় একটা ভিক্টিম রোল প্লে করে রাখতি,আর ভেতরটা? ভেতরটা তোর ততটাই নোংরা! ততটাই কুৎসিত! লোক ঠকানোয় তুই এত সাংঘাতিক খেলোয়ার, যে তীব্র রেজা তালুকদার অবধি তোর ভোলাভালা মুখ দেখে ভড়কে গেছিল!”
এত গুলো কথার পিঠে পুষ্পিতা উদাস,উন্মনা। একইরকম নিশ্চুপ,নিষ্পৃহ। অত্যাশ্চর্যে মোড়া জড়ের ন্যায় ঠায় বসে রইল সে।
তীব্র ঝাড়া মেরে গাল ছাড়ল। সরিয়ে আনল হাত।
মেঝেতে চেয়ে শ্বাস টানল জোরে। কঠিন অথচ আর্দ্র স্বরে বলল,
“ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম,অথচ প্রেমিকার স্বপ্নের কোথাও আমি ছিলাম না। যার মনের মতো হতে চেয়েছিলাম,তার মনটাই পাইনি। আমার মুখে তো থুথু ছুড়ে মারা উচিত, তাই না?”
পুষ্পিতা ফের ঢোক গিলল। কণ্ঠে অনমনীয়তা,
“ আশা করি আপনার বলা শেষ হয়েছে। এবার আপনি আসতে পারেন।”
তীব্র চোখের ভেতর বারুদ জ্বলে উঠল। দাঁত পিষে হাত তুলল মারতে। কিন্তু পারল না! যাকে ভালোবাসে,তাকে আঘাত করা যায়? তীব্র হাত নামিয়ে আনে। শিলার ন্যায় রুঢ় গলায় বলে,
“ ভেবেছিলাম যেদিন তোকে সামনে পাব,সেদিন আমার জীবনে আমার হাতের প্রথম খুনটা তুই-ই হবি। কিন্তু…”
পরেরটুকু তীব্র আর বলল না। বিরতি নেয়ার সাথে পেছন ঘুরে গেল। ভেঙে আসা বুকে স্পর্ধা যোগাতে, দেখল এদিক-সেদিক।
সেই পুরোটা সময় চওড়া পিঠের পানে চেয়ে রইল পুষ্পিতা। ফ্যালফ্যালে চোখের কোণে এক পশলা ধারা।
তীব্র ঘুরে চাইতেই,চট করে চিবুক নামিয়ে নিলো ফের।
তীব্রর কণ্ঠস্বরে এবার আমূল বদল এলো। আগের থেকেও রুক্ষতার পাহাড় নিয়ে বলল,
“ তুই কী ভেবেছিলি,আমাকে ছেড়ে এলে আমি মরে যাব?
এত সস্তা আমার জীবন? তুই এখানে সংসার পাতিয়েছিস আর আমি ওখানে তোর শোকে নেশা করে পড়ে থাকব তাই না? আমি তীব্র! তীব্র রেজা তালুকদার। কারো শোকে মরার মতো দূর্বল নই।
খুব ভালো আছি আমি। আর ভবিষ্যতেও আরো বেশি ভালো থাকব।”
পুষ্পিতা নীরস হেসে বলল,
“ আমিও তো সেটাই চাই। আপনি ভালো থাকুন,খুব ভা…”
তীব্র হুঙ্কার ছুড়ল মাঝপথে,
“ চোপ! একদম চোপ। তোর এসব ন্যাকামি দেখতে চাই না আমি।”
একটু থেমে বলল,
“ তখন যে ছেলেটা বেরিয়ে গেল, ওটাই তোর বর?”
পুষ্পিতা হ্যাঁ -না বলল না। নিস্পন্দ মেয়েটাকে দেখে হাসল তীব্র। ভেজা গলায় বলল,
“ লজ্জা করে না তোর? দিনের পর দিন আমার বুকে মাথা রেখে,
মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কথা বলে, এখন অন্য পুরুষের সাথে সংসার করছিস!
মনের মধ্যে এত প্রবঞ্চনা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে?
শালা সব দোষ আমার, যে একটা মরিচীকার পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজের জীবনটাকেই শেষ করে দিলাম।”
পুষ্পিতার জবাব নেই। শুধু
চোখ থেকে এক ফোঁটা উষ্ণ জল কব্জিতে এসে পড়ল।
তীব্র কি তা দেখেছে? দেখেনি। সে বলেই গেল,
“ কী ভেবেছিস, নিজে বিয়ে করে সুখে থাকবি,আর আমি পচে মরব? রূপের খুব দেমাগ তোর,তাই না? চ্যালেঞ্জ করলাম,
আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তোর থেকে হাজার গুণ সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করব আমি। আর তা যদি নাহয়, আমার নামও তীব্র রেজা তালুকদার না!”
পুষ্পিতা বুকের হাহাকারটা মুখের উচ্ছ্বলতায় বদলে দিয়ে বলল,
“ শুভকামনা! আপনার নতুন জীবন সুখের হোক।”
এতবার,এতভাবে বাধ সাধা সত্ত্বেও বেহায়ার ন্যায় নয়ন তারায় সমুদ্র জাগল তার।
গালে পড়ার আগেই পুষ্পিতা বাম হাত তুলে চোখ মুছে নেয়।
মাথা তুলতেই দেখল তীব্র চেয়ে আছে। একটু আগের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেরত এসেছে হঠাৎ। কপালের মাঝে অল্প রেখার মেলা। তীব্র কিছু বলল না। থম ধরা নদীর ন্যায় আচমকা কেমন চুপ করে গেল। অদ্ভুতুরে হাঁসফাঁসে ভাব করে মুখ ফিরিয়ে রওনা করল বের হতে।
অমনি সালমা মুখোমুখি পড়লেন। চৌকাঠেই দাঁড়িয়ে তিনি। চোখের রাজ্যে এক আকাশ বিস্ময়।
ভীষণ তাজ্জব বনে বললেন,
“ তুমি এখানে কী করে এলে?”
প্রশ্ন শুনেও তীব্রর কদম থামল না। যেতে যেতে ছুড়ে দিলো,
“ লোকেশন ট্র্যাক করে।”
ছেলেটা চলে গেছে। কিন্তু হাঁ করে চেয়ে রইলেন সালমা। ব্যাপারখানা এখনও মাথার ওপর ঘুরছে। লোকেশন ট্র্যাক করে কীভাবে এলো?
তাতে তো ফোন নম্বর চাই।
কিন্তু ওনার সিম তো নতুন। তীব্রর তো সেটা জানার কথা নয়। আর সবথেকে বড়ো কথা, ছেলেটাকে না শেষ নূহার বিয়েতে দেখলেন? কার ফোন নম্বর ট্র্যাক করল তবে!
ভদ্রমহিলার কেন যেন রাহাতের কথাই মাথায় এলো। ছেলেটা যখন এসে বলল আয়েশা কাঁদছেন,এক ছুটে ওয়াশরুমের পথে ছুটেছিলেন তিনি।
আয়েশা তখন বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে মুখে জল দিচ্ছিলেন। সালমা পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। পিঠে হাত রাখতেই ফিরে চাইলেন প্রৌঢ়া।
“ কী আপা, কিছু বলবেন?”
“ আপনি ঠিক আছেন?”
“ হ্যাঁ। কেন বলুন তো!”
সালমা কথা খুঁজলেন। আয়েশার চেহারায় থাকা জল থেকে চোখের জল আলাদা করা দুষ্কর। রয়েসয়ে বললেন,
“ না আসলে,একমাত্র মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন তো! এরকম দিন একদিন আমিও পার করে এসেছিলাম, তাই আর কী ভাবলাম…’’
আয়েশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ কী আর করার বলুন! এই
জগত তো একটা নিয়ম বেঁধে দিয়েই খালাশ। ভোগান্তি যা হয় সেতো আমাদের বাবা মায়ের। নিজের
নাড়ি ছেড়া ধন সারাজীবনের মতো পর করে দেয়া যে কত কঠিন! যার যায় সেই বোঝে। ছাড়ুন ওসব। বিয়ে পড়ানো শুরু হোলো,চলুন যাই।”
সালমা মাথা নাড়লেন ঠিকই, কিন্তু খটকা জাগল মনে। আয়েশার কথার স্বর একদম স্বাভাবিক। কাঁদলে তো এমন থাকার কথা নয়! তাহলে যে রাহাত বলল…
দোনামনা নিয়ে ফিরে এলেন সালমা। অদূর হতে চোখ পড়ল কাঁধব্যাগের চেইন আটকাচ্ছে রাহাত। ত্রস্ত ছুটে গেলেন তিনি। টান মেরে ব্যাগ নিলেন হাতে। চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“ কী করছিস? ব্যাগে হাত দিয়েছিস কেন?”
ছেলেটা হকচকাল। ভয় পেলো একটু। তুঁতলে বলল,
“ ক কিছু না,কিছু না। চেইন,ন খোলা ছিল আটকে দিলাম।”
বিষয়টা নিয়ে সালমা তেমন ঘাটেননি । কিন্তু এখন যেন কানায় কানায় হিসেব মিলে গেল। রাহাত কি ফোন নিয়ে তীব্রকে দিয়েছিল? পুষ্পিতার না ওনার? কার নম্বর ট্র্যাক করে ছেলেটা এলো এখানে?
সালমা সব আউলে ফেললেন। তীব্রর প্রস্থান দেখে মূক নয়ন ফেরত আনলেন তারপর। বুকের ভেতর একটা সূক্ষ্ম ব্যথা কিলবিল করে উঠল।
সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৭
পুষ্পিতা বসা থেকে শুয়েছে। ওপাশ ফিরে মাথার বালিশটা এনে আকড়ে ধরেছে বুকে। সহসা,
বন্ধ চোখের ভাঁজ গলে একটা উষ্ণ জলের স্রোত গড়িয়ে কান অবধি এলো।
সব মিলিয়ে সুচ ফোটানোর ব্যথা জাগল মনে।
এই ব্যথার যন্ত্রণা ভয়ানক,ভীতিকর !
যার যাতনায় পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষ রেখে কেবল নির্দিষ্ট ঐ একজনের জন্যেই হৃদয় পুড়ে যায়।